দম বন্ধ ভালোবাসা পর্ব-০৬

0
4436

#দম_বন্ধ_ভালোবাসা
#পার্ট_ছয়
#Mst_Liza

এরই মধ্যে সকলে চলে আসলো।আমাদের দুজনকে একসাথে দেখে অনেকটা অবাক হলো সবাই।আমি নিশ্চুপ হয়ে রইলাম।উনি কিছু না বলে ক্লাস রুম থেকে বেড়িয়ে গেলেন।প্রিয়া, মিনি, নিশি এগিয়ে এসে আমার সামনে দাড়ালো।আমার কাছে জানতে চাইলো এই ফাঁকা ক্লাসে উনার সাথে কি করছি আমি।আমি ওদের কথার কোনো জবাব না দিয়ে ক্লাস রুম থেকে বেড়িয়ে আসতে লাগলাম।এবার সকলে মিলে ঘিরে ধরলো আমাকে।সকলে খুব উৎসাহ নিয়ে আমাকে প্রশ্ন করতে লাগলো।আমি বিরক্ত হয়ে সবাইকে ঠেলে ছুটে ওয়াশরুমে চলে আসলাম।

আমি মনে মনে ঠিক করলাম আর চুপ করে থাকবো না।এবার থেকে উনি আমার কাছে আসলেই প্রতিবাদ করবো।

কিছুদিন চলে গেলো উনার কোনো দেখা পেলাম না।হসপিটালে উনি আসে কিনা সেটাও বুঝতে পারলাম না।মনে মনে ভাবতে লাগলাম উনার কোনো বিপদ হয়নি তো! আজ হঠাৎ সায়ান নিজে থেকে কল করলো।কিন্তু তেমন একটা আনন্দ হচ্ছে না মনের মধ্যে। হসপিটালের সামনের রেস্টুরেন্টে দেখা করতে চাইলো সায়ান।ভাবলাম গত বছরে জন্মদিনে সায়ানের গিফট করা ড্রেসটা পরে যায়।আমি রেস্টুরেন্টে এসে দু’ঘন্টা ধরে বসে রইলাম।সায়ান অনেক লেট করে আসলো।এসে আমার সামনের টেবিলে বসলে আমি কিছু বলার আগে আমাকে হাতটা উঁচু করে থামিয়ে দিলো। সায়ান টেবিলের উপর থেকে আমার হাত দুটো নিয়ে শক্ত করে ধরে বলল,

—“ছরি ফুল।আমি জানি না কিভাবে তোমাকে এই কথাটা বলবো।কিন্তু এটা না বলে আমি পারছি না।কথাটা হলো তোমাকে আমি বিয়ে করতে পারবো না ফুল।এটা সত্যি তোমাকে আমি ভালোবেসেছি।তুমিও আমার জন্য যথেষ্ট পার্ফেক্ট।আমি যেইভাবে তোমার সাথে কথা বলেছি।তোমাকে যতো কিছুর জন্য বাড়ণ করেছি সবটা শুনেছো তুমি।হয়তো তুমিও আমাকে ভালোবাসো।কিন্তু আমার স্বপ্ন আমার ভালোবাসার থেকেও অনেক উঁচু। আমাকে বিয়ে করলে তুমি পারবে না সুখি হতে।তোমাকে না পারবো আমি সময় দিতে।আর না পারবো তোমাকে খুশি রাখতে।”

আমি সায়ানকে থামিয়ে দিয়ে বললাম,

—“তুমি এভাবে কেন বলছো সায়ান? আমি কি কখনো তোমাকে অভিযোগ করেছি? তুমি যেমন তেমনই আমি এক্সেপ্ট করেছি।তাহলে এমন কথা তোমার মনে কেন আনছো? আমাকে এসব বলার কোনো প্রয়োজন নেই তোমার।”

—“প্রয়োজন আছে ফুল।আমি তোমাকে এগুলো বলছি কারণ।আজ আমার কাছে এই শহরের নাম্বার ওয়ান বিজনেস ম্যান মির্জা গ্রুপ অব ইন্ডাস্ট্রির মালিক সোহাগ মির্জা।তার বোন রাইসা মির্জার জন্য নিজে বিয়ের প্রস্তাব এনেছে।যাকে বিয়ে করলে আমার স্বপ্ন পূরণ হবে।আমাকে একটা এ্যাওয়ার্ড ফাংশনে দেখে পছন্দ করেছিলো রাইসা মির্জা।আর বোনের পছন্দের মানুষকে বোনের হাতে তুলে দেবার জন্য উনি আমাকে বলেছে নিজের ভাগের সব সম্পত্তি আমার নামে লিখে দেবে।আর তুমি ভাবো ফুল উনার বোনকে বিয়ে করলে বোনের অংশটুকুও আমিই পাবো।”

আমি সায়ানের কথা শুনে অবাক হলাম।ভাবলাম কিছুরই তো অভাব নেই সায়ানের।তাহলে কেন এমন একটা লোভ মনে মনে তৈরি করে রেখেছে? সায়ান আমার হাতদুটো এখনও ধরে আছে। আমি একটানে নিজের হাতদুটো ছাড়িয়ে নিলাম। শুধু মাত্র বাবার শেষ ইচ্ছা ছিলো বলেই সায়ানকে বোঝানোর কথা ভাবলাম।নইলে মা এটা জানতে পেলে খুব কস্ট পাবে।

—“সায়ান তোমার তো সব আছে।”

—“হ্যাঁ আছে।কিন্তু আমি এই শহরের নাম্বার ওয়ান বিজনেস ম্যান হতে চাই।তখন সকলে আমাকে এক নামে চিনবে।”

—“কিন্তু তোমার বাবা আর আমার বাবা যে দুজন দুজনকে কথা দিয়েছে আমাদের বিয়ের জন্য সেটা?”

—“প্লিজ ফুল।সেইজন্য তো তোমার সাথে কথা বলতে আসলাম আমি।আমাদের যদি বিয়ে হয়ে যেতো তাহলে একটা কথা ছিলো।আমি ভেবে দেখতাম।কিন্তু বিয়েটা যখন হয়নি।তখন এতোকিছু ভাবার কোনো প্রয়োজন নেই আমাদের।”

আমি উঠে দাড়ালাম। সায়ানকে বললাম,

—“বিয়েটা যখন হয়নি তখন আগে থেকে এমন একটা সিদ্ধান্ত নিয়ে তুমি খুব বড় একটা উপকার করে ফেলেছো আমার।আমার মনে হয় না আমাদের আর কোনো কথা বলার প্রয়োজন আছে।সিদ্ধান্ত যখন নিয়ে ফেলেছো তখন আসতে পারও।তোমার দেওয়া সব গিফট আমি তোমাকে পাঠিয়ে দিবো।আমি কারও কাছে ঋণী থাকি না।”

সায়ান উঠে দাড়িয়ে বলল,

—“ধন্যবাদ ফুল।”

আমি মুখটা ঘুরিয়ে চলে আসলাম। পেছনের দিকে আর ঘুরে তাকালাম না।সোজা হোস্টেলে এসে চেঞ্জ করে সায়ানের দেওয়া সব গিফট প্যাক করতে লাগলাম। হঠাৎ উনার কথা মনে পরলো।উঠে সাদে এসে দাড়ালাম। মনে হলো যেন আসেপাশে কোথাও লুকিয়ে আছেন উনি।হুট করে এসেই আমাকে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে রাখবে।কিন্তু না উনার সাথে যেই ব্যাবহারটা করেছি আমি।মনে হয় না আর আসবে।আসলে এতোদিন ঠিকই আসতো জ্বালাতে।সায়ান যখন নেই তখন উনার সাথে আমার নিজে গিয়ে কথা বলা উচিৎ।

পরেরদিন সকালে হসপিটালে গিয়ে উনার কেবিনের সামনে এসে দেখলাম অনেক পেশেন্ট সিরিয়াল দিয়ে আছে।এতো বিজি উনি আমাকে দেখলে নির্ঘাত পেশেন্টদের রেখে আমাকে নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পরবেন।আমি ক্লাসরুমে চলে আসলাম। ক্লাস শেষে উনার কেবিনের সামনে আবার আসলাম।শুনতে পেলাম একটা সার্জারি করতে ও.টি তে ঢুকবে।তাই আর উনার সামনে এলাম না।ও.টি শেষে ওয়াশরুম থেকে ফ্রেশ হয়ে উনি নিজের কেবিনে আসতেই দেখতে পেলেন আমি উনার চেয়ারটাতে বসে আছি।আমাকে দেখে কিছু বলছেন না উনি।বাইরে থেকে একজন নার্স দরজায় নক করলে উনি বললেন একটু পরে আসতে।নার্সটা চলে গেলে উনি এগিয়ে এসে টেবিলের উপর বসে মুখটা একটু নিচু করে চেয়ারটা শক্ত করে চেপে ধরলেন আমার দুপাশ থেকে। আমাকে কিছু বলতে গেলে আমি উনার ঠোঁটে আঙুল চেপে ধরে বললাম,

—“ছরি।এতোদিন আমার সামনে আসলেন না কেন?”

উনি আমার মুখের দিকে তাকিয়ে আছে। যেন উনার বিশ্বাস হচ্ছে না।আমি উনাকে বললাম সায়ানের কথা।

—“আপনি ঠিকই বলেন।আপনার মতো এতো ভালো কেউ আমাকে বাসতে পারবে না।সায়ান শুধু আমাকে কাঁদাতো।আমি বাবার শেষ ইচ্ছা আর মায়ের কস্ট হবে ভেবেই সায়ানকে বিয়ে করতে চেয়েছিলাম। কিন্তু সায়ান নিজে বিয়েটা ভেঙে দিয়েছে।আপনি ভাববেন না সায়ান চলে গেছে বলে আমি আপনার কাছে এসেছি। আপনি তো আমাকে ভালোবাসেন তাই না? তাহলে আপনার কাছে এসে কি আমি ভুল করেছি? আপনি পারবেন আমাকে ছাড়া থাকতে?”

উনি এখনও আমার মুখের দিকে তাকিয়ে আছে। মাথা নাড়িয়ে শুধু না অর্থ বোঝালে।আমি উনার বুকে মাথা রেখে বললাম,

—“আমাকে আবার বিয়ে করবে? বলও? তোমাকে আমি তুমি করেই ডাকবো।স্বামী না তুমি আমার।কি হলো? কিছু বলছো না কেন?”

উনি আমাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বললেন,

—“কি বলবো সেটাই তো বুঝতে পারছি না।তুমি কি সত্যি এসেছো? একটা চিমটি কাটো তো।”

—“চিমটি কেন? কামড় দেবো। সেদিন কিভাবে কামড়েছিলে তুমি আমায় মনে আছে? শোধ তুলবো না?”

—“দাও?”

আমি মাথাটা উঠিয়ে উনার কানের কাছে মুখটা এগিয়ে নিয়ে এসে ছোট্ট করে একটা কামড় বসিয়ে দিলাম।উনি কানের ডগা ঘষতে লাগলেন।আমি মুচকি হেসে চেয়ার থেকে উঠে দাড়ালে উনি আমার হাতটা ধরে ঘুরিয়ে নিয়ে নিজের কোলের উপর বসালেন।এক হাতে আমার পেট চেপে ধরে অন্য হাতটা আমার বুকে রাখলেন। আমার কাঁধে উনার নিশ্বাস পরছে।আমার গলায় উনি ঠোঁটের উষ্ণ পরস দিতে আমি বলে উঠলাম,

—“দম বন্ধ হয়ে আসছে আমার।”

কথাটা শুনে উনি আমাকে ছেড়ে দিলেন।টেবিলের উপর থেকে নেমে দাড়িয়ে বললেন আমায়,

—“তুমি আমার কাছে আসলেই আমি পাগল হয়ে যায়।তোমার থেকে অনুমতি না নিয়ে একটু আধটু আদরও দিয়ে ফেলি।তুমি আবার রেগে যাবে নাতো?”

আমি আলতো হেসে উনার গালে হাত রেখে বললাম,

—“রাগার কি আছে? সেটা হলে আমি নিজ থেকে তোমার কাছে এসে সাহস দেখিয়ে এতোগুলো কথা বলতাম না।আর তুমি তো আমার স্বামী।অনেক কস্ট করেছো শুধুমাত্র আমাকে পাওয়ার জন্য তুমি।অনেক অপেক্ষা করেছো আমার জন্য আর না।আমি বলছি তো আমি তোমার।আজ নিজেকে আমি তোমার কাছে স্বর্পে দিচ্ছি।তুমি যা ইচ্ছা করতে পারো।তোমার বাবা ছাড়া আমাদের বিয়েটার কথা কেউ জানেও না।আমি শুধু চাইবো তোমার বাবাকে বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে পাঠাও আমার মায়ের কাছে।এবার বিয়েটা হলে আমি পুরোপুরি ভাবে তোমার কাছে থাকবো।তুমি সবসময় আমাকে কাছে পাবে।”

—“সত্যি বলছো ফুল?”

—“হুমমম।একটা কথা বলবো?”

—“হ্যাঁ বলও?”

—“তোমাকে দেখতে রাজকুমারের মতো।প্রিয়া আছে না? ওর থেকে একটু দূরে দূরে থাকবে।সব মেয়েদের থেকে দূরে থাকবে।সবাই তোমার দিকে নজর দেয়।আর এতো সুন্দর করে সেজে আসার কি দরকার? তোমাকে শুধু আমি দেখবো।”

হেসে উঠে বলল,

—“হিংসা হয়?”

—“নাহ।আমিও যেমন তোমার। তুমিও তেমন আমার।শুধু আমার।”

—“এতো ভালো তুমি আমায় কবে থেকে বাসলে?”

—“জানি না।কিন্তু তোমাকে না দেখলে আমি থাকতে পারি না এখন।তোমার নিশ্বাসের গন্ধ পাওয়ার জন্য হলেও তোমাকে আমি খুঁজি। তোমার দম বন্ধ ভালোবাসাতেও এখন আমি অভ্যস্ত।আর?”

—“আর কি?”

—“ছরি।তোমাকে চিনতে আমার অনেক সময় লেগেছে।”

এটুকু বলে থামতেই আমার ঠোঁটে কাছে মুখটা এগিয়ে নিয়ে আসলো হৃদ।চোখের ইশারায় আমাকে আরও কাছে আসতে বোঝালে। আমি ওর গালে হাত রেখে ঠোঁটে আলতো আদর দিতে ও আমার চুলের ভাজে হাত ডুবিয়ে দিলো।আমার ঠোঁট দুটো নিজের আয়ত্তে নিয়ে নিলো।মনে হচ্ছে যেন হৃদ কত বছরের তৃষ্ণা মেটাচ্ছে আজ।আমি চোখ দুটো বন্ধ করে শুধু ওকে সাড়া দিয়ে যাচ্ছি।টানা দশ মিনিট পর আমাকে ছেড়ে দিলো হৃদ।আমি ছুটে গিয়ে দরজার কাছে দাড়িয়ে হাপাতে হাপাতে বললাম,

—“তোমার বাবাকে আজই পাঠিও কিন্তু।”

কথাটা বলে ঘুরে দাড়াতে সামনে প্রিয়া আর নিশিকে দেখতে পেলাম। আমাকে দেখে এগিয়ে আসলো ওরা।আমার হাত ধরে নিয়ে গিয়ে লিফটে ওঠে লিফটটা বন্ধ করে জিজ্ঞেসা করলো ওরা,

—“তোর ঠোঁটের লিপস্টিক এভাবে লেপ্টে আছে কেন?”

আমি অবাক হয়ে ঠোঁটে হাত রাখতেই হেসে উঠলো ওরা।ওদের হাসি দেখ বুঝতে পারলাম আমি কিছুদিন ধরে তো লিপস্টিক ঠোঁটে দিই না।কারণ ঠোঁটে লিপস্টিক দেওয়া হৃদ পছন্দ করে না।ওদের দিকে তাকালে ওরা দুজন বলল,

—“সেদিন ডা.হৃদ স্যার আর তোর মধ্যে হওয়া সব কথায় আমরা শুনে নিয়েছিলাম।হোস্টেল থেকে তুই একাই বের হয়েছিলি ঠিকি।কিন্তু অতো সকালে ক্লাসে এসে যেন তুই বোর না হোস তারজন্য আমরা দুজনও এসেছিলাম তোকে সঙ্গ দিতে।আর তোদের মধ্যে হওয়া সব কথা শুনেছি। ডা. হৃদ স্যার খুব ভালো ফুল।উনাকে কস্ট দিস না।সায়ানকে ছেড়ে উনার কাছে ফিরে আই।”

আমি ওদের বললাম,

—“সায়ান বিয়েটা ভেঙে দিয়েছে।আর আসবে না সায়ান।যদি আসেও আমি সায়ানের কাছে যাবো না।আর আমি জানি হৃদ কেমন।এই কয়দিনে বুঝে গিয়েছি।আমি ঠিক করেছি আর এক বিন্দুও কস্ট দেবো না হৃদকে।”

আমার কথা শুনে ওরা দুজন খুশি হয়ে গেলো।আমাকে জড়িয়ে ধরে বলল,

—“একটা সঠিক সিদ্ধান্ত নিয়েছিস ফুল।ডা.হৃদ স্যারের মতোন একটা মানুষ এতোটা কস্ট ডিজার্ভ করে না।”

চলবে,,,,