ধোঁয়াশা পর্ব-০৫

0
143

‘ধোঁয়াশা’ ৫.

~ তাবিনা মাহনূর

___________________

মিনারার ঘরে কাউকে ঢুকতে দেয়া হচ্ছে না। পুলিশ এসে লা শ নিয়ে চলে গেছে। নিশীথকে জিজ্ঞাসাবাদ শেষে রুহিয়ার কাছে গেলে পুলিশের কোনো লাভ হয়নি। তারা বুঝেছে রুহিয়া মানসিকভাবে অসুস্থ। রেহানও চলে এসেছে পুলিশকে রুহিয়ার ব্যাপারে জানাতে। ইনবিহাজকে আসতে বলা হয়েছে। ইনবিহাজ প্রতিবেশীর সাহায্যে গাড়ি ভাড়া করে তাহিয়াকে নিয়ে ঢাকার পথে রওনা হয়েছেন।

পাশের বাসার ফাইজা ভাবি রুহিয়াকে জড়িয়ে ধরে বসে আছে। এ বাসায় তিনি ছাড়া আর কেউ নেই। পুলিশ দেখে সবাই এ বাড়ির কাছেও আসছে না। ফাইজা নরম মনের মানুষ। রুহিয়াকে একা ছেড়ে ঘরে যেতে ইচ্ছে করছে না। কিন্তু তার স্বামী এসে ভ্রু কুঁচকে উঠে যেতে বললে সেও অপারগ হয়ে নিশীথের কাছে গেল।

– ভাইয়া, আমি আসছি। কোনো সমস্যা হলে ডাকতে দ্বিধা করবেন না।

নিশীথ কোনো কথা বলেনি। ফাইজা চলে গেল অস্বস্তি নিয়ে। বেলা একটা পেরিয়ে গিয়েছে। সকাল থেকে দুজনেই কিছু খায়নি। নিশীথ রুহিয়ার দিকে তাকালো। স্তব্ধ বসে থাকা রুহিয়াকে দেখে নিশীথের জীবন অর্থহীন মনে হচ্ছে। ফাঁকা বাসায় রুহিয়ার কাছে বসে সান্ত্বনা দেয়ার সাহস পাচ্ছে না সে। তবু ধীর পায়ে হেঁটে রুহিয়ার কাছে বসে সে ডেকে উঠলো, ‘রুহি।’

রুহিয়া শুষ্ক চোখে তার দিকে তাকালো। নিশীথ আদুরে কণ্ঠে বললো, ‘যা গিয়েছে, সেটা কি আর ফেরত আনা সম্ভব হবে বলো? চুপ করে থাকলে আরো কষ্ট বাড়বে। তুমি বরং কাঁদো, একটু কাঁদো।’

রুহিয়া ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলো। যেন এ কথার অপেক্ষাতেই ছিল সে। উচ্চস্বরে আর্তনাদ করে সে বললো, ‘সব চলে যাচ্ছে, সব ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে। কিছুই থাকবে না আর। সবাই শেষ হয়ে যাবে।’

নিশীথ জড়িয়ে ধরলো তাকে। রুহিয়ার কান্না থামেনি। অতিরিক্ত কান্নার কারণে নিঃশ্বাস আটকে আসছে তার। মায়াকান্নার মাঝেই ইনবিহাজ এসে পড়লেন। বাড়ির নিচ থেকে ফোন করে তিনি নিশীথকে নিচে নামতে বললেন। নিশীথ রুহিয়াকে সঙ্গে নিয়ে নিচে নামলো। নিচে নামতেই রুহিয়া দৌড়ে গিয়ে মাকে জড়িয়ে ধরলো। গাড়ি থেকে তাহিয়াকে নামাতে সাহায্য করলো নিশীথ। ইনবিহাজ তাহিয়াকে জড়িয়ে ধরে ঘরে গেলেন। রুহিয়াকে নিশীথ বিছানায় বসিয়ে বাইরে গেলে ইনবিহাজ তাকে ডেকে বললেন, ‘কি হয়েছিল বাবা বলো তো।’

ইনবিহাজের অশ্রুসিক্ত কন্ঠ শুনে নিশীথ হতাশ ভঙ্গিতে বললো, ‘জানি না মা। সকালে ঘুম থেকে উঠে দেখি নাস্তা নেই। তারপর রুহিয়া ঘুম থেকে উঠলো। খালার উঠতে দেরি হচ্ছে দেখে আমরা চাবি দিয়ে দরজা খুলি। তারপর দেখি ফ্যানের সাথে খালার শরীর ঝুলছে।’

ইনবিহাজ চোখ মুছে প্রশ্ন করলেন, ‘হঠাৎ এমন হলো কেন? গতকাল মিনারার মেজাজ কেমন ছিল?’

নিশীথ বললো, ‘গত দুই তিন দিন একটু অন্যরকম ছিলেন খালা। আগের মতো হাসতেন না। কাজে আলসেমি করতেন, আনমনে হাঁটতেন। একবার হোঁচট খেয়ে পড়ে গিয়েছিলেন। মনে হয় কিছু একটা নিয়ে খুব চিন্তিত ছিলেন তিনি।’

ইনবিহাজ আর প্রশ্ন করলেন না। নিশীথ ঘরে গিয়ে দেখলো রুহিয়া ঘুমিয়ে পড়েছে, অথবা চোখ বন্ধ করে শুয়ে আছে। বাসায় খাবার রান্না নেই। নিশীথ ইনবিহাজকে রুহিয়ার দিকে খেয়াল রাখতে বলে নিচে গেল।

_________________

কয়েকদিন অস্বাভাবিক কেটে গেল নিশীথের জীবনে। মিনারার মৃত্যুর পর পুলিশের ঝামেলা রয়ে গেল, তবে শিথিল হয়ে এলো পরিচিত ওসির মাধ্যমে। কিন্তু সমস্যা বেঁধেছে রুহিয়াকে নিয়ে। গর্ভের সন্তান হারানোর পর রুহিয়া যেমন অস্বাভাবিক শান্ত আর পাগলাটে হয়ে গিয়েছিল, মিনারার মৃত্যুর পর আবার তেমন রূপ ধারণ করেছে সে। তবে এবার যুক্ত হয়েছে আরো কিছু বিপত্তি।

যেমন মাঝরাতে রুহিয়া ঘুম থেকে উঠে ফ্রিজ থেকে কাঁচা মাংস বের করে খাওয়া শুরু করে। নিশীথ একদিন দেখে ফেলার পর থেকে এমনটা আর করেনি। নিজের হাতে পায়ে নিজেই খামচি, কামড় দিয়ে রক্ত বের করে রুহিয়া। তাহিয়ার চুল ধরে টানে, ইনবিহাজ কাছে গেলে তাকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দেয়। শুধু খাওয়ার সময় সে শান্ত থাকে।

আজ নিশীথ অফিসে যাওয়ার আগে রুহিয়াকে ঘুমের ওষুধ খাইয়ে দিয়েছে। ইনবিহাজ স্বস্তি পেয়েছেন। দুই মেয়েকে সামলে রাখতে খুব কষ্ট হচ্ছে তার। স্বপ্নাকে আসার কথা বলেছিল নিশীথ, কিন্তু তিনি এড়িয়ে গেছেন বিভিন্ন কাজের কথা বলে। দীর্ঘশ্বাস ফেলে নিশীথ ভাবে, পৃথিবী সত্যিই একাকিত্বের রাজত্ব।

যুহরের সালাত আদায় শেষে ইনবিহাজ ডাইনিং রুমে গেলেন। রুহিয়াকে উচ্চস্বরে ডাকলেন, ‘রুহি মা, ঘুম থেকে উঠে পড়ো। দুপুর হয়ে গিয়েছে।’

রুহিয়ার দিক থেকে উত্তর এলো না কোনো। ইনবিহাজ ভাত বেড়ে টেবিলে থালা রেখে আবার ডাকলেন, ‘রুহিয়া!’

এবারও কোনো উত্তর শোনা গেল না। ইনবিহাজ হাঁটতে হাঁটতে রুহিয়ার ঘরে গেলেন। ঘরে ঢুকে বললেন, ‘রুহি মা।’

ঘরে কেউ নেই। বাথরুমের দরজা খোলা, বারান্দা শূন্য। ইনবিহাজ আতংকিত হয়ে সারা ঘরে হাঁটলেন। কেউ নেই। পুরো বাসায় রুহিয়ার অস্তিত্ব নেই। ইনবিহাজ দরজা খুলে পাশের বাসায় কলিং বেল বাজালেন। ফাইজা দরজা খুলতেই তিনি বললেন, ‘রুহিয়া কি তোমার কাছে মা?’

নেই, রুহিয়া ফাইজার কাছেও নেই। ফাইজা আর ইনবিহাজ দুজনে সব জায়গায় রুহিয়াকে খুঁজলো। গ্যারেজে, ছাদে, গলিতে – কোনো জায়গা বাদ নেই। ইনবিহাজ ভয়ার্ত কণ্ঠে ডাকছেন রুহিয়াকে। কোথাও রুহিয়ার কন্ঠ ভেসে এলো না। তিনি কম্পিত হাতে নিশীথকে ফোন করলেন। নিশীথ কল ধরতেই তিনি বললেন, ‘রুহিয়াকে কোথাও পাচ্ছি না বাবা।’

অফিস ছুটি নিয়ে নিশীথ চলে এসেছে বাড়িতে। চারিদিকে লোক লাগিয়ে খুঁজে বেরিয়েছে সে অনেকক্ষণ। যখন সন্ধ্যা পেরিয়ে গেল, তখন নিশীথের কাছে ফোন এলো। রুহিয়াকে কমলাপুর রেলস্টেশনে পাওয়া গিয়েছে। এ কথা শোনার পর নিশীথ দেরি না করে সেখানে পৌঁছে গেল। খুব নিশ্চুপ রুহিয়াকে দেখে নিশীথের মনে কোনো মায়া জাগলো না। প্রতিদিন রুহিয়ার অকাজগুলো তাকে বিরক্ত করে তুলছে। আজ বিরক্তের সীমা ছাড়িয়ে গিয়েছে। রুহিয়াকে কিছু না বলে তার হাত ধরে নিশীথ গাড়িতে উঠে বসলো। বাড়ি ফিরেই শুরু হলো তার ক্রোধের প্রকাশ।

– কি শুরু করেছো রুহি? প্রতিদিন আমাদের চিন্তায় রাখতে খুব ভালো লাগে তোমার?

ইনবিহাজ ঘরের এক কোণে দাঁড়িয়ে কাঁদছেন। এখানে তার কিছুই বলার নেই। মেয়েটা অসুস্থ। নিশীথও ভালো ছেলে, আর কতদিন এসব সহ্য করবে? নীরব অশান্ত এই দৃশ্য দেখা ছাড়া তার কিছুই করার নেই।

রুহিয়ার চুপ করে বসে আছে, একটু একটু করে শরীর দুলছে তার। নিশীথ বকেই চলেছে, ‘আমরা মানুষ রুহি। আমরা যন্ত্র না। প্রতিদিন তোমার এসব কাজের জন্য কি পরিমান মানসিক অত্যাচার সহ্য করতে হচ্ছে তুমি কি সেটা বোঝো? এমন তো নয় যে তোমাকে আমরা ডাক্তার দেখাইনি। রেহান কাজ ফেলে তোমার চিকিৎসা করতে বাসায় আসে। আর কি চাও তুমি?’

রুহিয়া নিষ্পলক তাকিয়ে আছে মেঝের দিকে। নিশীথ যেন আজ সব রাগ প্রকাশের পণ করেছে। থামছে না সে। ইনবিহাজ তাহিয়ার কাছে চলে গেছেন। এখানে থেকে এসব শুনে কষ্ট বাড়াতে চান না তিনি। তাহিয়ার ঘরে গিয়ে দরজা আটকে দিয়েছেন।

নিশীথ রুহিয়ার দিকে তাকিয়ে আঙ্গুল উঁচিয়ে বললো, ‘কি হলো রুহি? রাগ হচ্ছে? আমারও রাগ হচ্ছে। সেই যে আমাদের মধ্যে ঝামেলা হলো, তারপর থেকে তুমি কেমন উদ্ভ্রান্তের মতো আচরণ করছো। তোমার এই কাজগুলো যদি দিন দিন বেড়েই চলে, তাহলে আমি সত্যি বলছি, আমি নতুন কোনো সিদ্ধান্ত নেব। তোমাকে এখানে রাখবো না আর। পাগলাগারদে রেখে আসবো, মানসিক হাসপাতালে রেখে আসবো। তুমি সুস্থ হওয়ার পর তোমাকে নিয়ে আসবো। রুহি, এটেনশন সিক করো না বলে দিচ্ছি।’

হঠাৎ রুহিয়া শব্দ করে বমি করে ফেললো। বমির সাথে রক্ত এসেছে। মেঝের উপর কতগুলো কীট পতঙ্গ দেখা যাচ্ছে। বিস্মিত নিশীথ কপালে হাত রেখে বললো, ‘রুহি! তুমি কি খেয়েছো এসব?’

রুহিয়ার জ্ঞান নেই। বমি করেই সে অজ্ঞান হয়ে বিছানায় পরে গেছে। নিশীথ দ্রুত তাকে কোলে নিয়ে চিৎকার করলো, ‘মা, মা! রুহি অসুস্থ হয়ে পড়েছে। আপনি দরজা আটকে দিন, আমি হাসপাতালে যাচ্ছি।’

ইনবিহাজ বেরিয়ে এলেন। রুহিয়ার অবস্থা দেখে তিনি কেঁদে ফেললেন, ‘কি হয়েছে রুহি মার? কি হয়েছে আমার রুহির?’

উত্তর দেয়ার সময় পেলো না নিশীথ। রুহিয়াকে কোলে নিয়ে সে হাসপাতালে চলে গেল। ইমারজেন্সি বিভাগের অধীনে থাকা ডাক্তার রুহিয়ার চিকিৎসা করলেন। তিনি কিছু ওষুধ লিখে দিলেন এবং আল্ট্রাসনোগ্রাম করার পরামর্শ দিলেন। সব শুনে নিশীথ ঘুমন্ত রুহিয়ার দিকে তাকালো। নিথর দেহ রুহিয়ার, নিশীথ ক্লান্ত। ডাক্তার চলে যাওয়ার পর নিশীথ রুহিয়ার সামনে চেয়ারে বসলো। হঠাৎ করে তার খুব মনে পড়ছে পুরোনো দিনের কথা।

নিশীথের জ্বর হয়েছিল। স্বাভাবিক নয়, একদম একশো চার ডিগ্রি জ্বর। রুহিয়ার চিন্তিত মুখটা মনে পড়ে নিশীথের। মাথায় পানি ঢেলে দেয়া, গা মুছে দেয়া, স্যুপ তৈরি করে খাইয়ে দেয়া- সব রকম সেবায় নিয়োজিত ছিল রুহিয়া। সে সময় রুহিয়া চাকরি করতো। কিন্তু সেদিন সে ছুটি নিয়েছিল। সারাদিন নিশীথের যত্নের পর নিজের যত্নের কথা ভুলে গিয়েছিল সে। নিশীথ অপলক দেখেছিল তার অর্ধাঙ্গিনীর স্ত্রীসুলভ আচরণ। মুচকি হেসে সে বলেছিল, ‘আজকে তোমাকে বউয়ের মতো লাগছে।’

এ কথাটা রুহিয়ার মনে গেঁথে ছিল। তাই তো সে চাকরি থেকে ফিরেই প্রতিদিন নিশীথের সেবায় নিজেকে উজাড় করে ফেলতো। নিশীথ তাতে অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছিল। এক সময় এই সেবাগুলো তার কাছে নিছক দায়িত্ববোধ বলে মনে হতো। তাই জীবনে যখন জয়া এলো, তখন রুহিয়ার যত্নশীল ভালোবাসা এক মুহূর্তের জন্য ভুলে যেতে দ্বিধা হলো না তার।

পুরোনো দিনের কথা ভেবে নিশীথের চোখে অশ্রু জমে উঠলো। রুহিয়ার ভগ্ন মুখের দিকে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলে সে বললো, ‘আর কত কাল অপেক্ষায় থাকবো রুহি?’

__________________

চলবে ইন শা আল্লাহ….

[কাল শেষ পর্ব দেয়া হবে ইন শা আল্লাহ।]