নিয়তি পর্ব-১১

0
334

#নিয়তি
লেখনীতে -বর্ষা ইসলাম

১১.

মাস গড়ালো। ছোট্ট সাফওয়ান হাত পা নেড়ে খেলতে শিখে গেছে। শরীরে খিলখিলে স্বভাব। মেহরুবা রং পাল্টিয়েছে।শেহরীনের মুখে মিষ্টি স্বভাব দৃষ্টিগোচর করলেও আড়ালে আবডালে মনে বিষ পুষে রেখেছে।

-বোকা সোকা শেহরীন মেহরুবার বাইরের রুপটা কে আকড়ে ধরেই সংসারের ঘানি টেনে যাচ্ছে। মেহরুবা বুবু তাকে খুব ভালোবাসে কি না!

ঘড়িতে বিকেল ৪ টে বাজে।দুপুরের উত্তপ্ত সূর্য তার তেজ্বসীয়তা হারিয়েছে।নিরুত্তাপ সূর্যের পরন্ত বিকেল।প্রকৃতিতে শ্রাবনের ঠান্ডা ফুরফুরে বাতাস।ভাত ঘুম শেষে এলো মেলো শরীর আর শাড়ির ভাজ নিয়ে বারান্দায় এগিয়ে যায় শেহরীন।দু হাত আকড়ে ধরে শক্তপোক্ত বারান্দার গ্রীল। দৃষ্টি মেলে দিলো মেঘহীন নীলচে সাদা খোলা আকাশে।

প্রকৃতির বেপোরোয়া বাতাস হুরহুর করে মাতিয়ে তুললো শেহরীনের উষ্ণ শরীর।না চাইতেও শরীর ছাপিয়ে উকি দিয়ে গেলো অবাধ্য এক তরল চাওয়া।মন চাচ্ছে অবাধ্য পুরুষের মায়াবতী হতে।মনের ইচ্ছেতে সায় দিতে না দিতেই আকাশ সম বিষন্নতায় ভরে গেলো মন।কেঁদে উঠলো বুক।

-‘বিয়ের ছয় মাস পেরিয়ে ৭ মাসে গড়ালো।আবেশের সানিধ্য সে আজও পেলো না।প্রিয় মানুষটার স্পর্শ থেকে আজও দুরেই রয়ে গেলো।মুহুর্তেই বুক টা কেমন চিনচিনে ব্যথায় ভরে উঠলো।গাল বেয়ে গড়িয়ে পড়লো কষ্টের নোনা জল।অসস্তি তে ফেটে পড়া বুকটা নিয়ে আনমনেই বলে উঠলো,এ যন্ত্রণার শেষ কোথায়?এমন জীবন কি কখনো কাম্য ছিলো তার?

-‘টকটকে লালরঙের বিছানার চাদর।বিছানার মাঝখানে হাত পা ছড়িয়ে ছিটিয়ে নিজ স্বভাবে খেলে যাচ্ছে ফুটফুটে ছোট্ট সাফওয়ান।পাশেই আবেশ মেহরুবা।স্বস্তির চোখে দেখে যাচ্ছে একমাত্র সন্তানের হাস্যজ্বল মুখ।আছরের নামাজ শেষ করে ড্রয়িংরুমের দিকে পা বাড়ায় শেহরীন।আজকাল তার খুব বাজে অভ্যাস হয়ে গেছে।

সাফওয়ান কে এক মুহুর্ত না দেখতে পেলে বুকটা ফাকা ফাকা লাগে।কিন্তু মেহরুবা চায় না সাফওয়ান শেহরীনের কাছে থাকুক।শেহরীন যেনো মেহরুবার এমন মনোভাব বুঝেও বুঝে না।সাফওয়ান কে এক নজর দেখার লোভে উঁকি দেয় আবেশের রুমে।মেহরুবার আধশোয়া শরীরটার উপর গা এলিয়ে শুয়ে আছে আবেশ।চোখে মুখে হাসির ছটা।শেহরীন যেনো সইতে গিয়েও সইতে পারলো না।তার নিয়তি তো সে মেনেই নিয়েছে।তবে কষ্ট কেনো হচ্ছে!

-‘এক নজর সাফওয়ান কে দেখে দরজার পাশ থেকে সরে যাওয়ার আগেই মেহরুবার নজরে আসে শেহরীন।মেহরুবার মুখের বাধ ছুটে গেলো।চোখে মুখে বিদ্রুপ টেনে বলে উঠলো,

-‘আজ কাল যে তোমার ঘরে ঘরে উঁকি ঝুঁকি দেওয়ার স্বভাব হয়েছে জানতাম না তো শেহরীন!

মেহরুবার কথায় আবেশ বিছানায় উঠে বসে।এক নজর তাকায় শেহরীনের অসহায় মুখটির দিকে।চোখে টলটলে পানি।আবেশের মায়া হয়।শেহরীন বাকরুদ্ধ হয়ে গেছে।কথা বলার শক্তি নেই।মেহরুবা তাকে এমন ভাবে বলতে পারলো!বুক ভাঙা কষ্ট নিয়ে দরজা থেকে সরে যেতেই বাধ সাধে আবেশ।সাফওয়ান কে তুলে দেয় শেহরীনের কোলে।শেহরীন আর নিজেকে সামলাতে পারেনা।

সাফওয়ান কে বুকে নিয়েই হাউমাউ করে কাঁদতে থাকে।আবেশের কি হলো কে জানে।শেহরীন সাফওয়ান দুজনকেই জড়িয়ে নেয় নিজের বুকে।বিছানায় বসে সব টা দেখছে মেহরুবা।শরীরে তার দাউ দাউ করে আগুন জ্বলছে।এখনি সব ভস্ম করে দিবে।ফুসে উঠার আগেই শ্বাশুড়ি আয়না বেগম কে চোখে পড়ে তার।শেহরীনের কান্নার আওয়াজেই রুম থেকে বেরিয়ে আসেন তিনি।এক ঝটকায় আবেশের থেকে সরিয়ে নেন শেহরীন কে।আবেশ হতভম্ব হয়ে যায়।

সাফওয়ান কে তুলে দেয় আবেশের কোলে।কোনো কথা না বলে এক মুহুর্ত দেরি না করে শেহরীন কে টেনে নিয়ে গিয়ে বসান ড্রয়িংরুমে।

আবেশের বুকে কোথায় যেনো বিবেকের টান লাগে।সুবোধ জাগ্রত হয়।সাফওয়ান কে কোলে নিয়ে গিয়ে দাড়ায় মেহরুবার সামনে।মেহরুবা কিছু বলার আগেই আবেশ তিক্ত কন্ঠে বিরস মুখে বলে উঠে,

-‘মেহরুবা তুমি হয়তো ভুলে যাচ্ছো শেহরীন চেয়েছে বলেই তুমি আজ এখানে।শেহরীন চেয়েছে বলেই সাফওয়ান তোমার কোল জুড়ে এখনো আছে।হস্পিটাল থেকে ফেরার পর কি হয়েছিলো মনে নেই তোমার!এতো সহজে ভুলে গেলে কি করে!এতো অকৃতজ্ঞ হওয়া মানুষের ধর্ম নয়।দিন রাত হাড় ভাঙা খাটুনি খেটে তোমার পথ সহজ করে দিছে।আর তুমি!!

শেহরীন সাফওয়ান কে দেখতেই এখানে এসেছিলো।তোমার রংঢং দেখতে নয়।এমন তীড় ছোড়া কথা বলার কোনো প্রয়োজন ছিলোনা।অবশ্য তোমার মতো মেয়ের কাছে এসব কিছুই না।তোমরা সবই পারো-‘

একটানে কথা গুলো বলে শেষ করে আবেশ।রাগে তার শরীর কাঁপছে। আবেশের বলা শেষ কথা টা মেহরুবার বুকে বিধে গেলো।বিয়ের এতো বছর পর আবেশ এভাবে তাকে বলে ফেললো!তাও আবার শেহরীনের জন্য!এমনটা সে কিছুতেই মেনে নিতে পারছেনা।রাগে ফুসতে ফুসতে অস্ফুট স্বরে বলেই ফেললো,

এর খেসারত তোকে দিতেই হবে শেহরীন!!

ড্রয়িংরুমে শ্বাশুড়ির সামনে বসে বাধ ভাঙা কান্না কেঁদে যাচ্ছে শেহরীন। কোনো মতেই তাকে সামলাতে পারছেন না শ্বাশুড়ি আয়না বেগম। জীবনের প্রতিটা কষ্টের মুহুর্ত যেনো একে একে স্পষ্ট হয়ে চোখের সামনে ধরা দিচ্ছে শেহরীনের। যন্ত্রণা গুলো কেই কল্পনায় আয়ত্ত করে নিয়ে নোনা জলের স্রোত ধরেছে।কান্নায় কান্নায় ফুলে উঠেছে চোখ মুখ। অশান্তি তে বুক ভেঙে আসছে।এক আকাশ ক্ষোভ নিয়ে গলা ছেড়ে চিৎকার করে বলে উঠলো, উপরওয়ালা এ কেমন জীবন দিলো আমাকে?স্বামী সুখ যদি নাই পাবো তবে বিয়ে নামক পবিত্র কলঙ্ক কেনো ল্যাপ্টে দিলো আমার শরীরে? কেনো মা কেনো?

লাগাতার চিৎকার করে মুহুর্তেই নিস্তেজ হয়ে পড়ে শেহরীন।শরীরের ভার টুকু ছেড়ে দিয়ে ঢলে পড়ে শ্বাশুড়ির কোলে।চোখ মুখ ফ্যাকাসে হয়ে উঠলো নিমিষেই।আয়না বেগম বুঝতে পারেন শেহরীন অচেতন হয়ে পড়েছে।বোধশক্তি ঘুমিয়ে গেছে।কষ্টে কষ্টে জর্জরিত হয়ে গেছে হৃদয়।আর এক মুহুর্ত দেরি না করে সাফিনা ফুপুর উদ্দেশ্যে কন্ঠ ছাড়েন আয়না বেগম।সাফিনা ফুপু হতভম্ব হয়ে রান্নাঘর থেকে দৌড়ে আসেন।শেহরীনের মাথা টা কোলে নিয়ে সোফাতেই লম্বালম্বি ভাবে শুইয়ে দেন।চোখে মুখে সমবেদনার করুন ছাপ।আয়না বেগম উত্তেজিত হয়ে শেহরীনের মুখে পানির ছটা দিতে থাকেন পরপর কয়েক বার।কিন্তু শেহরীনের জ্ঞান ফিরেনা।

উপায়ন্তর না পেয়ে ডাক্তার কে কল করে আইরিন।শরীরে তাপমাত্রা তীব্র থেকে তীব্রতর হতে থাকে।হুট করে দুতলা থেকে ছুটে আসে আবেশ।পাঁজা কোলে তুলে নেয় শেহরীন কে।এক মুহুর্ত দেরি না করে পা বাড়ায় শেহরীনের রুমের দিকে।আবেশের পেছন পেছন ছুটে যায় শ্বাশুড়ি আয়না বেগম,ফুপু সাফিনা,আর ননদ আইরিন।আড়াল থেকে সব টা দেখে মেহরুবা।

-‘মনের এক পাশ স্বামী ভাগের তীব্র যন্ত্রণা হিংসা,রাগে ডুবে থাকলেও অন্য পাশ দিয়ে নিরলসভাবে ভাবতে থাকে তার জন্যই কি শেহরীনের এমন পরিনতি?নাকি শেহরীনের কারনেই সে সবার কাছে অপ্রিয়?

নারী তো মমতাময়ী মা আর স্নেহময়ী বোনের দাবিদার।তবে মেহরুবার কি করা উচিত? শেহরীন কে মেনে নেওয়া নাকি নিজেই ত্যাগী হওয়া?সাত পাঁচ ভাবতে ভাবতেই মেহরুবার চোখে ভেসে উঠে শেহরীনের নিঃস্বার্থ দায়িত্বের প্রতিচ্ছবি গুলো!

-‘সেদিন মাঝরাত!ছোট্ট সাফওয়ানের বয়স তখন মাত্র ১০ দিন।আবেশ ঘরে নেই।হুট করেই মেহরুবার ঘুম ভেঙে যায়।সাফওয়ান তখন বিভোর ঘুমে আচ্ছন্ন।অথচ পাশে আবেশ নেই।মেহরুবা এক প্রকার জোর করে ধরেই নিয়েছে আবেশ শেহরীনের ঘরে।কিন্তু এতো রাতে শেহরীনের ঘরে যাওয়াটা যেনো মেনে নিতে পারছেনা মেহরুবা।এক সেকেন্ড সময় নেয় না সে।লম্বা লম্বা পা ফেলে দ্রুত ছুটে যায় শেহরীনের ঘরে।শেহরীনের রুমে আলো জ্বলছে।দরজা টা আস্তে করে ভিড়ানো।রাগ সামলাতে না পেরে ভেতরে কি চলছে তা দেখার জন্যই ঝট করে দরজা টা খুলে ফেলে মেহরুবা।শেহরীন তখন মাত্রই তাহাজ্জুদ শেষ করে জায়নামাজ টা হাতে নিয়ে উঠে দাড়িয়েছে। এমন সময় মেহরুবার এমন আচরণে হতবাক হয় শেহরীন।তবুও মেহরুবা কে কিছু বুঝতে না দিয়ে মুখে হাসি টেনে আস্তে করে জিজ্ঞেস করে,

-‘কিছু বলবে মেহুরুবা বু?
-‘মেহরুবা কোনো ভনিতা না করে স্পষ্ট ভাবেই বলে ফেললো,
-‘আবেশ কোথায় জানো?
-‘শেহরীন ভ্রু কুচকে নির্লিপ্ত ভাবে উত্তর দেয়,
-‘না তো!

মেহরুবা আর কোনো কথা না বলে শেহরীনের রুম থেকে চলে আসতেই পৃথিবীর আকাশ ভেঙে তার মাথায় পড়লো।মুখ থেকে কথা বেরুচ্ছে না।তার ঘরে দাউ দাউ করে আগুন জ্বলছে।অথচ তার বুকের মানিক ঘুমন্ত সাফওয়ান কে সে ঘরে রেখে এসেছে।বোধশক্তিহীন ভাবে মেঝেতে বসে পড়ে সাফওয়ান সাফওয়ান বলে অনর্গল চিৎকার করতে থাকে।শেহরীন দৌড়ে আসে।চিৎকার শুনে আবেশ সহ বাড়ির সবাই ছুটে আসে।

-‘মাঝরাতে ঘরে কিভাবে আগুন লাগলো কারো বুঝে আসে না।আবেশ সাফওয়ানের ঘরের দিকে ছুটে যেতে চাইলে বাধ সাধেন আয়না বেগম।নিজের ছেলে কে কোনো মতেই এমন ভয়াবহ দাবানলের দিকে যেতে দিতে রাজি নন তিনি।অথচ আবেশ তার মাকে এটা বুঝাতে পারছে না যে ঐ ঘরে তার ও ছেলে রয়েছে।পুড়ে মরে যাবে!এ কষ্ট সে কিভাবে সইবে।

-‘মেহরুবার বুক ভাঙা আর্তনাদ আর আবেশের বুকের ছটফটানি কে তুচ্ছ করে গায়ে আষ্টেপৃষ্টে চাদর জড়িয়ে সাফওয়ান কে কোলে নিয়ে দৌড়ে বের ঘর থেকে হয়ে আসে শেহরীন।সাফওয়ান তখন ধামাল তুলে কান্নায় ব্যস্ত।শেহরীন হাপাচ্ছে।সাফওয়ান কে মেহরুবার কোলে দিয়ে মেঝেতে বসে দম নিতে থাকে সে।সবার নজর তখন শেহরীনের দিকে।আকাশ সম বিষ্ময় নিয়ে তাকিয়ে আছে।

আয়না বেগম শেহরীনের পাশে এসে বসেন।দু কাঁধে হাত দিয়ে ঝাঁকাতে থাকে শেহরীন কে।এতো বড় রিস্ক কেনো নিতে গেলি শেহরীন।মরে টরে যাওয়ার ইচ্ছে হয়েছে তোর?

শেহরীন কথা না বাড়িয়ে হাঁপাতে হাঁপাতেই বলে,

-‘পুরো রুমে এখনো আগুন ছড়ায়নি ।যতদুর মনে হচ্ছে এসি বিস্ফোরণ হয়েছে।আমাকে নিয়ে না ভেবে আগুন নেভানোর ব্যবস্থা করেন।নয়তো পুরো বাড়ি ছারখার হয়ে যাবে মা!

আমার বাড়িতো এমনিতেই ছাড়খার হয়ে যাচ্ছে।সংসার পুড়ে খাক হয়ে যাচ্ছে।শুধু মাত্র এই মেয়ের জন্যই!

মেহরুবার দিকে তাকিয়ে কথাটা বলেন আয়না বেগম।মেহরুবা সেদিকে কান না দিয়ে সাফওয়ান কে আদর করতেই ব্যস্ত হয়ে আছে।

ফায়ার সার্ভিসের লোক আসলো।আগুন নিভলো।ছোট্ট সাফওয়ান নতুন জীবন পেলো।থেকে গেলো মেহরুবার বুক জুড়ে!কোল জুড়ে!

ঘটনা টা মনে করতেই মেহরুবার চোখের কোনে জল জমা হলো।ছুটে গেলো বিছানায় থাকা সাফওয়ানের কাছে।ঘুমন্ত সাফওয়ানকেই সে বুকে তুলে নেয়।না চাইতেও হাউমাউ করে কেঁদে।বুক ভাঙা কান্না নিয়েই বলতে থাকে,

-‘সেদিন তোকে হারালে আমি কিভাবে বেঁচে থাকতাম রে বাবুই!আমি যে নিঃস্ব হয়ে যেতাম!আমাকে পূর্ন করতেই যখন এ দুনিয়াতে এলি তবে এমন পোড়া কপাল নিয়ে কেনো এলি বাবুই!যেখানে তোর দাদু তোর মুখ পর্যন্ত দেখতে চায় না!

সুখ নিয়ে কেনো এলিনা! এতো দুঃখের বোঝা নিয়ে কেনো আসতে গেলি! কেনো? কেনো?

চলবে!