দৃষ্টির অলক্ষ্যে পর্ব-০৯

0
306

#দৃষ্টির_অলক্ষ্যে
#পর্বঃ০৯
#রূপন্তি_রাহমান (ছদ্মনাম)

দুপুর গড়িয়ে বিকেল হল। একমনে কাজ করে চলেছে ফয়সাল। নতুন প্রজেক্ট হাতে এলে কাজের প্রসারটা একটু বেশি থাকে। এর মাঝে বিকট শব্দে তার ফোন বেজে উঠলো। ফাইলে নিজের দৃষ্টি নিবদ্ধ রেখে মোবাইল রিসিভ করেই শুনতে পেল ওপাশের সেই পরিচিত পুরুষের কথা,

‘কি মশাই, বউকে কি আজকাল শারীরিকভাবে সুখী করতে পারছেন না?’ আপনার বউ যে শরীরের খিদে মিটানোর জন্য আজকাল আবাসিক হোটেলে ছেলে নিয়ে যায় জানতাম না তো। এই বয়সে পৌরষত্বে ভাটা পড়লে চলে?’

প্রতিটা কথার নিনাদ ফয়সালের কর্ণগোচর হতেই ধপ করে মেজাজ গরম হয়ে গেলো। রাগে, ক্ষোভে কপালের রগটা ফুলে উঠলো।দাঁতে দাঁত চেপে চাপা গলায় বলল,

‘আপনাকে যদি সামনে পেতাম আমি সত্যি আপনাকে খু’ন করতাম। এই আপনি আমার জীবনটাকে হেল করে ছেড়েছেন। আপনাকে তো আমার বউয়ের পিছনে জাসুসি করতে বলিনি।’

ফোনের ওপাশে থাকা ব্যক্তি রগড় গলায় বলল,

‘আহ্হা! রেগে যাচ্ছেন কেন? সত্য কথা তিতাই হয়। আমি আজ নিজের চোখে দেখলাম দুপুর বেলা।’

হাত মুষ্টি বদ্ধ করে নিজেকে শান্ত করার প্রয়াস চালালো ফয়সাল। খুব জোরে জোরে নিঃশ্বাস নিচ্ছে সে। কোনোমতেই রাগ কমছে না। একহাতে নিজের চুলগুলো টেনে বলল,

‘সে দুপুরে কোথাও যায়নি। আমার জন্য লাঞ্চ নিয়ে এসেছিল। আর সাহস থাকে তো মুখোমুখি হয়ে কথা বলেন।এতো লুকোচুরি করেন কেন? আমার সাথে কথা বলা শেষ করে মোবাইলও বন্ধ করে ফেলেন।সত্য বললে আপনার এতো কিসের ভয়?’

ওপাশের ব্যক্তি ফয়সালের কথা শুনে শব্দযোগে হাসতে লাগলো। সেই হাসি বড় বিচ্ছিরি শুনতে লাগলো ফয়সালের কাছে। এভাবে উদ্ভটভাবে কেউ হাসে? আস্তে আস্তে ক্ষীণ হয়ে এলো সেই হাসির শব্দ।

‘ভয় পাবো আর আমি? হাসালেন মশাই। আপনার ভালোর জন্য বলছি সব। আপনার স্ত্রী আপনার নাকের ডগা দিয়ে তার রাসলীলা চালিয়ে দিচ্ছে কিন্তু আপনি টেরও পাচ্ছেন না। কালো কাপড়ে আপনার চোখ দুটো বাঁধা। চোখ থেকে সেই কালো কাপড়ের বাঁধন খুলুন আর দেখুন আপনার স্ত্রী আপনাকে সাত বছর যাবৎ ঠকিয়ে যাচ্ছে। বিশ্বাস না হলে আমি এমএমএস সেন্ড করছি আপনি দেখে নিয়েন।’

কান থেকে মোবাইলটা নামিয়ে থম মে’রে বসে রইলো সে। কি করবে না করবে দিশা পেলো না সে। পথহারা পথিকের ন্যায় তার অবস্থা। সে অনুভব করলো মানসিক ভাবে বড্ড অসহায় সে। তন্মধ্যে মেসেজ টিউন বেজে উঠলো। মেসেজ ওপেন করতেই ফয়সালের শরীরের প্রতিটা র’ক্তবিন্দু টগবগিয়ে উঠলো। রাগে জেগে গরম হয়ে উঠলো তার সর্বাঙ্গ।

কালো কোট পরিহিত একজনের সাথে তূবা হোটেলে ওয়াশিংটন লি. এর ভেতরে যাচ্ছে। ফয়সালের ছবির দিকে অনিমেষ তাকিয়ে রইলো। বলার ভাষা হারিয়ে ফেলেছে সে। সেখানে যাওয়ার কোনো কারণ দেখতে পাচ্ছে না সে। মোবাইলটা টেবিলের উপর রাখলো।আবারও টুং করে শব্দ হলো। সে জানে এটা অপরিচিত লোকের মেসেজ। চোখ বন্ধ করে গা এলিয়ে দিল নিজের চেয়ারে। শরীরের সমস্ত শক্তি যেন হাওয়ায় মিলিয়ে যাচ্ছে। কিয়ৎকাল এভাবে থাকার পর উঠে দাঁড়ায়। আজ হয় এসপার হবে না হয় উসপার। এমডির কাছে অসুস্থতার কথা বলে ছুটলো বাসার দিকে। জ্যামে আটকা পড়ে ফয়সালের মেজাজ আরো খারাপ হয়ে গেলো।

_______________________

ফয়সালের সেই চড়ে কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে গেলো তূবা। অকস্মাৎ চড়ে হতবিহ্বল সে। ঠিক কি প্রতিক্রিয়া জানাবে সে তার জানা নেই। গালে হাত রেখে অনুভূতিশূন্য চোখে সে তাকিয়ে রইলো সামনে দন্ডায়মান ফয়সালের দিকে। ফয়সালের ক্রোধানলে দগ্ধ মুখের দিকে নেত্রপাত করে নিজের অপরাধ বুঝার ব্যর্থ চেষ্টা চালাচ্ছে তূবা। রাশেদা খাতুন দৌড়ে ওদের কাছে এলেন।ফারিয়া বাবার আগুল লাল চোখ আর রাগান্বিত মুখ দেখে ভয়ে কাঁপতে শুরু করল। রাশেদা খাতুন কিছু বলার জন্য মুখ খুলতেই ফয়সাল সহর্ষে বলে উঠলো,

‘ আমাদের স্বামী স্ত্রীর মাঝে একদম আসবে না, মা। আমি এতোদিনের বোঝাপড়া আজ মিটাবো।’

তূবার দিকে এগিয়ে গিয়ে তার বাহু চেপে ধরে ফয়সাল হুঙ্কার দিয়ে বলল,

‘আমাকে দিয়ে তোমার হয় না? ক’জন লাগে চাহিদা মিটানোর জন্য? আজ সকালের এসব জ্ঞানী বাণী বলে আমাকে কাঠের চশমা পড়িয়েছো। আজ দুপুরে আমার জন্য খাবার নিয়ে যাওয়া মাত্র একটা অযুহাত ছিল তাই না? তোমার অভিসন্ধি তো ছিল অন্য কিছু। এতো জ্বালা থাকলে আমাকেই বলতে পারতে।’

শ্বাশুড়ির দিকে একবার নজর বুলালো তূবা। অতঃপর ফয়সালের দিকে নিজের চক্ষু স্থির রেখে নিস্তেজ, বিষাদভারাতুর গলায় বলল,

‘নিজের মনের ভ্রান্ত ধারণার জের ধরে রাগের বশে হটকারিতায় এমন কিছু বলো না যার জন্য তোমাকে সারাজীবন পস্তাতে হয়। শরীরের আ’ঘা’ত মিলিয়ে তবে কথার আ’ঘা’ত থেকে যায় আ’মৃ’ত্যু।’

এবারও ফয়সাল গর্জে উঠলো। পূর্বের তুলনায় আরো বেশি। ফয়সালের সেই গর্জনে যেন কেঁপে উঠলো রুমের প্রতিটা আসবাবপত্র। ফারিয়া ভয়ে দাদির আঁচল আঁকড়ে ধরল।

‘তুমি পস্তানোর কথা বলছো? আমি তো সেই বিয়ের পর থেকেই পস্তাচ্ছি। প্রতিনিয়ত আমি তোমার নেগেটিভ তথ্য পেয়েছি। তোমাকে দু’কথা জিজ্ঞেস করার সাহসও পেতাম না। ভালোবেসে ফেলেছিলাম তোমাকে। যদি ছেড়ে চলে যাও সেই ভয়ে। তবে আজ ধৈর্য্যের বাঁধ ভেঙেছে। আগেও যেতে তাই না? ফারিয়া আমার সন্তান তো? নাকি অন্যকারো সন্তানকে আমার বলে চালিয়ে দিয়েছো?’

শেষোক্ত বাচ্য তূবার শ্রবণেন্দ্রিয় হতেই ঠাস করে মেঝেতে বসে পড়লো সে। নির্বাক, নির্বিকার বাকরূদ্ধ হয়ে ফয়সালের দিকে তাকিয়ে রইলো। ফয়সালের করা শেষ দুই প্রশ্নের উত্তর তার কাছে নেই। কিসের ভিত্তিতে সে এতো বড় কথা বললো বড্ড জানতে ইচ্ছে হলো তার। কিন্তু কণ্ঠনালী দিয়ে একটা শব্দও সে বের করতে পারলো না। সকল শব্দেরা যেন পুঁজিত হয়ে গলায় আঁটকে আছে।

এতোক্ষণ চুপ করে সব শুনলেও এবার আর নিজেকে দমিয়ে রাখতে পারলেন না রাশেদা খাতুন। সপাটে ছেলের গাল বরাবর চড় বসালেন। রাগে থরথর করে কাঁপতে লাগলেন তিনি।

‘এই চড়টা আমার আরো আগে দেওয়া উচিৎ ছিলো। তাহলে এসব লাগামছেঁড়া, বেখাপ্পা, কুৎসিত কথা তোর মুখ দিয়ে বের হতো না। মানুষ কোনো তথ্য পেলে তা যাচাই করে।তারপর বাকিসব কিছু।’

‘আমি ক্লান্ত হয়ে গিয়েছি মা। ওর দহনে আমি সেই প্রথম থেকে জ্বলছি। এই দেখ।’ বলেই সে ছবিটা দেখালো।

‘একটা পুরুষের সাথে সে কেন আবাসিক হোটেলে গিয়েছে? আমাকে এর উত্তর দাও।’

রাশেদা বেগম ছেলের দিকে বিস্ফোরিত চোখে তাকায়।

‘সেখানে গেলো বলে খারাপ কাজ করবে? এই শিক্ষা আমি তোকে দিয়েছিলাম?’

এবার মুখ খুলল তূবা।

‘ফয়সাল, ফারিয়া তোমার মেয়ে না। আই রিপিট ফারিয়া তোমার মেয়ে না। সে শুধু আমার মেয়ে। যখন ওর জন্ম নিয়ে তোমার মনে সন্দেহের সৃষ্টি হয়েই গিয়েছে তাহলে সে তোমার মেয়ে কখনো হতেই পারে না। তুমি নরমাল আমাকে এসব জিজ্ঞেস করলে আমি উত্তর দিয়ে দিতাম। তবে আমাকে হাজার জিজ্ঞেস করলেও আমি আমার সম্পর্কে তোমার কোনো ভুল ভাঙাবো না। আমার সম্পর্কে তো তোমার ধারণা হয়েই গিয়েছে না। একসাথে এক বিছানায় থাকার যে মানুষ টা আমাকে চিনলো না।তার কাছে নিজেকে নতুন করে উপস্থাপন করার বিন্দুমাত্র ইন্টারেস্ট আমার নেই। আমি খারাপ আমি,,,,,’

কথাটা গলায় আঁটকে এলো তূবার। রাগে, দুঃখে চোখ বুঁজে নিলো সে। গাল বেয়ে গড়িয়ে পড়তে অভিমানের অশ্রু।

‘কেউ তোমাকে আমার সম্পর্কে এতোটা বছর উসকে এসেছে। না তুমি তাকে চিনার চেষ্টা করছো। না তুমি তাকে জানার চেষ্টা করেছো। আর না আমার থেকে এসবের সত্যতা যাচাই করেছো। প্রথমে তোমার প্রশ্নে জমেছে, তারপর সন্দেহ আর আজ? আজ তো বলেই দিলে। একটা মানুষকে ঠিক যতটা নিচে নামানো তার থেকেও বেশি নিচে নামালে তুমি আমাকে। তোমার কাছে নিজের সম্পর্কে জেনে আমি কৃতজ্ঞ। নিজেকে চিনলাম নিজের চরিত্র সম্পর্কে জানলাম নতুন করে,
ধন্যবাদ। বলেছিলাম না হটকারিতায় এমন কিছু বলো না যার জন্য সারাজীবন পস্তাতে হয়? তোমার আর আমার পথচলা হয়তো এই পর্যন্তই ছিলো। এতোদিন তোমার শত অবহেলা, রাগ, জেদ সহ্য করেও তোমার সাথে ছিলাম। কারণ আমি জানতাম তোমার মনে আমার জন্য একটা সফট কর্ণার আছে। ভালো তুমি একা বাসোনি। আমিও ভালোবাসি তোমায়। আমার অনুভূতি, অনুরক্তির ইতিটা না হয় এখানেই টানলাম। তোমার জন্য করা আমার সকল মন কেমনের সমাপ্তি এখানেই ঘটলো।’

বসা থেকে উঠে দাঁড়ালো সে। তারপর ফারিয়াকে কাছে টেনে নিল। ফারিয়া ভয়ে জবুথবু হয়ে আছে। মায়ের ইশারায় মাকে আঁকড়ে ধরল সে। হাতে থাকা স্বর্ণের চুড়ি, গলার চিকন চেইন আর তাতে থাকা লকেট, কানের দুল খুলে তূবা শ্বাশুড়ির হাতে দিলো।

‘আমার সকল অধিকার, দায়িত্ব, কর্তব্যবন্ধন আর দায়বদ্ধতা আমি এখানেই ক’ব’র দিয়ে গেলাম। চল মা নানুর বাড়ি যাবো।’

সদর দরজা পার হতে গিয়েও হলো না তূবা। পিছন ফিরে তাকালো আবার। ফয়সালকে উদ্দেশ্য করে বলে,

‘আমার সম্পর্কে তোমার ধারণা যেন কখনো বদলে না যায়। যেদিন ধারণা বদলে সেদিন নিজের চোখে নিজে অপরাধী হয়ে যাবে। আয়নায় চোখে চোখ মিলাতে পারবে। নিজের করা ভুলের দহনে দগ্ধ হবে তুমি। প্রতিনিয়ত একটু একটু করে ম’র’বে তুমি। তার চেয়ে ভালো তুমি সঠিক থাকো। আর তোমার চোখে আমিই অপরাধী থাকি। বিবেক যখন তাড়া করে বেড়াবে দু’দণ্ড শান্তি পাবে না। চরিত্রবান কাউকে দেখে আবার জীবন শুরু করো। আমাকে বিয়ে করে তো পস্তালে সারাজীবন।’

রাশেদা খাতুনকে বলল,

‘নিজের যত্ন নিবেন। আপনার প্রেসারের ঔষধ শেষ। আর ডায়াবেটিস মাপার কাঠি শেষ। ওগুলো আনবেন। আর মনে করে ঔষধ খাবেন। চলো মা অনেক রাত হয়ে গেল।’

এক আকাশ পরিমাণ দুঃখ বুকে নিয়ে বিদায় নিলো তূবা। হতবিহ্বল হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো সে। তূবা চলে যেতই সে সম্বিত ফিরে পেল। হটকারিতায় অনেক নিকৃষ্ট শব্দ সে মুখ দিয়ে বের করে ফেলেছে। এজন্যই হয়তো বলে রাগ করলে মাথা ঠান্ডা করতে হয়। রাশেদা খাতুন পাথরের মূর্তি মতো সোফায় বসে রইলো। ছেলের অর্বাচীন, ছেলেমানুষী আর অবিবেচনাময় কান্ডের জন্য সংসারটা ভাঙার পথে। তবে একটা শাস্তি ওর প্রাপ্য।

দৌড়ে নিচে গেলো ফয়সাল। এদিক ওদিক খোঁজেও তূবাকে আর নিজের মেয়েকে পেলো না। ফোন করতে লাগল একের পর এক। তূবা ফোন কে’টে দিচ্ছে। এরপর কল করায় বলল ওয়েটিং। তারপর বন্ধ। সেখানেই বসে নিজের মাথার চুল টেনে ধরলো। আজ এতো বছর পর তার চোখ দিয়ে অশ্রু গড়াতে লাগল।

_____________________

নতুন নাম্বার থেকে নাযীফাহকে মেসেজ করার জন্য মাত্রই ফোন হাতে নিল তাহমিদ। ঠিক তখনি তূবার নাম্বার থেকে কল এলো। ফোন রিসিভ করে শুনতে পেলো তাহমিদ তূবার মলিন, বিষন্ন আর মেঘমেদুর কন্ঠ,

‘আমাকে বাসায় নিয়ে যাবি ভাই? আমি না বড্ড ক্লান্ত, হাঁপিয়ে গিয়েছি আমি। আমি একটু বিশ্রাম চাই। একটু শান্তি চাই।’

বোনের এমন বিষাদভারাতুর গলা কর্ণগোচর হতেই তাহমিদ আতংকিত, ভীতিগ্রস্ত গলায় বলল,

‘কি হয়েছে তোর? এভাবে কথা বলছিস কেন?’

‘অবহেলা আর অপমানের দেয়ালে আমার পিঠ ঠেকে গেছে। আমি আর পারছি না। আমাকে নিয়ে যা তুই। আমি ক্লান্ত পথিক।’

টি-শার্ট আর টাউজার পরিধিত অবস্থায় তাহমিদ ছুটলো নিজের বোনের কাছে।

#চলবে।

বানান ভুল ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন।