দুই_পৃথিবী পর্ব-০৭

0
1022

#দুই_পৃথিবী
#লেখিকা- রিতু
#পর্ব-৭
আনিস সরকার রাতে খেতে বসেছে তার মেয়ে আর মেয়ের জামাইয়ের সাথে।তাকে দেখে মনে হচ্ছে তার চেয়ে সুখি মানুষ এ পৃথিবীতে কেন অন্য কোন পৃথিবীতেও নেই।সে হাসি হাসি মুখ করে তার মেয়ের জামাইকে বললো
-ছোট মাছ টা খেতে কেমন হয়েছে মুহিব?
মুহিব খেতে খেতেই জবাব দিল
-জ্বি ফুপাজি,ভাল।
আনিস সাহেব উৎসাহের সাথে বলতে শুরু করলো
-ভালো হবেই বা না কেন!নদীর মাছ।পিয়াজ কুচিকুচি করে কেটে বেশি করে মরিচ দিয়ে সব মশলাপাতি দিয়ে মাখিয়ে তারপর কিছুক্ষণ জ্বাল করেছি।বুঝেছ মুহিব,,নামানোর সময় এত বাসনা বের হয়েছিল।
-আপনি রান্না করেছেন?
আনিস সাহেব দ্বিগুন উৎসাহ নিয়ে বললো
-হ্যা।ময়নার মা রাঁধতে চেয়েছিল।কিন্তু আমি দেই নি।এত ভাল মাছ সে রেধে নষ্ট করবে।
-খুব ভাল হয়েছে ফুপাজি।
-তুমি রান্নাবান্না কিছু পারো?
মুহিব খুব স্বাভাবিক ভাবেই বললো
-নাহ।
-টেনশন করো না।আমি শিখিয়ে দিব।আমি পারি না এমন কোন রান্নাই নেই।
-আচ্ছা।
এতক্ষণ স্নেহা চুপচাপ সব শুনছিল।এ পর্যায়ে স্নেহা খাওয়া বাদ দিয়ে তার বাবা কে বললো
-ও রান্না শিখে কি করবে?আমাকে রান্না করে খাওয়াবে নাকি?
আনিস সাহেব হেসে বললো
-দরকার হলে খাওয়াবে।
স্নেহা মুহিবের দিকে তাকিয়ে বললো
-দরকার হবে নাহ।

রাত ১১ টা।সব ঘরের বাতি নিভানো।যে যার যার ঘরে শুয়ে পড়েছে।শুধু বারান্দার বাতি টা জ্বলছে।বারান্দায় বসে গল্প করছেন আনিস সাহেব আর মুহিব।তাদের গল্পের মূল বিষয় দেশ।আনিস সাহেবের মতে দেশ উত্থনে যাচ্ছে দিনে দিনে।অবশ্য মুহিব এ নিয়ে কোনো মন্তব্য করছে নাহ।শুধু শুনে যাচ্ছে।তার ঘুম পেয়ে যাচ্ছে এই সব বক্তব্য শুনে।মনে হচ্ছে এখানেই সে ঘুমিয়ে যাবে আর কিছু সময় বসে থাকলে।কিন্তু কিছু বলতেও পারছে নাহ।হাজার হলেও শ্বশুর,বয়সে বড়।তাকে তো আর বলা যায় না যে ‘আপনার এই ফালতু বকবক বন্ধ করুন।আমি ঘুমাতে যাব।’
মুহিব ছাড়া পেল ১২ টার ঠিক ৫ মিনিট আগে।তার ঘুমে চোখ বন্ধ হয়ে আসছিল।কোন রকম স্নেহার রুমে ঢুকে স্নেহার পাশে শুয়ে পড়লো সে।স্নেহা হয়ত জেগে ছিল।মুহিব কে শুয়ে পড়তে দেখে সে উঠে বসলো তারপর মুহিবকে ডেকে বললো
-বাবা কি বললো?
মুহিব ঘুম ঘুম কন্ঠে বললো
-তেমন কিছুই না।দেশ নিয়ে কথা।
-তোমার কি ঘুম পেয়েছে?
-হুম।
-ঘুমানোর আগে একটা ডিল করবো।
মুহিব ভ্রু কুচকে বললো
-কাল সকালে সব ডিল।ঘুমা এখন।
-না,এখনই।
-তাড়াতাড়ি বল।
-আমি আর এখন থেকে তোমাকে মুহিব ভাই ডাকবো নাহ।আর তুমি ও আমাকে আর তুই করে বলবে নাহ।রাজি?
মুহিব কিছুটা হতভম্ব হয়ে গেল।যে মেয়েকে কিনা কাল রাতে কোন ভাবেই ভাই বলা থেকে বাদ দেওয়ানো গেল না তার মুখ থেকে হঠাৎ এই ধরনের কথা শুনে মুহিবের পুরো আক্কেলগুড়ুম অবস্থা।এক দিনের ব্যবধানে কি এমন হলো তার এটা মাথায় আসছে নাহ।
-কি হলো কথা বলছো না কেন?
মুহিব নিজেকে সামলে নিয়ে বললো
-অহ হ্যা।রাজি।বলাই যাই।সমস্যা তো নেই।
স্নেহা অল্প হেসে বললো
-আচ্ছা যাও এখন ঘুমাও।
-আচ্ছা।
মুহিবের ঘুম টা কোথায় যেন যেন হারিয়ে গেছে।কিছুক্ষণ আগেও সে ঘুমের চোটে কথা বলতে পারছিল নাহ।অথচ এখন তার চোখে বিন্দুমাত্র ঘুম নেই।
স্নেহার নড়াচড়া দেখে মুহিব স্নেহার দিকে ফিরে স্নেহা কে ডেকে বললো
-স্নেহা?ঘুমিয়েছিস?
স্নেহা হাই তুলতে তুলতে বললো
-তুমি তোমার ডিল টা ফলো করছো নাহ।
মুহিব স্নেহার দিকে একটু এগিয়ে এসে বললো
-মনে ছিল না।একটু কিছুদিন সময় লাগবে।
-আচ্ছা লাগুক।
-আমি যে দু দিন হলো তোর পাশে শুয়ে ঘুমাই।তোর কি কোন সমস্যা হয়?
-কি সমস্যা হবে?
-না মানে..
মুহিবের কথা শেষ করার আগেই স্নেহা বললো
-হয় না।অন্য মেয়েদের অচেনা সব মানুষ কে নিয়ে মাঝখান থেকে জীবন শুরু করতে হয়।সেখানে আমি তোমাদেরকে চিনি,জানি।আর আমি তো নিজের বাড়িতেই আছি।সমস্যা হবার প্রশ্নই আসে নাহ।
-সেটাও।
-হুম।আর পাশে ঘুমানোর ব্যাপার টাও তেমন কিছু নাহ।কিন্তু বিরক্ত লাগবে হয়তো মাঝেমাঝে।মাত্র তো ১/২ দিন হলো।
মুহিব শোয়া থেকে উঠে বসে বললো
-আচ্ছা আমরা কিন্তু ফেসবুকে সিংগাল স্ট্যাটাস টা চেঞ্জ করি নাই।করবো?
স্নেহা অপর পাশ ফিরতে ফিরতে বললো
-খুব জরুরি হলে করে দাও।
-থাক।কাল সকালে দিব।
-আচ্ছা।
-ঘুমাবি এখন?
-তুমি বললে ঘুমাবো নাহ।
-ঘুমাবি না কেন!ঘুমা।কিন্তু একটু পর ঘুমা।আমার ঘুম টা কেটে গেছে।
স্নেহা উঠে বসলো মুহিবের পাশে।তারপর বললো
-চলো ছাদে গিয়ে জোছনা বিলাশ করি।
মুহিব হাসি মুখে বললো
-চল।
মুহিব আর স্নেহা ছাদে গিয়ে পাশাপাশি দাঁড়িয়ে আছে অনেকক্ষণ হলো।কেউ কোন কথা বলছে নাহ।কেমন যেন ঠান্ডা ঠান্ডা অনুভব হচ্ছে স্নেহার।মাঝে মাঝে হালকা বাতাসের একটা ঝাপটা এসে লাগছে তার গায়ে।খুব একটা জোছনা বিলাশ করতে পারছে নাহ তারা।কারণ আজ রাতে জোছনা তেমন একটা দেখা যাচ্ছে নাহ।মুহিব কোন কথা না বলে স্নেহার পিছনে গিয়ে দাঁড়াল।তারপর স্নেহার খোঁপা করা চুল টা ধীরে খুলে দিল।স্নেহার হাটু সমান লম্বা কেশ ঝুপ করে নেমে পুরো পিঠকে ঢেকে ফেললো কিছু সময়ের মাঝেই।হালকা বাতাসে চুল গুলো সামান্য উড়ছে তার সাথে ওঠা নামা করছে মুহিবের হার্টবিট।অপরূপ সুন্দরী এক নারী তার দীর্ঘ শীতল কেশ মেলে এত রাতে তার পাশে দাঁড়িয়ে আছে।তার এই সৌন্দর্যকে হালকা জোছনার আলো যেন হাজার গুণে বাড়িয়ে দিয়েছে।দম বন্ধ হয়ে আসছে মুহিবের।তার এখন কি করা উচিৎ?স্নেহা কে জড়িয়ে ধরা নাকি এখানে ১ মিনিট না দাঁড়িয়ে নিচে চলে যাওয়া??স্নেহা হয়তো বুঝতে পারলো মুহিবের অবস্থা।তাই মুহিবকে খুব অবাক করে ধীরে মুহিবের আঙুল এর মাঝে তার আঙুলগুলো দিল।মুহিব কে কিছু বোঝবার সুযোগ দেওয়ার আগেই মুহিবের বুকে মুখ গুঁজল স্নেহা।খাকিনক্ষণ হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে নিজেকে সামলে নিল মুহিব।তারপর এক হাত দিয়েই জড়িয়ে ধরে মুখ গুঁজল স্নেহার চুলে।স্নেহা খুব স্বাভাবিক ভাবেই মুখ না তুলেই মুহিব কে বললো
-ভালো করে জড়িয়ে ধরো তোহ।নাকি জরিয়ে ধরতেও জানো না।এটাতেও ফেল?
মুহিব নিরব হয়ে আছে।তার এখন কারো সাথে কথা বলতে ইচ্ছা করছে নাহ।কোনো কিছুর জবাব দিতে ইচ্ছা করছে নাহ।সে এই সময়টা উপভোগ করতে চায় নিরব হয়ে।
মুহিব কে চুপ থাকতে দেখে স্নেহা আবার বললো
-কি ব্যাপার?কাপছো কেন তুমি?
এর জবাব ও স্নেহা পেল না।কতক্ষণ সময় এভাবে কাটলো জানে না মুহিব।স্নেহা যখন মুখ টা মুহিবের বুক থেকে উঠিয়ে ডাকলো মুহিবকে তখন মুহিবের ঘোর কাটলো।স্নেহা কে ছেড়ে সে একটু দূরে দাঁড়িয়ে বললো
-জড়িয়ে ধরতে জানি।কিন্তু তুই আমার এক হাত ধরে ছিলি শক্ত করে।আর এক হাত দিয়ে যতটুকু কাজ করা যায় করেছি।
স্নেহা মুহিবের কথা শুনে হাসতে হাসতে বললো
-উম্ম।মোটামুটি পেরেছ।জরিয়ে ধরার অনেক ক্যাটাগরি আছে।আর তোমার এই ক্যাটাগরিকে আমি ১০০ তে ৬০ দিলাম।পাস করিয়ে দিলাম।কিন্তু A-.
-তুই এত ক্যাটাগরি কিভাবে জানিস?
-প্লিজ আর তুই তুই করবে নাহ।তুই বললে আমি কথার উত্তর দিব নাহ।
-আচ্ছা বলবো না।
-একটা জিনিশ খেয়াল করেছ?
মুহিব তীক্ষ্ণ চোখে তাকিয়ে বললো
-কি?
-আমরা জোছনা বিলাশ করতে এসেছিলাম।কিন্তু এখন মনে হচ্ছে জোছনাই আমাদের রোমান্স বিলাশ করে নিচ্ছে।
বলেই কিছুক্ষণ প্রাণখুলে হাসতে লাগলো স্নেহা।হালকা জোছনার আলোতে এই হাসিটা দেখে মুহিবের বুক বারবার মোচড় দিয়ে উঠছে।
মুহিবরা যখন ছাদ থেকে নেমে এল তখন বাজে রাত তিনটা।এসেই মুহিব বিছানায় শুয়ে পড়লো।স্নেহা ঢুকলো ওয়াশরুমে।
স্নেহা শুতে এসে দেখলো মুহিব শুয়ে এপাশ ওপাশ করছে।সে মুহিবকে ডেকে বললো
-ঘুম আসছে নাহ?
-নাহ।
-তুমি কি আমাকে জড়িয়ে ধরতে চাও?চাইলে ধরতে পার।
মুহিব স্নেহার দিকে এগিয়ে এসে বললো
-হ্যা চাই।
স্নেহা মুহিবের বুকে মুখগুজে ভাবতে লাগলো আজকের দুপুরে আফসানের সাথে কাটানো মুহূর্ত।’আচ্ছা আফসান কি ঘুমিয়ে পড়েছে?’

মুহিবের ঘুম ভাঙল তার মা মিতানুর রহমানের ফোনের আওয়াজে।আজ মুহিবের রাতে একটু ঘুম ও হয় নি।পুরোটা রাত কাটিয়েছে স্নেহা কে বুকে নিয়ে স্নেহার চুলে মুখ গুজে।ঘুম না হলেও এর মতো শান্তির রাত সে আগে কাটায় নি।আগে কাটাবেও বা কিভাবে!আগে তো তার পাশে স্নেহাও থাকে নি।ভোরের দিকে ঘুমিয়েছিল কিছুটা সে কিন্তু এর মাঝেই এল তার মায়ের ফোন।ঘুম ঘুম কন্ঠে ফোন কল রিসিভ করে বললো সে
-আসসালামুআলাইকুম,শুভ সকাল মা।
মিতানুর রহমান এক গাল হেসে বললেন
-ওয়ালাইকুমসালাম।বাবু ভালো আছিস তুই?
-হ্যা মা।তুমি?
-আমি আর ভালো!ছেলে ছেলের বৌকে সাথে নিয়ে থাকতে পারছি নাহ।এর চেয়ে কষ্টের কিছু আছে?
-মা প্লিজ,এই কথা রাখ।আমি স্নেহাকে বুঝিয়ে খুব তাড়াতাড়ি নিয়ে আসব।
-আচ্ছা।বাবু তুই আমাকে মিস করেছিস তোহ?
-হ্যা মা।অনেক।
-তাইলে একটা ভালো খবর দেই।মিস করতে আর হবে নাহ।
মুহিব ভ্রু কুচকে বললো
-কি ভালো খবর?
-তোর ছোট চাচার মেয়ে অনুর বিয়ের কথা চলছিল নাহ?ওর বিয়ের তারিখ ঠিক ঠাক হয়েছে।
মুহিব আনন্দের সাথে বললো
-আরে এটা তো আসলেই ভাল খবর।
-তাইলে আর বলছি কিহ!
-কবে ঠিক হলো?
-ভেবে বল তো?
-ভাবতে পারছি নাহ।মা তুমিই বলো।
-কাল।
মুহিব অবাক হয়ে বললো
-আরে কি বলছো!কাল?
-হ্যা।আর আমি ট্রেনের টিকেট কেটে ফেলেছি।তোর,আমার,স্নেহার,মুন্নির আর জামাইয়ের।
মুহিব কিছুটা চিন্তিত হয়ে বললো
-তার মানে ট্রেন আজকের?
-হ্যা।৩ টার ট্রেন।তোরা তাড়াতাড়ি রেডি হয়ে কমলাপুর চলে আসিস সময় মত।
-মা,আগে স্নেহার সাথে কথা বলি।
মিতানুর রহমান কিছুটা বিরক্ত নিয়ে বললো
-ওর সাথে আবার কথা বলতে হবে কেন?আমি যে যেতে বলেছি এটা ওকে বল।আর তোরা ঠিক সময় মতো উপস্থিত হবি।রাখলাম এখন।

স্নেহা তার অভ্যাসমত সকালে উঠে চা করে বারান্দায় নিয়ে এল।বারান্দায় তার বাবা আনিস সরকার আর মুহিব বসে আছে।স্নেহা চায়ের কাপ তাদের দুজনের হাতে তুলে দিয়ে নিজের জন্য নিয়ে মুহিবের পাশে এসে বসলো।আনিস সাহেব কাল থেকে খুব ফুরফুরে মেজাজে রয়েছে।মেয়ে আর মেয়ের জামাইকে এক সাথে বসে চা খেতে দেখে তার আনন্দের যেন কোন সীমা নেই।সে চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে বললো
-বাহ তোদের দুজন কে এক সাথে খুব মানিয়েছে।
স্নেহা আলত করে হাসি দিল।মুহিব পাশ থেকে বললো
-স্নেহা মা ফোন করেছিল।
-কি বললো খালা?
মুহিব সব খুলে বললো স্নেহাকে।মুহিব প্রথমে ভেবেছিল স্নেহা রাজি হবে নাহ।এই ভয়েই মা কে বলেছিল আগে স্নেহার সাথে কথা বলি।কিন্তু মুহিব কে অবাক করে স্নেহা একবার বলাতেই রাজি হয়ে গেল।খুব উৎসাহ নিয়ে স্নেহা ব্যাগ প্যাক করলো।অবশ্য উৎসাহ থাকাটা স্বাভাবিক।কারণ স্নেহা এই প্রথম গ্রামে যাচ্ছে।স্নেহার ১৯ বছর বয়সের জীবনে সে ঢাকার বাইরে কখনো যায় নি।

ট্রেন ছাড়লো দুপুর ঠিক ৩ টায়।ঢাকা টু পাবনা।মুহিবের মা মিতানুর রহমান ফাস্ট ক্লাসের একটা কামড়া বুক করেছে।ট্রেনে যে যার যার মতো বসে গল্পতে মেতে আছে।শুধু স্নেহা একাই বসে ট্রেনের জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে আছে।এই প্রথম তার ঢাকা থেকে বাইরে যাওয়া,এই প্রথম তার ট্রেন জার্নি।খুব অন্য রকমের কিছু অনুভব হচ্ছে তার মনে।সে তাকিয়ে তাকিয়ে বাইরের দৃশ্য দেখছে।ধূসর চোখে তাকিয়ে স্নেহা গাছগুলো কে দেখছে।আচ্ছা সে নিজে বসে আছে অথচ গাছ গুলো চলছে?নাকি গাছ গুলো বসে আছে সে নিজে চলছে??
-এই স্নেহে?স্নেহা?
মুন্নির ডাক শুনে স্নেহার চিন্তায় ছেদ পড়ল।সে মুন্নির দিকে তাকিয়ে বললো
-বলো আপু।
-তুই এক কোণায় একা একা কি করিস?এদিকে আয় জয়েন হ আমার সাথে।
স্নেহা উঠে মুন্নির কাছে গিয়ে বসলো।
মিতানুর রহমানের স্বামী মারা গিয়েছেন ছয় বছর হয়েছে।তারা দুই ভাই ছিল।ছোট ভাই গ্রামে থেকে জমিজমা দেখাশুনা করেন।তার মেয়ে অনুর বিয়েতেই যাচ্ছে আজ মিতানুর তার সপরিবারে।অনু এবার ইন্টার পরীক্ষা দিবে।আর মাত্র কয়েক মাস আছে পরীক্ষার।কিন্তু এর মাঝেই বিয়ে দিয়ে দিচ্ছে তাকে।এটা ভেবে মিতানুর কিছুটা চিন্তিত।পরীক্ষার পর একবারে বিয়ে দিলেই পারতো।কিন্তু তার দেবর এই বিয়ে নাকি হাত ছাড়া করবে নাহ।ছেলে ঢাকাতে চাকরি করে।কোন ভার্সিটির নাকি প্রফেসর।অবশ্য ভাল ছেলে হাত ছাড়া না করাই ভাল।মুন্নিকে অবশ্য এত তাড়াতাড়ি বিয়ে না দিলেও অনার্স ৩য় বর্ষতে পড়ার সময় বিয়ে দিয়ে দিয়েছিল ওর বাবা।মেয়ের বিয়ের এক বছর পরই মারা গেল সে।মেয়ের বিয়েটা নিজ চোখে দেখে যেতে পারলেও ছেলের টা আর পারলো নাহ।এদিকে মুন্নির বিয়ে হয়েছে সাত বছর হলো এখনো বাচ্চাকাচ্চা হচ্ছে না।কতো চিকিৎসাই না করালো তবুও কিছু হচ্ছে নাহ।ভেবেই দীর্ঘ একটি নিশ্বাস ছেড়ে কামরা থেকে বের হয়ে করিডোরে গিয়ে দাঁড়াল মিতানুর।
মিতানুর কে বেড়িয়ে যেতে দেখে মুন্নি মুহিবের দিকে তাকিয়ে বললো
-দেখেছিস?মায়ের কি আক্কেল?
মুহিব ভ্রু কুঁচকে বললো
-কেন?মা কি করেছে?
-আরে এতক্ষণ হলো আমাদের মাঝে বসে ছিল।তার বোঝা উচিৎ এখানে ছোটদের আড্ডা চলছে।এখানে তার কি কাজ?তার থাকার ফলে অনেক কথাই বলা যাচ্ছিল না।ভাজ্ঞিস উঠে গেছে।
মুহিব বিরক্ত নিয়ে বললো
-মা এখানে না বসলে কোথায় বসবে?
-বাদ দে।উঠে তো গেছে।এখন শান্তিতে কথা বলতে পারবো।
মুন্নির দিকে তাকিয়ে তার স্বামী কবির বললো
-তুমি বাড়াবাড়ি করছো।সব সময় এমন কথা বলবে না যেটা শুনতে খারাপ লাগে।
মুন্নি কঠিন চোখে কবিরের দিকে তাকিয়ে বললো
-মুখ বন্ধ রাখ তুমি।তোমার সাথে আমি কথা বলছি নাহ।
এ পর্যায়ে স্নেহা কবিরের দিকে তাকিয়ে বললো
-চলুন কিছু খেলা যাক।গানের কলি খেলবেন?
-হ্যা।চলো শুরু করি।স্নেহা আর আমি এক দল।মুহিব আর মুন্নি এক দল।স্নেহা তুমি গান ধরো।তোমার গানের শেষ অক্ষর দিয়ে মুহিবরা গান গাইবে।রাজি?
মুন্নি তীক্ষ্ণ চোখে কবিরের দিকে তাকিয়ে বললো
-আর কতোক্ষণ লাগবে পৌছতে?
-দেরি আছে।আরো ঘন্টা দুয়েকের মত লাগবে।স্নেহা শুরু করো তো তুমি।
স্নেহা কবিরের ইশারায় গাইতে শুরু করলো
“তুমি যাকে ভালোবাসো
স্নানের ঘরে বাস্পে ভাসো
তার জীবনে ঝড়
তোমার কথার শব্দ দূষণ
তোমার গলার স্বর
আমার দর্জায় খিল দিয়েছি
আমার দারুন জ্বর
তুমি অন্য কারোর সঙ্গে বেঁধো ঘর||
তোমার নৌকোর মুখোমুখি আমার সৈন্যদল
বাঁচার লড়াই
আমার মন্ত্রী খোয়া গেছে একটা চালের ভুল
কোথায় দাড়াই
কথার ওপর কেবল কথা
সিলিং ছুতে চায়
নিজের মুখের আয়্না আদল
লাগছে অসহায়
তুমি অন্য কারোর ছন্দে বেঁধো গান||
বুকের ভেতর ফুঁটছে যেন মাছের কানকোর লাল
এতো নরম
শাড়ীর সুতো বুনছে যেন সেই লালের কঙ্কাল
বিপদ বড়
কথার ওপর কেবল কথা
সিলিং ছুতে চায়
নিজের মুখের আয়্না আদল
লাগছে অসহায়
তুমি অন্য কারোর ছন্দে বেঁধো গান||
তুমি যাকে ভালোবাসো
স্নানের ঘরে বাস্পে ভাসো
তার জীবনে ঝড়
তোমার কথার শব্দ দূষণ
তোমার গলার স্বর
আমার দর্জায় খিল দিয়েছি
আমার দারুন জ্বর
তুমি অন্য কারোর সঙ্গে বেঁধো ঘর||”

ট্রেন ইন করেছে স্টেশনে।কবির মুন্নিকে বললো
-তুমি মা কে ধরে বের হও।আমি আর মুহিব ব্যাগ পত্র নিয়ে নামছি।স্নেহা,মুন্নির সাথে নাম।
স্টেশন থেকে তাদের ছোট চাচা তাদের নিতে এসেছে।তারা ছোট চাচার বাড়িতে যেতে যেতে বেজে গেল রাত ৯ টা।মুহিবদের দেখে একদল ছেলেমেয়ে চেঁচিয়ে উঠে বললো
-দেরি করে ফেলেছ তোমরা।গায়ে হলুদ কিছুক্ষণ আগেই হয়ে গেল।

বিয়ে বাড়ি পুরো জমে গেছে।এই অন্ধকারেও বিয়ে বাড়ি ঝলমল করছে আলোতে।একতলা পুরনো বাড়ি।পুরো বাড়িতে আলোয় চিকচিক করছে।উঠোনে সারি সারি আলো জ্বলছে।বাড়ির সামনের অংশে গেট সাজিয়েছে।সেই গেটের সাথের বাতিগুলো জ্বলছে আর নিভছে।অন্ধকারেও এই বাড়িটা দেখতে কত সুন্দরই না লাগছে।
স্নেহা বাড়ির সাজসজ্জা মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে কিছুক্ষণ দেখলো।অন্ধকারে বাড়ির আশেপাশে না দেখা গেলেও বাড়ির এই সৌন্দর্যেই আপাতত সে মুগ্ধ।

রাতে সামান্য কিছু খেয়ে স্নেহা শুয়ে পড়লো।তার মাথা ধরেছে।এক কাপ চা খেতে পারলে ভাল হতো।কিন্তু এখানে কাকে কি বলবে বুঝতে পারছে না।আসার পর থেকে বড় খালা আর মুন্নি আপু কে খুঁজেই পাচ্ছে না।মুহিবকে একবার দেখলে ও তারো আর কোন খোজ নেই।এমন কেয়ারলেস মানুষ এরা কিভাবে হয়!

বাইরে সূর্য উঠেছে।গাছে গাছে পাখি ডাকছে।স্নেহার ঘুম ভেঙেছে কিছুক্ষণ হলো।ঘুম থেকে উঠার পর চা খাওয়া একটা নেশা হয়ে দাঁড়িয়েছে স্নেহার।অথচ কি করবে বুঝতে পারছে নাহ।মাথা ব্যাথাটা অবশ্য এখন আর নেই।ভাবতে ভাবতেই ঘরে মুহিব এসে ঢুকলো।তার পরণে সাদা পাঞ্জাবি আর লুঙি।কোঁকড়া চুলের সাথে তাকে একদম পারফেক্ট লাগছে দেখতে।মনে হচ্ছে এই সাজটা তার জন্যই তৈরি হয়েছে।
-কখন উঠেছো?
স্নেহা হাই তুলতে তুলতে বললো
-বাব্বাহ।এখানে এসে একদিনেই নিজেকে চেঞ্জ করে ফেলেছ নাকি?চেনাই যাচ্ছে না।তার উপর আমাকে আবার তুমি করে ডাকছো।ব্যাপার টা কি বলো তোহ?
মুহিব হালকা হেসে বললো
-কিছু নাহ।চলো ছাদে যাই।ছাদ থেকে পুরো বাড়িটা দেখতে পাবে।
-আমি ফ্রেশ হয় নি।আর আমার চা ও লাগবে।
-ফ্রেশ পরে হবে।এখন চলো তোহ।
মুহিবের সাথে সাথে এগুলো স্নেহা।মুহিব ছাদে যাবার সময় দু কাপ চা উপরে পাঠিয়ে দিতে বললো।
স্নেহা ছাদে উঠে অবাক চোখে চারিদিক তাকিয়ে দেখতে লাগলো।এত সুন্দর সকাল সে আগে কখনো দেখে নি।পাখির কিচিরমিচির শব্দ,ফুলের সুবাসে মুখরিত হয়ে আছে চারিদিক।মুহিব স্নেহার পাশে দাঁড়িয়ে হাত ধরে বললো
-হালকা একটা সুবাস পাচ্ছো?
স্নেহা মুগ্ধ কণ্ঠে জবাব দিল
-হ্যা।পাচ্ছি।
-বলো তো কিসের?
-বলতে পারছি নাহ।
-বকুল ফুলের।ওই দিক টায় গাছ।আরো অনেক ফুলের গাছ আছে বাগানে।যাবা?
-চলো।
মুহিবরা নিচে এসে চা নিয়ে বাগানের দিকে গেল।বাগান টা বাড়ির পিছনে।বাড়ির পিছনের দরজা দিয়েই তারা ঢুকলো বাগানে।বাগানটা অনেক পুরানো।মুহিবের দাদার শখ ছিল বাগান করা।আর তিনি মারা যাবার পর তেমন একটা পরিচর্যা কেউ না করার কারণে বাগান টা কেমন যেন জংগলে পরিণত হয়েছে।বড় বড় ঘাসের জন্য অনেক ফুল গাছ ঢেকে গেছে।মুহিব আর স্নেহা বাগানে যেতেই তাদের সামনে পড়লো গোলাপ গাছ।পুরো টা গাছ গোলাপে ঢেকে আছে।স্নেহা বিস্ময় নিয়ে বললো
-আল্লাহ!এত গোলাপ?
-হ্যা।তোল কয়েকটা।
স্নেহা চায়ের কাপ টা মুহিবের হাতে দিয়ে দুই টা বড় বড় গোলাপ তুললো তারপর মুহিবের দিকে তাকিয়ে বললো
-খোঁপায় ফুল দিয়ে দাও।

সকাল ন টার বেশি বাজে।পুরো বিয়ে বাড়িতে মানুষ জনে ভরে আছে।বাড়ির সামনেই খোলা মাঠে পিচ্চিরা দৌড়াদৌড়ি করছে।তাদের চিৎকারে কান পাতা দায় হয়ে দাঁড়িয়েছে।গেটের একপাশেই চেয়ার নিয়ে কিছু মুরুব্বিরা জড়ো হয়ে গল্প করছে।তার ঠিক অপর পাশেই বাবুর্চি রা চুলো বানানোর জন্য মাটি খুরছে।ছাদে সামিয়ানার ব্যবস্থা করা হয়েছে।সেখানেই বর যাত্রিদের খাবার ব্যবস্থা।বাড়ির ভেতরে মহিলারা সব জড়ো হয়ে বসে পিয়াজ,রসুন,আদা ছিলছে।সেখানেই স্নেহাকে নিয়ে এল মুন্নি।স্নেহাকে দেখে কিছু মহিলা হা করে তাকিয়ে আছে।তাদের মধ্যে একজন বলে উঠলো
-এমন চান্দের লাহান বৌ কোন থাইকা ধইরা আনছোস রে বড় বৌ?
প্রশ্ন টি পাশের বাড়ির একজন মুহিবের মা মিতানুর সরকারকে করেছে।প্রশ্ন শুনে মিতানুর হাসি মুখে স্নেহা কে বললো
-স্নেহা এটা তোমার চাচী শ্বাশুরী।তোমার শ্বশুরের চাচাতো ভাইয়ের বৌ।সালাম করো ওনাকে।
স্নেহা এগিয়ে গিয়ে সালাম করল।উনি হাসি মুখে বললেন
-বাইচা থাক মা।দেইখা শুইনা চইলো।সুন্দর মাইয়াগো পিছনে আবার জ্বিন ভূতের আনাগোনা থাকে।

বরের বাড়ি থেকে মাছ,পান,সুপারি নিয়ে এসেছেন এক ভদ্রলোক।তাকে নিয়ে গ্রামের কিছু অল্প বয়সি মেয়েরা মেতে উঠলো।মহা আনন্দে তার গায়ে রঙ মাখাতে লেগে গেল তারা।তাদের সাথে যোগ দিল গ্রামের আরো কিছু ছেলেরা।শুরু হয়ে গেল তাদের রঙ নিয়ে খেলা।একদল মেয়ে দৌড়াচ্ছে,ঠিক তাদের পিছনেই একদল ছেলে যাচ্ছে রঙ নিয়ে।চিৎকার আর ছোটাছুটি তে চারিদিকে মেতে উঠেছে।কিছু কিছু ছেলে অপরিচিত মেয়েদের গালে রঙ লাগিয়ে দিচ্ছে ভাব করার জন্য।
রঙ ছোড়াছুঁড়ির ব্যাপার টা দেখে পুরো অবাক হয়ে গেছে স্নেহা।সে তাকিয়ে তাকিয়ে সবার কার্যক্রম দেখছিল।হঠাৎ চিৎকার গুলো ক্রমে ক্রমে এগিয়ে আসতে শুরু করলো তার দিকে।কয়েক সেকেন্ড এর মাঝেই স্নেহার সাদা গাল কালো হয়ে গেল।তাকে রঙ এ ডুবিয়ে দিয়েছে ছেলে মেয়েরা।সে স্তব্ধ হয়ে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে রইলো।অবশ্য রঙ ছাড়া আপাতত কাউকেই দেখতে পাওয়া যাচ্ছে না।সবাইকেই রঙে ডুবিয়েই ছেড়েছে এরা।এক দুই জন যারা ঘুপটি মেরে দরজা বন্ধ করে পালয়ে আছে তাদেরও রঙ দেবার বিশেষ আয়োজন করা হচ্ছে।এটা ভেবেই কিছুটা স্বস্তি পেল স্নেহা।মনে মনে তার ভালোই লাগছে।এখানে না এলে সে জানতেও পারতো না গ্রামের বিয়ে গুলো এত মজার হয়।শহরের বিয়েতে কি এত মজা এত আনন্দ আছে!নেই।সে কৃতজ্ঞতার চোখে খুঁজতে থাকলো মুহিব কে।তাকে একটা থ্যাংকস দেওয়া উচিৎ।হঠাৎ পিছন থেকে স্নেহা কে কে যেন ডেকে উঠলো।স্নেহা পিছনে তাকাতেই ভয়ে জমে গেল।
-আরে ভয় পাচ্ছিস কেন?
স্নেহা হতভম্ব হয়ে বললো
-তোমার এই অবস্থা কি করে?
-আর বলিস নাহ!অনুর বান্ধবি গুলো এত বদ।সবগুলো মিলে আমাকে রঙে ডুবিয়ে আবার কাদায় ফেলিয়ে গড়াগড়ি খাওয়াইছে।বলেই দাত বের করে হাসতে লাগলো মুহিব।পুরো শরীরে কালো রঙ এর জন্য তার এই সাদা দাত ঝকঝকে করছে।দেখতে কি বিশ্রী লাগছে।মুহিবকে এই অবস্থায় দেখে কান্না পাচ্ছে স্নেহার।

(চলবে)