তোমাতেই পরিপূর্ণ পর্ব-০৮

0
558

#তোমাতেই_পরিপূর্ণ
লেখিকা-জান্নাতুল ফারিয়া প্রত্যাশা
৮.
পড়ার টেবলি বসে বইয়ের দিকে তাকিয়ে আছে মিথি। যদিও পড়ায় তার বিন্দুমাত্র মন নেই, তাও চেষ্টা করছে আরকি যদি একটু মনকে ধরে বেঁধে এনে এই টেবিলে বসানো যায়। রসায়ন বইয়ের ভয়ানক সব বিক্রিয়াগুলো দেখলে মনে হয় বিক্রিয়াগুলো যৌগে যৌগে হচ্ছে না, হচ্ছে তার মাথার ভিতর। ইশ, কি বিদঘুটে এই বিক্রিয়াগুলো! আর জৈব রসায়ন, এর কথা না বললেও চলে। এই চ্যাপ্টার পড়তে গেলে খালি মাথা না সমস্ত শরীরে বিক্রিয়া শুরু হয়ে যাবে। মিথি বিরক্ত হয়ে রসায়ন বইটা বন্ধ করে দিল। হাতে নিল বাংলা বইটা। এই বইয়ের একটা গল্প ভীষণ প্রিয় তার। ‘অপরিচিতা’ যতবার পড়ে ততবারই সে মুগ্ধ হয়। আহা, কি প্রেম! কি ভালোবাসা! ইশ, অনুপমের কল্যাণীর প্রতি কি নিদারুণ ভালোবাসা। যদি একবার নৈরিথও তাকে এইভাবে ভালোবাসতো। তবে সেও বলতো, ‘হ্যাঁ, জায়াগা আছে তবে ট্রেনের ভেতর নয় তার মনের ভেতর।’ মিথি মুচকি হেসে আবারও গল্পটা পড়ল। দীর্ঘশ্বাস ফেলে বইটা বন্ধ করলো। ঠোঁটের কোণে হাসির রেশটা রয়ে গেছে এখনও। কিছু ভাবছে সে। আচ্ছা, নৈরিথের মন থেকে যদি সে সব ভয় দূর করতে পারে তবে নৈরিথও কি তাকে ভালোবাসবে? অনুপমের মতো করে ভালোবাসতে পারবে নৈরিথ? পারবে তার মতো অপেক্ষা করতে? কি জানি? কোনো উত্তর খুঁজে পেল না মিথি। আবারও একটা বই হাতে নিতেই আমিরা বেগম তার রুমে এলেন। তার উল্টো পাশের চেয়ারটাতে বসে বললেন,

‘রাদিত কেমন পড়ায়?’

মিথি মৃদু সুরে বললো,

‘ভালো।’

আমিরা বেগম যেন এইটুকুতে সন্তুষ্ট হতে পারলেন না। তিনি ব্রু কুঁচকে বললেন,

‘কেমন ভালো? নৈরিথের থেকে ভালো তো নাকি?’

মিথি এবার চোখ তুলে মার দিকে তাকাল। কিছুটা বিরক্ত কন্ঠে বললো,

‘মা, তুমি বারবার নৈরিথ স্যারের সঙ্গে রাদিত স্যারের তুলনা করতে কেন বলো? দুজনেই যার যার জায়গা থেকে ভালো। আমি কাউকে তুলনা করে কিছু বলতে পারবো না।’

আমিরা বেগম সরু চোখে তাকালেন। মনের ভেতর সন্দেহটা আবারও মাথা চাড়া দিয়ে উঠল। রাশভারী কন্ঠে তিনি বললেন,

‘তোমার বলতে না চাওয়ার কারণ কিন্তু আমি খুব ভালো করেই বুঝতে পারছি মিথি। শোনো, মাথায় যত আজগুবী চিন্তা আছে সব ঝেড়ে ফেল। পড়াশোনায় মন দাও। এইচএসসি তে ভালো রেজাল্ট না করতে পারলে কিন্তু লোক সমাজে মুখ দেখাতে পারবো না। তাই সব কিছু ছেড়ে ছুড়ে এখন ভালোভাবে পড়। আর রাদিত তো আছেই। কোনো সমস্যা হলেই ওকে নক করবে, বুঝতে পেরেছো?’

অগত্যাই মাথা নাড়াল মিথি। মায়ের কথায় বিরক্তের চরম সীমায় পৌঁছে গিয়েছে সে। রাগে কিছুক্ষণ হাতের কলমটাকে চাপড়ে চুপড়ে সেটা ছুড়ে মারে। তারপর জোরে একটা নিশ্বাস নিয়ে নিজেকে শান্ত করার চেষ্টা করে সে। মনের ভেতরটা কেমন খচখচ করছে তার। মায়ের হাবভাব সুবিধার ঠেকছে না। আর আজকে রাদিতের বলা কথাটাও তাকে খানিক ভাবাচ্ছে। এত এত ভাবনায় মাথার ভেতর জ্যাম হয়ে আছে ওর। উফফ, যদি মোবাইলের মেমোরি রিফ্রেশমেন্টের মতো মাথায়ও রিফ্রেশমেন্ট বাটন থাকতো, তাহলে আর এই জ্যাম বাঁধতো না।
.
.
আজ আকাশে মস্ত বড়ো এক চাঁদ উঠেছে। ঠিক বিশাল এক থালার মতো। মিথি বারান্দায় দাঁড়িয়ে চাঁদটার দিকে চেয়ে রইল। কি অপূর্ব তার সৌন্দর্য! কি মোহনীয়! একবার তাকালে আর চোখ ফেরানোর উপায় নেই। জোৎস্নার আলোয় মিথির চোখ গেল পাশের বিল্ডিং এর বারন্দাটার দিকে। যদিও কিছু দেখা যাচ্ছে না তাও মিথি চেয়ে আছে ঐ বারান্দার দিকে। কিছুক্ষণ পর তার কানে ভেসে এল গিটারের তীক্ষ্ণ সুর। টুংটাং বেজে চলছে। মিথি একটু সোজা হয়ে দাঁড়াল। কানটা একটু সামনে এগিয়ে শুনতে লাগল সেই সুর। কেউ গান গাইছে। পুরুষালী এক সুর শুনতে পাচ্ছে সে। স্পষ্ট না, রাতের নিস্তব্ধতায় ক্ষীণ সুরটাও তার কানে এসে বাজছে। মিথি নিশ্চুপ হয়ে রইল। গানের এক দু লাইন হয়তো বুঝতে পারছে সে।

‘তুমি আকাশের বুকে বিশালতার উপমা
তুমি আমার চোখেতে সরলতার প্রতিমা
আমি তোমাকে গড়ি, ভেঙ্গেচুরে শতবার
রয়েছো তুমি বহুদূরে আমাকে রেখে ছলনায়
এ হৃদয় ভেঙ্গে গেলে জানো কি তা
লাগে না, লাগে না জোড়া
লাগে না, লাগে না জোড়া’

খুব পরিচিত এই সুর। যতটুকুই মিথি শুনেছে ততটুকুতেই তার মন অস্থির হয়ে উঠেছে। বার বার কেন মনে হচ্ছে এটা সিফাতের কন্ঠ। এই কন্ঠ অনেক শুনেছে সে। কিন্তু এখন আর শোনা হয় না। কথা হয় না সিফাতের সাথে প্রায় দুবছরের মতো। মিস করে প্রতিটা মুহূর্ত। মিথি এবার থাকতে না পেরে জোরে ডেকে উঠল,

‘সিফাত! তুই কি গান গাইছিস? আমি তোর ভয়েস চিনি। সিফাত, প্লীজ কথা বল আমার সাথে। আমি সরি। প্লীজ সিফাত।’

মিথি চোখ দিয়ে পানি গড়িয়ে পড়ল। সে টের পেল সেই গানের সুরটা এখনও আর শোনা যাচ্ছে না। মিথি অস্থির হয়ে পড়ল। ইচ্ছে করছে ঐ ছেলেটার সাথে এক্ষুণি গিয়ে কথা বলতে। তার মন বলছে ঐ সিফাত। মিথি মনে মনে ঠিক করে নেয় কাল কলেজ থেকে আসার সময় আবার সে ঐ ফ্ল্যাটে যাবে। একবার হলেও দেখবে ঐ ছেলেটাকে। তার মনের সন্দেহ তাকে দূর করতেই হবে।
.
সকালে আজ তাড়াতাড়ি উঠে পড়ল মিথি। চুলগুলো একপাশে বেনী করে ডাইনিংরুমে গেল। ডাইনিং টেবিলের নাস্তা দেখেই মনটা খুশিতে লাফিয়ে উঠল তার। খিচুরি আর ডিম ভাজি ভীষণ প্রিয় তার। চেয়ারে বসেই মিথি অস্থির হয়ে বললো,

‘মা, খিচুরি দাও জলদি।’

মাহি তখন ভেংচি কেটে বললো,

‘এএ রাক্ষুসী খিচুরি দেখেছে, এখন সে তার আসল রুপে চলে আসবে।’

মিথি নাক ফুলিয়ে দাঁত কিড়মিড়িয়ে মাহির দিকে তাকিয়ে বললো,

‘ঐ কি বললি তুই?’

মাহি পাউরুটির মধ্যে কামড় বসিয়ে বললো,

‘বলেছি আজকে কি বার?’

মিথি তেঁতিয়ে উঠে বললো,

‘বাবা, দেখেছো তোমার ছেলে কি ফাজিল হয়েছে? ওকে কিছু বলবে তুমি।’

মাহি রুটি চিবুতে চিবুতে বললো,

‘আমি কি ফাজলামি করলাম। যেটা সত্যি সেটাই তো বলেছি। তুমি খিচুরি দেখলে রাক্ষস হয়ে যাও না ও সরি রাক্ষুসী।’

মিথি গাল ফুলিয়ে চেঁচিয়ে উঠে বললো,

‘বাবা!’

আতাউর সাহের মুখের সামনে থেকে খবরের কাগজটা ভাজ করে টেবিলের উপর রাখলেন। তারপর গম্ভীর চোখে একবার ছেলের দিকে আর একবার মেয়ের দিকে তাকালেন। তারপর থমথমে গলায় বললেন,

‘শুনো মিথি, তোমাকে না আমি বিয়ে দিয়ে দিব। আর মাহিকে নিয়ে অনাথ আশ্রমে রেখে আসবো। সারাটা দিন খালি ঝগড়া আর ঝগড়া। এত ঝগড়া করলে কি করে হবে বলতো?’

মিথি ব্রু উঁচিয়ে প্রতিবাদের সুরে বললো,

‘আমি কি করেছি বাবা? তোমার ছেলেই তো শুরু করেছে।’

মাহি বললো,

‘এই না বাবা। বুবু বলেছে বুবু। আমি কিছু বলেনি। আমি তো গুড বয়ের মতো রুটি খাচ্ছিলাম।’

মিথি মাহির দিকে তেড়ে এসে বলে,

‘একটা দিব তোকে ফাজিল ছেলে। আবার মিথ্যা বলাও শিখে গেছে।’

‘আমি মিথ্যা বলি না তুমি মিথ্যা বলো। তুমি তো একশোটা কথা বললে তার মধ্যে নিরানব্বই টাই মিথ্যা কথা। আসছে আমাকে বলতে।’

মিথি আবারও রেগে কিছু বলতে যাবে, তার আগেই রান্নাঘর থেকে আমিরা বেগম বেরিয়ে আসেন। তার হাতের খুন্তি দেখে দুই ভাই বোনই চুপ। তাদের ফেইস দেখে মনে হচ্ছে যেন ওদের চেয়ে নিষ্পাপ বাচ্চা পৃথিবীতে আর একটাও নেই।

মিথি দাঁত কেলিয়ে হেসে বললো,

‘মা, খিচুরি দিবে না?’

আমিরা বেগম রাগি চোখে একবার মেয়ের দিকে তাকিয়ে একটা খাবারের প্লেটে মিথিকে খিচুরি বেড়ে দিলেন। তারপর রান্নাঘরে ঢোকার আগে আরেকবার তাদের দিকে ফিরে তাকিয়ে বললেন,

‘আর যদি একটা শব্দও শুনেছি, তাহলে এই খুন্তি তোমাদের পিঠে ভাঙব।’

মিথি মাহি দুজনেই চুপচাপ মাথা হেলিয়ে তাদের খাওয়ায় মনোযোগ দিল।
.
.
নেহা কিছুক্ষণ যাবত ছটফট করছে। এদিক ওদিক ছোটাছুটি করছে। কিছুক্ষণ বসে বসে হাত কচলাচ্ছে তো আবার কিছুক্ষণ পায়চারি করছে। মিথি গালে হাত দিয়ে বসে বসে নেহাকে দেখে যাচ্ছে কিছুক্ষণ যাবত। বিরক্তিতে তার কপালে চওড়া ভাঁজ পড়েছে। বড় একটা হাই তুলে মিথি এবার সোজা হয়ে বসলো। সশব্দে নেহাকে বললো,

‘এই মেয়ে, কি হয়েছে তোর? এমন ট্যাংরা মাছের মতো লাফাচ্ছিস কেন?’

নেহা হন্তদন্ত হয়ে মিথির সামনে এসে বসলো। তারপর সে ভীষণ কৌতূহল নিয়ে মিথিকে জিগ্যেস করলো,

‘দোস্ত, ভাই কি তোকে ভালোবাসে?’

মিথি খানিক চুপ থেকে বললো,

‘কেন? তোর হঠাৎ এই কথা মনে হলো কেন?’

নেহার চোখে মুখে একরাশ কৌতুহল উপচে পড়ছে যেন। সে রাশভারী গলায় বললো,

‘তার দুইটা কারণ। প্রথমত কাল ভাইয়ের সাথে তোর কথোপকথনগুলো কল রেকর্ডিং এ আমি শুনেছি। আর দ্বিতীয়ত, ভাই কালকে তোর ব্যাপারে আমার কাছে অনেক কিছু জানতে চেয়েছে। এর আগে তো ভাই তোকে নিয়ে এত কিছু জানতে চায়নি। কাল তো আমি ভীষণ অবাক হয়েছি। তবে কি দোস্ত, ভাই ও আস্তে আস্তে তোকে ভালোবাসতে শুরু করেছে?’

মিথিও অবাক হলো। হা করে কিছুক্ষণ চেয়ে রইল নেহার দিকে। মনের ভেতর অন্যরকম এক প্রশান্তি পাচ্ছে সে। ভাবতেই ভাল লাগছে নৈরিথও তাকে নিয়ে ভাবছে। কিন্তু হঠাৎ মিথির রাদিতের কথা মনে পড়ে গেল। হুট করেই মনে এক আশংকা চেপে বসলো। যদি তার এই আশংকাই ঠিক হয়, তবে কি করবে সে?

চলবে..