দখিনা বারান্দায় তুমি আমি পর্ব-০৮

0
358

#দখিনা বারান্দায় তুমি আমি
#আফসানা_মিমি
|অষ্টম পর্ব |

সায়াহ্নের শুরু। আকাশে গুরুম গুরুম আওয়াজ শোনা যাচ্ছে। মেঘালয়ের পাহাড় জমাট বেঁধে আছে গলে বর্ষণের অপেক্ষা করছে।
আরান চলে আসে দুহার বলা সেই স্থানে। তন্ন তন্ন করে খুঁজছে দুহাকে। আরান মনকে বুঝাচ্ছে দুহা ঠিক আছে কিন্তু বাস্তব কথা হচ্ছে দূর-দূরান্তে, মাইলের পর মাইল কোথাও দেখা যাচ্ছে না।
শরীর ঘেমে একাকার। ললাটের বিন্দু বিন্দু ঘাম জানান দিচ্ছে আরান কতটা বিচলিত দুহার চিন্তায়। দুহার মুঠোফোন বেজে চলছে। রিংটোনের আওয়াজ অনুসরণ করে আরানের সেখানে যায়। কাশবনের ঝোপঝাড়। দুহার ফোন পড়ে আছে। ফোন হাতে নিয়ে আরান আশেপাশে ভালোভাবে পর্যবেক্ষণ করে। দুহা নেই, নেই তার কোন অস্তিত্ব। অদূরে লাল বক্স পড়ে আছে। আরান হাতে তুলে নেয় সেটা। একজোড়া নুপুর রয়েছে তাতে। চিনতে অসুবিধে হলো না আরানের। এটা তার দেওয়া উপহার। যা আজ পর্যন্ত দুহা যত্নে রেখেছে নিজের কাছে। নুপুর জোড়া মুষ্টিবদ্ধ করে আরান চোখ বন্ধ করে নেয়। ছলছল নয়নে শুধায়,
‘ কোথায় খুঁজে পাবো তোমায়, দুহা!’
——-

আবছায়া আলো ঘেরা ঘরটির এক কোণায় নিস্তেজ দেহ পড়ে আছে এলমা। ঠোঁট কেটে র’ক্ত পড়ছে, হাত-পা ছিলে গেছে। অজ্ঞান এখনো। বাহিরে দুজন পুরুষ পাহারায় নিয়োজিত। রাগে দুজনের চোয়াল শক্ত করে রেখেছে।
‘ একটাকে পেয়েছি, আরেকটা হাতের কাছে পেয়েও পেলাম না। চতুর ছিলো ভীষণ। লাভ দিয়েছে গাড়ি থেকে। কোথায় চলে গেছে?’
সিগারেট ধরলো লোকটি। লম্বা নিশ্বাস ভেতরে টেনে নাক মুখে ধোঁয়া আকাশে উড়িয়ে দিলো। অপরজন লোকটির হাত থেকে সিগারেট টান মেরে একই কাজ করল। গাল চুলকাচ্ছে, মুখশ্রীতে লোভনীয় ভাব। উওরে বলে,
‘ যাই বলিশ ভেতরের মাইয়াটার থেকে ঐ মাইয়াটা দারুন ছিল। গড়নে,গঠনে! আমার তো ইচ্ছে করছিল বসের আগেই কাম সাবার করতে।’
‘ চুপ শা’লা এসব কথা মুখেও আনবি না। বস জানতে পারলে জান নিয়ে নিবো।’
দুজন লোক নিশ্চুপ। নিশ্বাসের গতিবেগ ছাড়া আর কোনো আওয়াজ শোনা যাচ্ছে না।
———

গাড়ি ছুটছে আপন গতিতে। আরোহণকৃত মানবটি আশাপাশে খুঁজে চলছে প্রেয়সীকে। চোখের সামনে ভেসে উঠছে তিন বছর আগের সেই রোমহর্ষক দিনটার কথা। সেদিন এবং আজকে উভয়দিনে আরান দুহাকে বাঁচাতে পারেনি। অনেকেই বলে, পুরুষ মানুষের শত কষ্টের মাঝেও কাঁদতে নেই। পুরুষ মানুষ নাকি কাঁদতে জানে না। আদৌও কি তাই! আরান কাঁদছে মেয়েদের মত ফুঁপিয়ে। আরানের অন্তর ক্ষতবিক্ষত হয়ে যাচ্ছে প্রেয়সীর বিরহে। কোন কূল কিনারা পাচ্ছে না আরান। হঠাৎ আড়ানের মুঠো ফোনে কল আসে। ফোন কানে নিতেই আরানের মুখ উজ্জ্বল হয়ে ওঠে খুশিতে। গাড়ি ঘুরিয়ে আরান চলে যায় সঠিক স্থানে।

খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হাঁটছে দুহা। অবস্থান করছে পাকা একটি রাস্তার পাশে। একটার পর একটা গাড়ি ছুটে চলছে আপন গতিতে। একজন অবলা মেয়েকে দেখে কেউ গাড়ি থামাচ্ছে না। দুহা থামাতে চেষ্টাও করেনি। দুহা অন্যমনস্ক, ভাবছে এলমার কথা। বড়ো একটা কারো গাড়ি এলমাকে সঙ্গে করে নিয়ে চলে গেছে। রক্ষা করতে পারেনি দুহা। নিজে কোন রকম বেঁচে এসেছে সেখান থেকে। চলন্ত গাড়ি থেকে ঝাঁপ দিয়েছে পাকা রাস্তায়। ভাগ্যিস সেখানে কয়েকজন ছেলে মেয়ে ছিল। নয়তো আজও এলমার স্থান যেখানে দুহার স্থান শেখা থাহতো। দুহার এখন নিজেকে স্বার্থপর মনে হচ্ছে। এলমাকে ফেলে যে সে একাই ঝাঁপ দিয়েছে তা ভেবে।

সাদা রঙের একটা প্রাইভেট কার আচমকা দুহার সামনে এসে দাঁড়ায়। দুহা ভাবে হয়তো সেই বাজে লোকগুলোর গাড়ি এটা। কিন্তু না দুহাকে অবাক করে আরান বেরিয়ে আসে গাড়ি থেকে। দুহা নিজের আবেগকে ধরে রাখতে পারল না। খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে এসে আরানকে ঝাপটে ধরে দুহা। কান্না করছে সে বিরবির করে কিছু একটা বলছে যা আরানের বোধগম্য হচ্ছে না। আরন শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। নিজেকে পুরুষ বলে গালি দিচ্ছে।
আরান আর নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারল না। দুহার কান্না যে সহ্য হচ্ছে না। কান্না থামাতে হবে। আরান এবার দুহার মাথায় হাত বুলিয়ে আশ্বস্ত স্বরে বলে,

‘ভয় নেই দুহা। আছি তো আমি পাশে।’

‘ ওরা ওরা এলমাকে তুলে নিয়ে গিয়েছে আরান ভাইয়া। আমার চোখের সামনে মেয়েটা অজ্ঞান হয়ে পড়ে ছিল। আমি কিছুই করতে পারিনি।’

আরান দুহাকে নিজের থেকে আলাদা করল। চোখের পানি মুছে গালে হাত রেখে বলল,

‘ কারা ছিল? তুমি কাউকে দেখেছো? তোমার এই অবস্থা কেন? সে সময় কি হয়েছিল তোমার?’

দুহা এবার আরো জোরে কান্না শুরু করে। মনে পড়ে যায় সেই সময়ের কথা। দুহা কান্না সেই বিরল মুহূর্তের কথা বলতে শুরু করে,

‘ এলমাকে যখন খুঁজে পাচ্ছিলাম না। তখন আপনার কথা মতো আমি ঝোপঝাড়ের আড়ালে লুকাতে যাই। কিন্তু সেখানে আরো আগে থেকেই দুজন লোক লুকিয়ে ছিল। আমাকে দেখে তখন টেনে হিচড়ে নিয়ে যেতে থাকে গাড়ির দিকে। আমি চিৎকার করতে থাকি কিন্তু বাঁচার কোন মাধ্যম পাইনা। একসময় যে লোক আমাকে ধরে রেখেছিল তার হাতে কামড় বসিয়ে গাড়ির দরজা খুলে লাফ দেই। খোলা মাঠ ছিল। কিছু ছেলেমেয়ে সেখানে বল খেলছিল। তাই লোকগুলো আমাকে চেয়েও আবার পুনরায় ধরে নিয়ে যেতে পারেনি। এরপর থেকে আমি হাঁটতে হাঁটতে এ পর্যন্ত এসেছি।’

আরান এবার নিজের ইচ্ছায় দুহাকে জড়িয়ে ধরে। মাথায় অধর ছুঁয়ে বলে,

‘ চিন্তা করো না দুহা। এলমাকে খোঁজার দায়িত্ব আমার। কারণ সে আমার দায়িত্ব ছিল। আমি আমার দায়িত্ব কখনোই নিতে পারিনি। তোমার ক্ষেত্রেও না এমনকি ছোট বোনের ক্ষেত্রেও না।’

আয়ানের কথা দোহার কানে প্রবেশ করেনি। দুহা কান্না করে যাচ্ছে। দুহা যদি খুব মনোযোগ সহকারে শুনতো আরানের কথা তাহলে একটু হলেও বুঝতে পারত আরানের কথার মর্মার্থ।
————–

আজ দুই মাস অতিবাহিত হয়ে গেছে এলমা নিখোঁজ। এলমার বাবা-মা বেঁচে থাকতেও মৃত। দুহা রুটিন অনুযায়ী প্রতিদিন বিকেলে এলমার বাসায় যায়। কাকতালীয়ভাবে আরানকে প্রায় দিনই এলমার বাড়ির সামনে দেখতে পায় দুহা। জিজ্ঞেস করলে বলে, ‘ শিক্ষক হিসেবে এলমার বাবা-মার খোঁজ নিতে আসলাম।’ প্রত্যুওরে দুহা ভ্রু যুগল কুঁচকে নেয়।

দুহা আজও যাচ্ছে এলমার বাড়িতে। কলিং বেল বাজাতেই দশ বছরের রাবেয়া মেয়েটা দরজা খুলে দেয়। হাসিমুখে বলে,’ আসেন আফা, আইজ একখান রেসিপি রানছি। যা মজা হইছে না! এলমা আপা থাকলে কইতো! আয় রাবেয়া তোকে সাজাইয়া দেই।’

আনন্দের সহিত বললেও শেষের কথায় মন খারাপ করে ফেলে শেষের কথায়। কান্না করে ফেলে মেয়েটা। দুহার চোখেও জল। কয়েকদিনের পরিচয়ে এলমাকে অনেক আপন করে নিয়েছিল সে।

‘ কাঁদে না রাবেয়া! পুলিশ এলমার খোঁজ করছে। খুব শীঘ্রই এলমা আমাদের কাছে চলে আসবে।’

সোফার ঘর থেকে কথার আওয়াজ ভেসে আসছে। দুহা সেদিকে এগিয়ে যায়। সেখানে উপস্থিত থাকা একজনের কথা শুনে থমকে যায় দুহা। মুখে হাত চেপে রাখে যেন আওয়াজ না বের হয়। মনে মনে হিসাব কষে চলে আসে সেখান থেকে। পিছন থেকে রাবেয়া ডেকে যাচ্ছে দুহাকে। কিন্তু দুহা দিক বেদিক না দেখে সম্মুখে এগিয়ে যায়।
————

আঁধার রজনী। ছাদে বসে আছে দুহা। গান গাইছে আপনমনে। ছাদের দরজা বন্ধ করার আওয়াজ আসে কানে। দুহা জানে মানুষটা কে! মুখে হাসির রেখা ফুটে উঠে তাঁর। গানের স্বর আরো বাড়িয়ে দেয়। মানুষটা পাশে এসে দাঁড়িয়েছে দুহা বুঝতে পেরেছে।

‘ এসেছেন তবে?’

‘ বাধ্য করেছো তুমি।’

‘ জেনে গেলাম তো সব তথ্য। এবার হা’জ’তে ঢুকাবেন নাকি আমায়?’

আরান হাসে। দুহার পাশে এসে বলে,

‘ ভালোবাসার হা’জ’তে বন্দি হতে চাইলে রাজি আছি। তবে ফি হিসেবে ছোট ছোট আবদার রাখব, না করতে পারবে না তুমি।’

দুহা হাসে। নিবিড়ভাবে আরানের হাত জড়িয়ে ধরে। অন্তরে চরম শান্তি। ভালোবাসার মানুষটি পাশে আছে আর কি চাই।

চলবে……..