দখিনা বারান্দায় তুমি আমি পর্ব-০৯

0
385

#দখিনা বারান্দায় তুমি আমি
#আফসানা_মিমি
|নবম পর্ব |

টিফিনের সময়ে মলিন মুখে কলেজ ক্যাম্পাসের ক্যান্টিনে বসে আছে দুহা। বিশেষ কারণ আছে বৈকি। দুহার আরান অনুপস্থিত আজ কয়েক সপ্তাহ ধরে। আরানের অনুপস্থিতিতে তাহেরা ম্যাডাম ক্লাস নিচ্ছেন। আজ আরমান ও অনুপস্থিত দূর সম্পর্কের চাচা মারা গিয়েছেন সেখানে যেতে হয়েছে। দুহার এখন মনে মনে খুব আফসোস করছে কেনো সে এমন প্রতিষ্ঠানে ভর্তি হয়েছিল! যেখানে পড়াশোনা ছাড়া আর সব কিছুর সুযোগ আছে! এখানে নতুন এসেই ছাত্রীর মৃ’ত্যু, তারপর এলমার অ’প’হ’র’ণ। দুহা ভেবে নিয়েছে সে এই কলেজ থেকে টিসি নিয়ে অন্য কোথাও ভর্তি হবে। আর আজ ই এই ব্যাপারে দুহার বাবার সাথে কথা বলবে।

‘ একা একা কি করছো লিটল গার্ল?’

কারো কথা শুনে পিছনে ফিরে তাকাল দুহা। তাহেরা ম্যাডাম দাঁড়িয়ে আছেন হাসি মুখে। বলা বাহুল্য তাহেরা ম্যাডামকে সবাই যেমন ভয় পায় রাগের জন্য, দুহার বেলায় ব্যাপারটা বিপরীত হয়ে আছে। দুহার সামনে তাহেরা ম্যাডাম পানি। দুহাকে আদর করেন, আপন ভাবেন। কয়েক সপ্তাহর মধ্যেই দুহার সাথে ভালো সম্পর্ক হয়েছে ওনার।

‘ কী ব্যাপার! কোথায় হারালে।’

চেয়ার টেনে দুহার সামনে বসে পড়লেন তাহেরা ম্যাডাম। মুখে সব সময় মত চমৎকার হাসি। দুহা খুশি হয়েছে। একাকীত্বে একজন সঙ্গী পেয়ে গিয়েছে। হাসি মুখে উত্তর দেয়,

‘ আরমান আজকে আসেনি তাই মনটা খারাপ।’

‘ আমি চলে এসেছি তোমার সঙ্গ দিতে। চলো একসাথে টিফিন করি। আমি নিজ হাতে রান্না করে নিয়ে এসেছি। খাবে?’

দুহা ইতস্তবোধ করছে। এদিক সেদিক তাকিয়ে নিজেকে ঠিকঠাক করে উত্তর দিল,

‘ ম্যাডাম! এতটাও আমার জন্য করতে হবে না। মানুষ দেখলে কি ভাববে। ভাববে আমি আপনাকে তেল লাগাচ্ছি ভালো রেজাল্ট করার জন্য। আপনি খান, আমি না হয় অন্য দিন!’

‘ আমি তোমাকে নিজের মেয়ের মত ভাবি তাই কে কি বলছে তা কানে নেই না।’

নিজের হাতে খুব যত্ন করে খাইয়ে দেন তাহেরা ম্যাডাম দুহাকে। ম্যাডামের চোখেমুখে খুশির ঝিলিক আর দুহার মুখে তৃপ্ততা। একজন মায়ের হাতে যেন একজন মেয়ে খাবার খাচ্ছে।

টিফিনের ঘণ্টা বাজতেই দুহা নিজেকে পরিপাটি করে চলে যায় নিজ ক্লাসে। সবগুলো ক্লাস কমপ্লিট করে কলেজের বাহিরে দাঁড়াতে দেখা মিলে আরানের। আয়ান গম্ভীর মুখে দাঁড়িয়ে আছে গেটের সামনে। দুহাকে দেখা মাত্র মুখশ্রী আরো গম্ভীর করে তোলে। দুহার হাত শক্ত করে ধরে সামনের দিকে আগাতে থাকে।

‘ আরে হচ্ছে টা কি! এভাবে ষাঁড়ের মতো টেনে টেনে আমাকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছেন? আমি মানুষ, গরু না।’

আরানের গম্ভীর স্বর শোনা যায়,

‘ তাহেরা ম্যাডামের কাছ থেকে দূরে থাকবে।’

‘ কেন থাকব? উনি তো আমাকে খুবই ভালোবাসেন। মেয়ের মত আদর করেন। সবাই বলে উনি নাকি খুবই রাগী কিন্তু আমার কাছে ওনাকে একদম নরম তুলার মত লাগে।’

‘আমি যা বলেছি তাই।’
‘আমি আপনার কথা শুনব না। কি করবেন আপনি শুনি?’

আরান থেমে গেলো। অগ্নি চোখে তাকালো দুহার দিকে।

‘ একদম উঠিয়ে পঁচা ডোবায় ফেলে দিয়ে আসবো। বেশি সাহস বেড়ে গেছে না! ভালোবাসি, তাই বলে যে তোমার অন্যায় ও প্রশ্রয় দিব তা কিন্তু না।’

দুহাও রেগে গেলো। দাঁড়িয়ে কোমড়ে হাত রেখে বলল,

‘ এই যে পুলিশ পুলিশ ছদ্দবেশে আছেন তো কি হয়েছে! আমি কিন্তু আপনার পরিচয় জানি। এভাবে ধমক দিলে যে আমি আপনাকে ভয় পাব সেটা কিন্তু না।’

‘ তুমি কিন্তু বেশি বেশি বলছো। তুমি কি চাও আমি আগের মতো কিছু করি! একদম পিছু ছাড়বো না বলে দিলাম দুহা! সারাক্ষণ আঠার মতো লেগে থাকবো তোমার সাথে।’

দুহা জিহ্বায় কামড় কা’টে। হেসে ফেলে পূর্বের কথা মনে করে। আরান দুহকে বুঝতে পারে কিন্তু কিছু বলে না। কলেজ থেকে কিছু দূরে এসে দুহাকে নিবিড় ভাবে এক হাতে জড়িয়ে ধরে। এরপর মাথায় অধর ছুঁয়ে বলে,

‘আমার পিচ্চিটা।’
———

দেখতে দেখতে আরো একটা মাস পার হয়েছে। এলমার কোন খোঁজ খবর মেলেনি। সকলের সামনে একটা বিষয় খোলাসা হয়েছে আর সেটা হচ্ছে এলমা বাবা একজন রিটায়ার্ড পুলিশ অফিসার। এলমার কথিত আঙ্কেল হচ্ছে আরান। আরান এলমার সুরক্ষার দায়িত্বে ছিল। অবস্থান করতো এলমাদের বাসায়। দুষ্টুমি করে আরানকে আঙ্কেল ডাকতো।

আরান গোয়েন্দা পুলিশ অফিসার।কলেজের ছাত্র ছাত্রীদের মৃত্যুর রহস্য উন্মোচনের জন্যই এখানে নিয়োজিত হয়েছিল সে। যা অবগত ছিল শুধুমাত্র কলেজের প্রিন্সিপাল স্যার। আরান নিজের কাজের অতি নিকটে চলে এসেছে। সন্দেহ করেছে কয়েকজনকে এবং সন্দেহ সত্যি হয়েছে কয়েকজনের মাঝে।

আজ শুক্রবার। ছুটির দিন। দুহা নিজেকে পরিপাটি করে তৈরি করে নিয়েছে। উদ্দেশ্য তাহেরা ম্যাডামের বাড়ি। আজ তাহেরা ম্যাডামের জন্মদিন। বিশাল বড় আয়োজন করেছেন তিনি। শুধু দুহাকে নয় আরো অনেক শিক্ষার্থীকে আমন্ত্রণ করেছেন তিনি।

সকাল থেকে আরানকে অনেকবার ফোন করেছে দুহা। বিগত চব্বিশ ঘন্টা আরানের সাথে কোন যোগাযোগ নেই। আরান বেঁ’চে আছে না ম’রে গেছে কোন কিছু সম্পর্কে অবগত নয় দুহা। চিন্তা হচ্ছে,ভয় গ্রাস করছে অন্তরে। আবারো চেষ্টা করে আয়নের নাম্বারে। রিং বাজতে বাজতে বন্ধ হয়ে যায় কিন্তু আরানের ফোন ওঠাবার নাম গন্ধ নাই।
দুঃখে দুহা ছোট্ট করে একটি মেসেজ পাঠিয়ে দিল আরানের নাম্বারে। তারপর কিছু একটা ভেবে মুচকি হেসে রহিমা খালাকে বলে বের হয়ে যায় বাড়ি থেকে।

রাস্তা থেকে আরমানকেও সাথে নিয়ে নিলো দুহা। আজ যেন আরমানের কথাও ফুরাচ্ছে না। অনবরত কথা বলেই যাচ্ছে। কথা বলার মাঝে এক পর্যায়ে বলে ওঠে,

‘ তুই জানিস! দিনে দিনে যে তুই সুন্দরী হয়ে যাচ্ছিস?’

আরমানের হঠাৎ কথায় দুহা বিষম খেল। বিস্ময়কর চোখে তাকিয়ে বলে,

‘ এটা কেমন কথা রে ভাই! তুই কী কিছু সেবন করেছিস? মাথার মগজ কি শূন্য হয়ে গেছে?’

‘ আরে ধ্যাত কী বলি! আমি তো প্র্যাকটিস করছিলাম আমার এক নাম্বার নাম্বার গার্লফ্রেন্ডের জন্য। একটা মেয়েকে খুব পছন্দ হয়েছে। আমার নানু বাড়ির পাশে। এখন কথা হচ্ছে তোর পছন্দ হবে কিনা জানিনা।’

‘ তোর পছন্দ খুবই ভালো, যার প্রমান আমি। তাহলে অবশ্যই সেই মেয়ে ও ভালো হবে।’

বেশ ভাব নিয়ে কথা বলল দুহা। হেসে উঠলো দুজন। খোশগল্প করতে করতে তাহেরা ম্যাডামদের বাসায় চলে আসলো দুজন।
——-

দুজন ছেলের মাঝে কথা কা’টা’কা’টি হচ্ছে। এক কথা দুই কথা বলে বিশাল ঝগড়ার সৃষ্টি হয়েছে। এক পর্যায়ে মা’রা’মা’রি অবস্থা। আশেপাশের মানুষজন জড়ো হয়ে তামশা দেখছে। আরমান দুহা পাশেই ছিল। ছেলে দুইটা মারামারি করতে করতে এক পর্যায়ে দুহা আরমানের সামনে চলে আসে। দুজনের শরীর থেকেই র’ক্ত বের হচ্ছে। কেউ কারোর থেকে কম না। অবশেষে একজন পরাজয় বরণ করে এবং ক্ষমা চায়। তবে সেই ছেলের অবস্থা সংকটে। সেই ছেলে আরমানের কাছে এসে হাত পা ধরে বলছে যেন তাকে বচায়।
আরমানে দুহা পড়ে মহা বিপদে। আরমান চাইছে না দুহাকে একা রেখে কোথাও যেতে। আবার সামনে এমন অবস্থা। উপায়ান্তর না পেয়ে দুহাকে বলে একাই ভিতরে যেতে। এদিকে আরমান এবং কয়েকজন মানুষ ধরে আহত লোকটিকে নিয়ে যায় হাসপাতালে।

সাদা রঙে রং করা দোতলা ভবন। এই ভবন হচ্ছে তাহেরা ম্যাডামের। বাইরে থেকে একদম সাদা। ভেতরে প্রবেশ করে দুহা। আশ্চর্যজনক বিষয় হলো দরজা খোলা ছিল।
চারিদিকে একদম চুপচাপ। দুহা ভবনে প্রবেশ করে। সবকিছু অন্ধকার, দরজা জানালা বন্ধ। বাহিরের আবছায়া আলোতে হাঁটা ও কষ্টের হয়ে গেছে। দুহা ম্যাডাম বলে ডেকে উঠে। একবার, দুইবার করে কয়েকবার ডাকে কিন্তু কারো কোন খবর নেই। এমনকি জন্মদিনে উপলক্ষে যে অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছে তার কোন নিশানা নেই। একপর্যায়ে ভয়ে বাড়ি থেকে বের হয়ে আসতে নেয় কিন্তু আফসোস দুহা যেই দরজা দিয়ে এসেছিল সে দরজা বন্ধ।
দুহা পড়েছে মহাবিপদে। মনে মনে ভাবছে তাহেরা ম্যাডাম কি তার সাথে দুষ্টুমি করছে? দুহা নিজের জীবন নিয়ে খুবই আফসোস করছে। বারবার দুহা এমন বিপদে কেন পরে তাই ভাবছে।

নিস্তব্ধ পরিবেশ। মানুষের শ্বাস নিশ্বাসের আওয়াজ শোনা যাচ্ছে শুধু। দুহা এবার চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকে। ভাবতে থাকে এ অবস্থায় কি করবে। এতক্ষণে এতোটুকু বুঝতে পেরেছে যে তাহারা ম্যাডাম ভালো না। নয়তো এমন কাজ করতো না। এদিকে আরমানের জন্য খুব চিন্তা হচ্ছে। না জানি আরমানের বাহিরে কোন বিপদ হয়েছে কিনা। হঠাৎ কারো ফুপানোর আওয়াজ কানে আসে। দুহা সেই আওয়াজ অনুসরণ করে এগিয়ে যায় থেমে যায় একটি ঘরের সামনে যে ঘর থেকে আওয়াজের উৎস। দুহা কি করবে বুঝতে পারছে না ভেতরে যদি অনাকাঙ্ক্ষিত কাউকে দেখতে পায়!
দুহার দরজা খুলে দেয়। দেয়াল হাতরে সুইচ বোর্ড খুঁজতে থাকে কিন্তু আফসোস সুইচবোর্ড পেলেও বাতিল জ্বললো না। অন্ধের মত হাঁটতে থাকে এক পর্যায়ে পায়ের কাছে কারো সাথে ধাক্কা লাগে। দুহা ভয় পেয়ে যায়। ভীত স্বরে কে এখানে বলে সরে দাঁড়ায়। দুহাকে অবাক করে দিয়ে কেউ একজন বলে ওঠে,’ পানি খাব।’

দোহার চিনতে পারে এটা তার প্রাণপ্রিয় বন্ধু এলমার স্বর। কাছে চলে যায় দুহা এলমার দুর্বল শরীর টেনে উঠায়। এরমধ্যে এলমাকে রেখে দেয়াল হাতরে জানালার খোঁজ করে এবং পেয়েও যায়। চোখে পানি চলে আসে দুহার। কেউ যেন দুহার শরীরে আঁচড় কে’টে’ছে। মেয়েটা জমিনের শুয়ে কাঁৎমরাচ্ছে। কেঁদে ফেলে দুহা। সবকিছু চোখের সামনে পরিষ্কার হয়ে আসে। এসব কিছুর পিছনে তাহেরা ম্যাডামের হাত। নিশ্চয় বাহিরের ঝগড়াঝাটি পিছনে তাহেরা ম্যাডামের হাত আছে নয়তো এমন কিছু হতো না।

দুহা এলমার গালে হাত রেখে ডাকতে থাকে। চোখ বন্ধ অবস্থায় নিঃশ্বাস নিচ্ছে শুধু সে। একবার দুইবার তিনবার ডাকার পর এলমা স্বম্বিত ফিরে আসে।
আঁধো চোখ খুলে তাকায় দুহার পানে। দুহাকে দেখে যেন প্রাণ ফিরে আসে। এলমা কেঁদে ফেলে এরপর বলতে থাকে রোমহর্ষক কাহিনী।

‘ আমাকে ওরা শেষ করে ফেলেছে দুহা। আমি বাঁচতে চাই না আর। ওরা আমার সবকিছু কেড়ে নিয়েছে। আমাকে কেন এভাবে ফেলে রেখেছে! কি দোষ করেছি আমি? আমি বাঁচতে চাই না দুহা। ওরা আমার সম্মান কেড়ে নিয়েছে। একজন, দুইজন না প্রতিদিন দদজনের মত দল বেঁধে আমায় ধ’র্ষ’ণ করেছে। তুই ই বল এভাবে বেঁচে থেকে কি লাভ আমার?’

চলবে….