দৃষ্টির অলক্ষ্যে পর্ব-৪+৫

0
353

#দৃষ্টির_অলক্ষ্যে
#পর্বঃ০৪
#রূপন্তি_রাহমান (ছদ্মনাম)

ঘাড় ঘুরিয়ে তাহমিদকে দেখে ঠিকরে গেলো নাযীফাহ। তাহমিদের কথা ঠিক হজম করতে পারছে না সে। একে তো চিনতে পেরেছে আরেক তো পাঁচ বছর আগে তো কারন জেনেই বিয়ে ভেঙেছিল, তাহলে? দুজনের চোখে চোখ পড়তেই দৃষ্টি নত করে ফেলে সে। দুরত্ব বজায় রেখে তাহমিদ হাত ভাঁজ করে দাঁড়ালো। নাযীফাহ কে নিশ্চুপ দেখে তাহমিদ ভ্রু উঁচিয়ে পুনশ্চ প্রশ্ন করলো,

‘উত্তর দিলেন না, মিস নাযীফাহ?’

এইবার নিষ্প্রাণ, শুকনো হাসলো নাযীফাহ।

‘অভাগীদের কপালে বিয়ে থাকে নাকি? অভাগীরা বেঁচে থাকে সারাজীবন মানুষের কটু কথা শোনার। বেঁচে থেকে হাজার বার ম’রে তারা। এরা প্রতিনিয়ত তিলে তিলে শেষ হয়।’

তাহমিদ জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো নাযীফাহ’র দিকে।

‘ঠিক বুঝলাম না।’

‘কিছু না স্যার।’

‘আমার উত্তরটা কিন্তু ঠিক পেলাম না।’

‘উত্তরটা সম্পর্কে আপনারা অবগত। কারণ জেনেই তো আপনারা,,,।’

তাহমিদ অসহায় গলায় বলল,

‘আমি সত্যিই জানি না। মা কেন বিয়ে ভেঙেছে। আমি এতো বলার পরও মা কে আটকাতে পারিনি।’

নাযীফাহ ধীরূজ গলায় মলিন হেসে বলে,

‘পুরোনো কথা বাদ দিন স্যার। এসব উঠলে আপনিও অস্বস্তিতে পড়বেন আর আমিও। যা ঘটে যায় তাই অতীত। আর অতীত নিয়ে ঘাটাঘাটি না করাই ভালো। পুরোনো ক্ষ’তগুলো তাজা হয়ে উঠে।’

‘স্যার কখন এলেন?’ তনয়ার প্রশ্নে চমকে উঠে তাহমিদ। নাযীফাহ’র চোখেমুখে ভয় দেখা দেয়।তাহমিদ ফিরতি প্রশ্ন করে,

‘তুমি কখন এলে?’

‘এইতো স্যার এখনই এলাম। বাকিরা আসেনি?’

স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে নাযীফাহ। তারমানে কিছুই সে শুনেনি।

‘না আসেনি।হয়তো এখনই চলে আসবে।’

____________________

‘এমনটা করার কি খুব দরকার?’

দরজার কাছে দাঁড়িয়ে থাকা যুবকের প্রশ্নে বাঁকা হেসে তাকায় এপাশের মানুষ টা।

‘দরকার আছে বলেই তো করি। আমি পৈশাচিক আনন্দ পাই। শান্তি লাগে আমার খুব শান্তি।’

‘একটা সুখের সংসার তুমি একটু একটু করে শেষ করে দিচ্ছ। বাচ্চা ছেলেটার ভবিষ্যত ন’ষ্ট করছো। আর নাযীফাহ কে তুমি অর্ধেক মে’রেই ফেলেছো। এবার তো বন্ধ করো।’

‘আমি যতদিন বেঁচে থাকি বন্ধ হবে না। সে সুখে সংসার করবে আর আমি বসে বসে দেখবো তা তো হবে না। আজ এই সুখের সংসার আমার হওয়ার কথা ছিলো। আমার যেহেতু হয়নি তাই আমিও সংসার করতে দিবো না।’

‘আল্লাহ সইবে না।এসবের ফল তুমি পাবে।’

‘পাচ্ছিই তো, আমি ফল পাচ্ছি। ওদের হাসিখুশি দেখলে আমার কষ্ট হয়। আমিও ভালোবেসেছি। এতো বার করে নিজের আবেগ প্রকাশ করেছি। কই গ্রহণ তো করলো না। অনেক করেছে সুখের সংসার এবার একটু দুঃখের সাগরে ভাসুক।’

‘হয়তো তোমার নিয়তি তে ছিলো না। তাই তোমার সাথে তার বিয়ে হয়নি। তাই বলে তুমি তোমার সেই ভালোবাসাকে ঘৃনা আর রাগে পরিনত করবে। আর নাযীফাহ তো তোমাকে তার,,,,,।

‘মনে করা আর জেনেটিক্যালি হওয়া এক কথা না।’

‘তাই তুমি তার সদ্ব্যবহার করছো।’

কুটিল হাসলো মানুষটা।

‘ওই পরিবারের সবাইকে অপদস্ত হতে দেখলে আমার বেশ লাগে। গত পাঁচটা বছর ধরে আমি শান্তিতে ঘুমাই। বিশ্বাস কর বাবা আমি এর আগে ঘুমাতে পারতাম না। প্রত্যাক্ষান করার কথা মনে হয়ে যেতো। সে বুঝুক স্বপ্ন ভেসে গেলে কেমন লাগে।’

দীর্ঘশ্বাস ফেলে যুবক। এই দীর্ঘশ্বাসে মিশে আছে আক্ষেপ, অনুশোচনা আর অনুতাপ। তার নিজের উপর খুব রাগ হয়। সবকিছু জেনেও তাকে চুপচাপ থাকতে হয়। সেও বাঁধা তার কিছুই করার নেই। তার মা যে মৃ’ত্যুর মুখে। মুখ খুললেই এপাশের মানুষ তার মাকে দৃষ্টির অলক্ষ্যে শে’ষ করে দিবে। বড় নিখুঁত তার অভিনয়। সে সুচ হয়ে ঢুকে আর ফাঁড় হয়ে বের হয়। এই মানুষটার রোষানল, ক্রোধ থেকে বাঁচতে নিজের ভালোবাসাকেও জলাঞ্জলি দিয়েছে সে। তারপরও তার ভালোবাসাকে এই মানুষের ক্রোধ থেকে বাঁ’চাতে পারলো না।

____________________

‘ফয়সাল, তুমি কি বিজি?’

ফাইলের পাতা উল্টাতে উল্টাতে ফয়সাল জবাব দিলো,

‘অফিসে আছি। বিজি তো থাকবোই।’

তূবা আমতা আমতা করে বলল,

‘আসলে ফারিয়া সন্ধ্যার দিকে বাসার বাইরে যেতে চাইছে। মানে ফাস্টফুড খাবে। সেজন্য তোমাকে বলতে ফোন দিয়েছিলাম।’

ফয়সাল ব্যস্তভঙ্গিতে বলল,

‘তো যাও এতে বলার কি আছে।’

তূবা ‘আচ্ছা’ বলে ফোন কে’টে দিলো। ড্রয়িং রুমে এসে দেখলো শ্যামলী নিজের বাসায় ফেরার প্রস্তুতি নিচ্ছে।

‘তোর কি কাজ করার ইচ্ছে আছে নাকি নাই?’

কোমরে উড়না গুঁজে শ্যামলীর উত্তর,

‘ক্যান আপা কি অইছে?’

রাগী গলায় তূবা বলল,

‘তোকে রাখা হয়েছে মায়ের সাহায্যের জন্য তার বয়স হয়েছে। কিছুই সে আগের মতো করতে পারে না। অবসর সময়ে মায়ের সাথে গল্প করবি সময় কাটাবি। আর তুই দুই দিন পরপর ফাঁকি দিস কাজে। এমন করলে তোকে বাদ দিয়ে দিবে।’

মাথা নত করে ফেলে শ্যামলী।

‘ওই বাসা থেকে মাটন বিরিয়ানি রান্না করে এনেছিলাম। তোর জন্যও এক বক্স রেখেছি। যাওয়ার সময় ফ্রিজ থেকে নিয়ে যাস।’

নত মস্তকে সম্মতিতে মাথা নাড়ে শ্যামলী।

পশ্চিম আকাশে অস্তগামী সূর্য। দিনের ঔজ্জ্বল্যতা ধীরে ধীরে কমে আসছে। পুরো আকাশ জুড়ে লালিমা। ফারিয়া কে রেডি করিয়ে তূবা মায়ের কাছে এলো।

‘চলো না মা একসাথে বের হই। তুমি তো সারাদিন বাসায় থাকো বাইরে হাঁটাহাঁটি করলে ভালো লাগবে।’

ফারিয়া ঝুটি করা চুলগুলো নাড়িয়ে বলল,

‘চল না নানু।’

মনোয়ারা বেগম আদরের সহিত নাতনির গাল টানলেন।

‘না, নানু তোমরাই যাও।নানুর শরীর ভালো লাগছে না।’

তারপর তূবার দিকে তাকিয়ে বললেন,

‘বাইরে গিয়ে হাঁটাহাঁটি করলে হাঁটুর ব্যথা বাড়বে। তাছাড়া আর একটু পরে তাহমিদ চলে আসবে।’

‘ওকে বলবো আমাদের সাথে জয়েন করতে। একেবারে ডিনার করে ফিরবো।’

‘আরে ছেলেটা ক্লান্ত থাকবে।দরকার নেই এসব করার। তোরাই বরং যা।’

সন্ধ্যার টিমটিমে আলো। বিশাল অন্তরীক্ষে বড় থালার ন্যায় চন্দ্রিমা উঁকি দিয়েছে। সে একটু একটু করে তার উজ্জ্বল দীপ্তি ছড়াচ্ছে চতুর্দিকে। তার আশেপাশে ঘিরে থাকা অসংখ্য তারকা মিটমিট করে জ্বলছে। সোডিয়ামের হলদেটে আলো জ্বলে উঠলো। যার দরুন এখন সবকিছু পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে। যে যার মতো হেঁটে চলেছে ব্যস্ত রাস্তায়। ছোট্ট ফারিয়া তিরিং বিরিং করে মায়ের মায়ের বা হাতের কনিষ্ঠ আঙুল ধরে হাঁটছে। অঙ্গজার এমন দুষ্টুমি উপভোগ করছে তূবা। রেস্টুরেন্টে মা মেয়ে বসেই তূবা মেয়েকে প্রশ্ন করলো,

‘কি খাবে মা? পিৎজা অর্ডার করি? নাকি চিকেন ললিপপ?’

ফারিয়া একটু ভাবার ভঙ্গিতে বলল,

‘দু’টোই।’

তূবা চোখ গরম করে বলল,

‘উহু, যেকোনো একটা খেতে হবে। একদিনে দু’টো খাওয়া যাবে না। অসুস্থ হয়ে যাবে।’

ফারিয়া ঠোঁট উল্টে মায়ের দিকে তাকিয়ে রইলো।

‘আরে তূবা যে। কতদিন পর দেখা।’

কোনো পুরুষের মুখে নিজের নাম শুনে চমকে যায় তূবা। মেয়ের থেকে দৃষ্টি সরিয়ে ঘাড় কাত করে তাকায় বা দিকে।

‘আরে মিলন ভাই, কেমন আছেন?’

‘আলহামদুলিল্লাহ, মেয়ে নিয়ে খেতে এসেছো? তা হাসবেন্ড কোথায়?’

‘হাসবেন্ড অফিসে। মেয়ের বায়না মিটাতে আসলাম।’

‘ক্যান আই জয়েন উইথ ইউ?’

‘ইয়াহ সিউর।’

‘স্বামীর বাড়িতেই বেশি থাকো মনে হচ্ছে? এইদিকে তো আর আসো না।’

‘তেমন কিছু না ভাই, আসলে মেয়ে বড় হচ্ছে, শ্বাশুড়ি অসুস্থ, মেয়ের বাবা প্রমোশন হয়েছে আগের থেকেও ব্যস্ত। সারাদিনের ক্লান্তি শেষে তার পাশে থাকতে হয়। তাই আর কি। তবে আমি দুইদিনের জন্য এই বাড়িতে এসেছি।’

‘আগে তো আসলে মায়ের সাথে দেখা করে যেতে।’

‘মায়ের শরীর টা বেশি ভালো না মিলন ভাই। সেজন্য এসেছি। তাই আর যাওয়া হয়নি। মায়ের কাছে কাছে থাকছি।’

তূবাদের প্রতিবেশী মিলন। বেশ কিছুক্ষন কথা বলার পর ওয়েটার এসে পিৎজা দিয়ে গেলো। মিলনের সাথে কথা বলছে আর মেয়েকে খাইয়ে দিচ্ছে তূবা। হয়তো সে জানে না তার জন্য নীরব ঝড় অপেক্ষা করছে।

______________________________

নিবন্ত, অবসাদগ্রস্ত শরীরটাকে নিয়ে সোফায় বসে পড়ল তাহমিদ। আজ ক্লান্তির পরিমানটা একটু বেশি। রাস্তার জ্যাম মানুষকে আরো তিক্ত করে তুলে। কিয়ৎকাল চোখ বুঁজে রইল তাহমিদ। মায়ের ডাকে আঁখি পল্লব উন্মুক্ত করে তাকায় সে। এক গ্লাস লেবুর শরবত হাতে দাঁড়িয়ে আছেন মনোয়ারা বেগম। মায়ের হাত থেকে গ্লাসটা নিয়ে এক চুমুকে শেষ করে শরবত টা। পরিশ্রান্ত, খিন্ন গলায় জিজ্ঞেস করে,

‘তোমার মেয়ে আর নাতনি কোথায়?’

ছেলের হাত থেকে খালি গ্লাসটা নিয়ে বললেন,

‘নাতনির আবদার মিটাতে মেয়ে তাকে নিয়ে বের হয়েছে।’

সোজা হয়ে বসে তাহমিদ। মনোয়ারা বেগম খালি গ্লাসটা নিয়ে রান্নাঘরের দিকে পা বাড়াতেই ছেলের কথা শুনে পা চলা থেমে যায় মনোয়ারা বেগমের।

‘আমি বিয়ে করলে খুব খুশি হবে মা?’

ছেলের মুখে বিয়ের কথা শুনে চক্ষুদ্বয় চকচক করে উঠলো মনোয়ারা বেগমের। উৎফুল্ল চোখ ছেলের দিকে নেত্রপাত করলেন উনি।

‘সত্যি বলছিস, বাবা তুই বিয়ে করবি? তুই যাকে বিয়ে করে আনবি আমি তাকেই মেনে নিবো।’

মায়ের দিকে তাকিয়ে মলিন হাসলো।

‘ভেবে বলছো তো? যাকে বিয়ে করবো তাকেই মেনে নিবে?’

দু’পা ছেলের দিকে এগিয়ে এসে দাঁড়ালেন তিনি।

‘আমি শুধু চাই তুই জীবন শুরু কর আর কিছু না।’

‘আমি তোমার কাছে কিছু কথা জানতে চাই মা।’

ছেলের দিকে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকলেন উনি।

‘পাঁচ বছর আগে কেন বিয়েটা ভেঙে দিয়েছিলে মা?’

মলিন হয়ে এলো মনোয়ারা বেগমের চেহারা।

‘ আমার মেয়েটা যেমন মানসিক অশান্তিতে থাকে ছেলেটা সেভাবে যেন মানসিক অশান্তিতে না থাকে তাই।’

‘কিসের জন্য মনে হয়েছিল মা আমি ওই মেয়েকে বিয়ে করলে মানসিক অশান্তিতে থাকবো? এই পাঁচ বছরে অনেকবার জিজ্ঞেস করেছি মা। একবারও তুমি উত্তর দাওনি। আজ আমি জানতে চাই মা কেন করেছিলে মা এমনটা? একটা মেয়েকে পূর্ণ একটা সংসারের স্বপ্ন দেখিয়ে মাঝপথে কেন বাঁধা হয়ে দাঁড়ালে? একটা পরিবারের সম্মানে কেন আ’ঘাত করলে? সবচেয়ে বড়কথা তোমার ছেলে ওই মেয়েটাকে মন থেকে চাইতো। আজ তুমি সব প্রশ্নের জবাব দিবে মা। আমার জানা খুব দরকার মা।’

আজ মনোয়ারা বেগম এতটুকু বুঝেছেন নাছোড়বান্দা তাহমিদ উনার পেট থেকে কথা বের করেই ছাড়বে। একটা মেয়ের ব্যক্তিগত বিষয় নিয়ে কখনো ছেলের সাথে আলোচনা করতে চাননি উনি। তাই কখনো প্রশ্নের উত্তর গুলো দিতেন না। লম্বা একটা শ্বাস ফেলে বললেন,

‘ওই মেয়েটার অন্য জায়গায় সম্পর্ক ছিলো। শুধু এতোটুকুতে সীমাবদ্ধ থাকলে হয়তো আমি বিয়েতে বাঁধা দিতাম না। মেয়েটার তার প্রেমিকের সাথে শারীরিক সম্পর্ক ও তৈরি হয়েছিল।’

মায়ের মুখ নিঃসৃত প্রত্যেকটা বাক্য শ্রবণেন্দ্রিয় হতেই বিস্ফোরিত চোখে তাকায় তাহমিদ তার মায়ের দিকে । তৎক্ষনাৎ সে বসা থেকে উঠে দাঁড়ায়। চোখ জোড়ায় তার এক আকাশ সমান বিস্ময়। একটা বাক্যও সে হজম করতে পারছে না। মেয়েটার যদি সম্পর্ক থাকে তাহলে পাঁচ বছর পরেও কেন সে অবিবাহিত? কেন বলল তার মতো অভাগীদের বিয়ে হয়না? হিসেব মিলছে না কিছুতেই।

#চলবে

বানান ভুল ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন।

#দৃষ্টির_অলক্ষ্যে
#পর্বঃ০৫
#রূপন্তি_রাহমান (ছদ্মনাম)

কেমন অস্থির লাগছে তাহমিদের। কাতর গলায় মাকে বলল,

‘তুমি নিশ্চিত মা?’

তিনি মেঘমেদুর কন্ঠে বললেন,

‘হুম আমি নিশ্চিত। তার প্রেমিক আমাকে প্রমাণ পাঠিয়েছিল। সেজন্য আমি শেষ মুহূর্তে গিয়ে বিয়েটা ভেঙে দিয়েছি। আমি যে বিয়েটা ভেঙেছি হয়তো সবাই সাময়িক কষ্ট পেয়েছে। কিন্তু বিয়েটা হয়ে গেলে দুই পরিবারের কেউ ভালো থাকতো না।বিশেষ করে তুই। চরমভাবে নিজের জীবনসঙ্গিনীর কাছ থেকে প্রতারণার স্বীকার হতি। তূবাটা যেমন স্বামীর অবহেলায় ধীরে ধীরে শেষ হয়ে যাচ্ছে তুইও নিজের স্ত্রীর অবহেলায় একেবারে শেষ হয়ে যেতি। মা হয়ে দুই সন্তানের একরকম করুণ পরিণতি কেমনে হতে দেই? সেজন্য সবকিছু শুরু হওয়ার আগেই সমাপ্তি টেনেছি। তবে এটা ভাবিনি আমার ছেলে যে নিজেকে গুটিয়ে নিবে।’

হাত দিয়ে কপাল ঘঁষতে লাগলো তাহমিদ।

‘কিন্তু তেমনটা তো কিছুই হলো না, মা। সবকিছু তো সেই আগের মতোই আছে।’

তাহমিদের কথার অর্থোদ্ধার করতে পারলেন না মনোয়ারা বেগম। ছেলেকে প্রশ্ন করলেন,

‘তোর কথা বুঝলাম না।’

শান্ত স্বরে তাহমিদ তার মাকে বলল,

‘দেখো মা, তোমার ভাষ্যমতে ওই মেয়ের কারো সাথে ফিজিক্যাল রিলেশন ছিলো। এবং যার সাথে ছিলো সে তোমাকে প্রমাণ দিয়েছে। তাহলে তো ওই মেয়ের এতোদিনে বিয়ে থা হয়ে বাচ্চাও হওয়ার কথা। কিন্তু সেই মেয়ে পাঁচ বছর পরেও অবিবাহিত কেন?’

মনোয়ারা বেগম কপাল কুঁজিত করে বললেন,

‘তুই সেই মেয়ের দেখা পেলি কই? আর জানলিই বা কি করে সেই মেয়ে অবিবাহিত?’

তপ্ত শ্বাস ফেলে তাহমিদ বলল,

‘কয়েকদিন আগে সে আমাদের অফিসে জয়েন করেছে। আর তার ট্রেইনড অফিসার আমি। আচ্ছা মা ব্যপারটা তোমার গড়মিল লাগছে না?’

‘হয়তো সেই ছেলে ধোঁকা দিয়েছে।’

‘আমার কিন্তু তা মনে হচ্ছে না। একটু খোলে বলবে কি হয়েছিল পাঁচ বছর আগে?’

‘কি আর হবে।পাঁচ বছর আগের তোদের বিয়ের সকল কেনাকাটা শেষ করে যখন বাড়ি ফিরলাম টাকার হিসেব মিলাতে যখন হাত ব্যাগে হাত দেই আমার হাতে একটা খাম আসে।’

বলে চুপ হয়ে গেলেন মনোয়ারা বেগম।

তাহমিদ প্রশ্ন করলো,

‘ কি ছিলো খামে?’

মনোয়ারা বেগম নিশ্চুপ রইলেন। কিভাবে বলবেন ছেলের সামনে এসব কথা? তাহমিদ পুনশ্চ বলল,

‘কি ছিলো খামে বলো না? বিষয় টা না জানলে আমি মানসিক শান্তি পাবো না।’

উনি দৃষ্টি নত করে বললেন,

‘দু’জনের অন্তরঙ্গ মুহূর্তের ছবি। ছেলেটার পিঠ দেখা যাচ্ছিলো আর সেই মেয়ের,,,।’

মায়ের অসম্পূর্ণ কথায় যা বোঝার বুঝে নিলো তাহমিদ। ফিরতি কোনো প্রশ্ন করলো না। মনোয়ারা পুনরায় বললেন,

‘ ছেলেটা হয়তো ভীড়ের সুযোগে আমার ব্যাগে ওটা রেখেছিল। ওখানে একটা ছোট্ট চিরকুটও ছিলো। তাতে লেখা ছিলো, ‘আমরা দুজন দুজনকে পছন্দ করি এবং ভালোবাসি। একটা দম্পত্তির যেমন সম্পর্ক থাকে আমাদের মাঝেও তেমন সম্পর্ক বিদ্যমান। আশা করি আমাদের দুজনের মাঝে বাঁধা হয়ে দাঁড়াবেন না। এগুলো যদি বিশ্বাস না হয় আমি আপনাকে আরো ছবি পাঠাবো।’

মনোয়ারা বেগম কিছু মনের করার ভঙ্গিতে বললেন,

‘ওখানে আরো কিছু লিখা ছিলো। আপাতত মনে পড়ছে না।’

তাহমিদ মিইয়ে যাওয়া গলায় বলল,

‘মা সেই ছবি গুলো কি আছে? দেখাতে পারবে একবার?’

মনোয়ারা বেগম ছেলের কথা শুনে বললেন,

‘এসব ছবি দেখা লাগবে না। একটা মেয়ের সম্মান সেখানে জড়িয়ে। আমি তোদের সেই শিক্ষা দেইনি। যা গেছে তো গেছে। আর ছবিগুলো আমি পুড়িয়ে ফেলেছি।’

_________________________

সবকিছু গোছগাছ করে মাত্রই অফিস থেকে বেরিয়েছে ফয়সাল। শরীর টা বড্ড ক্লান্ত তার। দু’টো দিন বউ আর মেয়েকে দেখে না শরীরের ক্লান্তি যেন কাটেই না। বাসায় যাওয়ার সাথে সাথে মেয়ের বাবাই ডাকটা শুনলে কেমন কলিজা ঠান্ডা হয়ে যায়। আর বউকে দেখলে? নিজের প্রশ্নে নিজেই হাসলো সে। বউ তো তার ক্লান্তি নিবারনের মহৌষধ। এতোগুলো বছর একসাথে কাটিয়ে দেওয়ার পরও আজও বলা হয়নি ভালোবাসি। কেন বলা হয়নি সেটা ভাবতেই মুখটা চুপসে গেলো ফয়সালের। গাড়ির সিটে গা এলিয়ে দিয়ে চোখ বন্ধ করে রাখলো সে। রিংটোনের শব্দে চোখ মেলে তাকায় সে। মোবাইল স্ক্রিনে আননোন নাম্বার দেখে কোনো প্রতিক্রিয়া দেখালো না। কল কে’টে পুনরায় চোখ বন্ধ করে ফেলে। এখন কারো সাথে কথা বলতে ইচ্ছে করছে না। আজ অফিসে কাজের প্রেসারটা একটু বেশিই ছিলো। পুনশ্চ বেজে উঠলো মোবাইল। বিরক্তিতে মুখ দিয়ে ‘চ’ উচ্চারণ করলো সে। অনিচ্ছা থাকা সত্বেও মোবাইল রিসিভ করেই কানে ধরতেই অচেনা পুরুষ বলে উঠলো,

‘মিস্টার ফয়সাল, আগেই বলেছি বউকে বাপের বাড়ি যেতে দিয়েন না। শুনলেন না আমার কথা। সে তো সেখানে যায় নিজের পুরোনো প্রেমিকের সাথে দেখা করার জন্য। বড় চালাক আপনার বউ। গাছেরও খায় তলারও কুঁড়ায়। আমি হলে কখনো এই বউ নিয়ে সংসার করতাম না।’

চোখ মুখ শক্ত হয়ে এলো ফয়সালের। বউ যেমন হউক পরপুরুষের কাছ থেকে নিজের বউয়ের নামপ বাজে কথা হয়তো কোনো পুরুষই সহ্য করতে পারে না। দাঁতে দাঁত চেপে বলল,

‘এসব বাজে কথা বলার জন্য আপনি আমাকে ফোন দিয়েছেন? আপনি কে ভাই? গত কয়েকবছর যাবৎ বিভিন্ন নাম্বার থেকে এসব বলে যাচ্ছেন। আপনার কি খেয়ে দেয়ে কাজ নেই?’

‘আহা! মশাই রেগে যাচ্ছেন কেন? সত্য কথা কিন্তু তিতাই হয়।আপনার বউ তার নাগরের সাথে দেখা করতে এসেছে। আপনি চাইলে আমি প্রমানও দিতে পারি। আমি আবার প্রমাণ ছাড়া কথা বলি না।’

এবার ফয়সাল দ্বিগুণ রেগে বলল,

‘আজেবাজে কথা বন্ধ করেন। আমার স্ত্রী,,,,।

সামনের ড্রাইভারের দিকে নজর যেতেই চুপ হয়ে গেলো সে। তার সামনে এসব বলা উচিত হবে না। হাজার হউক তূবা তার বউ। মোবাইল কান থেকে নামিয়ে ড্রাইভার কে উদ্দেশ্য করে বলল,

‘জামাল ভাই, আজ বেশি খিদে পেয়েছে। আপাতত খাওয়ার জন্য কিছু একটা নিয়ে আসুন না।’

ড্রাইভার গাড়ি একপাশে সাইড করে বেরিয়ে গেলো। ড্রাইভার যেতেই ফয়সাল ওই লোকটাকে রাগী গলায় বলল,

‘আমার স্ত্রীর নামে মিথ্যা বলবেন না। সে আমার মেয়েকে নিয়ে বাইরে গিয়েছে।’

‘উহু মশাই, আপনার বউয়ের চালাকি ধরতে পারলেন না। সে আপনার কাছে বলে গিয়েছে যেন আপনি তাকে সন্দেহ না করেন। আর সে যেন চুটিয়ে ডেটিং করতে পারে। বিশ্বাস না হলে আমি ছবি পাঠাচ্ছি। আপনি দেখতে পারেন।’

এমএমএস করে কয়েকটা ছবি পাঠালো। ছবি গুলো দেখে মাথায় রক্ত চড়ে গেলো ফয়সালের। কোথাকার কোন ছেলের সাথে হেসে হেসে কথা বলছে তার বউ। তার খুব নিকটে সে। যতটা নিকটে গেলে দুজনের মাঝে কোনো দূরত্ব থাকে। লোকটা কি তার বউয়ের কপালে চুমু দিচ্ছিল? নাকি কপালে? কই তার সাথে তো কখনো এভাবে কথা বলে না। বাসায় থাকলে তার কাছে দু’দন্ড শান্ত হয়ে বসে না। হাত মুষ্টি বদ্ধ করে নিজের রাগ নিয়ন্ত্রণ করতে লাগলো সে। টুং করে মেসেজ বেজে উঠলো,

‘মশাই, আমার তো মাঝে মাঝে মনে হয় মেয়েটাও আপনার না।’ এ যেন আগুনে ঘি ঢালার মতো ছিলো।

ড্রাইভার গাড়িতে বসে বলল,

‘স্যার, এক বোতল পানি আর পেস্ট্রি। আপনি তো কেক খান না।’

ফয়সাল পকেট থেকে টাকা বের করে ড্রাইভারের হাতে দিলো। এগুলোর দাম।অতঃপর চোখ করে বলল,

‘এগুলো তোমার মেয়েকে নিয়ে দিও। আর গাড়ি ঘুরাও বনানীর দিকে।’

‘এখন এতো দূরে যাবেন স্যার?’

‘হুম।’

____________________

হাতে কতগুলো হাওয়াই মিঠাই এর প্যাকেট নিয়ে লাফিয়ে লাফিয়ে হাঁটছে ফারিয়া। মেয়ের সাথে বেরিয়ে ক্লান্ত তূবা। একবার এখানে তো আরেকবার ওখানে। লাফাতে গিয়ে একবার পড়ে ব্যথা পেয়েছে সে। তারপরও দুষ্টুমি কমছে না। অকস্মাৎ মোবাইলের রিংটোনে চমকে উঠে তূবা। স্ক্রিনে ফয়সালের নাম জ্বলজ্বল করছে। ফোন রিসিভ করতেই ফয়সাল বলল,

‘এখনো বাইরে আছো নাকি বাসায় চলে গিয়েছো?’

‘আরে তোমার মেয়ে যা দুষ্টুমি করছে। একবার এখানে তো আরেকবার ওখানে। একেবারে হাঁপিয়ে গিয়েছি আমি। বাসায় আর যেতে পারিনি।এখনো বাইরে।’

‘লোকেশন বল।’

‘ক্যাফে ইতালিয়ানো। কিন্তু কেন?’

‘সেখানেই থাকো। তুমি আমার এখন বাসায় ফিরবে। জামাল ভাই, ক্যাফে ইতালিয়ানোর দিকে যান।’

‘কিন্তু ফয়সাল, আমি তো বলেই এসেছি সপ্তাহ খানেক থাকবো। তার চেয়ে ভালো তুমি সহ বাসায় এসো। আমরা সকালে একসাথে বেরিয়ে যাবো।’

নিজেকে ঠান্ডা রাখর আপ্রান চেষ্টা করছে ফয়সাল। সহ্য হচ্ছে না কিছু তার। চিৎকার করে বলতে ইচ্ছে করছে তুমি প্রতারক তূবা। তুমি ভালোবাসার মূল্য দিতে পারো না। তুমি প্রতিনিয়ত আমাকে ঠকাচ্ছ। কিন্তু বলতে পারলো না।

‘সোজা ভাষা বুঝো না তুমি? এই মুহুর্তে তুমি আমার সাথে বাসায় ফিরবে। অনেক বেরিয়েছো বাবার আর অনেক কিছু করেছেও।’

স্বামীর সাথে ফিরতি কোনো কথা বলল না। কথা বলে লাভও নেই। গত পাঁচটা বছর ধরে সে এমন করছে। এই ভালো তো এই খারাপ। হুট রেগে যায়। সব রাগ এসে পড়ে তার উপর। তার জীবনটা বন্দী খাঁচার পাখির মতো হয়ে গিয়েছে।

________________________

পরদিন রেস্টুরেন্টে মুখোমুখি বসে আছে নাযীফাহ আর তাহমিদ। দেখা করার কথা বলে কোনো কথাই বলছে না তাহমিদ। নাযীফাহ মন্থর গলায় জিজ্ঞেস করল,

‘আপনি কিছু একটা বলবেন বলেছিলেন স্যার। বলছেন না কেন?’

তন্মধ্যে ওয়েটার এসে বলল,

‘স্যার আপনাদের কোল্ড কফি।’

সৌজন্য হাসলো তাহমিদ। ওয়েটার চলে যেতেই এক কাপ কফি নাযীফাহ’র দিকে এগিয়ে গিয়ে বলল,

‘আপনার কি কারো সাথে রিলেশন ছিলো বা আছে? যার সাথে আপনি ফিজিক্যালি ইনভলভ?

আঁতকে উঠল নাযীফাহ। হতচকিত চোখে তাকায় তাহমিদের দিকে। পলক পড়ছে না চোখের। হতবিহ্বল সে, চক্ষু জোড়ায় বিস্ময়। পলকহীন চোখে তাহমিদের দিকে তাকিয়ে বলল,

‘যদি বলি ছিলো?’

চকিত হয় তাহমিদ।

#চলবে

বানান ভুল ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন।