দৃষ্টির অলক্ষ্যে পর্ব-২+৩

0
364

#দৃষ্টির_অলক্ষ্যে
#পর্বঃ০২
#রূপন্তি_রাহমান (ছদ্মনাম)

‘আমি বোধ হয় কোনো পাপ করেছি। তার ফল তোরা পাচ্ছিস। তোর ভাইটাও কেমন জানি করে।কারণে অকারণে শুধু টাকা খুঁজে। আমার ছেলেটা বখে যাচ্ছে। এক সময়ের মেধাবী ছাত্রের এখন টেনেটুনে পাস করতে কষ্ট হয়। শাসন করেও লাভ হচ্ছে না।’

বাবার কথায় ক্রুদ্ধ শ্বাস ফেলে নাযীফাহ। ভাইয়ের পরিবর্তন সে নিজের চোখে দেখেছে। সান্ত্বনার স্বরে বাবাকে বলল,

‘ছোট মানুষ বাবা কিছু বোঝে না।বন্ধুদের সাথে চলতে ফিরতে টাকা পয়সা লাগে। তাই হয়তো তোমার কাছে বার বার যায়।’

মেয়ের কথার জবাবে তিনি বলেন,

‘কলেজ পড়ুয়া ছেলে আর ছোট নেই। ওকে কেউ আমাদের সকলের বিরুদ্ধে উসকে দিচ্ছে। আমরা নাকি তোকে সব দিয়ে দিচ্ছি।’

প্রসঙ্গ বদলাতে নাযীফাহ বলল,

‘বাবা আজকের চাঁদটা দেখেছো? কত বড় চাঁদ। নিস্তব্ধ, নিরিবিলি রাতে কি সুন্দর আবছায়া আলো ছড়াচ্ছে। দিবালোকে সূর্যের তাপমাত্রা যতটা প্রখর, উত্তপ্ত ঠিক রাতের বেলা চাঁদের নির্মল আর শীতল। আমাদের আশেপাশের মানুষেরা কেন নির্মল হয় না? এরা কেন সব জায়গায় নিজের স্বার্থ খোঁজে?’

প্রশ্নের পিঠে কোনো জবাব খোঁজে পেলো না খালেদ মোশাররফ। বাতায়নের ফাঁক দিয়ে তাকিয়ে রইলেন নক্ষত্রমন্ডলের দিকে।

‘তখন কি যেন বলছিলি? পাঁচ বছর কি না কি?’

মলিন হাসলে নাযীফাহ। ফোনের ওপাশ থেকে মেয়ের মলিন মুখখানা দেখলেন না খালেদ মোশাররফ। মেয়ের এমন ভেঙে পড়া, অবসন্ন আনন দেখলে হয়তো তৎক্ষনাৎ আগলে নিতেন। বাবারা বরাবরই মেয়েদের উপর দূর্বল যে।

‘আজকে আমার জয়েনিং ডেট ছিলো না? অফিসে গিয়ে দেখি উনি ট্রেইনড অফিসার।’

মেয়ের কথায় চকিত হয় খালেদ মোশাররফ। আতংক গ্রস্ত, তটস্থ গলায় প্রশ্ন করলেন,

‘তোকে কিছু বলেছে মা? সবার সামনে কি কটু কথা বলেছে? দরকার নেই এমন চাকরি করার। আমি তো নিষেধ করেছি তোর চাকরি করা লাগবে না। আমি মাসে শেষে টাকা পাঠাবো।’

বাবার ভীতিগ্রস্ত কন্ঠস্বর শ্রবণেন্দ্রিয় হতেই শব্দহীন হাসলো সে। সন্তানের জন্য বাবা মায়ের কত টেনশন আর উৎকন্ঠা।

‘মনে হয় না আমাকে চিনতে পেরেছে। মুখের ভাবভঙ্গি দেখে মনে হলো আমাকে প্রথম দেখেছে।’

স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলেন খালেদ মোশাররফ। প্রচন্ড ভয় পেয়ে গিয়েছেন উনি। উনার সন্তান কে কেউ কটু কথা বলুক উনি মানতে পারবেন না। গ্রাম বাংলায় একটা কথা আছে, ‘যার যার সন্তান তার তার কাছে হিরার টুকরো।’

‘না চিনলেই ভালো।’

অতঃপর দুই বাবা মেয়ে দুইজনই নিশ্চুপ, নীরব কানে ফোন ধরে রেখে অক্রিয় হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো কিয়ৎকাল। অলক্ষিতভাবে মেয়ের ফোঁপানোর শব্দ পেয়ে চমকে যায় খালেদ মোশাররফ। ভয়চকিত, আতঙ্কপ্রবন গলায় বললেন,

‘কি হয়েছে মা? কাঁদছিস কেন? তুই কাঁদলে বাবার কষ্ট হয় তো।’

এতোক্ষণে চেপে রাখা রোদন আর চেপে রাখতে পারলো না সে। কাকুতিপূর্ণ স্বরে বলল,

‘বাবা, আমার সাথেই কেন এমনটা হলো? আমি কার কি ক্ষতি করেছি বাবা? তোমার সম্মানের কথা চিন্তা করে কারো সাথে উচ্চ বাক্যে কথা বলিনি। ছেলেদের থেকে দূরে দূরে ছিলাম। দিনশেষে কেন আমার চরিত্রের উপর আঙুল তুলে মানুষ। সমবয়সী মেয়েরা যখন তাদের বাচ্চা নিয়ে যায় তখন কষ্ট হয় না। তারা যখন আমার দিকে বাঁকা নজরে তাকায় তখন আমার কষ্ট হয়। জীবনে বিয়েটাই মুখ্য বলো? মানুষের কটু কথা থেকে বাঁচতে গ্রাম ছেড়েছি। এতোটা মেন্টাল প্রেশার আমি আর নিতে পারছি না। আমার খুব কষ্ট হয় বাবা। আমি তো বিয়ের জন্য মরিয়া হয়নি তাহলে মানুষ কেন বয়স হয়েছে? বিয়ে করো বলে মাথায় খায়?’

মেয়ের কান্নার প্রতিটা নিনাদ খালেদ মোশাররফের বুকে তীরের মতো বিঁধছে। এক অসহায় বাবা তিনি।কোনো কিছুর কূলকিনারা করতে পারছেন না। কে আছে এসবের পিছনে?

‘কাঁদিস না মা। এই সকল দুঃখ একদিন সুখে পরিণত হবে। সকল দুশ্চিন্তা আর উৎকন্ঠার কালো মেঘ সরে গিয়ে সুখ আর শান্তি নামক বিহঙ্গরা ডানা ঝাপটে উড়ে বেড়াবে বিস্তৃত অন্তরীক্ষে। তখন মনে হবে এক সমুদ্র পরিমাণ দুঃখ ছিলো বলেই সুখ নামক ঢেউয়েরা আছড়ে পড়ছে কিনারায়। দুঃখ আছে বলেই সুখ নামক শব্দটা এতো দামি।ধৈর্য্য ধর মা ধৈর্য্য ধর। সমুদয় দুঃখ মিলিয়ে যাবে হাওয়ায়, আর সুখে অবগুণ্ঠিত হবে সমস্ত কায়া।’

________________

দ্রুত নাস্তা বানাচ্ছে মনোয়ারা বেগম। আর একটু পরেই ছেলে অফিসের উদ্দেশ্য বের হবে। এই বয়সে এতো তাড়াহুড়ো করে কাজ করা যায় নাকি? একা সবকিছু সামলাতে হিমশিম খাচ্ছেন উনি। কাজের মেয়েটা হয়েছে ফাঁকিবাজ। ঠিক যতটা দেরি করে আসা যায় ঠিক ততটাই দেরি করে আসে।

টেবিলে নাস্তা দেওয়া শেষ মনোয়ারা বেগমের। ফর্মাল ড্রেসআপে রুম থেকে বেরিয়ে এলো তাহমিদ। কাঁধে ঝুলানো ল্যাপটপের ব্যাগ। ব্যাগটা পাশের চেয়ারে রেখে বলল,

‘আজ শ্যামলী আসেনি।’

‘তিনি বড় বড় শিল্পপতিদের থেকেও ব্যস্ত। বাসায় এসে যে পায়ের ধূলো দেন সেটাই তো অনেক।’

চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে তাহমিদ বলল,

‘এতো ফাঁকি বাজি করলে বাদ দিয়ে দাও।’

মনোয়ারা বেগম রগঢ় গলায় বললেন,

‘এই শহরে চাকরির চেয়ে কাজের মেয়ে পাওয়া কঠিন।’

মায়ের কথা শুনে শব্দযোগে হাসতে লাগলো তাহমিদ।

‘তুমি পারো মা।’

নাস্তার পর্ব চুকিয়ে তাহমিদ ছুটলো অফিসের দিকে। মনোয়ারা বেগম টেবিল পরিষ্কার করে মাত্রই একটু বসেছেন ওমনি কলিং বেল বেজে উঠলো। শ্যামলী এসেছে ভেবে চোখ মুখ কঠিন হয়ে এলো উনার। প্রস্তুতি নিলেন আজ দু’কথা শুনিয়ে দিবেন। কাজে আসলে আসবে না আসলে নেই। দরজা সামান্য ফাঁক করতেই একটা আট বছর বয়সী ছোট্ট মেয়ে নানুউউউ বলে ঝাপিয়ে পড়লো মনোয়ারা বেগমের কোলে। বাচ্চাটার সংস্পর্শ পেয়ে মনোয়ারা বেগমের বিরক্তিভাব টা নিমিষেই উধাও হয়ে গেলো। ক্লান্তিকর মুখে ফুটে উঠলো হাসি।

‘আমার নানুমনিটা কেমন আছে।’

সে তার নানুর গলা জড়িয়ে বলল,

‘ভালো আছি। তুমি কেমন আছো নানু?’

‘এতোক্ষণ ভালো ছিলাম না। কিন্তু তোমাকে দেখে ভালো হয়ে গেছি।’

মন খারাপের অভিনয় করে মনোয়ারা বেগম পুনশ্চ বললেন,

‘আসার কথা কালকে ছিলো। তাহলে এলে না কেন?’

সে চোখ বড় বড় করে বলল,

‘জানো নানু, কাল কি হয়েছে? আমরা এখানে আসার জন্য রেডি হচ্ছিলাম তখন বাবা,,,,।

‘ফারিয়া, তুমি তোমার নানুর কোল থেকে নামো। দেখছো তিনি হাঁপাচ্ছেন। কষ্ট হচ্ছে উনার।’

মায়ের রাগত স্বরের চিৎকার শুনে কেঁপে উঠলো ফারিয়া। মনোয়ারা বেগম এবার মেয়ের দিকে দৃষ্টিপাত করলেন। কপালের একপাশে কা’টা। সূঁচালো দৃষ্টিতে মেয়ের পা থেকে মাথা অব্দি চোখ বুলালেন তিনি।

‘ওকে ধমকে চুপ করালি কেন, তূবা? ওকে ওর কথা শেষ করতে দে।’

তূবা মেয়ের দিকে চোখ গরম করে বলল,

‘কোনো কথা শেষ করতে হবে না। বাইরেই দাঁড়িয়ে থাকবো নাকি?’

মনোয়ারা বেগম মেয়ের অভিমুখে দৃষ্টি স্থির রেখে পুনরায় জিজ্ঞেস করলেেন,

‘কপালে কা’টা দাগ কিসের?’

এইবারে দৃষ্টি নত হয়ে গেলো তূবার। গলার স্বরও নমনীয় হয়ে এলো। মিইয়ে যাওয়া গলায় বলল,

‘কাল রাতে লোডশেডিং হওয়ার পর অন্ধকারে হাঁটতে গিয়ে দেয়ালের সাথে ধাক্কা লেগে কে’টে গেছে।’

মেয়ের মুখপানে স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলেন মনোয়ারা বেগম।

____________________

নাস্তা করে মাত্রই বসেছেন খালেদ মোশাররফ। ফাহমিদা বেগম টেবিল পরিষ্কার করছেন। উনার মুখোমুখি ফাহিম দাঁড়িয়ে বলল,

‘আমার পাঁচ হাজার টাকা?

খালেদ মোশাররফ ছেলের দিকে না তাকিয়ে বললেন,

‘তোর মায়ের কাছ থেকে পাঁচশো টাকা নিয়ে যা।’

পাঁচশো টাকার কথা শুনে মেজাজ তিরিক্ষি হয়ে গেলো ফাহিমের। রূঢ় গলায় বলল,

‘আমি পাঁচশো না পাঁচ হাজার টাকার কথা বলেছি।’

চোখ গরম করে তাকালেন খালেদ মোশাররফ।

‘কখনো গায়ে তুলিনি বলে ভাবিস না হাত তুলবো না।এখনো সময় আছে অসৎ সঙ্গ ত্যাগ কর।’

ফাহিম রাগে নিজের চুল গুলো টেনে হনহন করে কক্ষ থেকে প্রস্থান করলো। ছেলের যাওয়ার পানে তাকিয়ে তপ্ত শ্বাস ফেললেন তিনি।

ফাহিম মায়েের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে ক্রোধান্বিত গলায় বলল,

‘ভেবেই নিয়েছো, সবকিছু তোমার মেয়েকে দিয়ে যাব? বাবার জমিজমার লোভে বুঝি তোমার মেয়ে বিয়ে করছে না? এতো লোভ তোমার মেয়ের?’

কর্ণকুহরে প্রতিটা শব্দ পৌঁছানো মাত্রই সপাটে চড় বসিয়ে দিলেন ছেলের গালে ফাহমিদা বেগম। দিন দিন মাথায় চড়ে বসছে সে।

‘মেয়েটা আমার মানুষের কথার আ’ঘাতে গ্রামেই পা দেয় না। বাহিরের মানুষের কথা তো তাও সহ্য করা যায়। তুই মায়ের পেটের ভাই হয়ে কিভাবে বললি? তোর মুখের কথাগুলো শুনলে আমার মেয়ে ম’রে যাবে। কোলেপিঠে করে মানুষ করার পর যখন কেউ তিক্ত, মর্মভেদী কথা বলে তখন তো মনে হয় এর থেকে মৃ’ত্যুও শ্রেয়। তোকে পেটে ধরে আমি পাপ করেছিলাম।’

চড় দেওয়া গালে গালে হাত রেখে ভেতরে ভেতরে ফুঁসতে লাগলো ফাহিম। বিন্দু বিন্দু জলের ফোঁটার ন্যায় সকল রাগ, ক্ষোভ, ক্রোধ গিয়ে জমতে লাগলো নাযীফাহ’র উপর। যা সম্পর্কে সম্পূর্ণ অজ্ঞাত নাযীফাহ।

___________________

একটা ফাইল নিয়ে এসে তাহমিদের কেবিনের সামনে এসে দাঁড়িয়েছে নাযীফাহ। নক করবে কি করবে না ইতস্ত করতে লাগলো সে। তাহমিদের মুখোমুখি হলে তার বক্ষঃস্থলে ঝড়ের তান্ডব শুরু হয়। কেন জানি অসম্পূর্ণ স্বপ্নটা আবারও দেখতে ইচ্ছে করে। এক মন বলে, স্বপ্ন দেখে যা নাযীফাহ। তোর সেই অর্ধপূর্ণ অলীক কল্পনা বাস্তবে পাবে পরিপূর্ণতা। আরেকটা মন বলে, আবারও স্বপ্ন দেখে ভেঙে গুড়িয়ে যাস না। এইবার স্বপ্ন ভাঙলে একেবারে নিঃস্ব হয়ে যাবি। লোকটার বউ বাচ্চাও থাকতে পারে।

এসব আজেবাজে চিন্তা মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলে কয়েকটা নিঃশ্বাস ফেলে নিজেকে ধাতস্থ করলো সে। দরজায় টোকা দেওয়ার জন্য হাত বাড়াতেই তড়িৎ গতিতে দরজা খোলে তাহমিদ। তাহমিদ এতোটাই তাড়ার মধ্যে ছিলো তার বুকের সাথে,,

#চলবে

#দৃষ্টির_অলক্ষ্যে
#পর্বঃ০৩
#রূপন্তি_রাহমান (ছদ্মনাম)

তাহমিদ এতোটাই তাড়ার মধ্যে ছিলো যে দ্রুত কক্ষ থেকে বের হতে গিয়ে তার বুকের সাথে নাযীফাহ’র মাথার আকস্মিক অ’স্র বিহীন সং’ঘর্ষ হয়। শক্ত বলিষ্ঠ বুকের ধাক্কায় সে টাল সামলাতে না পেরে ছিটকে পড়ে মেঝেতে।বক্ষের ধাক্কায় নাকেও ব্যথা পেয়েছে নাযীফাহ আর কোমরেও ব্যথা পেয়েছে বেশ। কয়েকজন স্টাফ দ্রুত পায়ে এগিয়ে এলো তাদের কাছে। এতোগুলা মানুষের সামনে কোমরে হাত রাখতে গিয়েও রাখলো না সে। সমানে নাক ঢলতে লাগলো। আচমকা চোখের সামনে লোমশ পুরুষালি হাত দেখে চকিত হয় সে। অতঃপর যখন দেখলো মানুষ তাহমিদ সে শুকনো ঢুক গিলে।

‘কি হলো হাত ধরে উঠে আসুন। হারি আপ। আপনাদের সবাইকে নিয়ে ফ্যাক্টরীতে যাবো।’

চারপাশে একবার চোখ বুলিয়ে তাহমিদের হাত ধরে তাড়াতাড়ি উঠে গেলো সে। পিছন থেকে একজন বলল,

‘বেশি ব্যথা পেয়েছো?’

নাযীফাহ হেসে বলে, ‘তেমন একটা না।’

নাযীফাহ’র লাল হয়ে যাওয়া নাকে পাথরের নাকফুলটা জ্বলজ্বল করতে দেখে সেই দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো তাহমিদ।

‘স্যার আপনার গাড়ি আর বাকি স্টাফদের জন্য মাইক্রো চলে এসেছে নিচে।’

জুনিয়র তনয়ার কথা ধ্যান ভঙ্গ হয় তাহমিদের। এপাশ ওপাশ তাকায় সে। ষদুষ্ণ শ্বাস ফেলে বলল,

‘তুমি বাকি স্টাফদের দিয়ে নিচে যাও। আমি আসছি।’

তনয়া চলে যেতেই তাহমিদ নাযীফাহ’র দিকে তাকিয়ে শান্ত, সুস্থির স্বরে বলল,

‘আপনার বাবা মায়ের উচিত ছিলো ছোটবেলায় বেশি বেশি কমপ্ল্যান বা হরলিক্স খাওয়ানোর। বেশি বেশি করে শাকসবজি খাবেন তাহলে শরীরে বল হবে।তাহলে আর সামান্য শরীরের ছোঁয়ায় এভাবে মেঝেতে পড়বেন না। নিজেই নিজেকে কন্ট্রোল করতে পারবেন।’

বিস্ফোরিত, চমকিত নয়নে তাকিয়ে রইলো সে। এটা শরীরের সামান্য ছোঁয়া?

গাড়ির সামনে এসে বাঁধে বিপত্তি। মাইক্রো তে আর জায়গা নেই যে নাযীফাহ বসবে। যেহেতু পুরুষ আর সাথে মহিলা আছে সেক্ষেত্রে গাদাগাদি করে বসার প্রশ্নই আসে না। অসহায় হয়ে সে গাড়ির বাইরে দাঁড়িয়ে রইলো।

নাযীফাহকে গাড়ির বাইরে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে তাহমিদ তনয়াকে পাঠালো কি সমস্যা হয়েছে দেখার জন্য। তনয়া নাযীফাহ’র কাছে গিয়ে আবার দ্রুত পায়ে ফিরে এলো।

‘স্যার ওই গাড়িতে জায়গা নেই বসার। সেজন্য সে বাইরে দাঁড়িয়ে আছে। তাহমিদ কিছুক্ষন ভেবে বলল,

‘আচ্ছা ওই ড্রাইভার কে বলো গাড়ি স্টার্ট দিতে আর উনাকে বলো আমাদের গাড়িতে আসতে।’

‘কিন্তু স্যার?’

‘সমস্যা নেই আমি সামনে বসবো। আর তোমরা দু’জন পিছনের সিটে বসো তাহলেই হবে।

____________________________________________

‘তুই কিছু লুকাচ্ছিস আমাদের থেকে?’ মনোয়ারা বেগমের প্রশ্নের থতমত খেয়ে যায় তূবা।

‘শ্যামলী এলো না যে আজ?’

‘কথার মোড় ঘুরাবি না তূবা। যা প্রশ্ন করছি তার উত্তর দে।’

‘কি লুকাবো মা? লুকানোর কি আছে?’

হতাশা মিশ্রিত শ্বাস ফেলেন মনোয়ারা বেগম।

‘তোর বিবর্ন চেহেরা, নিস্তেজ গলার স্বর আর হালকা মুছে যাওয়া আ’ঘাতের চিহ্ন অনেক কিছুই বলে। চলে আয় না মা। আর করতে হবে না সংসার। তুই চলে এলে তোকে আমরা ফেলে দিবো না।’

‘অদৃশ্য বাঁধনে বাঁধা পড়েছি মা। সেই বাঁধন ছিন্ন করার শক্তি আমার নেই। আর সেই বাঁধন কে আরো মজবুত করেছে তোমার নাতনি।’

‘হা রে ফয়সালের কি কোথাও সম্পর্ক আছে?’

‘তেমন কিছু হলে বিশ্বাস করো মা তাও নিজের মনকে বুঝাতে পারতাম, যে হয়তো অন্য কাউকে ভালোবাসে তাই আমাকে মেনে নেয়নি। বিয়ের বছর খানিক ঠিক ছিলো। হুট করেই ও বদলে যেতে শুরু করলো। সেই রহস্যের কোনো কূলকিনারা করতে পারলাম না। কিসের জন্য ফয়সালের এমন আমূল পরিবর্তন?’

________________________

‘তোমার ছেলের এই উগ্র আচরণে কি করবে কিছু ভেবেছো? দিন দিন লাগামহীন হয়ে যাচ্ছে। কি বলছে না বলছে কিছুই মুখে আটকায় না।’

স্ত্রীর কথার পিঠে কোনো জবাব খুঁজে পেলেন না খালেদ মাহমুদ। তাকিয়ে রইলেন বাইরের কদম গাছটার দিকে। ছেলে মেয়ে দু’জনের চিন্তায় পাগলপ্রায় উনি।

‘গতকাল সন্ধ্যায় খায়ের ভাই বললেন ফাহিমকে নাকি উনি সি’গারেট খেতে দেখেছেন। এই কথাটা কয়েকমাস আগে বললেও আমি হয়তো বিশ্বাস করতাম না। আজ বিশ্বাস করতে হচ্ছে। কিসের কমতি দিয়েছি ফাহমিদা আমি?’

ছেলের সিগারেট খাওয়ার কথা শুনে চকিত হলেন ফাহমিদা বেগম। তাহলে কি উনার ছেলে পুরোপুরি ন’ষ্ট হয়ে গিয়েছে? অজানা আতঙ্কে উনার বুকের ভেতরটা মোচড় দিয়ে উঠলো।

‘তুমি কিছু জিজ্ঞেস করবে না ছেলেকে?’

‘আমার নিজেকে একটু ঠান্ডা মাথায় ভাবতে দাও। ছেলের সাথে রাগারাগি করলে কোনো ফয়দা হবে না। উল্টো হিতে বিপরীত হবে। দেখা যাবে ফাহিম উল্টো পাল্টা সিদ্ধান্ত নিয়ে বসে আছে।’

___________________________

এয়ারপোর্ট এরিয়ায় আসা মাত্রই জ্যামে ফেঁসেছে নাযীফাহদের গাড়ি। প্রচন্ড গরমে পাগলপ্রায় অবস্থা। ঘেমে নেয়ে একাকার একেকজন। সূর্যের তাপমাত্রাও গায়ে বিঁধছে তীর্যক ভাবে। ঘন্টা দেড়েক অপেক্ষার পরে জ্যাম ছাড়াতে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল সবাই। সামনের লুকিং গ্লাস দিয়ে একটু পর পর নাযীফাহ কে আড়চোখে দেখছে তাহমিদ। নাযীফাহ খেয়াল না করলেও ব্যপারটা চোখে বিঁধেছে তনয়ার। সূঁচালো দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো সেই দিকে।

ফ্যাক্টরীতে পৌঁছানো মাত্রই তাহমিদ সবাইকে বলল,

‘এটা আমাদের সবচেয়ে বড় ফ্যাক্টরী। বাকি দুইটাতেও নিয়ে যাবো। আপনারা এখন ফ্যাক্টরীর সকল কিছু অফিস থেকে দেওয়া নোটবুকে লিখবেন। যাবতীয় কিছু পাই পাই করে লিখতে হবে। দেখা যাক কার চোখে কতটা ত্রুটি ধরা পড়ে। পাশাপাশি এটাও দেখতে হবে প্রতি ঘন্টায় এখান থেকে ঠিক কত প্রোডাকশন হচ্ছে। আমরা তিনটা ফ্যাক্টরীর গড় হিসাব করবো।’

যে যার কাজে লেগে পড়লো সবাই। তাহমিদও সব ঘুরে ঘুরে দেখতে লাগলো। নাযীফাহ এদিক ওদিক ঘুরে নজর বুলাতে লাগলো। একশো প্রডাক্টে কত ক্ষতি হওয়া সম্ভবনা থাকে, প্রতি ষাট মিনিটে কত পন্য আসছে সবকিছু লিখতে লাগলো। তিন ঘন্টা অতিক্রম হওয়ার পর তাহমিদ সবাইকে আবার জড়ো করলো।

‘আমরা এখনি অফিসের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে যাবো। আশা করি সবাই সবকিছু নোট করেছেন। কাল আমরা আমাদের দ্বিতীয় ফ্যাক্টরীতে যাবো। কাল আর অফিস যেতে হবে না।সকাল নয়টায় তিন রাস্তার মোড়ে দাঁড়াবেন।সেখান থেকে মাইক্রো আপনাদের সবাইকে পিক করবে। তাহলে আমরা বেশি সময় পাবো পর্যবেক্ষণ করার।’

_______________________

ক্লান্ত, পরিশ্রান্ত দেহটাকে নিয়ে বাসায় প্রবেশ করতেই ফারিয়া মামা বলে জোরে ডেকে কোলে চড়লো তাহমিদের।

‘ফারিয়া, মামা মাত্রই অফিস থেকে ফিরেছে। খুব টায়ার্ড সে। এখন কোল থেকে নামো।’ ভারী কন্ঠস্বর তূবার।

বোনের মুখের দিকে তাকিয়ে শুকনো হাসলো তাহমিদ। মলিন হাসা বাদে তার আর উপায় নেই। বোনকে কিছু বললেও শুনবে না।

‘মামাই, তুমি আমার সাথে আসো। মামা তোমার জন্য রুমে অনেক গুলো চকলেট রেখেছি।’

রুমে গিয়ে ফারিয়ার হাতে ক্যাটবেরি সিল্কের একটা প্যাকেট দিয়ে কপালে চুমু দিয়ে জিজ্ঞেস করলো,

‘মায়ের কপালে কা’টা দাগ কিসের?’

ফারিয়া একটা বাইট দিয়ে বলল,

‘কালকে বাবাই আম্মুকে বকেছে। আম্মুর গালে চড়ও দিয়েছে। তারপর আম্মুকে ধাক্কা দিয়েছে। সোফায় লেগে আম্মুর কপাল কে’টে গিয়েছে।’

‘দাদুর কোথায় ছিলো?’

‘বাবাই দাদুনের কথা শুনেনা।’

‘ফুপিমণি কোথায়?’

‘ফুপিমনি তো আঙ্কেলদের বাড়িতে।’

দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে উঠে দাঁড়ায় সে। ফারিয়া কে খাটে বসিয়ে ফ্রেশ হয়ে আসে। অতঃপর ফারিয়াকে কোলে নিয়ে বোনের কাছে গেলো সে।

‘আর কত সহ্য করবি তূবা? একটা মানুষ আর কত সহ্য করতে পারে?’

হাত থেমে গেলো তূবার। ভাইয়ের জন্য প্লেটে খাবার নিচ্ছিলো সে। এদিক ওদিক তাকায় মায়ের অস্তিত্ব বুঝার জন্য। আশেপাশে মাকে না দেখে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে সে।

‘পেট থেকে কথা আদায় করে নিয়েছিস?’

‘পেট থেকে কথা বের করতে হয় না। তোর কপালের কা’টা দাগ, চোখের নিচে কালি আর জরাজীর্ণ শরীর দেখলে যে কেউ বুঝে যাবে। কার জন্য পড়ে আছিস? যার তোর জন্য বিন্দুমাত্র মায়া বা ভালোবাসা নেই, তার জন্য?’

তূবা নিস্তেজ আর নীরস গলায় বলল,

‘অসংখ্য কষ্ট, যন্ত্রণা পেয়েও মেয়েরা মায়ার টানে একটা ভালোবাসা, একটা সম্পর্ক, একটা সংসার টিকিয়ে রাখতে চায়।এজন্যই মেয়েরা মায়াবতী। আর মায়াবতীর কোন পুরুষবাচক শব্দ নেই।

– হুমায়ুন আহমেদ’

‘তূবা এসব উপন্যাসের পাতায় মানায় বাস্তব জীবনে না।৷ বেঁচে থাকতে হলে একজন মানুষ দরকার, একটা সাপোর্ট দরকার, একটা ঢাল দরকার যে কিনা বিপদ আপদে ছায়া দিবে।খারাপ সময়ে সান্ত্বনা দিবে। ফয়সাল ভাই তো তোকে ভালোই বাসে না।’

তাহমিদের দিকে তীক্ষ্ণধার দৃষ্টিতে তাকিয়ে তূবা বলল,

‘তোকে ফয়সাল বলেছে সে আমায় ভালোবাসে না? স্ত্রী তো আমি তাই না? শুন ভাই, ‘স্ত্রীকে চিনা যায় স্বামীর দরিদ্রতায়। আর স্বামীকে চিনা যায় স্ত্রীর অসুস্থতায়।’ আমি যখন অসুস্থ হই ফয়সাল প্রকাশ না করলেও আমি ওর চক্ষুদ্বয়ে উৎকন্ঠা দেখতে পাই। হারানোর ভয় দেখতে পাই।’

‘আবার নিজেই তোর শরীরে আ’ঘাত করে অদ্ভুত না ব্যপারটা? শুন তূবা ভাইবোনের টান থাকা স্বাভাবিক। কিন্তু তোর আর আমার একসাথে থাকা সেই জন্মলগ্ন থেকে। একসাথে একই উদরে আমরা ছিলাম। তোর নির্জীব মুখ দেখলে আমার একটা কথাই মনে হয় বাবা বেঁচে থাকলে কখনো এমনটা হতে দিতেন না। তোকে সেখান থেকে নিয়ে আসতেন আরো আগে। তোর সকল যাতনা, ক্লেশ, শুকিয়ে যাওয়া আ’ঘাতের চিহ্ন তোর থেকেও বেশি পীড়া আমাকে দেয়। সব ছেড়ে ছুড়ে চলে আয় তুই।’

তূবা নীরস গলায় জবাব দিলো,

‘চাইলেই ছেড়ে আসা যায় না। মায়া কাজ করে। ভালোবাসার জন্ম নেয়।ভালোবাসা নামক সেই অদৃশ্য বাঁধন ছিন্ন করা যায় না। আর ছেড়ে আসলেই এই সমাজ আমাকে বাঁ’চতে দিবে না। কটু কথা দিয়ে তিলে তিলে আমাকে শে’ষ করে দিবে। আর আমার মেয়েটা? ও ছন্নছাড়া হয়ে যাবে। আমার মেয়ের ভবিষ্যত নষ্ট হয়ে যাবে। কিছু কিছু সময় মা বাবা সন্তানের মঙ্গল কামনার জন্যও অনেক কিছু চেপে যায়।’

‘তোর বান্ধবী কই যে বাবার হাত পায়ে ধরে তার ভাইয়ের বউ করেছিল?’ ধারালো গলায় তাহমিদের প্রশ্ন।

নিরুত্তর, নিসাড়া হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো তূবা। বোনের কাছ থেকে কোনো উত্তর না পেয়ে ফারিয়া কে কোল থেকে নামিয়ে হনহন করে নিজের রুমের দিকে পা বাড়াতেই তূবা বলল,

‘ভাত বাড়লাম তো খাবি না?’

স্থান ত্যাগ করতে করতে তাহমিদের উত্তর,

‘বোনের শরীরের আ’ঘাতের চিহ্ন চোখে পড়তেই পেট ভরে গেছে। সহ্যের সীমা যেদিন অতিক্রম করবে সে আমি মনে রাখবো না আমি কাউকে কোনো কথা দিয়েছি।’

______________________

নিজের রুমের দরজা আটকে জানালা খুলে দাঁড়িয়ে আছে তাহমিদ। শীতল হাওয়া গায়ে এসে আছড়ে পড়ছে। হাত ভাঁজ করে জীবনের হিসাব মিলাতে ব্যস্ত সে।

‘পুরুষ নারীর প্রেমে পড়ে, খোলা চুলের মাতাল করা ঘ্রানে, কাজল কালো হরিণী চোখের, টুল পড়া গালের নয়তো বাঁকা দাঁতের হাসির। আমি যে দীর্ঘদিন পরে আবারও একই মানবীর প্রেমে পড়লাম। তার নাকে জ্বলজ্বল করতে থাকা নাকফুলের, তার ভীতিগ্রস্ত চেহারার। হয়তো তার প্রেমে পড়া আমার বারণ।হয়তো রোজ নতুন করে তার প্রেমে পড়ে তার স্বামী। হয়তো নিষিদ্ধ তার শহরে আমার সকল প্রণয়ের আগমন। হয়তো,,,,।’

তড়িঘড়ি কাকে যেন ফোন করে তাহমিদ।

‘শফিক ভাই, আমার আন্ডারে যাদেরকে দেওয়া হইছে তাদের সবাইর বায়োডাটা গুলো আমার ইমেইলে দিবেন প্লিজ? নতুন প্রডাকশনের কাজে এতোটাই ব্যস্ত ছিলাম সেভাবে খেয়াল করিনি। সিলেকশনের জন্য সবার এডুকেশন কোয়ালিফিকেশন টাও দেখে নিতে চাই।’

ওপাশে কি বলল শোনা গেলো না। কিন্তু তাহমিদ বলল,

‘আচ্ছা ভাই সমস্যা নেই। আপনি ফ্রী হয়ে দিয়েন আমাকে।’

রাতে ঘুমানোর আগে ইমেইল চেক দিলো তাহমিদ। একেবারে শেষে নাযীফাহ’র নাম। ম্যারিটাল স্ট্যাটাসের পাশে লিখা আনম্যারিড। ঔষ্ঠদ্বয় প্রসারিত হলো তাহমিদের। বিড়বিড় করে বলল,

‘তাহার শহরে আমার আগমন নিষিদ্ধ না।প্রণয়ের ঝড় তোলার সুযোগ এখনো আছে। নিঃসঙ্গতার চাদর ফেলে এবার সঙ্গীর হাতে হাত রাখার সময় হয়েছে।’

____________________

তুলনামূলক সবার আগে এসেই তিন রাস্তার মোড়ে দাঁড়িয়ে আছে নাযীফাহ। এখনো কেউ আসেনি। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে খেয়াল করলো আটটা পয়তাল্লিশ বাজে।

‘পাঁচটা বছর তো কম সময় না। বিয়ে কেন করলেন না আপনি?’

পুরুষালি কন্ঠে এমন প্রশ্ন শুনে থমকে গেলো নাযীফাহ। ঘাড় ঘুরিয়ে,,,

#চলবে

বানান ভুল ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন।