দ্বিতীয় সূচনা পর্ব-১৬+১৭+১৮+১৯

0
451

#দ্বিতীয়_সূচনা
#পর্ব_১৬
লেখা – আফরোজা আক্তার
(কোনোক্রমেই কপি করা যাবে না)

সংসদ ভবনের উল্টো পথে হাঁটছে ফারহান আর অয়নন্দিতা। পড়ন্ত বিকেলে এদিকটায় হাঁটতে বেশ ভালো লাগে। একরকম স্বস্তি অনুভব করা যায়। ফারহান তার গাড়িটা এক পাশে পার্ক করে অয়নন্দিতাকে বের হয়।
এমন নির্বাক চলচিত্র হয়ে হাঁটতে ভালো লাগছে না অয়নন্দিতার। এর থেকে তো ভালো ছিল সে বাসায় চলে যেত। কিন্তু রেস্টুরেন্টে ফারহান তাকে দেখে ফেলায় সেখান থেকে তাকে নিয়ে এসেছে এখানে।
চারপাশে বাতাস বইছে। সেই বাতাস এসে অয়নন্দিতার শরীর স্পর্শ করছে। বাতাসের খানিকটা ফারহানকেও ছুঁয়ে যাচ্ছে।
ফারহানের কিছু স্মৃতি মনে পড়ে যায়। এই রাস্তা ধরেই সে আর বন্দনা হেঁটেছিল একাধিক বার। কখনও পা ব্যথা হলে একটু বসে জিরিয়ে নিয়েছে। হাজারো স্মৃতি মিশে আছে এই জায়গায়। অনেকদিন পর ফারহান সংসদ ভবনের এই পাশে আসে সাথে অয়নন্দিতা। জায়গাটা সেই আগের মতোই আছে। চারপাশে থাকা গাছগুলোও আগের মতো মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে। ঘড়ির সময় দেখে একটু ভড়কে যায় ফারহান। বন্দনার সঙ্গে প্রথম দেখা তার এখানেই হয়েছিল এবং একই সময় হয়েছিল। সবই আগের মতো শুধু আশে থাকা মানুষটা বদলেছে। এইটুকুই তো। এর বেশি তো কিছুই না। তবে ক্ষতিটা সব থেকে বেশি ফারহানেরই হলো।
অয়নন্দিতা ভাবছে তার কিছু বলা উচিত। যেই ভাবা সেই কাজ। অয়নন্দিতা প্রশ্ন করে,
‘শুক্রবার কখন যাচ্ছি আমরা?’
কিছুক্ষণ চুপ থাকার পর ফারহান জবাব দেয়,
‘ভোরের দিকে।’
‘ওহ।’
এরপর আবারও নীরবতা। তবে অয়নন্দিতা এইবার নিশ্চিত যে, ফারহানের কিছু তো হয়েছে। কিন্তু কী হয়েছে জিজ্ঞেস করার সাহস পাচ্ছে না। তার আবার একটা অভ্যাস আছে, সে সহজেই কাউকে প্রশ্ন করতে পারে না। ফারহান অয়নন্দিতার দিকে একবার তাকায়। এরপর চোখ সরি নিয়ে বলা শুরু করে,
‘এই রাস্তায় অনেক স্মৃতি জড়িয়ে আছে অয়নন্দিতা। অনেক স্মৃতি জড়িয়ে আছে। বহুদিন পর এই রাস্তায় পা পড়েছে আমার। আশ্চর্যজনক হলেও একটা দারুণ মিল আছে। সেদিনও সাথে এক নারী ছিল। আজও সাথে এক নারী আছে। তবে তাদের মুখশ্রীটা আলাদা।’
অয়নন্দিতা এবার বলে,
‘দু’জন নারী তাদের মুখশ্রী এবং পারিপার্শ্বিক দিক থেকে আলাদা।’
ফারহান অজান্তেই মুচকি হাসি দেয়।
‘তা ঠিক। দু’জন নারী সম্পূর্ণ আলাদা। কিন্তু এখানে ভালোবাসা কাজ করে একজনের জন্য। আই লাভ হার। ইয়েস অয়নন্দিতা। আই লাভ হার। এন্ড অ্যাট দ্যাট মোমেন্ট আই মিস হার।’
অয়নন্দিতার ভীষণ ভালো লাগছে। নিজের ভালোবাসা প্রকাশ করায় ফারহানের প্রতি তার ভালো লাগা আরও বেশি কাজ করছে। বন্দনা ভীষণ লাকি ছিল যাকে এত ভালোবাসার মতো একজন মানুষ ছিল। সাধারণত অয়নন্দিতার জায়গায় অন্য কেউ হলে হয়তো হিংসা করত। কিন্তু অয়নন্দিতার ভালো লাগছে। নারীকে সত্যিকার অর্থে ভালোবাসতে পারে এমন পুরুষ কয়জন আছে এই দুনিয়ায়।
অয়নন্দিতার মুখে হাসি ফুটিয়ে জবাব দেয়,
‘সেও আপনাকে মিস করে। ভীষণ মিস করে।’
অয়নন্দিতার কথাটা শুনে তাচ্ছিল্যের হাসি দেয় ফারহান। এগিয়ে যায় সামনের দিকে।
‘অয়নন্দিতা, বসবে এখানে?’
‘আপনি বসতে চান?’
‘এই সময়ে এই জায়গাটায় বসলে এমনিতেও মন ভালো হয়ে যায়।’
‘তাহলে চলুন, বসি।’
‘এসো।’
সামনে সংসদ ভবন। আশেপাশে অনেককেই দেখা যাচ্ছে। সবাই ঘুরতে এসেছে। কেউ বা এসেছে ডেট করতে। ফারহান পাশে তাকাতেই এক মহিলাকে দেখতে পায়। মহিলা চুড়ি নিয়ে বসে আছে। একটা দীর্ঘশ্বাস এবং চাপা আর্তনাদ বের হয়ে আসে তার অন্তর থেকে। জরিনা নামে একজন বয়স্ক মহিলাও এখানে চুড়ি নিয়ে বসত। ফারহান তাকে খালা বলে সম্বোধন করত। কতবার যে বন্দনাকে সেই খালার কাছ চুড়ি কিনে দিয়েছিল। খালার সামনে গিয়ে দাঁড়ালেই খালা বলত, কিগো বাপজান, আইজকা চুড়ি কিনবা না? উত্তরে এক গাল হেসে তার পাশে বসে পড়ত বন্দনা। পছন্দ অনুযায়ী চুড়িগুলো নিয়ে সেখানেই পরে ফেলত৷ অতীতের স্মৃতিগুলো আজও জ্বল-জ্বল করে চোখের সামনে।
অয়নন্দিতার কাঁচের চুড়ির প্রতি দুর্বলতা সেই ছোটোবেলা থেকে। পুরোপুরি বুঝ হবার পর মায়ের কাছ থেকে শুনেছিল সে যদি বায়না কর‍ত তবে এই চুড়ির জন্যই বায়না করত। অন্যকিছু তার কাছে নাকি ভালো লাগে না। চুড়িগুলোর দিকে অয়নন্দিতাকে তাকিয়ে থাকতে দেখে ফারহান বলে,
‘চুড়ি পছন্দ তোমার?’
প্রশ্নের উত্তরে অয়নন্দিতাও বলে,
‘হ্যাঁ। ভীষণ লাগার একটা জিনিস হচ্ছে এই চুড়ি। আমার খুব পছন্দের।’
‘এসো। পছন্দ করো।’
কিছু কিছু মেয়ে মানুষ চুড়ির লোভ ছাড়তে পারে না। অয়নন্দিতা সেই মেয়ে মানুষের মধ্যে একজন। মহিলার সামনে হাটু গেড়ে বসে অয়নন্দিতা আর ফারহান।
অয়নন্দিতার পছন্দ আর সাথে নিজে পছন্দ করে ১০ ডজন চুড়ি কেনে ফারহান। অয়নন্দিতা কখনও এক সঙ্গে ২ ডজনের বেশি চুড়ি কিনেনি। এই প্রথম কেউ তাকে ১০ ডজন চুড়ি কিনে দিয়েছে।
এই ছোটো ছোটো খুশিগুলোই বা কয়জন পায়। অয়নন্দিতা পাচ্ছে। তবে খুশিগুলো ভাগাভাগি করে নিতে হচ্ছে তাকে। কারণ অয়নন্দিতা প্রথম রাতেই বুঝে নিয়েছে যে, সে ফারহানকে কখনও নিজের করে পাবে না। তাকে ভাগাভাগি করে নিতে হবে। কারণ বন্দনা না থেকেও তার প্রতিটি স্মৃতির মাধ্যমে এখনও রয়ে গেছে ফারহানের কল্পনায়। ফারহানের মনে তার বিচরণ সর্বক্ষণ। এতে অয়নন্দিতার কোনো কষ্ট নেই। তার সংবিধানে সে নিজেই একটা ধারা জারি করেছে। সেই জারি হলো, ভালোবাসার মানুষ যত দূরেই থাকুক না কেন মন থেকে কখনও সেই ভালোবাসার স্মৃতি দূরে যায় না। তবে ভালোবাসা সত্যিকারের হতে হয়।

চলবে………………………

#দ্বিতীয়_সূচনা
#পর্ব_১৭
লেখা – আফরোজা আক্তার
(কোনোক্রমেই কপি করা যাবে না)

রিসোর্টে পৌঁছে গেছে অয়নন্দিতা। ড্রাইভার দিয়ে অয়নন্দিতাকে রিসোর্টে পাঠিয়ে দেয়া হয়েছে। আপাতত রুমে অয়নন্দিতা একা। একা থাকায় আফসোস হচ্ছে না। আপত্তিও করছে না সে। কারণ সে বোঝে তার বর কাজপ্রিয় মানুষ। আর বিশেষ করে সে এখানে কাজেই এসেছে। শ্বশুর মশাই জোর করে তাকে পাঠিয়েছে তার বরের সঙ্গে।
জানালা দিয়ে বাইরের ভিউটা বেশ সুন্দর লাগছে অয়নন্দিতার কাছে। রাঙামাটি শহরটা যে এত সুন্দর জানা ছিল না অয়নন্দিতার। লোকমুখেই কেবল শুনেছে যে, শহরটা ভীষণ সুন্দর। কিন্তু চোখে কখনও দেখার সুযোগ হয়নি। হয়তো সুযোগ কোনোদিন হতো যদি তার বাবা-মা বেঁচে থাকত তো। তবে সুযোগ এখনও হয়েছে। স্বামী দ্বারা।
শাওয়ার নিয়ে বের হতেই ফারহানেট ফোন পায় অয়নন্দিতা।
‘হ্যালো।’
‘হ্যাঁ, ঠিকঠাক আছো তো?’
‘হু।’
‘খেয়ে নিও। অপেক্ষা কোরো না। আমার ফিরতে ফিরতে সন্ধ্যা হতে পারে।’
‘আচ্ছা।’
অয়নন্দিতার মুখ থেকে আচ্ছা শব্দটা শুনতে পেয়ে ফারহান কয়েক সেকেন্ড চুপ থাকে। কী ভাবছিল কে জানে। পরবর্তী প্রশ্ন করে,
‘একা থাকতে পারবে তো?’
অয়নন্দিতা হেসে জবাব দেয়,
‘পারব।’
‘আই এম সরি। ওকে?’
‘সরি কেন বলছেন?’
‘এইযে আমার সঙ্গে এসেও একা থাকতে হচ্ছে।’
‘প্রথমত, আপনি এখানে কাজেই এসেছেন। আমিই বাড়তি হয়ে এসেছি। আমার আসার ইচ্ছা ছিল না। আপনি না আনলেও সমস্যা ছিল না। বাবা বলায় আমি আর সেখানে দ্বিতীয় কোনো কথা বলিনি৷ এখন মনে হচ্ছে, আমার জন্য আপনার কাজে ক্ষতি হচ্ছে।’
‘এমন মনে করার কারণ?’
‘এইযে টেনশন নিচ্ছেন।’
এই মুহুর্তে কথা বলতে আর ইচ্ছা করছে না ফারহানের। বিশেষ কিছু না বলে ফোন রেখে দেয় ফারহান। অয়নন্দিতাও আর ফোন ব্যাক করেনি। সে এখন বের হবে। রিসোর্টে প্রবেশ করার সময় দেখেছে চারপাশের জায়গাটা। ভীষণ সুন্দর ছিল চারপাশের পরিবেশটা। অয়নন্দিতা এখন সেই পরিবেশের সঙ্গে নিজেকে মেশাতে চাইছে এবং সে এটাই করবে।

কাজের ফাঁকে অয়নন্দিতার কথা মনে পড়ছে ফারহানের। এমনই একটা সময়ে বন্দনাকে নিয়ে সিলেট গিয়েছিল সে। মূলত সেখানে কাজের জন্যই যাওয়া হয়েছিল। আনফরচুনেটলি সেদিন তার কাজের প্রচুর চাপ ছিল। আর সে সময় মতো হোটেলে পৌঁছাতে সক্ষম হয়নি। বন্দনা সেদিন খুব রেগে গিয়েছিল। ফারহানকে প্রচুর হ্যাপা পোহাতে হয়েছিল বন্দনার রাগ ভাঙানোর জন্য।
ফারহান চুপচাপ বসে আছে। ভাবছে তার ব্যস্ততা নিয়ে অয়নন্দিতা কিছু মনে করবে না তো? সে রাগ করবে না তো? পরমুহূর্তেই ফোনে বলা অয়নন্দিতার কথাগুলো মনে পড়ে যায় তার। খুব পজিটিভ ওয়েতে অয়নন্দিতা কথাগুলো বলেছে তাকে।
মিজান নামের একজন এসে দরজায় নক করে। ফারহান মুখ তুলে তাকায় তার দিকে।
‘ইয়েস।’
‘স্যার, ওনারা চলে এসেছে।’
‘ওকে। আমি আসছি। যাস্ট টু মিনিট।’
পিওন চলে গেলে ফারহান টেবিলে থাকা গ্লাসটা হাতে তুলে নেয়। থেমে থেমে গ্লাসের পুরো পানি শেষ করে। দীর্ঘশ্বাস যেন আপনা-আপনিই বের হয়ে আসছে ভেতর থেকে। নিজেকে শান্ত রেখে মিটিং রুমে পা বাড়ায় ফারহান।

দুপুরের পর যখন বেলা পড়ে যায়। তখন প্রকৃতি অন্য রুপ ধারণ করে। পড়ন্ত বিকেলে একলা একা আপন মনে হাঁটার মজাই আলাদা। অয়নন্দিতা এই মজাটা নষ্ট করতে চায় না। তাই এই পড়ন্ত বিকেলেই বের হয়ে পড়ে রিসোর্ট থেকে। বের হওয়ার সময় রিসোর্ট ম্যানেজার বার বার করে তাকে বলে দিয়েছে, ম্যাডাম, বেশি দূরে যাবেন না প্লিজ। স্যারের নিষেধ আছে। অয়নন্দিতা মাথা নাড়িয়ে সায় দিয়ে গেছে। কারণ তখন মাথা নাড়ানো ছাড়া আর কোনো উপায় ছিল না।
আপন মনে হাঁটছে অয়নন্দিতা। মুক্ত বাতাস শরীর স্পর্শ করছে তার। এই মুহুর্তে তার পাশে ফারহানের অস্তিত্ব না থাকায় সে আহত। দুপাশে গাছের ছায়া। মাঝামাঝি পথ ধরে এগিয়ে যাচ্ছে অয়নন্দিতা।
কিছুদূর যেতেই হঠাৎ সে টের পায় কেউ তাকে ডাকছে। অয়নন্দিতা পেছনে তাকায়। কেউ একজন দ্রুত পায়ে হেঁটে তার দিকে এগিয়ে আসছে। স্পষ্টস্বরে বলছে,
এক্সকিউজ মি। এইযে শুনছেন। একটু দাঁড়িয়ে যান প্লিজ। অয়নন্দিতা দাঁড়িয়ে যায়। একজন নারী হাঁপাতে হাঁপাতে তার সামনে এসে দাঁড়ায়। অয়নন্দিতা তাকে চেনে না। কখনও দেখেওনি। কৌতূহলী চাহনি নিয়ে তাকিয়ে আছে নারীর দিকে। প্রশ্ন করে,
‘আপনি কি আমায় চেনেন?’
নারী মিষ্টি হেসে জবাব দেয়,
‘জি না। চিনি না৷ আপনিও আমায় চেনেন না। তবে আপনি যেই রিসোর্টে উঠেছেন আমিও সেই রিসোর্টে উঠেছি। অবশ্য আমি আর আমার হাসবেন্ড উঠেছি। আজ দু’দিন হলো আমরা এখানে। জানালা দিয়ে দেখলাম আপনি বের হয়েছেন। আসলে আমিও বোর হচ্ছিলাম একা একা রুমে। তাই আপনাকে দেখে আমিও বের হয়ে গেলাম। ভাবলাম একসাথে কিছুটা সময় কাটানো যাবে।’
অয়নন্দিতা তার কথায় বেশ খুশী হয়। ভাবছে, যাক তার একজন সঙ্গী হলো। পরিচয় পর্বটা সেড়ে নিলে মন্দ হয় না। অয়নন্দিতা হাসি মুখে নিজের পরিচয় দেয়।
‘আমি অয়নন্দিতা। ঢাকা থেকে এসেছি।’
‘আমি ইয়াসমিন। আমরা এসেছি খুলনা থেকে। বাই দ্যা ওয়ে, আপনি একা এসেছেন?’
‘জি না। আমার হাসবেন্ড আছে সাথে।’
‘কোথায়? দেখতে পাচ্ছি না যে।’
‘তিনি মিটিংয়ে।’
‘ওহ আচ্ছা।’
‘চলুন, সামনে যাওয়া যাক।’
‘হ্যাঁ চলুন। যাওয়া যাক।’

চলবে………………………

#দ্বিতীয়_সূচনা
#পর্ব_১৮
লেখা – আফরোজা আক্তার
(কোনোক্রমেই কপি করা যাবে না)

ফারহান যেই ভয়টা সারাদিন যাবত পেয়েছে সেটাই হয়েছে। অয়নন্দিতা রুমে নেই। এদিকে সন্ধ্যে হয়ে এসেছে। ম্যানেজার বলল অয়নন্দিতা রিসোর্টের বাইরে গেছে। ফারহান এটাই বুঝতে পারছে না যে, সে ম্যানেজারকে মানা করা সত্ত্বেও ম্যানেজার কী করে অয়নন্দিতাকে বের হতে দিয়েছে। এ নিয়ে কিছুক্ষণ ম্যানেজারকে ঝেড়েছে ফারহান। রিসোর্ট মালিক ফারহানের বাবার বন্ধু। খুব কাছের বন্ধু। সে হিসেবে ফারহান পূর্ণ অধিকার রাখে ম্যানেজারকে দুটো কথা শোনানোর।
অয়নন্দিতা নাকি একাই বের হয়েছে। আর ম্যানেজার না করার পরেও হাঁটতে বের হয়েছে। সঙ্গে একজনকে নিতে বলার পরেও সে না করেছে। এমনটাই ম্যানেজারের বক্তব্য। ফারহানের মাথা কাজ করছে না। এই অচেনা জায়গায় অয়নন্দিতা যাবে কোথায়। চারপাশে পাহাড়। আবারও যদি কোনো দুর্ঘটনা ঘটে যায়। নিজেকে সামাল দেবে কী করে ফারহান সেটাই ভাবছে সে।
কয়েকবার ফোন করার পর বুঝতে পারে অয়নন্দিতা তার ফোনটা রুমেই চার্জ দিয়ে গেছে। প্রচন্ড রাগে মাথা খারাপ হয়ে গেছে ফারহানের। বার বার বলেছিল সে, একা বের হয়োও না। তবুও মেয়েটা বের হয়েছে। এমন সময়ই ফোনটা বেজে ওঠে ফারহানের। অত্যন্ত উৎসুক দৃষ্টিতে ফোন হাতে নেয় সে। ভেবেছে, অয়নন্দিতা পথ ভুলে গিয়ে হয়তো কারো ফোন থেকে ফোন করেছে। কিন্তু ফোন হাতে নিয়ে দেখে তার ধারণা ভুল। ফোন এসেছে ঢাকা থেকে। অয়নন্দিতার ভাই হাসান ফোন দিয়েছে। ফারহান মনে মনে একশো একবার নিজের ভাগ্যকে গালমন্দ করছে। এতদিন ফোন আসেনি। অথচ আজ এখানে এসে অয়নন্দিতা নিখোঁজ আর এখনই তার ভাইয়ের ফোন আসতে হলো। কিন্তু তাকে কেন ফোন করল। ফারহান দ্রুতই অয়নন্দিতার ফোনটা হাতে নেয়। ফোনে প্রায় দশটা মিসডকল। ছয়টা হাসানের ফোন থেকে আর চারটা তার ফোন থেকে। লজিক এখন কাজ করছে। অয়নন্দিতাকে না পেয়ে তার ভাই ফোন করেছে। কিন্তু হাসানকে এখন সে কী জবাব দেবে সেটাই ভাবছে।
কিছুক্ষণ চুপচাপ বসে পুরো বিষয়টা ভেবে নেয় ফারহান। ফোনটা ক্রমাগত বেজেই যাচ্ছে। ফোনটা রিসিভ করে ফারহান। স্থির কন্ঠে বলে,
‘হ্যালো।’
‘হ্যালো ফারহান, কেমন আছেন?’
‘এইতো ভালো। আপনি কেমন আছেন?’
‘ভালো।’
‘আচ্ছা, অয়নি কোথায়? ওকে ফোন করলাম রিসিভ করল না যে।’
‘অয়নন্দিতা ঘুমাচ্ছে। একটু টায়ার্ড তো। ওর ফোন সাইলেন্ট করা৷’
‘ওহ। আচ্ছা ও উঠলে বলবেন। কেমন?’
‘হ্যাঁ অবশ্যই।’
ফারহান খুব নিখুঁতভাবে মিথ্যা বলল হাসানকে। ইচ্ছা করে বলেনি৷ বাধ্য হয়েছে বলতে। ফারহান যতটা সম্ভব নিজেকে দমিয়ে রাখার চেষ্টা করছে কিন্তু পারছে না। এদিকে পুরো রিসোর্ট এবং রিসোর্টের চারপাশটায় দেখাশোনা শুরু হয়ে গেছে।
পুলিশ অফিসার রাফি এসে হাজির হয়েছে রিসোর্টে। ফারহান অলরেডি রাঙামাটি থানায় খবর দিয়ে ফেলেছে। মিসিং ডায়েরি করা হয়েছে। ফারহান পারছে না চিৎকার করে ডাকে অয়নন্দিতাকে। গাড়ি নিয়ে একবার টহল দেওয়াও হয়ে গেছে। কিন্তু খোঁজ পায়নি অয়নন্দিতার।

রাত আটটা। ফারহান আরও একবার গাড়ি নিয়ে বের হয়েছে। চারপাশটা দেখে এসেছে। কিন্তু অয়নন্দিতাকে পায়নি। রাগে, দুঃখে মেজাজ ভীষণ খারাপ হয়ে গেছে তার। না করার পরেও অয়নন্দিতা কেন বের হলো এটাই তার রাগের কারণ।
আনুমানিক আটটা পনেরো হবে, অয়নন্দিতা রিসোর্টে ফেরে। ফারহান তখন রিসিপশনের সামনে দাঁড়িয়ে আছে। পুলিশ অফিসার রাফির ফোনের অপেক্ষায় সে। ফোন এলেই সে বের হবে। কিন্তু তার আগেই অয়নন্দিতার পা পড়ে গেছে রিসোর্টে। দম বন্ধ করা পরিস্থিতি দেখে অয়নন্দিতা খানিক ঘাবড়ে যায়। আর তাকে দেখে ফারহান যেন নিজের প্রাণ ফিরে পায়। চোখ জোড়া বন্ধ করে একটা ঠান্ডা নিঃশ্বাস ছেড়ে সেখানেরই সোফায় বসে পড়ে ফারহান। একপাশে সকল স্টাফরা দাঁড়িয়ে আছে। ফারহানের পাশে ম্যানেজার দাঁড়িয়ে আছে।
অয়নন্দিতাকে দেখে ম্যানেজারও যেন হাফ ছেড়ে বাঁচে। বাই এনি চাঞ্চ যদি কিছু হয়ে যেতো তাহলে তো তার চাকরি নিয়ে টানাটানি হতো। কপাল ভালো এ যাত্রায় তার চাকরি বেঁচে গেছে।
ফারহান বসা থেকে উঠে দাঁড়ায়। ধীর গতিতে অয়নন্দিতার সামনে এসে দাঁড়ায়। সবার সামনে অয়নন্দিতার বামহাতের বাহুতে স্পর্শ করে সে। এরপর হালকা টানে রুমের দিকে পা বাড়ায়।

মুখোমুখি দু’জন দাঁড়িয়ে আছে। রুমে এসি চলছে তবুও ফারহান ঘামছে। গলার নিচের রগগুলো তার ফুলে ফেঁপে আছে। রাগ মাত্রাতিরিক্ত বেড়ে গেছে এখন। ফারহান ভাবছে, তাদের যদি সাক্ষাৎ যদি আরও কয়েকবছর আগে হতো তাহলে হয়তো কষিয়ে একটা চড় বসিয়ে দিত অয়নন্দিতার গালে। কিন্তু এখন তা করা সম্ভব না। এর কারণ সম্পর্কের বন্ধনে সবে মাত্রই পা রেখেছে তারা দু’জন।
ফারহানের রাগান্বিত বডি ল্যাংগুয়েজ দেখে অয়নন্দিতার কলিজা শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেছে। সে জানত এমন কিছুই হবে। কারণ সে বড্ড দেরি করে ফেলেছে। ইয়াসমিন নামের ওই নারীকে সে বার বার বলেছিল রিসোর্টে ফেরার কথা। কিন্তু সে কিছু শপিংয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ায় তার সঙ্গে থাকতে হয়। আর সেই থাকাটাই কাল হয়ে দাঁড়িয়েছে।
ফারহান অয়নন্দিতার দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করে,
‘এতক্ষণ কোথায় ছিলে তুমি?’
ফারহানের কন্ঠস্বরে কাঠিন্য। অয়নন্দিতা মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে৷ এই মুহুর্তে নীরবতাও ফারহানের কাছে বিরক্তি হয়ে যাচ্ছে। ফারহান আবারও বলে,
‘একটা প্রশ্ন করলে তার জবাব দিতে হয়। এতটুকু ভদ্রতা আমি তোমার কাছে আশা করতেই পারি। তাই না? কোথায় ছিলে এতক্ষণ?’
‘আসলে আমি,,,।’
অয়নন্দিতাকে থামিয়ে দেয় ফারহান৷
‘ওয়েট। তুমি এখানকার কিছুই চেনো না। তবে এতক্ষণ কোথায় ছিলে। আর ম্যানেজার তোমায় না করেছিল নিশ্চয়ই। তবুও তুমি বের হয়েছ কেন?’
কম্পিত গলায় অয়নন্দিতা জবাব দেয়,
‘আমার ভালো লাগছিল না। খাওয়া দাওয়ার পর বোর লাগছিল৷ তাই বের হয়েছিলাম। আমি দূরে যেতাম না। আশেপাশের জায়গা থেকেই ঘুরে চলে আসতাম। কিন্তু,,,।’
‘কিন্তু,,, কীসের কিন্তু। কিন্তু কী, বলো।’
‘এই রিসোর্টেই উঠেছেন এমন একজন নাম ইয়াসমিন। আপনি রিসিপশনে গিয়ে চেক করতে পারেন। তিনি আমায় ডাকলেন। বললেন তার স্বামী বাইরে মিটিংয়ে গেছে। তিনিও একা আর আমিও একা। তাই দু’জন মিলে সামনে যাওয়া যাক। আমিও ভাবলাম এখানেই তো থাকব। যাওয়া যাক। কিন্তু সে এখানের মার্কেটে নিয়ে গেল। বলল এখানে নাকি ভালো ভালো জিনিস পাওয়া যায়। তাই গেলাম। দেরি হয়ে যাচ্ছিল। আমি বার বার বলছিলাম, চলুন আমাদের যাওয়া উচিত। আমার হাসবেন্ড চলে আসবে৷ কিন্তু তিনি শুনলেন না। তাই তার সঙ্গে আমায় থাকতে হলো।’
ফারহান এতক্ষণ চুপচাপ শুনছিল অয়নন্দিতার কথাগুলো। এখানে ভালো ভালো জিনসও পাওয়া যায় সে জানত না। পুনরায় প্রশ্ন করল,
‘তা ওই ইয়াসমিনের নামের ভদ্রমহিলা কোথায়? তোমাকে তো একা ঢুকতে দেখলাম।’
‘আমরা দু’জনেই রিসোর্টে ফিরেছি এক সঙ্গে। ওই সময়ই গেইটের সামনেই তার হাসবেন্ডের গাড়ি এসে থামে। তিনি তার স্বামীর সঙ্গে গাড়ি করে চলে যান।’
‘এভাবে কখনও একা একা বের হবে না তুমি। তোমার জন্য এটা নতুন জায়গা অয়নন্দিতা। প্লিজ, আমার ভয় হয়। তুমি বুঝতে পারবে না আমি কী পরিমাণ চিন্তায় ছিলাম।’
‘আমায় নিয়ে এত চিন্তা?’
‘অবাক হলে নাকি জানতে চাইলে?’
‘দুটো এক সঙ্গেই।’
‘ঘরপোড়া গরু আমি অয়নন্দিতা। হারানোর যন্ত্রণা আমার থেকে ভালো কেউ উপলব্ধি করতে পারবে না। আমার আর একদিন লাগবে সমস্ত কাজ শেষ করতে। পরশুদিন থেকে আমি ফ্রী। টানা এক সপ্তাহ তোমায় নিয়ে ঘুরব আমি। কথা দিলাম। কিন্তু প্লিজ, একা একা আর কোথাও বের হবে না। কেমন?’
ফারহানের চাহনিতে নিজের জন্য ভয় দেখতে পায় অয়নন্দিতা। সে খুশি হবে নাকি কী করবে ভেবে পাচ্ছে না। ভাবছে যা হচ্ছে তা কি শুধুই দায়িত্ব নাকি দায়িত্বের আড়ালে ভালোবাসা নামক অনুভূতিও মিশ্রিত। ফারহান দ্বিতীয়বারের মতো কাউকে ভালোবাসবে? এটাও তার কাছে একটা প্রশ্ন। যার উত্তর হয়তো সময় বলে দেবে।

রাত দুটো। ফারহান ল্যাপটপে কাজ করছে৷ অয়নন্দিতার ঘুম আসছে না। নতুন জায়গায় ঘুম আসবে না এটাই স্বাভাবিক। এখানে ওয়াইফাই ব্যবস্থা ততটা ভালো না। তাই এমবি দিয়েই কাজ চালাতে হবে। এত রাতে ফেসবুকে এক্টিভ হতেও ইচ্ছে করছে না। গলা ছেড়ে গান গাইতে মন চাইছে তার। কিন্তু এখন গান গাইলে ফারহান বিরক্ত হবে সাথে অন্যান্য রুমের লোকজনের অসুবিধা হবে। কিন্তু এভাবে বোবার মতোও বসে থাকতে ভালো লাগছে না তার। বারান্দায় গিয়ে বসবে নাকি সেটাও ভাবছে সে।
ফারহান সামনে তাকিয়ে দেখে জানালার পাশে অয়নন্দিতা দাঁড়িয়ে আছে। সেও বুঝতে পেরেছে হয়তো ঘুম আসছে না বলেই দাঁড়িয়ে আছে। সন্ধ্যায় ঘটে যাওয়া ঘটনা নিয়ে ফারহান নিজেও একটি হীনমন্যতায় ভুগছে। না চাইতেও সে খারাপ আচরণ করেছে অয়নন্দিতার সঙ্গে। এটাই তাকে লজ্জা দিচ্ছে। কাজে মন দিতে না পারলেও তাকে কাজ করতে হচ্ছে। কারণ সন্ধ্যের পর থেকে সে এতটাই ডিস্টার্ব ছিল যে কাজটা তখন গোছাতে পারেনি। তাই এখন যত রাতই হোক সব কাজ গোছাতে হবে। সকাল এগারোটায় আরেকটা মিটিংয়ে বসতে হবে তাকে। সেটা নিয়েই যত ব্যস্ততা তার। সব কাজ শেষ করে অয়নন্দিতাকে কিছুদিন সময় দেবে এটাই তার পরবর্তী চিন্তাভাবনা।
এদিকে অয়নন্দিতা ততক্ষণে বারান্দায় গিয়ে বসেছে। আহ, দখিনা বাতাসে শরীর তার জুড়িয়ে যাচ্ছে। এখান থেকে আকাশটা খুব কাছে দেখা যাচ্ছে। কিন্তু হাত দিয়ে ধরার উপায় নেই। চোখ জোড়া বন্ধ করে বাতাসের গন্ধ নিতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে অয়নন্দিতা। কন্ঠস্বরে উচ্চারিত হয়,
চোখে আমার তৃষ্ণা, ওগো তৃষ্ণা আমার
বক্ষ জুড়ে।

চলবে……………………………….

#দ্বিতীয়_সূচনা
#পর্ব_১৯
লেখা – আফরোজা আক্তার
(কোনোক্রমেই কপি করা যাবে না)

চারপাশে সবুজে ঘেরা। পুরো রাঙামাটি শহরটা যেন সবুজের রাজত্ব। ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে প্রকৃতি দেখছে অয়নন্দিতা। মুক্ত বাতাস শরীর যখন স্পর্শ করে তখন উত্তেজিত মনটা শান্ত হতে কয়েক সেকেন্ড নেয় মাত্র। খোলা আকাশের দিকে তাকালে অজস্র চিন্তায় ঘেরা মস্তিষ্কটাও অবসরে যায়। এই সময়টায় একা থাকতে ইচ্ছে তো করছে না অয়নন্দিতার। কিন্তু তাকে থাকতে হচ্ছে। কারণ সে এখানে হানিমুন কিংবা ঘুরার উদ্দেশ্যে আসেনি। এসেছে বরের সঙ্গে। আর বর এসেছে কাজের সূত্রে।
ফোনের শব্দটা কানে যেতেই রুমে প্রবেশ করে অয়নন্দিতা। ফারহান ফোন করেছে। রিসিভ করে হ্যালো বলার পর ফারহান প্রশ্ন করে,
‘বাইরে বের হওনি তো?’
অয়নন্দিতা না চাইতেও মুচকি হাসে। যদিও তার এই হাসি ফারহানের দৃষ্টি থেকে বহু দূরে। অয়নন্দিতা ফোন কানে নিয়েই বারান্দায় গিয়ে দাঁড়ায়। বেতের সিঙ্গেল সোফায় বসতে বসতে জবাব দেয়,
‘নাহ। বের হইনি।’
‘গুড। ভেরি গুড।’
‘বাইরে বের হয়েছি কি না এইটা জানার জন্য আমায় ফোন করেছেন?’
‘নাহ। তেমনটা নয়।’
‘আমার তো তেমনটাই মনে হচ্ছে।’
অয়নন্দিতার কন্ঠে কাঠিন্য ভাব। ফারহান ভাবছে, সে কি ফোন করে ভুল করেছে? নাকি অয়নন্দিতার কোনো কারণে মুড অফ। ফারহান কিছু বলার মতো কথা খুঁজে পায়নি। তাই, এসে কথা বলব বলে ফোন রেখে দেয়। অয়নন্দিতাও উচ্চবাচ্য করেনি। ফোনটা পাশে রেখে দূরে অবস্থিত পাহাড়ের দিকে তাকিয়ে কিছু খোঁজ করার বাহানা করছে।
ঘড়িতে যখন রাত দেড়টা। ফারহান তখন রুমে আসে। সারাদিনের সমস্ত কাজ শেষ করে রুমে ফিরতে যে তার এত দেরি হতে পারে এটা তার কল্পনাতেই ছিল না। পুরো রুম অন্ধকার। ছোটো বাতিটা নীল রঙা আলো ছড়াচ্ছে। সেই আলোতেই ফারহান অয়নন্দিতাকে দেখতে পায়। অয়নন্দিতা ঘুমোচ্ছে। দেখে মনে হচ্ছে গভীর ঘুমের অতলে ঢুবে আছে সে।
রিসিপশন থেকে জানতে পেরেছে অয়নন্দিতা রাতের খাবার খায়নি। সন্ধ্যায় নাস্তা বলতে এক মগ কোল্ড কফি। এর বেশি আর কিছুই না। অয়নন্দিতা কাজটা না করলেও পার‍ত। এভাবে না খেয়ে ঘুমোনো উচিত হয়নি তার। ফারহান নিজের প্রতিও বিরক্ত। আরও আগে আসা উচিত ছিল তার। এখানে এভাবে একটা রুমে একটা মেয়ে কতক্ষণ একা একা থাকবে? তার জীবনে ভুলের শেষ নেই। এই ভুল-ই তার জীবনটাকে শেষ করে দিয়েছে। এখন যদিও বা কিছুটা ঠিক হতে নিচ্ছে কিন্তু তার ভুল আবারও হচ্ছে।
বেঘোরে ঘুমোনো অয়নন্দিতার চাহনি দেখতে ব্যস্ত ফারহান। সেও আর কিছু খায়নি। ফ্রেশ হয়ে পাশের খালি জায়গায় শুয়ে পড়ে। ভাবছে, অয়নন্দিতা ভুল করেনি তো তাকে বিয়ে করে। কিংবা সে ভুল করেনি তো নিজের সঙ্গে আবারও নতুন করে কাউকে জড়িয়ে। বাবা-মায়ের কথায় অয়নন্দিতাকে কি কেবল সঙ্গ দেবার জন্যই নিজের জীবনে নিয়ে এসেছিল? মনের মধ্যে কতশত প্রশ্নের ছুটোছুটি। কিন্তু স্থির হয়ে উত্তর খুঁজে বের করার সেই সময় এবং ইচ্ছা কোনোটাই নেই তার।

‘এইযে শুনছেন, হ্যালো। এইযে অয়নন্দিতা। শুনছেন?’
কারো ডাকে অয়নন্দিতা দাঁড়িয়ে যায়। থেমে গিয়ে পেছনে তাকায় সে। ইয়াসমিন নামের সেই নারীটা দাঁড়িয়ে আছে তার বিপরীতমুখী হয়ে। ভ্রু জোড়া হালকা উঁচু করে অয়নন্দিতা পা বাড়ায় ইয়াসমিনের দিকে। মেয়েটাকে আজ বেশ সুন্দর লাগছে। নেভী ব্লু রঙের একটা শাড়ি পরেছে।
দু’জন দু’জনার কাছাকাছি এসে কুশল বিনিময় করে। অয়নন্দিতা আজ বেশ সতর্কতা অবলম্বন করবে। ওইদিনের মতো আজ আর কোথাও যাবে না সে। ইয়াসমিনের সঙ্গে তো ভুলেও যাবে না।
ইয়াসমিন অয়নন্দিতার দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করে,
‘কেমন আছেন অয়নন্দিতা?’
‘এইতো ভালো আছি। আপনি কেমন আছেন?’
‘আমিও বেশ ভালো। কোথায় যাচ্ছেন?’
‘কোথাও না। এখানেই আছি।’
‘বর কোথায়?’
‘ব্যস্ত আছেন।’
‘রিসিপশনে শুনলাম আপনার বর নাকি আপনাকে খুঁজে না পেয়ে রাঙামাটির পুলিশ ফোর্স নামিয়ে ফেলেছিল।’
অয়নন্দিতা হালকা হেসে জবাব দেয়,
‘অনেকটা ওইরকমই।’
‘আমি থাকলে বলতাম। আমার জন্যই এত কিছু হয়ে গেল কয়েকঘন্টায়।’
‘ফোনটা নিয়ে গেলে এত ঝামেলা হতো না। আমি তো এখানে নতুন। সে ভেবেছিল যদি হারিয়ে যাই।’
‘এত ভালোবাসা!’
আবারও মুচকি হাসে অয়নন্দিতা। উত্তর দেয়,
‘হ্যাঁ। অনেক ভালোবাসা। যেই ভালোবাসার গভীরতা এতই বেশি যার তল পরিমাপ করার ক্ষমতা নেই।’
‘বাহ! আমার কর্তাও আমায় ভীষণ ভালোবাসে। চোখে হারায় আমায় সে। দুই বছরের সংসারে কখনও বুঝতেই দেয়নি যে আমাদের বিয়ের দুটো বছর পার হয়ে গেছে। আমার জন্য প্রতিটা দিনই সে স্পেশাল করে রেখেছে।’
‘আপনাকে ভীষণ সুন্দর লাগছে।’
‘তাই বুঝি?’
‘হ্যাঁ। নেভী ব্লু রঙের শাড়িতে অপূর্ব লাগছে।’
‘আপনাকেও ভীষণ ভীষণ ভীষণ সুন্দর লাগছে অয়নন্দিতা। হলুদ রঙের শাড়িতে আপনাকেও হলুদ ফুলের মতো লাগছে। বর দেখলে পাগল হয়ে যাবে।’
‘হয়তো।’
‘চলুন না ওপাশটায় যাই। কর্তা আজ মিটিংয়ে ব্যস্ত। বিকেলে ফিরবে।’
যত যাই হোক অয়নন্দিতা আজ কোথাও যাবে না।
‘নাহ গো। কোথাও যাব না। এখানেই একটু হাঁটাহাঁটি করি।’
‘কর্তার ভয়ে যাবেন না?’
‘ভয় না। শ্রদ্ধা বলতে পারেন। সেই সাথে ভালোবাসাও।’
ইয়াসমিনের এক জোড়া চোখ যেন অয়নন্দিতার চাহনির মাঝে কিছু একটা খুঁজছে। কিন্তু ব্যর্থ হতে হচ্ছে তাকে। খুঁজতে থাকা সেই কিছুটা খুঁজে পাওয়া ভীষণ কঠিন।

রিসোর্ট থেকে কিছুটা দূরে অবস্থান করছে ফারহান। পাশে বসে আছে অয়নন্দিতাও। বিকেলের শেষ সময়ে সমস্ত কাজে ইতি টেনে রিসোর্টে ফিরে আসতে সক্ষম হয় ফারহান। এসে অয়নন্দিতাকে নিয়ে বের হয়ে পড়ে। ফারহানের মনে হয়েছে এখন অন্তত কিছুটা সময় তাদের একত্রে অতিবাহিত করা উচিত। জীবনের খারাপ স্মৃতিগুলো আঁকড়ে ধরে থাকলে কোনো লাভ নেই। এতে কেবলই লসের পাল্লা ভারী হবে। অয়নন্দিতারও একটা জীবন আছে। মেয়েটা নিঃশব্দে সবটা মেনে নিয়েছে বলে তাকে সারাজীবন মানিয়ে নেওয়ার মতো জীবন উপহার দেওয়া ঠিক হবে না। সবকিছুই উপলব্ধি করতে হয়েছে ফারহানকে।
তাদের দু’জনের মাঝে নীরবতা এসে বাসা বেঁধেছে। এই মুহুর্তের পরিবেশটা নীরবতায় ছেয়ে আছে। নীরবতায় ছেয়ে থাকা পরিবেশটা যেন গুমোট হয়ে আছে। ফারহানের মস্তিষ্কে ঘুরঘুর করছে কিছু শব্দ। শব্দগুলো বলতে পারলে সে ভেতরগত ভাবে শান্তি পেলেও পেতে পারে। পাশ ফিরে যখন অয়নন্দিতার দিকে তাকায় অয়নন্দিতা তখন চুপচাপ অন্ধকার দেখছে।
মস্তিষ্কে ঘুরপাক খাওয়া শব্দগুলো বের হয় ফারহানের কণ্ঠনালী দিয়ে।
‘চুপচাপ থাকার ব্রত করবে আজ?’
খানিকটা অবাক হয়ে তাকায় অয়নন্দিতা ফারহানের চোখের দিকে। সে তো বরাবরই চুপচাপ থাকে। কে জানে ফারহানের কেন মনে হয়েছে যে, স্পেশালভাবে আজই সে চুপচাপ আছে।
‘ব্রত করার মতো তেমন কিছু ঘটেনি।’
‘তবে নীরব কেন?’
‘আঁধার দেখছি।’
‘তুমি কি কোনো বিষয় নিয়ে আমার সঙ্গে রেগে আছো?’
‘নাহ। একদমই না।’
‘আচ্ছা।’

খানিকক্ষণের নীরবতা শেষে ফারহান একটা ছোটো নিঃশ্বাস গোপনে বাতাসে মিলিয়ে দেয়। প্রশ্ন করে,
‘কখনও ভালোবেসেছ কাউকে?’
অয়নন্দিতা অবাক হয়নি। স্বাভাবিক ভঙ্গিতেই জবাব দেয়,
‘তেমন করে ভালোবাসার সুযোগ হয়নি।’
‘সুযোগ হলে বাসতে?’
‘চেষ্টা করতাম। তবে খাটি ভালোবাসা খুঁজতাম। অপাত্রে ভালোবাসা দান করব কেন?’
‘অপাত্রে ভালোবাসা দান করা সত্যিই বোকামি। আমার মতো বোকারাই কেবল এই বোকামি করে।’
অয়নন্দিতা একদৃষ্টে তাকিয়ে আছে ফারহানের দিকে। ফারহানের নজর তখন দূরের পাহাড়ের শীর্ষ চূড়ায়।
‘আমার ভালোবাসা দান না করে আমি বোধ হয় ভালোই করেছি। আমার সকল ভালোবাসার অধিকার কেবলমাত্র একজনের জন্যে। আর সে আমার পাশেই বসে আছে।’
চমকিত নজরে ফারহান তাকায় অয়নন্দিতার মুখপানে। অয়নন্দিতা হাসিমুখে বলতে শুরু করে,
‘চলার পথে কাটা থাকবে। অনেক সময় পায়েও বিঁধবে। ব্যথাও লাগবে, রক্তও ঝরবে। তবুও এগিয়ে যেতে হবে। সত্যিকারের ভালোবাসা ধরা পড়বেই। একদিন আগে হোক আর একদিন পরে হোক। আপনার ভালোবাসা থেকে খানিকটা ভালোবাসা আমার পেছনে ইনভেস্ট করতে পারেন। লাভ না হলেও লস হবে না আশা করি।’

চলবে………………………….