দুই_পৃথিবী পর্ব-০৮

0
948

#দুই_পৃথিবী
#লেখিকা-নাইমা জাহান রিতু
#পর্ব-৮
আয়েশা বেগম অনেকক্ষণ হলো চেষ্টা করছে ভয়ংকর রাগের একটা ভংগি করতে।যা দেখে তার ৪ বছর বয়সের দু নাতি নাতনী ভয় পাবে।কিন্তু সে কিছুতেই পেরে উঠছে নাহ।মা মরা ছেলে মেয়ে দুটো।আর যে শিশুর মা নেই তার উপর রাগ করা কিংবা শাসন করা বেশ কঠিন ব্যাপার।আয়েশা বেগমের অবশ্য ইচ্ছে করছে তাদের গালে চারটা থাপ্পড় লাগাতে।কিন্তু কেন যেন ইচ্ছে করছে নাহ।রাগ সামলে নিয়ে আয়েশা বেগম এগিয়ে এল তার দুই নাতি নাতনী রাফি আর রুনকির দিকে।এসেই চোখ কিছুটা কঠিন করে বললো
-তোমাদের ছোট ফুপু তোমাদের তৈরি করতে এসেছিল।কিন্তু তোমরা নাকি লুকিয়ে ছিলে?
রুনকি ভয়ে দাদীর দিকে ফিরে বললো
-হ্যা দাদী।
-কারণ টা কি জানতে পারি?এখন কি লুকোচুরি খেলার সময়?সবাই বের হয়ে গাড়িতে উঠে বসেছে।আর তোমরা এখনো তৈরি হও নি।এই ফাজলামির জন্য তোমাদের কি ভয়ংকর শাস্তি দেওয়া উচিৎ তোমরা জানো?
রাফি খুব স্বাভাবিক ভাবেই তার দাদী কে বললো
-বাবা না এলে আমরা যাব না।
-তোমাদের বাবা ট্রেনে আছে।স্টেশন থেকে সরাসরি গাড়িতে উঠে তোমাদের সাথে বিয়ে বাড়িতে যাবে।এটা কি ভূলে গেছ তোমরা?
রাফি আর রুনকি দু জন দু জনের দিকে তাকিয়ে বললো
-আমাদের তো এটা কেউ বলে নি।
আয়েশা বেগম কিছুটা বিরক্ত হয়ে বললো
-বলতে হবে কেন?তোমরা যাও কাপড় নিয়ে আসো।আমি পড়িয়ে দেই।
রাফি আর রুনকি জমজ ভাই বোন।৪ বছর আগেই তাদের জন্ম দিতে গিয়ে তাদের মা দুনিয়া ছেড়ে চলে গেছে।বাবা ও ঢাকায় থাকে।৬ মাস পর পর আসে।এখানে দাদী আর ছোট ফুপুর কোলে পিঠে করেই ধীরেধীরে বেড়ে উঠেছে ওরা।তাদের দাদীর মতে সে পৃথিবীতে এমন দুষ্ট ছেলে মেয়ে কখনো দেখে নি।এই ৪ বছর বয়সেই কথায় পটু তারা।এমন কোন কথা নেই যেটা তারা বলতে পারে না।তাদের পছন্দের কাজ একটি,,সেটি হলো সবার অনুকরণ করা।যে যখন যেভাবে হাটবে যেভাবে কথা বলবে দুই ভাই বোন তখন সেভাবেই তার অনুকরণ করে তাকে রাগিয়ে দেবে।অবশ্য আয়েশা বেগমের ভয়ে তারা এই কাজ টাও কিছুদিন যাবৎ ভালো ভাবে করতে পারছে নাহ।তারা যদি এ বাড়ির কাওকে ভয় পায়ে থাকে তাহলে সেটি তার দাদীকেই।আজ তাদের ছোট চাচার বিয়ে।কিন্তু বাবা এখনো আসে নি বলে তারাও তৈরি হচ্ছিল না।কিন্তু দাদীর এক কথায় তারা ভদ্র ছেলেমেয়ের মত চুপচাপ তৈরি হতে লাগলো।আয়েশা বেগম তাদের চুল আচরিয়ে দেবার সময় তাদের উদ্দেশ্য করে বললো
-তোমাদের কারণে যে বিয়ে যেতে দেরি হচ্ছে এটার শাস্তি তোমরা পাবে।আর খবরদার ওই বাড়িতে গিয়ে ঝামেলা করবে না।যদি তোমাদের নামে কোন রিপোর্ট না আসে তাহলে তোমাদের জন্য যে দেরি হচ্ছে এই শাস্তি টা মাফ করে দিব।বুঝেছো তোমরা?
রাফি আর রুনকি দুজনেই মাথা নেড়ে বললো
-হুম।
-আর সবসময় দাদার হাত ধরে থাকবে।কাওকে বিরক্ত করবে নাহ।
বরের বাড়ি থেকে রাফি আর রুনকি কে নিয়ে গাড়ি ছাড়লো দুপুর ২ টায়।যেতে বেশিক্ষণ লাগবে না।নাটোর থেকে পাবনা যেতে দুই আড়াই ঘন্টার উপরে লাগার কথা নয়।

তুমুল হৈচৈ এর শব্দের সাথে ‘বর এসেছে বর এসেছে’ শুনতে পেল স্নেহা।সে আজ গোলাপি রঙের একটি কাতান পড়েছে,চুল খোঁপা করে বাগান থেকে গোলাপ তুলে এনে খোঁপায় গুজেছে।এতোক্ষণ আয়নার সামনে বসে ঠোঁটে লিপস্টিক লাগাচ্ছিল সে।বর এসেছে শুনে শাড়িটা ঠিক ঠাক করে ঘর থেকে বেড়িয়ে এল স্নেহা।
মুহিব স্নেহাকে দেখে মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে আছে তার দিকে।আচ্ছা একটা মেয়ে এতোটা সুন্দর হতে পারে?তার বউ টা এত সুন্দর যে স্নেহার দিকে আশেপাশের সবাই তাকিয়ে আছে।এই মুহূর্তে খুব হিংসা হচ্ছে মুহিবের।তার বৌকে সব লোক দেখবে কেন?তাকে দেখার,সৌন্দর্য উপভোগ করার অধিকার শুধু মাত্র আছে একজনের।আর সে হচ্ছে মুহিব।কিন্তু এখন দেখা যাচ্ছে সবাই হা করে তার সম্পত্তির দিকে নজর দিচ্ছে।এত টা সুন্দর না ও হলে পারতো স্নেহা।
-এই এখানে কি করছো?ওদিকটায় চলো।বর এসে গেছে।
স্নেহার কথায় মুহিবের চিন্তায় ছেদ পড়লো।সে স্নেহার দিকে তাকিয়ে বললো
-হ্যা।এসেছে।গেটের ঝামেলা মিটুক।
-গেট ধরাটাই তো সবচেয়ে বেশি ইন্ট্রেস্টিং।চলো প্লিজ।
মুহিব বিরক্ত মুখে বললো
-ওখানে অনেক লোক।ওইখানে তুমি গেলে কিছু লোক তোমার গায়ের উপর ইচ্ছা করে এসে পড়বে।তখন কি ভালো লাগবে?
স্নেহা হতাশ ভঙ্গিতে বললো
-পড়লে পড়বে।আমার শরীর তো পচে খসে পড়বে না।
-কি বলছো তুমি এসব?তুমি বড়ং অনুর ঘরে যাও তো।ঠিক তুমি যেভাবে সেজেছ ওকেও ঠিক এভাবেই সাজিয়ে দিবে।যাতে ওর বর ওকে দেখার সাথে সাথেই ফিট হয়ে পড়ে থাকে।
মুহিবের কথা শুনে স্নেহার মুখে হাসি ফুটলো।হাসতে হাসতে স্নেহা বললো।
-কই আমার বর তো এখনো ঠিক ঠাকই আছে।ফিট হয়ে পড়ে নি তো।
মুহিব চোখ মেরে বললো
-মন টা ফিট খেয়ে পড়ে গেছে।শুধু শরীর টা নিয়ে ঘুরছি।বিশ্বাস না হলে মনে একটা চিমটি কাটো,দেখবা ব্যাথা পাচ্ছি নাহ।
মুহিব এ ধরনের রসিকতা স্নেহার সাথে তেমন একটা করে না।এই কাজ গুলো স্নেহার সাথে করতো আফসান।সকাল থেকে বিয়ে বাড়ির জম জমাট আয়োজনে স্নেহা প্রায় ভুলেই গিয়েছিল আফসানের কথা।মুহিবের এই কথায় স্নেহার আফসানের কথা মনে পড়লো।আচ্ছা পড়শু আফসানের বাসা থেকে আসার পর একটা বারো ফোন করেনি আফসান।কেন করলো না?ঠিক আছে তোহ আফসান??স্নেহার ঘোর কাটলো চিৎকার চেঁচামেচির শব্দে।সে মুহিবের দিকে তাকিয়ে বললো
-কি হয়েছে?চিৎকার করছে কে?
মুহিব নিজেও বুঝতে পারছে নাহ।চিৎকার চেঁচামেচি শোনা যাচ্ছে অনুর ঘর থেকে।সে স্নেহাকে নিয়ে এগিয়ে গেল অনুর ঘরের দিকে।

রাফি আর রুনকিকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে নাহ।গাড়ি থেকে নামার পর এক বার দেখেছিল তার ছোট ফুপু আশা।তারপর থেকে আর কারো নজরে আসে নি তারা।আশার কপাল দিয়ে ঘাম ঝড়ছে।এ বাড়ির সামনে একটা বড় পুকুর আছে।গাড়িতে আসার সময় রাফি তাকে বলেছিল
-ফুপু এটা নদী না পুকুর?
-পুকুর।
-নদী না কেন?
আশা ভ্রু কুঁচকে জবাব দিল
-আল্লাহ বানাইনি তাই হয় নি।আর একটা প্রশ্ন ও করবি নাহ।চুপচাপ বসে থাক।
আচ্ছা ওরা দু জন পুকুরে নামেনি তোহ?আশা আর কিছু না ভেবেই দৌড়ে পুকুরপাড়ে গেল।
অনুর ঘরে যে একটু আগে চিৎকার চেঁচামিচি হচ্ছিল সেটা এখন আর নেই।সব ঠিকঠাক।একটু আগে যে বিয়েরডালা নিয়ে বড় একটা ঝামেলা হয়ে গেছে এই ঘরে সেটা কে বলবে!যে বিষয় নিয়ে চেঁচামেচি হচ্ছিল সেগুলো হলো ব্লাউজ বড় হয়েছে,শাড়ির রঙ টা নাকি ভালো হয় নি,জুতাটা নাকি বেশি উচু হয়েছে,সেন্টের গন্ধটা নাকে এলে বমি আসে,ব্লা ব্লা।স্নেহা এগুলো শুনে মুহিব কে বলেছিল
-এতো গুলো ভূল ছেলেরা কিভাবে করল?আর এখন কি হবে তাইলে?
মুহিব হাসতে হাসতে বললো
-আরে এটা সব বিয়েতেই হয়।কোনো দিনই ছেলেপক্ষের ডালা মেয়েপক্ষের কারো পছন্দ হয় না।আর এটা নিয়ে তারা কিছুক্ষণ মেতে উঠবেন।ঝগড়া করবেন।তারপর আবার সব ঠান্ডা।ঠিক যেমন ভাবে দপ করে তারা জ্বলে উঠে ঠিক তেমন ভাবেই ফস করে নিভে যাবে।
-আন্টি আন্টি?
স্নেহা গন্ডোগলের কথা নিয়ে চিন্তা করছিল।ঠিক তখনই হঠাৎ পিচ্চি দুটো ছেলে মেয়ে এসে তাকে ডাকতে লাগলো।পিচ্চি দুটোর চেহারা মায়ায় ভরা।ফরসা গোলকাকার মুখের মাঝে দুটো গোল গোল চোখ।যেন রুটি মাঝে মার্বেল বসিয়ে দিয়েছে কেউ।স্নেহার মনে হলো দুটো বাচ্চার চেহারা একই।শুধু একজনের চুলটা কাধ সমান,আর একজনের ছোট।যদি মেয়েটার চুল কেটে ছেলেটার সমান করা হয় তাহলে তাদের দু জনকে কেউ আলাদা করতে পারবে না।ওদের বাবা মা ও পারবে কিনা সন্দেহ।স্নেহা নিচু হয়ে ছেলেটার গাল ধরে বললো
-কিছু বলবে?
পিচ্চি ছেলেটা বললো
-বউ কোথায় আছে আপনি কি বলতে পারবেন?আমরা তাকে দেখতে এসেছি।কিছু ছবি ও তুলবো।চাচ্চু তুলতে বলেছে।
-তোমরা বউ এর খোঁজে এসেছ তাহলে!আর চাচ্চুটা কে?
এ পর্যায়ে পিচ্চি মেয়েটা বললো
-আরে চাচ্চু কে চেন না?বউ এর বরই তো চাচ্চু।
স্নেহা এবার মেয়েটা দিকে তাকিয়ে বললো
-নাম কি তোমাদের?
-আমার নাম রুনকি,ওর নাম রাফি।
রাফি ভ্রু কুঁচকে স্নেহার দিকে তাকিয়ে বললো
-আপনি এত কথা বলছেন কেন?বউ কে চেনেন তো আবার?
স্নেহা হেসে বললো
-চিনি।চলো নিয়ে যায়।আর তোমাদের নাম গুলো কিন্তু অনেক সুন্দর।
স্নেহা রাফি আর রুনকি কে নিয়ে এগুলো অনুর ঘরের দিকে।ঠিক তখনি একটি মেয়ে ডাকতে লাগলো রাফি আর রুনকির নাম ধরে।
-এই এই তোরা এখানে কি করছিস?তোদের না বলেছি সবসময় আমার সাথে সাথে থাকতে।
রাফি তার হাতের ফোন দেখিয়ে বললো
-চাচ্চু বউ এর ছবি তুলতে বলেছে।তাই বউ এর কাছে যাচ্ছি।তুমি যাও তো।কাজে ডিস্টার্ব করো না।
আশা হতভম্ব হয়ে গেল রাফির কথা শুনে।তার ভাইয়ের কি কোন কাণ্ডজ্ঞান নেই?বিয়ে হতে কিছু সময় বাকি।এতোক্ষণই আর তার সহ্য হচ্ছিল না!ছোট ছোট দুই ছেলে মেয়েকে পাঠিয়েছে ছবি উঠানোর জন্য!!বউ কে না দেখতে পেলে কি সে মরে যাবে নাকি?লজ্জা সরম সব কি ব্যাংকে জমা রেখে আসছে নাকি সে!
রাফি আর রুনকি স্নেহার হাত ধরে বললো
-চলুন তো।
তারা আশা কে রেখে বউ এর ঘরে চলে গেল।আশার রাগে গা কাঁপছে।তার উচিৎ ই হয়নি এই দুই টাকে এখানে নিয়ে আসার।

স্নেহা বাচ্চা দুটো কে সাথে নিয়ে বাইরে এসেছে অনুর ঘর থেকে অনেকক্ষণ হলো।এই দুটো বাচ্চার উপর একটা মায়া জন্মে গেছে তার।এত পিচ্চি দু টো বাচ্চা,অথচ কি সুন্দর ভাবেই না কথা বলে।কিন্তু যখন স্নেহা জানতে পারলো ওদের মা নেই তখন স্নেহার কি যে খারাপ লাগছিল!আল্লাহ পৃথিবীতে কতো খেলাই না দেখায়!তার মা বেচে থেকেও নেই আর এই দুটো পিচ্চির মা তো নেইই।এদের সাথে স্নেহার অসম্ভব কিছু মিল আছে।মা ছাড়া মানুষ হয়েছে তারা,স্নেহা নিজেও।এর জন্যই কি দু টো পিচ্চিকে তার এত আপন লাগছে?আর পিচ্চি গুলাও অনেক মিশুক।নাহলে কিছু সময়ের মাঝে কাওকে এতটা আপন মনে করে এতোটা সহজ ভাবে মিশতে পারতো না।
-আন্টি,ওইদিকটায় চলো।বাবার ডাক শুনতে পাচ্ছি।
রাফি আর রুনকি কে নিয়ে বাগানের দিকে যেতেই থমকে গেল স্নেহা।চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে রইলো আফসানের দিকে।আফসান এখানে এল কি করে?নাকি এটা অন্য কেউ?অন্যকেউই হবে।আফসান কে নিয়ে চিন্তা ভাবনা করার কারণে সে চোখে হয়তো ভুল দেখছে।
বাগানের ভিতর আসতেই রাফি আর রুনকি দৌড়ে ছুটতে লাগলো তার বাবার দিকে।তাদের দুইজনের মাঝে প্রতিযোগিতা চলছে।কে আগে দৌড়িয়ে গিয়ে বাবার বুকে ঝাঁপিয়ে পড়তে পারে।স্নেহা কিছুটা দূরে দাঁড়িয়ে দেখতে লাগলো দৌড়ের প্রতিযোগিতা।স্নেহার সামনে যে সত্যিই আফসান দাঁড়িয়ে আছে সেদিকে তার সামান্যতম আগ্রহ নেই।সে তীক্ষ্ণ চোখে তাকিয়ে প্রতিযোগিতা দেখছে।কে আগে আফসানের বুকে ঝাঁপিয়ে পড়তে পারবে?রাফি নাকি রুনকি???

(চলবে)