দখিনা বারান্দায় তুমি আমি পর্ব-০৭

0
347

#দখিনা বারান্দায় তুমি আমি
#আফসানা_মিমি
|সপ্তম পর্ব |

উষসীর সময়ে প্রতি মা-বাবা সন্তানদের পড়তে বসায়। এই সময় মোক্ষম পড়াশোনার জন্য। ব্যস্ত মা-বাবারাও সারাদিনের পরিশ্রমের শেষে কাজ থেকে নিস্তার পান। শত ক্লান্তির মধ্যেও সন্তানকে শিক্ষাদানে পিছপা হোন না।

পড়াশোনা নামে ডায়েরি লিখছে দুহা। মনের অব্যক্ত সব কথন লিখে যাচ্ছে। প্রায় সময় এই কাজ করে দুহা। মুঠোফোনের আওয়াজে লিখায় ব্যাঘাত ঘটে। ললাটের উপর সূক্ষ্ম ভাজ বিদ্যমান। ফোনের পর্দায় এলমার হাস্যজ্বল চেহারা ভাসছে। রিসিভ করে হ্যলো বলতে দেরি কিন্তু এলমার কথা বলতে দেরি না।

‘ আমার গুলগুলি! ‘
এলমার চিৎকারে দুহা কান থেকে ফোন নামিয়ে নেয়। ভাবতে থাকে গুলগুলির মানে টা কী! ওইদিকে এলমা গুলগুলি বলে চিৎকার করে যাচ্ছে। অবশেষে দুহা মুখ খুলে এবং বলে,

‘ গুলগুলি কে?’

‘ তুই গুলগুলি। তা কি করছিস আমার বুলবুলি?’

‘ বুলবুলি?’

অপরপাশে এলমার হাসির শব্দ। দুহা বুঝতে পারে এলমার দুষ্টুমি। উওর দেয়, ‘পড়ছিলাম’

‘ মিথ্যা কথা। তুই তো ডায়েরি লিখছিস।’

কান থেকে ফোন সরিয়ে ফেলে দুহা। আশেপাশে ভালোভাবে লক্ষ্য করে দেখে এলমা আছে কিনা। অপরপাশে এলমা হাসছে। আবারও বলে ওঠে,
‘ সত্যিই কী ডায়েরি লিখছিলি? আমি তো অন্ধকারে ঢিল মেরেছি।’
দুহা এবার হেসে উঠে।

‘ আগামীকাল কলেজে যাবি?’

দুহা বসা থেকে উঠে বারান্দায় দোলনায় বসে। টিমটিম লাইটের আলো পড়ছে বারান্দায়। দুহা প্রত্যুওরে বলে, ‘ নতুন ক্লাস শুরু হয়েছে, যেতে তো হবেই।’
‘ এত পড়াশোনা করে লাভ নাই রে গুলগুলি!
‘ তো কি করবি! হাঁড়ি পাতিল মাজবি?’
এলমা হাসছে। দুইদিনে দুহাকে আপন করে নিয়েছে। স্বর ধীরে করে এলমা বলছে,’ আগামীকাল কলেজ ফাঁকি দিয়ে ঘুরতে যাবো।’
দুহা শোনার সাথে সাথে চিৎকার করে বলে ওঠে,’ কখনো না। আমি কোনদিন ক্লাস মিস দেই না।’
‘ এজন্যই তো আগামীকাল মিস দিবো। তুই যদি আমার সাথে ঘুরতে না যাস তো আমাদের বন্ধুত্ব আজই শেষ।’
ফোন কেঁটে গেলো। দুহা পড়েছে মহা বিপদে। আগামীকাল কী হবে তাই ভাবছে।

কিছু পড়ে যাওয়ার আওয়াজে বারান্দা থেকে ঘরে ফিরে আসে দুহা। চোখের সামনে আরানকে দেখে থমকে যায়। আরান গভীর মনোযোগ সহকারে দুহার ডায়েরি পড়ছে আর মুচকি হাসছে। প্রথমে মনের ভ্রম ভেবে দুহা চুপটি করে দাঁড়িয়ে থাকে পরক্ষণে ডায়েরিতে ব্যক্তিগত লিখা আছে ভেবে হন্তদন্ত পায়ে এসে ছো মেরে আরানের হাত থেকে ডায়েরি নিয়ে নেয়। ভীত দৃষ্টিতে আরানের পানে তাকায় সে। আরান হয়তো বিশেষ কিছু পড়ছিলো। দুহার এহেন কাজে আরান ভ্রু যুগল কুঁচকে নেয়। বুকে হাত রেখে তীক্ষ্ম দৃষ্টিতে তাকিয়ে রয়। দুহার কাছে এই আরান নতুন একজন মানব। গুমরো মুখী, কথায় রস কষ নেই। অনুভূতি হারিয়ে গেছে তার। আরানের চাহনিতে দুহা অস্বস্তিতে পড়ে। ডায়েরি দুহাতে বক্ষঃস্থলের সাথে চেপে ধরে জিজ্ঞেস করে,
‘ আপনি এখানে যে?’

দুহার প্রশ্নে আরান সন্তুষ্ট হলো না। বিছানায় আয়েশ করে বসলো। দুহার হাতের ডায়েরির দিকে তীক্ষ্ম দৃষ্টিপাত করে বলল,

‘ বেড়াতে এসেছি। কুটুমের সাথে বুঝি এভাবে কথা বলতে হয়?’

দুহা থতমত খেয়ে যায়। কথা বলার কুল কিনারা পাচ্ছে না। উলটা পালটা কথায় যদি আরান গেয়ে বাঁধার মত কিছু বলে ফেলে?
দুহার নীরবতা আরানকে খুব পুড়াচ্ছে। অন্তরের মাঝে অসহনীয় যন্ত্রণা হচ্ছে। আরান খুব করে চাইছে দুহা কিছু বলুক ঠিক আগের মত। হঠাৎ আরানের মাথায় দুষ্টু বুদ্ধি আটলো। দুই পা উঠিয়ে সটান হয়ে শুয়ে পড়লো। চোখ বুঝে বলল,
‘ যা গরম পড়েছে! বাতাস করো তো দুহা রাণী?’

নাক লাল হয়ে আসে দুহার। দুহার জীবনের সবচেয়ে বিরক্তিকর বস্তু হচ্ছে মোজা। দুহার জীবনের চির শত্রুও বলা যায়! স্কুল বা কলেজ থেকে এসে দুহার সর্বপ্রথম কাজ হলো মোজা ধোঁয়া। মোজার গন্ধ নাকে আসলেই নাক পিটপিট করে। বমি চলে আসে। আরান এই বিষয়ে অবগত। ইচ্ছে করেই দুহার কামরায় মোজা পরিধান করে এসেছে এবং বিছানায় আয়েশ করে বসেছেও। যেন দুহা আরানকে কিছু বকে, কথা বলে। হলোও তাই! লাল হওয়া নাক নিয়ে দুহা চিৎকার করে ওঠে,
‘ এই এই করছেন কী? নামুন, নামুন বলছি বদ বাঁদড়।’

হেসে উঠে আরান। দুহার সামনে মুখে কাঠিন্যতা এনে বলে,
‘ সাহস তো কম না তোমার মেয়ে? বড়োদের সাথে আবারও বেয়াদবি করছো?’

ভয় পেলো যেন দুহা। কিন্তু দমে গেলো না। ডায়েরি টেবিলের উপর রেখে এবার কোমড়ে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে বলতে শুরু করল,

‘ এত কিছু বুঝি না। নামতে হবে বিছানা থেকে। আপনার জন্য আমি অসুস্থ হয়ে পড়লে খবর আছে বলে দিলাম।’

‘ নামবো না, কি করবে?’

দুহা ভাবনায় বিভোর। সত্যিই তো কী করবে সে? এতটুকু বল ও নেই যে আরানের সাথে লড়াই করবে। পর পর দুইটা হাঁচি দিয়ে ফেলেছে দুহা। নাকে সুড়সুড়ি দেয়া শুরু হয়েছে। এক আঙুলে নাক মুছে কাতর স্বরে বলল,
‘ লেখে গেছে ঠান্ডা। এবার আমার সেবা করবে কে, শুনি?’

আরান শোয়া থেকে উঠে গেছে ইতিমধ্যে। দুহার কাছে এসে নাক টেনে প্রত্যুওরে বলে,
‘ আমি আছি তো! সবসময়, তোমার আশেপাশে।’

অন্তরে তোলপাড় সৃষ্টি করে আরান চলে গেছে ঘর থেকে। দুহা বক্ষঃস্থলে হাত,রেখে দূর্বল শরীরে বিছানায় বসে, যেখানে আরান এতক্ষণ শুয়ে ছিলো। দুহা ভাবছে আরানের বলা কথা। সে কী এখনো দুহা পছন্দ করে? মনে হচ্ছে তো পছন্দ করে। দুহা স্পষ্ট দেখতে পেরেছে আরানের চোখে তার জন্য অসীম ভালোবাসা যা দুহা বছর খানেক আগে মামার বাড়িতে দেখতে পেয়েছিল। নাকের সুড়সুড়ির কথা ভুলে শুয়ে পড়ে দুহা। লজ্জায় মুখ ঢেকে ফেলে অনিমেষে।

খাবারের টেবিলে আজ এলাহি কাণ্ড করে বসেছে দুহার মা। হরেক আইটেমের রান্না বান্না করেছেন তিনি। কুটুম বলে কথা! প্রথম বাড়িতে এসেছে আপ্যায়ন ভালোভাবে না করলে ভাইয়ের শ্বশুরবাড়িতে মান সম্মান থাকবে না। দুহার বাবা দুলাল সাহেবের সাথে শোফায় বসে কথা বলছে। প্রসঙ্গ আরানের কাজকর্ম নিয়ে

‘ পেশায় কি কর তুমি?’

‘ এইতো বাচ্চাদের পড়াই, নিজে পড়ি। সময় পেলে সব ছেড়ে ঘুরে বেড়াই।’

‘ এতোটুকুতে কি তোমার হাত খরচ চলে?’

‘ চলে মানে! দৌঁড়ায়। তা এত তদারকি কেন? আপনার মেয়েকে বিয়ে দিবেন বুঝি!’

ঠাট্টার মাঝে আরানের কথা শুনে দুলাল সাহেব থতমত খেয়ে যান। দুলাল সাহেব খুব রসিক মানুষ। রসিকতা করতে পছন্দ করেন। আরানের সহিত মশকরা করে কথা বলছিলেন কিন্তু আরান যে এভাবে দুলাল সাহেবকে মাটিতে পিষে দিবে কে জানতো। খুক খুক কেশে পরিস্থিতির সামলে নেয় দুলাল সাহেব। আশেপাশে পর্যবেক্ষণ করেন স্ত্রী সন্তানদের দেখতে। কেউ নেই। এবার নিচু কন্ঠে দুলাল সাহেব বলেন,

‘ মেয়ে আমার ছোট। এত তাড়াতাড়ি বিয়ে দিচ্ছি না। কিন্তু ভালো পাত্র পেলে হাতছাড়া করব না।’
‘ মনে করুন পেয়ে গেছেন। এবার মানসিকভাবে প্রস্তুতি নেন।’

আরান হাসছে। মনে মনে ভাবছে,’ হবু শ্বশুরের সাথে ভালই মজা করা হচ্ছে। শশুর যদি জানতো যে তার মেয়েকে সত্যি সত্যি আমি চাইছি তাহলে আমাকে এতক্ষণে ঘর থেকে বের করে দিতো।’

হাসি-ঠাট্টার মাঝে দুই মানব খাবার টেবিলে বসলো দুলাল সাহেব মেয়ের অনুপস্থিতি দেখে ভ্রু কুঁচকে তাকান। মনে মনে ভাবেন,’ বাবা আসলে বাবার গলায় ঝুলে থাকে দুহা, চঞ্চলতায় দুলাল সাহেবের মাথা ধরে যায় কিন্তু আজ দুহার চঞ্চলতা চোখে ধরা দিচ্ছে না।
দুলাল হোসেন পাশে স্ত্রীর দিকে তাকাতেই দুহার মা বলে উঠেন,’ কাগজ কলম গিয়েছে দুহাকে নিয়ে আসতে। লুহা পড়ছে নিজের ঘরে।’
দুহার মায়ের কথা শুনে আরান হাসে। বিড়বিড় করে বলে,
‘পড়াশোনা তো বাহানা মাত্র। আসল কথা হচ্ছে সে আমার স্মৃতিচারণে ব্যস্ত।এত সহজে ঘর থেকে বের হবে না আজ।

————-
বুকে ব্যাগ গুঁজে ভীত নয়নে আশেপাশে নজর ঘুরাচ্ছে দুহা। বর্তমানে সে দাঁড়িয়ে আছে কলেজের পিছনের পাশটায়। এলমার সাথে মিলে কলেজ থেকে পালিয়ে এসেছে তারা। প্রথম ক্লাসে করে বাথরুমে যাবার বাহানায় পালিয়ে আসে। বুক সমান দেয়াল পার করে দুহা এলমার সাহায্যে। দুহা দাঁড়িয়ে আছে, ভয় পাচ্ছে। পাঁচ মিনিট হয়ে গেছে এলমার খবর নাই। এলমা ধরা পড়ে গেছে টিচারের কাছে, ভাবছে দুহা। দাঁত দিয়ে নখ কামড়াচ্ছে আর বারবার উঁকি দিয়ে দেখছে অপর পাশটায়। কিছুক্ষণ পর ধপাস করে শব্দ হয়। দুহা তাকিয়ে দেখে এলমা নিচে চিতপটাং হয়ে শুয়ে আছে। দুহা দৌড়ে এগিয়ে যায়। বিচলিত হয়ে জিজ্ঞেস করে,

‘ ব্যথা কী বেশি পেয়েছিস?’
গায়ের ময়লা ঝাড়তে ঝাড়তে এলমা হাসি মুখে জবাব দেয়,
‘ এতটুকুতে এলমা ব্যথা পাবে নাকি! তাড়াহুড়া করতে গিয়ে পড়ে গিয়েছি। ঐ যে তাহেরা ম্যাডাম একটুর জন্য দেখেনি আমাকে। ধরা পড়লে খবর খারাপ হতো। চল আজ তোকে সুন্দর জায়গায় নিয়ে যাবো।’

দুই বান্ধবী হাতে হাত মিলিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে। দুজনের মুখে হসি। দুই বান্ধবীর পিছনে কেউ একজন কাউকে ফোন করে বলে,
‘ শিকারি আসছে আরেকটা শিকারি কে নিয়ে নিজ ইচ্ছায়। খাঁচা তৈরি করো, শিকার করতে হবে তো! আজ আমার পকেট ভর্তি চাই।’

সবুজ অরণ্য। দুই বান্ধবী মন খুলে হাসছে। দুহা এলমা এসেছে পাশের একটা পুকুর পাড়ে। মাদুর বিছিয়ে বসেছে দুইজন। সাথে নিয়ে এসেছে হরেক রকম খাবার। সব বুদ্ধি এলমারই। দুহা খালি হাতে এসেছে শুধুমাত্র কাঁধে একটি ব্যাগ ঝুলিয়ে।
এলমা গিয়েছে পুকুর পাড়ে হাতমুখ ধৌত করার জন্য। এদিকে দুহা চারপাশ দেখছে। আজ প্রায় তিন বছর পর এরকম খোলা জায়গায় আসা তার। তিন বছর পূর্বে সেই ঘটনার পর থেকে একাকি কোথাও বের হয় না দুহা। এলমার সাথে থেকে একটু সাহস বেড়েছে। চোখ বন্ধ করে লম্বা নিঃশ্বাস নিয়ে হাসছে দুহা।
চিন্তা করছে গতকাল রাতের কথা।
দুহা যখন খা বারের টেবিলে আসে আরানকে দেখতে পায় সেখানে। লজ্জায় নুয়ে পড়ে দুহা। আরানের বিপরীত দিকে বসে পড়ে। আরান প্রথমে শান্ত ভদ্র থাকলেও পর মুহূর্তে সে পাল্টে যায়। দুহার পায়ে সুড়সুড়ি দিতে শুরু করে। দুহা প্রথমে ভাবে কাগজ বা কলমের কাজ। তাই দুহা পালটা সুড়সুড়ি দেয় সেই পায়ে এরপর তাকায় কাগজ কলমের পানে। তার মজা করে খেতে ব্যস্ত। তখন চোখ যায় আরানের দিকে। আরান দুহার দিকে তাকিয়ে মিটিমিটি হাসছে। দুহা বুঝে যায় এটা আরানের কাজ। লজ্জায় মাথা নুইয়ে ফেলে। এদিকে আরান দুহার লাজুকমাখা মুখশ্রী দেখতে বারবার একই কাজ করতে থাকে।

দুহা সেসব কথা মনে করে হাসছে। দুহার হাসি মুখ দেখে এলমা নিজেও হেসে ফেলে। তারপর ঠাট্টার ছলে বলে,

‘ কি রে প্রেমে পড়েছিস নাকি কারো? একাকী হাসা কিন্তু প্রেমের লক্ষণ!’

প্রত্যুওরে মুচকি হাসি উপহার দেয় দুহা। এলমার উদ্দেশ্যে বলে,

‘প্রেমে তো সেই কবে পড়েছি কিন্তু সে ধরা দিচ্ছে না। ব্যাপার না আমি নিজেই চলে যাব তার কাছে। এরপর সোজা তার অন্তরের কাছাকাছি এসে বলবো, ভালোবাসি।’

‘বাপরে কি ভালবাসা! এত ভালোবাসা কই রাখিস রে তুই? ইস পোড়া কপাল আমার, ভালোবাসার মানুষ নেই কোন। আরে এই বয়সে কাউকে ভালোই লাগে না। কেউ চোর, তো কেউ ডাকাত, কেউ নাক বোচা তো কেউ খা’টা’শ। একটারও মনে ধরে না।’

‘তোর জীবনে যেদিন ভালোবাসা আসবে সেদিন তুই বুঝবি। আশেপাশের সব কিছু গভীরভাবে অনুভব করবি। মনে ভালো লাগা কাজ করবে, মনে ছন্দ আসবে, লিখতে ইচ্ছে করবে, গাইতে ইচ্ছে করবে, হেলেদুলে নাচতে ইচ্ছে করবে। প্রকৃতিকে ভালবাসতে ইচ্ছে করবে, তুই যখন ভালবাসতে যাবি প্রকৃতিও তোকে ভালবাসতে চলে আসবে। এটাই ভালোবাসা।’

‘বাবা তোর মত এত গভীরভাবে ভাবা আমার কাজ না। দরকার নেই। চল আজকের দিনটা এনজয় করি।’

দুই বন্ধু হাসিমুখে সময় কাটাচ্ছে। একজন অপরজনকে নিয়ে আসা খাবার খাইয়ে দিচ্ছে। কিছুক্ষণ পর পর ছবি তুলছে। আবার নানান গল্প গুজব করে একজন আরেকজনের উপর ঢলে পড়ছে। এভাবেই চলছে সময়।

সময় তখন অপরাহের শেষের দিকে। বাড়ি ফিরতে হবে দুজনের। সবকিছু গুছিয়ে দুহা এলমা উঠে পড়ে। দুজন কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে হেঁটে যায় সামনের দিকে। আজ যেন দুজন বাচ্চা সেজে গেছে। ফিরে গিয়েছে সেই শিশু কালে।

রাস্তার কাছাকাছি চলে আসে দুইজন। হঠাৎ দুহার মনে পড়ে, হাসি মজার ছলে পুকুর পাড়ে দুহা বক্স ফেলে চলে আসে। যেখানে আরানের দেয়া নুপুর রয়েছে। দুহা বিচলিত হয়ে পড়ে। এলমার দিকে ফিরে বলে,

‘ পুকুর পাড়ে আমি আমার একটা বক্স রেখে এসেছি। সেখানে তার দেওয়া শেষ উপহার রয়েছে। আমি সেটা ছাড়া এক পাও সামনে আগাবো না। চল বক্স নিয়ে আসি।’

নাটক করে রাস্তার পাশে বসে যায় এলমা। পায়ে ব্যথা বলার অজুহাত দিয়ে বসে পড়ে রাস্তার পাশে। অগত্যা দুহা নিজে এগিয়ে যায় সেখানে। যাওয়ার আগে এলমার কোলে রেখে যায় নিজের ব্যাগ। সময় অতিবাহিত হয়ে যায়, মিনিট শেষ হতে পাঁচ মিনিট পার হয়ে যায়। দুহা হাসি মুখে এগিয়ে আসে রাস্তার পাশে। আশেপাশে নজর বুলিয়ে এলমাকে খোঁজ করে চলে কিন্তু আফসোস এলমার কোন খোঁজ পাওয়া যায় না। রাস্তার পাড়ে নিচে পড়ে আছে দুহার ব্যাগ এবং সেখানে কাউকে টেনে হিঁচড়ে নিয়ে যাওয়ার দাগ ভেসে আছে। দুহা বুঝতে পারল কেউ এলমাকে কোথাও নিয়ে গিয়েছে। আশেপাশে ভালোভাবে খোঁজ করলো কিছুক্ষণ। দুই হাত কাঁপছে, শরীর অসার হয়ে আসছে, ভয়ে কান্না করছে দুহা। কাকে ফোন করবে, কীভাবে কি করবে কিছুই বুঝে উঠতে পারছে না। কিছুক্ষণ পর খেয়াল আসে। দুহার কাছে আরানের নাম্বার আছে যা গতকাল রাতে কাগজ-কলম দিয়েছিল মজার ছালে।

কাঁপা কাঁপা হাতে আয়নের নাম্বারে কল লাগায়। সময় নিয়ে আরান রিসিভ করে।

‘ আরান ভাইয়া, এলমাকে পাচ্ছি না।’

দুহার স্বর শুনে আরানের সময় লাগেনি চিনতে। দুহা কান্না করছে। আজ কলেজেও দুজনকে দেখেনি আরান। ভেবেছিল হয়তো আসেনি। আরান দুহাকে আশ্বাস দিয়ে বলে,

‘ পাচ্ছো না মানে? কোথায় তুমি?’
দুহা কান্নার জন্য কিছুই বলতে পারছে না। আরান লম্বা নিশ্বাস ত্যাগ করে। নরম স্বরে বলে,

‘কিছু হয়নি দুহা! আমি আছি তো! কোথায় আছো এখন?’

দুহা ঠিকানা বলে। আরান রেগে যায়। এতদূরে তারা কি করছে ভেবে। মাথা ঠান্ডা করে আরান। ফোন না কেঁটেই গাড়ি নিয়ে রওনা হয় দুহার কাছে।

দুহার কানে ফোন। আরান অভয় দিচ্ছে যে সে আসছে। মনে সাহস সঞ্চয় করতে বলেছে। কিছু একটা ভেবে আরান বলে ওঠে,
‘ দুহা, আশেপাশে কোন ঝোপঝাড় থাকলে সেটার আড়ালে লুকিয়ে পড়ো।’
‘ কেন? আমার ভয় করছে আরান ভাইয়া।’

‘ যা বলছি তা করো। আমি চাইনা তোমার কোন ক্ষতি হোক।’

দুহা তাই করল। আরান দ্রুত গতিতে গাড়ি চালাচ্ছে। শরীর ঘেমে একাকার হয়ে যাচ্ছে। কানে ফোন। কি যেন ভেবে আরেকটা ফোন দিয়ে কাউকে ম্যাসেজ লিখে পাঠিয়ে দিলো। এরপর আবার মনোযোগ দিলো গাড়ি চালানোর দিকে। হঠাৎ আরানের কানে দুহার চিৎকার ভেসে আসে। দুহা বলছে, ছেড়ে দাও! আরান ভাইয়া বাঁচান আমাকে।
আস্তে আস্তে দুহার স্বর ফোন থেকে দূরে শোনা যাচ্ছে। অপর পাশে আরান বলছে,’ দুহা তুমি ঠিক আছো?’
দুহা শুনতে পাচ্ছে না। মুখোশের আড়ালে কেউ একজন দুহাকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে।

চলবে……..