দোটানা ২ পর্ব-০৩

0
586

#দোটানা ২
#লেখিকা_আরোহী_নুর
#পর্ব_০৩

আরুশিকে অপারেশন থিয়েটারে ঢুকানো হবে ঠিক তখনি একটা নার্স এসে খবর দিলো আরুশির মা পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করেছেন,কেউ যেনো তখন গলন্ত সিসা ঢেলে দিয়েছিলো আরুশির কানে,বিশ্বাস করতে ব্যার্থ হলো নার্সের কথায়,ছোটে গেলো মা মা বলে চিৎকার করে,কিন্তু সেই নার্সের বলা কথাটাই সত্য বেরুলো,নিস্তব্ধ হয়ে পরে আছেন আরুশির মা হাসপাতালের বেডে,নিশ্বাস বন্ধ তার,নেই কোনো হেলদুল,চিৎকার করে ডাকছে মাকে আরুশি নেই কোনো জবাব।

ও মা, মাগো উঠো না,দেখো না মা তোমার আরুশি কান্না করছে,কান্না মুছে দিবে না আমার,শোয়াবে না কোলে, দিবে না চোখের জল মুছে,ও মা শুনো না গো মা,আর কখনো দৌঁড় ঝাপ করবো না,বোকামো করে যার তার উপর বিশ্বাস করবো না,তোমার সব কথা শুনবো গো মা উঠো না কথা বলো না আমার সাথে,তুমি ছাড়া যে আমার আর কেউ নেই মা,আমি যে অনাথ হয়ে গেলাম,আমি যে রাতে একা ভয় পাই মা,কে আমাকে কোলে শুয়াবে,কে আদর করবে মা,কে শাসন করবে,কে মুখে তুলে খাবার খাওয়াবো,বলো না মা,উঠো না।এই মা,মা।

……….

মাকে একটু আগেই কবরে শোয়ানো হলো,এমন কেউ নেই যে আরুশির কান্না দেখে কাঁদে নি,পাগলের মতো মা মা বলে চিৎকার করছে এখনও মায়ের কবরের পাশে শুয়ে থেকে,কেউ তাকে সেখান থেকে উঠাতে সক্ষম হলো না,ব্যার্থ হয়ে একে একে সব চলে গেলো,আজকালকার সমাজ এমনই কারো দুঃখে ব্যাথীত হলেও তার সময় সীমা বেশিক্ষণ স্থায়ী হয় না।

না খেয়ে সারাটা দিন কাটালো আরুশি,কারো মনে তার কোনো খোঁজ নেই,পৃথিবীতে যার কেউ থাকে না তার নিয়তি তো এমনই হয়,সারাদিন মায়ের কবরের পাশে বসে থাকলো পাথরের মতো,সন্ধ্যা গড়াতেই মাগরিবের আযান কানে ভেসে এলো আরুশির,চোখ মুখ শক্ত করে নিয়ে উঠে দাঁড়ালো সে,মনে মনে কঠিন কিছু পণ করে নিলো।
____________________

চৌধুরী বাড়ি আজ সুন্দর ভাবে সজ্জিত করা হয়েছে,এই বাড়ির একমাত্র মেয়ের জন্মদিন বলে কথা,তবে সে নেই কথাটা আলাদা,মেয়ের জন্মদিনে তার পরনের ছুটো ছুটো কাপড়গুলো নিয়ে বুকে জড়িয়ে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলো নিধী,শুণ্য বুকটার ভিতর যে হাহাকার ছাড়া আজ আর কিছুই নেই।প্রায় দিনই এটাই নিধীর মুখ্য কাজ হয়।

নিধী আবারও কান্না করছো তুমি?এভাবে কেঁদো না প্লিজ,বুকটা যে বড্ড হাহাকারে ভরে উঠে আমার।

নিহান পাশে বসে চোখের জল আলতো করে মুছে দিয়ে কথাগুলো বললে তাকে ঝাপটে ধরে শব্দ করে কাঁদতে শুরু করলো নিধী।

আর পারছি না নিহান,আর পারছি না,কি পাপ করেছিলাম আমি যে আল্লাহ আমার বুক থেকে আমার কলিজার টুকরাকে কেঁড়ে নিলেন।

শান্ত হও নিধী আল্লাহ ঠিকই একদিন আমাদের দিকে মুখ তুলে তাকাবেন তুমি দেখে নিও।আমাদের আরুশি একদিন ফিরে আসবেই।

প্রিয়তমা স্ত্রীর মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে লাগলো নিহান,এদিকে তার অগোচরে নিজেরও আঁখির জল মুছে নিলো।

আজ চৌধুরী বাড়িতে সবাই আছেন,কেউ বাইরে যাবে না আজ।বছরের এই দিনটায় কেউ কোথাও যায় না সবাই বাড়িতেই থাকে।আজ আয়ান সায়ান দুজনও বাড়িতে,দুজন যেমনই হোক আজকের দিনের মর্ম তাদের কাছে অসীম,দুজনই আজকে নীল রঙের শার্ট পরলো কারন আরুশির নীল রং অনেক পছন্দ ছিলো,আরুশি না থাকলেও তার স্মৃতি এই দুটি হৃদয়কেও কুঁকড়ে খায়,যে বয়সে ওরা আরুশিকে হারিয়েছিলো সে বয়সের আর কোনো কথা তেমন মনে না থাকলেও আরুশির কথা ভুলে না দুজন।আরুশির একখানা ছবি হাতে নিয়ে নিখুঁতভাবে দেখতে ব্যস্ত আয়ান।

হৃদহরনী না জানি তুই কোথায় আছিস?যদি একবারও তোকে খুঁজে পাই আর কোথাও হারাতে দিবো না তোকে,বন্ধ করবো মনের মনিকোঠায়। ওই সায়ানের নজরও পরতে দিবো না তোর উপর,ওর জন্যই তো তোকে আজ হারিয়ে গেলাম আমি।

সায়ান আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজের দিকে তীক্ষ্ণ নজরে তাকিয়ে আছে।

না জানি কোথায় আছিস আরু পাখি?তবে আজ যদি এখানে থাকতি আমারই হতি।লুকাতাম তোকে ওই আয়ানের নজর থেকে।ওর জন্যই তুই আমার কাছে নেই আজ।

বিপরীত দুই প্রান্তের দুটি রুম থেকে বেড়িয়ে আসলো আয়ান সায়ান,সামনাসামনি পরতেই দুজনেরই মুখে বিরক্তির ভাব জন্মালো,একে ওপরকে পাশ কাটিয়ে চলে গেলো দুদিকে।

দুজনই একে ওপরের প্রতিরূপ হলেও একে অপরকে সহ্য করতে পারে না এরা।যেনো দুজন দুই ভাই না শত্রুর থেকেও ভয়ানক,এদের ঝগড়া একজনকে নিয়ে শুরু হয়েছিলো সে একজন বর্তমানে এদের মধ্যে না থাকলেও ঝগড়ার সমাপ্তি ঘটে নি এখনও,সময়ের সাথে এদের মনোমালিন্যের পরিমাণ যেনো ভেড়েই চললো।

প্রতি বছর আজকের দিনে চৌধুরী বাড়িতে নিধীর তৈরী এতিমখানার বাচ্চাদের আনিয়ে আরুশির জন্মদিন পালন করা হয় ওর স্মৃতিতে।আজকেও তেমনটা করা হচ্ছে,কষ্ট চাঁপা দিয়ে সবাই মুখে হাসি ফুঁটিয়ে বাচ্চাদের নিয়ে কেক কাটতে এগিয়ে গেলো,আজকে আরুশির ২৫ তম জন্মদিন, সবাই মিলে কেক কাটতে নিবে তখনি মেইন ডোর থাক্কা দিয়ে ঘরে প্রবেশ করলো কেউ একজন,উক্ত ব্যক্তিত্বকে দেখে বাকি সবার প্রতিক্রিয়া স্বাভাবিক থাকলেও চটকে যাওয়া প্রতিক্রিয়া করে আয়ান সায়ান দুজনই,একসাথেই বলে উঠে দুজন….

তুমি এখানে?

নির্ভয় ভঙ্গিতে জবাব দেয় আরুশি হ্যাঁ আমি।অধিকার নিতে এসেছি ,সায়ান চৌধুরীর স্ত্রীর মর্যাদা চাই আমার।

কথাটা শুনে উপস্থিত সবাই হতবাক হয়,সায়ান হাত মুষ্টিবদ্ধ করে শুকনো ঢুক গিলে নেয়।অবশেষে যেটার ভয় ছিলো আরুশি তাই ঘটালো।

কেউ কিছুই বুঝে উঠার আগে আরুশি হাতে থাকা কাগজটা সোজা এনে নিরবের হাতে দিলো,কাগজটাতে চোখ বুলিয়ে নিরবের চোখ মুহুর্তে অগ্নি বর্ণ ধারন করলো।

চৌধুরী বাড়ি এখন পুরোটা শান্ত, সব বাচ্চাদের অনাথ আশ্রাম পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে, যে কজন মেহমান এসেছিলেন তারাও চলে গেছেন,পরিস্থিতি সামলে সবাইকে পাঠানো হয়ে গেছে।বর্তমানে চৌধুরী বাড়ির সবাই একসাথে জরো আছে ড্রয়িংরুমে।মি.আর মিসেস.চৌধুরীকে টুরে পাঠানো হয়েছে,নিধীর মা চার বছর আগে মারা গেছেন।

আরুশি এক প্রান্তে দাঁড়িয়ে আছে কথা আর নিধীর সাথে, এদিকে নিরব ফেঁটে পড়েছে সায়ানের উপর।

দেখো ডেড ওই মেয়েটা চিটার,আমাকে ব্লেকমেইল করছে।তুমি নিজের বাচ্চাকে বিশ্বাস না করে বিশ্বাস করবে ওই ফকিন্নিকে।

সাট আপ সায়ান,তুমি কচি খোকা নও যে কেউ জোর করে বিয়ের কাগজে তোমার সাইন নিয়ে নিবে।

কাগজগুলো নকল ডেড।

তাহলে সেখানে তোমার সাইন কি করছে?কাগজ আসল নকল ফ্যাক্ট করে না সায়ান,তোমার সাইন আসল এটাই ফ্যাক্ট।

দেখো ডেড আজকাল ঢাকা শহরে এরকম বিয়ে ওহরহ হচ্ছে তাই বলে তো এটা নয় যে কাউকে ঘরের বউ বানিয়ে নেওয়া হবে,ওসব ফকিন্নিদের নিয়ে খেলা যায় বিয়ে করা যায় না।

সায়ান।গর্জে উঠে থাপ্পড় বসালো নিরব সায়ানের গালে।সাথে সাথে অশ্রভরে উঠলো সায়ানের চোখে,ওর বাবা ওকে শাসন করলেও কখনো হাত উঠায় নি,আর আজ….

তুমি আমার উপর হাত উঠালে ডেড?

তোকে তো প্রাণে মেরে ফেলতে ইচ্ছে করছে আমার,এই ছিলো আমার শিক্ষা?আমার ঘরে এমন পশু জন্ম নেবে আমার জানা ছিলো না।কথা আর নিধীর সায় পেয়েই তুই মাথায় উঠেছিস তবে আর না,বিয়ে বিয়ে খেলা তাই না?ওই অসহায় মেয়ের জীবন নিয়ে খেলা করেছিস,এখন ওকেই তোর জীবন সঙ্গিনী বানাতে হবে এটাই ফাইনাল।

আমি ওই ফকিন্নিকে বিয়ে করবো না ডেড,সায়ানের এতোও দূর্দিন আসে নি যে ওর মতো রাস্তার মেয়েকে বিয়ে করবে।

রাগে পাশে থাকা ছুটো টেবিল তুলে ছুড়ে মারে ফ্লোরে সায়ান তারপর বাইরে বেড়িয়ে যায়।

ওর বিয়ের ব্যবস্থা শুরু করো বিয়ে কেমনে করে না আমি দেখছি।

এটা কি বলছো বাবা,হ্যাঁ আমারও সায়ানের লাইফ স্টাইল মোটেও পছন্দ না।ও যে টাইপের সেক্ষেত্রে ওর জন্য এমন ভুল করা স্বাভাবিক,তাই বলে তো এটা নয় যে সামান্য ভুলের জন্য রাস্তার একটা মেয়েকে ওর গলায় ঝুলিয়ে দেওয়া হবে।

তোমার কোনো অপিনিয়ন আমি এখানে চাই নি আয়ান,আমরা বড়রা দেখে নেবো ব্যাপারটা।

হ্যাঁ আপনারাই বড় আমি তো এখনও কথা বলতেই শিখি নি,মিন মিন করে কথাটা বলে আরুশির দিকে রাগি দৃষ্টিতে তাকিয়ে স্থান ত্যাগ করলো আয়ান।আরুশিও রহস্যময়ী দৃষ্টিতে আড়চোখে তাকালো আয়ানের দিকে।

আরুশির মাথায় হাত বুলিয়ে নিধী বলে উঠলো।

নিরব স্যার ব্যাপারটা নিয়ে আমরা পরে কথা বলে নিবো মেয়েটাকে আমরা বরং থাকার জায়গা করে দিই।সারাদিন খেয়েছে কি না কে জানে।মুখটা কেমন শুকিয়ে আছে।

হ্যাঁ নিধী নিয়ে যাও ওকে।নিহান বলে উঠলো।

অতঃপর নিধী আর কথা আরুশির থাকার জন্য একটা রুম রেডি করে দিলো।দুজনেরই আরুশিকে দেখে বড্ড মায়া হলো,কেনো যেনো নিধীর আরুশির উপর থেকে চোখ সরাতেই মন চাইছে না।ঠিক যেনো তার আরুশির মতোই দেখতে মেয়েটা,সেই চোখ–সেই নাক–সেই মুখ–আর নামটাও যে আরুশিই,কৌতুহল আর কারনবশতই কথা নিধী সব কিছু জানতে চাইলো আরুশির কাছে ওর মা বাবা কারা?সায়ানের সাথে ওর পরিচয় কিভাবে সবকিছু। তারপর আরুশি সব কিছু বললো প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত,আরুশির কথাগুলো শুনে ওর জন্য দুজনেরই খারাপ লাগার পরিমাণ আরও বেড়ে যায়।নিধীর যেনো নিজের অতীতের ক্ষতগুলো আবারও তাজা হয়ে উঠলো আরুশির কথায়।দুজন আরুশিকে খাইয়ে বিশ্রাম করতে বলে সেখান থেকে প্রস্থান করলো।

আরুশি নিজের সাথে নিজের সবকিছু নিয়ে এসেছে,বুঝে শুনে সবদিক বিবেচনায় নিয়ে তার এখানে আসা,এবার ব্যাগ থেকে মায়ের ছবি বের করলো স্ব যতনে,হাত বুলালো মায়ের ছবির উপর,উপচে পরলো চোখ বেয়ে জল,মুছলো তা পরম যত্নে অতঃপর ঠোঁটের কোনে ফুঁটালো রহস্যময়ী হাসি।
____________________

আয়ান চিৎ হয়ে শুয়ে আছে বিছানার উপর,রাগে গা জ্বলছে ওর।আরুশির মতো গরীব একটা মেয়ে তাও এতো তেজি তার বাড়িতে বর্তমানে অবস্থান করছে ভেবেই মাথা গরম হয়ে উঠছে ওর।বার বার মনে পরছে তার সেদিনের কথা।

নিরব নিহান আরুশিকে কাজে রাখে তাই আয়ান জানতো না আরুশির কন্ডিশন, কিন্তু সেদিন হঠাৎ জানতে পারে আরুশি খুব গরীব,ওর বাবা চাচা ওর যোগ্যতায় ওকে কাজে রেখেছেন,কথাটা শুনে মাথা চটকালো আয়ানের,চৌধুরী গ্রুপ ওফ ইন্ডাস্ট্রিতে এখন যারাই কাজ করে তারা সবাই সাবলম্বী, কেউ একেবারে গরীব না,কারন আয়ান যে কাউকেই কাজে রাখতে গেলে আগে যাচাই করে তার কন্ডিশন, তাই আরুশি গরীব শোনার পর ওকে সোজা কথায় বলে।

মিস আরুশি আজ থেকে আপনি এই অফিসে চাকরি করতে পারবেন না।

কেনো স্যার?আমার কাজে কোনো ঘাতটি হয়েছে?

নো মিস আরুশি।আপনার কাজে কোনো ঘাতটি নেই তবে একটাই সমস্যা আপনি গরীব।

তাই বলে কি আমার চাকরি করার অধিকার নেই?

না নেই।

আর তা আপনি কোন বইয়ে পড়েছেন জানতে পারি।

ইউ ব্লা/ডি পুওর,আমাকে জবাবদিহি করার সাহস আসে কোথা থেকে তোমার?বেড়িয়ে যাও আমার অফিস থেকে এক্ষুনি। হাতে থাকা কয়েকটা ফাইল ছুড়ে মারে আরুশির মুখে আয়ান কথাগুলো বলে।

আরুশিও রেগে যায় তাতে অনেক,তার আত্মসম্মানে আঘাত পায় সে,তাই নির্ভয়ে সোজা জবাব দেয়।

ন্যায় কথা বলতে এই আরুশি কখনো ভয় পায় না স্যার।হ্যাঁ আমি গরীব–কিন্তু মানুষ, চাকরি করার যথেষ্ট যোগ্যতা আর অধিকার দুটোই আছে আমার,তবে সেটা আপনার মতো সুন্দর পোষাকের আড়ালে ভালো মানুষ হিসেবে বেঁচে থাকা অধমেরা বুঝতে পারবে না,আমারও আপনার চাকরি চাই না।

বেরিয়ে আসে আরুশি অফিস থেকে,আয়ান রাগে কয়েকটা ঘুষি মারে সামনের টেবিলে।

ছাড়বো না আরুশি তোমাকে,তোমার এতো বড় সাহস,সামান্য রাস্তার মেয়ে হয়ে চৌধুরী বাড়ির বউয়ের মর্যাদা পেতে চাও।তোমার এই সপ্ন কখনো পুরন হবে না।জানিনা সায়ান কি করবে কিন্তু ও যাই করুক আমি তোমার বেঁচে থাকা মুশকিল করে দিবো।

চলবে………….