তোমার আমার চুপকথা পর্ব-০৬

0
249

#তোমার_আমার_চুপকথা
#৬ষ্ঠ_পর্ব
কপি করা নিষিদ্ধ❌

নিস্তব্ধ ঘরের প্রতিটি কোন আলোড়িত হচ্ছে মোবাইল ফোনের কর্কশ ধ্বনিতে। পেইন কিলারের প্রভাবে গাঢ় ঘুমে মগ্ন ছিলো আত্মিকা। রিংটোনের আলোড়নে ধরফরিয়ে উঠলো সে। হাতরে তাড়াতাড়ি ফোনটি হাতে দিলো। রিসিভ করে কাঁপা স্বরে বললো,
“হ্যালো, আসসালামু আলাইকুম”
“ওয়ালাইকুমুস সালাম, আত্মিকা তুই এখনো ঘুমাচ্ছিস?”
“হ্যা, পেইন কিলার খেয়েছিলাম তো’
“এখানে মহা কান্ড ঘটেছে। রাইয়ান ভাই তো মারামারি করেছে, এখন হাসপাতালে ভর্তি”

তাসনুভার আতংকিত স্বর কানে আসতেই বুকে কামড় পড়লো আত্মিকার। ঘুম উবে গেলো। আমাবস্যা ঘনিয়ে এলো মুখশ্রীতে মুহূর্তেই। মস্তিষ্ক ঘুমের প্রবণতায় নিষ্ক্রিয় ছিলোই, আরোও বেশি যেনো অকেজো হয়ে গেলো। ভয়ার্ত কণ্ঠে বলল,
“মানে?”
“মানে মুনে বলার সময় নেই। তুই যদি তাকে দেখতে চাস, ইবনে সিনাতে চলে আয়”

বলেই খট করে ফোন কেটে দিলো তাসনুভা। আত্মিকা বিমূঢ় দৃষ্টিতে চেয়ে রইলো মোবাইলের স্ক্রিনের দিকে। রাইয়ান মানুষটি বহির্জগতে খুব সুশীল, সুসজ্জিত মানুষ। নিজের ইমেজ নামক জিনিসটি নিয়ে সে বেশ সচেতন। তাহলে কি এমন ঘটেছে যে নিজের এই ইমেজটাকেও কাদাপানি দিয়ে লেপ্টে দিতেও সে দ্বিধা করে নি! আত্মিকা কোনো মতে উঠে দাঁড়ালো। পা চলতে চাইছে না, মাথাটা হালকা ঘুরে উঠলো। কিন্তু থেমে রইলো না আত্মিকা। তাকে যেতে হবে। বুকটা অশনী বাতাসের ঝোকে কাবু হয়ে আছে, রাইয়ানকে একবার না দেখলে সে স্বস্তি পাবে না।

হাসপাতালে এসে চক্ষুচরাগ গাছ হলো আত্মিকার। এখানে মোটামোটি পঙ্গপালের আবির্ভাব ঘটেছে যেনো। মহাশয়ের জন্য ঘটা করে কেবিন বুক করে হয়েছে। আরো একটি কেবিনে সোহানকে অর্থাৎ যার সাথে মারপিট করেছিলো মহাশয় তাকে স্যালাইন লাগিয়ে শুইয়ে রাখা হয়েছে। তার নাক ভেঙ্গে দিয়েছে। আর মহাশয়ের কথা না বললেই নয়, তার ঠোঁট ফেটে গিয়েছে। ডান হাতে সফেদ ব্যাণ্ডেজ। সেই হাতেই আপেল নিয়ে আয়েশ করে খাচ্ছে সে। তার মাঝে খুব একটা ভাবপরিবর্তন লক্ষ্য করা যাচ্ছে না। মনে হচ্ছে এটা তো রোজের ব্যাপার। ইসমাইল তার পাশে বসে আছে। তার মুখে চিন্তার রেশ ও নেই। তাসনুভা তো বেশ আয়েশ করে কফি খাচ্ছে আর হাসতে হাসতে গড়াগড়ি খাচ্ছে, কি কেমন হাসির কথা। অথচ মেয়েটি যেভাবে ফোন করে বলেছে, আত্মিকার মনে হয়েছিলো না জানে কি মারাত্মক কিছু ঘটেছে। আত্মিকা কেবিনে প্রবেশ করতেই আশ্চর্যজনক ভাবে সবাই বেরিয়ে গেলো। ইসমাইল ভাই বের হতে হতে চিন্তিত স্বরে বললেন,
“এবার নিজের জিনিস বুঝে নাও। আমরা ওর সাথে পারছি না। সে কোনো ঔষধ খাচ্ছে না।এবার তুমি ই সামলাও”

আত্মিকা অবাক নয়নে চাইলো। একটু আগেও লোকটি নিশ্চিন্তে বসে ছিলো। মুহূর্তেই তার ভাবমূর্তি বদলে গেলো! এরা পারেও। আত্মিকা সরাসরি দাঁড়ালো রাইয়ানের সামনে। রাইয়ান আপেল খাওয়া থামালো না। তবে চোখ তুলে আত্নিকাকে দেখতেও ভুল করলো না। সরু দৃষ্টি দিয়ে দেখলো তার মনোহরিনীকে। চুল কোনমতে খোপাতে বাধা। কপালের পাশ থেকে কিছু চুল বেরিয়ে আছে। পায়ে বাসার স্লিপার। পায়জামাটাও তড়িঘড়িতে উল্টো পরেছে। রাইয়ানের ঠোঁট চিরে প্রশান্তির হাসির রেখা উদিত হলো৷ যা দৃষ্টি এড়ালো না আত্মিকার। থমথমে স্বরে শুধালো,
“আপনি মারপিট করেছেন?”

আত্মিকার প্রশ্নে চোখ তুলে তাকালো রাইয়ান। দৃষ্টিতে নির্লিপ্ততা। খুব দায়সারাভাবে উত্তর দিলো,
“না”
“তাহলে ওই পাশের কেবিনের ছেলেটির নাক ভাঙ্গা কেনো?”

ক্রোধের অনল কন্ঠের ধার বাড়ালো। আত্মিকার লাল চোখের দিকে একবার চাইলো রাইয়ান। কিন্তু তার নির্লিপ্ততা কমলো না। বরং সাদা বালিশে পিঠ লাগিয়ে বললো,
“ওর নাকটা খুব উঁচু, তাই শখ হয়েছিলো ওর নাক দিয়ে ভার্সিটি চত্ত্বর পরিষ্কার করার। তাই ভেঙ্গে গেছে হয়তো”

এবার যেনো সীমা অতিক্রম হলো ক্রোধের। একেবারে মুখোমুখী দাঁড়ালো আত্মিকা তার। কন্ঠে ফুলকারি দিয়ে উঠলো বিরক্তি,
“মশকরা করেন?”
“আপনার সাথে কি আমার মশকরার সম্পর্ক?”
“তাহলে আমি যা জানতে চাইছি সেটার উত্তর দিচ্ছেন না কেনো?”
“কি জানতে চাইছেন?”

আত্মিকা অধৈর্য্য স্বরে বললো,
“আপনি অহেতুক ছেলেটিকে মেরেছেন কেনো?”
“আমি রাইয়ান, অহেতুক কোনো কাজ করে না”
“কাউকে মারা অহেতুক নয়?”
“সে আমার ভালোবাসার মানুষটিকে আঘাত করবে আর আমি মুখে আঙ্গুল দিয়ে বসে থাকবো? শুনুন আত্মিকা আমি এতো ভালো মানুষ নই। আমি যেচে কাউকে কিছু না বললেও, কেউ আমার ক্ষতি করতে চাইলে আমি ছেড়ে কথা বলি না। সোহানের সাথে আমার ঝামেলা, সে আপনাকে আক্রমণ কেনো করলো! আপনাকে আক্রমণ না করলে তো আমি কিছুই বলতাম না”

রাইয়ানের কণ্ঠে জড়তা নেই। আত্মিকা বিমূর্ত নয়নে তাকিয়ে আছে। কোথাও শিউলি ফুল ফুটেছে বুঝি, এতো শান্তি কেনো লাগছে! তবুও জড়ানো স্বরে বললো,
“আপনি আর এমন কিছু করবেন না”
“কথা দিতে পারছি না”
“কেনো? কেনো কথা দিতে পারবেন না? আমাকে মানুষ মনে হচ্ছে না?”

আত্মিকার কন্ঠে রোষের পরদে অভিমানের জোয়ার উঠলো। সে এগিয়ে এল আরেকটু কাছে। রাইয়ান আত্মিকার কণ্ঠে চমকালো। কিন্তু সে কিছু করার পূর্বে আত্মিকা তার কলার চেপে ধরলো। ধরা গলায় বললো,
“আপনি কি ভাবছেন! আমার জন্য মারপিট করে হিরো হয়েগেছেন। আমি বাহবা জানাবো আপনাকে। আপনাকে মাথায় তুলে নাচবো! আজ্ঞে না। আমার মারপিট ভালো লাগে না। আপনি জানেন খবরটা শোনা মাত্র আমার অবস্থা কি ছিলো! যে আমি এতো সুচীবায়, এই কাঁদামাটিতে হাটতেও অস্বস্তি লাগে সেই আমি স্লিপার পড়ে চলে এসেছি। তাও বাথরুমের স্লিপার। আমি ভুলে গিয়েছিলাম তখন নিজের কথা। আপনার কোনো ধারণা আছে আমার উপর কি যাচ্ছিলো। যদি এমন ই করার ছিলো তাহলে কেনো এসেছেন আমার জীবনে। কেনো আমার অভ্যাসে পরিণত হলেন। কেনো বলুন?”

আত্মিকার চোখ ছলছল করছে। কন্ঠ জড়িয়ে আসছে। রাইয়ানের ঠোঁটে দূর্বোধ্য হাসি। সে কিছু না বলেই শক্ত বাধনে জড়িয়ে নিলো আত্মিকাকে। আত্মিকার মাথাটা সুঠাম বুকে চেপে আলতো হাত বুলালো তার ঘন কেশে। আত্মিকা থামলো না। অভিযোগের পুটলি খুললো সে। বুকে কিল দিতে দিতে বললো,
“আপনার সাথে জড়ানোই আমার ভুল ছিলো। আপনি আমার কথা কখনোই চিন্তা করেন না। আমার বুক এখনো কাঁপছে। যদি আপনার কিছু হয়ে যেতো কথাটা চিন্তা করলেই আমার হাত পা জমে যাচ্ছে। অথচ আপনি আপেল খাচ্ছেন। কি উল্লাস হৃদয়ে। এই আপনার ভালোবাসা?”
“আমার ভালোবাসার পরীক্ষা নিবেন না আত্নিকা। আপনার প্রশ্নের পাতা ফুরিয়ে যাবে”

রাইয়ানের কথাটা শুনে মাথা তুললো আত্মিকা। ধীর স্বরে বললো,
“তাহলে এমন আর কখনো করবেন না কথা দিন”
“কথা দিলে সেটা ভেঙ্গে যাবে আত্মিকা। সেই কথা কেন নিতে চাইছেন? বেশ! কখনো যদি আপনি বা আমার পরিবারের কেউ ঝামেলায় না পড়ে আমি মারপিট করবো না। কথা দিয়েছি। এবার আপনি একটা প্রশ্নের উত্তর দিন তো! আমার জন্য এতো অস্থির কেনো হয়েছিলেন? আমাকে তো আপনি ভালোবাসেন না। তাহলে এতোটা আবেগপ্রবণ কেনো হলেন আজ আত্মিকা?”
“যদি বলি আমি ভুল ছিলাম, কুহেলিকায় চিন্তাদৃষ্টি ঝাপসা হয়ে গিয়েছিলো। মেনে নিবেন?”

আত্মিকার কথায় রাইয়ান হাসলো। স্বচ্ছ, নিখাঁদ হাসি। তার কপালের অবিন্যস্ত চুলগুলো কানে গুজে বললো,
“আপনি যা বলবেন আমি মেনে নিবো”
“যদি বলি ভালোবাসি?”

আত্মিকা উত্তরের প্রতীক্ষা করলো। রাইয়ানের গাঢ় নয়নে নিজের প্রতিচ্ছবি দেখছে সে। অতীব বাঁচাল ব্যাক্তিটি চুপ করে গেলে অস্থিরতা বাড়ে। রাইয়ান ও আজ চুপ। তার চুপকথা পড়ার চেষ্টা করলো আত্মিকা। কিন্তু ততটা প্রতীক্ষা করাল না রাইয়ান। কোমড় শক্ত করে ধরে উঁচু করে তুললো আত্মিকাকে। আত্মিকার তার এমন কাজে চোখ বড়বড় করে চাইলো। সেই বিস্ময়কে বাড়িয়ে দিলো আরোও একটি সাংঘাতিক কাজ যখন পুরুষালি এক জোড়া ঠোঁটের ভাজে খাবি খেল তার পাতলা অধর……

চলবে