দ্বিতীয় সূচনা পর্ব-৪৬+৪৭+৪৮+৪৯

0
474

#দ্বিতীয়_সূচনা
#পর্ব_৪৬
লেখা – আফরোজা আক্তার
(কোনোক্রমেই কপি করা যাবে না)

নাস্তার টেবিলে ফারহানের নজর অয়নন্দিতার দিকে। গত রাতের ঘটনার জন্য হয়তো কষ্ট পেয়েছে অয়নন্দিতা। ঘুম থেকে উঠে অয়নন্দিতাকে কাছে পায়নি সে, তাই আর আলাদা করে কথা হয়নি তাদের। টেবিলের একপাশে ফারহান অন্যপ্রান্তে অয়নন্দিতা। সাজির সঙ্গে গল্পে মেতেছে সে। ফারাশ একবার নিজের ভাইকে দেখছে আবার অয়নন্দিতাকে দেখছে।
কিছুক্ষণ পর রমজান শেখ টেবিলে বসলে ফারহান নতুন অর্ডারের ব্যাপারে কথা বলতে শুরু করে। ফারাশও সেই কথায় নিজের মতামত জানায়।
খাওয়া দাওয়ার পর ফারাশ এবং রমজান শেখ বের হয়ে যায়৷ ফারহান কিছুটা সময় টেবিলেই বসে থাকে। ততক্ষণে অয়নন্দিতা নিজের ঘরে চলে যায়। ঘরটা অগোছালো হয়ে আছে। যদিও ফারহান গোছালো মানুষ তবুও কেন জানি অয়নন্দিতা নিজ হাতে গুছিয়ে শান্তি পায়। ফারহানও নিজের ঘরের দিকে পা বাড়ায়৷
ফারহানের রেখে যাওয়া তোয়ালেটা অয়নন্দিতা বারান্দার দড়িতে ঝুলিয়ে দেয়। বারান্দায় রোদ এসেছে। সকালবেলার রোদটা বেশ মিষ্টি হয়। শরীরে মাখলে শরীরটা বেশ গরম হয়। এইভেবেই পাশে দাঁড়িয়ে আছে অয়নন্দিতা। মাথা নিচু করে রোদ পোহাচ্ছে সে।
ঘরে অয়নন্দিতাকে না পেয়ে এদিক-সেদিক তাকায় ফারহান। হঠাৎই অয়নন্দিতার ওড়নার কিছু অংশ দরজার ফাঁকে দেখা যায়৷ ফারহান বুঝে যায়, অয়নন্দিতা বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছে। দরজায় থাকা লকটা আটকে দেয় ফারহান। চুপি চুপি শব্দহীন ভাবে হেঁটে হেঁটে অয়নন্দিতার পেছনে তাকায়। অয়নন্দিতা কোনো কিছু নিয়ে গভীর চিন্তা করছিল তাই সে টের-ও পায়নি তার পেছনে জলজ্যান্ত একজন মানুষ দাঁড়িয়ে আছে।
ফারহান হালক ঝুঁকে অয়নন্দিতার ঘাড়ে ফু দেয়। হালকা বাতাস ঘাড়ের চুলগুলোকে নাড়িয়ে দিতেই অয়নন্দিতা পেছনে ঘুরে তাকায়। আর তখনই ফারহান তাকে জড়িয়ে ধরে। আচমকা এইভাবে জড়িয়ে ধরার কারণ বুঝতে না পেরে অয়নন্দিতা ফারহানের বুকে চুপচাপ থাকে। অয়নন্দিতার নীরবতা উপলব্ধি করতে পেরে ফারহান কানের কাছে ফিসফিসিয়ে বলে,
‘মন খারাপ করে এখানে দাঁড়িয়ে আছো। আমার সঙ্গে কথাও বলবে না?’
‘আমি তো মন খারাপ করিনি।’
‘গতকাল রাতের জন্য সরি। তখন মাথাটা ভীষণ গরম ছিল। এর মধ্যেই তোমার ফোন। আমার ভুল হয়েছে। ফোনটা রিসিভ না করলেই পারতাম। সরি।’
‘সরি বলতে হবে না। আমি বুঝতে পেরেছি।’
‘তুমি রাগ করে আছো অয়নন্দিতা। আমি বুঝতে পারি তোমাকে।’
‘আমি রাগ করিনি। সত্যি বলছি।’
‘তবে আমি আসার আগেই ঘুমিয়ে গিয়েছিলে কেন? আর সকালবেলাও আমার সঙ্গে কথা বলোনি। এটা রাগ না তো কী?’
‘আমি রাগ করিনি। আমার অভিমান হয়েছে।’
‘অভিমান!’
‘হ্যাঁ। অভিমান।’
ফারহান মুচকি হাসে।
‘অভিমান ভাঙাবো কী করে?’
‘শাস্তি পেতে হবে।’
‘কী শাস্তি বলো। তোমার জন্য সব শাস্তি মাথা পেতে নেব।’
‘আমার সঙ্গে রাত জাগতে হবে। আজ সারারাত গল্প করতে হবে। এটাই তোমার শাস্তি৷’
শাস্তিটা নেহাৎই ছেলেমানুষী। ফারহান একটু শব্দ করেই হাসে। এরপর বলে,
‘ঠিকাছে। আজকের রাতটা তোমার সঙ্গে জেগে কাটাবো। অনেক গল্প করব।’
‘লুডু খেলতে হবে। হেরে গেলে ৫০০ টাকা জরিমানা।’
‘৫০০ টাকা জরিমানা! টাকার পরিমাণটা একটু বেশি হয়ে গেল না?’
‘কিহ??’
‘হা হা। আচ্ছা, ৫০০ টাকার বদলে ৫০০ টা চুমু দেব। চলবে?’
অয়নন্দিতা চোখ জোড়া বড়ো করে ফারহানের বুকে এলোপাথাড়ি ঘুষি মারতে শুরু করে।
‘খারাপ লোক একটা।’
‘এভাবে মারলে তো মরে যাব। তখন কাঁদলেও আর ফিরে আসব না।’
ফারহানের কথাটা শুনে অয়নন্দিতার বুকটা কেঁপে ওঠে। ঠিক যেমনটা ছোটোবেলায় নিজের বাবা মায়ের মৃত্যুর খবরটা শুনে বুকটা কেঁপে উঠেছিল। মুহুর্তের মধ্যেই দু’চোখে পানি জমাট হতে শুরু করে। কথাটা বলার সময় ফারহান বুঝতে না পারলেও এখন বুঝতে পারছে যে, সে ভুল মানুষকে ভুল কিছু বলেছে। অয়নন্দিতা অন্যান্য মানুষের মতো সাধারণ মানুষ না। তার ভেতরে যে কষ্ট লুকিয়ে আছে সেই কষ্টতে আরও খোঁচা দিয়েছে সে। অয়নন্দিতার গাল জোড়া চেপে ধরে কপালের সঙ্গে কপাল মেলায় ফারহান।
‘আই এম সরি। আমি কিন্তু মজা করেছি।’
‘এমন মজা কখনও কোরো না আমার সঙ্গে। জানো তো, এই মজাটা আমার সঙ্গে আমার বাবা মাও করেছে। তারা ফিরে আসেনি। আমার জীবনে তারা ফিরে আসেনি।’
ফারহান মজা করতে গিয়ে অয়নন্দিতার কলিজায় আঘাত করেছে। সে বুঝতেও পারেনি অয়নন্দিতা কষ্ট পাবে৷ অন্যদিকে অফিসেরও দেরি হয়ে যাচ্ছে। ফারহান অয়নন্দিতার কপালে চুমু দিয়ে বিদায় জানাতে চায়৷ অয়নন্দিতাও অনুমতি দেয়।
নিচে নেমে কী মনে করে যেন ফারহান উপরে তাকায়৷ বারান্দায় তখন অয়নন্দিতা দাঁড়িয়ে। মুচকি হেসে হাতের ইশারায় ফারহানকে বিদায় জানায় সে। ফারহানও হাসিমুখে হাতের ইশারা করে গাড়ি স্টার্ট দেয়। কয়েক সেকেন্ড পর ফারহানের গাড়িটা গেইটের বাইরে চলে যায়। আর অয়নন্দিতা পথের দিকে তাকিয়ে থেকে চাপা নিঃশ্বাস ছাড়ে। আকাশের দিকে এক নজর তাকায় সে।
‘আমার কাছ থেকে অনেক কিছু কেড়ে নিয়েছ তুমি। এই মানুষটাকে কিন্তু আমি চাইনি। এই মানুষটাকে কিন্তু তুমিই দিয়েছ আমায়। যাকে দিয়েছ তাকে কখনও নিয়ে যাওয়ার কথা ভাববে না। নয়তো আমি এবার পাথর হয়ে যাব। যেই পাথর ভেঙে কোনো সরঞ্জামও বানাতে সক্ষম হবে না কেউ৷’

চলবে………………………….

#দ্বিতীয়_সূচনা
#পর্ব_৪৭
লেখা – আফরোজা আক্তার
(কোনোক্রমেই কপি করা যাবে না)

নিজেকে যতটা সম্ভব শান্ত রাখার চেষ্টা করছে ফারহান। কিন্তু শান্ত রাখতে পারছেই না। তার ইচ্ছা করছে পুরো অফিসটা তছনছ করে ফেলতে। রমজান শেখ অর্থাৎ তার বাবা যেই সিদ্ধান্ত নিয়েছেন সেটাতে তার মত নেই। সে চায় পুরো অর্ডারটাই ক্যান্সেল করে দিতে। কারণ, সে জানে এখানে ঝামেলা হবে। রমজান শেখ কেবিনে এসে ছেলের মুখোমুখি বসেন।
‘ফারহান, তোমার কোথায় সমস্যা হচ্ছে?’
‘তুমি জানো না সমস্যা কোথায়?’
‘এই সমস্যার জন্য দায়ী কে? আমি নাকি আমরা নাকি তুমি?’
‘বাবা, আমি চাই না এই অর্ডার অনুযায়ী আমরা কাজ করি।’
‘ভুলে যেও না ফারহান, এখানে আমার সম্মান জড়িত।’
‘বাবা, সম্মান আরও যাবে। এদের সঙ্গে কাজ করা মানে এরা সব শেষ করে দিবে।’
‘এদের সঙ্গে রেগুলার ক্লাইন্টদের সাথে ঝামেলায় জড়াতে চাই না আমি।’
বাবাকে কিছুতেই বোঝাতে পারছেন না ফারহান। ভালো হবে না, কিছু ভালো হবে না। মন চাইছে সব ছেড়েছুড়ে চলে যেতে।

সাজিকে নিয়ে বের হয়েছে অয়নন্দিতা। শপিংমলে অন্যদিনের তুলনায় আজ একটু বেশিই ভিড়। সাজি কিছু ড্রেস কিনবে। অয়নন্দিতাও তার প্রয়োজনীয় কিছু নেবে। সেই উদ্দেশ্যেই আসা। এস্কেলেটরে উঠেই অয়নন্দিতার দেখা হয়ে যায় তার বান্ধবীর সঙ্গে। সাজি তাদের স্পেস দিয়ে অন্য দোকানে ঢোকে। এদিক-ওদিক দেখাদেখি করছে সে। কোনো ড্রেস-ই পছন্দ হচ্ছে না তার। অথচ নিয় কালেকশনের অভাব নেই। সেলসম্যান এসে পাশে দাঁড়ায়।
‘কোনটা দেখাব ম্যাম?’
‘কোনোটাই তো পছন্দ হচ্ছে না।’
‘কী বলছেন ম্যাম? এত এত ড্রেস, আর আপনি বলছেন পছন্দ হচ্ছে না।’
‘আসলেই হচ্ছে না। না হলে কী করব, বলুন।’
‘এপাশটা দেখতে পারেন। আশা করি ভালো লাগবে।’
‘আচ্ছা দেখছি আমি।’
সেলসম্যান চলে গেলে সাজি এপাশে ভালো করে নজর দেয়। কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকার পর সেখানে থাকা একটা কালো ড্রেসে নজর পড়ে তার। প্রথম দেখাতেই পছন্দ হয় তার। এই ড্রেসটাই নেবে সে। ড্রেসটার কাছে গিয়ে সেলসম্যানকে ডাকে সাজি।
‘এক্সকিউজ মি, এই ড্রেসটা।’
অ্যাট দ্য সেইম টাইম আরেকজনও সেইম এই ড্রেসটাই দেখিয়ে সেলসম্যানকে ডাকে। সেলসম্যান কনফিউজড হয়ে যায় দু’জনকে দেখে। সাজিও তার ভ্রু জোড়া কুঁচকে পাশে তাকায়। মনে মনে বিরক্ত হচ্ছে সে। এত খুঁজে একটা ড্রেস পছন্দ হলো তা-ও এখন ড্রেসটার ওপর অন্য একজন্রর নজর। সাজি পাশে তাকিয়ে আরও অবাক হয়ে যায়। তার পাশে হাসান দাঁড়িয়ে আছে। হাসান নিজেও বেশ অবাক হয়ে যায়৷ প্রায় অনেকদিন পর দু’জন দু’জনকে দেখেছে। লাস্টবার দেখা হয়েছিল অয়নন্দিতা যেদিন অসুস্থ হয়েছিল। তা-ও অন্তত দেড় মাস তো হবেই। হাসানের চোখমুখ ভালো না তেমন। মনে হয়, কত রাত নির্ঘুম কাটিয়েছে সে। হাসান সাজিকে দেখে একটু বিব্রতবোধ করে। সাজিই প্রথম সেধে কথা বলা শুরু করে,
‘হাসান ভাইয়া, আপনি এখানে?’
হাসান কিছুক্ষণ চুপ থেকে ধীর কন্ঠে জবাব দেয়,
‘কেমন আছো তুমি?’
‘আমি ভালো আছি। বাসায় সবাই ভালো?’
‘হ্যাঁ, ভালো।’
‘আপনি কি অসুস্থ নাকি?’
‘নাহ।’
‘ভাবীও এসেছে।’
‘অয়নি, কোথায় সে?’
‘ওই তো ওইখানেই আছে। ভাবীর এক ফ্রেন্ডের সঙ্গে দেখা হয়েছে। কথা বলছে।’
হাসানকে কিছু না বলতে দেখে সাজি আবারও বলে,
‘ড্রেসটা আপনি পছন্দ করেছেন। কার জন্য, মিলি ভাবীর জন্য?’
‘হ্যাঁ, আসলে, মানে,,,’
সাজি হালকা হাসে।
‘বুঝতে পেরেছি। আপনি নিয়ে যান ড্রেসটা।’
‘নাহ থাক। আমি অন্য দোকানে দেখব।’
‘পছন্দ যখন এটাই হয়েছে তবে অন্য দোকান কেন? এটাই নিয়ে নিন।’
‘এটা তো তোমারও পছন্দ হয়েছে।’
সাজি সেলসম্যানকে জিজ্ঞেস করে এই ড্রেসের আরেকটা পিস আছে কি না। কিন্তু সেলসম্যান জানায় এই ড্রেসটা এক পিস-ই আছে। কথাটা বলার পর পর-ই সাজি আয়নায় হাসানকে দেখে। তার মুখটা বিষন্নতায় ছেয়ে গেছে। বোঝা-ই যাচ্ছিল ড্রেসটা ভীষণ পছন্দ হয়েছে তার। আর মিলি ভীষণ সুন্দর। তাকে এই ড্রেসটায় বেশ ভালো মানাবে। সাজি খানিকক্ষণ তাকিয়ে থেকে চোখ সরিয়ে নেয়। বুকের ভেতরটা কেমন জানি করছে তার। সে সেলসম্যানকে বলে ড্রেসটা প্যাক করে হাসানকে দিয়ে দিতে। এতে হাসান কয়েকবার না করে। কিন্তু সাজি শোনেনি।
বিল পেমেন্ট করে হাসান দোকান থেকে বের হতে নিলেই অয়নন্দিতার মুখোমুখি হয়। ভাইকে অনেকদিন পর দেখে অয়নন্দিতা। হাসানের চোখ-মুখ দেখে অয়নন্দিতা ঘাবড়ে যায়। হাসানকে এর আগে কখনও সে এমন দেখেনি৷
‘কেমন আছো ভাইয়া?’
‘এইতো ভালো। তুই কেমন আছিস?’
‘খোঁজ খবর রাখো আমার?’
‘ব্যস্ত থাকি তো। তবে মায়ের কাছে তোর কথা শুনি।’
‘কী হয়েছে তোমার? এমন লাগছে কেন?’
‘কই, কিছু হয়নি তো।’
‘উহু, কিছু তো হয়েছে। বলো, কী হয়েছে?’
‘কিছুই হয়নি।’
অয়নন্দিতা বুঝে গেছে তার ভাই কিছুই বলবে না। তাকে একবার বাড়ি যেতে হবে। তবেই সে সব জানতে পারবে। কিন্তু মামীর সঙ্গে তো রোজ-ই কথা হয়, কই তিনি তো কিছুই বলেনি। আপাতত এইসব বাদ দিয়ে অয়নন্দিতা জিজ্ঞেস করে,
‘এখানে কী করছিলে?’
হাসান মুখ খুলবে তখনই সাজি পেছন থেকে বলে ওঠে,
‘ড্রেস কিনতে এসেছিলেন। আনফরচুনেটলি ওই ড্রেসটাই ওনার পছন্দ হলো, যেটায় আমার নজর পড়েছে।’
অয়নন্দিতা একটু তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকায় সাজির দিকে। এরপরের কাহিনী জানতে চাইলে সাজি বলে,
‘আনফরচুনেটলি এই এক পিস ড্রেস-ই এখানে এভেইলেবল।’
‘ড্রেসটা কে নিল অবশেষে?’
‘অবশেষে ড্রেসটা হাসান সাহেবের ভাগ্যেই ছিল।’
কথাটা শোনার পর হাসান ঘাড় ঘুরিয়ে সাজির দিকে তাকায়। সাজিও মলিন হাসি দেয়। হাসান অয়নন্দিতার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে চলে যায়। সাজি হাসানের প্রস্থানের দিকে গাঢ় নজরে তাকিয়ে থাকে। বুঝতে পারছে না সে হাসানকে দেখার পর ভেতরটা এমন করছে কী কারণে? আজ হাসানকে তার চোখে ভালো লেগেছে। ভীষণ ভালো লেগেছে। মনে হচ্ছিল যেন, পৃথিবীতে একমাত্র হাসান-ই আছে যে সুদর্শন পুরুষ মানুষ। বিশেষ করে হাসানের হাঁটার ভঙ্গিমাটা।

শপিং শেষ করে এস্কেলেটর দিয়ে নেমে রেস্টুরেন্টে ঢোকে সাজি আর অয়নন্দিতা। সাজি কফি খাবে। সাথে অয়নন্দিতাকে থাকতে হচ্ছে। কফি অর্ডার করে দু’জনেই বসে আছে। অয়নন্দিতা ফারহানকে একবার ফোন করেছিল। ফারহান রিসিভ করেনি। হয়তো ব্যস্ত আছে সে। সাজি হাসানকেই ভাবছে। কালো চেক শার্টে হাসানকে দারুণ লাগছিল তার চোখে। এমন সময়,
‘সাজি, তুমি এখানে!’
কথাটা শোনা মাত্রই সাজি পাশে তাকায়। এদিকে ফোন থেকে নজর সরিয়ে অয়নন্দিতাও সামনে থাকা মানুষটির দিকে তাকায়। তাকে দেখা মাত্রই সাজি শরীর রাগে রি রি করে ওঠে। হাতের মুঠো শক্ত হয়ে যায় তার। ইচ্ছে করছিল এই মুহুর্তে সবার সামনে ঠাটিয়ে এক চড় বসাতে। চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ায় সাজি৷ অয়নন্দিতাও দাঁড়িয়ে যায়। ঘৃণা মিশ্রিত কন্ঠে সাজি বলে,
‘জায়গাটা কি তোমার একার সম্পত্তি নাকি?’
সাজির কথা শুনে সামনের মানুষটি হেসে জবাব দেয়,
‘জায়গাটা পাবলিক প্রোপার্টি। যে কেউই আসবে।’
‘তাহলে বেকার প্রশ্ন করছ কেন?’
‘অনেক বছর পর দেখলাম তোমায়, তাই ভাবলাম কথা বলি।’
‘চোখের সামনে থেকে সরে যাও। নয়তো আমার হাত উঠে যাবে।’
‘রাগটা আগের মতোই আছে দেখছি। তা ইনি কে?’
অয়নন্দিতা দেখছে সাজি রেগে যাচ্ছে। মেয়েটা তাকে রাগান্বিত করছে। অয়নন্দিতা অবশ্য তাকে চিনতে পারছে না। পাবলিক প্লেসে কোনো অশান্তি হোক অয়নন্দিতা চাচ্ছে না৷ তাই সিচুয়েশন ঠিক করার জন্য বলে,
‘এক্সকিউজ মি, আপনি কে? আর এইভাবে যেচে এসে কথা বলছেন।’
‘সাজি আমায় চেনে।’
‘সাজিকে দেখে মনে হচ্ছে না সে আপনাকে সহ্য করতে পারছে। আপনি প্লিজ আসুন।’
মেয়েটা মুচকি হেসে সাজির দিকে তাকায়। আর সাজি ঘৃণার দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে তার দিকে।
‘ইনি নিশ্চয়ই তোমার ভাই আই মিন ফারহানের ওয়াইফ।’
কথাটা বলার পর অয়নন্দিতা অবাক হয়ে যায়। এতক্ষণে অয়নন্দিতা শিওর যে, এই মেয়ে সবাই চেনে। ভালো থেকো সাজি– বলেই মেয়েটা সামনে এগিয়ে যায়। সাজিও অয়নন্দিতাকে তাড়া দেয় এখান থেকে বের হয়ে যাওয়ার জন্য। অয়নন্দিতা সাজির কথানুযায়ী বের হতে হতে প্রশ্ন করে,
‘ইনি কে সাজি?’
অয়নন্দিতার প্রশ্নটা ওই মেয়ের কানে পৌঁছায়। সাজি কিছু বলার আগে মেয়েটা পেছন থেকে ডাকে।
‘এই যে ম্যাডাম।’
ডাক শোনার পর অয়নন্দিতা এবং সাজি একত্রে পেছনে তাকাতেই সে বলে ওঠে,
‘সাজি তোমার ভাবীকে বলো, আমার নাম বন্দনা।’
বন্দনা– নামটা শোনার সঙ্গে সঙ্গে অয়নন্দিতার আত্মা কেঁপে ওঠে। আর সাজি রাগে ফেটে পড়ে।

চলবে………………………….

#দ্বিতীয়_সূচনা
#পর্ব_৪৮
লেখা – আফরোজা আক্তার
(কোনোক্রমেই কপি করা যাবে না)

মিটিংরুমে মুখোমুখি বসে আছে ফারহান আর জাহরাফ। জাহরাফের মুখের ভঙ্গিই বলে দিচ্ছিল সে ভীষণ খুশি। অবশ্যই সে খুশি। ভীষণ খুশি। কারণ সে তার সামনে ফারহানকে দেখতে পাচ্ছে। তার কাছে ফারহানকে পরাজিত সৈনিক বলে মনে হয়। মনে হয় না, সে পরাজিত এক সৈনিক। হেরে যাওয়া মানুষ। আর হেরে যাওয়া মানুষদের মুখোমুখি হতে তার ভালো লাগে। ভীষণ ভালো লাগে৷
নির্লজ্জ আর ইতর টাইপ মানুষটাকে দেখার পরেও নিজেকে এইভাবে শান্ত রাখতে হচ্ছে ফারহানকে। কারণ, তার বাবার আদেশ। কোনো অশান্তি করা চলবে না। জাহরাফের হাসিটা তাকে ক্ষতবিক্ষত করছে। যেন মনে হচ্ছে, কেউ একজন তার পুরো শরীর ছুরি দিয়ে ফালা ফালা করছে। কিছুক্ষণ পর ফারাশ মিটিংরুমে এসে উপস্থিত হয়৷ জাহরাফকে দেখে নিজেকে অত্যন্ত সামলে রেখেই ভাইয়ের পাশে বসে ফারাশ। অন্যদিকে ফারাশকে দেখে জাহরাফ বলে ওঠে,
‘ফারাশ, নাইস টু মিট ইউ।’
গাল বাঁকিয়ে শয়তানি হাসি দিয়ে ফারাশও জবাব দেয়,
‘আই ডিড নট লাইক ইউর প্রেজেন্স।’
ফারাশের কথা শুনে জাহরাফ শব্দ করে হাসে।
‘ভাগ্য কি জিনিস, তাই না? এত বছর পর আবার দেখা করিয়েই দিল৷’
ফারহান ভেবেছিল সে কথা বলবে না। কিন্তু জাহরাফের এই কথাটা শুনে সে কথা না বলে থাকতে পারল না। চোখ থেকে চশমাটা খুলে জাহরাফের দিকে তাকিয়ে হাতদুটো একত্রিত করে টেবিলের ওপর রাখে। ফারহানের চোখ জোড়া রাগে ফেটে যাচ্ছে। এদিক-সেদিক তাকিয়ে ফারহান বলে,
‘ভাগ্যকে এই মুহুর্তে আমার চুতিয়া বলতে হচ্ছে। কি চুতিয়া জিনিস এই ভাগ্য, তাই না? যার জন্যই তো তোমার মতো চুতিয়া লোকের সামনে বসতে হলো আমায়।’
ফারহানের কথায় জাহরাফের মুখটা কালো হয়ে যায় আর ফারাশ তৎক্ষণাৎ হেসে দেয়। জাহরাফ রাগান্বিত কন্ঠে বলে,
‘হাসো হাসো। ফারাশ, হেসে নাও। এই অর্ডারটাই তোমাদের কোম্পানির শেষ অর্ডার হবে। লিখে দিলাম।’
ফারাশ হাসি থামিয়ে জবাব দেয়,
‘এই অর্ডার সাপ্লাইয়ের পর তুমি জাহরাফ জীবনেও এমুখো হবে না। সাদা কাগলে কালো কালি দিয়ে আমিও লিখে দিলাম। যদি না মেলে তো আমার নাম বদলে দিও।’
‘চ্যালেঞ্জ করলাম। পারলে করে দেখাও।’
‘চ্যালেঞ্জ করব না তবে করে দেখাব। তোমার মতো এমন চোর ছ্যাচড় কত এলো কত গেল। কোনো কূল কর‍তে পারল না। তুমিই ভাগ্যবান, যে সিধ কেটে চুরি করতে পেরেছিলে। তবে বার বার না। মনে রেখো কথাটা।’
ফারাশের নাম ধরে গর্জে ওঠে জাহরাফ। ফারহান তখন বলে,
‘ধীরে জাহরাফ, ধীরে। এটা অফিস। তোমার বাসা নয়। এখানে আওয়াজ নামিয়ে কথা বলবে।’
কিছুক্ষণ পরই এক এক করে সবাই মিটিংরুমে উপস্থিত হয়৷ রমজান শেখ মিটিংরুমে পা রেখেই জাহরাফকে দেখতে পান। তিনি বিশেষ কিছু বলেননি। নজর সরিয়ে নিজ আসনে বসে পড়েন।

শপিং ব্যাগগুলো বিছানায় রেখে সোফায় নিজের শরীর ছেড়ে দেয় অয়নন্দিতা। এটাই ভাবার চেষ্টা করছে, কী হচ্ছে তার সঙ্গে? ফারহানকে নিয়ে জীবনটা সুন্দর ভাবেই তো কেটে যাচ্ছিল তবে এত বছর পর হঠাৎ বন্দনার এইভাবে সামনে আসাটা কীসের ইঙ্গিত দিচ্ছে? বন্দনাকে কয়েক সেকেন্ডের জন্য দেখে অয়নন্দিতার মস্তিষ্কের প্রতিটা স্নায়ুকোষ তাদের কাজ বন্ধ করে দিয়েছিল। তাকে ভাবাতে বাধ্য করেছে বন্ধনা হঠাৎ কেন এইভাবে সেধে এসেছে আলাপ করতে।
অয়নন্দিতার আইডি ঘেঁটে হাসানের আইডি বের করে সাজি। হাসানের পুরো আইডি চেক করা শেষ তার। আইডিটা বেশ পরিষ্কার। মিলি সমেত বহু ছবি তার টাইমলাইনে। হাসানের সঙ্গে মিলিকে বেশ মানায় তবে কেন যেন সাজি মানতে পারছে না। হাসানকে যেদিন প্রথম দেখেছিল সেদিন থেকেই হাসানকে ভালো লাগতে শুরু করে। তবে ভালো লাগাটা মনের মধ্যে লুকিয়ে রেখেছিল৷
কে জানে কতক্ষণ এই ভালো লাগাটা লুকায়িত রাখতে পারবে সে।

রাত নয়টা নাগাদ ফারহান বাড়ি ফিরে। এমনিতেই কোনো একটা কারণে মাথা গরম ছিল তার। যখন সাজি সমস্ত ঘটনা তাকে খুলে বলল তখনই তার মাথা আরও গরম হয়ে গেল। সে বুঝতেছে না, একই সঙ্গে সব ঘটনা ঘটছে কীভাবে। পুরোটা তো আর কাকতালীয় ঘটনা হতে পারে না।
ফারহান দ্রুত পায়ে নিজের ঘরে আসে৷ অয়নন্দিতা তখন ঘরেই ছিল। ফারহান ঘরে অয়নন্দিতাকে দেখে থমকে যায়। এক পা দু পা করে অয়নন্দিতার কাছে এগিয়ে আসে। ফারহানের স্তব্ধতাই অয়নন্দিতাকে বুঝিয়ে দেয় যে, ফারহান অলরেডি সব কিছুই জেনে গেছে। অয়নন্দিতা কিছু বলতে যাবে তখনই ফারহান তাকে জড়িয়ে ধরে।
‘কিছু বোলো না। আমি সব ঠিক করে দিব। একদিন সব ঠিক হয়ে যাবে৷ তাকে তোমার ত্রিসীমানায় আসতে দেব না আমি। কোনো কষ্ট দিতে দেব না তোমায়। তুমি শুধু আমার পাশে থাকবে।’
ফারহানের কথা শুনে নিঃশব্দে কাঁদতে শুরু করে অয়নন্দিতা। তার জানা নেই, শেষ অবধি তার আর ফারহানের সংসারটা টিকবে কি না।

চলবে………………………..

#দ্বিতীয়_সূচনা
#পর্ব_৪৯
লেখা – আফরোজা আক্তার
(কোনোক্রমেই কপি করা যাবে না)

পায়ের উপর পা তুলে কফির মগে চুমুক দেয় জাহরাফ। মুখোমুখি বসে আছে বন্দনা। তার নজর জাহরাফকে দেখছে। ওই জাহরাফকে সে চিনতে পারে না। যেই জাহরাফ এক সময় তাকে ভীষণ ভালোবাসতো। যেই জাহরাফের ভালোবাসা পেয়ে একদিন সে ফারহানকে ভুলে গিয়েছিল। ফারহানের ভালোবাসা ভুলে গিয়েছিল। এর জন্য অবশ্য সে-ই দোষী। কারণ, ফারহানের কাছে সবই ছিল। টাকা-পয়সা, নাম-ধাম, সম্পত্তিসহ সব কিছুই ছিল। তবুও সে জাহরাফের ভালোবাসার ফাঁদে পা দিয়েছিল। আর সেটা স্ব-ইচ্ছায়।
টেবিলের ওপর কফি মগটা রেখে জাহরাফ বন্দনাকে বলে,
‘গতকাল দেখা হয়েছিল তোমার ফারহানের সঙ্গে।’
চমকে ওঠে বন্দনা। কপাল কুঁচকে তাকায় জাহরাফের দিকে।
‘আমার ফারহান! লাইক সিরিয়াসলি।’
‘এক সময় তো ছিল।’
‘এক সময় তো তুমিও থার্ড পারসন ছিলে। এখনও কি আছো?’
জাহরাফ হালকা দমে যায়। বন্দনা আবারও বলে,
‘যাই হোক, কিছু বলেছে নাকি?’
‘আমায় দেখে যে সে খুশি হবে না এটা তো জানা কথা।’
‘উল্টাপাল্টা কিছু বলেছে নাকি?’
‘নাহ তেমন কিছু বলেনি। তবে ফারাশ বলেছে।’
‘কি বলেছে?’
‘উড়োভাবে বলে বুঝিয়েছে আমি চোর।’
‘ওর এমনিতেও ঠোঁট কাটা। মিটিংয়ে কী হলো, অর্ডার সাবমিট করেছে ওরা?’
‘আশা তো করা যায়।’
‘তোমায় একটা কথা বলি জাহরাফ। তার সঙ্গে সম্পর্কটা শুধুই প্রফেশনালি হবে। ব্যক্তিগত দিকে না যাওয়াই ব্যাটার।’
ম্যাগাজিন থেকে চোখ সরিয়ে বন্দনার দিকে তাকায় জাহরাফ।
‘দরদ হচ্ছে নাকি?’
‘যদি বলি হচ্ছে, তখন কি ডিভোর্স দিবা নাকি?’
‘নাহ। আগে এক চোট ঠ্যাঙাবো তোমায়। আর শোন, আমার শখ নেই ফারহানের সঙ্গে ব্যক্তিগত রেষারেষিতে যাওয়ার।’
‘ব্যাস, কথাটা মনে রাখলেই হলো। রাতে খাবে তো নাকি আজকেও ক্লাবে যাবে।’
‘ক্লাবে যাব।’
‘রোজ-ই তোমায় ক্লাবে যেতে হয়। তাই না?’
‘হ্যাঁ, যেতে হয়।’
‘আজকের বান্ধবীর নাম কী?’
‘তুমি গিয়ে দেখে এসো, আজকের বান্ধবী কে?’
বন্দনা একটা নিঃশ্বাস ছাড়ে। দীর্ঘ নিঃশ্বাস৷ বোঝাই যাচ্ছে ভেতরে অনেক কষ্ট লুকানো আছে।

মামীর হাতে ধরে বসে আছে অয়নন্দিতা। তার জন্য যে এত খারাপ খবর অপেক্ষা করে আছে সেটা তার অজানা আছে। মিলির ক্যান্সার ধরা পড়েছে। ব্রেস্ট ক্যান্সার। লাস্ট স্টেজ। বেশিদিন বাঁচবে না৷ হাসান নিজের জমা পূঁজি যা ছিল সবই খরচ করেছে। কিছুতেই লাভ হচ্ছে না। কেমো দেওয়া হচ্ছে মিলিকে। কিন্তু উন্নতি হচ্ছে না। মিলির সার্ভাইব করাটা একেবারেই অসম্ভব। অয়নন্দিতা জানতে চায় তাকে কেন জানানো হয়নি। জবাবে মামী বললেন,
‘তোর মামা বলতে বারণ করেছে। মিলিও বলল, থাক বলার দরকার নেই। হাসানও তাই চেয়েছিল। অসুখটা একেবারে শেষ পর্যায়ে এসে ধরা পড়ল। মেয়েটার প্রতি কত রাগ করতাম। এখন দেখলেই মায়া হয়। আমার ছেলেটা একেবারেই ভেঙে পড়েছে।’
অয়নন্দিতার খারাপ লাগছে৷ কোনো এক সময় মিলি তার সঙ্গে অনেক খারাপ আচরণ করত। কিন্তু তার বিয়ের সময় একেবারেই স্বাভাবিক হয়ে গেল তবে কি মিলি মৃত্যুর ডাক শুনতে পেয়েছিল৷ কাছের মানুষগুলো কেন এইভাবে প্রতারিত করে চলে যায়। কেন তারা বোঝে না যে, তাদের চলে যাওয়ার পর জীবন কতখানি খালি হয়ে যায়। অয়নন্দিতা নিজের বাবা-মা’কে হারিয়ে ভীষণ খালি হয়ে গেছে। আর কিছুদিন পর হয়তো হাসানিকেও এমন শূন্যতা নিয়ে বাঁচতে হবে৷ আয়শা বেগম আঁচলে চোখ মুছতে মুছতে বললেন,
‘কিছু খাবি?’
‘উহু৷ ভাইয়া আর ভাবী কোথায়?’
‘হাসান মিলিকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে গেছে। মেয়েটা যেতে চায় না তবুও জোর করে নিয়ে যায়।’
‘জোর করে না মামী। বলো, বাঁচানোর আশায়।’
‘একেবারেই শেষ পর্যায়ে এসে দাঁড়িয়েছে। এখান থেকে ফেরা আর সম্ভব না। হাসান এটা বুঝতেই চায় না।’
‘সম্ভব যদি হতো আমি আমার বাবা-মা’কে যেতে দিতাম না মামী৷’
‘ফারহান কেমন আছে রে?’
‘ভালো আছে। মামী আমার কষ্ট হচ্ছে। ভীষণ কষ্ট হচ্ছে। আল্লাহ পাক কেন এইভাবে প্রতারিত করে আমাদের। প্রিয় মানুষগুলোকে কেন কেড়ে নেয় মামী।’
‘তার কাছ থেকে যে যতদিনের হায়াত নিয়ে এসেছে, এই দুনিয়ায় তার মেয়াদ ঠিক ততদিন। মেয়াদ ফুরিয়ে যাবে। ডাক পড়বে। এরপর অন্ধকার কবর। আমার ছেলেটা এই শোক কাটাতে পারবে তো অয়নি?’
‘জানি না গো মামী। জানি না।’
অয়নন্দিতার চোখে পানি। গলা ধরে আসছে তার। এমন সময় মিলি আর হাসান বাসায় পা রাখে। মিলিকে দেখে অয়নন্দিতা দাঁড়িয়ে যায়৷ এত সুন্দর মেয়েটার চোখের নিচে কালি পড়েছে। যেন দু’চোখে গাঢ় অন্ধকার নেমেছে। ঝড় আসবে। বড়ো ঝড়। যেই ঝড়ে সব লণ্ডভণ্ড হয়ে যাবে। মিলির পরনে সেই জামাটা যেটা হাসান সেদিন কিনেছিল। মিলিকে বেশ মানিয়েছে। অয়নন্দিতাকে দেখে মিলি জড়িয়ে ধরে।
‘কেমন আছো অয়নি?’
‘আমি কে তোমার? আমার খোঁজ খবর না নাও তুমি।’
‘এত রাগ কেন?’
‘আমায় জানাওনি কেন তোমরা? আমি কি পর?’
‘নতুন সংসার তোমার। বিরক্ত করতে চাইনি। হাসানকে আমিই মানা করেছিলাম যেন না বলে।’
অয়নন্দিতা চোখের পানি মুছে হাসানের দিকে তাকায়।
‘কী বলল ডক্টর?’
অসহায় দৃষ্টিতে অয়নন্দিতার দিকে তাকায় হাসান। মুখটা দেখেই বোঝা যাচ্ছিল তার ভেতরটা কতটা ক্ষতবিক্ষত হয়ে আছে। চোখের সামনে প্রিয় মানুষটা একটু একটু করে মৃত্যুর দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। চোখ জোড়ায় পানি জমাট হয়েছে। হাসান কিছু বলার আগেই মিলি বলে,
‘ছাড়ো তো ডক্টরের কথা। লোকটা মহা বদমাশ।’
‘কেন, কী করেছে?’
‘এত এত মেডিসিন দেয়। সবাই জানে যে, আমি আর বেশিদিন নেই। তবুও সে মেডিসিন দিতেই থাকবে। আমার জামাইর টাকা-পয়সা সব শেষ।’
কথাটা শেষ হবার সঙ্গে সঙ্গে হাসান ধমকে ওঠে।
‘চুপ করবে তুমি? বেশি কথা বোলো না। রেস্ট নাও। মা, আমি একটু আসতেছি।’
বোঝা যাচ্ছিল যে হাসানের সহ্য হচ্ছে না। সবার সামনে চোখ থেকে পানি ফেলবে না সে। তাই সবার আড়ালে চলে যায়। আয়শা বেগম মিলিকে তার খাবার এনে দেন। অয়নন্দিতা মিলির পাশে বসে তাকে খাওয়ানো শুরু করে।
‘ফারহান ভাই কেমন আছে গো?’
‘ভালো। সব কিছু ঠিকঠাক তো।’
‘হু।’
মিলি খেয়াল করে, অয়নন্দিতা নিঃশব্দে কাঁদছে। অবিশ্য কান্নার কারণ অজানা নয়৷ তার সময় ফুরাচ্ছে আর সবার চোখ ভারী হচ্ছে।
‘কেঁদো না তো৷ তোমরা কাঁদলে আমার খারাপ লাগে। বেশি খারাপ লাগে আমার জামাইটার জন্য। ও বেচারা এখনও কিছুই দেখল না। তার আগেই সব শেষ হতে চলেছে৷’
অয়নন্দিতা খাবারের প্লেটটা রেখে মিলিকে জড়িয়ে ধরে। চোখ জোড়া থেকে পানিগুলো অঝোরে ঝরে যাচ্ছে। কোনো কথা আসছে না মুখে। মিলির কপালে আলতো করে চুমু দিয়ে ব্যাগটা নিয়ে বের হয়ে যায় সে। আয়শা বেগম বার বার ডেকেছেন কিন্তু অয়নন্দিতা শোনেনি। মিলি একটা নিঃশ্বাস ছেড়ে চোখ জোড়া বন্ধ করে। দু’চোখ বেয়ে দু’ফোটা পানি গড়িয়ে পড়ে। শাশুড়ির দিকে তাকায় মিলি।
‘মা, আমার শরীর ভালো লাগছে না। একটু ঘরে যাব।’
আয়শা বেগম মিলিকে ধরলেন। মিলিকে ঘরে শুইয়ে দিয়ে তিনি অন্য কাজে মন দেবেন৷
‘মা, আজকে আব্বু আর আম্মু আসবে। আমায় নিয়ে যেতে চাইবে। মা, আমি যেতে চাই না। আপনি বরং আব্বু আম্মুকে বলবেন, তারা যেন আমায় না নেয়। আমি শেষ কয়েকটা দিন হাসানের সঙ্গেই থাকতে চাই মা।’
আয়শা বেগমের কথা বলতে কষ্ট হচ্ছে। কান্না দমিয়ে রেখে তিনি বললেন,
‘আচ্ছা বলব৷’
‘মা, আরেকটা কথা।’
‘বলো৷’
‘আমি চলে যাওয়ার পর হাসান আরও ভেঙে পড়বে মা। আপনি তখন হাসানকে সামলে নিবেন। আর ওকে আবার নতুন করে সব সাজাতে বলবেন। আমি যতবার এই কথা বলি ততবারই হাসান আমায় ধমক দেয় মা।’
আয়শা বেগম মিলির দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে বলে,
‘শুয়ে থাকো চুপচাপ। বেশি কথা না। আমি তোমার খাবার ব্যবস্থা করি।’
মিলিকে শুইয়ে দিয়েই আয়শা বেগম দ্রুত পায়ে রান্নাঘরে চলে আসেন। মুখে হাত দিয়ে শব্দ করে কেঁদে ওঠেন।

ফারহানকে জড়িয়ে ধরে কাঁদছে অয়নন্দিতা। ফারহান তাকে কী বলে সান্ত্বনা দেবে সেটা জানা নেই। মিলি মেয়েটা বেশ ভালো। সে যতদিন দেখেছে বেশ হাসিখুশি দেখেছে৷ ফারহান বাড়ি এসে শোনে অয়নন্দিতা মামার বাসা থেকে ফিরেই কান্নাকাটি করছে। রওশন বেগমও দুঃখ প্রকাশ করলেন৷ ফারহান অয়নন্দিতাকে বোঝায়,
‘অয়নন্দিতা, আমি বা তুমি আমরা কেউই জানি না কার ভাগ্যে কী লেখা আছে। তাই না? কষ্ট পেয়ো না। প্লিজ।’
‘ভাইয়ার কী হবে, ভাবতে পারছ?’
‘সবটাই ভাবতে পারছি। এমন কি অনুভবও করতে পারছি। কিন্তু এটাই হয়তো বিধির বিধান।’
‘আল্লাহ পাকের সিদ্ধান্ত ওত কঠোর কেন হয়?’
‘আল্লাহ পাক তার মনুষ্য জাতিকে বেশি ভালোবাসেন। তাই।’
‘ভালোবাসলে এত কঠিন অসুখ কেন দেন। আবার নিজের কাছে নিয়েও যান। কেন?’
‘ওই যে, মনুষ্য জাতিকে পরীক্ষা করেন। ডক্টর কী বলেছে?’
‘লাস্ট স্টেইজ৷ একদম শেষ পর্যায়। কিছুই সম্ভব না। কোনো একদিন হয়তো ফাঁকি দেবে আমাদের সবাইকে।’
কথাটা শুনে ফারহান একটু দম নেয়। ছোটো করে একটা নিঃশ্বাস ছেড়ে অয়নন্দিতাকে জড়িয়ে ধরে।
দরজার ওপাশ থেকে সাজি সবটাই শুনতে পায়। তার জানা ছিল না যে, হাসান এত বড়ো একটা বিপদে আছে। মিলির শারীরিক অবস্থা ভালো না। বেশিদিন সময় নেই। কথাটা তার জন্য কতটা পীড়াদায়ক। এটা সে বুঝতে পারছে। চোখের পানি মুছে নিজের ঘরের দিকে পা বাড়ায় সাজি।

পরদিন বিকেলে।
কলিংবেলের আওয়াজ শুনে আয়শা বেগম দরজা খুলেন৷
দরজা খুলে অবাক হন তিনি। দরজায় সাজি দাঁড়িয়ে আছে। সাজি তেমন এক্যেই বাসায় আসে না। প্রথম প্রথম আসলেও পরবর্তীতে আর আসেনি। আয়শা বেগম আদর করে সাজিকে ভেতরে নিয়ে আসে৷ সাজি দেখতে পাচ্ছে আয়শা বেগমের চোখ মুখের অবস্থা ভালো না। ভেতরে প্রবেশ করেই সাজির দেখা হয় অয়নন্দিতার মামা অর্থাৎ হাসানের বাবা খাইরুল সাহেবের সঙ্গে। সালাম দিলে খাইরুল সাহেবও বিষন্ন মুখে সালাম নেন। এরপর বাইরে বের হয়ে যান। সাজি বুঝতে পারছে, এই পরিবারের সবাই ভীষণ রকম আহত। আয়শা বেগম প্রশ্ন করেন,
‘কেমন আছো মা?’
‘জি ভালো আছি। আপনারা কেমন আছেন আন্টি?’
‘আমরা ভালো নেই গো মা। আমাদের ভালো থাকা আল্লাহ পাক কেড়ে নিয়েছেন।’
কথাটা বলেই আয়শা বেগম কেঁদে দেন। সাজিরও খারাপ লাগছে। সে অনুরোধ করে,
‘আন্টি, আমি কি মিলি ভাবীর সঙ্গে একবার দেখা করতে পারি?’
‘মিলি তার ঘরেই আছে। ওই পাশের ঘরটাই মিলির। যাও। দেখা করো গিয়ে।’
‘ধন্যবাদ আন্টি।’
‘অয়নি এলো না?’
‘ভাবী নিজেও জানে না যে আমি এখানে এসেছি। আসলে আমার একটা কাজ ছিল তো এখানে। ওটা সারতেই এসেছিলাম। ভাবলাম দেখা করে যাই।’
‘ওহ।’
সাজিকে মিথ্যা বলতে হলো। আসলে সে মিলিকে দেখতেই এসেছিল। অয়নন্দিতাকে সে ইচ্ছা করেই বলেনি। আয়শা বেগম আবারও বললেন,
‘যাও তুমি। আমি তোমার জন্য একটু নাস্তার ব্যবস্থা করছি।’
‘নাহ নাহ আন্টি। প্লিজ, ঝামেলা করবেন না।’
‘ঝামেলার কিছু নেই। তুমি যাও।’
সাজি ধীর পায়ে মিলির ঘরের দিকে এগিয়ে যায়। পর্দা সরিয়ে বিছানায় নজর দেয় সাজি। কম্বল জড়িয়ে মিলি শুয়ে আছে খাটে। সাজি সাবধানতা অবলম্বন করে পা টিপে টিপে মিলির ঘরে প্রবেশ। কিন্তু সাজির পায়ের শব্দ মিলির কান অবধি পৌঁছে যায়। মিলি ওপাশে মুখ করেই প্রশ্ন করে,
‘কে?’
সাজি চমকে যায়। দাঁড়িয়ে পড়ে সেখানে। জবাব দেয়,
‘আমি সাজি।’
মিলির কষ্ট হলেও সে উঠে বসে। সাজির দিকে তাকায়। মলিন হাসি দেয়।
‘ওহ তুমি। তা এত পা টিপে টিপে আসলে কেন? এসে ডাক দিলেই হতো।’
‘ভাবলাম তুমি হয়তো ঘুমাচ্ছ।’
‘তোমার আর হাসানের দেখি এক অভ্যাস। দু’জনেরই পা টিপে ঘরে ঢোকার স্বভাব।’
কথাটা শোনার পর সাজি নড়েচড়ে বসে। মিলির অবস্থা ভালো না৷ এত সুন্দর চুলগুলো পড়ে গেছে। স্কার্ল্প দেখা যাচ্ছে। কেমো দেওয়াতেই হয়তো এমন হয়েছে। চোখের নিচটায় কালি পড়ে গেছে। এত সুন্দর একটা মানুষকে অসুস্থতা কীভাবে গ্রাস করে ফেলল। হাসানের করুণ মুখটা চোখের সামনে ভাসছে সাজির। তার দিনগুলো না জানি কতটা কষ্টে অতিবাহিত হচ্ছে। গোলাপের তোড়াটা মিলির দিকে এগিয়ে দেয় সাজি৷
‘ফুলগুলো তোমার জন্য এনেছিলাম।’
‘বাহ, সুন্দর তো। আমার গোলাপফুল খুব ভালো লাগে।’
‘কারণ, তুমি গোলাপের মতোই সুন্দর।’
‘এটা ভালো বলেছ। আমি গোলাপের মতো সুন্দর কি না জানি না তবে গোলাপ আর আমার পরিণাম একই। তাজা গোলাপ ধীরে ধীরে নুয়ে যাবে। এক সময় ঝরে যাবে। আমিও তেমন। আর তো বেশিদিন নেই। আমিও ঝরে যাব।’
বুকটা মোচড় দিয়ে ওঠে সাজির। কতটা কষ্ট নিয়ে মিলি এমনভাবে কথা বলছে। তার সহ্য হচ্ছে না। এখানে থাকলে হয়তো কেঁদে ফেলবে। চলে যাওয়াটাই শ্রেয়।
‘আজ উঠি গো। আবার কোনো এক সময় আসব।’
‘চলে যাবে?’
‘হুম।’
‘যাও। আটকাব না। তবে আবার এসো। দেখ, এমন যেন না হয় তুমি আসলে আর আমি খাটিয়ায় শুয়ে থাকলাম।’
সাজি কিছু না বলে ঘর থেকে বের হয়ে যায়। বের হয়েই চোখ বন্ধ করে পানি ছেড়ে দেয়। কয়েকটা ঢোক গিলে চোখের পানি মুছে দরজার দিকে যায়। দরজা খুলে বের হতে নিলেই হাসানের সঙ্গে ধাক্কা খায়। হয়তো হাসানেরও এই সময় বাসায় আসার কথা ছিল। হাসানকে দেখে মায়া হচ্ছে সাজির। মানুষটার চোখ-মুখ বলে দিচ্ছে সে কষ্টে আছে। হাসান সাজিকে দেখে অবাক হয়৷ চোখ কুঁচকে তাকায় সে। সাজি নিজেকে কন্ট্রোল করে বলে,
‘সরি।’
‘ইটস ওকে।’
পাশ কাটিয়ে সাজি বের হতে নিলে হাসান বলে,
‘চলে যাচ্ছ যে। বসবে না?’
‘বসেছি। আজ আসি।’
‘দাঁড়াও সাজি৷’
হাসান সাজিকে দাঁড় করায়৷ খোলা দরজাটা হালকা করে টেনে সাজির পাশে এসে দাঁড়ায়।
‘তুমি সেদিন শপিংমলে একটু অন্য ভঙ্গিতে কথা বলেছিলে। এর কারণ কী?’
সাজি কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকে হাসানের দিকে। এটা নিছকই নিজেকে স্বাভাবিক রাখার অভিনয় মাত্র।
‘আমি তো নরমাল ভাবেই কথা বললাম।’
হাসান প্রসঙ্গ ঘুরিয়ে দেয়।
‘মিলিকে দেখেছ?’
‘হ্যাঁ।’
‘মিলিকে দেখতেই এসেছ। তাই না?’
‘আপনি চিন্তা করবেন না। ভালো হয়ে যাবে সে।’
‘এখন আর চিন্তা করি না। মেয়েটা আমায় ছেড়ে চলে যাবে। এটাই মানতে পারছি না। সে ভালো হবে এটাও আর আশা করি না। কারণ, মিথ্যা আশা বড্ড বেশি কষ্ট দেয়। যাই হোক। তুমি আর এখানে এসো না। আমার সামনেও এসো না।’
অবাক হয় সাজি। হঠাৎ এমন কথা।
‘আসব না কেন?’
‘আমি বলেছি। তাই আসবে না।’
‘যদি আসি তবে কী হবে?’
‘ক্ষতি হবে তোমার। এসো না প্লিজ। তোমার বডি ল্যাংগুয়েজ বলে দিচ্ছে তোমার ভেতরে কী চলছে।’
‘তবে বলব, উপায় নেই। আমার মন আটকে গেছে। আসি।’
সাজি আর এক সেকেন্ডও দাঁড়ায়নি সেখানে। সিঁড়িতে পা ফেলে নিচে নেমে যায় সে। হাসান সেখানেই দাঁড়িয়ে থাকে। রেলিংয়ে হাত দিয়ে দীর্ঘশ্বাসে বুকটা ভার করে ওঠে তার। নিয়তি একই সঙ্গে দুই রকম খেলা খেলছে তার সঙ্গে। যার কোনো অর্থই সে বুঝতে পারছে না।
‘আল্লাহ পাক, মিলিকে ভালো করে দেওয়া যায় না? মিলি চলে গেলে নিজেকে সামাল দিতে পারব না আমি। সাজির মনে যা চলছে তার পরিণাম আমার জানা নেই। আমায় সাহায্য করুন আল্লাহ পাক। সাহায্য করুন।’

চলবে…………………………….