তোমার আমার চুপকথা পর্ব-০৫

0
253

#তোমার_আমার_চুপকথা
#৫ম_পর্ব
কপি করা নিষিদ্ধ ❌

“কেমন আছো পৃথুল?”

প্রাক্তন স্ত্রীর কন্ঠটি কানে আসতেই স্তব্ধ হয়ে গেলো পা। হাজারো চিন্তার জোয়ার এলো মস্তিষ্ক জুড়ে। পেছনে ফিরতেই সেই মুখশ্রীর দেখা পেলো যাকে চারবছর পূর্বে চোখে হারাতো। হৃদয়ে সঞ্চিত নানানবিধ অনুভূতিগুলো হামলা করলো মন এবং মস্তিষ্কের উপর। পৃথুল শান্ত নয়নে তাকিয়ে আছে। তার মুখোভাব সায়াহ্নের শীতল দিঘীর ন্যায় স্থির। চোখ গুটিয়ে নিপুনভাবে দেখলো সে তার প্রাক্তন স্ত্রীকে। শতরুপা এগিয়ে এসে দাঁড়ালো ঠিক মুখোমুখি। মুখে হাসির রেখা এখনো অক্ষত। সে অনেক বদলে গিয়েছে। আগের মতো অপরুপাটি নেই। সেই দীঘল কেশ এখন কেটে ফেলেছে। চোখে উঠেছে চশমা। মুখে মালিন্যের ছাপ কোথাও না কোথাও যেনো ঠিক ই দেখা যাচ্ছে। পৃথুল চুপ করে রইলো। তাকে চুপ দেখে শতরুপার হাসি খানিকটা মলিন হলো। বিব্রত কণ্ঠে বললো,
“কথা বলবে না?”
“বলার কথা খুজে পাচ্ছি না”

শতরুপা দৃষ্টি নামালো, মাথা নুইয়ে ধীর স্বরে শুধালো,
“আমাকে ক্ষমা করো নি তাই না?”
“ক্ষমা করা বা না করার মতো আমাদের মাঝে কোনো সম্পর্ক নেই শতরুপা। যেদিন আমাকে এক রাত হাজতে কাটাতে হয়েছিলো, আমার অভিযোগ, অভিমান, রাগ সব কর্পুরের মত উবে গিয়েছিলো। এখন তাদের রেশও আমি পাবো না। হ্যা, তবে চার বছর পর তোমাকে চেয়ে স্তম্ভিত হয়েছি মানতে হবে”
“পৃথুল, আসলে……”

পৃথুল শতরুপার কথার মাঝে বাধা দিলো। হাত দিয়ে থামতে বললো,
“এখন পুরোনো কাসন্দি ঘেটো না, এসবে লাভ নেই। যা হবার সেটা হয়ে গেছে। এখন তোমার কোনো এক্সপ্লেনেশন আমাকে আমার জীবনের সেই যন্ত্রণাময় দিনগুলো ভুলিয়ে দিবে না। সেই দিনগুলোতেই আমার প্রতিটা স্পন্দনে তুমি ছিলে, আমি তোমাতে নাস্তাবুদ ছিলাম। কি লাভ হলো! বিনিমনে আমি প্রতারণা ছাড়া কিচ্ছু পাই নি। ভালোবাসার হিসেবে আমার ঝুলিতে শুন্যতাই পেয়েছি। আর কি জিজ্ঞেস করছিলে, কেমন আছি? খুব ভালো আছি। কারণ আমার জংধরা, জীর্ণ জীবনে কারো আগমণ ঘটেছে। যে তার স্নিগ্ধতা দিয়ে সব ধুলাবালিকে সরিয়ে নতুন করে আমাকে সাজিয়েছে। আমাকে পূর্ণ করেছে। আলহামদুলিল্লাহ, অনেক ভালো আছি”

পৃথুলের হাসি বিস্তৃত হলো। শতরুপা তার দিকে বিষন্ন নয়নে চেয়ে রইলো। ভেঙ্গেচুরে দেওয়া ক্ষতবিক্ষত পৃথুলটি আর নেই। আজ সত্যি সত্যিই যেন সব হিসেব চুক্তা হলো। কিছুই পরিশেষ নেই। তবে বুকের ফাঁকা স্থানে আফসোসের মাত্রা বাড়লো। যে মরীচিকার টানে নিখাদ হৃদয়টিকে পায়ে ঠেলেছিলো। সেই ভুলের জন্য কেবল আফসোস ই পরিশিষ্ট থাকে_________

পৃথুল এগিয়ে যেতেই দেখলো আরশিয়া সিড়িতে দাঁড়িয়ে আছে। সে শতরুপার সাথে পৃথুলকে কথা বলতে দেখেছে। কিন্তু এগিয়ে যাবার সাহস হয় নি। কিছু সময় অতিজঘন্য অতীতকেও পাতা উলটে দেখতে হয়। বলা তো যায় না, কখন কি সামনে আসে!

আরশিয়ার কাছে দাঁড়াতেই পৃথুল মৃদু হেসে বললো,
“শিক্ষিকা মহোদয়াকে সারপ্রাইজ দিতে চেয়েছিলাম। কিন্তু গুবলেট হয়ে গেলো”
“আপনি ঠিক আছেন?”
“কেনো বলুন তো?”
“অতীতের মুখোমুখি হওয়া কঠিন। সবাই পারে না। আর অতীত যদি হয় অনুভূতিপ্রবণ তবে তো……”

আরশিয়া কথাটি শেষ করার পুর্বেই পৃথুল তাকে বাহুবন্ধনে আবদ্ধ করলো। থুতনি ঠেকালো আরশিয়ার কাঁধে। খুব শক্ত আলিঙ্গনে আগলে বললো,
“শিক্ষিকা মহোদয়া, আপনি যে প্রতি নিয়ত আমাকে নিজের প্রতি প্রবলভাবে আকৃষ্ট করছেন, এটা কিন্তু অন্যায়। আমি মানুষটির চেন্তাচেতনা হারিয়ে রোমিও টাইপ হয়ে যাচ্ছি”

আরশিয়া খেয়াল করলো প্রতিটি চোখ তাদের দেখছে। ফলে লজ্জায় লাল হয়ে উঠলো সে। পৃথুলকে খুব কষ্টে ছাড়ালো। খানিকটা রুষ্ট স্বরে বললো,
“আশপাশটা দেখবেন তো সাংবাদিক। লাজলজ্জা বলেও তো কিছু আছে”
“আমার দোষ নেই, দোষটি আপনার।“
“মানলাম, আমার দোষ এবার ছাড়ুন।“

বলেই পৃথুলের বাহুবন্ধন ছাড়ালো। পৃথুল তখন তার হাতটি শক্ত করে ধরেই হাটা শুরু করলো। আরশিয়া হতবাক স্বরে বলল,
“কোথায় যাচ্ছি?”
“বাড়ি, বউ এর সাথে শান্তিতে প্রেম করতে চাই”

আরশিয়া লজ্জার মাথা নুইয়ে ফেললো। কে জানতো, অল্প কথার সাংবাদিকটি অন্তর থেকে কঠিন প্রেমিক পুরুষ হবে__________

*****
ভার্সিটিময় নতুন কথা ছড়ালো। রাইয়ান এবং আত্মিকার ছাড়াছাড়ি বিশাল এক ঢেউ তুললো যেনো উৎসাহী জনগণের মাঝে। বিশেষ করে মনফেকু ইসমাইল ভাইএর তো চিন্তার শেষ নেই। আত্মিকার মত মেয়ে কেনো রাইয়ানের মত ছেলের সাথে ঝামেলা করেছে এটাই যেনো তার চিন্তার এক এবং অন্যতম কারণ। হিসেব বিভিন্ন হিসেব এবং থিওরি আবিষ্কার করছে, কিন্তু বামপক্ষ এবং ডানপক্ষ যেনো মিলছে না। তাই আজ বাগে পেয়ে উনি একেবারে জেরাই করে বসলেন আত্মিকাকে।
“আচ্ছা তোমাদের ঝগড়ার কারণটি কি? এতো বড় সিদ্ধান্ত নিলে, নিশ্চয়ই বিশাল কারণ থাকবে”

ইসমাইল ভাই এর মুখ বেশ কঠিন, তার দৃঢ় কৌতুহল এবং সিরিয়াস ভাবখানা বিপাকে ফেললো আত্মিকাকে। ইনিয়ে বিনিয়ে বললো,
“ভাইয়া, আমাদের আর কি যাচ্ছিলো না”

কথাটা শুনে ইসমাইল ভাই এর বিশ্বাস হলো না। উলটো জোর গলায় বললেন,
“কি বলছো যাচ্ছিলো না! মাত্র পাঁচ-ছয় মাসেই যাচ্ছিলো না তকমাটি কি খাটে? দেখ তোমাদের পার্সোনাল ব্যাপারে আমার নাক গলানো উচিত নয়। কিন্তু রাইয়ানকে আমি চিনি। ছেলেটিকে যেমন মনে হয় সে তেমন নয়। ও যে তোমাকে ভালোবাসে তাতে তো তোমার সন্দেহ নেই, তাহলে সমস্যা কি?”
“ভালোবাসা একপাক্ষিক হয় না, উভয় দিক থেকেই সেটা হওয়া উচিত”
“তুমি বলছো তুমি তাকে ভালোবাসো না?”

আত্মিকা চুপ করে রইলো। কারণ উত্তরটি তার নিজেরও অজানা। ভালোবাসা নামক অদ্ভুত প্রহেলিকায় সে খেই হারিয়ে ফেলেছে। শুধু এতোটুকু বুঝতে পারছে এই রাইয়ান নামক মানুষটি তাকে অদৃশ্য মায়াজালে তাকে আবদ্ধ করেছে। শান্ত, নিবৃত্ত জীবনটির মাঝে এমন ঝড় তুলেছে যে আত্মিকা নিজেও দিশাহীন যাত্রীর মতো পথ খুজে বেড়াচ্ছে। আত্মিকাকে চুপ করে থাকতে দেখে ইসমাইল ভাই মৃদু হাসলেন। ধীর স্বরে বললেন,
“তুমি ওকে ভালো না বাসলে আজ তোমার মুখখানা এতো মলিন থাকতো না। এই দূরত্ব তুমিও সইতে পারছো না। আচ্ছা বলতো ভালো না বাসলে কেউ খরখরে রোদে অপেক্ষা করতে পারে? ভালো না বাসলে কারোর প্রতি অহেতুক চিন্তা করতে পারে? ভালো না বাসলে কারো বিরহে ঘুম বিসর্জন দিতে পারে? তুমি গতরাতে ঘুমাও নি, তোমার চোখ সাক্ষী দিচ্ছে। তাই তুমি রাইয়ানকে ভালোবাসো না, কথাটি মিথ্যে। একেবারে ইংরেজীতে যাকে বলে, “white lie”। তোমরা দুজন একেবারে মেইড ফর ইচ আদার, অহেতুক কারণে নিজেদের মাঝে দেওয়াল তুলো না“

আত্মিকা নিশ্চুপ চেয়ে রইলো মনফেকু ইসমাইল ভাইয়ের দিকে। মানুষটিকে আজ ততটা বিরক্ত লাগছে না। বরংচ মনে হচ্ছে, মানুষটি আসলে প্রেম ভালোবাসা সম্পর্কে কিছু হলেও জানে। আবার তার এই বিশাল জ্ঞান যে আত্মিকাকে আরোও দ্বিধায় জর্জরিত করে ফেললো, সেটা এই অতিবুদ্ধিমান মানবটি বুঝলো না ঠিক। আত্মিকা নির্নিমেষভাবে আকাশপাতাল ভাবছিলো, তখন ই কোথা থেকে একটি ইটের ভাঙ্গা অংশ এসে লাগলো আত্মিকার কনুই এ। “আহ” করে ছোট আর্তনাদ করে উঠলো আত্মিকা। প্রবলবেগে আসায় চামড়া চিরে গলগল করে পড়লো রক্ত। ঘটনার আকস্মিকতায় ইসমাইল থমকে গেলো। তাড়াতাড়ি ধরলো সে আত্মিকাকে। গত সপ্তাহের গ্যাঞ্জামটির অন্ত হয়ে গিয়েছে, তবে আজ কেনো এমন কান্ড। দৃষ্টি এদিক ওদিক ফেরাতেই মানুষটিকে নজরে পড়লো। হাক দিলো জোরে,
“এই সোহান, সোহান পালাবি না”

সোহান দাঁড়ালো না। সে তার কার্যসিদ্ধি করেই পলায়ন করেছে। এদিকে আত্মিকার কনুই দিয়ে চুয়ে চুয়ে রক্ত পড়ছে। ইসমাইল দ্রুত ভ্যানে উঠতে বললো আত্মিকাকে। মেডিকেল সেন্টারে নিয়ে যাওয়া প্রয়োজন।

*****

কনুই এ সফেজ ব্যান্ডেজ। আত্মিকার মুখে ভীতির ছাঁপ। এমন কিছু হবে কখনো চিন্তাও করে নি। এদিকে ইসমাইলের কপালে বলিরেখার ভাঁজ। পারভেজ ছুটে এলো মেডিকেল সেন্টারে। রাইয়ান আসে নি। পারভেজ আসতেই ইসমাইল ধীর কন্ঠে চিন্তিত স্বরে বললো,
“আচ্ছা, সোহানের সাথে কিছু হয়েছে কি?”
“কেনো বলুন তো ইসমাইল ভাই?”
“আমি সোহানকে দেখেছি”

পারভেজ খুব আস্তে কিছু ইসমাইল ভাইকে বললো, যা আত্মিকার কর্ণকুহর অবধি এলো না। আত্মিকার চোখ তখন খুঁজছিলো সেই সৌম্য পুরুষটিকে। তখন ই ইসমাইল ভাই বলে উঠলেন,
“চলো আত্মিকা তোমাকে বাসায় পৌছে দেই”
“না, না ভাই আমি যেতে পারবো”
“কি বলো, এই অবস্থায় একা যাবে নাকি?”

ইসমাইল ভাই মোটেই রাজি হলেন না। অবশেষে উপায়ন্তর না পেয়ে তার সাথেই বাড়ি যেতে হলো। রাইয়ান এলো না। মানুষটি সেই হৃদয় নিংড়ানো ভালোবাসার দর্শন বুঝি আর হবে না।

****

নিস্তব্ধ ঘরের প্রতিটি কোন আলোড়িত হচ্ছে মোবাইল ফোনের কর্কশ ধ্বনিতে। পেইন কিলারের প্রভাবে গাঢ় ঘুমে মগ্ন ছিলো আত্মিকা। রিংটোনের আলোড়নে ধরফরিয়ে উঠলো সে। হাতরে তাড়াতাড়ি ফোনটি হাতে দিলো। রিসিভ করে কাঁপা স্বরে বললো,
“হ্যালো, আসসালামু আলাইকুম”
“ওয়ালাইকুমুস সালাম, আত্মিকা তুই এখনো ঘুমাচ্ছিস?”
“হ্যা, পেইন কিলার খেয়েছিলাম তো’
“এখানে মহা কান্ড ঘটেছে। রাইয়ান ভাই তো মারামারি করেছে, এখন হাসপাতালে ভর্তি”……………….
চলবে