তোমার আমার চুপকথা পর্ব-০৭ এবং শেষ পর্ব

0
399

#তোমার_আমার_চুপকথা
#অন্তিম_পর্ব (প্রথম অংশ)
কপি করা নিষিদ্ধ❌

কিন্তু ততটা প্রতীক্ষা করাল না রাইয়ান। কোমড় শক্ত করে ধরে উঁচু করে তুললো আত্মিকাকে। আত্মিকার তার এমন কাজে চোখ বড়বড় করে চাইলো। সেই বিস্ময়কে বাড়িয়ে দিলো আরোও একটি সাংঘাতিক কাজ যখন পুরুষালি এক জোড়া ঠোঁটের ভাজে খাবি খেল তার পাতলা অধর। উত্তপ্ত ঠোঁটজোড়া শুষে নিতে চাইলো প্রতিক্ষীত সেই সময়ের যন্ত্রণাগুলো। কি নিদারুণ সেই আকাঙখা। কি প্রগাঢ় সেই স্পর্শ। হতবাক আত্মিকার হৃদস্পন্দন সকল দায়রা গুড়িয়ে দিলো যে। বুক কাঁপছে। হাত পা অবশ হয়ে এলো। তৃষিত হৃদয়ের তৃপ্তি মিটিয়ে উন্মুক্ত হলো পাতলা অধরজোড়া। তাকে শুন্য থেকে মাটিতে নামালো রায়হান। বেহায়া পুরুষের চোখে মুগ্ধতা। ঠোঁট চিরে উদিত হয়েছে মনোমুগ্ধকর হাসি। আত্মিকার নিজেকে ধাতস্থ করতে সময় লাগলো। তটস্থ স্বরে বললো,
“এটা কি হলো?”

আত্মিকার বিমূঢ় প্রশ্নে রাইয়ান কেবল ই হাসলো। মিহি স্বরে প্রগাঢ় উল্লাসে বললো,
“সামান্য অসভ্যতা, রাগ করলেন? আমি ক্ষমা চাইবো না। বহুকাঙ্ক্ষিত সাধ পূরণ হলে মানুষ পাগল হয়ে যায়। আমিও হয়তো পাগল হয়ে গেছি। আর পাগলে কি না করে!”

কি যুক্তি। আত্মিকার পলক পড়লো না। নিষ্পলক চোখে মানুষটির উচ্ছ্বাসিত মুখশ্রীর দিকে চেয়ে রইলো। কি উজ্জ্বল লাগছে। কালচিটা পড়া পুরু ঠোঁট জোড়ার সুধা পান করেছে সে। ভাবতেই শিরদাঁড়া বেয়ে নেমে এলো উষ্ণ রক্তস্রোত। হৃদয়টা পিঞ্জর ভেঙ্গে বের হয়ে গেলো বুঝি। লজ্জার নেত্রপল্লব ঝুঁকে এলো। আত্মকেন্দ্রিক মেয়েটার জীবনের কেন্দ্রবিন্দু পাল্টেছে। অবশেষে বড়বোনের আখ্যায়িত শক্ত খরখরে টোস্ট বিস্কুট রাইয়ান নামক মিষ্টি চায়ে একটু একটু নয় সম্পূর্ণ গলে গেছে। ভাবা যায়!

রাইয়ান আলতো হাতে তার গালজোড়া ছুলো। প্রগাঢ় স্বরে বললো,
“আমার অসভ্যতায় লজ্জা পেলেন বেয়াই? আপনার লজ্জায় রাঙ্গা মুখশ্রী দেখে অসভ্যতার মাত্রাটা আরেকটু বাড়াতে ইচ্ছে করছে।”
“মানে?”

বিস্ফারিত চোখে তাকালো আত্মিকা। রাইয়ানের ঠোঁটে দুষ্টু হাসি। আত্মিকার মুখে তখন রাজ্যের কৌতুহল, সামান্য ভীতি আর আকাশ-সম লজ্জা। রাইয়ান কানের কাছে মুখখানা এনে খুব আস্তে বললো,
“আপনাকে তুমি বলার অসভ্যতাটা আজ থেকেই শুরু করতে চাই।”

“তুমি” সম্বোধনটি শুনতেই এক অদ্ভুত শিহরণ জাগলো। এই শিহরণের অনুভূতিটি অচেনা তার। রাইয়ানের মুখে তুমিটুকু এতোটা মায়াবী কেনো লাগছে? কেনো মনে হচ্ছে এই অনুভূতি থেকে সুন্দর অনুভূতি হয়তো আর কিছু হতে পারে না। আত্মিকা টের পেলো, কিছুদিন পূর্বেও বিরক্তির সারিতে রাখা মানুষটি আজ তার প্রিয় এর তালিকার একজন। কখনো প্রেম করতে না চাওয়া মানুষটি আজ প্রেমের তরীতে গা ভাসিয়েছে ভাবতেও অবাক লাগছে আত্মিকার। প্রেম কি এমন ই! নিঃশব্দে হাসলো আত্মিকা। মৃদু স্বরে বললো,
“আপনি কি জানেন আপনি একটা পাগল?”
“জানি! আর এই পাগলের পাল্লায় পড়েছো আত্মিকা।”
“পালানোর সুযোগ আছে কি?”
“পালানোর ইচ্ছে জাগছে বুঝি? সেই সুযোগ নেই। একবার ছাড় দিয়েছি মানে বারবার দিবো এটা তোমার ভুল। এখন সম্পর্কটি মেকি নেই। এখন তুমি আমার সত্যি সত্যি প্রেমিকা।”

তুমি শব্দটি কি সবসময় এমন মিষ্টি ছিলো? নাকি রাইয়ানের কণ্ঠে তার মিষ্টতা বৃদ্ধি পেয়েছে বুঝতে পারলো না আত্মিকা। তবে ভালো লাগছে। খুব বেশি ই ভালো লাগছে।

*****

পৃথুল দাঁড়িয়ে আছে বারান্দায়। তার চোখ বৃষ্টিস্নাত মৃদু হাওয়ায় দোদুল্যমান নীল অপরাজিতার দিকে। মা কখনো অপরাজিতা লাগান না। তার কাছে ফুলটি অহেতুক মনে হয়। শুধু গাদাখানেক পাতা আর পাতা। তার মাঝে উঁকি দেওয়া স্বল্প পরিসরের নীল রঙ কার ভালো লাগে! কিন্তু এই স্বল্প নীল রঙ্গের জন্য মরিয়া তার প্রিয় মানুষটি। তাই নিজেই অপরাজিতা গাছ লাগিয়েছে পৃথুল। বারান্দার রেলিং লেপ্টে সাপের মতো বেড়ে চলেছে অপরাজিতা গাছ। ফুল হয়েছে বেশ। রেকর্ড ব্রেকিং বর্ষা শেষে স্নাত পাতা গুলো বেশি সবুজ লাগছে যেনো। এমন সময় আগমণ ঘটলো আরশিয়ার। হাতে চায়ের ট্রে। দুটো কাপে দুজনের জন্য চা। চায়ের কাপ এগিয়ে দিলেই পৃথুল অবাক কণ্ঠে বললো,
“চা কেনো? আমি তো চা খাই না”
“জানি, আজ খাবেন।”
“কফি শেষ হয়ে গেছে? কোহিনুরকে বললেই ও এনে দিতো”
“কফি আছে। কিন্তু আজ আপনি চা ই খাবেন”

আরশিয়া কথায় বেশ অবাক হলো পৃথুল। আরশিয়া কখনো তাকে জোর করে না। তবে আজ কেনো? আরশিয়া এবার থমথমে স্বরে শুধালো,
“আপনি কি ভুলে গেছেন সাংবাদিক আজ কি?”
“আজ কি?”
“আপনি ভুলে গেছেন?”

আরশিয়ার হতভম্ব স্বরে কিছুটা বিচলিত হলো পৃথুল। আজ কি! তার সত্যি ই মনে নেই। তাদের এনিভার্সারি চলে গিয়েছে গত মাসে। আজ আরশিয়ার জন্মদিন ও নয়। তাহলে আজ কি! বিয়ের এক বছর পরও আরশিয়ার চুপকথাগুলো পড়ে উঠতে পারে না পৃথুল। আরশিয়াও তাকে ভিন্ন ভিন্ন পরীক্ষায় ফেলে। পৃথুল বেশ অনুতাপী স্বরে বললো,
“আমি সত্যি ই জানি না আরশিয়া! আজ কি?”
“জানা লাগবে না”

বলেই অভিমানিনী চায়ের ট্রে টা ধপ করে বারান্দার ছোট্ট টেবিলে রেখে দিলো। প্রস্থান করলো সে নিজ ঘরে। এদিকে মস্তিষ্কের প্রতিটি নিউরণ ব্যাস্ত হয়ে উঠলো। উত্তেজিত হলো উত্তর খোঁজার। এমন সময় আগমণ ঘটলো রাইয়ানের। তাকে বেশ কুন্ঠিত দেখালো। পৃথুল কিছু জিজ্ঞেস করার পূর্বেই সে বলে উঠলো,
“আমার তোর সাহায্যের প্রয়োজন ভাই”…..

চলবে

#তোমার_আমার_চুপকথা
#অন্তিম_পর্ব (শেষ অংশ)
কপি করা নিষিদ্ধ❌

রাইয়ানকে বেশ কুন্ঠিত দেখালো। পৃথুল কিছু জিজ্ঞেস করার পূর্বেই সে বলে উঠলো,
“আমার তোর সাহায্যের প্রয়োজন ভাই”

পৃথুলের দৃষ্টি সরু হলো। কন্ঠে গাম্ভীর্যের ছলকানি অটুট রেখে শুধালো,
“কি হয়েছে?”
“আজকে আত্মিকা আমাকে তাদের বাসায় ডেকেছে। ওর আব্বার সাথে কথা বলার জন্য”

রাইয়ানের কপালের প্রগাঢ় ভাঁজের কারণ এবার স্পষ্ট হলো পৃথুলের। আত্মিকা, আরশিয়ার বাবা অর্থাৎ পৃথুলের একমাত্র শ্বশুর হাসান সাহেবকে সে এই দু বছরে যতটুকু চিনেছে সেই অনুযায়ী মানুষটি সম্পর্কে এক শব্দে বিবরণ দিতে বলা হলে সে বলবে উনি ঘাউড়া। প্রচন্ড জেদী এবং একগুয়ে। এখনো পৃথুলের মনে আছে, তার বিয়ের সময়ের কান্ড। আরশিয়া যদি না চাইতো তবে কখনো আরশিয়ার সাথে বিয়েটা হতো না। অবশ্য সেজন্য আরশিয়াকেও শাস্তি দিতে সে ভুলে নি। টানা একমাস কথা বলে নি। পৃথুলের এখনো মনে আছে সেদিনের কথা যেদিন তাকে প্রথম জামাতা হিসেবে মেনে নিয়েছিলেন। আলাদা করে ডেকে নিয়ে গিয়েছিলেন তার ঘরে। পৃথুল ভীতু মনে তার সাথে গিয়েছিলো। হাসান সাহেব তাকে বসতে বললেন। পৃথুল বসতেই বিনা ভনীতায় বললেন,
“তুমি নিশ্চয়ই জানো আরশিয়া, আত্মিকা এবং আনহা মাতৃহীন”
“জি”
“এও জানো, আমার কাছে আমার মেয়েরা এক একটি হিরের খনি”
“জি”
“বাংলাদেশে একটা কুৎসিত প্রথা আছে। মেয়েদের বিয়েকে তারা ভাবে সবচেয়ে বড় কাজ। আর একবার বিয়ে হয়ে গেলে তাদের সম্পূর্ণ দায়িত্ব গা থেকে ঝেড়ে ফেলে। আমি কিন্তু এমন পিতা নই। আমার কাছে আমার মেয়ে মৃত্যুর আগ অবধি আমার মেয়ে, মানে তার সুখ-দুঃখের সব কিছুর দায় আমার। কালেভাদ্রে হ্যালো হাই করার ইচ্ছে আমার নেই। আমার কাছে তার হাস্যোজ্জ্বল মুখটা বেশি প্রাধান্য। তাই তোমাকে একটা কথা বলে রাখি। আরশিয়াকে সুখে রাখবে। তার চোখে যদি তোমার কারণে অশ্রু আসে তাহলে আমি তোমার থেকে হিসেবটা বুঝে নিবো। তাও সুদে আসলে”

লোকটি শান্ত গলায় কথাগুলো বলছিলো। কিন্তু পৃথুলের কাছে মনে হচ্ছিলো, কেউ তার দিকে বন্দুক তাক করে আছে। এদিক ওদিক হলেই ফায়ার। সেই দিনের পর থেকে তার ভালো করেই ধারণা হয়ে গেছে নিজ শ্বশুর সম্পর্কে। এই কারণেই যখন জেনেছিলো রাইয়ান আত্মিকাকে ভালোবাসে, সে ভয় পাচ্ছিলো। পৃথুল চিন্তিত স্বরে বললো,
“এই প্রস্তাবটি আসার হেতু কি? উনি কি জেনে গিয়েছে তুই তার মেয়েকে পছন্দ করিস?”
“আ…আসলে, একটা কান্ড ঘটেছে”

আমতা আমতা করে কথাটা বললো রাইয়ান। কান্ডের বিবরণ দিতে যেয়ে মুখখানা আরোও পাংশুটে বর্ণ ধারণ করলো। কিছুদিন পূর্বের কথা, রাইয়ানের পড়াশোনা প্রায় শেষের দিকে। শুধু থিসিসের ডিফেন্সটুকু বাকি। সেই সাথে তার একটি ছোটখাটো কোম্পানিতে চাকরি হয়ে গিয়েছে। বেতনও খুব খারাপ নয়। সেই খুশিতে আত্মহারা হয়ে সে একটা মারাত্মক কাজ করতে গিয়েছিলো। মনোস্থির করেছে আত্মিকাকে সে বিয়ের জন্য প্রপোজ করবে। তাই সাংঘাতিক সাংঘাতি চিন্তা করেছে সে। অবশেষে সাতটি চিন্তা নদীতে ভাসিয়ে শেষমেশ একটি অভিনব পদ্ধতি বেছে নিলো। শুধু অপেক্ষা রইলো আত্মিকার আগমনের।

বিকেলের শেষলগ্ন। এক আকাশ নীলচে রঙ আর মুঠোভরা সোনালী কিরণ একাকার হয়ে আছে। বুড়ো বট গাছটির নিচে অপেক্ষারত আত্মিকা। যে মানুষটির জরুরী তলব সেই মানুষটিই আসে নি। প্রতীক্ষার প্রহর ঘন হল, ধৈর্য্যের বাধ ভাঙলো। ঠিক তখন ই আগমণ ঘটলো মানুষটির। হাপাতে হাপাতে এলো সে, শার্ট ঘামে ভিজে লেগে আছে সুতনু দেহে। আত্মিকার সামনে দাঁড়াতেই অনুনয় করতে করতে বলল,
“সরি সরি দেরি হয়ে গেলো। অনেক সময় অপেক্ষা করালাম তাই না?”
“সেটা বাদ দাও, কোথায় ছিলে এতোসময়?”

আত্মিকার “আপনি” টি এই কদিনে “তুমি” তে রুপান্তরিত হয়েছে। শুধু তুমি বললে ভুল, বেশ আন্তরিক তুমি। রাইয়ান মুচকি হাসলো। এগিয়ে দিলো একটি ম্যাগাজিন। ভার্সিটির পার্সোনাল ম্যাগাজিন। প্রতিবছর এটা বের হয়। এখানে ভার্সিটির বাৎসরিক উন্নয়নের সকল বর্ণনা থাকে। শুধু তাই নয়, ভার্সিটি থেকে কৃতী ছাত্রদেরও সম্মাননা দেওয়া হয়। আর যারা সদ্য বিদায় নিবে তাদের থেকে দু এক বানী নিয়ে ছাপানো হয়। রাইয়ান ও তার মাঝে একজন। কলেজের সকল সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানাদির পরিচালক এবং ক্লাবের জেনারেল সেক্রেটারী হিসেবে তার ইন্টারভিউটি ঘটা করেই নেওয়া হয়েছে। সেই ইন্টারভিউ এর পাতাটি বের করে এগিয়ে দিলো আত্মিকার কাছে। খানিকটা ভয়, আনন্দ, উচ্ছ্বাসের সংমিশ্রণে বললো,
“পড়”

পাতাটিতে চোখ বুলাতেই রাইয়ানের ভিসি হাত থেকে সার্টিফিকেট নেওয়া হাস্যজ্জ্বল ছবিটি নজর কাড়লো। আত্মিকার পাতলা ঠোঁটে নিখাঁদ হাসি ফুটে উঠলো। উচ্ছ্বাসিত স্বরে বললো,
“তোমার ইন্টারভিউ ছেপেছে?”
“নাহ, আমার খালাতো ভাইয়ের। অবশ্যই আমার ইন্টারভিউ ছেপেছে। এটার জন্যই লেট হচ্ছিলো। তুমি পড়ো না, দেখো না কেমন হয়েছে?”

আত্মিকা যেই না ম্যাগাজিনটি হাতে নিবে অমনি কোথা থেকে উৎসাহী জনগনের আগমন ঘটলো। তাদের মাঝে ইসমাইল ভাই তো আছে। সাথে পারভেজ, তাসনুভা এবং মোটামুটি আত্মিকা এবং রাইয়ানের পরিচিত সকলেই আছে। ইসমাইল ভাই এসেই পিঠে চাপড় বসালো রাইয়ানের পিঠে। আৎকে উঠলো সে। লোকটি ঠিক ই তাদের খুজে চলে এলো। অথচ রাইয়ানের পরিকল্পনা ছিলো এই পঙ্গপাল থেকে বিরত থেকে কিছু একটা করবে। কিন্তু হলো না। ঠিক ই সবাই চলে এলো। এদিকে রাইয়ানের মুখখানা চুপসে গেলো। আমতা আমতা করে বললো,
“তোমরা এখানে?”
“আর কি করার, তোকে যে মতিনের টঙ্গে ডাকলাম পাত্তা দিলি নি। তাই আমরাই চলে এলাম। এসে দেখি রোমিও জুলিয়েট প্রেমে মগ্ন। শোনো প্রেম করার সময় অনেক আছে। ডিফেন্স শেষ হলেই যে যার জায়গায়। তাই তোমায় আমরা এখন ছাড়ছি না, চলো ট্রিট দিবে। চাকরি পেয়েছো একটা ট্রিট প্রাপ্য আমাদের”

ইসমাইল ভাইয়ের কথায় বিপাকে পড়লো রাইয়ান। তাদের ভাগানোর কোনো বুদ্ধিও খেলছে না মাথায়। উপর থেকে তার প্রেমিকা এক কাঠি উপরে কাজ করলো। উৎসাহী জনতাকে আরোও উছকে দিয়ে বললো,
“ইসমাইল ভাই, আমরা প্রেম করছিলাম না। আসলে রাইয়ানের ভার্সিটি ম্যাগাজিনে ইন্টারভিউ ছেপেছে। ঐটাই পড়ছিলাম। দেখুন”

বলেই ম্যাগাজিনটি এগিয়ে দিলো আত্মিকা। এদিক রাইয়ানের ছটফটানি শুরু হলো। খপ করে ইসমাইল ভাইয়ের হাত ধরে বললো,
“ভাই এটা এমন কি, ফালতু ইন্টারভিউ”
“হাফ, কিসের ফালতু। তুমি হলে ভার্সিটির প্রখ্যাত ছাত্র। তোমার ইন্টারভিউ ফালতু হয়?”

বলেই ইসমাইল ভাই ম্যাগাজিনটা হাতে নিলেন। তার কন্ঠে গদগদ ভাব। বেশ প্রফুল্লতার সাথে ইন্টারভিউটি পড়তে লাগলেন,
“আসসালামু আলাইকুম, আমি রাইয়ান ইকবাল। আমি চতুর্থ বর্ষের ছাত্র। সামনেই ডিফেন্স এরপর ই এই প্রাঙ্গনকে বিদায় নেবার পালা। সত্যি বলতে এই চারটে বছর আমার জীবনের স্মরণীয় মুহূর্ত হিসেবে স্মৃতির পাতায় উঠে আছে। আমার এখনো মনে আছে আমি তখন ফ্রেশী। সিনিয়রদের চাপে পড়ে ক্লাবে জয়েন করতে হয়েছিলো। অচেনা পরিবেশ, অচেনা মুখ। ইচ্ছে ছিলো সকলের মাঝে নিজের একটি ছাপ ছাড়া। পেরেছি কি না জানি না, তবে এই ক্লাব এবং ভার্সিটির জুনিয়র, সিনিয়র, বন্ধু সবাই আমার মাঝে একটি ছাপ ছেড়ে গেছে। আজ আমাকে যতটা পার্ফেক্ট মনে হয় আমি তাদের কারণেই। শিক্ষকদের কথা কি বলব, আমি ইহজনমে ভালো ছাত্র ছিলাম না। তবুও তাদের ভালোবাসা কম পাই নি। হয়তো এক্সট্রা কারিকুলামের জন্যই, সবাই আমাকে চিনে। এই ভার্সিটি আমাকে অনেক কিছু দিয়েছে। বন্ধু, পরিচিতি, ভালোবাসা। এমন কি আমার নিরেট হৃদয়ে রাজত্ব করা মনোহরিণীকেও। হয়ত সে আমার পাশে বসেই আমার এই ইন্টারভিউটি পড়ছে। তাকে একটা প্রশ্ন করার আছে। জানি এটা হয়তো পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর প্রশ্নটি সবচেয়ে উদ্ভটভাবে করা হচ্ছে। তবুও তোমাকে বিস্মিত করার এর চেয়ে সুন্দর মুহূর্ত হয়তো পাবো না। আত্মিকা শুধু একটাই প্রশ্ন বিগত তিন চার মাস যাবৎ করার জন্য হন্যে হয়ে আছি। তুমি কি আমাকে বিয়ে করবে?”

ইসমাইল ভাই বেকুবের মত চেয়ে রইলো। এদিকে উপস্থিত সকলের চোখ বিস্ফারিত। উপরন্তু আত্মিকা নিজেই বিমূঢ় হয়ে চেয়ে আছে রাইয়ানের দিকে। রাইয়ান অপ্রস্তুতের মতো হেসে বলল,
‘করবে বিয়ে আমাকে?”

রাইয়ানের দিকে হতবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে পৃথুল। চোখে মুখে বিশাল অবিশ্বাসের হাতছানি, সেই সাথে আফসোস ও রয়েছে। হতাশ স্বরে বললো,
“এতো ভেবে এই ছিলো অভিনব পরিকল্পনা। বাপের জন্মে এতো বিচ্ছিরি আর ফালতুভাবে প্রপোজ করতে কাউকে দেখি নি। আত্মিকা কি বললো?”
“প্রপোজ করলো ইসমাইল ভাই। তাসনুভার চাপে পড়ে সে হ্যা করে দিলো। এর পর সাতদিন কথা হয় নি। সাতদিন বাদে জানালো হাসান আংকেল দেখা করতে চান। ভাইয়া, আমাকে সাহায্য কর”

পৃথুল বিশাল এক নিঃশ্বাস ছাড়লো। বিরক্ত স্বরে বললো,
“নিজের অবস্থা কেরোসিন। তোকে কি সাহায্য করবো। যাক গে, শুধু এটুকু মনে রাখবি, হবু শ্বশুর একজন নিতান্ত খচ্চর ব্যাক্তি। শুধু হ্যা তে হ্যা মিলাবি। তার দূর্বল অংশ তার কন্যারা। আর তুমি তাকেই বিয়ে করতে চাইছো। সুতরাং তোমার একটাই বাক্য হবে, “আমি আপনার মেয়ের প্রতি নিবেদিত প্রাণ”

****

বিকেলের কমলা আকাশ সাদা মেঘের বিক্ষিপ্তভাবে ঘুরে বেড়াচ্ছে। অস্তগামী সূর্যের সাথে সাথে জনজীবনে ক্ষাণিকটা বিরতি। শীতল সমীরে দুলছে কেঁচি গেটের লাগওয়া কাগজী ফুলের গাছটি। হাতে চমচম আর রসমালাই এর প্যাকেট হাতে কেঁচি গেটের বাহিরে দাঁড়িয়ে আছে রাইয়ান। দোয়া দরুদ পড়ে বুকে ফু দিলো তিনবার। তারপর বিসমিল্লাহ বলে প্রবেশ করলো সে। দুশ্চিন্তার মেঘ চেপে আছে হৃদয়। একটু সিগারেট খাওয়া হলে মন্দ হতো না। কিন্তু আত্মিকার সাথে প্রেম করার পর থেকে সে সিগারেট ছোঁয় না। কারণ আত্মিকা বলেছিলো, “ওই ঠোঁট সিগারেট ছুঁলে আমি ঐ ঠোঁটে চুমু খাবো না”— প্রেমিকার জেদের কাছে হাটু ভাঙ্গলো তার। যতই হোক বহুপ্রতীক্ষিত স্বজনী সে। দুরুদুর বুকে কলিংবেল চাপতেই আনহা দরজা খুললো। মেয়েটি তাকে দেখে দাঁত বের করে হাসলো। আনহা মেয়েটি বাকি দু বোন থেকে অনেক আলাদা। আত্মিকা এবং সে একেবারে চুম্বকের নর্থ আর সাউথ পোল। রাইয়ানকে আপাদমস্তক দেখে বললো,
“হবু দুলাভাই কি ইন্টারভিউ দিতে এসেছেন? এমন গলাছ্যালা মুরগীর মতো টাই ঝুলিয়েছেন কেন?”

পরিপাটি হয়ে আসার তাগিদায় একেবারে অতিরিক্ত সাজসজ্জা হয়ে গেলো কি! আমতা আমতা করে রাইয়ান বললো,
“হাসান আংকেলের সাথে প্রথম এভাবে দেখা তো?”
“তা মিষ্টি কি ঘুষ?”
“না না, একটু সৌজন্যতা”
“বেশি করবেন না। বাবা কিন্তু অতি ভদ্রতা পছন্দ করে না। একেবারে খ্যাক করে ধরে টাটা বলে দিবে”

রাইয়ানের মুখ শুকিয়ে গেলো। রাইয়ানের এমন বাংলার পাঁচের মতো মুখখানা দেখে হি হি করে হেসে উঠলো আনহা। এর মাঝেই আত্মিকা এলো। অবাক স্বরে বললো,
“তুমি বাহিরে দাঁড়িয়ে আছো কেনো? ভেতরে আসো”

আত্মিকা তাকে বসার ঘরে বসতে বললে রাইয়ান ফিসফিসিয়ে শুধালো,
“আমাকে কি গলা ছ্যালা মুরগী লাগছে?”
“নাহ, আস্তো হুতুমপেঁচা লাগছে।“
“হ্যা?”
“আমি মজা করছিলাম। এতো ভয় পাচ্ছো কেনো? আমার বাবা বাঘ না ভল্লুক?”
“ডাইনাসোর। ভাই বলেছে উনি কথা দিয়েও গুলি ছুঁড়েন”
“এমন কিছুই হবে না”

এমন সময় বসার ঘরে এলেন হাসান সাহেব। মুখখানা গম্ভীর। তাকে দেখে রাইয়ানের আত্মা আরোও শুকিয়ে গেলো। রাইয়ান তাকে দেখেই সালাম দিলো। সালামের উত্তরটাও হাসান সাহেব দিলেন গোমড়া মুখে। বসলেন একেবারে রাইয়ানের মুখোমুখি। নির্বিকারভাবে বললেন,
“কেমন আছো?”
“আলহামদুলিল্লাহ”
“মিষ্টি তুমি এনেছো?”
“জি”
“আমার ডায়াবেটিস আছে, জানতে না মনে হয়”
“জি না, আসলে”
“তুমি জানো আমি তোমাকে কেনো ডেকেছি?”
“জি, আবার না।“
“আত্মিকা বলে নি”
“বলেছে। কিন্তু কথাটা কি বিষয়ক হবে সে বলে নি”
“শুনেছি তুমি আত্মিকাকে ভালোবাসো? বিয়ে করতে চাও?”

রাইয়ান শুকনো ঢোক গিললো। গলা শুকিয়ে আসছে। দীর্ঘশ্বাস ফেলে মনোবল যোগাড় করে বলল,
“জি”
“তোমার বাসায় জানে?”
“আম্মা জানেন, আব্বাকে বলেছেন। চাচীও জানেন। আগামী সপ্তাহে দেখতে আসতে চাইছিলেন”
“তোমাকে একটা সোজাসাপ্টা একটা প্রশ্ন করি, তুমি সত্যি নিজেকে আমার মেয়ের যোগ্য ভাবো?”

বাবার এমন প্রশ্নে আত্মিকাও অবাক হলো, প্রশ্ন করে বসলো,
“বাবা এমন তো কথা ছিলো না”

রাইয়ান তখন স্মিত হেসে বললো,
“না আংকেল, আমি সত্যি ওর যোগ্য নই। আমি সেটা জানি। কিন্তু হার মানতে পারছি না, আবার ওকে ভালো না বেসেও থাকতে পারছি না। অযোগ্য জেনেও তাকে পাওয়ার অদম্য ইচ্ছে আমার। প্রতিনিয়ত নিজের সাথে লড়াই করি, যেনো আত্মিকার যোগ্য না হলেও তাকে আগলে রাখার ক্ষমতা থাকে। এবং আমার এই চেষ্টা আজীবন থাকবে”

হাসান সাহেব সরু দৃষ্টিতে চাইলেন। কিছুক্ষণ পর মৌনতা ভেঙ্গে বললো,
“আত্মিকা ভালো চা বানায়।“
“জি”
“চা খাও?”
“জি”
“বেশ, তোমার মাকে বলো আগামী সপ্তাহে ব্যাস্ত থাকবো আমি। উনি যেনো এর পরের সপ্তাহে আসেন”

হাসান সাহেবের এমন কথায় বিমূঢ় দৃষ্টিতে চাইলো রাইয়ান। বুক থেকে পাহাড় নেমে গেলো যেনো। অবশেষে তার মনোহরিনী সম্পূর্ণরুপে তার আঙ্গিনায় আসবে।

****

সন্ধ্যের গন্ধ মিলিয়ে পূর্ণরাত্রি নেমেছে। রাইয়ান দাঁড়িয়ে আছে কেঁচি গেটের ওপারে। এপারে আত্মিকা। এবার যাবার পালা। কি মনে করে পিছু ফিরে তাকালো শুভ্র মুখে, প্রশ্ন ছুড়লো,
“আচ্ছা, সত্যি আমাকে তুমি বিয়ে করতে চাও?”
“হঠাৎ এই প্রশ্ন?”
“না সেদিন যেভাবে তোমাকে প্রপোজ করলাম! তাই সন্দেহ হচ্ছে”
“শুনুন রাইয়ান সাহেব এই সন্দেহ নদীতে ফেলুন। হ্যা যখন করেছি আমি পিছু হটছি না”
“শেষ সুযোগ কিন্তু?”
“ভয় দেখাচ্ছো?”
“উহু, সাবধান করছি। আমার থেকে নিস্তার হবে না কিন্তু। প্রেমিক যেমন, স্বামী হিসেবে দ্বিগুন বিরক্তিকর হব কিন্তু”

রাইয়ানের কথায় খিলখিল করে হেসে উঠলো আত্মিকা। রাত্রীর মৌনতা চুরমার হলো সেই প্রাণোচ্ছ্বল হাসিতে। রাইয়ান তখন পকেট থেকে একটি আংটির বাক্স বের করলো। হাটু গেড়ে আংটিটি এগিয়ে বললো,
“উইল ইউ ম্যারি মি?”
“ইয়েস”

অনামিকাতে সৌন্দর্য্য বাড়ালো আংটিটি। কপালে পুরু ঠোঁট চুমু গেলো স্বল্প ভাবে। কানে ফিসফিসিয়ে বললো,
“অপেক্ষা করো। পুরো গুষ্টি নিয়ে আসবো”

*******

ছাদে তখন শুনশান নীরবতা। লাইট জ্বলছে না। অথচ এখানেই পৃথুল ডেকেছে আরশিয়াকে। রান্নাঘরের কাজ শেষে আরশিয়া ঘরে এসেই দেখলো ঘরে কেউ নেই। সাংবাদিকের ল্যাপটপ খোলা। না বলে কোথাও যাবার মানুষ সে নয়। ফোন করতে যাবে তখন ই টি টেবিলের উপর ছোট্ট একটি চিরকুট নজরে পড়লো। সেখানে লেখা,
“ছাদে আসুন”

অন্ধকারে কোনো মতে ছাদের মধ্য বরাবর যেতেই জ্বলে উঠলো রুপালি মরিচবাতি। নিচে ফুলের পাপড়ি দিয়ে হার্ট বানানো। সামনে টাঙ্গানো প্লাকার্ড, “সরি”। আরশিয়ার অধৈর্য্য চোখ খুজছে পৃথুলকে। ঠিক তখন ই পেছন থেকে এক জোড়া সুঠাম হাত জড়িয়ে ধরলো তাকে। কানে কানে বললো,
“আমাকে কি ক্ষমা করা যায় শিক্ষিকা মহোদয়া?”
“আপনার মনে আছে?”
“থাকবে না? আজকের এই দিনে দুবছর পূর্বে আমাদের ভালোবাসার সূত্রপাত ঘটেছিলো। আপনাকে পূর্ণরুপে পেয়েছিলাম আমি।“

বলেই নিজের দিকে ঘোরালো আরশিয়াকে। তার কোমল হাতজোড়া মুঠোবদ্ধ করে বললো,
“ক্ষমা করেছেন?”
“না করে উপায় আছে? আমার চুপকথা বুঝে যাচ্ছেন এখন তো চাইলেও রাগ করে থাকা যায় না”
“আপনি আমার জীবনে আসার পর থেকে আমার জন্য প্রতিক্ষণ খুব মূল্যবান। তাই একটি দিনকে স্মরণ করে রাখতে চাই না। আমার জন্য আপনার সাথে কাটানো প্রতিটি ক্ষণ স্মরণীয়”

আরশিয়া এগিয়ে এলো তার কাছে। খোচা খোচা দাঁড়ি যুক্ত গালে কোমল ঠোঁট ছুয়ে বলল,
“আপনি সত্যি পাগল জানেন তো? যতবার অভিযোগের খাতা খুলতে চাই আপনি সেটায় লেখা সবকিছু মুছে ফেলেন মুহূর্তে। কিভাবে পারেন বলুন তো?”
“আপনি যেভাবে আমার জীবনের সকল জীর্ণতা মুছে ফেলেন, হয়তো সেভাবে”
“অল্প কথার সাংবাদিকের সাথে এখন তর্কতেও হেরে যাচ্ছি”
“তবে তর্কগুলো উঠিয়ে নিন। আজ শুধু থাক আপনি, আমি এবং আমাদের না বলা চুপকথা। কি খুব মন্দ হবে?”

আরশিয়া চোখ নামিয়ে নিলো। তাকে পাজাকোল করে তুলে নিলো পৃথুল। গন্তব্য নিজ ঘর। মানুষটিকে আবার নিজের করে পাবার তুমুল অভিলাষ ঘিরে ধরেছে তাকে। নরম শরীরটিকে বুকের সাথে মিশিয়ে রেখেছে পৃথুল। আরশিয়ার মুগ্ধ নয়ন দেখছে তাকে। ব্যক্ত কথা তো সবাই বুঝে কিন্তু তার সাংবাদিক তার চুপকথাও বুঝে। এটাই তার ভালোবাসার পূর্ণতা___

||সমাপ্ত||