দ্বিতীয় সূচনা পর্ব-২৬+২৭+২৮+২৯+৩০

0
507

#দ্বিতীয়_সূচনা
#পর্ব_২৬
লেখা – আফরোজা আক্তার
(কোনোক্রমেই কপি করা যাবে না)

আজ সারাদিন বৃষ্টি হয়েছে। এখনও টুপটুপ বৃষ্টি হচ্ছে।
হালকা ঠান্ডাও পড়ছে। বৃষ্টি জানান দিচ্ছে শীত এসে গেছে। ফারহান ব্লেজার পরা। তবুও ঠান্ডার ভাবটা যাচ্ছে না। পরক্ষণেই মনে পড়ে তার, গাড়িতে তো এসি চলছে। ইদানীং বড্ড বেখেয়ালি হয়ে পড়েছে সে। এসি অফ করতে ভুলে গেছে সে।
দুপুরের পর অয়নন্দিতার সঙ্গে কথা হয়েছিল একবার। আর বিকেলে দুই একটা মেসেজ। অয়নন্দিতার কন্ঠস্বর শুনে ফারহানের মনে হয়, হয়তো মেয়েটার ঠান্ডা লেগেছে। কন্ঠটা কেমন যেন বসা ছিল। ফারহান জিজ্ঞেসও করেছিল কয়েকবার। কিছু হয়নি, একটু ঠান্ডা লেগেছে। এর বেশি কিছু না — এইটুকুই বলেছিল অয়নন্দিতা।
ফারহান ভাবছে, এতদিন আমাদের বাড়ি ছিল কিছুই হয়নি। যেই না মামা বাড়ি গেল ওমনি অসুস্থ হয়ে পড়ল। সঙ্গে সঙ্গেই আবার ভাবনায় পরিবর্তন আসে তার। বিয়ের আগে তো মামা বাড়িই ছিল। হয়তো আবহাওয়া পরিবর্তনের জন্য ঠান্ডা লেগেছে। অতিরিক্ত চিন্তা করাতেই এসব উল্টাপাল্টা ভাবনা আসছে তার মাথায়।
একবার যাবে নাকি অয়নন্দিতার মামা বাড়ি, ভাবছে ফারহান। গাড়িটা ইউ টার্ন নিয়ে যাওয়া যেতেই পারে। ঘড়ি দেখে। ঘড়িতে এখন রাত নয়টা বেজে বিশ মিনিট। বেশি রাত হয়নি। যাওয়া যেতেই পারে। ফারহান গাড়ি ঘোরাবে এমন সময় ফোন বেজে ওঠে। ফারহান একপাশে গাড়ি দাঁড় করায়। বাবার ফোন পেয়ে ফারহান ফোন রিসিভ করে।
‘হ্যালো বাবা।’
‘ফারহান, তুমি কি বাড়ি আসতেছ?’
বাড়িতে তো সে এখন যাবে না। সে তো যাবে অয়নন্দিতার মামার বাড়ি। কিন্তু বাবাকে কি বলা ঠিক হবে। তাই কথাটা লুকিয়ে ফেলে।
‘হ্যাঁ। বাসাতেই আসছি। কেন?’
‘অয়নন্দিতার তো অনেক ঠান্ডা লেগেছে। গলা তো প্রায় বসে গেছে। ঠিক মতো কথাও বলতে পারছে না।’
ফারহানের কপালে ভাজ পড়ে। দুপুরের পরেই তো কথা বলেছিল। এতটাও তো খারাপ ছিল না। মেসেজেও কিছু বলেনি। কিন্তু অয়নন্দিতার অসুস্থতার খবর তার বাবা জানল কীভাবে? তার বাবা কি অয়নন্দিতার মামার বাসায়?
ছেলের কথা না শুনতে পেয়ে রমজান সাহেব গলা ছেড়ে শব্দ করেন।
‘হ্যালো। ফারহান, শুনতে পাচ্ছ?’
ধ্যান ভাঙ্গে ফারহানের।
‘হ্যাঁ। শুনতে পাচ্ছি৷ ডক্টর আংকেলকে অ্যাড্রেস বললেই তো তিনি অয়নন্দিতার মামার বাসায় চলে যেতে পারেন।’
‘কেন, তিনি অয়নন্দিতার মামার যাবেন কেন?’
‘অয়নন্দিতা তো তার মামার বাসায় তাই না?’
‘নাহ। অয়নন্দিতা সন্ধ্যার কিছুক্ষণ আগেই বাড়ি ফিরেছে। সে আসার পরই তোমার মা বুঝতে পারে তার শরীর ভালো নেই। আর তোমার ডক্টর আংকেল এসেছিলেন। অয়নন্দিতাকে দেখেও গেছেন। প্রেসক্রিপশনের কপি পাঠাচ্ছি। মেডিসিনগুলো নিয়ে এসো। এইজন্যই ফোন করা তোমায়।’
ফারহান চমকে যায়। অয়নন্দিতা বাড়ি চলে এসেছে। কই, একবারও তো তাকে বলেনি যে সে চলে আসবে। মেয়েটার মনে যে কখন কী চলে বোঝা বড়ো দায়। অতিরিক্ত ভেবে নার্ভ দুর্বল করার কোনো মানে হয় না। ফারহান গাড়ি স্টার্ট দেয়। আপাতত ফার্মেসিতে যাবে। মেডিসিন নেবে। এরপর সোজা বাড়ি যাবে।

অয়নন্দিতা শাল জড়িয়ে ইজি চেয়ারে বসে আছে। কিছুক্ষণ আগেই রওশন বেগম এসে লিকার দিয়ে গেছে। গলার ব্যথাটা বেড়েছে তার। বিকেলে ফারহানের সঙ্গে মেসেজ করার পর মনকে আর আটকে রাখতে পারেনি। দু’দিন হয়ে গেছে সে ফারহানকে দেখেনি। এদিকে অয়নন্দিতা শিওর ছিল যে ফারহান মামার বাসায় আসবে না। তার থেকে বরং চলে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেয় সে। আবার ভাবে, যদি ফারহান প্রশ্ন করে তাহলে বলে দিবে বেড়ানো শেষ তাই চলে এসেছি। ফারহানকে তো আর বলা যাবে না যে, সে ফারহানকে খুব মিস করছিল তাই চলে এসেছে। দুপুর থেকেই শরীর ভালো লাগছিল না তার। তবুও ভেবেছিল ঠিক হয়ে যাবে, কিন্তু এখানে আসার পর পরই শরীর আরও খারাপ হয়ে গেছে তার। জ্বর টর এলে বিরাট সমস্যায় পড়ে যাবে। এমনিতে সহসা তার জ্বর হয় না। কিন্তু যখন হয় তখন দিন দুনিয়া সব ভুলে যায়।
ফারহান ঘরে ঢুকেই দেখে অয়নন্দিতা ইজি চেয়ারে চোখ বন্ধ করে হেলান দিয়ে শুয়ে আছে। ফারহানের ভেতর থেকে একটা ঠান্ডা নিঃশ্বাস বের হয়ে আসে। নিঃশ্বাসটা যে শিতল এটা নিয়ে ফারহানের বিন্দুমাত্র সন্দেহ নেই। এমন শিতল নিঃশ্বাস বহুদিন পরে বের হলো তার অন্তর থেকে। আজ দু’দিন পর সে অয়নন্দিতাকে দেখছে। তার ঘরটা যেই শূন্যতা বুকে নিয়ে গত দু’দিন ধরে পড়েছিল সেই ঘরটা আজ আলো হয়ে আছে এমনটাই মনে করছে ফারহান।
ফারহান এক কোণে চুপচাপ দাঁড়িয়ে দেখছে অয়নন্দিতাকে। মেরুন রঙের শালটা বেশ মানিয়েছে। অসুস্থ অবস্থাতেও অয়নন্দিতাকে দেখতে সুন্দর লাগছে। নাকের ডগাটা সামান্য লাল হয়ে আছে। ফারহান পা টিপে টিপে আরেকটু কাছে এগিয়ে যায়। প্রবল গাঢ় একটা স্মেল নাকে লাগে ফারহানের। আরেকটু কাছে গেলেই বুঝতে পারে স্মেলটা বাম এর। অয়নন্দিতা হয়তো তার মাথার দুই সাইডে বাম লাগিয়েছে। ভালো করে খেয়াল করলে বুঝতে পারে অয়নন্দিতার চোখের ল্যাশগুলোতে পানি জমে আছে। বুঝতে পারে সামান্য বাম চোখেও লাগিয়েছে। যার কারণে চোখ জোড়া বন্ধ করে আছে। ফারহান বুঝতে পারে তার বউয়ের শরীর আসলেই খারাপ।
খুব সাবধানতার সাথে ফারহান দু’পা পিছিয়ে যায়। এবং খুব সাবধানেই সে বাকি কাজগুলো করে। সাবধানে না করলেও প্রবলেম ছিল না কারণ অয়নন্দিতা ওই সময়ে ঘুমে ছিল। গভীর ঘুমে। ইজি চেয়ারে দুলতে দুলতে ফারহানের কথা ভাবতে ভাবতে চোখ লেগে যায় তার। আর তারপরই গভীর ঘুম।
ফারহান ফ্রেশ হয়ে ওয়াসরুম থেকে বের হয়ে দেখে অয়নন্দিতা এখনও সেই আগের পজিশনেই ঘুমিয়ে আছে। কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকার পর ফারহান আর নিজেকে আটকে রাখতে পারেনি। অয়নন্দিতার কাছে গিয়ে দাঁড়ায়। কপালে হাত রাখে। কপালে হাত রাখতেই বুঝতে পারে অয়নন্দিতার শরীরের তাপমাত্রা হাই। বুঝতে আর বাকি নেই যে অয়নন্দিতার জ্বর এসেছে।
নিজের শরীরে কারও স্পর্শ বুঝতে পেরেই অয়নন্দিতা চোখ খোলে। চোখ খুলে পাশে ফারহানকে দেখতে পাবে এতটাও আশা করেনি সে। অয়নন্দিতা তাড়াহুড়ো না করে শান্ত স্বরেই বলে,
‘আপনি! কখন এলেন?’
অয়নন্দিতা পূর্বের ন্যায় হেলান দিয়ে শুয়ে আছে ইজি চেয়ারে। ফারহান তার সামনে বিছানায় বসে। হালকা হেসে বলে,
‘পঁয়তাল্লিশ মিনিট হবে।’
‘আমি তো টেরই পাইনি।’
‘ঘুমে ছিলে তুমি। টের পাবে কী করে?’
‘এতক্ষণ ঘুমিয়েছি আমি!’
অয়নন্দিতার বিস্ময় প্রকাশের ভঙ্গিমা দেখে ফারহান একদৃষ্টে তাকিয়ে থাকে। অয়নন্দিতার কন্ঠস্বরটা বসে গেছে। কথাগুলো কেমন অস্পষ্ট শোনাচ্ছে। তবুও কেন যেন এই কন্ঠস্বরটা ফারহানের ভীষণ ভালো লাগছে। ফারহানের অয়নন্দিতার কথা শুনতে ভালো লাগছে। তাই বুদ্ধি খাটিয়ে অয়নন্দিতাকে তার মামা বাড়ির গল্প শোনাতে বলে। বোকা অয়নন্দিতা এই বসা গলা নিয়েই মামা বাড়ির আদর মাখা স্মৃতিগুলো ফারহানকে বলতে শুরু করে। আর ফারহান গালে হাত দিয়ে পলকহীন চোখে অয়নন্দিতাকে দেখতে থাকে।

চলবে……………………………

#দ্বিতীয়_সূচনা
#পর্ব_২৭
লেখা – আফরোজা আক্তার
(কোনোক্রমেই কপি করা যাবে না)

প্রচন্ড মাথা ব্যথায় অস্থির অয়নন্দিতা। জ্বরটাও ছেড়ে ছেড়ে আসছে। গলাও পুরোপুরি বসে গেছে। অয়নন্দিতার এতটা অসুস্থ হয়ে পড়ার কারণ খুঁজে পাচ্ছিল না ফারহান। বিকেলের দিকে অয়নন্দিতার মামা মামী এসেছিলেন। এবং সেই সাথে এটাও বলে গেছেন যে ঠান্ডা খাওয়ার মধ্যে শুধু একটা আইসক্রিম খেয়েছিল। আর তারপর থেকেই ঠান্ডা লাগে। আইসক্রিম খাওয়ার বিষয়টা নিয়ে ফারহান রাগান্বিত হলেও কিছু বলেনি অয়নন্দিতাকে।
এপাশে মুখ করে ঘুমোচ্ছে অয়নন্দিতা। ফারহানের চোখে ঘুম নেই। জেগে জেগে তাকিয়ে আছে অয়নন্দিতার মুখের দিকে৷ জ্বরে অবস্থা খারাপ হয়ে গেছে অয়নন্দিতার। ঠোঁট জোড়া শুষ্ক হয়ে আছে। চোখগুলো লালচে। ফারহান এক পাশ হয়ে গাঢ় নজরে দেখছে অয়নন্দিতাকে। ইদানীং অয়নন্দিতার দিকে তাকিয়েই থাকতে ভালো লাগে ফারহানের। সে চায় তাদের মধ্যে কথা কম হোক। কিন্তু দৃষ্টি আকর্ষণ থেকে যাক।
ঘুম ভেঙে নড়েচড়ে ওঠে অয়নন্দিতা। পাশে হাত রেখে টের পায় তার পাশের জায়গাটা খালি৷ মুহুর্তেই চোখ খুলে তাকায় সে। ফারহান পাশে নেই। ঘরে যতটুকু আলো আছে ততটুকু দিয়েই অয়নন্দিতা দেখতে পায় তার ঘরের দরজাটা ভেতর থেকে বন্ধ। তার মানে ফারহান বাইরে যায়নি। বার কয়েক এদিক-সেদিক তাকায়। কিন্তু দেখতে পায়নি। অয়নন্দিতা শোয়া থেকে উঠে বসে। গলায় তেমন জোরও নেই যে শব্দ করে ডাকবে ফারহানকে। বাধ্য হয় বিছানা থেকে নামতে। ওয়াসরুমের দরজাটাও বাইরে থেকে বন্ধ। অয়নন্দিতা বুঝতে পারে ফারহান বারান্দাতেই আছে। বারান্দার সামনে দাঁড়ায় অয়নন্দিতা। দেখতে পায় ফারহান সেখানেই দাঁড়িয়ে আছে। সিগারেট টানছে এক মনে। অয়নন্দিতা ভাবছে, অনুমান যদি ঠিক হয় এখন গভীর রাত কারণ সে এখনও ঘড়ি দেখেনি। এত রাতে না ঘুমিয়ে ফারহান এখানে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে সিগারেট টানছে। ব্যাপারটা কেমন যেন লাগছে অয়নন্দিতার কাছে। তার দুর্বল চিত্ত মনে মনে বলছে, ফারহান নিশ্চয়ই কোনো কিছু নিয়ে চিন্তিত৷ নইলে সে এত রাতে না ঘুমিয়ে এখানে দাঁড়িয়ে সিগারেট টানত না।

নিজের কাঁধে কারো আলতো স্পর্শ পেয়ে ফারহান পেছন ফিরে তাকায়। বাইরের ল্যাম্পপোস্টের ঘোলাটে আলোতে অয়নন্দিতার মুখখানা স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে ফারহান। ফারহান অয়নন্দিতাকে এখানে এভাবে আশা করেনি। হঠাৎ দেখতে পেয়ে চমকে যায় সে। তার ধারণা অনুযায়ী অয়নন্দিতা এতক্ষণ ঘুমেছিল।
ফারহান হাতে থাকা জ্বলন্ত সিগারেটটা ফেলে দিয়ে অয়নন্দিতার দুই বাহু আঁকড়ে ধরে পাছে সে পড়ে যায়। বসা গলায় অয়নন্দিতা প্রশ্ন করে,
‘না ঘুমিয়ে এখানে সিগারেট টানছেন?’
অয়নন্দিতার বসা গলাটা অদ্ভুত রকম শোনাচ্ছিল। কিন্তু এই শব্দটা ফারহানের বেশ ভালো লাগছিল। মন চাইছিল আরও কথা বলুক অয়নন্দিতা। কিন্তু ডক্টর বলে গেছে বেশি কথা না বলতে। জোর করে শব্দ করে কথা না বলতে। নয়তো ভোকাল কর্ডে সমস্যা হতে পারে। ফারহানের চোখে মুখে স্নিগ্ধ হাসি। অয়নন্দিতা উত্তর না পেয়ে আবারও প্রশ্ন করে,
‘এত রাতে এখানে কী করেন? ঘুমাবেন না?’
এবার ফারহান জবাব দেয়,
‘ঘুম আসছিল না।’
‘কেন?’
‘ঘুমকে জিজ্ঞেস করতে হবে।‘
‘ করেন প্রশ্ন। জিজ্ঞেস করেন, কেন সে এখনও আসছে না।’
ফারহান হাসছে। অয়নন্দিতা তাকিয়ে দেখছে ফারহানের দিকে। একটা সতেজ ভাব ফারহাবের মুখশ্রীতে। ফারহান প্রশ্ন করে,
‘তুমি ঘুম থেকে উঠলে কেন?’
‘হঠাৎই ঘুমটা ভেঙে গেছে। পাশে তাকিয়ে দেখি আপনি নেই।’
‘তাই খুঁজতে চলে এলে!’
‘হ্যাঁ।’
‘এত খোঁজার কারণ কী?’
অয়নন্দিতা পূর্বের মতোই তাকিয়ে আছে। ঠোঁটের কোণে মুচকি হাসি এনে জবাব দেয়,
‘যদি হারিয়ে ফেলি।’
‘হারানোর হলে সত্যিই হারিয়ে যাব একদিন। তার আগে হারিয়ে যাওয়া নিয়ে ভয় পেও না।’
কথাটা শুনে অয়নন্দিতার তার নিজের বাবা মায়ের কথা মনে পড়ে যায়। তারাও তো একদিন হুট করেই হারিয়ে গিয়েছিল অয়নন্দিতার হাসিখুশি জীবন থেকে। ফারহানও বলছে হারিয়ে যাওয়ার কথা। বাবা মায়ের হারিয়ে যাওয়াটা মানতে অনেকটা সময় লেগেছে৷ এবার যদি ফারহান হারিয়ে যায় তাহলে হয়তো অয়নন্দিতা আর এই পৃথিবীতে ভালো মতো বেঁচে থাকতে পারবে না। হারিয়ে যাওয়ার কথা শুনলেই বুকের ভেতরটা মোচড় দিয়ে ওঠে তার। আল্লাহ পাক কি তবে সমস্ত হারিয়ে যাওয়া তার জন্যই রেখে দিয়েছে নাকি? অয়নন্দিতা তেমন কিছু না ভেবে হঠাৎই ফারহানকে জড়িয়ে ধরে। এই প্রথমবার সে ফারহানকে নিজ থেকে জড়িয়ে ধরে।
অয়নন্দিতা যে তাকে এভাবে হুট করে জড়িয়ে ধরবে সে ভাবেনি। এই ঘটনার পর ফারহান কয়েক সেকেন্ডের জন্য ব্ল্যাক আউট হয়ে গেছে। অয়নন্দিতার শরীরের গরম ভাবটা পুরোপুরিভাবে ফারহানকে আঁকড়ে ধরেছে। জড়িয়ে ধরার কয়েক মিনিট পর অয়নন্দিতা টের পায় তার শরীরে ফারহানের হাত পড়েনি। দুঃখ হলেও সেই দুঃখটা চেপে রাখতে সক্ষম হয় অয়নন্দিতা। তার লোভের মাত্রা দিন দিন যে বেড়ে যাচ্ছে তা সে বুঝতে পারছে। ভালোবাসার লোভ অত্যন্ত খারাপ জিনিস। পৃথিবীতে টাকা পয়সার লোভের থেকেও মারাত্মক হলো ভালোবাসার লোভ। এই লোভ খারাপ মানুষকে মুহুর্তের মধ্যেই ভালো মানুষে পরিণত করে আবার ভালো মানুষকে মুহুর্তের মধ্যেই ভয়ংকর করে তোলে।
নিজেকে ফারহানের কাছ থেকে ছাড়িয়ে নিয়ে অয়নন্দিতা বলে ওঠে,
‘কাল তো অফিস আছে। ঘুমাতে চলুন।’
‘তুমি যাও। আমি কিছুক্ষণ পর আসছি।’
‘নাহ। কিছুক্ষণ পর না। এক্ষুনি চলুন।’
‘জোর খাটাচ্ছ মনে হচ্ছে।’
‘মনে হলে তা-ই। চলুন এখন।’
অয়নন্দিতা ফারহানকে ঘরে নিয়ে যায়।
‘শুয়ে পড়ুন। এরপর লম্বা একটা ঘুম দিন।’
‘তোমার শরীরের এখন কী অবস্থা অয়নন্দিতা?’
‘মাথা ব্যথা করছে।’
‘গলাটা তো একেবারেই বসে গেছে।’
‘সব একত্রে ধরল।’
‘তুমি শুয়ে পড়ো। আমি তোমার মাথাটা ম্যাসাজ করে দেই। দেখবে ভালো লাগবে।’
‘নাহ। লাগবে না। ঘুমিয়ে পড়ুন আপনি।’
অয়নন্দিতার পাশে শুয়ে পড়ে ফারহান। ততক্ষণে অয়নন্দিতার চোখ জোড়া বন্ধ হয়ে গেছে। ফারহান নিজেকে আর দমিয়ে রাখতে পারেনি। অয়নন্দিতা তার ব্যথাটা লুকিয়ে রাখলেও ফারহানের চোখ এড়ায়নি। ফারহান তার ডান হাত দিয়ে অয়নন্দিতার কপালের দুটো দিক ম্যাসাজ করা শুরু করে।
জানালা দিয়ে আসা ঘোলাটে আলোতে ঘুমন্ত অয়নন্দিতার চেহারাটা বড্ড বেশি মায়া মাখানো মনে হচ্ছে ফারহানের কাছে। হাতটা কপাল থেকে কখন যে অয়নন্দিতার গালে চলে আসে বুঝতে পারেনি।
ফারহান শুয়ে আছে অয়নন্দিতার পাশে। চোখে ঘুম নেই। মনটা বড়ো বেশি উদ্বিগ্ন হয়ে আছে। তবে কি সে অয়নন্দিতার ভালোবাসায় পা রাখতে চলেছে?

চলবে………………

#দ্বিতীয়_সূচনা
#পর্ব_২৮
লেখা – আফরোজা আক্তার
(কোনোক্রমেই কপি করা যাবে না)

ফরমাল পরে ফারহান রেডি হয়ে গেছে। অয়নন্দিতা বিছানায় হেলান দিয়ে বসে ফারহানকে দেখছে। আয়নায় অয়নন্দিতার রিফ্লেকশন দেখতে পাচ্ছে ফারহান। আয়নার সামনে নিজেকে তৈরি করছে আর আড়চোখে অয়নন্দিতাকে দেখছে।
গত পাঁচদিনের জ্বরে অয়নন্দিতার চোখ মুখ একেবারেই ফ্যাকাসে হয়ে গেছে। চোখের নিচের দিকটায় হালকা কালি পড়েছে। ঠোঁট জোড়াও শুকিয়ে কাঠ হয়ে আছে। চুলগুলোরও এই কয়েকদিন একেবারেই বাজে অবস্থা ছিল। যদিও গতকালকে সাজি আর রওশন বেগম মিলে তার মাথা ধুয়ে দিয়েছে। বেঁধেও দিয়েছে।
অয়নন্দিতার অসুস্থতা ফারহানকে বেশ চিন্তিত করে তুলেছিল। ছেড়ে ছেড়ে জ্বর আসা ভালো না। বার বার ডক্টরের সঙ্গে এ নিয়ে কথা বলেছে ফারহান। যখন যেই মেডিসিন সাজেস্ট করেছে সেটাই আনিয়েছে নয়তো নিজে গিয়ে এনেছে। রাত ভর অয়নন্দিতার মাথার পাশে বসে জাগিয়েছে। আপনজন হারানোর যন্ত্রণা ফারহান বোঝে। তাই ভয় হয় তার অয়নন্দিতাকে নিয়ে। যদিও অয়নন্দিতার সঙ্গে তার সম্পর্কটা আসলে কতটুকু গভীর সেটা নিয়ে সে এখনও দ্বিধা দ্বন্দ্বে আছে।
ফারহান সম্পূর্ণ তৈরি হয়ে পেছন ফিরে অয়নন্দিতার দিকে তাকায়। ফারহান তাকালে অয়নন্দিতাও হালকা হাসি দিয়ে হাতের ইশারায় বোঝায় ফারহানকে বেশ হ্যান্ডসাম লাগছে। ফারহানও অয়নন্দিতার ইশারায় এক গাল হেসে সামনে এগিয়ে আসে। পাশের খালি জায়গাটায় বসে পড়ে।
‘শরীর কেমন লাগছে এখন?’
‘ভালো।’
‘গলাটা এখনও ঠিক হচ্ছে না দেখছি।’
‘মনে হয় আর ঠিক হবে না।’
‘হা হা। ধুর বোকা। কেন ঠিক হবে না। আরও খাও আইসক্রিম।’
‘দুইটা খেয়েছিলাম। বুঝব কী করে যে আইসক্রিম খেলে আমায় এইভাবে জ্বরে ভুগতে হবে।’
‘যতদিন বাঁচবে ততদিন ভুলেও আর আইসক্রিমের কথা মুখেও আনবে না।’
এমন কড়া আদেশ! অয়নন্দিতা কিঞ্চিৎ রেগে বলে,
‘এটা কেমন কথা! জ্বর হয়েছে বলে আমি আইসক্রিম খাব না আর। তাও আবার সারাজীবনের জন্য।’
‘চেহারার কী করেছ দেখেছ তুমি? এত সুন্দর চোখ জোড়ার নিচে কালি পড়ে গেছে। এই যে এত সুন্দর আর্ট করা ঠোঁট তোমার। দেখেছ কেমন শুকিয়ে কাঠ হয়ে আছে। সেদিকে খেয়াল আছে তোমার?’
অয়নন্দিতা অবাক নয়নে ফারহানের দিকে তাকিয়ে আছে। পলক যেন পড়ছেই না তার চোখে। এই প্রথম ফারহান তার সৌন্দর্যের বর্ণনা দিল।
কিছুক্ষণ পর ফারহানও নড়েচড়ে বসে। সে কী সব বলল এতক্ষণ। অজান্তেই অয়নন্দিতার সৌন্দর্যের বর্ণনা করে দিল।
ফারহানের কাছ থেকে পজেটিভ ভাইব পাচ্ছে অয়নন্দিতা। তার মানে ফারহানও কি পজেটিভ হচ্ছে এই সম্পর্কটায়।
ফারহান কোনো রকমে কথা কাটিয়ে উঠে যায় বিছানা থেকে। আসছি বলে সোজা ঘর থেকে বের হয়ে যায়। অয়নন্দিতা তখন বিছানায় বসে মুচকি হেসে ঘরের দরজার দিকে তাকিয়ে থাকে। তার স্বপ্ন কি তবে সত্যি হতে চলেছে? ফারহান কি তবে তাকে ভালোবাসতে শুরু করে দিয়েছে?

অফিসে কাজের চাপ অনেক। রমজান শেখ সব দিক গুছিয়ে উঠতে পারছেন না। ফারহানকেও দেখতে হচ্ছে সব দিক। কাজে মন বসে গেলে কোনদিক দিয়ে যে সময় চলে যায় তার আর হিসেব থাকে না।
ল্যাপটপে হাত রেখেই ঘড়িতে নজর দেয় ফারহান। বিকেল সাড়ে চারটা বেজে গেছে। সে এখন পর্যন্ত লাঞ্চ করেনি। অয়নন্দিতা খেয়েছে কি না কে জানে। ফারহান চট করেই ফোনটা হাতে নেয় আর ফোন করে অয়নন্দিতাকে।
বার কয়েক বাজতেই অয়নন্দিতা ফোন রিসিভ করে।
‘হ্যালো।’
‘কী করছ?’
‘শুয়ে ছিলাম।’
‘দুপুরে খেয়েছ?’
‘হ্যাঁ।’
‘মেডিসিন নিয়েছ?’
‘হ্যাঁ। আপনি খেয়েছেন?’
সে যে এখনও লাঞ্চ করেনি এটা অয়নন্দিতাকে বলা যাবে না। বললেই বিপদ৷ তাই অকপটে মিথ্যা বলে দেয়,
‘হ্যাঁ।’
‘কখন ফিরবেন?’
‘দেখি কখন ফেরা যায়।’
‘আমি বসে থাকতে থাকতে বোর হয়ে গেছি।’
‘কেন বসে থাকছ কেন? সাজি কোথায়, মা কোথায়?’
‘সাজি বাসায় নেই। মা বের হয়েছে। ফারাশ ভাইয়াও নেই।’
‘তুমি বাসায় একা?’
‘আপাতত একা। নিচে তো বুয়া আছে।’
‘মহা মুশকিল।’
‘আমিও বের হবো।’
‘কোথায় যাবে?’
‘রিক্সায় ঘুরব।’
‘আবার!’
‘হ্যাঁ। মন চাইছে।’
‘সুস্থ হও আগে। এরপর ঘুরতে নিয়ে যাব।’
‘আমি তো সুস্থ-ই আছি।’
‘রেস্ট নাও। রাখছি এখন।’
ফারহান ফোন রেখে দেয়৷ অয়নন্দিতার মনটাও খারাপ হয়ে যায়। আজ কতদিন সে ঘরে বন্দী হয়ে রয়েছে। এখন শরীর মোটামুটি সুস্থ। বাড়ির বাইরে পা রাখলে বেশ ভালো হতো। বিছানা থেকে নামে অয়নন্দিতা। বারান্দায় গিয়ে বসে। শান্ত আকাশটার দিকে মুখ তুলে তাকায়। মাঝে মাঝে দুই একটা পাখি উড়ে যাচ্ছে। নীড়ে ফেরার সময় হয়েছে তাদের। তাই এদিক-সেদিক ছোটাছুটিতে ব্যস্ত তারা।
নিজেকে ভীষণ একা মনে হচ্ছে তার। এই সময় মামীর সঙ্গে থাকলে ভালো হতো। মামী নিশ্চয়ই তাকে একা রেখে কোথাও বের হতো না। শাশুড়িকেও দোষ দেওয়া যাচ্ছে না। তিনি কাজেই বের হয়েছেন। নয়তো এই কয়েকটা দিন তিনি যথেষ্ট করেছেন তার জন্য। সাজি পড়াশোনার জন্যই বের হয়েছে। ফারাশকে তো আর বলা যায় না পাশে বক্সে গল্প করো।
সবাই সবার মতো ব্যস্ত এ বাড়িতে৷ শুধু তারই ব্যস্ততা নেই। আজ মা বাবাকে মনে পড়ছে অয়নন্দিতার। বাবা থাকলে হয়তো বাবার সঙ্গে বসে গল্প করত। মা থাকলে হয়তো চুলে হাত বুলিয়ে দিত। কতদিন হলো মায়ের হাতের স্পর্শ পায় না অয়নন্দিতা। চোখে পানি এলেও নিজেকে দমিয়ে রাখে সে। এখন আর কাঁদে না তেমন। শুধু দোয়া করে তারা যেখানেই থাকুক, ভালো থাকুক।

হঠাৎ গাড়ির শব্দ কানে যায় অয়নন্দিতার। ইজি চেয়ার থেকে উঠে গিয়ে নিচে তাকায় সে। গেইট দিয়ে গাড়ি ঢুকেছে। হয়তো শাশুড়ি মা এসেছেন। একটা ছোটো নিঃশ্বাস গোপন করে অয়নন্দিতা। তার মন হয়তো এই সময় অন্য কাউকে আশা করেছিল। সব সময় সব আশা পূরণ হয় না। এটা অয়নন্দিতার জানা আছে।
চেয়ার থেকে উঠে ঘরে ঢুকতেই ভূত দেখার মতো চমকে যায় সে। তার সামনে ফারহান দাঁড়িয়ে আছে। এই সময় ফারহান কখনও বাড়ি আসে না। অয়নন্দিতা যে মনে মনে ফারহানকেই আশা করেছিল আর ফারহানও যে এইভাবে তার সামনে প্রকট হয়ে যাবে এটা তার ভাবনায় একেবারেই ছিল না। অয়নন্দিতা বেশ অবাক হয় ফারহানকে দেখে। প্রশ্ন করে,
‘আপনি! এই সময়ে?’
‘আশা করোনি বোধ হয়?’
অয়নন্দিতা সত্যিটাই বলে,
‘চেয়েছিলাম যাতে আপনি আসেন। কিন্তু ভাবিনি যে আসবেন।’
‘তোমার চাওয়া-পাওয়াগুলো আমার সামনে একবার প্রকাশ করতে পারো তো।’
‘সব চাওয়া-পাওয়া কি আর প্রকাশ করা যায়?’
‘যায় কি না জানি না। তবে করে দেখতে হয়।’
‘হঠাৎ বাড়ি এলেন যে?’
‘তৈরি হয়ে নাও। বের হবো আমরা।’
‘কোথায় যাব?’
‘রিক্সায় ঘুরতে যাবে না?’
অয়নন্দিতা যেন এক মুহুর্তেই আকাশের চাঁদ হাতে পেয়ে গেছে। মনে মনে চাওয়া জিনিসটা যখন বাস্তবে রুপ নেয় তখন এর থেকে ভালো কিছু হয়তো আর হয় না। অয়নন্দিতা এক গাল হেসে মুগ্ধ নয়নে ফারহানের দিকে তাকিয়ে ঠোঁটের ইশারায় ধন্যবাদ জানায়৷ আর ফারহান, সেও অয়নন্দিতার মুগ্ধ ইশারায় একদৃষ্টে চেয়ে আছে।

চলবে………………………….

#দ্বিতীয়_সূচনা
#পর্ব_২৯
লেখা – আফরোজা আক্তার
(কোনোক্রমেই কপি করা যাবে না)

নীল হলুদে মিশ্রিত বাটিক শাড়িতে অয়নন্দিতাকে মাশা-আল্লাহ অপূর্ব লাগছে। শাড়ির উপরে মেরুন রঙের শালও জড়িয়েছে সে। অবশ্য শালটা সে পরতে চায়নি কিন্তু ফারহান তাকে শাল ছাড়া বেরও হতে দেয়নি। এই অসুস্থ শরীরে অয়নন্দিতাকে বাইরে বের করার অপরাধে তাকে বকা খেতে হবে। তার উপর যদি টের পায় অয়নন্দিতা শরীরে শাল জড়ায়নি তাহলে তো হয়েছেই। ফারহান জোর করেই শাল পরিয়ে দেয় অয়নন্দিতার।
নদীর পাড়ে বসে আছে দু’জন। অয়নন্দিতা তাকিয়ে আছে নদীর পানির দিকে। পাশে বসে ফারহানের নজর পানির দিকে না গিয়ে অয়নন্দিতার মুখশ্রী দেখতে ব্যস্ত।
ন্যুড রঙের লিপস্টিক মাখানো অয়নন্দিতার ঠোঁট জোড়া যেন প্রজাপতির ডানায় মতো লাগছে। কাজল বিহীন চোখ জোড়ায় যেন রাজ্য জয়ের আনন্দ। এত খুশি কেন অয়নন্দিতার চোখে। জানতে ভীষণ ইচ্ছা করছে ফারহানের। বলতে ইচ্ছে করছে, হ্যাঁ গো মেয়ে, রাজ্যের খুশি বয়ে বেড়াচ্ছে তোমার ওই শীতল চোখে। এর রহস্য কী। কিন্তু আফসোস, সে মুখ খোলার আগেই অয়নন্দিতা ঘাড় ফিরিয়ে ফারহানের দিকে তাকায়। আচমকা তাকাতেই ফারহানও ভড়কে যায়। সে যে এতক্ষণ ধরে একদৃষ্টে তাকিয়ে দেখছিল অয়নন্দিতাকে সেই বিষয়টা তো ধরা পড়ে গেল।
মলিন হাসি দিয়ে অয়নন্দিতা বলে,
‘আমার ভীষণ ভালো লাগছে জানেন তো। মনে হচ্ছিল আমি দম বন্ধ হয়ে মরেই যাব। কী এক অসুস্থতা ভর করল আর আমি একেবারেই ঘরবন্দী হয়ে গেলাম। একটু বাইরে বের হওয়ার জন্য মনটা ছটফট করছিল আমার।’
ছোটো বাচ্চারা যেমন বায়না করা খেলনাও পেলে আনন্দ পায় হয়তো অয়নন্দিতার আনন্দটাও তেমন। ফারহান এক গাল হেসে চোখ থেকে সানগ্লাসটা সরায়।
‘তোমার ভালো লাগছে সেটা না হয় বুঝলাম। কিন্তু আমায় যে আজ বকুনি খেতে হবে। তখন কি আমায় বাঁচাবে?’
‘বকুনি খাবেন কেন?’
‘কেন খাব না, এইযে অসুস্থ মানুষটাকে নিয়ে বের হলাম। মা এতক্ষণে হয়তো টের পেয়ে গেছে। আমায় ফোন করল বলে। কথাটা বাবার কানেও যাবে। এরপর দু’জন মিলে বকবে আমায়। সাথে ওই দুই সাগরেদ একজন সাজি ম্যাডাম অন্যজন ফারাশ স্যার। তারাও তালে তাল দেবে।’
অয়নন্দিতা খিল খিল করে হেসে ওঠে। বলে,
‘বেশ হবে। আমি বলব, আমি আমি বের হতে চাইনি। তিনিই আমায় জোর করে বের করিয়েছেন।’
‘এইভাবে মিথ্যা বলতে পারবে তুমি, তাও আবার আমার নামে। আমায় যখন বকবে কষ্ট হবে না তোমার?’
অয়নন্দিতার হাসিটা মলিন হয়ে যায়। ভাবে৷ ঠিকই তো, তারই তো ইচ্ছা ছিল বাইরে বের হওয়ার। ফারহান শুধু সাহায্য করেছে তাকে। এখন তো ফারহানকেই বকা শুনতে হবে। ফারহান হাসিমুখে অয়নন্দিতাকে দেখছে। অয়নন্দিতা যে কিছু ভাবছে সেটাও ফারহান জানে।
‘যা ভাবছ আর ভেবে কাজ নেই। আমার বউয়ের জন্য এতটুকুন বকা হজম করার মতো শক্তি আমার আছে। কেমন?’
আমার বউ– শব্দটা শুনে অয়নন্দিতার ভেতরটা ছ্যাত করে ওঠে। ফারহান নিজের মুখে বলল আমার বউ। অয়নন্দিতার শরীরটা যেন মুহুর্তেই শীতল বাতাসে জুড়ে গেল। চারদিকে তাকাতে লাগল সে। হিম বাতাস বইছে।
ফারহান সামনের দিকে তাকিয়ে আছে। পাশেই ফুচকার দোকান। সে জানে অয়নন্দিতার ফুচকা ভীষণ পছন্দ। ফারহান এক প্লেট ফুচকার অর্ডার দিয়ে দেয়। এর আগে ফারহান কখনও রাস্তার পাশে দাঁড়ায়নি আর সেই ফারহান এখন অয়নন্দিতার সাথে বসে ফুচকা খায়। সময়গুলো বড্ড বেশি পরিবর্তনশীল। আগের মানুষটাকে ভালোবেসেও পূর্ণতা পায়নি ফারহান। আর এই মানুষটাকে ভালো না বেসেও পূর্ণতা পাচ্ছে প্রতিনিয়ত। একদম সাধারণ জীবন যাপনেও যে এত পূর্ণতা তা আগে বুঝতে পারেনি ফারহান। হয়তো এই বোঝানোর ক্ষমতাটা আগের মানুষটার মধ্যে ছিল না। তাই তো সে না পেরেছে ভালোবাসায় পূর্ণতা দিতে না পেরেছে ফারহানকে এই ছোটো ছোটো আনন্দের মূল্য বোঝাতে।

শীতের বিকেলটা অনুভব করতে পেরে মুচকি হাসে অয়নন্দিতা। পড়ন্ত বিকেলে ঠান্ডা ভাব আর রোদের উঁকি ঝুঁকির খেলাটা তার বরাবরেরই পছন্দ। আজ অসুস্থ শরীরর আরও ভালো লাগছে।
নীরবতা পালন করে ফারহানও পাশেই হাঁটছে অয়নন্দিতার। এত সুন্দর পরিবেশে নীরব থাকতে মোটেই ভালো লাগছে না তার। প্রাণ খুলে কথা বলতে পারলে ভালো হতো। কিছুটা পথ গিয়েই অয়নন্দিতা বলতে শুরু করে,
‘আপনি চুপ কেন?’
প্রশ্নটা ফারহানের কানে যেতেই মুখ তুলে তাকায় সে।
‘তুমি তো কিছুই বলছ না। তাই আমিও চুপচাপ।’
‘আমি তো ভাবলাম আপনি আমার উপর ক্ষেপে আছেন।’
‘এমনটা ভাবার কারণ কী?’
‘সব থেকে বড়ো কারণ আপনার অনেকটা সময় খরচ হয়ে গেছে। এই সময়টুকুন অফিসের কাজে লাগাতে পারতেন। আমার জন্য শুধু শুধু এখন হাঁটতে হচ্ছে আপনাকে।’
‘আমার হাঁটতে খারাপ লাগছে না। আর সময় খরচের কথা বললে তো, তাহলে তুমি বোধ হয় একটা কথা ভুলে গেছ।’
কিঞ্চিৎ অবাক হয় অয়নন্দিতা। প্রশ্ন করে,
‘কোন কথা ভুলে গেলাম আমি।’
‘মনে করে দেখ।’
‘উমমম,,, নাহ মনে তো পড়ছে না। কোন কথা ভুলে গেছি আমি।’
ফারহান হালকা হেসে বলতে শুরু করে,
‘চলার পথে কাটা থাকবে। অনেক সময় পায়েও বিঁধবে। ব্যথাও লাগবে, রক্তও ঝরবে। তবুও এগিয়ে যেতে হবে। সত্যিকারের ভালোবাসা ধরা পড়বেই। একদিন আগে হোক আর একদিন পরে হোক। আপনার ভালোবাসা থেকে খানিকটা ভালোবাসা আমার পেছনে ইনভেস্ট করতে পারেন। লাভ না হলেও লস হবে না আশা করি — এই কথাটা কেউ একজন আমায় বলেছিল। আফসোস যে বলেছিল সে-ই আজ ভুলে গেছে।’
অয়নন্দিতার মনে পড়ে যায়। রাঙামাটি গিয়ে একদিন বিকেল বেলা সে নিজেই ফারহানকে বলেছিল এই কথাটা। সেদিন কথার মারপ্যাঁচেই হোক আর একটু ঘুরিয়ে-প্যাঁচিয়েই হোক ফারহানকে নিজের মনের কথাটা বলেছিল অয়নন্দিতা। কিন্তু ফারহান আজকে হঠাৎ সেই কথাটা এখন বলল কেন? এদিকে অয়নন্দিতাকে চুপ থাকতে দেখে ফারহান বলে,
‘এবার মনে পড়েছে?’
‘একদিন বলেছিলাম বোধ হয়।’
‘বোধ হয়!’
ফারহানের রিয়েকশন দেখে অয়নন্দিতা হেসে দেয়।
‘কিন্তু সেই কথাটা এখানে কেন এলো।’
‘যেভাবে তুমি খরচের কথাটা এনেছ সেভাবেই এই কথাটাও এলো।’
‘আমি না অবাক হলাম অন্য বিষয়ে।’
‘কোন বিষয়ে?’
‘এইযে আপনি আমার বলা হুবুহু কথাটা বললেন। আপনার ব্রেইন অনেক শার্প।’
‘তাহলে ভাবো, আমি কত ব্রিলিয়ান্ট।’
‘হয়েছে হয়েছে, এখন বলুন তো কথাটা এখানে কেন এলো।’
‘ধরে নাও আমি আমার ভালোবাসার খানিকটা তোমার পেছনে ইনভেস্ট করতে চাচ্ছি। কতটা প্রফিট হবে জানি না। তবে এতটুকুন আমিও শিওর আছি যে, অধিক লাভ না হলেও লস একেবারেই হবে না।’
ফারহানের কথাটা শুনে অয়নন্দিতার পা জোড়া চলতি পথেই থেমে যায়। ফারহানও কি তবে তার দিকে অগ্রসর হচ্ছে? অয়নন্দিতার মায়াবী চোখে চেয়ে থাকা ফারহানের হৃদয়ে এক উষ্ণ অনুভূতি অনুভব হয়। এই চোখ জোড়া যেন বলে দিচ্ছে গভীর ভালোবাসার কথা। এই চোখ জোড়া যেন জানান দিচ্ছে অজানা পথে হারিয়ে যাওয়ার বার্তা।

চলবে………………………….

#দ্বিতীয়_সূচনা
#পর্ব_৩০
লেখা – আফরোজা আক্তার
(কোনোক্রমেই কপি করা যাবে না)

বাড়িতে পা রাখতেই রওশন বেগম, সাজি এবং রমজান শেখ-এর সামনে পড়ে ফারহান আর অয়নন্দিতা। তারা তিনজন ড্রইংরুমেই বসে ছিল। ফারহান আর অয়নন্দিতাকে দেখে তিনজনের মুখেই হালকা হাসি। রওশন বেগম বসা থেকে উঠে অয়নন্দিতার কাছে যান। ছেলের বউকে আঁকড়ে ধরেন। কপালে হাত দিয়ে চেক করেন জ্বর আছে কি না।
শাশুড়ি মায়ের এই ভালোবাসাটুকুই অয়নন্দিতাকে এখন আর মায়ের অভাব বুঝতে দেয় না। শ্বশুর মশাইয়ের স্নেহটুকুই অয়নন্দিতাকে এখন আর বাবার অভাব বুঝতে দেয় না। সাজির বোনের মতো আচরণটুকু অয়নন্দিতাকে এখন আর একাকীত্ব বুঝতে দেয় না।
আর ফারহান, তার কিছুটা ভালোবাসা বাকিটা বন্ধুত্বসুলভ আচরণ তাকে দ্বিধায় ফেলতে বাধ্য করে, ফারহান কি তাকে ভালোবাসে নাকি কখনও ভালোবাসতে পারবে না নাকি তাদের দু’জনকে সারাজীবন বন্ধু হয়েই কাটাতে হবে?
অয়নন্দিতা তার শাশুড়ি মায়ের পাশে গিয়ে বসে। ছেলের বউয়ের মাথায় হাত রেখে রওশন বেগম বলেন,
‘এই অসুস্থ শরীরে বাইরে যাওয়ার কী দরকার ছিল অয়নন্দিতা? এখন যদি শরীরটা আরও খারাপ হয়, তখন কী হবে?’
অয়নন্দিতা কিছু বলতে যাবে তখনই ফারহান বলে,
‘তোমার বউমাকে অত্যন্ত সাবধানেই রেখেছি মা। চিন্তা কোরো না, কিছু হবে না ইনশাআল্লাহ।’
‘আরও কিছুদিন পর বের হলেই ভালো হতো।’
‘অসুস্থ বলে কি একটু ঘুরতে পারবে না বেচারি? তার কথাতেই বোঝা যাচ্ছিল যে, সে বোর হচ্ছে। তাই ভাবলাম আমিও যখন ফ্রী আছি একটু বের হই ওকে নিয়ে।’
রমজান শেখ ছেলের কথায় সমর্থন জানিয়ে বলেন,
‘এইভাবে ঘরবন্দী থাকলে আরও অসুস্থ হয়ে যাবে। এর চেয়ে বরং একটু আধটু ঘুরবে। এটাই ভালো।’
সামনা-সামনি বসাতে দু’জন দু’জনকে সরাসরিই দেখতে পাচ্ছে। অয়নন্দিতার অবাক চোখ ফারহানকে দেখে যাচ্ছে আর ফারহানের চোখ অয়নন্দিতার চোখের ভাষা বোঝার চেষ্টা করছে। চোখ জোড়া গভীর ভালোবাসার জানান দিচ্ছে ফারহানকে। তাদের এই চোখাচোখিতে ভাব বিনিময় তৃতীয় ব্যক্তির চোখে পড়ে। সাজি একদিকে মোবাইল ফোনে ব্যস্ত, আবার অন্যদিকে ভাই-ভাবীকে দেখতে ব্যস্ত। চোখের সামনে এদের দু’জনকে দেখলে ঠোঁটের কোণে অটোমেটিকলি হাসি চলে আসে। সাজি এই ভেবেই খুশি যে তার ভাইটা আস্তে আস্তে এই সম্পর্কের প্রতি স্বাভাবিক হচ্ছে।

ফারহান এবং রমজান শেখ স্টাডি রুমে চলে যান। রওশন বেগমকে দু’কাপ চা পাঠাতে বলেন রমজান শেখ। ব্যবসা নিয়ে কিছু আলাপ আলোচনায় বসবেন বাবা-ছেলে। এই বাড়িতে আলাদা করে একটা স্টাডি রুমের ব্যবস্থা করা হয়েছে যেখানে একান্তে বসে অফিসের কাজগুলো করা যায়। প্রথমে রমজান শেখ এই স্টাডি রুমে কাজ করতেন। আর এখন বাবা এবং ছেলে দু’জনেই বসেন এই রুমে। কিছুদিন পর হয়তো আরও একজন বসবেন। যিনি এখনও ঘুরে বেড়াতেই ভালোবাসেন। রমজান শেখ ফারহানকে বার বার বলছেন ফারাশকে ব্যবসা বুঝিয়ে দিতে কিন্তু ফারহান চায় ফারাশ আরও কিছুটাদিন ঘুরেফিরে কাটাক। এরপর তো সারাজীবন ব্যবসা-ই সামাল দিতে হবে।
খানিক বাদেই দু’কাপ চা নিয়ে স্টাডি রুমে হাজির হয় অয়নন্দিতা। চায়ের ট্রে হাতে নিয়ে অয়নন্দিতাকে এইভাবে আশা করেনি ফারহান। রমজান শেখ হাসিমুখে বলেন,
‘তুমি নিয়ে আসলে কেন মা, বুয়া কোথায়?’
অয়নন্দিতা হালকা হেসে জবাব দেয়,
‘বুয়া কিচেনে অন্য কাজে ব্যস্ত আছে বাবা। তাই আমিই নিয়ে এলাম।’
‘আচ্ছা।’
বাবার চোখের আড়ালে ফারহান আড়চোখে অয়নন্দিতাকে দেখছে। অয়নন্দিতা চায়ের ট্রে-টা টেবিলের ওপর রেখে দরজা অবধি চলে গিয়েও পেছনে ফিরে তাকায়। মন বলছিল ফারহান হয়তো তার দিকে তাকিয়ে আছে। মনের কথাটাই সত্যি হয়েছে। পেছনে তাকিয়ে ফারহানের চোখে চোখ পড়ে তার। হালকা হেসে ঘাড়টা নিচু করে রুম থেকে বের হয়ে যায় অয়নন্দিতা। ফারহান কিছুক্ষণের জন্য যেন ফ্রিজড হয়ে যায়। অয়নন্দিতার এই রুপটা আগে কখনও দেখেনি সে কিংবা দেখা হয়নি। লুকায়িত সেই রুপটা আজ দেখে নিজের ইমোশনকে কন্ট্রোল করতে হিমসিম খেতে হচ্ছে ফারহানকে। আরও কিছুটা সময় অতিবাহিত করতে ইচ্ছে করছে অয়নন্দিতার সঙ্গে। কিন্তু আপাতত সে রমজান শেখের সঙ্গে আছে। চাইলেই এখান থেকে বের হওয়া যাবে না।
রাত প্রায় সাড়ে এগারোটা। অয়নন্দিতা বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছে। রাত আটটা অবধি মনটা ভালো থাকলেও আটটার পর থেকেই মনটা বিষন্নতায় ছেয়ে গেছে অয়নন্দিতার। ফারহান বলেছিল রায়ে আর বের হবে না, কিন্তু তবুও সে বের হয়েছে। চল্লিশ মিনিট স্টাডি রুমে অতিবাহিত করে ঘরে এসেই শার্ট চেঞ্জ করে বের হয়ে যায় ফারহান। অয়নন্দিতা সাহস করে একবার জিজ্ঞেসও করেছিল ফারহানকে। ফারহান হাসিমুখে জবাব দেয়, একটা জরুরী কাজ পড়েছে। ঘন্টা খানেকের মধ্যে চলে আসব। একত্রে খাবার খাব এসে।
কিন্তু ঘন্টা খানেক হয়ে আরও দুই ঘন্টা অতিবাহিত হয়ে গেছে। ফারহান এখনও আসছে না। কয়েকবার ফোনও করেছিল কিন্তু ফারহান ফোনটা রিসিভ করেনি। আকাশে মেঘ জমেছে। এমনিতেই হালকা শীত পড়ছে। তার উপর যদি বৃষ্টি হয় তাহলে তো আর কোনো কথাই রইল না।
অয়নন্দিতার চোখ জোড়া বাড়ির বড়ো ফটকের দিকে। কখন একটা গাড়ি বাড়ির ভেতরে ঢুকবে সেই অপেক্ষায় আছে সে। এদিকে ক্ষুধাও লেগেছে ভীষণ। রাতের খাবার খাওয়ার সময় খাবার টেবিলে সবাই জোর করেছিল তাকে। বলেছিল খেয়ে নিতে সবার সঙ্গে। কিন্তু অয়নন্দিতা জানে খাবার তার গলা দিয়ে নামবে না। কারণ, ফারহান বলে গিয়েছে এসে একত্রে খাবার খাবে। তাই অয়নন্দিতা পরে খাব বলে সেখান থেকে সরে যায়। অপেক্ষায় আছে ফারহানের। কখন সে আসবে আর কখন তারা দু’জন এক সঙ্গে খাবার খাবে।
দরজায় টোকা পড়ার সঙ্গে সঙ্গে অয়নন্দিতা দৌড়ে ঘরের ভেতর চলে আসে। ভেবেছে ফারহান এসে গেছে। ফারহানকে মনের মধ্যে এতটাই বসিয়ে নিয়েছে যে, বোকা মেয়ে বেমালুম ভুলে গেছে যে বাড়ির ভেতরে কোনো গাড়ি-ই ঢুকেনি। ফারহান তো গাড়ি নিয়ে বের হয়েছিল। ঘরে এসে অবাক হয় অয়নন্দিতা। ফারহান না দরজায় দাঁড়িয়ে আছে ফারাশ। এত রাতে ফারাশকে ঘরে দেখে অনেক কিছুই মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছিল অয়নন্দিতার। ফারাশও বুঝতে পেরেছে তার ভাবী হয়তো এখানে অন্য কাউকে আশা করেছিল। অয়নন্দিতাকে কমফোর্ট জোনে রাখার জন্য মুখে হাসি আনে ফারাশ।
‘ভেতরে আসতে পারি?’
ফারাশের প্রশ্ন শুনে আরও অবাক হয় অয়নন্দিতা। অবাক হয় এই ভেবে যে, তাদের বাড়ি তাদের ঘর অথচ ফারাশ অনুমতি নিচ্ছে সে ভেতরে আসবে কি না। অয়নন্দিতা সঙ্গে সঙ্গে ফারাশকে ভেতরে আসতে বলে। ফারাশ সোফায় বসতে বসতে বলে,
‘বারান্দায় ছিলে বুঝি?’
‘জি।’
‘ভাইয়ার জন্য অপেক্ষা করছিলে?’
উত্তরটা হ্যাঁবোধক হলেও অয়নন্দিতার উত্তর দিতে অস্বস্তি হচ্ছিল তাই চুপ করে আছে সে। ফারাশ এইবারও অয়নন্দিতার না বলা কথাটুকু বুঝে নেয়।
‘খাবারও তো খেলে না দেখলাম।’
‘ক্ষুধা লাগেনি।’
‘ক্ষুধা লাগেনি নাকি ভাইয়ার জন্য অপেক্ষা করছ?’
এইবারের উত্তরটাও হ্যাঁবোধক। কিন্তু এইবারও চুপ অয়নন্দিতা। আর এইবারও ফারাশ বুঝে নেয়।
‘ভাইয়া চলে আসবে। টেনশন নিও না। ভাইয়া না আসা পর্যন্ত আমরা কথা বলি। কেমন?’
‘আচ্ছা।’
‘তুমি কিন্তু আমার ছোটো।’
‘হ্যাঁ। জানি আমি।’
‘কিন্তু সম্পর্কে বড়ো। এখন তুমিই বলো তোমায় কী বলে ডাকব। ভাবী নাকি অন্য কিছু?’
‘যেভাবে ডাকলে আপনার সুবিধা হবে।’
‘এই ওয়েট ওয়েট, আমি তোমার বড়ো তবে এতটাও বড়ো নই। আর সম্পর্কে আমি তোমার দেবর, ভাসুর নই। সো আপনি আজ্ঞে কোরো না। আপনি থেকে তুমিতে ট্রান্সফার হও।’
‘কিন্তু,,,’
‘কিন্তু টিন্তু বাদ। ট্রান্সফার লেটার আগামীকাল নিয়ে আসব।’
ফারাশের কথা শুনে অয়নন্দিতা না চাইতেও হেসে দেয়। অয়নন্দিতার হাসি দেখে ফারাশও হাসে। ফারহান আর ফারাশের হাসিটা প্রায় এক রকম। ফারহানের মতো ফারাশও বেশ সুদর্শন। বিয়ের এতদিন পরও তাদের মধ্যে তেমন কথা হতো না। ফারাশ তার বন্ধু বান্ধবী নিয়ে ব্যস্ত থাকে। এখানে সেখানে ট্যুর দেয়। সেইসব নিয়ে ব্যস্ত থাকে তাই তেমন কথা এবং দেখা হতো না তাদের। আজ কী মনে করে ফারাশ নিজ থেকেই এই ঘরে এসেছে কে জানে।
অয়নন্দিতাকে ফারাশ আবারও প্রশ্ন করে,
‘বললে না তো তোমায় আমি কী বলে ডাকব?’
‘যা ডেকে তুমি কমফোর্ট ফিল করো।’
‘ভাবী ডাকতে আন-কমফোর্ট লাগে। অয়নন্দিতাও বড়ো নাম। অভ্যস্ত নই আমি। ছোটো একটা নাম দিতে হবে তোমার।’
ফারাশ বেশ মজার মজার কথা বলে। তার কথা শুনে মানুষকে না চাইতেও হাসতে হয়। অয়নন্দিতা হেসে বলে,
‘তবে একটা ছোটো নাম দিও৷’
‘ওকে রাজরানী।’
‘রাজরানী! আমি রাজরানী!’
‘হ্যাঁ। ভেবে নাও এটা আমাদের ছোটো একটা রাজ্য। এই রাজ্যের মহারাজা হচ্ছেন রমজান শেখ আর মহারানী রওশন বেগম। তাদের দু’জন রাজকুমার একজন রাজকুমারী। বড়ো রাজকুমারের বধূ তুমি। তাহলে তুমি তো রাজরানী-ই হলে। তাই না।’
অয়নন্দিতা গালে হাত দিয়ে ফারাশের কথাগুলো শুনে গেল। কীসব রাজ্য, মহারাজ, রাজকুমারের গল্প বলল। ফারাশ চেয়ে আছে অয়নন্দিতার দিকে। মেয়েটাকে বেশ ভালো লাগে তার কাছে। বিশেষ করে তার চোখ জোড়া ফারাশকে বেশ ভাবাচ্ছে। যেন রাজ্যের রহস্য লুকিয়ে আছে ওই দুটো চোখে। ফারাশ ভাবে, এই মেয়েটাই পারবে তার ভাইয়ের যন্ত্রণাগুলোকে ধীরে ধীরে কমিয়ে দিতে। হুট করেই ফারাশ বলে ওঠে,
‘ব্যাস, পেয়ে গেছি নাম। তোমায় আমি রাজরানী বলে ডাকব। সকালে সাজিকেও বলব যাতে ও তোমায় রাজরানী বলে ডাকে।’
‘রাজরানী, কেমন একটা মুঘল আমলের মতো শোনাচ্ছে না?’
‘নো সমস্যা। শোনালে শোনাক। তুমি আমাদের এই ছোটো রাজ্যের রাজরানী।’
‘তোমার রানী কবে আসবে?’
‘হা হা, আগে এই রাজকুমার নিজের পায়ে দাঁড়াক।’
‘এখন কী অন্যের পায়ে দাঁড়িয়ে আছো?’
ফারাশ জবাব দিতে যাবে ওমন সময় ফারহান ঘরে ঢোকে। এই সময় ফারাশকে নিজের ঘরে অয়নন্দিতার সঙ্গে দেখে ফারহানের ভ্রু জোড়া কিঞ্চিৎ কুঁচকে যায়। ফারাশ এবং অয়নন্দিতা উভয়ের নজর পড়ে ফারহানের দিকে। এতক্ষণ পরে অয়নন্দিতার স্বস্তির নিঃশ্বাস পড়ে। তার সামনে যে ফারহান দাঁড়িয়ে আছে। বড়ো ভাইকে দেখে ফারাশ বলে,
‘রাজকুমার হাজির।’
ফারহান ভেতরে প্রবেশ করে বলে,
‘কী ব্যাপার! ফারাশ সাহেব কি রাস্তা ভুলে আমার ঘরে ঢুকে পড়েছে নাকি?’
‘আজ্ঞে না। আপনি এত দেরি করে এলেন। রাজরানী তো আপনার প্রতিক্ষায় ফটকের দিকে চোখ মেলে তাকিয়ে ছিল। তাই, এই অধম রাজরানীর মনটা ভালো করার জন্য বকবক করছিল।’
‘কীসব যে বলিস মাঝে মাঝে।’
‘যা বলি ভালোই বলি৷ রাজরানী তোমার অপেক্ষা করতে করতে রাতের খাবারটাও খায়নি। ফ্রেশ হয়ে দু’জন মিলে রাতের খাবারটা খেয়ে নাও।’
ফারাশের কথা শুনে ফারহান অয়নন্দিতার দিকে তাকায়। মনে পড়ে সে বলে গিয়েছিল, সে আসলে দু’জন একত্রেই খাবে। বারোটার বেশি বেজে গেছে। ভেবেছিল কাজটা তাড়াতাড়ি শেষ করতে পারবে৷ কিন্তু এত দেরি হবে বুঝতে পারেনি।
ফারাশ বিদায় নিয়ে ঘর থেকে বের হয়ে যায়। ফারহান অয়নন্দিতার কাছে চলে আসে। দুই হাত দিয়ে অয়নন্দিতার বাহু জোড়া আঁকড়ে ধরে। হালকা হেসে বলে,
‘তুমি ডাইনিংয়ে খাবার দাও। আমি ফ্রেশ হয়ে আসছি। কেমন?’
অয়নন্দিতা এক গাল হেসে হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়ায়। ফারহান ওয়াসরুমে চলে গেলে অয়নন্দিতাও নিচে যাওয়ার জন্য ঘর থেকে বের হয়।

চলবে…………………………..