দখিনা বারান্দায় তুমি আমি পর্ব-১০(অন্তিম পর্ব)

0
557

#দখিনা বারান্দায় তুমি আমি
#আফসানা_মিমি
|অন্তিম পর্ব |

দুহা এবং এলমা দুজন দুজনকে জড়িয়ে ধরে রেখেছে। বাহিরে মানুষের আগমনের আভাস পাওয়া যাচ্ছে। খুবই ভয় পাচ্ছে তারা। বেশি ভয় পাচ্ছে এলমা যেন আগন্তুকের চেহারা দেখতে চায় না সে।

‘ বাহ দুই পাখি একসাথে একই খাঁচায়! আমি তো ভেবেছিলাম এসে মনে হয় অনেক কাহিনী করতে হবে। কিন্তু না কিছুই করতে হয়নি আমার।’

কালো পোশাকে আবৃত করে রেখেছে তাহেরা ম্যাডাম নিজেকে। দেখতে মা’ফি’য়া মা’ফি’য়া মনে হচ্ছে। অন্য দিনে চোখে চশমা এবং শরীরের শালীনতা পোশাক পরে কলেজে চলে আসতো তখন মুখের মধ্যে ভালো মানুষই ফুটে উঠত কিন্তু আজ মনে হচ্ছে সে যেন একটা কু’খ্যা’ত স’ন্ত্রা’সী।
ঘৃণায় মুখ ফিরিয়ে নেয় দুহা। তখনই তাহেরা ম্যাডামের স্বর কানে ভেসে আসে,
‘ও লে লে আমার বাচ্চাটা। ঘৃনা হচ্ছে বুঝি। আমি তো এটাই চাই, সবাই আমাকে ঘৃনা করুক। আমার আসল চেহারা বুঝুক। আমি কতটা ডেঞ্জারাস তা অনভব করুক। আমার নিজেকে নিয়ে নিজের গর্ব করতে ইচ্ছে করে, পৃথিবীর আড়ালে আমি একজন স’ন্ত্রা’সী, নারী পা’চা’র’কা’রী, মানুষের অঙ্গ প্রত্যঙ্গ খুলে তা লক্ষ্য লক্ষ্য টাকার বিনিময়ে বিক্রি করি। এটাই আমার পেশা। কলেজের সাথে যুক্ত আছি কয়েক বছর যাবত। সকলের মধ্যে নিজেকে এমনভাবে উপস্থাপন করি যেন আমি একজন আদর্শ শিক্ষক। সত্যি বলতে আমি কোন শিক্ষক নই। ফেইক পরিচয় পত্র দিয়ে প্রবেশ করি কলেজে।
এই মেয়েটার বাবা আমার সব কষ্টের উপর জল ঢেলে দিয়েছে গত বছর। গোপন গোয়েন্দার সাহায্যে প্রায় সকল তথ্য বের করে ফেলেছিল কিন্তু আফসোস কিছুই করতে পারেনি। এর আগেই রিটায়েড হয়ে যায়। কিন্তু আমার পিছনে লাগিয়ে দেয় একজন গোয়েন্দা পুলিশকে। সে কে এখনো আমার অজানা। এর বাবার জন্য আমার অনেক লস হয়েছে। তাইতো টার্গেটে রাখি এই মেয়েকে সাথে তোমাকেও। তুমি রক্ষা পেয়ে যাও সেদিন। আমার দলের বাচ্চারা মেয়ের কাছ থেকে একটু মজা নিয়েছে। যাইহোক এবার আমার কাজ শেষ। দুই পাখিকে একসাথে পেয়েছি। এদেরকে কে’টে’কু’টে অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ বিক্রি করে ফেলব। এরপর বিদেশে পাড়ি জমাবো। কেউ জানবে না, বুঝবেও না যে সব কিছুর পিছনে আমার হাতে রয়েছে।’

দুহা ভাষা খুঁজে পাচ্ছে না। একজন মেয়ের জঘন্য রুপ দেখে নিজেকে মেয়ে বলে আখ্যায়িত করতে ঘৃণা লাগছে। তাহেরা ম্যাডাম আচমকা দুহার কাছে এগিয়ে এসে এক ঝটকায় এলমাকে দূরে সরিয়ে নেয়। এলমাকে দুইজন লোকের হাতে উঠিয়ে দিয়ে দুহার গালে পর পর দুইটা আঘাত করে বসে। এতে করে দুহার ঠোঁট কে’টে র’ক্ত বের হয়ে যায়। দুহা থুবড়ে পড়ে মাটিতে। এলমা দূর্বল শরীর চিৎকার করছে যেন প্রাণ প্রিয় বান্ধবীকে কিছু না করে। তাহেরার কানে তা প্রবেশ করছে না। এক পর্যায়ে সিরিঞ্জ নিয়ে এগিয়ে
যেতে থাকে দুহার দিকে। নিজেকে বাঁচাতে চেষ্টা করছে দুহা। মনে মনে স্বরন করছে আরানকে।
হাতে ইনজেকশন পুশ করা হয়েছে। তাহেরার চোখে, মুখে খুশির ঝিলিক। আজকের কাজ শেষে তাহেরা পাড়ি জমাবে বিদেশে। দুহার চোখ বুজে আসছে। নিভু নিভু চোখে দেখছে দুজন লোক এলমাকে খারাবভাবে ছুঁয়ে দিচ্ছে। দুহা দূর্বল স্বরে বলছে, ছেড়ে দাও এলমাকে।’
——————-

পিটপিট করে চোখ খুলছে দুহা। মাথার উপর সাদা রঙের ছাঁদ। কিছুটা ঝাপসা, হালকা। ছাঁদ যেন ঝাঁপিয়ে পড়ছে দুহার দিকে। চোখ বন্ধ করে নেয় সে। মনে করতে থাকে পূর্বের ঘটনা। তড়িৎ গতিতে চোখ খুলল দুহা। ঘন ঘন নিশ্বাস ত্যাগ করছে সে। প্রবল বাতাস গায়ে লাগা সত্বেও ঘামছে সে। হাত দ্বারা ললাটের ঘাম মুছে নিবে। হাত কারোর হাতে আবদ্ধ। আরান অন্য মনস্ক ছিলো। হাতে টান লাগায় তার সম্বিত ফিরে আসে। দুহার বিচলিত অবস্থা দেখে কাছে গিয়ে বসে। আদুরের সহিত জিজ্ঞেস করে,’ কি হয়েছে দুহা! খারাপ লাগছে? এই যে আমি পাশে আছি। ‘

‘এলমা কোথায়?’
দুহার নিশ্বাস যেন আটকে আছে। এলমার চিন্তায় বিভোর সে।
‘ এলমা যেখানে আছে ভালো আছে।’

আরানের গম্ভীর স্বর দুহার পছন্দ হলো না। চিৎকার করে বলল,
‘ মারা গেছে তাই না? আপনি কোন কাজের না। বিপদে কখনো এগিয়ে আসেন না। যখন আপনার খুব প্রয়োজন হয় তখন আপনাকে পাশে পাই না। এবারো তাই হয়েছে তাই না! এলমাকে ঐ পশুর দলেরা মেরে ফেলেছে তাই না! এলমা,,,এলমা

অতিরিক্ত উত্তেজিত হয়ে গেছে দুহা। শরীর কাঁপছে। আরান সবটাই নীরবে পর্যবেক্ষণ করেছে। আরান আস্তে করে দুহাকে জড়িয়ে ধরে। দুহা বিশ্বস্ত জায়গা পেয়ে ডুকরে কেঁদে ওঠে। আরান দুহার অবস্থা দেখে পাগলী বলে আখ্যায়িত করে। এরপর মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলে,

‘ এলমার অবস্থা খুবই আশংকাজনক ছিল। স্যার উন্নতমানের চিকিৎসা এবং মানসিক প্রশান্তির জন্য সিঙ্গাপুরে নিয়ে যান। একটা কথা কি জানো! বর্তমান সময়ে আমাদের দেশে ধ’র্ষ’ণে শিকার হওয়া মেয়েরা সমাজে বসবাস করতে পারে না। সমাজের কিছু শ্রেণীর মানুষেরা কলঙ্কিত বলে ডাকে যেখানে সেখানে। মেয়েরা যে রাস্তায় বেরোবে তার কোন পন্থা নেই। তাই আমি নিজেই স্যারকে বলেছি এলমাকে নিয়ে দূরে কোথাও চলে যেতে। এতে করে এলমার চিকিৎসা ও হবে এবর দূরে থেকে জীবনের কালো অতীতও মুছে যাবে।’

‘ আমাদের কীভাবে উদ্ধার করেছেন?’
‘সেই এক লম্বা ইতিহাস ।’
‘ শুনবো।’
‘ তাহেরা ম্যাডামকে সন্দেহ হয় এলমার নিখোঁজের পর থেকে। তাহেরার পিছনে লোক লাগিয়ে রেখেছিলাম। তোমার মনে আছে কলেজের সেই মেয়ের কথা যাকে আমরা ডোবায় পেয়েছিলাম! সেই মেয়ের রিপোর্ট আসে আমার কাছে এলমার নিখোঁজের দুইদিন আগে। তখন আমি পুরোপুরি সেই কেসের উপরেই তদন্ত করছিলাম। ফরেনসিক রিপোর্ট থেকে তাহেরা ম্যাডামের হাতের আঙ্গুলের ছাপ পাই। প্রথমে জানতাম না সেটা কার। কলেজে টিফিনের সময়ে খুবই কৌশলে তাহেরা ম্যাডামের হাতের ছাপ নেই একটা ফাইলে এবং সেখান থেকে সে ফাইলটা ফরেনসিক ল্যাবে পাঠিয়ে দিই, ম্যাচও হয়। এলমা আর তোমার নিখোঁজের দিন আমি একটু দূরে ছিলাম। ভাবতে পারিনি তাদের নেক্সট টার্গেট তোমরা হবে কেননা তোমার সাথে এবং এলমার সাথে আমি পরিচিত হয়েও অপরিচিতদের মত ব্যবহার করতাম। তাহেরা ম্যাডাম আমাকে সন্দেহ করেন কলেজে জয়েন হওয়ার কয়েক দিন পর। আমিও বুঝতে পারি কিন্তু কিছু বলি না। দেখতে চেয়েছিলাম উনি কোন পর্যন্ত যায়। যার ফলাফল তোমাকে ভোগ করতে হয়েছে। তারা এমনভাবে আঘাত করবে তা আমরা কেউ ভাবিনি। কেননা আমি ছাড়াও পিছনে আরও তিনজন বডিগার্ড ছিল যারা নাকি সাধারণ বেশে থাকতো। তাহেরা ম্যাডাম তাদেরকেও হাত করে নেয়। যা এলমান নিখোঁজ হওয়ার পর জানতে পারি। তোমার ম্যাসেজ দেখেছিলাম প্রায় আধা ঘন্টা পর। সাথে সাথে টিম নিয়ে বের হয়ে যাই এবং তোমার নাম্বার ট্র্যাক করি। তোমরা যে বাড়িতে অবস্থান করছিলে সেটা কিন্তু তাহেনা ম্যাডামের বাড়ি না বরঞ্চ উনি ভাড়া নিয়েছিলেন কয়েকদিনের জন্য। শুধু এই বাড়ি না উনি পরপর বাসা পরিবর্তন করেন। আমরা যেন উনাকে ট্র্যাক করতে না পারি এইজন্য। তোমাকে আমরা অচেতন অবস্থায় পাই। এলমাকে খুঁজে পাই পাশের ঘরে সেও অচেতন অবস্থায় ছিল দুইটা লোক ছিল সে রুমে হয়তো খারাপ কিছু করতে যাচ্ছিল। আমরা সেখানে উপস্থিত হই এবং তাদের দুজনকে গ্রেফতার করি।
এবার বলি তাহেরা ম্যাডামের কথা। উপর তলায় তাহের ম্যাডামকে আমরা খুঁজে পাই। তিনি গানের তালে তালে নাচছিলেন আর তৈরি হচ্ছিলেন দেশ থেকে চলে যাওয়ার জন্য। আমরা সেখানে তাকে খুঁজে পাই। এলমার বাবা নিজ হাতে তাহেরাকে আঘাত করেন। আমি সহ যত পুলিশ সেখানে উপস্থিত ছিল সবাই তাহেরার মুখের উপর থুতু মেরে আসি। একজন নারী হয়ে অপর নারীর সাথে এরূপ আচরণ করার জন্য কঠোর শাস্তির দাখিলত করি।’

‘ এত কিছু হয়ে গেছে আর আমি কিছুই জানিনা?’

‘ জানবেন কীভাবে ম্যাডাম! আপনাকে তো ড্রাগ দিয়ে অজ্ঞান করে রাখা হয়েছিল।’

দুহায এবার শান্ত হল। চুপচাপ আরানের ধকধক আওয়াজ শুনতে লাগলো। আরান ব্যাপারটা বুঝতে পেরে দুহার কর মাথায় অধর ছুঁয়ে এবং বলে

‘ তোমাকে ছাড়া এ জীবন বড় অসহায়। সময় গড়িয়েছে যদিও ভালোবাসা কমে নি একটুও।’
———–

ছয় মাস পর,

যেখান থেকে কাহিনী শুরু হয়েছে ঠিক সেখানেই সেই জায়গায় এসে দাঁড়িয়েছে দুহা এবং আরান। আজ কাগজ এবং কলমের দশম জন্মদিন।
একটু আগেই দুহা এলমার সাথে কথা বলেছে ভিডিও কলে। এলমা এখন আগে থেকে সুস্থ কিন্তু মানসিকভাবে এখনো দুর্বল। আগের মত চঞ্চলতা নেই মেয়েটার মাঝে। তবুও লোহা খুশি এলমাকে দেখতে পেয়ে।

দুহার মামী খুবই ব্যস্ত।হ আজ দুই ছেলের জন্মদিন। অনেক বছর পর বড় করে আয়োজন করেছেন আবারও তিনি। তার আরেকটাও কারণ আছে আর সেটা হল দুহা এবং আরানের আংটি বদল হবে আজ।

দক্ষিণের বারান্দায় দাঁড়িয়েছে দুহা। পরিধানে লাল শাড়ি, বাতাসে চুলগুলো এলোমেলো উড়ছে, কানের ঝুমকো হেলে দুলে দুলছে প্রকৃতির তালে তালে ভালোভাবে উপভোগ করছে সে। চোখ বন্ধ, গুনগুন করে গান গাইছে। কারো বলিষ্ঠ হাতের ছোঁয়া কোমড়ে লাগায় দুহার গান বন্ধ হয়ে যায়। মুখে ফুটে উঠে চমৎকার হাসি। মানুষটার শরীরের গন্ধটা জানান দেয় এটা দুহার আরান। দুহা মুচকি হাসে এবং বলে,

‘ এত দেরী করলেন যে!’

‘ রাস্তায় জ্যাম ছিলো অনেক। ‘

‘ কাকে সাহায্য করে আসলেন?’

দুহার কথা শুনে আরান আনন্দে হাসে। আরান দুহার আঙ্গুল নিয়ে খেলতে খেলতে উত্তর দেয়,

‘একজন গর্ভবতী মহিলাকে।’

দুহা নিশ্চুপ কিছু বলে না। অনুভব করছে প্রিয় মানুষটাকে পাশে দাঁড়িয়ে প্রকৃতি। আবছায়া আলো পড়ছে দুহার মুখশ্রীতে। আকস্মিক আরান দুহার হাত ছেড়ে দেয়। হাঁটু গেড়ে দুহার সামনে বসে।হাতে চমৎকার পাথরের আংটি। দুহার উদ্দেশ্যে বলে,

‘এই দখিনা বারান্দায় তুমি আমি একায়
আবছায়া আলোয় দেখি যে তোমায় প্রতিবার
প্রকৃতির প্রকৃত রূপে, চাঁদের ঝলমল আলোতে,
বলছি তোমায় আজ,
ভালোবাসি দুহা
পেয়ো না কো আর লাজ!’

সমাপ্ত