তোর রঙে রাঙাবো পর্ব-০৭

0
1933

#তোর_রঙে_রাঙাবো
#Part_07
#Writer_NOVA

সন্ধ্যা নেমেছে বহু সময় আগে।মাগরিবের নামাজ পড়ে রুমে বসে ছিলাম।বেশ কিছু সময় পায়চারি করে চেয়ার টেনে টেবিলে পড়তে বসলাম।ম্যানেজমেন্ট নিয়ে আমার অবস্থা খারাপ হয়ে গেছে।এখানে ব্যবস্থাপনা ঐ খানে ব্যবস্থাপনা।এতো ব্যবস্থাপনা মানে কে? পছন্দ করে যখন নিয়েছি এখন না মানলেও পড়তে হবে।দিনকে দিন অনীহা হয়ে যাচ্ছে বিষয়টার ওপর।একটা বই নিয়ে পাতা উল্ট পাল্টে দেখছিলাম।তখনি দুই কাপ চা ও পাউরুটির প্লেট হাতে ভাইয়ু রুমে ঢুকলো।

তাসিনঃ রাইপরী, চা খেয়ে নে।দেখবি পড়তে ভালো লাগবে।সাথে তোর পছন্দের পাউরুটি।

আমিঃ আমার কাছে এখন এই সাবজেক্টটা যাস্ট বিরক্তিকর লাগে।সবকিছু মাথা খাটিয়ে খাটিয়ে বুঝতে হয়।এতো মাথা খাটালে আমি পাগল হয়ে যাবো।ইন্টারে থাকতে ভীষণ ভালো লেগেছে। তাই শখে শখে নিয়ে বসলাম।খুশির ঠেলায় নিয়ে এখন পস্তাচ্ছি। ইচ্ছে করছে পাল্টিয়ে অন্য সাবজেক্টস নেই। কিন্তু তাও সম্ভব নয়।

তাসিনঃ এতো প্যারা নিস না।যাস্ট চিল কর।কোন কিছুই কঠিন নয়।সবকিছুই সহজ।যদি আমরা বুঝতে পারি।আমরাই সব কিছুর মধ্যে জটিলতা সৃষ্টি করি।তুই এখনো পড়ায় মনোযোগ বসাতে পারিসনি।তাই বিষয়টা তোর কাছে জটিল লাগছে।জটিল ভেবে সবসময় যদি এটাকে অবহেলা করে দূরে ঠেলে দিস তাহলে বিষয়টা আরো পাথরের মতো কঠিন হয়ে যাবে তোর কাছে।পড়াশোনায় মুখস্থ নামক শব্দটাই সর্বনাশের মূল।মুখস্থ বিদ্যায় কখনো কেউ উন্নতি করতে পারে না।মুখস্থ করলে কিছু দিন পর ভুলে যাবি।তারপর আবার মুখস্থ করতে হবে। অথচ বুঝে বুঝে মন লাগিয়ে পড়লে সেটা ভবিষ্যতে কাজে লাগে।ভুলে যাওয়ার কোন চান্সই নেই। বুঝলি রাইপরী।

আমিঃ হুম বুঝেছি। এবার দয়া করে তুমি পড়ার টপিক বাদ দেও।আমাকে শান্তি মতো চা দিয়ে পাউরুটি খেতে দেও।তুমি এরকম ফুলবাবু সেজে রয়েছে কেন? কোথাও যাবে নাকি?

তাসিনঃ হ্যাঁ,একটু কাজ আছে। রাজনৈতিক নেতাদের সাথে মিটিং যেতে হবে। সেইজন্যই তো আজ অফিস থেকে তাড়াতাড়ি চলে এসেছি। আমার চা খাওয়া শেষ। দরজাটা বন্ধ করে দে।আমি এখন বেরুবো।

আমিঃ তুমি কিসের জব করো? আমি তোমার জবের কোন আগাগোড়া খুঁজে পাই না।আজ পর্যন্ত অফিসের নামটা পর্যন্ত বলোনি।আমার তোমাকে কিরকম কিরকম জানি লাগে? তুমি কোন ইলিগ্যাল কাজ করো না তো ভাইয়ু?তুমি বলেছিলে, তুমি সামান্য একটা জব করো।কিন্তু মাঝে মাঝে এত টাকা আনো কোথা থেকে?যেগুলো নিজের কাবার্ডে লুকিয়ে রাখো।ভেবো না আবার তোমার কোন টাকা সেখান থেকে সরিয়েছি।দুইবার তোমাকে লুকাতে দেখেছি।তাই জিজ্ঞেস করছি। (জিজ্ঞোসু দৃষ্টিতে)

🌺🌺🌺

ভাইয়ু কিছুটা ঘাবড়ে গিয়েছিলো।কিন্তু কেন তা আমি জানি না।ডান হাত মুঠ করে বড় একটা দীর্ঘশ্বাস নিয়ে আমার মাথায় হাত বুলিয়ে বললো।

তাসিনঃ ধূর,পাগলী।কি যে বলিস না তুই।ঐ টাকা তো আমাদের রাজনৈতিক দলের। মাঝে মাঝে আমাকে আমানত রাখতে দেয়।তাই বাসায় এনে লুকিয়ে রাখি।আর বাকি প্রশ্নের উত্তর আমি তোকে সময় হলে সব খুলে বলবো।এখন তোর এই ছোট্ট মাথায় চাপ দিয়ে পড়ালেখায় ডিস্টার্ব করিস না।আমার দেরী হয়ে যাচ্ছে। আজ উঠি।রাতে ফিরতে দেরী হবে।দরজা লক করে ঘুমিয়ে পড়িস।আমার কাছে ডুপ্লিকেট চাবি আছে।

ভাইয়ু চায়ের কাপটা পিরিচে রেখে আমার সামনে এসে দাঁড়ালো। তারপর কপালে আলতো করে চুমু খেয়ে হনহন করে বাইরে চলে গেলো।আমি দরজাটা বন্ধ করে রুমে এসে ধপ করে খাটে বসে পরলাম।

আমিঃ ভাইয়ুকে আমার মাঝে মাঝে সন্দেহ হয়।কি কাজ করে সে? আমাকে বলতে চায় না কেন? যতবার জানতে চেয়েছি ততবার কথা ঘুরিয়ে আমার কাছ থেকে পালিয়ে গেছে। বিষয়টা খুব ভাবায় আমায়।নিজের ভাইকে মাঝে মাঝে চিনতে পারি না আমি।কিরকম অদ্ভুত আচরণ করে। এমনি ভাইয়ু রেগে গেলে বাঘ হয়ে যায়।কিন্তু তখন এক রহস্য ঘেরা মানুষ মনে হয়। বুঝি না বাবা উনাদের ব্যাপার-স্যাপার। একেক সময় একেক রূপ। তবে আমার বিশ্বাস আছে আমার ভাইয়ু ভুল কোন কাজ করতেই পারে না। আমি বরং মনটাকে অন্য দিকে না দিয়ে ধরে বেঁধে পড়ায় দিয়ে দেই।তাতে কাজে লাগবে।

আমি ফালতু চিন্তাগুলো রেখে পড়ায় মন দিলাম।কিন্তু মন বসছে না।ওহ হ্যাঁ আজকে কলেজে একটা অবাক ঘটনা ঘটেছে। সোহানের চেলা-পেলা আমার কাছে এসে সারা ক্যাম্পাসের ছেলে-মেয়েদের সামনে আমার কাছে মাফ চেয়েছে।যাতে আমি খুব অবাক হয়ে যায়।শুধু আমি নয় পুরো কলেজ অবাক হয়ে গিয়েছিলো।সোহানকে নাকি কোথাও খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না।রাজীবের এক হাতের কব্জি কাটা ছিলো।আমি ভালোমতো খেয়াল করে দেখলাম ঐ হাত দিয়ে আমার হাত ধরেছিলো।মেয়ে দুটোর গাল লাল হয়ে আছে।ছেলেগুলোর মুখের মধ্যে অগণিত মারের দাগ ছিলো।কেউ ইচ্ছে মতো এদের ধোলাই দিয়েছে।তাদের এভাবে দেখে না চাইতেও মুখে হাসি ফুটে উঠছিলো।কে করেছে কে জানে? তবে তাকে অসংখ্য ধন্যবাদ।

সেদিনের ঘটনার পর আজ কলেজে গিয়ে তীব্র ও তাসিন দুজনেই সোহান ও তার দলের খোঁজ করেছে। কিন্তু কেউ তাদের কথা বলতে পারে নি।এর কিছু সময় পরই সোহান বাদে বাকি সবাইকে রাইয়ের কাছে মাফ চাইতে দেখে। রাই তখন খুব খুশি ছিলো।সে যদি আশেপাশে ভালো করে তাকাতো তাহলে দেখতে পেতো আরেকজন ব্যাক্তির মুখেও ছিলো বিশ্ব জয় করা হাসি।যে তার প্রিয় মানুষটার মুখে হাসি ফুটানোর জন্য ঠিক কি কি করেছে? অবশেষে সে সফল হয়েছে।

🌺🌺🌺

পরেরদিন…..

বিকেলের রোদটা এখনো মিইয়ে যায়নি।চারিদিকের পরিবেশটা বেশ শান্ত হয়ে আছে।পাখীরা তাদের নীড়ে ফিরে যাচ্ছে। এদিকটায় গাছ-গাছালি থাকায় পাখিদের দেখা মিলে।অপরূপ এক পরিবেশ হাতছানি দিচ্ছে।

বর্তমানে তাসিন বসে আছে পুষ্পদের ড্রয়িং রুমের সোফায়। পুষ্প খানিকটা অসুস্থ। সেই খবর পেয়ে একগাদা ফলমূল নিয়ে ওদের বাসায় এসেছে এক পলক পুষ্পকে দেখবে বলে।চায়ের কাপ হাতে নিয়ে এদিক সেদিক তাকিয়ে পুষ্পকে খুঁজে চলছে।সেটা বুঝতে পেরে পুষ্পের বাবা সিরাজ সাহেব বললেন।

সিরাজঃ তুমি কি কাউকে খুঁজছো বাবা?

তাসিনঃ না মানে হ্যাঁ।পুষ্পকে যে দেখছি না। এতক্ষণ ধরে এসে বসে আছি। একবারো ওর দেখা মিললো না।তাই ওকেই খুঁজছিলাম। পুষ্পর কি হয়েছে আঙ্কেল?

সিরাজঃ তেমন কিছু না।গতকাল রাত থেকে জ্বর ছিলো।সাথে মাথাব্যাথা।আল্লাহর রহমতে এখন ভালো আছে।এভাবেই তো দিনকাল ভালো না।তাই একটু ঘাবড়ে গিয়েছিলাম।আল্লাহর দরবারে হাজার হাজার শুকুর। এখন মেয়েটা সুস্থ হয়ে গেছে। পুষ্প রুমে ঘুমোচ্ছে। তুমি চা খাও আমি ওর মাকে বলছি ডেকে দিতে।আমাকে আবার আসরের নামাজ পড়তে মসজিদে যেতে হবে। তুমি তাহলে বসো, আমি উঠছি।রাতের খাবার না খেয়ে কিন্তু যেতে পারবে না।

সিরাজ সাহেব উঠে পরলেন।তাসিন অবাক চোখে তার দিকে তাকিয়ে রইলো। চিনা নেই, জানা নেই একটা ছেলেকে এতো খাতির,যত্ন করছে।আবার বলছে রাতের খাবারও খেয়ে যেতে।একবারো ভাবেনি তার মেয়েকে পছন্দ করতে পারে ছেলেটা।আমার ছেলেটাকে সন্দেহ করা উচিত বা কড়া নজরে রাখা উচিত।তা না করে তার স্ত্রী কে বলবেন পুষ্পকে ডেকে দিতে।বিষয়টা ভীষণ অদ্ভুত লাগলো তাসিনের কাছে। পুষ্পর মা রুবিনা বেগম বাহারি ফলের ট্রে নিয়ে তাসিনের পাশে বসলো।

তাসিনঃ আসসালামু আলাইকুম আন্টি।কেমন আছেন?

রুবিনাঃ অলাইকুম আস সালাম। আলহামদুলিল্লাহ ভালো। তুমি কেমন আছো?

তাসিনঃ আলহামদুলিল্লাহ ভালো। আপনি কষ্ট করে এগুলো আনতে গেলেন কেন বলুন তো।এমনি একগাদা খাবার দিয়ে রেখেছেন। সেগুলোই তো খেয়ে শেষ করতে পারবো না। আবার কতগুলো নিয়ে এলেন।এরকম পাগলামি কে করতে বলেছে আপনাকে?

রুবিনাঃ সে কি কথা? তুমি এত দূর থেকে এলে তোমাকে খালি মুখে বিদায় করে দিবো নাকি।তোমার কথা প্রায় পুষ্প বলে।তা তোমার ছোট বোনটা কেমন আছে?

তাসিনঃ জ্বি আলহামদুলিল্লাহ ভালো আছে।ও ভালো না থাকলে তো আমি ভালো থাকতাম না।আন্টি, পুষ্পকে যে দেখছি না।

রুবিনাঃ ওকে ডাক দিয়ে আসলাম।এতক্ষণে তো চলে আসার কথা।তুমি বসো আমি আবার ডেকে আসি।

🌺🌺🌺

রুবিনা বেগম চলে গেলেন।বেশ কিছু সময় পর চোখ ডলতে ডলতে পুষ্প এসে হাজির।বেচারী, প্রথমে তার মায়ের কথা বিশ্বাস করতে চায়নি যে তাসিন এসেছে।

পুষ্পঃ আসসালামু আলাইকুম। তা নেতা মশাইয়ের হঠাৎ আমার বাসায় পদধূলি দিলো যে?সূর্য আজ কোন দিক দিয়ে উঠেছে।

তাসিনঃ অলাইকুম আস সালাম। সূর্য প্রতিদিন যেদিক দিয়ে উঠে সেদিক দিয়ে উঠেছে। আপনার কোন খোঁজ খবর নেই কেন? লাপাত্তা হয়ে যান কিছু দিন পর পর।আজ বাসায় না আসলে তো জানতেই পারতাম না তুমি অসুস্থ। একটা কল করে জানাবে তো।তোমার ফ্রেন্ডদের থেকে তোমার খবর নিয়ে তারপর চলে এলাম।

পুষ্পঃ আমার শরীর ভালো না থাকলে কার কি আসে যায়? কেউ তো একটা কল করার প্রয়োজন মনে করেনি।নিজের রাজনীতি নিয়ে বিজি থাকে।এতো ব্যস্ত মানুষকে ডিস্টার্ব করে পরে বকা শুনবো নাকি।

পুষ্প এক নাগাড়ে কথাগুলো বলে তাসিনের দিকে তাকিয়ে ভয় পেয়ে গেলো। তাসিন অগ্নি দৃষ্টিতে ওর দিকে তাকিয়ে আছে। চোখ, মুখ শক্ত করে বললো।

তাসিনঃ তোমার মুখ থেকে বাজে কথা আমি একদম এলাউ করবো না। গতকাল রাতে আমি সত্যিই রাজনৈতিক মিটিংয়ে ছিলাম।সেখান থেকে ফেরার পথে কয়েকবার তোমাকে কল করেছি।কিন্তু তোমার মোবাইল বন্ধ বলেছে।সারা দিন পাগলের মতো একের পর এক কল করেছি। কিন্তু তোমার কোন রেসপন্স নেই। তোমার ফ্রেন্ডকে কল করে তোমার অবস্থা জানতে পেরেছি। আধা ঘণ্টার মধ্যে তোমার বাসায় এসে পৌঁছালাম।তোমার অসুস্থতার কথা শুনে আমি ঠিক কতটা পাগল ও অস্থির হয়ে পরেছিলাম তা শুধু আমি জানি পুষ্প।(রেগে)

পুষ্পঃ আসলে গতকালে জ্বরটা একটু বেশি উঠেছিলো।আম্মুর কাছে মোবাইল ছিলো।হয়তো হাত লেগে এরোপ্লেন মোড অন হয়ে গিয়েছিল। এখনো মোবাইল আম্মুর কাছে।তাই আমি কিছু জানি না।
(ভয়ে আমতাআমতা করে)

তাসিনঃ একটা কথা কান খুলে শুনে রাখো পুষ্প।আমার বোন যেমন আমার জন্য অনেক বেশি ইম্পরট্যান্ট তেমনি তুমিও আমার জন্য অনেক অনেক ইম্পর্ট্যান্ট। আমি তোমাদের দুজনকে ছেড়ে কিছুতেই ভালো থাকতে পারবো না।আমি তোমার ও রাইপরীর সাথে কখনো তুলনা করবো না। কারণ দুজনের সাথে তুলনা করা যায় না।একজন আমার অক্সিজেন আরেকজন আমার হার্ট।এই দুটো ছাড়া আমি বাঁচবো কি করে বলো?আর কখনও এসব কথা বললে আমার থেকে খারাপ কেউ হবে না। কথাটা মনে রেখো।

কথাগুলো বলে দ্রুত পায়ে বাসা থেকে বের হয়ে গেলো তাসিন।পুষ্প অবাক হয়ে তাসিনের যাওয়ার পানে তাকিয়ে রইলো।হঠাৎ করে তাসিন কেন রেগে গেলো তাই বুঝতে পারছে না সে।এমনি মজা করে তাসিনকে কথাগুলো বলেছিলো পুষ্প।কিন্তু তাসিন যে এতোটা রিয়েক্ট করে ফেলবে তা বুঝতে পারেনি। বুঝলে অবশ্য এমনটা করতো না।

#চলবে