তোমার আমার চুপকথা পর্ব-০৪

0
276

#তোমার_আমার_চুপকথা
#৪র্থ_পর্ব

আত্মিকার বিশ্বাস হচ্ছে না। রাইয়ান সত্যি তাকে অদেখা করলো! ক্ষুদ্ধ হলো হৃদয় কিঞ্চিত। খানিকটা হলো অভিমান। কিন্তু কারণ খুঁজে পেলো না। তাসনুভা তার জিজ্ঞেসাবাদ অব্যহত লাগলো। ভাবুক স্বরে শোধালো,
“কি রে? বললি না তো। তোদের কি ঝগড়া হয়েছে নাকি? রাইয়ান ভাই এমন অদেখা করে চলে গেলো কেনো?”

তাসনুভা বন্ধুনিবেদিত প্রাণ এতে আত্মিকার সন্দেহ নেই। খুব ই ভালো সে। কিন্তু এই সব বিষয়ে নাক গলানো স্বভাবটা মোটেই ভালো লাগে না। কেনো ভাই? এতো কৌতুহল কেনো তোর? এই খবরটা না জানলে কি তোর পৃথিবী ভেঙ্গে পড়বে? জমিন ফাঁক হয়ে যাবে? আকাশ খসে পড়বে? কি সমস্যা? আত্মিকা ভ্রু কুচকালো। ঝাঝালো স্বরে বলল,
“এটা না জানলে কি তোর মহাভারত অশুদ্ধ হয়ে যাবে?”
“আমাকে বলবি না তুই?”

বলেই ঠোঁট উলটালো সে। আত্মিকা বিরক্তির সাথে দীর্ঘশ্বাস ফেললো। স্বাভাবিক স্বরে বললো,
“আমাদের মাঝে বিশাল ঝগড়া হয়েছে, একেবারে ধরে নে ইউক্রেন আর রাশিয়ার যুদ্ধের মতো বিশাল। তাই আমরা সিদ্ধান্ত নিয়েছি আমরা এই সম্পর্ক আর কন্টিনিউ করবো না। একেবারে ব্রেকাপ”

কথাটা তাসনুভার পৃথিবী কাঁপিয়ে দিলো যেনো। হতভম্ব হয়ে গলা উঁচিয়ে বললো,
“কি?”

তার স্বর বিল্ডিং এর সকলের দৃষ্টি আকর্ষণ করলো। ফলে আত্মিকা তার মুখ চেপে ধরলো। দাঁত কিড়মিড়িয়ে বললো,
“চেচাচ্ছিস কেনো?”
“কি বলছিস তুই? চেচাবো না?”
“এটা একটা স্বাভাবিক ব্যাপার”
“মোটেই নয়। এটা মোটেই স্বাভাবিক কিছু নয়। এটা একটা বিশাল খবর। ব্রান্ড নিউ ব্রেকিং নিউজ। তুই কি পাষাণ, কিভাবে পারলি তুই?”

তাসনুভার মুখোভাব দেখে মনে হচ্ছে সে এখনি কেঁদে দিবে। এতো দুঃখ কিসের? ব্রেকাপ তো আত্মিকার হয়েছে, কিন্তু এ এতো দুঃখী কেনো? সবচেয়ে বড় প্রশ্ন, “পাষাণ” আখ্যা দেবার কি মানে? বন্ধু বান্ধবের নৈতিক দায়িত্ব, ব্রেকাপ হলে প্রথমে তার ঘনিষ্ঠ বান্ধবীকে সান্ত্বনা দেওয়া। যার সাথে ব্রেকাপ হয়েছে তার দোষ থাকুক বা না থাকুক দোষ তাকেই দেওয়া। এটাই বন্ধুদের একমাত্র দায়িত্ব। কিন্তু তাসনুভা কি সুন্দর অকপটে “পাষাণ” বলে দিলো আত্মিকাকে। আত্মিকা হতবাক হলো। চোখ বিস্ফারিত করে বললো,
“আমি? আমি পাষাণ?”
“হ্যা, তুই পাষাণ। তাই তো রাইয়ান ভাইয়ের সাথে ঝগড়া করেছিস, আবার ব্রেকাপ ও করেছিস। পাষাণ না হলে কি করতে পারতি?”
“তুই শিওর কি করে হলি? এই সম্পর্কের ইতি আমি টেনেছি শিওর কি করে হলি?”
“তাহলে বলতে চাচ্ছিস রাইয়ান ভাইয়া ব্রেকাপ করেছে? এও বিশ্বাস করতে হবে? হাহ! উনি হচ্ছে তুই অন্তপ্রাণ। স্বপ্নেও সে তোকে কষ্ট দিতে পারেন না। আমাদের চোখ নেই নাকি? কখনো দেখেছিস তোর বিরুদ্ধে কোনো কথা বলতে! সবসময় “আত্মিকা, আত্মিকা”। সে কিনা তোর সাথে ব্রেকাপ করবে! আমাকে বিশ্বাসও করতে হবে”

আত্মিকা হা করে চেয়ে রইল। এমন বান্ধবী থাকলে শত্রুর কি প্রয়োজন! আর এই মানুষটি কি জাদু জানে নাকি? সবাইকে হাত করে নিয়েছে। হ্যা, সে মানছে সম্পর্কের ইতি সে টেনেছে। কিন্তু বান্ধবী হয়ে তাসনুভা কি করে ঐ মানুষটির সাফাই গাচ্ছে। ধুর! আত্মিকা চিরচিরে কণ্ঠে বললো,
“এক কাজ কর। সাদা পাতায় রাইয়ান ভাই, রাইয়ান ভাই লিখে জপ কর। অসহ্য”

বলেই হনহন করে হাটা দিল সে। তাসনুভা পিছু ডাকলো কিন্তু শুনলো না সে। পা স্বয়ংক্রিয়ভাবে থেমে গেলো রাইয়ানদের ক্লাসের সম্মুখে। পলি আপুর সাথে রাইয়ান সাহেব কথা বলছেন। আহা! হাসি যেনো ধরছে না মুখে। পলি আপু ঢলে ঢলে পড়ছেন রাইয়ানের বাহুর উপর। রাইয়ান বাধাও দিচ্ছে না। কি চমৎকারভাবে হাসছেন। আচ্ছা, পুরুষদের হাসিও বুঝি সুন্দর হয়। হঠাৎ চিনচিনে ব্যাথা অনুভূত হলো আত্মিকার। কিন্তু কেনো? সে তো রাইয়ানকে ভালোবাসে না। তাহলে এই অসহ্য অনুভূতি কেন! তিতকুটে অনুভূতি হৃদয় ছেয়ে যাচ্ছে।হঠাৎই চোখাচোখি হলো দুজনের চোখের। কি অদ্ভুত ব্যাপার, যে মানুষটি তার ক্লাসের বাহিরে ঘন্টার পর ঘন্টা অক্লান্তভাবে দাঁড়িয়ে থাকতো সেই মানুষটির ক্লাসের বাহিরে আজ আত্মিকা দাঁড়ানো। অথচ মানুষটির মাঝে অনীহা। মানুষ সব মানতে পারে, শুধু অনীহা মানতে পারে না। কিন্তু আত্মিকা তো সেই মানুষগুলোর মধ্যে পড়ে না। তার অনুভূতিগুলো এতো নরম নয়। তাহলে আজ সে কেনো অনীহা মানতে পারছে না। আত্মিকা দাঁড়ালো না। তড়িৎ গতিতে পা চালালো। রাইয়ান তার দিকে তাকিয়ে ছিলো। আত্মিকার মূর্ছানো মুখখানা দেখে বারবার মনে হচ্ছিলো, একটু যেয়ে শুধাই, “কি হয়েছে আপনার? রাতে ঘুমান নি?”—- কিন্তু মেয়েটি তার সাথে কথা বলবে না। সে মুক্তি চায়। মিথ্যে সম্পর্কের জাল থেকে মুক্তি চায়। তাহলে মোহ বাড়িয়ে কি লাভ!

সূর্য তখন তার তেজ ধুসর আশ্বিনা মেঘের চাদরে মুড়তে ব্যাস্ত। শীতল বাতাসে দোলা খাচ্ছে প্রশস্থ মাঠের পাশের বড় আমগাছটি। শান্ত পরিবেশ। ছাত্রছাত্রীদের ক্লাস প্রায় শেষ। কেউ কেউ ল্যাবের তাড়ায় ছুটছে। হঠাৎ ই সব গরম হয়ে উঠলো। মাঠের মধ্যখানে এক কথা দু কথা বেধে মারামারি লেগে গেলো। সেই মারামারিতে ধীরে ধীরে ছাত্রদের যোগদান শান্ত পরিবেশকে উত্তেজিত করে তুললো। আত্মিকা মাত্র ক্লাস শেষ করে বেরিয়েছে। হৈ হুল্লোড়, চেঁচামেচি শুনে ঘাবড়ালো সে। তাসনুভা একটি ছুটন্ত মেয়ের হাত ধরে শুধালো,
“হয়েছে কি?”
“খেলা নিয়ে মারপিট। একজন মাথা ফাটিয়ে দিয়েছে। স্যার এলো বলে। বাহিরের লোক ও আছে। তোমরা বাড়ি চলে যাও”

আত্মিকা আতংকিত হলো মেয়েটির কথায়। এই মারপিট তার নিতান্ত অপছন্দ। ফলে এমনটা কানে আসতেই উত্তেজনা বাড়লো তার। ত্রাস, ভয়, আতংক ঘিরে ধরলো। দিকবিদিক দেখলো রিক্সার খোঁজে। ঠিক তখন ই একটা বলিষ্ট হাত তার কবজি চেপে ধরলো। ভয়ে পাশে ফিরলো সে। কিন্তু মানুষটিকে দেখে ভয়ের মেঘগুলো উবে গেলো। রাইয়ান তার হাত ধরে রীতিমতো গেটের দিকে হাটতে লাগলো। আত্মিকা বলল,
“কোথায় নিয়ে যাচ্ছেন আমাকে?”
“গ্যাঞ্জামের মধ্যে থাকবেন? থাকলে থাকুন”

বলেই হাতটি ছেড়ে দিল সে। আত্মিকা হতবাক চেয়ে রইলো তার দিকে। কথা হাতড়ালো, কিন্তু খুজে পেল না বলার মতো কিছু। তার মুখখানা মিয়ে গেলো। মিনমিন করে বলল,
“আমাকে একটু বের করে দেন গেট থেকে”

রাইয়ান নির্বিকার চিত্তে বললো,
“কেনো? আমার কি ঠেকা?”
“অনুরোধ হিসেবে নিন”

সাথে সাথে তাসনুভা বলে উঠলো,
“ভাইয়া, বিপদে পড়েছি। ঝগড়া ঝাটি পড়ে করেন। এখন আমাদের একটু এই ঝামেলা থেকে বের করে দিন”

রাইয়ান এবার কোনো কথা বললো না। শুধু হাতটি চেপে ধরলো আত্মিকার। তারপর পা বাড়ালো গেটের দিকে। তাসনুভাকে একটি রিক্সায় তুলে দিয়ে একটা রিক্সায় উঠতে বললো আত্মিকাকে। এর পর বললো,
“চাপেন”
“কেনো?”
“আমি বসবো”

আত্মিকা কিছু না বলেই চেপে বসলো। এখন তর্ক করবে না সে। এমনেই তখনের মারপিটে বুক কাঁপছে। রাইয়ান পাশে থাকলে ভয় করবে না। রিক্সায় বসতে বসতেই পকেট থেকে সিগারেটের প্যাকেটটা বের করলো রাইয়ান। গলা ঝাড়া দিয়ে বলল,
“বেয়াদবি ক্ষমা করবেন”

বলেই সিগারেট জ্বালালো সে। এমন নির্বিকার চিত্তে পুরু ঠোঁটের ভাজে রেখে সুখটান দিলো। ভস ভস করে ছাড়লো সাদা ধোয়া। আত্মিকা ভ্রু কুঞ্চিত করলো। নাকের পাটা ফুললো তার। হিনহিনে স্বরে বললো,
“আপনি আবার সিগারেট খাচ্ছেন? এমন তো কথা ছিলো না”
“হ্যা, আমার জীবনে সিগারেট প্রেমিকার সমতুল্য। একনিষ্ঠ বন্ধু। তবে হ্যা, যদি আমার প্রেমিকা আমাকে সিগারেট ছেড়ে দিতে বলে তাহলে আমি কোনো প্রশ্নবিহীন তা ছেড়ে দিবো। কারণ আমার প্রেমিকার জন্য আমি সব করতে পারি। কিন্তু আপনি আমার প্রেমিকা নন। আর পাঁচটা সাধারণ মেয়ের মতোই আপনি। সুতরাং আপনার কথা শুনতে ইচ্ছে হচ্ছে না”

রাইয়ানের দায়সারা কথায় দাঁত দিয়ে ক্ষতবিক্ষত করলো ঠোঁট। রাগ হলো তার। ভার স্বরে বলল,
“এতো তাড়াতাড়ি উবে গেলো ভালোবাসা?”

আত্মিকার প্রশ্নে ঘাড় কাত করে তাকালো রাইয়ান। মৃদু হাসলো। তারপর বললো,
“না, ভালোবাসা উবে নি। এখনো সংগোপনে সঞ্চিত রেখেছি। কিন্তু আমি সেটা আর প্রকাশ করবো না। কারণ এই ভালোবাসাটা কেবল আমার নিজস্ব। তার দায়ভার আপনার উপর চাপানো অন্যায়”

রাইয়ানের দিকে ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে রইল আত্মিকা। কথা গুলো যেনো নদীর স্রোতের সাথে ভেসে গেছে। সেই সাথে চিনচিনে ব্যাথাটা তীব্র হলো। অহেতুক রাগ হলো, কষ্ট হলো। কিন্তু কারণ হাতড়ে শুন্যতা ছাড়া কিচ্ছু পেলো না।

******

পৃথুল আজ আরশিয়াকে নিজে নিতে এসেছে কলেজে। সারপ্রাইজ দেবার পরিকল্পনা আছে। এমন ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র সারপ্রাইজ তার বউ খুব ভালোবাসে। বিল্ডিং এর বাহিরেই দাঁড়িয়ে ছিলো। ঠিক তখন ই কানে ভেসে এলো পরিচিত কণ্ঠ,
“কেমন আছো পৃথুল?”………………

চলবে