দ্বিতীয় সূচনা পর্ব-১৩+১৪+১৫

0
451

#দ্বিতীয়_সূচনা
#পর্ব_১৩
লেখা – আফরোজা আক্তার
(কোনোক্রমেই কপি করা যাবে না)

আলহামদুলিল্লাহ কবুল শব্দটা ভীষণ সহজ কিন্তু এর অর্থ বেশ শক্ত। আলহামদুলিল্লাহ কবুল শুধু একটা শব্দ না। সারাজীবনের দায়িত্ব। এমন এক দায়িত্ব যা সারাজীবন পালন করতে হয় উভয়কেই।
অয়নন্দিতা বসে আছে। ফারহান বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছে৷ অয়নন্দিতা বিয়ে নিয়ে কখনও তেমন কিছু ভাবেনি। ভাবেনি তার জীবনে এমন একজন আসবে। দুই একজন বান্ধবীর কাছ থেকে বিয়ে, সংসার, স্বামী, দায়িত্ব এইসব সম্পর্কে শুনেছে। আগে বাবা-মায়ের সংসারে খুনসুটি দেখেছে। এরপর মামা-মামীর সংসার। ভাইয়া-ভাবীর টক ঝাল মিষ্টি সম্পর্কের সাক্ষী সে। কিন্তু কখনও ভাবেনি নিজেরও সংসার করতে হবে। নিজেরও স্বামী হবে। ঘর হবে। আজ তার সবই হয়েছে। আনন্দের চাইতে ভয়টাই বেশি। নিজেকে প্রস্তুত হতে হবে সব কিছুর জন্য। সংসার করতে হবে বুঝে-শুনে। স্বামীর সব কিছুতে নজর রাখতে হবে।
বিছানায় বসে বসে এসবই ভাবছিল অয়নন্দিতা। ঘরটা বেশ সুন্দর। দেখে বোঝা যাচ্ছে তার স্বামী রুচিসম্মত আসবাবপত্রে অভ্যস্ত। অয়নন্দিতা কিছুক্ষণ পর বুঝতে পারে সে এসি’র নিচে বসে আছে। তার মানে তার ঘরে এসিও আছে। সে বার বার তাকাচ্ছে বারান্দার দরজার দিকে। ফারহান তখনও বারান্দায়। এদিকে শাড়ি পরে তার যেন দম আসে আর যায় অবস্থা। এসব পরে থাকার তো মানেই হয় না। লাগেজ খুলে পুরো লাগেজে চোখ বুলায় অয়নন্দিতা। একটা নরম সুতি শাড়ি পরলে ভালো হয়। আসার সময় মামী বার বার বলে দিয়েছে দুই তিন দিন এই বাড়িতে শাড়ি পরতে। পরে থ্রিপিস পরা যাবে। মামীর কথা অনুযায়ী অয়নন্দিতা একটা সুতি শাড়ি বের করে। আয়নার সামনে গিয়ে দাঁড়ায় সে। এক এক করে গহনাগুলো খুলে ফেলে নিঃশব্দে। একটা গোসল দিলে অনেক ভালো হবে। এটা অবশ্য অয়নন্দিতার ভাবনা। দোপাট্টা খুলে বিছানায় রেখে টাওয়াল নিয়ে ওয়াসরুমে যায় অয়নন্দিতার। ওয়াসরুমটা বেশ বড়ো আর ভীষণ সুন্দর। অয়নন্দিতা কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে পুরো ওয়াসরুমের দিকে তাকিয়ে থাকে।
ফারহান অলরেডি ছয়টা সিগারেট টেনেছে। রাতটা সুন্দর হলেও তার অসহ্য লাগছে। আজকে জোছনা কিন্তু জোছনাটাকেও বিরক্ত লাগছে তার কাছে। বন্দনার কথা বার বার মনে পড়ছে। বিয়ে পড়ানোর সময়ও বন্দনাকে ভীষণ মিস করেছে সে। একই রকম একটা দিন, একই রকম একটা রাত। জোছনাটাও অদ্ভুতভাবে মিলে গেছে। সেও একই আছে। শুধু নারী চরিত্রটা বদলে গেছে। আজ কেন যেন মন থেকে সরাতে পারছে না বন্দনাকে। মাঝে মাঝে নিজের ওপর সে ভীষণ বিরক্ত হয়। এই মন নামক অদৃশ্য অনুভূতিটাকে যদি খুন করা যেত তাহলে ফারহান সবার আগে এই মনটাকেই খুন করে ফেলত। মেরে ফেলত সমস্ত অনুভূতিকে। বন্দনা তাকে ছেড়ে কেন চলে গেল এই প্রশ্নটা আজও ঘুরপাক খায়। কিন্তু উত্তর পাওয়ার উপায় নেই।
এমন সময় ফোনের রিংটোন বেজে ওঠে। ফারহান দেখতে পায় ফোনের স্ক্রিনে শরীফের নাম্বার ভাসছে। একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে ফোনটা রিসিভ করে ফারহান। বলে,
‘হ্যালো।’
‘হ্যাঁ। কী অবস্থা বন্ধু। মধুরাত কেমন কাটছে।’
শরীফের কথায় হালকা মলিন হাসে ফারহান। বলে,
‘মধুরাতে কর্মরত থাকলে কি আর তোর ফোন রিসিভ করি আমি?’
ফারহানের কথায় ফাইযলামি থাকলেও শরীফ বুঝতে পেরেছে ফারহান এখনও অয়নন্দিতার সাথে কথা বলেনি।
নিজেই প্রশ্ন করে,
‘অয়নন্দিতার সাথে কথা বলিসনি এখনও?’
‘নাহ। বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছি।’
‘সিগারেট টানছিস নিশ্চয়ই।’
‘হ্যাঁ ছয়টা শেষ করলাম।’
‘তোর মাথা ঠিকাছে?’
‘ভালো লাগে না রে। বিশ্বাস কর, এই বিয়েটা করেছি একমাত্র মা-বাবার জন্য। অয়নন্দিতা মেয়েটা ভালো। ভীষণ শান্ত আর চুপচাপ। তাই ভাবলাম ওকে বিয়ে করলে এটলিস্ট রোজ রোজ বিয়ের প্যারা থেকে বেঁচে যাব।’
‘পাগল নাকি তুই ফারহান। যা কথা বল ওর সাথে। আই থিংক তোর ভালো লাগবে। আমার ছাত্রী বলে বলছি না। মেয়েটার দিকে দু’দন্ড তাকা। দেখবি তোর অস্থির মন শান্ত হয়ে যাবে।’
‘কিছুতেই তাকে মন থেকে সরাতে পারছি না। কিছুতেই না। আজকে আরও বেশি করে মনে পড়ছে আমার। আমিই কি একমাত্র প্রেমিক পুরুষ যে কি না এমন পাগলের মতো ভালোবেসেছিলাম তাকে। চলে গেল আমায় ফেলে রেখে। আর এত দূরেই গেল যে ফিরে এলো না।’
সামনে থাকলে ফারহানকে দুইটা চড় বসাতো শরীফ। আফসোস সামনে নেই। নিজেকে যতটা সম্ভব সংযত রেখে ফারহানকে কিছু কথা বলে ফোন রাখে সে।

ফারহান ঘরে এসে অন্যকিছু আবিষ্কার করে। সে যেমনটা ভেবেছিল, এখনও হয়তো বারান্দা থেকে এসে দেখবে অয়নন্দিতা পূর্বের মতো বসে থাকবে। কিন্তু নাহ, ফারহান ঘরে ঢুকেই চমকে গেছে। ততক্ষণে অয়নন্দিতা অনেকগুলো কাজ শেষ করেছে। গোসল করেছে, গহনাগুলো গুছিয়ে এক পাশে রেখেছে। লেহেঙ্গাটা অন্যপাশে রেখেছে। বিছানার ওপর থেকে ফুলগুলো সরিয়ে ফেলেছে। একদম টিপটপ হয়ে গেছে। ফারহানের মুখ থেকে আচমকাই বের হয়ে যায়,
‘কী করছেন আপনি?’
অয়নন্দিতা পেছনের দিকে তাকায়। ফারহান অয়নন্দিতার দিকে তাকিয়ে আছে। অয়নন্দিতাকে আরও সুন্দর লাগছে। বিনা মেকআপে মেয়েটাকে ভীষণ সুন্দর লাগে এর প্রমাণ অবশ্য সে আরও আগেই পেয়েছিল। তবে আজ আরও সুন্দর লাগছে। দু’হাতে লাল রঙা মেহেদী যেন হাতের সৌন্দর্য বাড়িয়ে দিয়েছে। হালকা মিন্ট কালারের শাড়িটায় অপূর্ব লাগছিল অয়নন্দিতাকে। ফারহান এতক্ষণে বুঝতে পেরেছে শরীফ তাকে ভুল কিছু বলেনি। মেয়েটার মধ্যে আসলেই তেমন কোনো ব্যাপার আছে। অয়নন্দিতা হালকা হেসে বলে,
‘আপনি তো বারান্দায় ছিলেন। আমারও গা গোলাচ্ছিল। তাই শাওয়ার নিয়ে নিলাম। সব গুছিয়ে রাখলাম। ভাবলাম আপনি ঘুমাবেন অথচ বিছানায় ফুলের ছড়াছড়ি। তাই সেইগুলোও সরিয়ে দিলাম। এখন ঘুমোতে আর অসুবিধা হবে না৷’
অয়নন্দিতার কোনো কথাতেই তার ইন্টারেস্ট নেই। সে আপাতত অয়নন্দিতার প্রশংসা করছে,
‘শাড়িটায় আপনাকে ভীষণ সুন্দর লাগছে।’
অয়নন্দিতাও হাসিমাখা মুখে ধন্যবাদ জানায় ফারহানকে।
‘আমি ফ্রেশ হয়ে আসছি। আপনি ঘুমাবেন না কিন্তু।’
মাথা দোলায় অয়নন্দিতা। হ্যাঁ সূচক ইশারা পেয়ে ফারহান টাওয়াল নিয়ে ওয়াসররুমে চলে যায়।

ঠিক একই জায়গায় দাঁড়ায় অয়নন্দিতা। আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে সে। বারান্দাটা দক্ষিণ দিকে অবস্থিত বলে এখানে খুব সহজেই বাতাস আসে। বারান্দায় দাঁড়ালে প্রাকৃতিক বাতাসে মন ভরে যায়। এই বাতাস যেন এসি’র বাতাসকেও হার মানায়।
ফারহান চুপিসারে অয়নন্দিতার পাশে এসেই দাঁড়ায়। ফারহানের উপস্থিত নিজের পাশে টের পেয়ে অয়নন্দিতাও পাশ ফিরে তাকায়।
‘আপনি কিন্তু আমার প্রশ্নের উত্তর দিলেন না।’
অবাক নয়নে তাকায় অয়নন্দিতা।
‘কোন প্রশ্ন?’
‘ওই যে পরশু জিজ্ঞেস করলাম, আপনাকে কী বলে ডাকব?’
ফারহানের কথায় মুচকি হাসে অয়নন্দিতা।
‘আমি কিন্তু উত্তরটা সেদিনই দিয়েছিলাম।’
‘কখন, কোথায়?’
‘ওই যে, যে নামে ডেকে আপনার মন ভরবে।’
‘একেক সময় একেক নামে ডকব। কখনও অয়নন্দিতা, কখনও অয়নি, কখনও বা মিসেস শেখ। চলবে?’
এবার একটু শব্দ করেই হাসে অয়নন্দিতা
‘আচ্ছা। চলবে।’
‘আচ্ছা আমি কি তুমিতে যেতে পারি নাকি আপনিতেই থাকব।’
‘মানে?’
‘মানে, এইযে আমরা একে অপরকে আপনি আজ্ঞে করছি। এটা কি তুমিতে বদলানো যায়?’
‘আপনি তুমি বলতে পারেন। সমস্যা নেই।’
ফারহান অনুমতি পায়। কিন্তু অয়নন্দিতা, সে কি তুমি ডাকবে তাকে? প্রশ্নটা খচ খচ করছে মনে।
‘তুমি ডাকবে না?’
‘অভ্যেস নেই তো। আস্তে আস্তে ঠিক হয়ে যাবে। আই মিন আমি চেষ্টা করব।’
ফারহানের মনে হচ্ছে অয়নন্দিতা খুব ম্যাচিওর। তার কথাবার্তার ভাব ভঙ্গি অন্যরকম। অয়নন্দিতাকে বুঝিয়ে বললে সে বুঝবে। আর ফারহান এই সুযোগটাই কাজে লাগাবে।

কিছুক্ষণের বিরতির পর ফারহান অয়নন্দিতার হাত ধরে। এতে অয়নন্দিতা চমকে গেলেও নিজেকে সামলে নিয়েছে বেশ। ফারহান অয়নন্দিতার চোখের দিকে চেয়ে বলল,
‘ঘরে চলো। কিছু কথা বলব তোমায়।’
ফারহানের আমন্ত্রণে ঘরে যায় অয়নন্দিতা। বিছানায় বসতেই ফারহান তার পাশে এসে বসে। বুকটা ধক করে ওঠে অয়নন্দিতার। এত দ্রুতই ফারহান তার এত কাছে চলে আসবে সে ভাবেনি। তবে ভেবে আর কাজ কী। ফারহান তার স্বামী। আর সে ফারহানের স্ত্রী। স্বামীর সব চাহিদা মেটানো একজন স্ত্রীর কর্তব্য। গতকাল রাতে মামী আর খালা মিলে সব বুঝিয়ে দিয়েছে তাকে। তারা এটাও বলেছে যদি, তার নিজের ভালো লাগে বা সম্মতি থাকে তাহলে ফারহান তাকে স্পর্শ করলেও সে যাতে সাড়া দেয়। অয়নন্দিতাও সেই পরামর্শ অনুযায়ী চলবে বলে ঠিক করে।
ফারহান দ্বিতীয়বারের মতো অয়নন্দিতার হাত ধরে। অয়নন্দিতা এবার আর চমকায়নি। এবার সম্পূর্ণ প্রস্তুতি নিয়ে রেখেছে। সে আজ এই মধুরাতে তার বরকে সঙ্গ দেবে। মন উজাড় করে, নিজেকে উজাড় করে সঙ্গ দেবে।

চলবে……………………….

#দ্বিতীয়_সূচনা
#পর্ব_১৪
লেখা – আফরোজা আক্তার
(কোনোক্রমেই কপি করা যাবে না)

গতকালকের রাতটা বেশ সুন্দর ছিল। বিশেষ করে অয়নন্দিতার কাছে অন্যরকম লেগেছে। রাতের প্রায় অর্ধেকটা সময় সে আর ফারহান গল্প করেছে। ফারহান তার নিজের কিছু অভিজ্ঞতা শেয়ার করেছে সেই সাথে নিজের ভালো লাগা, মন্দ লাগার কথা জানিয়েছে অয়নন্দিতাকে। অয়নন্দিতাও নিজের বাবা-মায়ের গল্প করেছে। খানিকটা সময় ধরে কেঁদেছেও।
অয়নন্দিতার আরও ভালো লেগেছে যে, ফারহান তাকে সব থেকে জরুরী কথাটা খুব অনায়াসে বলে দিয়েছে। অয়নন্দিতাও তার মতো করেই সবটা বুঝে নিয়েছে। ভবিষ্যতে আর কোনো ঝামেলা হবে না এইসব বিষয় নিয়ে।
সকাল সকাল সাজি এসে বকবক শুরু করে দিয়েছে। অয়নন্দিতা গোলাপি রঙের একটা জামদানী পরেছে। চুলগুলো ভারী হওয়ায় খোঁপাটা বেশ বড়ো হয় তার। অয়নন্দিতার খোঁপা দেখে সাজি বলে ওঠে,
‘খোঁপাটা বড্ড খালি খালি লাগছে। ফুল নিয়ে আসি?’
অয়নন্দিতাও হালকা হেসে জবাব দেয়,
‘কোথা থেকে আনবে আর কী ফুল আনবে?’
‘বাগান থেকে। বাগানে গোলাপ ফুল ফুটেছে।’
‘নাহ থাক। এমনিতেই ভালো লাগছে। গোলাপ ফুল দিলে কেমন পিকুলিয়ার পিকুলিয়ার লাগবে।’
‘অবশ্য তোমায় এমনিতেও সুন্দর লাগে।’
‘তোমাকে আমার থেকেও বেশি সুন্দর লাগে।’
তাদের দু’জনের কথার মাঝেই ফারহানের প্রবেশ ঘটে। ঘরে ঢুকেই ফারহান অবাক চোখে তাকায় অয়নন্দিতার দিকে। এই শাড়িতে ভীষণ সুন্দর লাগছে অয়নন্দিতাকে।অয়নন্দিতার নজরও ফারহানের দিকে। কালো শার্টে ফারহানকে দারুণ মানিয়েছে।
ভাইকে ঘরে ঢুকতে দেখে সাজি বের হয়ে যায়। সআজি বের হলে ফারহান ধীর গতিতে ড্রেসিং টেবিল অবধি আসে। চোখ রাখে অয়নন্দিতার চোখের দিকে। অয়নন্দিতা তখন হালকা হেসে বলে,
‘কোথায় চলে গিয়েছিলেন?’
‘যাইনি কোথাও। নিচেই ছিলাম।’
‘ওহ।’
‘সাজি একটু বেশি কথা বলে। যদিও ও খুব ফ্রী মাইন্ডের একজন মানুষ। সবার সঙ্গে খুব সহজেই মিশে যায়।’
‘আমারও ভীষণ ভালো লেগেছে সাজিকে। লক্ষ্মী আর মিষ্টি একটা মেয়ে।’
‘তুমি রেডি হয়ে গেছ।’
‘হ্যাঁ। আমি রেডি। একবার অবশ্য নিচে গিয়েছিলাম। মা বলল আমি যেন গোসল করে রেডি হয়ে যাই।’
‘মা! কোন মা?’
‘কোন মা মানে? আপনার মা। আমাকেও মা ডাকতে বলা হয়েছে। তাই আমিও ডাকলাম মা।’
‘কেউ না বলে দিলে ডাকতে না বুঝি?’
‘অবশ্যই ডাকতাম। আমার মা নেই। এখন থেকে উনিই আমার মা।’
ফারহানের হঠাৎই কিছু কথা মনে পড়ে যায়।
‘তুমি আমার মাকে আন্টি কেন ডাকো?’
‘আন্টি কি খারাপ নাকি বলো, আন্টি ডাকলে সমস্যা কোথায়?’
‘আমার মা তো তোমার শাশুড়ি। তাই না? শাশুড়িকে মা ডাকতে হয়৷’
‘আমার নিজের মা তো আছে। নিজের মা থাকতে আবার অন্য একজনকে কেন মা ডাকতে যাব?’
‘অন্য একজন মানে? কে অন্য একজন?’
‘তোমার মা তো আমার আপন কেউ নন। তিনি তো অন্য একজনই। তাই না?’
ফারহান আচমকাই তার চোখ জোড়া বন্ধ করে ফেলে। এদিক থেকে তাদের দু’জনের মাঝে খানিক গড়মিল আছে। দু’জনের চিন্তায় গড়মিল।

দুই দিন পর।
সবাই মিলে নাস্তার টেবিলে বসেছে। অয়নন্দিতাও এই দুই দিনে নিজেকে সবার সঙ্গে মানিয়ে নেওয়ার চেনা করছে। ধরেই সবার সঙ্গে মানিয়ে নেওয়া যায় না। একটু সময় লাগে। সেই অনুযায়ী অয়নন্দিতা অনেকটাই পেরেছে নিজেক সবার মতো করে মানিয়ে নিতে।
রমজান শেখ ব্রেডে বাটার লাগাতে লাগাতে ছেলের দিকে তাকান। এরপর বলেন,
‘এই শুক্রবার তোমার রাঙামাটি যাওয়ার কথা। মনে আছে তো ফারহান?’
বাবার কথা শুনে মুখ উপরে তুলে তাকায় ফারহান। গত চার/পাঁচ দিনের ব্যস্ততায় মাথা থেকে একেবারেই বের হয়ে গিয়েছিল যে তাকে একটা মিটিংয়ের জন্য এই শুক্রবার রাঙামাটি যেতে হবে। ভাগ্যিস বাবা মনে করিয়ে দিয়েছে। ফারহান মাথা নেড়ে সায় দেয়। রমজান শেখ ছেলের ইশারা পেয়ে বলে,
‘অয়নন্দিতাকেও সাথে নিয়ে যেও। মিটিং শেষ করে অয়নন্দিতাকে নিয়ে চারপাশের জায়গাগুলো ঘুরে এসো।’
ফারহান এতটাও আশা করেনি যা তার বাবা বলেছে।
‘কিন্তু বাবা, আমি সেখানে ব্যস্ত থাকব। ওকে কীভাবে সময় দেব?’
‘আমরা বিজনেসম্যানরা কতটুকুই বা সময় পাই ফারহান। এর মাঝেই নিজের প্রিয়জনকে সময় দিতে হয়েছে। কিংবা এখনও দিতে হয়। তোমার মায়ের সঙ্গেও আমি এভাবেই সময় কাটিয়েছি। ভবিষ্যতে ফারাশকেও এই পথেই চলতে হবে। মিটিং শেষে কয়েকদিন সেখানে বেড়াবে তোমরা। এখানকার আমি ফারাশকে বুঝিয়ে দেব।’
‘ফারাশ কাজ বুঝে নেবে?’
‘অফ কোর্স বুঝে নেবে। কম বড়ো তো হয়নি। একদিন দেখবে হুট করেই এসে বলবে বাবা আমি বিয়ে করব। তা বিয়ে যে করবে বেকার ছেলের কাছে মেয়ে দিবে কে?’
ফারাশ খাওয়া বন্ধ করে দিয়ে হা করে তাকিয়ে থাকে বাবা আর ভাইয়ের দিকে। অন্য একটা কারণে ফারাশের মুখে চিন্তার ভাব পড়ে। কপাল কুঁচকে যায় তার। যা স্পষ্ট ভাবে ধরা পড়ে অয়নন্দিতার চোখে। রমজান শেখ ঠোঁটের কোণে হালকা হাসি মেখে ছোটো ছেলের দিলে তাকান। এরপর খেতে খেতে বলেন,
‘ফারহান, একটা নিউজ কানে এসেছে তো।’
‘হোয়াট?’
‘তোমার ভাই নাকি মেয়ে নিয়ে ঘুরে।’
‘কীহ?’
‘জি, তোমার ভাই। ফারাশ শেখ। মেয়ে নিয়ে ঘোরাঘুরি করে।’
ফারাশ এতক্ষণ যেই ভয় পেয়েছিল সেটাই হয়েছে। তার মানে নায়া’র খবর তার বাবার কানে পৌঁছে গেছে। ফারহান একবার তার বাবার দিকে তাকায় আবার তার ভাইয়ের দিকে তাকায়। আবার চোখ চলে যায় তার মায়ের দিকে। রওশন বেগমও চোখের ইশারায় জানান দেয় ঘটনা সত্য। এবার ফারহান বলা শুরু করে,
‘ঘটনা সত্যি নাকি ফারাশ?’
না জানার ভঙ্গি নিয়ে ফারাশ জবাব দেয়,
‘কীসের ঘটনা ভাইয়া?’
‘এই যে মেয়ে ঘটিত ঘটনা।’
‘এইসব ভুয়া কথা। বানোয়াট। এমন কিছুই না।’
এমন সময় রমজান শেখ রওশন বেগমকে বলেন,
‘হ্যাঁ গো, আমাদের কি জমজ ছেলে ছিল নাকি?’
‘আগে জানতাম ছিল না। এখন তো মনে হচ্ছে ছিল।’
ফারহান না হাসলেও অয়নন্দিতার বেশ হাসি পাচ্ছে। এদের সবার মধ্যে সবার বন্ডিংটা অয়নন্দিতার বেশি ভালো লাগছে।
এরই মাঝে রমজান শেখ বললেন,
‘সবই যদি বানোয়াট হবে তাহলে আমি আর তোমার মা বোধ হয় বসুন্ধরায় ফুড কোর্টে অন্য আরেকজনকে দেখেছিলাম যে অনেকটাই তোমার মতো। অনেকটা বলতে কি, পুরোটাই তোমার মতো। বলতে গেলে লুক আ লাইক।’
ফারাশ বুঝে গেছে আর লুকিয়েও কোনো লাভ নেই। তাকে স্বয়ং তার পিতা এবং মাতা দু’জনেই দেখে ফেলেছে। ফারাশ ভাবছে এখান থেকে কেটে পড়া যায় কীভাবে।
মরার ওপর খাড়ার ঘা বলে একটা কথা আছে। এখানেও সেটা প্রযোজ্য হয়ে গেছে। নায়া ফোন করেছে। ফারাশ এক্সিউজ মি বলে উঠেই দ্রুত গতিতে বাড়ি থেকে বের হয়ে যায়। রমজান শেখ এবং রওশন বেগম দু’জনেই হাসছেন। ভাবছেন কিছুদিন পর নতুন সদস্য আরেকজন আসতে চলেছে তাদের সংসারে।

রাত প্রায় বারোটা। ফারহান অয়নন্দিতার পাশেই শুয়ে আছে। অয়নন্দিতা না বলছে কথা না নড়ছে। একদম চুপচাপ পড়ে আছে ওপাশে মুখ করে। ঘুমিয়ে আছে কি না তাও বোঝা যাচ্ছে না। ফারহান ভাবছে, অয়নন্দিতাকে নিয়ে কি তার রাঙামাটি যাওয়া উচিত হবে? আবার ভাবছে, না নিয়ে গিয়েও উপায় নেই। যেখানে বাবা বলে দিয়েছে। কিন্তু অয়নন্দিতা কী চায়? সে কি যেতে চাইবে ফারহানের সঙ্গে?
অয়নন্দিতাকে ডাকবে কি ডাকবে না, জিজ্ঞেস করবে কি করবে না ভাবছে ফারহান। মনে মনে বলছে, মেয়েটা এত ঘুম পাগল কেন? মনে হচ্ছে ঘুম ছাড়া দুনিয়ায় আর কিছুই নেই।

চলবে………………..

#দ্বিতীয়_সূচনা
#পর্ব_১৫
লেখা – আফরোজা আক্তার
(কোনোক্রমেই কপি করা যাবে না)

টাওয়ালে চুলের পানি নিতে নিতে ফোনে হাত রাখে অয়নন্দিতা। ফোন হাতে নিয়েই বেশ ভালো ধাক্কা খায় সে। ২৫ টা মিসডকল। তাও আবার ফারহানের ফোন থেকে। একবার ফোন ব্যাক করা উচিত কি না তাই ভাবছে অয়নন্দিতা। রীতিমতো ভয় পাচ্ছে তার। কারণ, এতবার ফোন করার পরেও সে রিসিভ করতে পারেনি। তবে এতে অয়নন্দিতারও দোষ নেই। সে শাওয়ার নিচ্ছিল। ফারহান তাকে ফোন করেছে প্রায় আধা ঘন্টা হয়ে গেছে। এখন ফোন দিলে যদি রাগ করে। অন্যদিকে তাকে একটু বেরও হতে হবে। শাম্মির সঙ্গে একবার দেখা করতে হবে। সকালে অবশ্য শাশুড়িকে বলেছিল। শাশুড়ি মা অনায়াসেই রাজি হয়েছে। ফারহানের কাছ থেকে অনুমতি নেওয়াটাই বাকি ছিল। শাওয়ার নিয়ে ফোন করে জানাবে ভেবেছিল। কিন্তু এখন দেখছে সব উল্টো হয়ে গেল।
অয়নন্দিতা ভয়ে ভয়েই ফোন ব্যাক করে। দুইবাত রিং বেজে যেতেই ফোন রিসিভ হয়।
‘হ্যালো।’
ফারহানের হ্যালো শব্দটা বেশ স্পষ্ট ভাবেই কানে লাগে অয়নন্দিতার। ফোনে ফারহানের কন্ঠস্বর বেশ সুন্দর শোনায়। অয়নন্দিতার এমনিতেও ভারী কন্ঠের পুরুষ ভালো লাগত। তার বাবারও ভারী কন্ঠ ছিল৷ আল্লাহ পাক তাকে তার বাবার মতোই একজন মিলিয়ে দিয়েছিল।
অয়নন্দিতা হ্যালোর জবাবে সালাম দিলে ফারহান সেই সালামের জবাব নেয়। অয়নন্দিতা সাফাই দিতে যেতেই ফারহান বলে ওঠে,
‘তুমি ওয়াশরুমে ছিলে। তাই রিসিভ করতে পারোনি।’
অয়নন্দিতা একটু অবাকই হয়েছে। প্রশ্ন করে,
‘আপনি কী করে জানলেন?’
‘ফোন রিসিভ করছিলে না। তাই সাজিকে পাঠিয়েছিলাম ঘরে। ও-ই বলল তুমি ওয়াসরুমে। শাওয়ার নিচ্ছিলে।’
‘ওহ। আচ্ছা বলুন। জরুরী কিছু বলবেন?’
‘কেন, জরুরী না হলে কি ফোন দেয়া যায় না?’
‘নাহ। তা কেন হবে। এমনিই জিজ্ঞেস করলাম আর কি।’
‘পরশু শুক্রবার। আমরা রাঙামাটি যাচ্ছি। কেমন?’
‘আমি গেলে কোনো অসুবিধা হবে না তো?’
‘নাহ। তেমন কোনো অসুবিধা হবে না। তবে তোমার সমস্যা হতে পারে।’
‘যেমন?’
‘একাকী সময় পার করতে হবে।’
অয়নন্দিতাও হেসে সহমত পোষণ করে। ফারহান অয়নন্দিতার হাসির বিপরীতে বলে,
‘কী আর করা, হাসবেন্ড যদি বিজনেসম্যান হয় তাহলে এইটুকুন সেক্রিফাইজ করতেই হয়।’
‘সেক্রিফাইজে আমি ভয় পাই না।’
‘দেখা যাক তবে।’
‘একটা কথা বলার ছিল আমার।’
‘বলো।’
‘আমি একটু বাইরে যাব। এক ঘন্টার জন্য। শাম্মির সঙ্গে দেখা করব।’
‘শাম্মি, শাম্মি। ওহ হ্যাঁ, মনে পড়েছে তোনার বেস্ট ফ্রেন্ড।’
‘হ্যাঁ।’
‘আচ্ছা যাও। দেখা করে এসো। সাবধানে যেও। ড্রাইভারকে বলবে সাবধাবে ড্রাইভ করতে।’
‘আমি রিক্সা করে যেতে পারব। গাড়ি লাগবে না।’
‘নিচে গাড়ি রাখা আছে। গাড়িতেই যাও। কেমন?’
অয়নন্দিতা কথা বাড়াতে চায়নি তাই ফারহানের কথা মেনে নিয়েই কথোপকথনে ইতি টেনে দেয়।

রেস্টুরেন্টে মুখোমুখি অয়নন্দিতা আর শাম্মি। শাম্মি ভীষণ খুশি অয়নন্দিতাকে দেখে। শাম্মির বরাবরই এই বান্ধবীকে নিয়ে চিন্তা হতো। বাবা-মা ছাড়া এতিম মেয়েটা কোনোদিন যেন অবহেলায় না থাকে। অয়নন্দিতা তার মামা-মামীর সংসারে ভালো থাকলেও মনে যে তার অনেক কষ্ট ছিল তা বুঝত শাম্মি। তাই মনে প্রাণে চাইত সে ভালো থাকুক। আজ অয়নন্দিতাকে দেখে শাম্মিও বুঝতে পেরেছে সে ভালো আছে। বেশ ভালো আছে। সুখে আছে।
‘অয়নি, তোকে দেখতে মাশা-আল্লাহ খুব সুন্দর লাগছে।’
হালকা হেসে শাম্মির দিকে তাকায়। শাম্মি প্রশ্ন করে,
‘ভাইয়া কেমন রে অয়নি?’
‘হ্যাঁ ভালো।’
‘কেমন ভালো?’
‘কেমন ভালো মানে? মানুষ হিসেবে ভালো, স্বামী হিসেবে ভালো। সব দিক দিয়েই ভালো।’
‘যাক ভালো হলেই ভালো।’
অয়নন্দিতা ঘড়িতে নজর দিয়ে সময় দেখে নেয়। অনেকক্ষণ হয়ে গেছে সে বাইরে এসেছে। এবার চলে যাওয়া উচিত।
‘শাম্মি, চল বের হই। বাসায় বলে এসেছি অল্প কিছুক্ষণ থাকব৷ অনেকটা সময় পার হয়ে গেছে।’
‘এত তাড়া?’
‘ফারহান বাসায় এসে যদি না দেখে, মনে কষ্ট পাবে।’
‘বকাঝকা করবে নাকি?’
‘ধুর। নাহ। বকাঝকা করার মানুষ তিনি নন।’
‘ওকে। চল তবে।’
ওয়েটারকে ডেকে বিল মিটিয়ে রেস্টুরেন্ট থেকে বের হওয়ার জন্য পা বাড়ায়। এমন সময়-ই কেউ একজন পেছন থেকে ডেকে ওঠে,
‘মিসেস শেখ।’
ডাকটা শুনে অয়নন্দিতা পেছনে তাকায়। অবাক চোখে তাকিয়ে থাকে তার বিপরীতে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষটার দিকে। মনে মনে বলে, ফারহান! এখানে?

চলবে…………………………