নিষিদ্ধ বরণ পর্ব-১৪+১৫

0
232

#নিষিদ্ধ_বরণ
#রোকসানা_রাহমান

পর্ব (১৪)

” উনাকে কষ্ট দিতে কিছু বলিনি, আম্মু! ”

আসমা রহমান থেমে গেলেন। মেয়ের দিকে ঘুরে দাঁড়িয়ে বললেন,
” মাহদীর সামনে নায়রাকে নিয়ে কথা বলা মানেই কষ্ট দেওয়া। ছেলেটা আগে থেকেই পাগল। নায়রাকে পেয়ে ভালো হওয়ার বদলে আরও বেশি পাগল হয়ে গেছিল। আমার নায়রাকে ওর মতো আর কেউ ভালোবাসতে পারবে না। আমি তো এটা দেখেই অবাক হই নায়রাকে ছাড়া এখনও বেঁচে আছে! মস্তিষ্ক বিগড়ে যায়নি! ”
” তুমি বলেছিলে বিয়ের পর উনি কখনও এ বাড়ি আসেনি। তোমরাও যাওনি। দুজনকে একসাথে দেখনি কখনও। তাহলে কিভাবে বুঝলে উনি আপুকে খুব ভালোবাসতেন। উনাদের বৈবাহিক জীবন অন্যদের মতো স্বাভাবিক ছিল? ”

আসমা রহমান রেগে গেলেন। বললেন,
” কী বলতে চাস? কী প্রমাণ করতে অশান্তি বাড়াচ্ছিস, নিহি? ”

নিহিতার মুখ ফসকে কিছু একটা বের হতে গিয়েও বদ্ধ ঠোঁটে বাঁধা খেল। সেই ফাঁকে আসমা রহমান বললেন,
” মাহদী নায়রাকে মেরে ফেলেছে, এটাই প্রমাণ করতে চাচ্ছিস? ”

নিহিতার বদ্ধ ঠোঁটজোড়া আলগা হলো। ধীরে কিন্তু স্পষ্ট স্বরে বলল,
” হতেই পারে। উনার জন্য অসম্ভব নয়। ”

আসমা রহমান বিস্ফারিত চোখে তাকালেন। রাগের পারদ উর্ধ্বাকাশে ছুটতে! মুখমণ্ডল কাঁপছে। তার জায়গায় অন্য কেউ হলে এতক্ষণে নিহিতার গালে ভারী চড়-থাপ্পড় পড়ত। নিজেকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে যথাসাধ্য চেষ্টা চালিয়ে বললেন,
” আমার অনুমতি ছাড়া এ ঘরের চৌকাঠ পার হওয়া তোর জন্য নিষেধ। ”

থমথমে গলায় আদেশটি দিয়ে চলে যাওয়ার জন্য ঘুরে দাঁড়ালেন। সামনে এক পা ফেলে বললেন,
” তখন মাহদী বলেছিল না? আমি মা, মেয়ের মুখ দেখেই সব বুঝতে পারি। ঠিকই বলেছিল। মাহদীর ভালোবাসায় নায়রা কতটা খুশি, কতটা সুখি তা ওর মুখ দেখেই বুঝতাম। ওর কথাবার্তায় বিশ্বাস করতাম। সবকিছু স্বচক্ষে দেখার প্রয়োজন হয় না। নায়রা এমন মেয়েও নয় যে মা-বাবার সামনে মিথ্যে সুখের গল্প করবে। এতটুকু নিশ্চয় তোর জানা? ”
নিহিতাও দমে না গিয়ে বলল,
” নায়রা আপু যে কারও সম্পর্কে বলতে গেলে খারাপের চেয়ে ভালোটা বেশি বলে এটাও আমার জানা। আর উনি তো আপুর স্বামী ছিল! ”

আসমা রহমান আগুন চোখে তাকালেন। মেয়ের সাথে আর কথা না বাড়িয়ে নিজের রুমের দিকে ছুটলেন।

শব্দ তালে রুমের ভেতর প্রবেশ করতে স্বামীর শাসনে পড়লেন,
” এভাবে হাঁটছ কেন, আসমা? মেয়েদের হাঁটতে… ”

তার কথা শেষ হতে না দিয়ে বললেন,
” মাহদী চলে যাচ্ছে। ”

এরশাদ রহমান খাট থেকে পিঠ আলগা করলেন। সোজা হয়ে বসে বললেন,
” চলে যাচ্ছে বলতে? এত রাতে কোথায় যাচ্ছে? ”
” রাতে নয়। সকালে যাচ্ছে। ঢাকার ট্রেন ধরবে। ”

এরশাদ রহমান খানিকটা চমকালেন। চমকিত স্বরে জিজ্ঞেস করলেন,
” হঠাৎ? আমাকে তো জানায়নি! ”

আসমা রহমানের রাগ তখনও পড়েনি। স্বামীর সাথে এতক্ষণ সহজ গলায় কথা বললেও এবার বিরক্ত ধরা পড়ল কণ্ঠে,
” জানানোর মতো অবস্থায় থাকলে তো জানাবে! ”

এরশাদ রহমান উদ্বিগ্ন কণ্ঠে বললেন,
” কেন? কী হয়েছে ওর? শরীর খারাপ করেছে নাকি? ”
” না। ”
” তাহলে? ”

আসমা রহমান দূরে দাঁড়িয়ে থেকেই মেয়ের ঘটানো সকল কর্মকাণ্ড বললেন। সবটা শোনার পর এরশাদ রহমানের মুখের হাবভাবের তেমন কোনো পরিবর্তন হলো না। বিছানা ছাড়তে ছাড়তে বললেন,
” তুমি শুয়ে পড়ো। আমি একটু মাহদীর সাথে দেখা করে আসি। ”

আসমা রহমান বাঁধা দিয়ে বললেন,
” মানাতে যাচ্ছ তো? কোনো লাভ নেই। ওর জেদ সম্পর্কে আমাদের সবারই জানা। এক বার যখন বলেছে তখন যাবেই। ”

এরশাদ রহমান মৃদু হাসলেন। দরজার দিকে এগুতে এগুতে বললেন,
” ছেলেটা পাল্টাচ্ছে! ”

_________________
নিহিতা পড়তে বসেছিল। মনোযোগ দিতে না পারায় বই ফেলে ঘুমানোর প্রস্তুতি নিচ্ছে। তন্মধ্যেই ভাবনায় হারাচ্ছে বার বার। উদাসীন হয়ে পড়ছে। আপুর কথা মনে পড়ছে খুব। তার সাথে কাটানো প্রতিটা মুহূর্ত হৃদয়ে কাঁপন সৃষ্টি করছে। এই অনেকগুলো বছর পর হঠাৎ অনুভব করল তার আপু নেই। সত্যিই নেই! আর কখনও দেখা হবে না। কখনও না! বালিশ ঠিকঠাক করে আলো নেভাতে গিয়ে উপলব্ধি করল সে অন্যায় করেছে। মায়ের সাথে তর্ক করেছে, অবিশ্বাস করেছে। আল্লাহ কি তাকে ক্ষমা করবে? নিহিতার ভেতরটা আরও একবার কেঁপে উঠল। চিন্তা-ভাবনা পাল্টে গেল। মেনে নিল তার মা সত্যি বলছে। মানতে খুব একটা কষ্ট হলো না। বাড়িতে আপুর সাথে দেখা না হলেও এক বার তার মাদরাসায় গিয়ে নায়রা দেখা করে এসেছিল। কত কী নিয়ে গিয়েছিল! সাথে করে ঢাকায় নিয়ে যেতেও চেয়েছিল। তখন পরীক্ষা চলছিল বিধায় যেতে পারেনি নিহিতা। সেদিন অনেক্ষণ গল্প করেছিল তারা। নিহিতার একবারের জন্যও তো মন কেমন করে উঠেনি। মনে হয়নি আপু কষ্টে আছে। তাহলে আজ কেন এমন মনে হচ্ছে? হঠাৎ করে হারিয়ে গিয়েছে বলে? কারও উপর দোষ চাপিয়ে মনকে সান্ত্বনা দেওয়ার জন্য?

নিহিতা রুম ছেড়ে বেরিয়ে এলো। মায়ের রুমের দিকে কয়েক পা এগিয়ে থেমে যায়। ভাবে, এভাবে মাফ চাইলে হয়তো মাফ করবেন। কিন্তু মনে কষ্টটা থেকেই যাবে। মাহদীকে শুধু মেয়ের জামাই হিসেবে নয়, ছেলের মতো ভালোবেসে ফেলেছেন! নাহলে নিহিতাকে এমন করে শাসায়?

নিহিতা আর দ্বিধাদ্বন্দে ভুগল না। বড় দরজা পেরিয়ে বারান্দায় নামল। উঠোনে পা রাখতে রাখতে চোখ রাখল দক্ষিণ ঘরটার দিকে। ভেতর থেকে আলো বেরিয়ে আসছে খোলা দরজা দিয়ে। নিহিতা আলোতে নজর রেখেই সামনে এগিয়ে গেল। কাছাকাছি পৌঁছাতে মাহদীর গলা পেল,
” আপনারা ভুল ভাবছেন, বাবা। নিহিতার উপর রাগ করতে যাব কেন? রাগ করার মতো কিছু হইনি। ছোট মানুষ। আপুর জন্য হয়তো মনখারাপ লাগছিল তাই আমার সাথে কথা বলতে এসেছিল। তাছাড়া আমাদের বিয়েটা হয়েছিল এক রকম জোরাজুরিতে, তার মধ্যে এক বছর পার হতে না হতেই নায়রার আকস্মিক মৃত্যু…”

শেষ কথাটা বলতে গিয়ে যেন মাহদীর গলা কাঁপল। চোখ ঝাপসা হয়ে এলো! চোখের পাতা ফেলল ঘন ঘন, ঠোঁট কামড়ে নিজেকে সামলে দ্রুত বলল,
” নিহিতার উপর রাগ করে যাচ্ছি না, বাবা। মনের স্কুল দুই দিন পর খুললেও আমার ছুটি কালই শেষ। ”

এরশাদ রহমান প্রথমে কিছু বললেন না। মনের ঘুমন্ত মুখের দিকে তাকালেন। মাথায় হাত রেখে আদর করলেন। তার দিকে ঝুঁকে থেকেই বললেন,
” তাহলে ও কে রেখে যাও। আমি নাহয় পরশু…”
” পারব না! ”

এরশাদ রহমান মাহদীর দিকে তাকালেন। অসহায় ভরা চোখে চোখ পড়তে মাহদী বলল,
” পাগল হয়ে যাব। বাবা, এমন অনুরোধ করবেন না যেটা আমি রাখতে পারব না। প্লিজ! ”

এরশাদ রহমান স্মিত হাসলেন। বললেন,
” আমি বুঝলেও তোমার শাশুড়ি বুঝবে না। কাল চলে গেলে তার ধারণা আরও পোক্ত হবে। নিহিতার সাথে মনোমালিন্যও চলতে পারে। ”

এরশাদ রহমান দাঁড়িয়ে পড়লে মাহদীও দাঁড়াল। করুণ স্বরে বলল,
” আপনি বুঝালেও হবে না? ”

এরশাদ রহমান মাথা দুপাশে নাড়লে মাহদী বলল,
” আমি চাচ্ছিলাম না আপনাদের কোনোভাবে কষ্ট দিতে। ”
” তাহলে থেকে যাও। দেখ আরও দুই দিনের ছুটি বাড়ানো যায় নাকি। ”

মাহদী মাথা নিচু করে ফেললে এরশাদ রহমান বললেন,
” তোমার শাশুড়িকে বুঝাতে না পারলেও তোমার সিনিয়রকে মনে হয় বুঝাতে পারব। চাইলে কল করে ফোন ধরিয়ে দিতে পার। চেষ্টা করে দেখতে পারি। ”

নিহিতা দরজার আড়াল থেকে সবকিছু শুনছিল। এবার একটু ভেতরে উঁকি দিল। চোখের চাহনি পড়ল সরাসরি মাহদীর উপর। সেই সাথে আবিষ্কার করল, মানুষটার চাহনি বদলেছে, কথা বলার ভঙ্গি বদলেছে। চালচলনে ধীরতা এসেছে। এবার দেখার পালা একরোখা স্বভাবটা টলে নাকি। নিহিতাকে অবাক করে দিয়ে মাহদী বলল,
” মায়ের খুশির জন্য আরও দুই দিন থাকব। ”

এরশাদ রহমানের হাসি চওড়া হলে মাহদী বলল,
” নিহিতার সাথে রাগারাগি করতে মানা করবেন। ও এখনও অবুঝ! ”

_________________

শুক্রবার। আকাশে দুপুরের রোদ্দুর। গোসল সেরে পাঞ্জাবি পরছিলেন এরশাদ রহমান। সেই সময় স্ত্রী বললেন,
” মাহদীকে সঙ্গে নিয়ে যেও। ”

এরশাদ রহমান জায়নামাজ কাঁধে তুলে বললেন,
” তোমার মনে হয় আমি বললেই সাথে যাবে? ”

আসমা রহমান হ্যাঁ- না কিছুই বললেন না। মনে পড়ল নায়রা এ বাড়িতে আসলে তার প্রথম প্রশ্নই ছিল, মাহদী নামাজ পড়া শুরু করেছে? নায়রা প্রতিবারই না বলত। যার জন্য পাগল সেই কোনো দিন নামাজ পড়াতে পারল না। তাহলে তাদের কথায় কি পড়বে? আসমা রহমান দুর্বল স্বরে বললেন,
” যেতেও পারে। তোমার কথায় এ গাঁয়ের অনেকেই তো নামাজ পড়ে! ”

এরশাদ রহমান স্ত্রীকে খুশি করতে বললেন,
” আচ্ছা, বলব। ”

স্বামীর পেছন পেছন আসমা রহমান বারান্দা পর্যন্ত এলেন। যদিও জানেন মাহদী নামাজে যাবে না তবুও আশা নিয়ে অপেক্ষা করছিলেন। সেই সময় মন ভেতর থেকে বেরিয়ে এলো। আনন্দিত গলায় বলল,
” নানাজান, দাঁড়াও। আমরাও যাব। ”

আসমা রহমান সিমেন্টের পিলারটি চেপে ধরলেন। অশ্রুভরা নয়নে দেখলেন মাহদী সাদা চকচকে পাঞ্জাবি পরে বেরিয়ে আসছে।

বাবা কাছে আসতে মন বলল,
” বাবা, কোলে নেও। ”

মাহদী ছেলেকে কোলে নিতে সে নানার দিকে ঝুকে এলো। বুকের পাশে আতর ল্যাপ্টে দিয়ে বলল,
” আমি নানাজানের পাশে দাঁড়াব। ”

একটু থেমে বলল,
” বাবার পাশেও দাঁড়াব। ”

তারপর মনখারাপ করে বলল,
” কিন্তু আমি যে একজন। দুজনের সাথে কিভাবে দাঁড়াবে? ”

মাহদী ছেলেকে নামিয়ে দিল। দুজনের মাঝে দাঁড় করিয়ে বলল,
” এই যে এভাবে। ”

________________
শুক্রবারে নিহিতাদের বাসায় ভালো খাবারের আয়োজন করা হয়। আজও ব্যতিক্রম হলো না। স্বামী মসজিদ থেকে আসার আগেই খাবার টেবিলে খাবার সাজিয়ে ফেলেন আসমা রহমান। আজ দ্বিগুন উৎসাহে সব কিছু গুছাচ্ছেন। মাহদীর মসজিদে যাওয়ার মুহূর্তটুকু বার বার মনে করে চোখের পানি মুচছেন। হাঁসের মাংসের বাটিরা টেবিলে রাখতে গিয়ে খেয়াল করলেন লেবু কাটেননি। গলা ছেড়ে মেয়েকে ফরমায়েশ দিলেন,
” মা, গাছ থেকে দুটো লেবু ছিঁড়ে আনত। ”

নিহিতা তখন গোসল করেছে মাত্র। ভেজা চুল থেকে তোয়ালে খুলে হিজাবটা হাতে নিয়েছিল ওযু করবে বলে। মায়ের গলা পেয়ে সেভাবেই বাইরে ছুটল। বারান্দা ধরে সোজা হেঁটে গেলে লেবু গাছটা পড়ে। নিহিতা বারান্দা পেরোতে পারল না। তার আগেই চোখ দুটো আটকে গেল গেইটের দিকে।

চলবে

#নিষিদ্ধ_বরণ
#রোকসানা_রাহমান

পর্ব (১৫)

নিহিতা তখন গোসল করেছে মাত্র। ভেজা চুল থেকে তোয়ালে খুলে হিজাবটা হাতে নিয়েছিল ওযু করবে বলে। মায়ের গলা পেয়ে সেভাবেই বাইরে ছুটল। বারান্দা ধরে সোজা হেঁটে গেলে লেবু গাছটা পড়ে। নিহিতা বারান্দা পেরোতে পারল না। তার আগেই চোখ দুটো আটকে গেল গেইটের দিকে।

শূভ্র রঙের পাঞ্জাবিখানায় মসৃণ মুখটা বড্ড কোমল, স্নিগ্ধ ও মসৃণ দেখাচ্ছে। দেহ কাঠামো থেকে যেন পবিত্র আলোর স্ফুরণ ঘটছে! ঠোঁটের মুচকি হাসিটা নিহিতার হৃদয়ে ছুরির ফলার মতো বিঁধতেই ধপাস শব্দ হলো! বারান্দা থেকে গড়িয়ে লেবু গাছের তলাতে গিয়ে থামল নিহিতার দেহখানি। ভয়ে, আতঙ্কে, টাল সামলাতে লেবুর একটি ঢাল চেপে ধরেছিল ডান হাতে। কাঁটা ফুটতেই আর্তনাদ করে উঠল!

ব্যথিত কণ্ঠস্বর সর্ব প্রথম পৌঁছাল মনের কানে। মাহদীর কোলে থেকেই চিৎকার করল,
” খালামনি! ”

তারপর তরতর করে নেমে আসল মাটিতে। বাবাকে ফেলে উঠোনের মধ্যখানে ছুটছে। মাহদী ছেলেকে ডাকতে ডাকতে ছুটে আসে। ছেলের কাছে দাঁড়াতে নিহিতার গোঙানি শব্দ পায়। ঘাড় ফিরে তাকাতে কিঞ্চিৎ ভয় পায়। নিহিতার কাছে পৌঁছায় ঝড়ের গতিতে! উঠানোর জন্য হাতে ধরতে গিয়েও থেমে যায়। বলল,
” কীভাবে পড়লে? সাবধানে উঠো! ”

নিহিতা মাটিতে হাতের ভর রেখে উঠতে গিয়ে ব্যথায় চিৎকার করে ওঠে। চোখ ছেড়ে পানি গড়িয়ে পড়তে বলল,
” পারছি না! ”

ততক্ষণে মন নানিকে ডেকে এনেছে। তিনি মেয়ের হিজাব ঠিক করে দিয়ে চুল ঢাকলেন। পাজামা টেনে গোড়ালি ঢেকে বললেন,
” পড়লি কিভাবে? ”

নিহিতা উত্তর দিল না। হাতে বিঁধে থাকা কাঁটার দিকে তাকিয়ে থেকে ফুঁপিয়ে উঠল। মাহদী ব্যাপারটা খেয়াল করে হাতের কাঁটা টেনে তুলল দ্রুত। তাড়া দিয়ে বলল,
” ও একা উঠতে পারবে না। আপনি সাহায্য করুন। কাঁটাস্থানে ওষুধ দিতে হবে। ”

কথাটা বলতে বলতে গেটের দিকে তাকাল। এরশাদ রহমান নামাজ শেষে গ্রামের বয়োজ্যেষ্ঠদের সাথে কথা বলছিলেন। মাহদীরাও সাথে ছিল। মন পানি খেতে চাওয়াই শ্বশুরকে রেখে চলে আসতে হয়েছে। এখনও আসছেন না দেখে চিন্তায় পড়ে গেল সে।

আসমা রহমান সর্ব শক্তিতে মেয়েকে তুলতে সফল হলেন। মায়ের হাতের জোরে নিহিতা সোজা হয়ে দাঁড়ালেও হাঁটতে পারল না। একপা সামনে এগুতে পড়ে যাচ্ছিল মাহদী চট করে ধরে ফেলে। নিহিতা অস্পষ্ট স্বরে বলল,
” মনে হয় পা-টা ভেঙে গেছে! ”

কথাটা মায়ের উদ্দেশ্যে বললেও উত্তর দিল মাহদী,
” আরে না! উপর থেকে পড়েছ তো তাই মচকে গেছে একটু। ”

মাহদীর কথায় খুব একটা আস্থা পেল না নিহিতা। মাহদী নিজেও অনাস্থায় ভুগছে। না দেখে কিভাবে বুঝল মচকে গেছে? সে কি ডাক্তার? মাহদী নিজের বলে ফেলা উক্তিতে লজ্জা পেল। মাঝখান থেকে আসমা রহমান বললেন,
” এখন ঘরে নিব কিভাবে? ”

আসমা রহমানকে ছুটে বাইরে বের হতে দেখে রিন্টুর মা পিছু নিয়েছিল। দূরে থেকে বলল,
” কোলোত নেন। খালাম্মা আপাক কোলোত নেন। ”

আসমা রহমান রেগে গেলেন। চোখ পাকিয়ে বললেন,
” ও কি বাচ্চা? আমি কিভাবে কোলে নেব? না বুঝে কথা বলতে আসবি না। ”

রিন্টুর মাকে শাসিয়ে মেয়ের দিকে তাকালেন। তারপর অসহায় স্বরে বললেন,
” তোর বাবাও বাসায় নেই। কখন আসবেন কে জানে! এভাবে আর কতক্ষণ থাকবি? ”

রিন্টুর মা আবারও কথা বললেন,
” খালুক লাগবে ক্যান? হামারে দুলাভাই আছে না? উনাক নিবা কন। ”

আসমা রহমান অগ্নি চোখে তাকালেন। কিছু বলতে পারলেন না। মন বাবার পাঞ্জাবি টেনে বলল,
” ও বাবা, খালামনিকে কোলে নেও। ব্যথা পাচ্ছে তো! ”

আসমা রহমান নাতির দিকে তাকালেন, মাহদীও। তারপর শাশুড়ি ও মেয়ে জামাইয়ের চোখাচোখি হলো। মাহদী ম্লান হাসল। চোখ সরিয়ে নিয়ে বলল,
” কোলে নিতে হবে কেন? একপা মচকেছে তো কী হয়েছে? অন্য পা আছে না? ওটা দিয়ে যেতে পারবে। ”

নিহিতার ডানহাতটা নিজের কাঁধে রেখে বলল,
” ছোটবেলায় কুতকুত খেলনি? ”

নিহিতা উত্তর দেওয়ার পূর্বে বলল,
” না খেলে থাকলে আজ খেলবে। এসো আমি সাহায্য করছি। ”
নিহিতা কুতকুত খেলার চেষ্টা করল না। মাহদীর উপর সম্পূর্ণ ভর ছেড়ে এক পায়ে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে বাড়ির ভেতর ঢুকল। আসমা রহমান ও রিন্টুর মায়ের সহযোগিতায় খাটে শুয়ে পড়ল। মাহদী রুম থেকে বের হতে গিয়ে হঠাৎ থেমে যায়। পড়ার টেবিলের সামনে একটি ফটোফ্রেমের দিকে স্থির দৃষ্টি রেখে সামনে এগিয়ে যায়। একটা বাচ্চাকে আরেকটা বাচ্চা চুল বেঁধে দিচ্ছে। চিরুনি হাতে মেয়েটির দিকে তাকিয়ে বলল,
” এটা নায়রা? ”

আসমা রহমান মেয়ের থেকে চোখ সরিয়ে ঘাড় বাঁকিয়ে তাকালেন মাহদীর দিকে। ফ্রেমের দিকে তাকিয়ে বললেন,
” হ্যাঁ। ”
” আপনাদের বাসায় ছবির ফ্রেম? অবাক লাগছে খুব! ”
” কেন? ”
” নায়রা আমাকে কখনও ছবি তুলতে দিত না। বাবা নাকি পছন্দ করেন না! ”
” হ্যাঁ। উনি এসব পছন্দ করেন না। ছবি তোলা ভালো নয়। খুব প্রয়োজন হলে তবেই তুলেন। ”
” তাহলে এটি? ”

আসমা রহমান মাহদীর দিকে ঘুরে বসল। বললেন,
” এটা ওর মামা তুলেছিল। বিদেশি মোবাইলের প্রথম ছবি। নিহিতার বাবা জানতেন না। পরে বাঁধিয়ে নিহিতাকে উপহার দিল তখন আর সরাতে পারেননি। কেউ ধরলেই কাঁদত খুব! ”

মাহদী ছোট্ট নায়রার মুখটায় হাতের তালুর নরম স্পর্শ রাখল। চোখ বন্ধ করতে দেখতে পেল নায়রা নিহিতার চুল আঁচড়ে দিচ্ছে পরম মমতায়। বেশ কিছুক্ষণ পর ছবিটা আগের জায়গায় রেখে দিল। মাহদী নিহিতার রুম ছেড়ে বেরিয়ে গিয়েও আবার ফিরে আসল। কাঁচুমাচু ভঙ্গিতে বলল,
” মা, ঐ ছবিটা আমাকে দেওয়া যায় না? ”

আসমা রহমান চমকে তাকালেন। পর মুহূর্তে মেঘে ঢেকে গেল মুখখানা। সেভাবে নিহিতার দিকে তাকালেন। নিহিতা শোয়া অবস্থায় ছবিটার দিকে তাকাল। পর মুহূর্তে মাহদীর দিকে। লম্বা নিশ্বাস টেনে বলল,
” দিয়ে দেও, আম্মু। ”
” তোর কষ্ট হবে না? ”
” না। উনি আমার থেকেও বেশি যত্নে রাখবেন। ”

আসমা রহমান ছবিটা মাহদীর হাতে দিতে সে বুকে চেপে ধরল। কৃতজ্ঞ হাসি দিয়ে চলে গেল। নিহিতা তার চলে যাওয়ার পানে চেয়ে স্বগোতক্তি করল, ‘ ওখানটাই তো আমিও আছি। তার বুকের ওমটা কি আমাকেও ছুঁয়ে দিল? ‘
ভাবতেই নিহিতা ভেতরে ভেতরে উষ্ণ অনুভূতি টের পেল।

” তোমরা এখন যাও, আম্মু। আমার নামাজ বাকি আছে। ”

আসমা রহমান রিন্টুর মাকে নিয়ে বেরিয়ে গেলে মনের দিকে তাকাল নিহিতা। বলল,
” ছোট আব্বু, তুমি একটু নানির কাছে যাও? আমার নামাজ শেষ হলে ডাকব। ”
” তোমার ব্যথা ভালো হয়ে গেছে, খালামনি? ”
” না। ”
” তাহলে নামাজ পড়বে কিভাবে? ”

নিহিতা মৃদু হাসল। বলল,
” বসে বসে। ”
” বসেও নামাজ পড়া যায়? ”

মনের কণ্ঠ থেকে বিস্ময় গলে পড়ল যেন! চোখেমুখে নিদারুন কৌতূহল।

” হ্যাঁ, যায়। কেউ দাঁড়াতে না পারলে সে বসে নামাজ পড়তে পারে। বসতে না পারলে শুয়েও পড়তে পারবে। আল্লাহ আমাদের সেই সুযোগ দিয়েছেন। ”
” সত্যি? ”
” হ্যাঁ। ”

এর মধ্যে রিন্টুর মা ওযু করার পানি দিয়ে গেল। নিহিতা আদুরে স্বরে বলল,
” ছোট আব্বু, এবার নানির কাছে যাও। ”
” কিন্তু আমার যে বসে বসে নামাজ পড়া দেখতে ইচ্ছে করছে, খালামনি। একটু থাকি? ”

মনের অনুরোধে নিহিতা হেসে ফেলল। বুকে জড়িয়ে বলল,
” আচ্ছা। থাক। কিন্তু আর কখনও এমন অনুরোধ করবে না। ঠিক আছে? ”

মন দারুন খুশিতে রাজি হয়ে গেল।

________________
বিকেলে চায়ের বদলে কফি দেখে অবাক হলো মাহদী। কফির কাপের নিচে একটা কাগজ চাপা দেওয়া। তার শুরুতে ইংলিশে লেখা ‘ Thank you ‘ তারপর নিচে বাংলায় লেখা, ‘ আপনি যে চা খান এটা মাকে বলেননি কেন? আপুটাও কী মন ভোলা! আপনাকে নিয়ে এত গল্প করেছে অথচ এই ছোট্ট অভ্যাসের কথা বলেনি। আপুর হয়ে আমি দুঃখিত। এখন থেকে আর চা খেতে হবে না। ‘

মাহদী কাগজটা মুচড়ে রুম থেকে বেরিয়ে এলো। মন বারান্দায় চেয়ার পেতে মোয়া খাচ্ছে। ছেলের উদ্দেশ্যে বলল,
” তুমি খালামনিকে বলেছ আমি কফি খাই? ”

মন খানিকটা ছিটকে উঠল। পরক্ষণে ভেবে বলল,
” হ্যাঁ। ”
” কেন? ”
” খালামনি জানতে চেয়েছে তাই। ”
” কী জানতে চেয়েছিল? ”
” সব তো মনে নেই, বাবা। ”

মাহদী শক্ত চাপে কাগজখানা চেপে ধরে বড় বাড়িটার দিকে তাকাল। চুপচাপ রুমে ফিরে এসে কফিতে চুমুক দিয়ে বলল,
” নানিকে বলে এসো, আমি তার হাতে চা-ই খাব। কফি যেন আর না বানায়। ”
” কফি তো নানি বানায়নি। ”
” তাহলে? ”
” খালামনি বানিয়েছে। ”

মাহদী কফিতে দ্বিতীয় চুমুক দিতে গিয়েও দিল না। ছেলের হাতে দিয়ে বলল,
” এটা তুমি খাও। শেষ হলে খালামনিকে বলে আসবে, আমি শুধু তোমার আম্মুর হাতের কফি খাই। ”

_____________
পরের দিন সকালে মনকে ঘুমে রেখে শ্বশুরের সাথে বাইরে হাঁটতে বেরিয়েছিল মাহদী। ফিরে আসতে ভ্রু কুঁচকে ফেলল। পুরো রুম ঝকঝকে, তকতকে। সব কিছু বেশ পরিপাটিভাবে গুছানো। সাজাতে গিয়ে এক জায়গার জিনিস অন্য জায়গায় সরানো হয়েছে। মেঝেটা ভিজে। বোধ হয় মাত্রই ধুয়েমুছে দিয়েছে কেউ। একটা অন্য রকম ঘ্রাণও পাচ্ছে। একটু খোঁজ করতেই উৎস মিলল। বিছানার কাছের ছোট টেবিলটার উপর স্তুপকারে বেলি ফুল রাখা। তা দিয়ে খেলছে মন। পাপড়ি দিয়ে বিছানা মাখামাখি! মাহদী জানতে চাইল,
” ফুল কোথায় পেলি? ”

মাহদী টেবিলটি দেখিয়ে বলল,
” এখানে। ”

মাহদী বুঝল মন জানে না। তার ঘুমন্ত অবস্থায় কেউ রেখে গেছে হয়তো। মাহদী আর মাথা ঘামাল না। ঘামে ভেজা শার্ট পালটাতে গিয়ে দেখে তার জামাকাপড় নেই কোথাও। মনকে জিজ্ঞেস করতেই বলল,
” খালামনি নিয়ে গেছে। ”
” কেন? ”
” ধুয়ে দিবে তাই। তুমি নাকি ধোও না। গন্ধ করছিল! ”

মাহদী আশ্চর্যান্বিত কণ্ঠে উচ্চারণ করল,
” আমি কাপড় ধুই না! আমার কাপড়ে গন্ধ! ”

চলবে।