তোর নামের রোদ্দুর ২ পর্ব-০৫

0
624

#তোর_নামের_রোদ্দুর-২
#লেখনিতে:মিথিলা মাশরেকা
পর্বঃ৫

সিফাত ভাইয়ার বাসরঘরে বিছানার নিচে পা ঝুলিয়ে সটান হয়ে শুয়ে আছেন শুদ্ধ ভাইয়া।কপালের ওপর হাত রেখে চোখ ঢেকে আছেন উনি।বাইরের নিয়মকানুন সেরে সীমা ভাবিকে নিয়ে এগোলাম ঘরের দিকে।এতোক্ষন ওখানে উনি ছিলেন না বলে স্বাভাবিকই ছিলাম।ভেবেছিলাম দরজা লক থাকবে,পৌছে দিয়েই চলে আসবো।কিন্তু সীমা ভাবি খামচে ধরে রেখে আমাকে আর যীনাত আপুকে।হাত ঘেমে গেছে ওর।ইতস্তত লাগছে।আবার সামনে শুদ্ধ ভাইয়ার ওই রুপে ভাবলেশহীনভাবে শুয়ে থাকাও দেখতে পারছি না।ইশান ভাইয়া বললো,

-এটা কেমন নিয়ম শালাবাবু?আমরা তো জানতাম দরজা লক থাকবে,তোমরা টাকা চাইবে,দিয়ে দেবে,চলে যাবে।দরজা খুলে রেখেছো,টাকা নেবে না নাকি?

ইমরোজ ভাইয়া দাত কেলিয়ে বললো,

-কে বললো টাকা নেবো না?কড়ায় গন্ডায় আদায় করবো টাকা।শুদ্ধ?হিসাবটা দে তো!

-কিসের হিসাব?বিয়ে করে ক্লান্ত আমি।কোনো আজাইরা ঝামেলা পাকাস না ইমরোজ!

-তাই বুঝি?তাহলে এক কাজ করো সিফাত ভাইয়া!আমরা এখানে থাকি,তুমি বরং আমাদের জন্য বরাদ্দ করা রুমটাতে ফুলটু নাক ডেকে ঘুমোও গিয়ে।কেউ ডিস্টার্ব করবে না।ওই ইনসু?যা তো!সীমা ভাবিকে তোর রুমে নিয়ে যা!আজ না হয় বাসরটা আমরা ব্যাচেলররাই….

তামিম ভাইয়ার কথা শুনেই সিফাত ভাইয়া সীমা ভাবির হাত ধরে ফেললো।সবাই জোরে হেসে দিলো একসাথে।আমি তখনও আড়চোখে শুদ্ধ ভাইয়ার শান্তশিষ্ট দেহটাকে বিছানায় পরে থাকতে দেখছি।নড়েচড়ে উঠতে দেখেই চোখ সরিয়ে নিলাম আমি।উনি বললেন,

-রিল্যাক্স গাইস!এতো সুন্দর করে রুম সাজালাম,আর সিফাত ভাইয়া অন্যঘরে চলে যাবে?নট ফর্সা!সিফাত ভাইয়া?এখানেই থাকবে তুমি।

-ওরে আমার পিউর ভাই!তুইই শুধু বুঝলি আমাকে।আয় বুকে আয়!

-ইয়ে মানে,জরিয়ে পরে ধরো,আগে হাতটা পকেটে ঢুকাও।টাকা ফেলো।দেন বউ নিয়ে বাসর করো।

-ও।বুঝেছি।তোদের সরকারী অফিসের জব এপ্লাইয়ের মতো চা নাস্তা চাই তাইতো।?আচ্ছা!এই নে,পাঁচ হাজার টাকা।জানি আমার ছপটভাই তোরা,আরো কমও চাইতি,তবুও নে।এতো তাড়াতাড়ি বুঝে গেছিস জন্য বেশিই দিলাম কিছুটা।

-আহা!আজ এভাবে আমাদের ভাই বলছো যে সিফাত ভাইয়া?এই গ্রান্ড বাসর ঘরের জন্য পাঁচ হাজার টাকা!এটা ভ্রাতৃত্ববোধ?নাকি কিপ্টামো?

-দেখ তামিম,তোর সাথে কথা বলছি না আমি।আমিতো শুদ্ধকে….

-শুদ্ধ এবার কিছু বলুক তবে?

-হ্যাঁ হ্যাঁ।বল না?আরো কিছু লাগবে?ওকে যা।দেনমোহরের উপরের এক টাকা টার মতো এখানেও পাঁচ হাজার এক টাকা ধার্য করলাম।যদিও খুচরা নেই এখন আমার কাছে।ও দিয়ে দেবো একসময়।

-এনাফ অফ ইউর সুইট ভাষন!একদম থুতু দিয়ে গুনে গুনে পঞ্চাশ হাজার টাকা ফেলো,চলে যাচ্ছি।

বিস্ময় নিয়ে তাকালাম শুদ্ধ ভাইয়ার দিক।কথাটা বলে পায়ের উপর পা তুলে একটা মাসুম হাসি দিয়ে পা নাড়াতে লাগলেন উনি।আশেপাশে সিফাত ভাইয়া বাদে বাকি সবার চেহারা স্বাভাবিক।সিফাত ভাইয়া জোর করে হাসার চেষ্টা করে বললো,

-হোয়াট আ জোক শুদ্ধ!বাসর ঘরে এমন জোকস্ না শুনলে জমে না।তুই ভাই….

-একবিন্দু মজা করেনি শুদ্ধ সিফাত ভাইয়া।দাও টাকা দাও,কেটে পরি।

-তুই চুপ থাক!শালা ঘরের শত্রু বিভীষন।তোর মতো ভাই থাকার চেয়ে না থাকা ভালো!

-উহুম উহুম!দেখো সিফাত,টাকা‌ এখন হোক আর দু চার ঘন্টা বার্গেইনিংয়ের পরে হোক,দিতে তো হবেই।সো,এটাই ভালো হবে তুমি এখনই দিয়ে দাও টাকাটা।

-কি বলছেন কি ইশান ভাইয়া?তাপসী আপুকে নিয়ে ঘরে ঢোকার সময় যে সাত হাজারে নামিয়েছিলেন তা কি আর জানিনা আমি?আজ আমি বউ নিয়ে ঘরে ঢুকবো আর আমাকে কি না পঞ্চাশ হাজার টাকা দিতে বলছেন?

-এতো কথা কেনো হচ্ছে ভাই?কষ্ট করে ঘর সাজিয়েছি,টাকা দাও,কেস ক্লোসড্!

-হ্যাঁ।ঠিকই তো!ইমরোজ ঠিক বলেছে একদম।দাও টাকা!

-তুই চুপ করে থাকবি শুদ্ধ?কিছু বলবি না?

-বলবো তো!লিসেন,ফুলটুল কিনতে লেগেছে দশ হাজার,আমরা কষ্ট করেছি দশ হাজারের,সময়ের দাম বিশ হাজার,আর তোমাকে বাইরে দাড় না করিয়ে ভেতরে ঢুকে এতো সুন্দর ভিউটা দেখতে দিলাম তাই দশ হাজার।আসলে কি বলোতো ইশান ভাইয়া,এই দশ হাজারের জন্যই রুম খোলা রেখেছিলাম।

-লাগবে না আমার বাসর ঘর।চলো সীমা!

এবার তাপসী আপু টেনে ধরলো সীমা ভাবিকে।বললো,

-তুই টাকা দিবি না,তুই যা।সীমা এখানেই থাকবে।

-কারেক্ট!সীমাকে আজ তুই পাচ্ছিস না সিফাত!

-এসব কি যীনাত আপু?ওরা দুজনেই টায়ার্ড।এভাবে আর কতোক্ষন?

সবাই আমার দিকে তাকালো।শুদ্ধ ভাইয়ার দৃষ্টিও আমাতেই স্থির।তাপসী আপু বললো,

-তুই এটা বলছিস?

-ঠিকই বলছি।কোথাও শুনেছো,বাসর ঘরে পঞ্চাশ হাজার টাকা দিয়ে ঢোকে কেউ?আবদার করলে,আর হয়ে গেলো?

আড়চোখে দেখলাম শুদ্ধ ভাইয়া চোয়াল শক্ত করে বসে আছেন।রাগ স্পষ্ট তার চেহারায়।চোখ সরিয়ে আবারো বললাম,

-কিছু কম করে রুম ছেড়ে দাও ওদের।রেস্ট করুক ওরা।

-ইনসু?হুশে আছিস তুই?

-এই মেয়ের মাথা পুরাই গেছে।

-চুপ!আমার সোওওওনা বোনুটা।এইতো বুঝেছিস।বুঝা না ওদেরও!

-এই বাচ্চা মেয়ে কি বুঝাবে আমাদের।রিফাত?সিফাত ভাইয়ার পকেট সার্চ কর।আর ভাইয়ার আলমারীর চাবি খোজ।

-ইনসু রে!বাচা!গাইস!জবরদস্তি কেনো করছো তোমরা?বললাম তো আমাউন্ট কমাতে!একটু কম কর,দিয়ে দেবো।সীমার সামনে আজ অন্তত এমন করিস না!

-সোজা আঙুলে ঘি তুলতে দিলে না শালাবাবু!আঙুল তো বাকাবেই এখন ওরা।

-ইনসু?তুই যা একটু দীদুনকে বুঝিয়ে নিয়ে আয় এখানে।যা বোনু,যা না!

এটাই একমাত্র উপায়।সীমা ভাবি হাত ছেড়েছে আমার কিন্তু তাপসী আপু হাত ধরে রেখেছে।একটু অস্থিরতা দেখিয়ে বললাম,

-তায়্যিব কাদছে তাপসী আপু!

আমার হাত ছেড়ে দিয়ে ও কান খাড়া করে বাইরে তাকালো।একদৌড়ে বেরোতে যাবো শুদ্ধ ভাইয়া ঝড়ের বেগে দরজার সামনে দাড়িয়ে ওটা লাগিয়ে দিলেন।

-একটু বেশিই উড়ছিস?

একটা শুকনো ঢোক গিললাম শুধু।সেজোমার কথামতো এর সামনে ভয় পাওয়া একদমই চলবে না।তাই কোনোমতে বললাম,

-একটু কম করে টাকা নিলেই পারেন।আপনারই তো ভাইয়া।

উনি ভ্রুকুচকে তাকালেন।বুকে হাত গুজে বললেন,

-ওকে ফাইন।এতো দয়া হচ্ছে তোর,ভাইয়া ত্রিশ হাজার টাকাই দিক।বাকি বিশ হাজার ঠিক সময়ে ঠিকঠাক মতো উশুল করে নেবো।

-কিন্তু শুদ্ধ….

উনি ইশারায় থামতে বললেন তামিম ভাইয়াকে।আমি অসহায়ভাবে তাকালাম সিফাত ভাইয়ার দিকে।ও একটা বাপ্পারাজ লুক দিয়ে টাকাটা বের করে দিলো ইমরোজ ভাইয়ার হাতে।টাকা হস্তান্তের পরপরই কেদে দিয়ে বললো,

-আমিও দেখবো,তোরা তোদের বাসর ঘরে কিভাবে ঢুকিস!যদি এর ডাবল একেকটার থেকে না খসিয়েছি তবে আমিও সিফাত না!

শুদ্ধ ভাইয়া এগিয়ে গিয়ে ইমরোজ ভাইয়ার কাছে থেকে টাকার বান্ডিলটা হাতে নিলেন।ওটা দিয়ে মুখে বাতাস করতে করতে বললেন,

-ডোন্ট ওয়ারি।আমার বিয়ের দিন ক্রেডিট কার্ডটাই হাতে ধরিয়ে দেবো তোমাদের।সে রাতে একমুহুর্ত ওয়েট করাবো না…

কথা শেষ না করেই উনি বেরিয়ে যাচ্ছিলেন।আমার সামনে দাড়িয়ে বাকা হেসে বললেন,

-আমার বউকে।

উনি বেরিয়ে গেলেন।পিছন পিছন যীনাত আর তাপসী আপু বাদে বাকি সবাইও।কিছুক্ষন তব্দা মেরে দাড়িয়ে রইলাম।এভাবে বলার কি ছিলো?ছিলো।অবশ্যই কিছু ছিলো।কতোটা বউপাগল হবেন উনি,সেটাই বোঝালেন সবাইকে।আমাকেও।কিন্তু তাতে আমার কি?কিছুই না।কিছুই যায় আসে না আমার!

_____________

আযানের কিছুটা পরপরই ঘুম ভাঙলো।তবে অস্বাভাবিক ভাবে।ঘুমের মধ্যে টের পেলাম কেউ একজন এক আঙুলে চোখে পরে থাকা চুলগুলো সরিয়ে দিলো।চোখ মেলে কাউকে পেলাম না সামনে।মতিভ্রম মনে করে নড়াচড়া করে শুয়ে পরলাম আবারো।কিন্তু কিছুটা সময় পরই কপালে ঠোটের ছোয়া অনুভব করে ধরফরিয়ে উঠে বসলাম।পাশে তাকিয়ে দেখলাম প্রতিদিনের মতো ইরাম উপুর হয়ে বেঘোরে ঘুমোচ্ছে,যীনাত আপু রুমে নেই।হয়তো বেরিয়ে গেছে।দরজা খোলা রুমের।তবে কি কেউ এসেছিলো?যা ঘটলো আমার সাথে তা বাস্তব ছিলো?কে ছিলো?কেনো ছিলো?

আমার ভাবনার মধ্যেই একটা বাচ্চা মেয়ে দৌড়ে এসে গালে চুমো দিয়ে বেরিয়ে গেলো।ছয় সাত বছরের মেয়েটা ফুপির দেবরের মেয়ে।গাল ধরে একটু থেমে থেকে হেসে উঠলাম।তারমানে এই ছিলো।এতো সকালে উঠে গেছে?ফ্রেশ হয়ে নামাজটা সেরে ব্যালকনিতে গিয়ে দাড়ালাম।ভোরের এই অন্ধকারটা বেশ লাগে দেখতে।যেখানে একটু আলোর উকি আরো বেশি সুন্দর দেখায়।ধীরে ধীরে আলো ফুটছে চারপাশে।একদম সোনালী রোদ্দুরে ছেয়ে যেতে লাগলো চারপাশটা।

প্রথম প্রহরের সেই রোদ্দুরে গেইটের দিকে চোখ নিতেই আটকে গেলাম।পিছন ফিরে দাড়িয়ে একজন।গায়ে কালো ছোট হাতা গেন্জি,ট্রাউজার।হয়তো জগিংয়ে গিয়েছিলো মানুষটা।ফর্সা কাধে,হাতে‌র পেশিতে লেগে থাকা ঘামের কনাগুলো রোদের আলোতে চিকচিক করে উঠছে।একটু পাশ ফিরতেই গালের চাপ দাড়িটুক দেখে বুঝলাম,ওটা শুদ্ধ ভাইয়া।চোখ সরিয়ে নিতে যাচ্ছিলাম।কিন্তু তার পাশে আরেকজনের উপস্থিতি দেখে পায়ের নিচের মাটি গরম হয়ে গেলো আমার।তাহমিনা কথা বলছে ওনার সাথে।কথা বলছে কম,চোখ দিয়ে গিলে খাচ্ছে বেশি।হাত মুঠো করে পা ছুড়লাম রাগে।পায়ের নিচে বরাবর থাকা ব্যালকনির গাছগুলোতে পানি দেওয়ার পাত্রটা ঠুস করে পরে গেলো।ওতে পানিও ছিলো।বারান্দাটা পানিতে ভরে গেছে পুরো।ইরাম হাই তুলে রুম থেকেই বলে উঠলো,

-বাজিয়েছো এলার্ম?তাইতো বলি,এখনো ঘুম ভাঙলো না কেনো!আজ ভাঙচুরের শব্দে ঘুম ভাঙানোর প্লান করেছিলে!

সকালটা মাটি আমার।ফুসতে ফুসতে রুমের বাইরে বেরোলাম।বারান্দার পানিটা না মুছলে আবার নানা কথা শুনতে হবে।দরজার কাছেই রাখা উইপার হাতে নিয়েছি সবেমাত্র,শুদ্ধ ভাইয়া তোয়ালে দিয়ে মুখ মুছতে মুছতে ভেতরে ঢুকতে যাচ্ছিলেন।আমাকে দেখে বাইরেই থেমে গেলেন উনি।আপাদমাস্তক দেখে একটু চুপ থেকে পেট ধরে শব্দ করে হেসে দিলেন উনি।ভ্রুকুচকে তাকিয়ে আছি শুধু।এতো হাসির কি হলো?উনি হাসি থামিয়ে বললেন,

-যা লাগছে না তোকে!একদম পাতা কুড়োনি মেয়ে!

কান দিয়ে ধোয়া বেরোতে লাগলো আমার।খিচে উঠে বললাম,

-নান অফ ইউর বিজনেস!স্টে ইন ইউর লিমিটস্!

-ওমা!ইংরেজী ঝেরে প্রমান দিচ্ছে,সে পাতা কুড়োনি নয়!

-দেখুন আপনি….

-ওয়েট!দেখি!

একপা এগোলেন উনি।আমিও পিছালাম।চোখ পাকিয়ে বললেন,

-ডোন্ট মুভ!জরিয়ে ধরবো কিন্তু!এমনিতেও তোর শাস্তি আম্মুর জন্য পেন্ডিং হয়ে আছে!

বিস্ফোরিত চোখে তাকালাম আমি।উনি কপালের এলোমেলো চুলগুলো কানে গুজে দিয়ে বললেন,

-মাত্রাতিরিক্ত অবাধ্য!একদম ওনার এর মতোই!

ডোন্ট কেয়ার ভাব নিয়ে উনি কথাটা বলে ভেতরে চলে গেলেন।ঠায় মেরে বাইরেই দাড়িয়ে রইলাম আমি।ওনার এর মতো অবাধ্য মানে?আমার চুলের ওনার তো আমি!আমি অবাধ্য?না।এই লোকটাকে ভয় পাই বলে সত্যিই ভয় দেখান আর অপমান করেন আমাকে।আর না।এবার থেকে জবাব দেবো ওনাকে আমি।ভেতরে ঢুকতে যাবো,তখনই তাহমিনার গলা,

-ইনসু!

বাসার দিকে এগোচ্ছে ও।একমুহুর্ত দেরি না করে ভেতরে ঢুকে ঠাস করে দরজা লাগিয়ে দিলাম ওর মুখের ওপর।দরকার পরলে আজ এই দরজায় দাড়োয়ান হবো আমি,তাও ভেতরে ঢুকতে দিচ্ছি না তোকে!

#চলবে…