নিয়তি পর্ব-১২

0
319

#নিয়তি
লেখনীতে-বর্ষা ইসলাম

১২.

কেটে গেলো কয়েক মাস।ছোট্ট সাফওয়ান এখন হামাগুড়ি দিতে শিখে গেছে।ড্রয়িংরুমের মেঝেতে বসে আয়না বেগম খেলা করছেন সাফওয়ান কে নিয়ে।মাঝে মাঝে কোলে তুলে নিয়ে দু গাল ভরে চুমু খাচ্ছেন।

গ্রীষ্মের কঠোরতা কাটিয়ে প্রকৃতিতে তিক্ত শীতের আানাগোনা।বেশীক্ষন ফ্লোরে নেমে থাকলে ঠান্ডা লেগে যাওয়ার আশংকায় সাফওয়ান কে কোলে নিয়ে উঠে দাঁড়ালেন আয়না বেগম।শরীর টা তার আগের মতো সুস্থ সবল নেই।ইদানীং খুব দুর্বল মনে হয় নিজেকে।তবুও সাফওয়ান কে নিয়ে সিড়ি বেয়ে উপরে উঠে গেলেন তিনি।এক সময়ের পরিত্যাজ্য সাফওয়ান আজ তার চোখের মনি।রান্না ঘর থেকে লুকিয়ে সব টা লক্ষ্য করে মেহরুবা।গায়ে চাদর জড়িয়ে সন্ধ্যার নাস্তা তৈরি করছে সে।বাড়িটা আজকাল ভীষন ফাঁকা লাগে।শ্বশুর,শ্বাশুড়ি,ননদ,সবাই মেনে নিয়েছে তাকে।মেনে নিয়েছে তার বুকের মানিক সাফওয়ান কে।তবুও যেনো তার স্বস্তি নেই।মনের কোথাও যেনো অশান্তির টান লেগেই থাকে।সব থেকেও মনে হয়ে সে শূন্য, নিঃস্ব! একা!ভীষন একা!

-‘অথচ আবেশ আগের মতোই তাকে ভালোবাসে।কেয়ার করে। তবুও কোনো কারনে মেহরুবার মনে হচ্ছে আবেশ আর আগের মতো নেই।সেই চঞ্চলতা তার মাঝে নেই।অনুভূতি শুকনো হয়ে গেছে।নিস্তব্ধ, নিরব হয়ে গেছে।

-‘চুলায় বসিয়ে দেওয়া সসপেনে ফুটন্ত পানির টগবগানো ভাব জানিয়ে দিচ্ছে চা পাতা ছেড়ে দেওয়ার সময় হয়ে গেছে।চা পাতা,সাথে এলাচ,দারুচিনি সাথে কয়েক টুকরো তেজ পাতা সসপেনে ছেড়ে দেয় মেহরুবা।সাথে সাথেই উষ্ণ মিষ্টি গন্ধ চারিদিক ছড়িয়ে পড়ে।মাগরিবের আযান পড়লো।নামায পড়ে ড্রয়িংরুমে বসলেন শ্বাশুড়ি আয়না বেগম ও শ্বশুর ইসহাক সাহেব।

চায়ের কাপ দুটো তাদের দিকে এগিয়ে দিয়ে একটু দুরে সরে বসে মেহরুবা।ইসহাক সাহেব চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে ব্যস্ত হয়ে পড়েন খবরের কাগজে।আয়না বেগম কি যেনো ভেবে মেহরুবার দিকে তাকায় এক নজর।চোখ মুখ ভীষণ শুকনো দেখাচ্ছে।চায়ের কাপে শেষ চুমুকটা দিতে দিতে মেহরুবার উদ্দেশ্যে বলে উঠেন,

-‘তোমার কি শরীর খারাপ মেহরুবা?চোখ মুখ এমন দেখাচ্ছে কেনো?

-‘,মেহরুবার কেনে জানি কান্না পাচ্ছে।ভীষণ কান্না।চিৎকার করে বলতে ইচ্ছে করছে,

-‘সব কিছু কেমন জানি লাগছে মা!অগুছালো লাগছে!জীবনটা ভীষন ছন্নছড়া হয়ে উঠেছে।সব থেকেও কি যেনো নেই আমার! কি যেনো নেই!

কিন্তু এমন বেদনাদায়ক কথা গুলো মেহরুবার মনেই চাপা পড়ে রইলো।তাকে নিশ্চুপ দেখে আয়না বেগম আবারো জিজ্ঞেস করলেন

আবেশ ফিরেছে?

মেহরুবা আস্তে করে মাথা নেড়ে জবাব দিলো।যার অর্থ না।

আয়না বেগম খুব রয়েসয়ে ছোট্ট একটা নিঃশ্বাস ছাড়লেন।মেহরুবা কে বললেন,

-‘সাফওয়ান রুমে একা আছে।যাও তার কাছে যাও।তার খেয়াল রাখো।আর আবেশ ফিরলে আমার ঘরে যেতে বইলো একবার।

মেহরুবা আবারো মাথা নেড়ে সায় দিলো।এঁটো কাপ গুলো রান্না ঘরে রেখে পা বাড়ালো নিজের রুমের দিকে।মেহরুবার যাওয়ার পথে আয়না বেগম নিঃস্পলক ভাবে চেয়ে রইলেন কিছুক্ষণ। নিজের মনে ভাবতে লাগলেন,

-‘শেহরীন থাকলে কি আর সংসার টা এমন মরা মরা মনে হতো।এমন বিষন্ন লাগতো!এ কেমন জোরপূর্বক দায়িত্বের দায়ভার দিয়ে গেলি শেহরীন!
শেহরীনের শেষ কথা টা রাখতেই মেনে নিয়েছেন সাফওয়ান,মেহরুবা কে।কিন্তু জোর করে কি আসলেই কিছু হয়!কারো প্রতি মায়া বাড়ানো যায়!শেহরীনের শূন্য স্থান টা কি কখনোই মেহরুবা কে দেওয়া সম্ভব!

কথা গুলো ভাবতেই চোখ থেকে জল গড়িয়ে পড়ে আয়না বেগমের।ভারাক্রান্ত মন নিয়েই আনমনে বলে উঠেন,

-‘তুই ভালো আছিস তো শেহের!এখনো রাগ আছে আমাদের উপর তাই না!

-‘নিশুতি অন্ধকার রাত।ডিম লাইটের আবছা সবুজ আলো পুরো রুমে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে।চারদিক ভীষন নিস্তব্ধ!থমথমে।ঘড়িতে রাত দুটো বাজে।মেহরুবা সাফওয়ান গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন।আবেশের চোখে ঘুম নেই।অজানা এক যন্ত্রণায় ছটফট করে মরছে বুকের এপাশ ওপাশ।অসহ্য এ যন্ত্রণার ভার আর কতদিন বয়ে যেতে হবে জানা নেই তার।নাহ!আর পারা যাচ্ছে না!বিছানা থেকে উঠে বসে আবেশ।শেহরীন কে খুব করে মনে পড়ছে আজ।আর এক দন্ড সময় নেয় না সে।ঘুমন্ত সাফওয়ানের কপালে চুমু একে দিয়ে মেহরুবার অগোচরে পা বাড়ায় শেহরীনের রুমের দিকে।

-‘কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই আবেশ গিয়ে থামে শেহরীনের রুমের সামনে।দরজাটা আগের মতোই আস্তে করে ভিড়ানো।পুরো রুমে ঘুটঘুটে অন্ধকার।হাহাকারে হৃদয় খা খা করছে যেনো।আবেশের বুকে ব্যথা হচ্ছে।চিনচিনে অসহ্য ব্যথা।দরজাটা ঠেলে ভেতরে ঢুকে আবেশ।অন্ধকার তার ভালো লাগেনা।দম আটকে আসে।অসহায় মনে হয়।রুমে আলো জ্বালিয়ে দিয়ে অস্ফুট স্বরে বলে উঠলো,

-‘শেহরীন ও তো অন্ধকার ভয় পেতো।খুব ভয় পেতো।তবে এখন দিনের পর দিন কিভাবে ঐ অন্ধকার কুঠরীতে ঘুমিয়ে আছো শেহরীন!মনে পড়েনা আর আমাকে!আর ভালোবাসো না বোধহয় তাই না শেহের!

কথা গুলো বলতেই বুক ভেঙে কান্না আসে আবেশের।কান্নায় ভিজে উঠে চোখের পাতা।আজ ৪ মাস গড়ালো শেহরীন এ পৃথিবীতে নেই।সেদিন কান্নার প্রবল বেগে হঠাৎ অচেতন হয়ে পড়ার বেশ কয়েক ঘন্টা চলে গেলেও শেহরীনের জ্ঞান না ফিরলে ডাক্তার আসে দেখে যান শেহরীন কে।সাথে জানিয়ে যান শেহরীন প্রচন্ড মানসিক চাপে ব্রেইন স্টোক করেছে।আপাতত রেস্টে থাকুক।মেডিসিন দেওয়া হয়েছে জ্ঞান ফিরলে হসপিটালে এডমিট করাতে হবে ইমিডিয়েটলি।ডাক্তার চলে যাওয়ার কিছুক্ষন পরই জ্ঞান ফিরে শেহরীনের।জোরকরেও তাকে হসপিটালে নিতে পারেনি কেউ।দিন টা ভালোই ভালোই কেটে গেলে রাত টাই হয়ে গেলো তার যন্ত্রণার অবসানের রাত।পরের দিনের সেনালী সূর্য টা তার আর দেখা হয়নি। কষ্টের দিন কে বিদায় দিয়ে শান্তির ঘুম ঘুমাচ্ছে সে।তার আর বুকে ব্যথা নেই।আবেশ কে না পাওয়ার যন্ত্রনা নেই।একদমই নেই!

চোখের জল মুছে আবেশ পুরো রুমটা ভালো করে দেখে নেয় একবার।পুরো বাড়ি জুরেই শেহরীনের হাতের ছোঁয়া লেগে আছে।তার রুমের আনাচে কানাচে জড়িয়ে আছে রাতের পর রাত আবেশ কে কাছে না পাওয়ার নিদারুন আক্ষেপ।রুমের প্রতিটা আসবাব পত্র যেনো সাক্ষী হয়ে আছে শেহরীনের কঠিন কষ্টের দিন গুলোর।এই চার মাসে শেহরীনের রুমটাতে দু বার এসেছে আবেশ।সে আসতে চায় না এ রুমে।কষ্ট হয়!যন্ত্রণা হয়!দম বন্ধ হয়ে আসে! মনে হয় শেহরীনের অতৃপ্ত আত্মা নিষ্ঠুর ভাবে ধিক্কার জানায় তাকে।তবুও সাহস করে সে এ ঘরে আজ এসেছে।শেহরীনের শেষ চিঠিটা আজ তাকে নেশার মতো কাছে টেনে এনেছে।

বুক ভরা কষ্ট নিয়ে থমথমে পায়ে আবেশ এগিয়ে যায় বিছানার দিকে।যেখানে শেহরীন আধশোয়া হয়ে বসে থাকতো সব সময়।যেখানে বসেই অসুস্থ শেহরীনের কপালে শেষ চুমু টা একে দিয়েছিলো আবেশ।সেই বিছানা,বালিশ, সবই আছে।শুধু নেই দিনের পর দিন সহস্র অবহেলা সহ্য করে যাওয়া শেহরীন।শেহরীনের নিত্য দিনের বসার জায়গাটাই গিয়ে বসে আবেশ।ডান টা এগিয়ে দেয় অযত্নে পড়ে থাকা বালিশের নিচে।যেখানে চাপা পড়ে আছে মৃত শেহরীনের জীবন্ত অনুভূতিতে মুড়ানো শেষ চিঠি,শেষ আলিঙ্গন।চোখ ভর্তি জল,বুক ভরা অসহ্য ব্যথা নিয়ে কাঁপা কাপা হাতে আবারও পড়া শুরু করে সেই নির্মম, নিষ্ঠুর,কঠিন যন্ত্রণার শব্দগুচ্ছ!!

শোনেন,

-‘ঘড়িতে রাত দুটো বাজে।চারদিক কি নিষ্ঠুর নীরবতা!দেখেন না তবুও আমার চোখে ঘুম নেই।আপনি নিশ্চয়ই ঘুমাচ্ছেন।মেহরুবা বুবু কে বুকে নিয়ে ঘুমাচ্ছেন তাই না?অথচ আমার বুক টা কি ভীষন ফাঁকা।কি ভীষন টনটনে ব্যথা বুকটা জুড়ে।এই অসুস্থ শেহরীন টা কে কি একটুও মনে পড়ছে না আপনার!আপনি কি জানেন না আমার এ অসুস্থতার কারন?আপনি কি বুঝেন না আমার বুকটা কেনো এতো ফাঁকা হয়ে আছে?কেনো এতো ব্যথা জমে আছে?

-‘রাতের প্রথম প্রহরে আপনি যখন এসেছিলেন আমার ঘরে,আমি ধরেই নিয়েছিলাম আজ রাত টা বোধ হয় আপনি আমার পাশেই থাকবেন।আপনি থাকবেন বলেই মা, আইরিন, সাফিনা ফুপু কে আমার ঘরে আসতে নিষেধ করেছিলাম।আমি তাদের বলেছিলাম আজ উনি থাকবেন আমার পাশে।আমার নিঃসঙ্গতা কে সঙ্গ দিবে।তারাও আমার কথা বিশ্বাস করে নিলো।তাই তো আর কেউ খোঁজ রাখলো না।এসে দেখলোও না কেমন আছি আমি।

-‘আপনি আসলেন।বসলেন আমার পাশে।না চাইতেও কপালে শেষ চুমুটা একে দিয়ে বললেন অনেক রাত হয়েছে শেহের ঘুমিয়ে পড়ো।আমার অফিসে আছে সকালে।আমি যাই।নিজের খেয়াল রেখো।আপনি চলে গেলেন।আমি একা হয়ে গেলাম।খুব একা।অথচ কত কথা আপনাকে বলবো বলে ভেবে রেখেছিলাম।আপনি যখন চলে যাচ্ছিলেন তখন আমার ইচ্ছে হচ্ছিল আপনাকে থামিয়ে দেই।কাছে ডেকে এনে বলি একটু বসুন না আমার পাশে।আমি আপনার বুকে মাথা রেখে আজ ঘুমাতে চাই।আমার যে বড্ড ঘুম পাচ্ছে।কিন্তুু আপনি আমার মনের আর্তনাদ শুনলেন না।চলেই গেলেন।

-‘আমার বুক টা ফেটে যাচ্ছে।কলিজা পুড়ে যাচ্ছে।বুকে কি টনটনে ব্যথা!ইশশশ!আমি যে আপনার অশান্তিতেই মরে গেলাম।আপনিই তো আমার প্রিয় অসুখ।আমি তো রোগে নয় আপনার অসুখেই কাতর হয়ে আছি।শেষ নিঃশ্বাস টুকু চলে যাওয়ার আগেও মনটা খুব করে বলছে আপনাকে যদি একবার দেখতে পেতাম।শুধু একবার!কিন্তুু আমার কি নিষ্ঠুর নিয়তি।আমি এই অন্ধকার রুমে বুকের ব্যথায় ছটফট করছি আর ওদিকে আপনি অন্য কাউকে বুকে নিয়ে সুখের নিশি যাপন করছেন।দেখেন না বুকের ব্যথা টা কি ভয়ংকর ভাবে বেড়ে যাচ্ছে!আমার তৃষ্ণা বেড়ে যাচ্ছে!আপনাকে এক নজর দেখার তৃষ্ণা! দু হাতে একবার আপনাকে ছুঁয়ে দেখার তৃষ্ণা!কঠিন তৃষ্ণায় জর্জরিত হয়ে উঠছে হৃদয়!

ঘড়ির কাটা বড্ড তাড়া দিচ্ছে আমাকে।সময়ের দম ফুরিয়ে এসেছে।চোখের পাতায় ভর করেছে অনন্তকালের ঘুম।সেই ঘুমটা টা এখন খুব প্রয়োজন আমার।অনেক ঘুম দরকার।সকালের সোনালী সূর্য আর আপনার সেই সুন্দর মুখ টা আর দেখা হলোনা আমার।ঘুমের রাজ্যে তলিয়ে গেলাম আমি অথচ রেখে গেলাম আমার অফুরন্ত ভালোবাসা।আর এটাই যে আমার নিয়তি ছিলো! আপনি সুখে থাকেন প্রিয়!!আমি না হয় আপনার সুখেই নিজেকে আগলে রাখবো!সামলে রাখবো আমার নিষ্ঠুর অনুভূতি গুলোকে।বেঁচে থাকবো আপনার অবহেলায়।অনন্তকালের জন্য!

ইতি
আপনার অবহেলিত শেহের।

চলবে,,,