ধোঁয়াশা পর্ব-০৩

0
143

‘ধোঁয়াশা’ ৩.

~ তাবিনা মাহনূর

____________________

আল্লাহর অশেষ রহমতে রুহিয়ার শরীরে কোনো ক্ষত সৃষ্টি হয়নি। নিশীথ আড়চোখে দেখেছিল রুহিয়া রান্নাঘরের দিকে যাচ্ছে। সে এটাকে রুহিয়ার স্বাভাবিক হওয়ার চেষ্টা ভেবে সেদিকে যায়নি। কিন্তু রুহিয়া যখন গ্যাসের চুলা জ্বালায়, তখন সেই আওয়াজ শুনে নিশীথ ঘাবড়ে যায়। সে দ্রুত উঠে দাঁড়িয়ে দৌড়ে রান্নাঘরে গিয়ে দেখে, রুহিয়া তার ওড়নার এক প্রান্ত চুলার আগুনে দিয়ে দিয়েছে। ভাগ্য ভালো যে ওড়না ছুড়ে ফেলে দেয়া হয়েছে। জামায় আগুন লাগলে রুহিয়ার শরীরে প্রভাব পড়তো।

স্বপ্নার ধারণা, তিনি বেঁচে থাকার অর্থ খুঁজতে বলায় মেয়েটা মারা যেতে চেয়েছে। কারণ এই মেয়ের মনে এখন কোনো স্বপ্ন নেই, যেই স্বপ্ন আঁকড়ে ধরে মেয়েটা জীবন গুছিয়ে নিতে চাইবে। স্বপ্না মুখে কিছু প্রকাশ না করলেও মনে মনে কথা বলার ক্ষেত্রে সংযত থাকার শিক্ষা নিলেন।

রুহিয়া আবারো ঘুমিয়েছে। নিশীথ বুঝতে পারে না, রুহিয়া কি সত্যিই ঘুমায় নাকি ঘুমের ভান করে শুয়ে থাকে। নিশীথ খুব ক্লান্ত। তার আর ভালো লাগছে না। স্বপ্না ফুপিকে রুহিয়ার কাছে রেখে সে ছাদে চলে গেল।

সন্ধ্যা নেমে রাতের আঁধার গাঢ় হচ্ছে। নিশীথ একা অনুভব করছে। পুরো শহর জুড়ে কত মানুষ, তবু কেউ নেই। নিশীথ কার কাছে তার মনের খবর ব্যক্ত করবে? এই শহরে সবাই ব্যস্ত। কেউ নেই তার কথা শোনার, কেউ নেই তাকে একটু আশ্বাস দেয়ার জন্য। সে যে প্রভু বিশ্বাস করে না। নাহলে জগতের একচ্ছত্র অধিপতি আস সামাদের কাছে প্রাণখুলে কাঁদতো সে। এখনো তার কান্না আসছে। আকাশের দিকে তাকিয়ে সে বললো, ‘তুমি যদি সত্য হও, আমাকে পথ দেখাও!’

নিশীথ জানে না সে কার কাছে চ্যালেঞ্জ করছে! জানলে সে সিজদাহরত অবস্থায় কাঁপতে কাঁপতে অশ্রু ঝরাতো।

__________________

আজ রেহানের বাসায় বিকেলের চা-নাস্তার দাওয়াত পেয়েছে নিশীথ। এটা যে দাওয়াত নয় তা রুহিয়া ছাড়া বাকি দুজন জানে, স্বপ্না ফুপি ও নিশীথ। দুজনেই বেশ পরিপাটি সেজে রুহিয়াকে তৈরি করে বেরিয়ে পড়লো। রুহিয়ার অনুমতি কিংবা ইচ্ছে জানার প্রয়োজন পড়েনি। সে মাতালের মতো চুপচাপ বাইরের পোশাক পরেছে, জুতা পায়ে দিয়ে হেঁটে হেঁটে ঘর ছেড়ে বেরিয়েছে। নিশীথ তার এই অবস্থা দেখে ধারণা করলো, রেহানের সাথে কথা বলার সময় রুহিয়া হয়তো খুব একটা প্রতিক্রিয়া দেখাবে না।

সত্যিই তাই। নাস্তার পর্ব শেষে স্বপ্না গল্প শুরু করলেন রেহানের স্ত্রীর সাথে। রেহান তার লাইব্রেরি ঘরের এক কোণে রোগীদের সাথে কথা বলার স্নিগ্ধ আয়োজন করে রেখেছে, যেখানে এখন সে আর রুহিয়া বসে আছে। কিছুটা দূরে নিশীথ বসে আছে। রেহানের প্রশ্নের উত্তরগুলো ধীরে ধীরে বললো রুহিয়া। কোনো প্রকার উচ্চবাচ্য করেনি সে। কথোপকথন শেষে রেহান ইশারায় নিশীথকে কাছে যেতে বললো।

নিশীথ রুহিয়াকে স্বপ্নার কাছে রেখে রেহানের কাছে গেল। রেহান ভ্রু কুঁচকে বললো, ‘ভাবীর সব কথার শুরুতে বাচ্চা, শেষেও বাচ্চা। মোট কথা, ভাবীর পুরো মস্তিষ্ক জুড়ে এখন বাচ্চাদের বিচরণ। মা না হতে পারার একটা ক্লেশ বুকে জমিয়ে রাখায় তার মানসিক অবস্থা খুবই খারাপ পর্যায়ে। সবচেয়ে খারাপ ব্যাপার কি জানিস? ভাবী তোকে অপরাধী ভাবছেন। বড় অপরাধী।’

নিশীথ মুখ নিচু করে বসে আছে। রেহান জিজ্ঞেস করলো, ‘ভাবী কেন অপরাধী ভাবছেন বল তো? তুই কি কিছু বলেছিস ভাবীকে?’

নিশীথ চুপ করে আছে। সে তার বন্ধুকে তার অতীতের কুকর্ম সম্পর্কে কিছুই জানায়নি। এবং রুহিয়া যে জয়া আর তাকে সন্দেহ করছে এই ব্যাপারেও কিছু বলেনি সে। এবারও এড়িয়ে গেল সে, ‘আমি শুধু বলেছি তুমি একটা আগাছা।’

রেহান মুখ কুঁচকে বললো, ‘ছি ছি নিশীথ! এটা কি বাজে কথা বলেছিস তুই?’

নিশীথ চুপ করেই থাকলো। এর চেয়েও বাজে ঘটনা যে ঘটে গিয়েছে তা বললে রেহান হয়তো রুহিয়াকে নিশীথের সাথে ডিভোর্স দিয়ে নতুন জীবন শুরু করতে বলবে। রেহান অবশ্য এর বেশি কথা বাড়ালো না। রুহিয়ার খেয়াল রাখতে বলে কিছু পরামর্শ দিলো সে। এবং পরের সপ্তাহে আবারো নিয়ে যেতে বললো।

নিশীথ বন্ধুর সাথে হাত মিলিয়ে স্বপ্না ফুপির কাছে গেল। ফুপি এখনো রেহানের স্ত্রীর সাথে গল্পে ব্যস্ত। নিশীথ আশেপাশে রুহিয়াকে না দেখে বললো, ‘রুহি কোথায়? আমরা এখন বের হবো।’

স্বপ্না বললেন, ‘ওয়াশরুমে গিয়েছে।’

নিশীথ ঘর থেকে বেরিয়ে অপেক্ষা করতে থাকলো। প্রায় দশ মিনিট হওয়া সত্ত্বেও যখন কেউ ড্রইং রুমে এলো না তখন নিশীথ ঘরে ঢুকে বললো, ‘কোথায় রুহি? তোমরা বের হচ্ছো না কেন? আমাকে আবার ডাক্তারের কাছে এপয়েন্টমেন্ট নিতে হবে।’

স্বপ্না চিন্তিত ভঙ্গিতে বললেন, ‘অনেকক্ষণ হয়ে গেল রুহি ওয়াশরুমে গিয়েছে। দেখ তো বাবা, মেয়েটা বের হলো কিনা।’

নিশীথ পুরো বাড়ির সবগুলো বাথরুম খুঁজে রুহিয়াকে পেলো না। চিন্তায় তার ঘাম ঝরছে। বন্ধু রেহানকে ছাদে পাঠিয়ে সে নীচে নেমে গেল। স্বপ্নাকে রেহানের স্ত্রীর সাথে রেখে সে গলির এ কোণ, ও কোণ ঘুরে দেখতে লাগলো রুহিয়া বাসা ছেড়ে বেরিয়েছে কিনা। রেহান একবার ফোন করে জানিয়েছে ছাদে কেউ নেই। তারমানে রুহিয়া বাইরে গিয়েছে। নিশীথের চিন্তা বাড়তেই থাকলো।

সন্ধ্যা গড়িয়ে রাত, রাত গড়িয়ে মধ্য রাত। রুহিয়ার দেখা নেই। নিশীথ পাগলের মতো রাস্তায় ছুটোছুটি করেছে, স্বপ্নাকে একবারের জন্য সে দেখেনি। কারণ তাকে দেখলেই রাগটা মাথায় চড়ে বসছে এবং মুখে অনেক অশ্লীল ভাষা চলে আসছে। স্বপ্না ফুপি সেসব শুনলে বাড়ি ছেড়ে চলে যাবেন। তখন আরো ভোগান্তি পোহাতে হবে।

নিশীথ কিছুটা প্রভাবশালী হওয়ায় এক দিন না যেতেই থানায় জিডি করতে পারলো। পরিচিত অফিসারকে এই রাতেই কাজে নামিয়ে দিয়েছে সে। স্বপ্না ফুপিকে বাসায় রেখে সে আবারো গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে পড়লো। রাত সাড়ে বারোটা বাজছে অথচ রুহিয়ার কোনো খোঁজ নেই। সে ধীরে ধীরে গাড়ি চালিয়ে যাচ্ছে আর দুই পাশে নজর রাখছে। এরই মাঝে স্বপ্নার ফোন পেয়ে সে বেশ বিরক্ত বোধ করলো। প্রথমবার না ধরলেও দ্বিতীয়বার ফোন ধরলো সে।

– জি ফুপি।
– বাসায় আয় তুই। তোর বউ বাসায়।

চমকে উঠলো নিশীথ। গাড়ি থামিয়ে সে আবারো জিজ্ঞেস করলো, ‘কি বললে ফুপি?’

– বাসায় আসতে বলেছি। রুহি নিজের ঘরে বিশ্রাম নিচ্ছে।

ফোন কেটে গাড়িটা উল্টো ঘুরিয়ে দ্রুত বাসার নিচে গেল নিশীথ। কোনো রকম গাড়ি গ্যারেজে ঢুকিয়ে সিঁড়ি বেয়েই দৌড়ে উপরে উঠতে শুরু করলো সে। লিফটের জন্য অপেক্ষা করারও সময় নেই তার।

দরজা খোলাই ছিল। নিশীথ ভেতরে ঢোকার পর স্বপ্না একবার তাকিয়েই নিজের ঘরে গিয়ে দরজা আটকে দিলেন। নিশীথ বুঝতে পারলো ফুপি কি বলতে চাইছেন। এতক্ষণ নিশীথ ফুপিকে খুব বেশি কিছু না বললেও মুখভঙ্গি দ্বারা অনেককিছু বলেছে। যেটা ফুপির জন্য কষ্টদায়ক ছিল।

নিশীথ ঘরে গিয়ে রুহিয়াকে চোখ বন্ধ করে শুয়ে থাকতে দেখলো। গায়ের পোশাক বদলেছে রুহিয়া। এর অর্থ সে আরো আগেই ফিরেছে। নিশীথের নিজেকে বোকা মনে হচ্ছে। একবারও তার মাথায় আসেনি রুহিয়া বাসায় ফিরে আসতে পারে। সে বারবার ভেবেছে হয়তো রুহিয়া আত্ম-হ-ত্যা করতে বাইরে গিয়েছে। একবার অবশ্য স্বপ্না ফুপি দারোয়ানকে ফোন করেছিলেন, কিন্তু দারোয়ান রুহিয়াকে বাসায় আসতে দেখেনি বলেছিল। এ জন্য নিশীথ রুহিয়ার বাসায় আসার ব্যাপারটা মাথাতেই আনেনি। এখন একটু রেগে গেলেও রুহিয়ার শারীরিক অবস্থার কথা চিন্তা করে সে দমে গেল।

রাতটা এক প্রকার অস্বস্তি নিয়েই কাটলো। নিশীথের ঘুম আসে না। রুহিয়া গভীর ঘুমে থাকে। নিশীথ চুপচাপ নিজের কর্মের কথা ভাবে। জয়া তার জীবনে কালো অধ্যায় বলা চলে। প্রিয়তমা স্ত্রীর এই দুর্দিনে সে কাছে থেকেও দূরে, শুধুমাত্র জয়ার কারণে। রেহান বলেছে রুহিয়াকে নিয়ে কোনো এতিমখানায় যেতে। বাচ্চাদের সাথে কিছুক্ষণ সময় কাটিয়ে এলে রুহিয়ার মানসিক অবস্থার উন্নতি হতে পারে। কালকের দিনটা পার করে সে রুহিকে নিয়ে অনাথ আশ্রমে যাবে।

_______________

পরের দিন কাটলো খুব স্বাভাবিক। নিশীথ অফিসে দিনের অধিকাংশ সময় ব্যয় করে বাসায় পৌঁছে সন্ধ্যার লালিমা দেখতে পায়, কিন্তু স্ত্রীর মুখের গোধূলি দেখা হয় না। স্বপ্না প্রচন্ড বিরক্ত বোধ করছেন এমন মরা বাসায় থেকে। ইশারা ইঙ্গিতে অনেক ভাবেই বুঝিয়েছেন তিনি চলে যেতে চান। কিন্তু নিশীথ বুঝেও না বোঝার ভান করছে। রুহিয়া বরাবরের মতো চুপচাপ থাকছে। নিশীথের পরিকল্পনা কালকের অনাথ আশ্রম নিয়ে।

‘ফুলকুঁড়ি ইয়াতিম আলয়’ নামের এতিমখানায় পৌঁছে রুহিয়া আশেপাশে তাকিয়ে দেখছে যেন সে নতুন কিছুর সাথে পরিচয় হতে চলেছে। নিশীথ খুশি হলো রুহিয়ার মুখভঙ্গি দেখে। স্বপ্নাও খুশি হলেন এমন একটা জায়গায় বেড়াতে এসে। তিনি চাইতেন এতিম শিশুদের সাথে সময় কাটাতে। কিন্তু ছেলেরা খুব ব্যস্ত থাকায় এসব জায়গায় কখনো আসা হয়নি। নিশীথের উসিলায় এবার আসতে পেরে তিনিও রুহিয়ার মতো আশেপাশে মনোযোগ দিয়ে দেখছেন।

নিশীথের পরিচিত এক বন্ধুর বাবার অনাথ আশ্রম এটি। তাই এখানে তার বন্ধুও এসেছে আজ তাকে সঙ্গ দিতে। বন্ধুর হাত ধরে সে কিছুক্ষণ কুশল বিনিময় করলো। স্বপ্না ভেবেছিলেন নিজের মতো করে চারিপাশে ঘুরবেন, দেখবেন বাচ্চারা এখানে কিভাবে থাকে। কিন্তু রুহিয়াকে দেখতে গিয়ে তার আনন্দ নিমিষেই বিরক্তিকর অনুভূতিতে পরিণত হলো। রুহিয়া এখন শান্ত দৃষ্টিতে এক দিকে তাকিয়ে আছে। স্বপ্না তাকে এক পাশে বসিয়ে শাড়ির আঁচল গায়ে জড়িয়ে একজন কর্মীর সাথে কথা বলতে শুরু করলেন।

হঠাৎ এক বাচ্চার চিৎকারে সবার মনোযোগ নষ্ট হলো। নিশীথ ভ্রু কুঁচকে শব্দের উৎস খুঁজতে খুঁজতে হাঁটছে। তার সাথে বাকিরাও দৌড়ে যাচ্ছে। মাঠ থেকে ভেসে আসছে চিৎকার। মাঠে গিয়ে নিশীথের হৃদপিন্ড স্তব্ধ হয়ে গেল।

মাঠে খেলতে থাকা এক পাঁচ ছয় বছর বয়সী ছেলের গলায় কামড় বসিয়ে দিয়েছে রুহিয়া।

____________

চলবে ইন শা আল্লাহ….