ধোঁয়াশা পর্ব-০৬ এবং শেষ পর্ব

0
307

‘ধোঁয়াশা’ ৬.

~ তাবিনা মাহনূর

____________________

রুহিয়ার শরীরের অবস্থা আগের চেয়ে উন্নতির পথে। ইনবিহাজের যত্নে রুহিয়া আগের তুলনায় স্বাভাবিক আচরণ করছে। পাশাপাশি নিশীথ এখন বেশ সহনশীল। রেহানের কাউন্সিলিং চলছে। তবে এখনো পুরোপুরি সুস্থ হয়নি রুহিয়া।

সেই ঘটনার পর আরো বেশ কিছুদিন কেটে গেল। মিনারার মৃত্যুকে আত্মহত্যা বলে পুলিশ মামলার নিষ্পত্তি ঘটিয়েছে। সেই ঝামেলায় আর জড়াতে হয়নি নিশীথকে। আজ ইনবিহাজ তাহিয়াকে নিয়ে হাসপাতালে গিয়েছেন। সকালবেলা তাহিয়া বমি করেছে, ইনবিহাজ ভীত হয়ে ফাইজার সাহায্যে তাকে নিয়ে হাসপাতালে গেছেন। নিশীথ অফিস থেকে ছুটি নিয়ে বাড়ি চলে এসেছে।

দুপুরের খাবার খেয়ে ঘরে বিশ্রাম নিচ্ছে দুজন। রুহিয়ার চোখ দুটো বন্ধ। এমন সময় কলিং বেলের আওয়াজ শুনে নিশীথ দরজা খুলতে গেল। ইনবিহাজ এসেছেন ভেবে দরজা খুলতেই অনাকাঙ্ক্ষিত মানুষকে দেখতে পেল সে। জয়া মুচকি হেসে বললো, ‘ভেতরে আসতে দিবে না?’

নিশীথ একবার পেছনে তাকিয়ে দেখলো। তারপর সামনে ফিরে বললো, ‘কি চাও?’

– আগে ভেতরে ঢুকতে দাও।
– ভেতরে ঢোকা যাবে না। আর তোমার সাথে আমার কোনো যোগাযোগ নেই। তোমাকে আগেই সাবধান করেছিলাম যেন আমাকে আর বিরক্ত না করো।
– নিশীথ, আমাকে ভেতরে ঢুকতে দাও। কিছু কথা বলেই চলে যাবো।
– যা বলার এখানে দাঁড়িয়ে বলো।

জয়া শ্বাস ছেড়ে বললো, ‘ওহ নিশীথ! এভাবে কেউ মানুষকে বাইরে দাঁড় করিয়ে রাখে?’

নিশীথ এবার দাঁতে দাঁত চেপে বললো, ‘ভুলে যেও না তুমি আমার সন্তানের খু নি, এ কথা আমি জানি। পুলিশের কাছে যাইনি বলে ভেবো না তোমার প্রতি আমার দুর্বলতা আছে। আমার সম্পূর্ণ সত্তা জুড়ে শুধু রুহি আছে।’

জয়ার মুখ শক্ত হয়ে এসেছে। সে বললো, ‘যা করেছি তোমার আর আমার ভালোর জন্যই করেছি। শুনলাম তোমার বউ পাগল হয়ে গিয়েছে। এমন বউ ঘরে রেখে কি করবে?’

– বাজে কথা বলো না জয়া। বুঝেছি, তোমার আসলে কিছুই বলার নেই।

নিশীথ দরজা আটকে দিতে গেলে হঠাৎ জয়া তাকে জড়িয়ে ধরলো। স্তব্ধ নিশীথ জয়াকে ছাড়িয়ে নিয়ে ক্রোধ মিশ্রিত কণ্ঠে বললো, ‘জয়া! তুমি আসলেই একটা নোংরা কীট।’ জয়ার গালে থাপ্পড় দিয়ে দরজা আটকে দিলো সে। আর তখনই শুনতে পেল, রুহিয়া ঘরের দরজা আটকে দিয়েছে। নিশীথ বুঝতে পারলো জয়া রুহিয়াকে দেখে ইচ্ছে করে এই কাজটা করেছে। দিশেহারা নিশীথ ঘরের দরজা ধাক্কিয়ে বললো, ‘রুহি, রুহি শোনো। আমাকে বিশ্বাস করো রুহি। রুহি!’

বেশ কিছুক্ষণ ধাক্কা দেয়ার পর রুহিয়া দরজা খুললো। নিশীথ অবাক হয়ে দেখলো, রুহিয়া বাইরের পোশাক পরে তৈরি। নিশীথের বুকে চিবুক ঠেকিয়ে রুহিয়া বললো, ‘আমাকে নিয়ে একটু বেড়াতে চলো।’

বাইক ছুটছে দুরন্ত গতিতে। নিশীথের মন আজ ভালো। তার প্রিয়তমা তাকে বিশ্বাস করেছে। আজ জয়ার আগমন বরং তার জীবনটা সহজ করে দিয়েছে। হাসিমুখে নিশীথ বাইক চালিয়ে চলছে পথের পর পথ, পেছনে তার প্রিয়া। নিশীথের পিঠে মাথা ঠেকিয়ে বসে আছে রুহিয়া। বেশ কিছুদূর যাওয়ার পর সে পানি খেতে চাইলো। নিশীথ প্রথমে শুনতে পায়নি। তাকে ডেকে রুহিয়া আবার পানি খেতে চাইলো। রাস্তার এক কোণে বাইক থামালো নিশীথ। রুহিয়ার দিকে তাকিয়ে বললো, ‘শুধু পানি খাবে? আর কিছু খাবে না?’

রুহিয়া দুই দিকে মাথা নাড়লো। বাইক থেকে নেমে সে রাস্তার কোণে দাঁড়ালো। এ জায়গায় আশেপাশে দোকান নেই বললেই চলে। রাস্তা পেরিয়ে অন্য পাশে একটা চায়ের দোকান দেখতে পেল নিশীথ। রুহিয়াকে দাঁড়িয়ে থাকতে বলে সে রাস্তা পার হলো।

রুহিয়ার হাতে নিশীথের ছবি। ছবিতে নিশীথ দাঁত বের করে হালকা হাসছে। চাপ দাড়ি আর সফেদ হাসি দেখে রুহিয়ার ঠোঁটের কোণে মুচকি হাসি ফুটে উঠলো। দুই আঙ্গুল দিয়ে ছবিটা সে এমনভাবে ধরলো, যেন নিশীথের গালে হাত রেখেছে সে। ওপাশ থেকে ভেসে এলো চিৎকার। রুহিয়া মাথা ঘুরিয়ে দেখলো, নিশীথের নিথর দেহ পরে আছে রাস্তায়। মাথার ভেতর থেকে করোটিকা ফেটে মস্তিষ্কের কিছু অংশ বেরিয়ে পড়েছে।

_________________________

বৃষ্টি পড়ছে ঝিরঝির। নিশীথের কবর দেয়া সম্পন্ন হলো। আমে রিকা থেকে নিশীথের বাবা মা অনুমতি দিয়েছেন কবর দেয়ার। ছেলেকে বেশিক্ষণ কষ্ট দিতে চাননি তারা, যদিও তারা রওনা হয়েছেন ইতিমধ্যে।

দূরে দাঁড়িয়ে আছেন ইনবিহাজ আর রুহিয়া। স্বপ্না এসেছিলেন, কাঁদতে কাঁদতে চলে গিয়েছেন। অনেক আত্মীয় স্বজন এসেছে। সবাই নিশীথের বাড়িতে। নিশীথ বেঁচে থাকাবস্থায় কেউ আসেনি, আর আজ বাড়িতে জায়গার সংকুলান হচ্ছে না।

কবর দেয়া শেষে পুরুষ মানুষগুলো সরে গেল। ইনবিহাজ ছাতা হাতে দাঁড়িয়ে আছেন। ছাতার নিচ থেকে রুহিয়া সরে দাঁড়ালো। ধীর পায়ে হেঁটে হেঁটে নিশীথের কবরের কাছে গেল সে। আশেপাশে কেউ নেই। ইনবিহাজের দিকে তাকিয়ে রুহিয়া বললো, ‘মা, তুমি একটু একা থাকতে দাও আমাকে।’

ইনবিহাজ চোখ মুছে সরে গেলেন। নিস্তব্ধ নির্জন স্থানে রুহিয়া দাঁড়িয়ে আছে, ভিজছে একাকী। নিশীথের কবরের পাশে বসলো সে। ভেজা মাটিতে হাত বুলিয়ে অস্ফুট স্বরে বললো, ‘নিশীথ, আমার ভালোবাসা।’

নিশীথের দিক থেকে কোনো উত্তর ভেসে এলো না। রুহিয়া আপন মনে বললো, ‘তোমাকে আজ একটা গল্প বলবো নিশীথ। গল্পটা তোমার জানা, কিন্তু এর আড়ালের গল্পটা তোমার অজানা। আড়ালের গল্পই বলবো আজ।’

একটু থেমে রুহিয়া বললো এতদিনের অস্বাভাবিকতার পেছনের গল্প।

– নিশীথ, তোমার ফোনে আমি ম্যাসেজ দেখেছি জয়ার। তোমার ম্যাসেজও দেখেছি। দেখে বুঝেছিলাম তুমি জয়াকে এড়িয়ে চলেছো। আমার গর্ভের সন্তান আর আমাকে নিয়েই তোমার জীবন। তাই তোমার কষ্ট কমিয়ে দিতে আমি জয়ার সাথে দেখা করার সিদ্ধান্ত নিই। এবং দেখা করি। কিন্তু আমি কি আর জানতাম, সেদিন দেখা করার কারণে আমার সন্তানের মৃত্যু হবে? আমি একটা ফোন কল পেয়ে বাইরে গিয়েছিলাম, কাউকে খুঁজে পাইনি। সেই সুযোগে জয়া আমার সাথে সবচেয়ে নিকৃষ্ট কাজটা করেছে। আমি সন্তান হারালাম, মা হওয়ার ক্ষমতা হারিয়ে ফেললাম।

রুহিয়া একা একা কথা বলছে, কিন্তু তার মনের চিত্রপটে নিশীথ তার সামনে প্রাণ নিয়ে বসে আছে। রুহিয়া বললো, ‘তারপর আমার মাঝে ক্রোধ জন্ম নিলো। আমি তোমাকে ঘৃণা করতে শুরু করি। নিজেকে বোঝাই, তুমি আসলে জয়ার কাছেই যাবে। আমার সাথে এতদিন অভিনয় করেছো। এভাবে ধীরে ধীরে আমার মনে গেঁথে গেল, তুমি আর জয়া আবার নোংরা সম্পর্কে জড়িয়েছো। আর তাই, আমিও একটা ভয়ঙ্কর খেলা খেললাম। আমি শয়তানের সাহায্য নিয়েছি নিশীথ। কুফরী করেছি তোমাদের!’

সন্তান হারানো মানসিক ভারসাম্যহীন রুহিয়া, প্রিয়তম স্বামীর প্রতি অতিরিক্ত ক্রোধে কা ফির আশেকের আশ্রয় নিয়েছে। নিশীথ আর জয়ার ছবি সংগ্রহ করে সে জঘণ্যতম কাজ করিয়েছে।

– প্রথম যেদিন রেহানের বাসা থেকে পালিয়ে গেলাম, সেদিন আসলে আশেকের বাড়ি গিয়েছিলাম আমি। আশেকের খোঁজ পেয়েছি আমার বান্ধবীর কাছ থেকে। তাকে বলেছিলাম জয়ার ক্ষতি করতে চাই আমি। তোমার কথা বলিনি। আশেকের কাছে গিয়ে তোমার আর জয়ার ছবি দিয়েছি আমি। আমার মস্তিষ্কে তখন শুধুই প্রতিশোধের আগুন জ্বলছিল। তোমাকেও আমি এই দুনিয়ায় ভালোভাবে বাঁচতে দেখতে চাইনি। তাই শেষ পর্যন্ত, তোমার ক্ষতি করতে আশেককে টাকা দিয়েছি।

রুহিয়া কল্পনা করলো, নিশীথ হয়তো এখন কাঁদছে। বাকহারা নিশীথকে কল্পনায় এঁকে রুহিয়া বললো, ‘আশেক শর্ত দিলো, কিছু প্রভাব আমার উপরেও পড়বে। আমি যেন ভয় না পাই। এ কারণেই আমার আচরণে অস্বাভাবিকতা ছিল নিশীথ। আমি নিজের মাঝে থাকতাম না। আমার মাঝে অন্য কেউ থাকতো, অন্য কারো বসবাস ছিল। তাই যা কিছু হতো, সব তার দ্বারা। আমি কিছুই করতাম না। কাঁচা মাংস সে খেতো, পোকা খেতো সে। আমি খেতাম না।’

বৃষ্টি ঝরছে অবিরাম। রুহিয়া ক্লান্ত হয়ে নিশীথের কবরের উপর শুয়ে পড়লো। চোখ বন্ধ করে সে বললো, ‘মিনা খালাকে মারতে চাইনি নিশীথ। মিনা খালা একদিন দরজা না ধাক্কিয়ে ভেতরে ঢুকে পড়েন। সেদিন আমি জাদু করছিলাম। আশেক শিখিয়ে দিয়েছিল কিছু কাজ। মিনা খালা আমাকে দেখে ফেলেন সেই কাজ করতে। শুধু আমাকে না, আমার পাশে বসে থাকা দুটো জিনকেও দেখে ফেলেন তিনি। তোমাকে কিছু বলার সাহস পাননি তিনি। ভেবেছিলাম ওরা মারবে না। অনুরোধ করেছিলাম ওদের। আশেককে ফোন করে বলেছিলাম যেন মিনা খালার ক্ষতি না হয়। কিন্তু আশেক বললো, এ বিষয়টা তার হাতে নেই। খারাপ জিনগুলো যদি মনে করে মিনা খালা তাদের জন্য হুমকির, তাহলে কিছুই করার থাকবে না। মিনা খালাকে একদিন ডেকে বললাম, তিনি যেন চুপ থাকেন। প্রয়োজন হলে মায়ের কাছে ফিরে যান, তবু চুপ থাকেন। খালা চুপ ছিলেন, তোমাকেও কিছু বলেননি। কিন্তু….

বজ্রপাতের শব্দে কেঁপে উঠলো রুহিয়া। কিন্তু চোখ খুললো না। বৃষ্টির জলবিন্দু পড়ছে তার মুখে, সেই জল শুষে নিয়ে সে বললো, ‘কিন্তু খালা মনে মনে আমাকে থামানোর পরিকল্পনা করে ফেলেছিলেন। একদিন বাইরে গিয়ে একজন ইমামের সাথে কথা বলেছেন এ ব্যাপারে। ইমাম সাহেব বাড়ির ভেতরে আসার আগেই আমি বুঝতে পারি। তাই সেদিন কোনোভাবেই ইমামকে ভেতরে ঢুকতে দিইনি। আমি মিনা খালাকে মায়ের কাছে চলে যেতে বলি। কিন্তু খালা শোনেন না, আমাকে বোঝাতে শুরু করেন। আমি আতঙ্কিত থাকতাম, তারা হয়তো খালার ক্ষতি করবে। আর তাই হলো। তারা মেরে ফেললো খালাকে। আমার কিছুই করার থাকলো না।’

ইনবিহাজ দূর থেকে মেয়েকে দেখছেন। মেয়েটা একবার বসছে, আরেকবার শুয়ে পড়ছে। গায়ে কাঁদা মেখে গিয়েছে। তিনি বুঝতে পারছেন না, কাছে যাওয়া ঠিক হবে কিনা।

– তারপর আমি অনেক কেঁদেছি। আশেককে ফোন করে বলেছি এগুলো থামাতে। আমি চাই না তোমার ক্ষতি হোক। আশেক বললো থামানো সম্ভব নয়। যা হওয়ার হয়ে গিয়েছে এবং বাকি টাকা যেন তাকে দিয়ে দেয়া হয়। আমি শুধু জয়ার ক্ষতি চাইলাম। আশেক বললো, দুজনেরই ক্ষতি হবে। কিছুই করার নেই। তারপর আমি অপেক্ষায় থাকলাম। সেদিন হারিয়ে যাইনি নিশীথ। সেদিন আমি আশেকের বাকি টাকা দিতে গিয়েছিলাম। তারপর কমলাপুর রেলওয়ে স্টেশন বসে ছিলাম তোমার অপেক্ষায়। তবে অসুস্থ হওয়াটা অভিনয় ছিল না। আমি চাইতাম সব আগের মতো হয়ে যাক। কিন্তু গত দিন যখন জয়াকে দেখলাম তোমাকে জড়িয়ে ধরতে, তখনই সিদ্ধান্ত নিলাম, ‘আজই সব শেষ করে ফেলবো।’

রুহিয়ার শ্বাস আটকে আসছে। ঝম ঝম বৃষ্টিতে শুয়ে থেকে শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে তার। একটু থেমে আবার বললো সে, ‘আমি তোমার খু নি। আমি তোমাকে খু ন করেছি। জয়াকেও করেছি। কাল জয়াও মারা গিয়েছে নিশীথ। আমাদের বাসা থেকে বের হওয়ার পর সেও এক্সিডেন্ট করেছে। এ খবর জানার সুযোগ তুমি পাওনি। কারণ তুমিও ততক্ষণে শেষ।’

উঠে বসলো রুহিয়া। নিশীথের কবরে হাত বুলিয়ে সে বললো, ‘নিশীথ, আমাকে ক্ষমা করে দিও। অবশ্য ক্ষমা করেও লাভ নেই। আমি পাপে জর্জরিত। আমার এখন খুব ভয় করছে নিশীথ। আমি এখন জানি অতিপ্রাকৃত সবকিছু সত্য। আর যেহেতু অতিপ্রাকৃত সব সত্য, তাই ধর্ম সত্য। সব ধোঁয়াশা কেটে গিয়েছে নিশীথ। ধর্ম সত্য, আমি নিঃশেষ। পৃথিবীটা এমন কেন নিশীথ?’

কথাগুলো বলতে বলতে আবার শুয়ে পড়লো রুহিয়া। তার পরিশ্রান্ত দেহ, কথা বলার শক্তি শেষ হয়ে আসছে ধীরে ধীরে। রুহিয়া বললো আরো কিছু কথা, ‘নিশীথ, পৃথিবীটা এমন কেন? কেন এতো দুঃখ? সব কি সুন্দরভাবে চলতে পারতো না? তুমি শুধু আমার হতে। আমি তোমার। আমাদের সন্তান বেঁচে থাকতো। আমরা একটা সুন্দর পরিবার হতে পারতাম। কিন্তু এগুলো হলো না। কাকে দোষ দেব বলো? আমরা নিজেরাই যে দোষী। আমাদের তৈরি নিয়ম মেনে আমরাই বাঁধা পড়ি নোংরা খেলায়। যদি আমরা আনুগত্য করতাম সর্বশ্রেষ্ঠ কারো, তবে তার দেয়া নিয়মে চলে আমরা শান্তি পেতাম কি? হয়তো পেতাম। কারণ যিনি সর্বশ্রেষ্ঠ, তিঁনি নিশ্চয়ই সঠিক নিয়ম জারি রাখতেন। তার নিয়ম মেনে হতে পারতো আমাদের সুন্দর জীবন। কিন্তু কিছুই হলো না, আমাদেরই দোষে। আর সম্ভবও নয়। সময় শেষ।’

শেষবার রুহিয়া বলে উঠলো, ‘নিশীথ, তুমি আমাকে একবার প্রশ্ন করেছিলে, আমি তোমাকে ভালোবাসি কিনা। উত্তরে বলেছিলাম, না। আর তাই তোমাকে মেরে ফেললাম নিশীথ।’

রুহিয়ার মুখ বেয়ে সাদা ফ্যান বের হচ্ছে। সে বললো, ‘কিন্তু আমি যে সত্যিই তোমাকে ভালোবাসি। তাই আমিও আর বেঁচে থাকতে চাই না নিশীথ।’

বৃষ্টির পানির সাথে রুহিয়ার অশ্রু মিশে আছে। মুখ দিয়ে রক্ত বের হচ্ছে, সেই রক্তে ভিজে আছে রুহিয়ার মুখশ্রী। তার চোখ দুটো খুলে আর বন্ধ হয়নি। যেন জগতের অপার বিস্ময় অবলোকন করে জগৎকে বিদায় জানানোর সময় পায়নি সে। দূর থেকে ইনবিহাজের মাতৃত্ব মন বুঝতে পারলো ঘটে গিয়েছে অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা।

দৌড়ে ইনবিহাজ মেয়ের কাছে গেলেন। চিৎকার করে কাঁদতে লাগলেন তিনি। আশেপাশে আবারও মানুষের ভিড় জমে উঠলো। একজন বললো, ‘মৃত্যু কত সহজ! কিন্তু এর পরের জীবন কি ততই সহজ?’

আমাদের ভাবনার জগতে শুধু দুনিয়া বিচরণ করলে নিশীথ আর রুহিয়ার মতোই ফলাফল মেলে। দুনিয়ায় অর্থের অভাব ছিল না তাদের, ছিল না কোনো চাওয়া পূরণ না করতে পারার কষ্ট। কিন্তু দুঃখ ঠিকই ছিল। অথচ তাদের বিপরীতে আখিরাত গড়ে তোলা মানুষটার হয়তো স্বাদ আহ্লাদ পূরণের ক্ষমতা নেই, দুঃখও আছে কিছু। কিন্তু মানুষটা সেই দুঃখকে দুঃখ বলে মনে করে না। কারণ সে আনুগত্য করে সর্বশ্রেষ্ঠ রবের। যাঁর বেঁধে দেয়া নিয়মে নেই কোনো অশান্তি, গ্লানি।

আমাদের সিদ্ধান্ত আমাদেরই নিতে হবে। আখিরাত গড়বো, নাকি দুনিয়া?

(সমাপ্ত)

_______________

[মন্তব্য রেখে যাবেন। ত্রুটি তুলে ধরবেন ইন শা আল্লাহ।]