দ্বিতীয় সূচনা পর্ব-২০+২১+২২+২৩+২৪+২৫

0
566

#দ্বিতীয়_সূচনা
#পর্ব_২০
লেখা – আফরোজা আক্তার
(কোনোক্রমেই কপি করা যাবে না)

রেস্টুরেন্টে বসে বসে অপেক্ষা করতে আর ভালো লাগছে না ফারহানের। সেই কখন অয়নন্দিতাকে বলা হয়েছে, কিন্তু সে এখনও আসেনি। ফারহান বার কয়েক ফোনও করেছে। এইতো আসছি — বলেই অয়নন্দিতা ফোন রেখেছে। কিন্তু আসা এখনও হয়নি। অফিসের বাকি কাজগুলো ফারাশকে বুঝিয়ে দিয়ে ফারহান বের হয়ে গেছে অফিস থেকে। পরিকল্পনা ছিল অয়নন্দিতাকে নিয়ে খানিকটা সময় ঘুরে বেড়াবে। কিন্তু তা আর হলো কই।
রাঙামাটি থেকেই তাদের সম্পর্কটা মোটামুটি সুন্দর হতে শুরু করে। জীবনে কখনও না কখনও দ্বিতীয় সূচনার প্রয়োজন পড়ে। জরুরি নয় যে, জীবনে প্রথম সূচনা-ই থাকতে হবে। কখনও কখনও প্রথম সূচনা সমাপ্তের পর দ্বিতীয় সূচনার প্রয়োজন হয়। ফারহানের জীবনেও দ্বিতীয় সূচনার প্রয়োজন ছিল। যা ঘটে গেল অয়নন্দিতার আগমনের মাধ্যমে।
অয়নন্দিতাও তার মতো করে সম্পর্কটাকে গোছানোর চেষ্টা করছে। সেও আশাবাদী, তার জীবনটাও সুখে ভরে উঠবে। ফারহানের ক্ষতস্থানে ভালোবাসার লেপ লাগিয়ে তাকে ভালো রাখার চেষ্টা করবে।

রেস্টুরেন্টে পা রাখতেই কর্ণারের টেবিলে ফারহানকে বসে থাকতে দেখে অয়নন্দিতা। যদিও ফারহানের মুখ ওপাশে ছিল কিন্তু অয়নন্দিতা ফারহানের পেছনের সাইড দেখেও চিনতে পারে যে মানুষটা তার বর। অয়নন্দিতা ধীর পায়ে হেঁটে ফারহানের পেছনে গিয়ে দাঁড়ায়।
ফারহান এক মনে ফোনে কী যেন দেখছে। পেছন থেকে উঁকি দিয়ে অয়নন্দিতা দেখতে পায় ফারহান ছবি দেখছে। অয়নন্দিতার ছবি। রাঙামাটিতে পাহাড়ের উপরে নীল শাড়ি পরা একটা ছবি। অয়নন্দিতার মনে পড়ে, ফারহানই তার ছবিটা তুলেছিল।
মুচকি হেসে ফারহানের কাঁধে হাত রাখে অয়নন্দিতা। এদিকে নিজের কাঁধে কারো স্পর্শ পড়ায় ফারহান মুহুর্তেই পেছনে তাকায়। অয়নন্দিতাকে তার সামনে দেখতে পেয়ে কিঞ্চিৎ আনন্দে হেসে ওঠে তার ওষ্ঠদ্বয়। অয়নন্দিতাও মুক্তোঝরানো হাসিমুখে তাকায় ফারহানের দিকে।
অয়নন্দিতা চেয়ারে বসতেই ফারহান প্রশ্ন করে,
‘এতক্ষণ লাগল এখানে আসতে?’
‘দুপুর টাইমে জ্যাম তো থাকবেই। তাই না। ব্যস্ত শহরে বসবাস আমাদের। ভুলে গেলে চলবে না।’
‘আমি আধাঘন্টা যাবত অপেক্ষা করছি।’
‘অপেক্ষার ফল মিঠা হয়। যাই হোক, অর্ডার করেছেন?’
সম্পর্কে উন্নতি ঘটলেও সম্বোধনটা এখনও আপনিতেই আটকে রেখেছে অয়নন্দিতা। ফারহান অবশ্য আপত্তি করেনি। আপনি আজ্ঞেতেও এক ধরনের ভালোবাসা মিশে থাকে।
‘আন্দাজে কী অর্ডার করব?’
‘ইশ! আগেভাগে অর্ডার করে দিবেন না। অর্ডার করে দিলে এতক্ষণে খাবার দিয়ে যেত।’
‘প্রবলেম নেই। এখানে খাবার দ্রুতই দেয়া হয়৷’
খাবার অর্ডার দিয়ে ফারহান আর অয়নন্দিতা গল্পে মেতে ওঠে। দু’জনে সম্পর্কে স্বামী-স্ত্রী কিন্তু মেশে বন্ধুর মতো। অয়নন্দিতার মতে স্বামী-স্ত্রী’র সম্পর্কের ভীতটা শুরু হোক বন্ধুত্বের মাধ্যমে। অয়নন্দিতার সঙ্গে ফারহানও একমত পোষণ করে। সেও চায় তার আর অয়নন্দিতার সম্পর্কের প্রথম স্থাপনটা শুরু হোক বন্ধুত্বের মধ্য দিয়ে।

রেস্টুরেন্ট থেকে বের হয়ে দু’জন হাঁটতে থাকে ফুটপাতের রাস্তা ধরে। সাধারণ মানুষজনের চাইতে ফারহানের অর্থসম্পদ একটু বেশি তবে সে থাকতে চায় সাধারণ মানুষের মতো। আর এটা এই কয়েকদিনে সে অয়নন্দিতাকে দেখে শিখেছে। জায়গা বুঝেই নিজের ক্ষমতা প্রয়োগ করে ফারহান।
কিছুদূর যেতেই কিছু ফুলের দোকান দেখতে পায় ফারহান। অয়নন্দিতাকে সাথে নিয়ে দোকানের সামনে গিয়ে দাঁড়ায় সে।
ফারহানের এইভাবে ফুলের দোকানের সামনে দাঁড়ানো দেখে অয়নন্দিতা খানিকটা ভড়কে যায়। তাকে আরও খানিকটা অবাক করে দিয়ে ফারহান একগুচ্ছ গোলাপ এনে সামনে ধরে। গোলাপগুলো অয়নন্দিতার দিকে এগিয়ে দিয়ে ফারহান সপ্রতিভ হেসে বলে ওঠে,
‘লাল টুকটুকে গোলাপগুলো কেন যেন মনে হলো তোমার হাতেই বেশি মানাবে। বন্ধুত্বের ধাপটা না হয় ফুল দিয়েই শুরু হোক।’

চলবে……………………………..

#দ্বিতীয়_সূচনা
#পর্ব_২১
লেখা – আফরোজা আক্তার
(কোনোক্রমেই কপি করা যাবে না)

গত এক সপ্তাহ ধরেই ফারহান অন্যমনস্ক হয়ে আছে। অফিস থেকে বেশ রাত করেই ফেরে। এই এক সপ্তাহে তিন দিন বাড়িতে আসেনি। অয়নন্দিতা জিজ্ঞেস করলে ঠিকঠাক মতো জবাব দেয় না ফারহান। বাড়ি না আসার কারণ কী হতে পারে সেটাও অয়নন্দিতার মাথায় আসছে না। প্রথমদিন যেদিন বাড়ি আসেনি সেদিন অয়নন্দিতা ফোন দিলেও ফারহান ফোন রিসিভ করেনি। পরদিন যখন বাড়ি আসে তখন জিজ্ঞেস করেও লাভ হয়নি। দু’দিন পর যখন আবারও বাড়ি আসল না তখন অয়নন্দিতা এই ব্যাপারটা নিয়ে সাজির সঙ্গে আলাপ করলে জানতে পায় উত্তরায় ফারহানের আলাদা একটা ফ্ল্যাট আছে। বন্দনার সঙ্গে ফারহান সেই ফ্ল্যাটেই থাকত এক সময়। এখনও ফারহান মাঝে মাঝেই সেখানে যায়। অয়নন্দিতা বিয়ে হয়ে এই বাড়িতে আসার পর এই প্রথম ফারহান বাড়ির বাইরে থেকেছে। ব্যাপারটা তার চোখে ভালো লাগছে না। কিন্তু ফারহানও কিছু বলছে না।
অফিস শেষে রাত বারোটায় ফারহান বাড়ি ফেরে। অয়নন্দিতা ব্যালকনি থেকেই দেখেছে ফারহানকে। ইজি চেয়ারে বসে বসে বই পড়ছে অয়নন্দিতা। মনে মনে সিদ্ধান্ত নিয়েছে আজ ফারহানকে জিজ্ঞেস করবে। উত্তর না দিলে জোর করে জিজ্ঞেস করবে। যতক্ষণ না ফারহান উত্তর না দিবে ততক্ষণ পর্যন্ত জিজ্ঞেস করবে। এই সংকল্প নিয়েই অয়নন্দিতা ফারহানের ঘরে ঢোকার অপেক্ষায় আছে।
ফারহান শাওয়ার নিয়ে ওয়াসরুম থেকে বের হলেই অয়নন্দিতা সামনে গিয়ে দাঁড়ায়। অয়নন্দিতাকে এইভাবে সামনে দাঁড়াতে দেখে ফারহান কিঞ্চিৎ অবাক হয়। ভ্রু জোড়া সামান্য কুঁচকে তাকায় অয়নন্দিতার দিকে। অয়নন্দিতার জিজ্ঞাসু চোখে তাকিয়ে থাকার মানেই হয় না। কারণ ফারহান জানে অয়নন্দিতার মনে এই মুহুর্তে কী চলছে।
ফারহান সহজভাবেই প্রশ্ন করে,
‘কী ব্যাপার! হঠাৎ এইভাবে সামনে এসে দাঁড়ালে যে?’
‘কথা আছে।’
‘ওকে। তবে কথা তো বসেও বলা যেতে পারে। তাই না? এইভাবে সামনে দাঁড়ানোর মানে কী?’
‘সামনে দাঁড়ালাম বলে কী অসুবিধা হলো?’
‘নাহ। তেমন অসুবিধা হয়নি। আচ্ছা বলো, কী কথা বলবে?’
‘আমি এই তিন দিন ধরে খেয়াল করলাম। আপনি আপনার উত্তরার ফ্ল্যাটে গিয়ে থাকছেন। এর কারণ কী?’
অয়নন্দিতার মুখে উত্তরার ফ্ল্যাটের কথা শুনে ফারহান অবাক হয়নি। সে বুঝতে পারে সাজি অথবা ফারাশ নয়তো মা-ই উত্তরার ফ্ল্যাটের কথা অয়নন্দিতাকে বলেছে। না হয় অয়নন্দিতার জানার কথা না। প্রশ্ন যখন অয়নন্দিতা করেছে তখন এর উত্তরে কিছু তো বলতেই হবে।
‘এর কোনো কারণ নেই। আমি মাঝে মাঝেই যাই ওইখানে।’
‘আগে একা ছিলেন। গিয়েছেন। এখন তো আমি আছি। এখনও সেখানে যাওয়া লাগে?’
‘ফ্ল্যাটে গিয়ে এক রাত থাকতে গেলে আমায় একা কিংবা দোকা হওয়া লাগবে?’
প্রশ্নের পিঠে প্রশ্নটা বেশ কঠিন। অয়নন্দিতাকে উত্তর দিতে হবে বুদ্ধি খাটিয়ে। লজিক বানাতে হবে। লজিক দিয়ে কথা বললে ফারহানকে চুপ করানো যাবে। ফারহানও শান্ত চোখে তাকিয়ে আছে অয়নন্দিতার দিকে। মনে মনে ভাবছে, অয়নন্দিতা এখন লজিক খুঁজছে। ফারহান বাঁকা হাসি দেয়। নির্দ্বিধায় অয়নন্দিতার একটা হাতে নিজের হাত রাখে। এরপর বলে,
‘লজিক বানাচ্ছো বুঝি?’
অত্যন্ত অবাক হয়ে অয়নন্দিতা ফারহানের দিকে তাকায়। ফারহান আরও একবার হাসে। অয়নন্দিতার সরল দেহটায় ফারহান নিজেকে ছেড়ে দেয়। আলতো স্পর্শে জড়িয়ে ধরে অয়নন্দিতাকে। অয়নন্দিতার কাঁধে নিজের থুতনি লাগিয়ে ফারহান ধীর কন্ঠে বলে,
‘লজিক বানাতে হবে না। তুমি যেই লজিকই খাটাও না কেন তার সব গুলোর জবাবই আমি দিতে পারব। কেমন? ঘুমিয়ে পড়ো। আমিও ঘুমাবো।’
অয়নন্দিতা ফারহানের বুকেত সঙ্গে মিশে আছে। ভালো লাগছে তার। এই স্পর্শে একটা আলাদা অনুভূতি প্রকাশ পাচ্ছে। অয়নন্দিতা সেই অবস্থাতেই একটা ঠান্ডা নিঃশ্বাস ছাড়ে। চোখ জোড়া বন্ধ করে বলে,
‘কী আছে ওই ফ্ল্যাটে? যে সেখানে যেতে হয়।’
‘অনেক কিছু আছে। একদিন তোমাকেও নিয়ে যাব। কথা দিলাম।’
‘সেখানে আপনি আমায় কখনও নিয়ে যেতেন না। যদি আমায় নিয়ে যাওয়ার মতো মন থাকত তবে আমার কাছে বলতেন যে আপনার আলাদা একটা ফ্ল্যাট আছে। আমি সাজির কাছ থেকে জানতে পারায় এখন বলছেন একদিন আমায় নিয়ে যাবেন।’
‘বাচ্চাদের মতো রাগও করতে জানো দেখছি।’
‘রাগ থাকলে রাগ হবেই। এতে বাচ্চা হওয়া লাগে না।’
‘চলো, তোমায় ঘুম পাড়িয়ে দেই।’
‘আমায় ঘুম পাড়াতে হবে না। আপনি খেতে আসুন।’
ফারহানের খেতে ইচ্ছে করছে না। তাই সে মিথ্যা বলে,
‘আমি তো খেয়ে এসেছি।’
‘আপনি খেয়ে এসেছেন?’
‘হ্যাঁ।’
‘ওহ। তাহলে আপনি শুয়ে পড়ুন। আমি নিচে যাব একটু। সব গুছিয়ে রাখতে বলব বুয়াকে।’
‘কেন, গোছাবে কেন?’
‘ভেবেছিলাম আপনি এলেই এক সঙ্গে খাব। আপনার আর আমার খাবারটা বুয়া ডাইনিংয়ে সাজিয়ে রেখেছিল। সেইগুলোই গুছিয়ে রাখতে বলব।’
ফারহানের কাছ থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নেয় অয়নন্দিতা। বিষন্ন মনে ঘর থেকে যেই না বের হবে ওমনি তার হাতটা ধরে ফারহান। অয়নন্দিতা ঘুরে দাঁড়াতেই ফারহান বলে,
‘এই নিয়ম কবে থেকে চালু হলো?’
‘কোন নিয়ম?’
‘না খেয়ে আমার জন্য অপেক্ষা করা।’
‘এটা নিয়ম না। মন চাইল, তাই।’
ফারহান হালকা হাসে।
‘ঠিকাছে, তুমি গিয়ে প্লেট সাজাও। আমি আসছি। দু’জন এক সঙ্গেই খাব।’
‘আপনি না খেয়ে এসেছেন?’
‘আবারও খাব। প্রয়োজনে দুইবার খাব৷ বন্ধুর জন্য এতটুকু তো করতেই পারি। তাই না?’
‘বন্ধু?’
‘হ্যাঁ। আমরা কি বন্ধু নই?’
ফারহানের প্রশ্নটা খুব সহজ। কিন্তু প্রশ্নের আড়ালে লুকিয়ে আছে অয়নন্দিতার হাহাকার। ভেবেছিল বন্ধুত্বের হাত ধরেই ভালোবাসায় নামবে তারা দু’জন। কিন্তু এখন দেখছে হিসাবটা উল্টো। ফারহান তো এখনও সেই বন্ধুত্বেই আটকে আছে। অয়নন্দিতা ভাবে, ভালোবাসাটা তবে হলো না৷ না হোক, ক্ষতি কীসে। বন্ধু হয়ে পাশে তো আছিই। বরং বন্ধু হয়েই সম্পর্কটা ভালো থাকুক৷ মুহুর্তেই খারাপ হয়ে যাওয়া মনটাকে ভালো করে অয়নন্দিতাও বলে ওঠে,
‘অবশ্যই আমরা বন্ধু। শুধু বন্ধু-ই না। আমরা দু’জন বেস্ট ফ্রেন্ড। কেমন?’
ফারহানও হাসিমুখে সমর্থন জানায়। অয়নন্দিতাও বন্ধুত্বের হাতটা শক্ত করে ধরে। আরও কিছুটা সময় অতিবাহিত হোক না এই বন্ধুত্বের পথে চলে। ভালোবাসাটা একটা সময় ঠিক হয়ে যাবে। দীর্ঘশ্বাসটা ভেতরেই রাখে অয়নন্দিতা। বের না হোক। মাঝে মাঝে দীর্ঘশ্বাসও অভিশাপ হয়ে দাঁড়ায় জীবনে। তাদের জীবনে অভিশাপ না আসুক।

চলবে……………………………

#দ্বিতীয়_সূচনা
#পর্ব_২২
লেখা – আফরোজা আক্তার
(কোনোক্রমেই কপি করা যাবে না)

লাগাতার ফোন বেজে যাচ্ছে অয়নন্দিতার। ওয়াসরুম থেকে কোনো রকম বের হয়ে দেখে ফারহান ফোন দিচ্ছে। ফোন রিসিভ করে কানে নিতেই ফারহান বলে,
‘এত ব্যস্ততা! আমার ফোনটা রিসিভ করা যায় না।’
অয়নন্দিতা হালকা হেসে জবাব দেয়,
‘ওয়াসরুমে ছিলাম আমি। গোসল করছিলাম।’
‘উপস!’
‘ফোনের শব্দ শুনে কোনো রকম বের হয়ে এলাম।’
‘বাহ। তাহলে আমার অভিযোগের দাম রইল না।’
‘জি।’
‘কাপড় পরে বের হয়েছ তো?’
ফারহান এতটাই ফানিভাবে কথাটা বলেছে যে অয়নন্দিতা বাধ্য হয় জোরে শব্দ করে হাসতে। ফোনের ওপাশ থেকে অয়নন্দিতার হাসিটা স্পষ্ট কানে লাগে ফারহানের। মুগ্ধতা মেশানো হাসি অয়নন্দিতার। যে শুনবে তার কাছেই ভালো লাগবে।
হাসি থামিয়ে অয়নন্দিতা বলে,
‘কোনো রকম প্যাঁচিয়ে পরে বের হয়েছি।’
‘ভিডিও কলে আসো তো, দেখি তোমায়। কেমন প্যাঁচিয়ে শাড়ি পরেছ তুমি।’
‘জঘন্য ভাবে পরেছি। দেখে কাজ নেই। এখন বলুন, ফোন করেছেন কেন? কিছু বলবেন?’
‘মন চাইল তোমার সঙ্গে কথা বলতে। তাই ফোন দিলাম।’
‘বাহ! কী করছেন?’
‘এইতো ল্যাপটপে চোখ আর কানে ফোন। হাতে মাউজ। মুখ নড়ছে।’
ফারহানের কথা শুনে অয়নন্দিতা আরও বেশি হাসে।
‘আজকে একটু বেশিই ফানি হয়ে যাচ্ছেন না আপনি?’
‘তোমার কি তাই মনে হচ্ছে?’
‘হ্যাঁ। মনে হচ্ছে।’
অয়নন্দিতার উত্তরে হালকা হাসে ফারহানও।
‘ফুচকা কেমন লাগে তোমার?’
ফারহানের প্রশ্ন শুনে অয়নন্দিতা কিঞ্চিৎ অবাক হয়ে উত্তর দেয়,
‘ভালো লাগে। কেন?’
‘খাবা?’
‘এই দুপুর বেলা ফুচকা খাব?’
‘দুপুরে খেতে কে বলেছে তোমায়? বিকেলে খাবে।’
‘তাহলে খাওয়া যায়।’
‘ওকে৷ আমি আবার ফোন করব। রেডি হয়ে থেকো। এরপর বের হবো।’
‘কোথায় যাব আমরা?’
‘দেখা যাক কোথায় যাওয়া যায়।’

খাওয়া দাওয়া শেষ করে অবসর সময় কাটাচ্ছে অয়নন্দিতা। বিবাহিত জীবনের বেশ কিছুদিন অতিবাহিত হয়ে গেছে। এখনও মাঝে মাঝে অবিশ্বাস্য হয় যে, সে এখন বিবাহিত। কারো বউ, কারো স্ত্রী, কারো ভাবী।তার উপর বাড়ির বড়ো বউ। এইসব ভাবতেই নিজেকে অনেকটা বড়ো বড়ো মনে হয় অয়নন্দিতার।
ইজি চেয়ারে পিঠ লাগাতেই দরজায় টোকা পড়ে। অয়নন্দিতা ভেতর থেকে আওয়াজ দিলে ফারাশ ঘরের ভেতরে প্রবেশ করে।

চলবে………………

#দ্বিতীয়_সূচনা
#পর্ব_২৩
লেখা – আফরোজা আক্তার
(কোনোক্রমেই কপি করা যাবে না)

শরৎকালের বিকেল। আকাশটা উজ্জ্বল। এখনও রোদের ছাপ রয়ে গেছে চারপাশে। আকাশে মেঘেরা এদিক-সেদিক উড়ছে। অয়নন্দিতার কাছে আজকের আকাশটা অন্যরকম লাগছে। এক কথায় যাকে বলা যায় অভূতপূর্ব সুন্দর। ফারহান পাশেই হাঁটছে। অয়নন্দিতার নজর মাঝে মাঝে ফারহানকেও দেখছে। ফরমালে ফারহানকে বেশ সুদর্শন লাগে। অয়নন্দিতা খেয়াল করেছে ফারহান অফিসে ফরমাল পরে যাওয়া আসা করে। আর নরমাল কোথাও বের হলে কখনও টি-শার্ট আবার কখনও ফুলহাতা শার্ট পরে বের হয়।
ফারাশের মুখে শুনেছে ফারহান নাকি প্রচন্ড রাগী মানুষ। কিন্তু অয়নন্দিতা এখন পর্যন্ত ফারহানের রাগের মুখোমুখি হয়নি। তার কাছে ফারহানকে রাগী মনে হয় না। অত্যন্ত শান্ত এবং ঠান্ডা মেজাজের পুরুষ মানুষ মনে হয়। এখন এই মনে হওয়াটা কতটা স্বাভাবিক সেটা সময়-ই বলে দেবে। ব্ল্যাক ব্লেজারটা হাতে নিয়ে হাঁটছে ফারহান। সাদা শার্ট হাতাগুলো ফোল্ড করে রাখা। পায়ে ব্ল্যাক সু। যে কোনো মেয়ে একবার হলেও তাকাবে। অয়নন্দিতার মনে পড়ে যায় সেদিনের কথা যেদিন প্রথম সে ফারহানকে দেখেছিল। কলেজে ফারহানের সবাই ধাক্কা খেয়ে সেদিন অয়নন্দিতার হাত রক্তাক্ত হয়েছিল। নিজেই অপরাধবোধে ভুগেছে৷ তাই তো হসপিটালে নিয়ে ছুটেছিল। মনে পড়ে ট্যুরের কথা। অন্যান্য মেয়েগুলো ফারহানকে আড়চোখে দেখছিল আর স্বপ্ন দেখছিল। কয়েকজন তো রীতিমতো চেষ্টাও করেছিল ফারহান যেন তাদের প্রতি আকর্ষিত হয়। কিন্তু আফসোসের কথা এই যে, তারা প্রত্যেকেই ব্যর্থ হয়েছে।
অয়নন্দিতা ভাবছে সে কি জিতেছে? নাহ, সে সফল হয়নি৷ কারণ, ফারহানের মন এখনও বন্দনাকেই ভালোবাসে। বন্দনাকে নিয়ে মাঝে মাঝে অয়নন্দিতার চাপা হিংসা হয়। বন্দনা এমন একজন নারী যে না থেকেও ফারহানের ভালোবাসা পাচ্ছে। আর সে, স্ব শরীরে ফারহানের এত কাছে থেকেও ফারহানের ভালোবাসা পাচ্ছে না। কত অদ্ভুত এই ভালোবাসার লীলাখেলা।

পাশে যে একজন জীবন্ত মানুষ হাঁটছে এতক্ষণে খেয়াল করে ফারহান। ভেবেছিল অয়নন্দিতা বোধ হয় হারিয়েই গেল। এমন চুপচাপ হয়ে কেউ হাঁটতে পারে তা এতদিন পরে বুঝতে পারে ফারহান। ফারহান মনে মনে প্রশ্ন করে, আচ্ছা অয়নন্দিতা এমন কেন? এত চুপচাপ কেন ও? সাধারণত মেয়েরা স্বামীর পাশে থাকলে অনেক গল্প কপ্রে। ফারহান অন্তত তা-ই জানে। কারণ বন্দনা যতক্ষণ তার সঙ্গে থাকত কিংবা যতক্ষণ সে বন্দনার সঙ্গে থাকত বেশিরভাগ সময় বন্দনাই কথা বলত। এটা হয়েছে, ওটা হয়েছে। আজ সাজি এটা করেছে, কাল ফারাশ ওটা করেছে। এটা পছন্দ, ওটা পছন্দ সব কিছু নিয়েই বন্দনা কথা বলত। বন্দনার এই এত সব অভ্যাসকে যদি এক লাইনে বলতে বলা হয় তবে বলা যায় — বন্দনা কথা ছাড়া থাকতে পারে না।
হলুদ জামা লাল সেলোয়ার আর ওড়নায় যেন অয়নন্দিতার সৌন্দর্য মাত্রাতিরিক্ত বেড়ে গেছে। সালোয়ার স্যুটেও অয়নন্দিতাকে সুন্দর লাগে। ফারহান ভাবছে, জগতে সব থেকে বিচিত্র হয় এই নারীকূল। এদের বোঝার সাধ্য আজ পর্যন্ত কোনো পুরুষের হয়নি। ফারহান আরও ভাবছে, একটা সময় সে ভুল ছিল। খুব ভুল ছিল। তার চিন্তা ভাবনা ভুল ছিল। সে ভাবত, সে নারী মন বুঝতে পারে। কারণ সে বন্দনাকে বুঝতে পারে। কিন্তু পরবর্তীতে বুঝতে পারে সে অনেক বড়ো ভুল করেছে। তার এতটাও বোঝা উচিত হয়নি।
কিছুটা পথ হেঁটে ওভারব্রিজ ক্রস করে। রাস্তায় সারি সারি রিক্সা। কতদিন হয়েছে রিক্সায় ঘুরে না সে। লাস্টবার ঘুরেছিল শাম্মির সঙ্গে। আজ-কাল শাম্মিও ব্যস্ত তার প্রেমিকের সঙ্গে। নতুন নতুন প্রেমে পড়লে যা হয় আর কি। এই মুহুর্তে ইচ্ছে হচ্ছে রিক্সায় উঠে পুরোটা সন্ধ্যা ঘুরে বেড়াতে। ইচ্ছেটা পূরণ করলে ক্ষতি নিশ্চয়ই হবে না। অয়নন্দিতা স্থির হয়ে দাঁড়ায়। অয়নন্দিতাকে থেমে যেতে দেখে ফারহানও দাঁড়িয়ে পড়ে সেখানে।
‘কী হলো, দাঁড়িয়ে পড়লে যে? পায়ে ব্যথা হচ্ছে নাকি?’
‘এত সহজে পায়ে ব্যথা হয় না আমার। আমি হাঁটতে পারি।’
‘তাহলে, দাঁড়িয়ে পড়লে যে।’
‘আমি এখন রিক্সায় উঠব। আর আপনাকেও আমার সঙ্গে রিক্সায় উঠতে হবে।’
‘রিক্সায়!’
‘হ্যাঁ।’
‘হঠাৎ রিক্সায় উঠতে চাইছ?’
‘মন চাইল। আগে প্রায় সময় রিক্সায় ঘুরতাম। আমি আর শাম্মি। আজ-কাল শাম্মি ভীষণ ব্যস্ত। কী প্রেম শুরু করল আমাকেই ভুলে গেল। ওর কপালে শনির দশা আছে।’
অয়নন্দিতার কথা শুনে ফারহান না হেসে থাকতে পারেনি৷
‘তোমারও তো বিয়ে হয়েছে। তো ও প্রেম করলে তোমার সমস্যা হচ্ছে কেন?’
‘ইদ্ভুত কথা বললেন তো। আমার বিয়ে হয়েছে তো কী হয়েছে। আমি কি ওর সঙ্গে যোগাযোগ রাখিনি? আমি তো কিছুদিন পর ওর সঙ্গে দেখা করেছি। একসঙ্গে রেস্টুরেন্টে খেয়েছিও। আমি তো ওকে ভুলে যাইনি। ও-ই আমায় ভুলে গেছে।’
‘তাহলে তো বলতে হয় ভীষণ অন্যায় করেছে। শাম্মি নামক মেয়েটাকে ধরতে হবে। কেন সে অয়নন্দিতার সঙ্গে যোগাযোগ করে না।’
‘যোগাযোগ যে একেবারেই করে না তাও কিন্তু না। করে তবে খুব কম। আগে অনলাইনে এলেই নক করত কিন্তু এখন অনলাইনে আমায় দেখলেও মেসেজ দেয় না। কিন্তু পোস্ট তো ঠিকই করে দেখি।’
অয়নন্দিতার অভিযোগগুলো বাচ্চাদের মতো শোনাচ্ছে। এ ক্ষেত্রে ফারহানের হাসি ছাড়া আর কিছুই করার নেই। এদিকে অয়নন্দিতা হাত দিয়ে একটা রিক্সাওয়ালাকে ইশারা করে। রিক্সাওয়ালাও ইশারা পেয়ে রিক্সা ঘুরিয়ে এ পাশে চলে আসে।
‘এই মামা, যাবেন?’
‘কই যাইবেন?’
‘নির্দিষ্ট কোনো ঠিকানা নেই। আপাতত ঘুরব।’
রিক্সাওয়ালা কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইল ফারহান আর অয়নন্দিতার দিকে। মনে মনে কী ভেবেছে কে জানে। মিনিট দুয়েক পর হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়ায় রিক্সাওয়ালা। অয়নন্দিতা রিক্সায় চড়ে বসে। সাথে ফারহানকেও বসায়। ফারহান একবারের জন্যেও না করেনি। আজকের সন্ধ্যাটা না হয় অয়নন্দিতার সঙ্গে রিক্সায় ঘুরে কাটুক।

ফারহানের সিগারেটের বাতিক আছে। অয়নন্দিতার সামনে ধরাতে সাহস পাচ্ছে না। একে তো রিক্সায় পাশাপাশি বসে আছে। এখন সিগারেট ধরালে কী না কী মনে করে সেটাও ভাবতে হচ্ছে তাকে।
‘অয়নন্দিতা, আমি কি একটা সিগারেট ধরাতে পারি?’
‘ইশ রে! এখনও সিগারেট টানার কথা বলে।’
‘অনুমতি চাইছি শুধু।’
‘অনুমতি না দিলে কী করবেন?’
‘এক পাশে রিক্সা থামাব। এরপর রিক্সা থেকে নামব। এরপর একটা বিড়ি ধরাব। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে টানব। এরপর আবার রিক্সায় উঠে বসব।’
‘তবুও টানতেই হবে।’
‘হ্যাঁ।’
‘থাক, রিক্সাও থামাতে হবে না। নামতেও হবে না। এখানেই টানুন।’
ফারহান মুচকি হাসে। এরপর সিগারেটে আগুন জ্বালায়। অয়নন্দিতার সিগারেটে খুব একটা সমস্যা হয় না। সে আরাম করেই ফারহানের পাশে বসে আছে।
‘সিগারেট টানা শেষ হলে আমায় ফুচকা খাওয়াতে হবে কিন্তু।’
ফারহানও হেসে সম্মতি জানায়।

চলবে…………………………

#দ্বিতীয়_সূচনা
#পর্ব_২৪
লেখা – আফরোজা আক্তার
(কোনোক্রমেই কপি করা যাবে না)

পাশ ফিরে উভয়ই শুয়ে আছে। অয়নন্দিতার মতে, বিকেলটা দারুণ কেটেছে। রাত আটটা পর্যন্ত রিক্সায় ঘুরেছে। ফুচকা খেয়েছে। তার ছোটো ছোটো ইচ্ছাগুলো পূরণ হয়েছে। এর জন্য অবশ্য ফারহানকে একটা ধন্যবাদ দিতে হয়। দেওয়াটা উচিত।
ফারহান আজ তাকে বেলীফুলের মালা কিনে দিয়েছে। তারা দু’জন ফুচকা খেয়ে যেই না রোড ক্রস করেছে তখনই দুইটা ছোটো বাচ্চা এসে তাদের সামনে দাঁড়ায়। তাজা বেলীফুলের মালা নিবেন নি আফা, দেহেন অনেক সন্দর কইরা বানাইছি। নেন না আফা। সে হ্যাঁ বলার আগেই ফারহান বেলীফুলের মালাগুলো কিনে নেয়। অয়নন্দিতাকে পরতে বললে অয়নন্দিতাও কনফিউজড হয়ে যায়। কোথায় পরবে এতগুলো মালা সে। শেষ পর্যন্ত ফারহানই সলিউশন দেয়। কয়েকটা দু’হাতে আর বাকিগুলো চুলে পরতে বলে। অয়নন্দিতাও ফারহানের কথানুযায়ী হাঁটতে হাঁটতে মালাগুলো পরে নেয়। বেলীফুলের ঘ্রাণটা বেশ কড়া। নাকে আটকে থাকার মতো একটা ঘ্রাণ। অয়নন্দিতার বেশ মনে আছে, সে যখন মালাগুলো নিয়ে পরছিল ফারহান তাকে দেখছিল। স্থির চোখে না দেখলেও কিছুক্ষণ পর পর দেখছিল।
একই বিছানায় রাত কাটে তাদের দু’জনের। এই পরিবেশে কামনার তাড়না থাকাই স্বাভাবিক। কিন্তু অয়নন্দিতা আর ফারহানের ক্ষেত্রে তা আলাদা। একটু ব্যতিক্রম ধর্মী বলা চলে। অয়নন্দিতার মন ফারহানকে কী রুপে পেয়ে খুশি তা এখনও ঘোলাটে। ফারহানের মন অয়নন্দিতাকে কী হিসেবে মানতে চাইছে সেটাও ঘোলাটে। বিবাহিত জীবনে থেকে তারা দু’জনই ঘোলাটে ভাবনায় আচ্ছাদিত।
ফারহানের সঙ্গে বন্ধুর মতো মেশে অয়নন্দিতা। আবার ফারহানও অয়নন্দিতার সঙ্গে বন্ধুর মতোই মেশে। স্বামী-স্ত্রী’র মধ্যে যেই সম্পর্ক থাকার কথা সেই সম্পর্কটা হয়তো তৈরি হতে আরও কিছুটা সময় লাগতে পারে। সেই সময়টা দিন কিংবা মাস অথবা বছরেও হতেও পারে। তবুও অয়নন্দিতা বেশ ভালো আছে তার বিবাহিত জীবনে।
ফারহান দেখতে যেমন সুদর্শন। বুদ্ধিতে তেমনই চৌকস। অয়নন্দিতার কাছে ফারহানকে অপছন্দ করার মতো কোনো কারণ নেই। কিন্তু ফারহানের কাছে অয়নন্দিতা আদৌ কেমন তা জানার প্রচুর আগ্রহ আছে অয়নন্দিতার। শুধু লাজ লজ্জার জন্য জিজ্ঞেস করতে পারে না।
শাম্মি প্রায়ই অয়নন্দিতাকে বলে, ভাগ্য করে একটা বর পেয়েছিস। কয়জন পায় এমন বর। আমি যদি পেতাম তাহলে তার পায়ের কাছে পড়ে থাকতাম। অয়নন্দিতার বুঝে আসে না শাম্মি কেন পায়ে পড়ে থাকার কথা বলে। নিঃসন্দেহে ফারহান অত্যন্ত ভদ্র একজন পুরুষ। তার পায়ের কাছে পড়ে থাকার কোনো প্রয়োজন হয় না। ফারহান তাকে যথেষ্ট সম্মান এবং স্নেহ করে।
মাঝে মাঝে শাম্মি একদম ওভার বলে। তার প্রশ্নগুলো অনেক ডীপলি হয়। যেমন, বর কতটা আদর করে, বর কতটা ভালোবাসে, বর রাতে ঘুমোতে দেয় কি না, সকালে গোসল হয় কি না। যার উত্তর দিতে অয়নন্দিতার মোটেও ভালো লাগে না। এক কথায় ভীষণ রকম অস্বস্তি আর বিরক্ত মনে হয়। তবুও সব হজম করে হাসিমুখে উত্তির দেয়, বরটা আমার। আমাকেই তো ভালোবাসবে। ভালোবাসাকে পরিমাপ করতে নেই। তাই বলতে পারছি না কতটা ভালোবাসে। উত্তর পেয়ে শাম্মিও চুপ হয়ে যায়। এতে শাম্মির দোষ নেই। সমবয়সী বান্ধবী থাকলে একটু আধটু বলবেই। অনেকে তো লিমিট ক্রস করে ফেলে। প্রথম রাতের ঘটনা ডিটেলসে না শুনলে তাদের আবার নাকি পেটের ভাত হজম হয় না। সেদিক থেকে শাম্মি ভালো আছে।

রাত সাড়ে তিনটা।
ফারহানের ঘুম আসছে না। কেমন জানি অস্বস্তি হচ্ছে। বুকটা জ্বালা করছে। মনে হয় গ্যাস্ট্রিকের প্রবলেমটা বেড়েছে। এর কারণ অয়নন্দিতার ফুচকা। সন্ধ্যায় মেয়েটাকে ফুচকা খাওয়াতে গিয়ে নিজেকেও খেতে হয়েছে। সাধারণত সে ফুচকা, চটপটি খায় না। এইগুলো খেলে তার গ্যাস্ট্রিকের প্রবলেম হয়। বন্দনা যতবার ফুচকা খেত, ততবার ফারহানকে জোর করত। কিন্তু ফারহান কখনও খায়নি। কিন্তু আজ যখন অয়নন্দিতা জোর করল তখন আর না বলতে পারেনি সে। পুরো এক প্লেট ফুচকা খেয়েছে সে। আর ফলাফল এখন তার বুক জ্বালা করছে। পাশ ফিরে দেখে অয়নন্দিতা বেঘোরে ঘুমোচ্ছে। ফারহান খুব ধীরে শোয়া থেকে উঠে বসে। এরপর বিছানা থেকে সরে যায়। ড্রয়ার থেকে তার মেডিসিন বক্সটা বের করে নেয়। ঘরটা অন্ধকার। লাইট অন করলে অয়নন্দিতার এত সুন্দর ঘুমটা নষ্ট হয়ে যাবে। শেষ রাতের ঘুম ভেঙে গেলে অনেক সমস্যা হয়। পরবর্তীতে আর ঘুম আসে না। ফলে সারাদিন খারাপ লাগে। সে চায়না অয়নন্দিতার ঘুমটা ভেঙে যাক। কিংবা অয়নন্দিতার নতুন দিনটা খারাপ ভাবে কাটুক। ফারহান মেডিসিন বক্সটা নিয়ে ঘরের বাইরে বের হয়ে যায়। পুরো বাড়ির সবাই ঘুমে বিভোর। ফারহান ধীর পায়ে বিনা শব্দে ডাইনিংরুমে চলে আসে। চেয়ার টেনে বসে সেখানে। সামনেই গ্লাস আর পানির জগটা রাখা আছে। গ্লাসে পানি নিয়ে মেডিসিন বক্স থেকে গ্যাস্ট্রিকের ওষুধ নিয়ে খেয়ে নেয়। কিছুক্ষণ এখানেই বসে থাকে। দেয়ালে থাকা ঘড়িটা টিক টিক করছে। সেকেন্ডের কাটা ঘুরছে অনবরত। ফারহান যেন অতীতে হারিয়ে যাচ্ছে।
মানব জীবনে অতীত বড়ো ভূমিকা পালন করে। অতীত কখনও খারাপ আবার কখনও ভালো। তবে অতীতের স্মৃতিগুলো দুঃসহ হয়ে থাকে। ফারহানের জীবনের অতীতটা সে মনে কর‍তে চায় না। তবুও অতীত তার পিছু ছাড়ে না। অতীতকে ভুলে থাকার জন্য নতুন অধ্যায়ের পাতা উলটেছে সে। কিন্তু নতুন অধ্যায়ের ভাজে ভাজে যেন সেই অতীত আরও গাঢ় হচ্ছে।
ফারহান না পারছে অতীত ভুলতে। না পারছে নতুন অধ্যায়কে আপন করে নিতে। দ্বিধা দ্বন্দ্বে জড়িয়ে সে যেন দিন দিন অসুস্থ হয়ে পড়ছে তার শরীর যেন দিন দিন অসার হয়ে যাচ্ছে। অতীতের স্মৃতিগুলো মধুময় ছিল বটে তবে তার শেষ হয়েছিল ভয়ানক পয়জন দিয়ে। পয়জনকে বাংলায় বিষ বলায় হয়। কিং কোবরার বিষের থেকেও তীব্র এই বিষের জ্বালা। সাপের বিষে মানুষ একেবারেই শেষ হয়ে যায় কিন্তু মনুষ্য বিষে অপর মানুষটা জীবিত থেকেও তিলে তিলে মরে।

‘এই যে মশাই, কী ভাবছ এত?’
ফারহান তাকিয়ে আছে সামনে অবস্থিত নারীর দিকে। পরনে তার লাল শাড়িটা তার দেহের সৌন্দর্য দ্বিগুন বাড়িয়ে তুলেছে। কী অপূর্ব তার হাসি। বিমোহিত নয়নে ফারহান তাকে পর্যবেক্ষণ করছে। বলছে,
‘এভাবে আমার সামনে এসে দাঁড়ালে আমার ভাবনাগুলো উল্টেপাল্টে যায়৷ তুমি বোঝো না?’
‘এত কী চিন্তা করো তুমি?’
‘আমার চিন্তার শেষ নেই সুন্দরী। তবে তোমায় নিয়ে ইদানীং একটু বেশিই চিন্তা হয়।’
‘কেন?’
‘এত সুন্দর তুমি। যদি আমি তোমায় হারিয়ে ফেলি।’
‘আমি হারিয়ে যাওয়ার পথিক হলে একদিন না একদিন পথভ্রষ্ট হবোই হবো। এরপর হারিয়েই যাব।’
‘তার মানে তুমি হারিয়ে যেতে পারো, তাই না?’
‘কে জানে। বলা তো যায় না। তবে যতদিন না হারিয়ে যাচ্ছি ততদিন আমি তোমারই আছি। বুঝলে মশাই?’
ফারহানের কথাগুলো কেন যেন জড়িয়ে যাচ্ছে। হাতিয়ে যাওয়ার পথিক হলে একদিন না একদিন পথভ্রষ্ট হবেই হবে। কিন্তু কেন হবে। পথভ্রষ্ট হবার জন্য তো সে এ পথে আসেনি। তবে কেনই বা পথভ্রষ্টের কথা এলো।

আল্লাহ হুয়াকবার, আল্লাহ হুয়াকবার।
ফারহানের ধ্যান ভাঙে। আজানের শব্দ শোনা যাচ্ছে। তার মানে চারটার বেশি বেজে গেছে। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে ফারহান। উঠে দাঁড়ায় চেয়ার থেকে। মেডিসিন বক্সটা হাতে নিয়ে পা বাড়ায় নিজের ঘরের দিকে। অয়নন্দিতা হয়তো এখনও ঘুমোচ্ছে। টেরও পায়নি তার পাশ থেকে ফারহান উঠে ডাইনিংরুমে এতক্ষণ বসেছিল।
বুকের জ্বালাটা কমেছে। চোখ জোড়ায় ঘুম ভর করেছে। ফারহান বিনা শব্দে বিছানায় নিজের শরীর লাগায়। সে যা ভেবেছিল তা-ই হয়েছে। অয়নন্দিতা ঘুমে। চিন্তামুক্ত ঘুম। শান্তির ঘুম। ফারহান আরও একবার চাপা নিঃশ্বাস ছাড়ে। চোখ জোড়া বন্ধ করে ঘুমের অতলে তলিয়ে যায়।

চলবে……………………….

#দ্বিতীয়_সূচনা
#পর্ব_২৫
লেখা – আফরোজা আক্তার
(কোনোক্রমেই কপি করা যাবে না)

বাড়ি ফিরে ফারহানের মুড অফ হয়ে গেছে। উপযুক্ত কোনো কারণ নেই। আর যা হয়েছে সেটা মুড অফ হবার মতো কোনক কারণও না। তবুও তার মুড অফ।
সোফায় বসে ল্যাপটপে কাজ করছে ফারহান। কিন্তু কাজে মন বসছে না। এমন সময় দরজায় টোকা পড়লে মাথা তুলে তাকায় ফারহান। ঘরের বাইরে সাজি দাঁড়িয়ে আছে। এই সময় সাজি! সাজিকে এর আগে কখনও সে তার ঘরে আসতে দেখেনি। সে যখন বাইরে থাকে তখন সাজি না হয় মিসেস রওশন বেগম আসেন এই ঘরে। সব পরিষ্কার করিয়ে দিয়ে যায়। অয়নন্দিতা এই বাড়িতে আসার পর সাজি প্রায় সময় অয়নন্দিতার সঙ্গে সময় কাটানোর জন্য আসে। কিন্তু আবার যখন ফারহান থাকে তখন আসে না। সাজি তার বাবা এবং বড়ো ভাইকে সমান ভয় পায় এবং শ্রদ্ধা করে। এটা নিয়ে ফারহানের অভিযোগ থাকলেও কখনও সাজিকে সরাসরি জিজ্ঞেস করেনি। সে বোঝে সাজি তাকে সম্মান করে বলেই খানিকটা দূরত্ব বজায় রেখে চলাফেরা করে। অন্যদিকে ফারাশ এবং সাজির ব্যবহার অত্যন্ত বন্ধুসুলভ। এরা দুই ভাই বোন মাঝে মাঝে উধাও হয়ে যায় একত্রে। ফারাশ সাথে থাকে বলে সাজির উধাও হয়ে যাওয়া নিয়ে কারো মাথা ব্যথা থাকে না তেমন।সাজিকে বাইরে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে ফারহান বলে,
‘কিছু বলবি?’
‘ভেতরে আসব?’
‘হ্যাঁ। আয়। অনুমতি নিতে হয় নাকি?’
সাজি ঘরের ভেতর প্রবেশ করে। সোফায় বসতে বসতে বলে,
‘একটু আধটু তো নিতেই হয়।’
‘তোর ভাবির কাছে যখন আসিস তখনও কি অনুমতি নিয়েই ঢুকতে হয় নাকি?’
‘উহু। ভাবি যখন থাকে তখন সরাসরিই এন্ট্রি নেই।’
‘তাহলে আমার ক্ষেত্রে অনুমতি নিতে হয় কেন?’
সাজি এই প্রশ্নের উত্তর না দেওয়াই উচিত মনে করছে। কারণ উত্তর দিতে গেলে অনেক কিছুর ক্ল্যারিফিকেশন দিতে হবে যা সাজি চায় না। বিদ্বান ব্যক্তির মতো সাজি কথার মাঝখানেই ইউটার্ন মারে।
‘ভাবি যে তার মামার বাড়ি গেল। কবে আসবে কিছু বলেছে তোমাকে?’
এখানেই আপত্তি ছিল ফারহানের। সে চায়নি যে অয়নন্দিতা কোথাও যাক। কিন্তু অয়নন্দিতাকে আটকাতেও পারেনি সে। অয়নন্দিতা যখন সকাল এগারোটায় ফোন করে বলল তার মামা এসেছে। সে তার মামার সঙ্গে বাড়ি যেতে চায়। তখন অনায়াসে হ্যাঁ বলে দিলেও পরক্ষণেই মনে হয়েছিল না করলেই ভালো হতো। কিন্তু যেখানে একবার হ্যাঁ বলে দিয়েছে সেখানে না বললে ব্যাপারটা খারাপ দেখায় তাই আর কিছু বলতে পারেনি সে। ভেবেছিল অয়নন্দিতার বাড়িতে না থাকায় তার কিছু আসবে যাবে না। কিন্তু এটা বুঝতেই পারেনি যে, বাড়ি ফিরে ঘরটা ফাঁকা দেখেই তার মনটা খারাপ হয়ে যাবে। এটা বুঝতেই পারেনি যে বাড়ি ফিরে ঘরটায় একজন মানুষের চোখের সামনে ঘুরঘুর করা, তা কথা না শুনতে পেয়ে এতটা বিষন্ন লাগবে। এমন মিশ্র অনুভূতিকে কী বলা যায় সেটাও ভাবতে হচ্ছে ফারহানকে।
সাজি তার প্রশ্নের উত্তর না পেয়ে আবারও একই প্রশ্ন করলে ফারহান শান্ত নজরে সাজির দিকে তাকায়। ফারহানের শান্ত নজর সাজিকে অন্যদিকে ধাবিত করছে। তার চোখ যা দেখছে সেটা কি আদৌ সত্যি। তবে কি তার ভাইটা আবারও নতুন করে কিছু ভাবতে শুরু করেছে। নিজের কন্ঠকে আরও মলিন করে সাজি পরবর্তী প্রশ্ন করে,
‘ভাইয়া, তোমার কি মন খারাপ নাকি?’
বোনের প্রশ্নের উত্তরে না বোধক মাথা নাড়ে ফারহান। না বোধক হলেও সাজি বুঝতে পারে আসল ঘটনা কোথায়।
‘ভাবিকে মিস করছ, তাই না?’
এবারও ফারহান চুপ। এভাবে চুপ করে থাকলে সাজি তো কোনো কথাই বলতে পারবে না। আবার অতিরিক্ত প্রশ্ন করলেও সমস্যা। ফারহান রেগে যাবে। সবটা বুঝতে পেরেই সাজি একটা ছোট্টো নিঃশ্বাস ফেলে সোফা থেকে উঠে দাঁড়ায়। সামনে পা বাড়াতেই ফারহান বলে ওঠে,
‘তোকে কিছু বলে যায়নি?’
ভাইয়ের কথায় পেছনে ঘুরে দাঁড়ায় সাজি।
‘আমি ছিলাম না। মা’কে জিজ্ঞেস করলাম। মা বলল দুই তিন দিন নাকি থাকবে। আমি পরে অবশ্য ফোন করেছিলাম। রিসিভ করল ভাবির মামী। আন্টি বলল, ভাবি নাকি ঘুমোচ্ছে।’
‘পরে আর ফোন করেনি?’
‘নাহ।’
‘ওহ।’
‘তুমি ফোন করেছিলে?’
‘নাহ।’
‘কেন?’
‘এমনি।’
‘এমনি আবার কী? ফোন করতে। আই থিংক ভাবির ফোনে ব্যালেন্স শেষ। যার জন্য ফোন করতে পারছে না।’
‘ব্যালেন্স শেষ হলে রিচার্জ করা খুব কঠিন কিছু না। সব কিছুর ক্ষেত্রে আগ্রহ প্রয়োজন। তার হয়তো আগ্রহ নেই। তাই ফোন করছে না।’
ভাইয়ের কথায় অভিমান খুঁজে পাচ্ছে সাজি। ব্যাপারটা তার কাছে ভালো লাগছে। এতদিন পর তার ভাই কারো প্রতি অভিমান করেছে। সাজি ভাইয়ের পাশে বসে।
‘তুমি একবার ফোন করে দেখতে পারো তো।’
‘সেও তো পারে ফোন দিতে।’
কথাটা বলে শেষ করতে না করতেই ফারহানের ফোনটা বেজে ওঠে। ফোনটা টি-টেবিলের ওপর রাখা ছিল বলে স্পষ্টভাবেই অয়নন্দিতার ছবিটা স্ক্রিনে দেখা যাচ্ছে। সাজির চোখ যায় ফোনের স্ক্রিনে। অয়নন্দিতাকে দেখা যাচ্ছে। লাল শাড়ি পরা, খোঁপায় গাজরা পরা একটা নিষ্পাপ মুখ। যার চোখ জোড়ার দিকে তাকালে মনে থাকা সমস্ত দুঃখ ভুলে থাকা যায়। যার মিষ্টি হাসি দেখলে রুপকথার রাজপুত্র তার রাজ্য ছাড়তেও বাধ্য। ইংরেজিতে ‘oyondita’ নামটা ভেসে উঠেছে। সাজি মুচকি হাসে এবং বলে,
‘দেখেছ ভাইয়া, ভাবির কথা বলতে না বলতেই সে ফোন করেছে। ফোনটা রিসিভ করো। কথা বলো তার সঙ্গে।’
সাজি চলে গেলে ফারহান ফোনটা রিসিভ করে। এপাশ-ওপাশ দু’পাশেই নীরবতা। অয়নন্দিতা অভিমান নিয়ে ফোনটা করছে আর ফারহান, সেও অভিমান নিয়েই ফোনটা রিসিভ করেছে।
নীরবতা পালন করার মতো ধৈর্য আর নেই অয়নন্দিতার। তাই সে নিজেই বলে ওঠে,
‘কেমন আছেন?’
ফারহানের অভিমানটা কেন যেন আরও গাঢ় হয়ে গেছে। ভেতরটা অস্বস্তিতে ভড়ে উঠছে। হার্টবিট বেড়ে যাচ্ছে মনে হচ্ছে। ফারহান বার কয়েক নিঃশ্বাস নেয়। এর ধীর কন্ঠে বলে,
‘ভালো। তুমি কেমন আছো?’
‘আমি ভালো আছি।’
‘ভালো আছো বলেই কি ভুলে গেছ?’
ফারহানের বলা এই কথাটা অয়নন্দিতার গায়ে কাটার মতো বিঁধে গেছে। মনে হলো খোঁচা মেরে বলা হয়েছে কথাটা। তবে খোঁচা মারার পেছনে যেই কারণটা লুকিয়ে আছে সেটা বুঝতে বেশিক্ষণ লাগেনি তার।
অয়নন্দিতা এদিক-ওদিক না ঘুরিয়ে সোজাসাপ্টা করেই উত্তর দেয়।
‘কোনো একজনও কিন্তু আমায় ভুলে গিয়েছে। সেও কিন্তু আমায় ফোন করেনি। তবে কি সেও খুব ভালো আছে?’
এবার ফারহান দমে যায়। কথাটা তো সত্যি। সারাদিনেও সে ফোন করেনি অয়নন্দিতাকে। বাড়ি ফিরে এসেও ফোন করেনি। সেদিক থেকে দেখতে গেলে দেরি হলেও অয়নন্দিতাই তাকে ফোন করেছে। এবার তার অভিমান এবং অভিযোগ দুটোই কমিয়ে দেওয়া উচিত।
অয়নন্দিতা হালকা হাসে। এতদিনে সে এটা অন্তত ভালো করেই বুঝেছে যে তার হাসিটা ফারহানকে একরকম শান্তি দেয়। আগেও খেয়াল করেছে, সে যখন ফারহানের সামনে হাসে তখন ফারহানের চোখ মুখে এক ধরনের প্রশান্তি কাজ করে।
‘আমি কি ফোনটা রেখে দিব?’
অয়নন্দিতার প্রশ্নের জবাবে ফারহান বলে,
‘রেখে দেওয়ার জন্যই বুঝি ফোন দিয়েছ?’
‘কেউ যদি কথা না বলে তবে ফোনের বিল বাড়িয়ে আছে।’
‘খেয়েছ রাতে?’
‘হ্যাঁ। আপনি খেয়েছেন?’
‘হ্যাঁ।’
ফারহান মিথ্যা বলে। সে খায়নি। তার খেতে ইচ্ছে করছে না। অয়নন্দিতার অনুপস্থিতিটা তাকে ব্যথিত করছে। খাওয়ার প্রতি অরুচি ধরেছে। আপনি খেয়েছেন?–প্রশ্নের উত্তরটা যদি ফারহান না বোধকে দিত তবে অয়নন্দিতা অস্থির হতো৷ ততক্ষণ পর্যন্ত বিরক্ত করত যতক্ষণ পর্যন্ত ফারহান না খেত। তাই অয়নন্দিতার অস্থিরতাকে দূরে রাখতেই ফারহান মিথ্যা বলে।
ফারহান ল্যাপটপ বন্ধ করে বারান্দায় এসে দাঁড়ায়।
‘কবে ফিরবে?’
‘আজকেই তো এলাম। দুটো দিন থাকব না?’
‘থাকতে চাচ্ছো?’
‘হ্যাঁ। থাকি না দুটো দিন।’
‘বেশ, থাকো। ঘুমিয়ে পড়ো। অনেক রাত হলো।’
‘রাগ করলেন বুঝি?’
‘নাহ। আমি শুয়ে পড়ব তো। আগামীকাল মিটিং আছে। নয়টায় অফিসে পৌঁছাতে হবে।’
অয়নন্দিতাও আর বাড়তি কথা না বলে ফোন রেখে দেয়।

পরদিন।
সন্ধ্যা হয়ে এসেছে। অয়নন্দিতা, মিলি বারান্দায় বসে কথা বলছে। মিলি প্রশ্ন করছে অয়নন্দিতা উত্তর দিচ্ছে। কিছু প্রশ্নের উত্তর না চাইলেও দিতে হচ্ছে। কিছু উত্তর বানিয়ে বানিয়ে বলতে হচ্ছে। মিলিসহ বাকিরা তার আর ফারহানের সম্পর্কটাকে যেমন স্বাভাবিক ভাবছে আসলে তাদের সম্পর্কটা যে তেমন স্বাভাবিক নয় এটা তারা দু’জন ছাড়া আর কেউ জানে না।
অয়নন্দিতার উদাস মুখটা মিলির নজর এড়ায়নি। এতক্ষণ যাবত প্রশ্নের উত্তরগুলো খুব সুন্দর করে গুছিয়ে দিলেও এখন অয়নন্দিতার সব কথা গুলিয়ে যাচ্ছে। মিলির সন্দেহ হচ্ছে। মিলি প্রশ্ন করে,
‘তুমি ঠিক আছো তো অয়নি?’
মিলির প্রশ্নে অয়নন্দিতা হাসিমুখে জবাব দেয়,
‘হ্যাঁ, ঠিক আছি।’
‘কেন যেন মনে হচ্ছে তুমি ভালো নেই।’
‘ভুল ধারণা তোমার। আমি ভালো আছি।’
‘আচ্ছা শোন, ফারহান ভাই কেন এলো না?’
‘কাজের চাপ বেশি৷ আর দ্বিতীয়ত হয়তো আমাদের বাসার পরিবেশ তার পছন্দ হবে না।’
‘এটা ঠিক বলেছ। তাদের বাড়িটা তো ভীষণ হাই-ফাই।’
‘এত হাই-ফাই জায়গায় বিয়ে না হলেই ভালো হতো। তাহলে জামাইও আসত। কী বলো?’
‘এভাবে বোলো না। তিনি হয়তো এসবে অভ্যস্ত না। যে যেই পরিবেশে থেকে অভ্যস্ত আর কি।’
মিলি যা-ই বলুক না কেন, ফারহান যে এখানে আসবে না এটা অয়নন্দিতা ভালো করেই জানে। তার আর ফারহানের সম্পর্কটা কতখানি এগোবে সেটা নিয়ে এখনও নিশ্চিত নয় অয়নন্দিতা। হয়তো সারাজীবন টিকে যাবে নয়তো মাঝপথেই শেষ হয়ে যাবে। সম্পর্কটা যদি বন্ধুত্বের মধ্যে থেকে যায় তবে স্বামী সোহাগ তার কপালে থাকবে না। সম্পর্কটা যদি দাম্পত্য জীবনের মধ্য দিয়ে যায় তবে বন্ধুত্বটা হয়তো হারিয়ে যাবে। ইকুয়েল ভাবে দুটো পেতে ভাগ্য লাগে। আর সেই ভাগ্যটা বোধ হয় অয়নন্দিতার নেই। কারণ, ফারহানের পৃথিবীর অর্ধেকের বেশিটাই জুড়ে আছে বন্দনা।

চলবে……………………..