নিয়তি পর্ব-৯+১০

0
318

নিয়তি
লেখনীতে-বর্ষা ইসলাম

৯.

-এখানে কত দিন হলো এসেছো?

-আজ ৫ দিন।

-তোমার বাড়ি থেকে কেউ খোঁজ করেনি আর?

-নাহ!

আবেশের কথায় একটা দীর্ঘশ্বাস বেড়িয়ে এলো মেহরুবার শরীরে। দ্বিতীয় বারের মতো আরো একবার বড়সড় চাপা শ্বাস ফেলে বিরস মুখে বলে উঠলো,

-‘আমার কি কখনো বাড়ি ছিলো? বিয়ের আগে জানতাম একটা বাড়ি ছিলো।সেটা আমার বাবার বাড়ি। এখন আর সেটা ভাবতেও ইচ্ছে হয় না। ঘৃনা হয়। তারপর বিয়ের পর ভাবলাম এখন হয়তো একটা নিজের বাড়ি হলো। কিন্তুু সেটা তো আকাশ কুসুম কল্পনায় রয়ে গেলো। বিয়ের নামে পন্য হিসেবে অভিহিত করা হলো আমাকে। এখন আর কি! হয়তো অনন্তকাল এখানেই পড়ে থাকতে হবে!

-শেষ কথাটা খুব যন্ত্রনা নিয়ে প্রকাশ করলো মেহরুবা। চোখ দুটো আবারো পানিতে ছলছল করে উঠলো। মুখ জুরে ছড়িয়ে পড়লো আকাশ সম বিষন্নতা।

-‘আবেশ এক নজর তাকায় মেহরুবার দিকে।পরক্ষণেই আবার চোখ নামিয়ে নেয়।ছিপছিপে গড়নের ফর্সা অল্পবয়সী মেয়ে মেহরুবা।চোখ মুখ মায়ায় ভরা।কিশোরী কন্যার চঞ্চলতা সারা শরীর জুড়ে।হাত দুটো মুষ্টি বদ্ধ হয়ে কপাল ছুঁয় আবেশ।নিচের দিকে তাকিয়েই খুব রয়ে সয়ে প্রশ্ন করে,

-‘এই নিষিদ্ধ জীবন থেকে বের হতে চাও?

আবেশের কথা যেনো বুঝেও বুঝতে পারলোনা মেহরুবা।অবাস্তব মনে হলো।চোখে মুখে ছড়িয়ে গেলো একরাশ বিষ্ময়তা।কন্ঠ খাদে নামিয়ে আস্তে করে বলে উঠলো,

-‘কে চায় বলুন এমন জীবন?আমি চাইলেই কি এখান থেকে বের হতে পারবো?

-‘আমি নিয়ে যাবো তোমাকে।

মেহরুবা হতভম্ব হয়।বাকরুদ্ধ হয়।এমন একটা কথা শোনার জন্য সে মোটেও প্রস্তুুত ছিলো না।মেহরুবা কে যারপর নাই অবাক করে দিয়ে তার দু হাত নিজের হাতের মধ্যে নিয়ে নেয় আবেশ।

কন্ঠে শীতলতা বাজিয়ে বলে উঠে,

-‘প্রথম দেখায় প্রেম হয় কি না জানি না।একে ভালোবাসা বলে নাকি মোহ বলে সেটাও আমি জানি না।অচেতন ঘোরে আবছা চোখ মেলে যখন তোমার মুখ টা দেখেছি না চাইতেও নিজের অজান্তেই তুমি আমার মনে গেঁথে গেছো মেহরুবা।আমি চাই তোমাকে এখান থেকে নিয়ে যেতে।শুধু ভালোবেসে নয় আমার সহধর্মিণীর মর্যাদা দিয়ে।

-‘আবেশের কথা যেনো বর্জ্যপাত ফেললো মেহরুবার মনে।বুকটা টলমল করে উঠলো।চোখের কোনে নোনাজলের উপচে পড়া ভীড়।মেহরুবার জর্জরিত হৃদয় তখন একটা প্রতিধ্বনিই গেয়ে যাচ্ছে,’এটাও সম্ভব!!

রাত পোহালো।ভোর হলো।সেদিনের মতো আবেশ চলে গেলো।মহুয়া দেবীর সাথে কন্ট্রাক্ট করা হয় মেহরুবার ঘরে যেনো অন্য পুরুষ প্রবেশ না করে।বেশ মোটা অংকের টাকা দিয়েই তাকে আয়ত্বে আনে আবেশ।তিনদিন পর আবেশ আবারো উপস্থিত হয় মেহরুবার কাছে।মেহরুবা কে সাথে নিয়ে আসতে চাইলে বাধ সাধে মহুয়া দেবী।পুলিশের ভয় দেখিয়ে এক প্রকার জোর করেই মেহরুবা কে সেখান থেকে নিয়ে আসে।

-‘পরিবার থেকে লুকিয়ে শহর থেকে একটু দুরে ফ্লাট ভাড়া করে আবেশ।বন্ধুদের সহোযোগিতায় বিয়েটাও করে নেয়।পরিবার, স্ত্রী দুই দিকেই সমান তালে সামলে নেয় আবেশ।পরিবারের কাছে বিয়ের কথা টা পুরোপুরিই লুকিয়ে যায়।

-‘,এভাবেই চলতে থাকে বেশ কিছুদিন।হঠাৎ একদিন পুলিশ গিয়ে হাজির হয় আবেশের বাড়িতে।আবেশ তখন বাড়িতেই ছিলো।সকাল সকাল বাড়িতে পুলিশ দেখে হতভম্ব হয়ে যায় আবেশ সহ বাড়ির সকলে।আবেশের বাবা ইসহাক সাহেব কারন জানতে চাইলে পুলিশ অফিসার বলে উঠেন,

-‘আবেশের নামে নারী অপহরন মামলা করেছেন মহুয়া দেবী। নিষিদ্ধ পল্লীর মেহরুবা নামের এক মেয়েকে জোর পূর্বক উঠিয়ে এনে গুম করে রেখেছেন উনি।

-‘পুলিশ অফিসারের কথা শুনে যেনো মাথায় আকাশ ভেঙে পড়লো ইসহাক সাহেবের।রান্না ঘর থেকে আয়না বেগম গর্জে উঠে বলেন,

-‘অফিসার আপনি বোধ হয় ভুলে যাচ্ছেন এটা ভদ্রলোকের বাড়ি।ভুলভাল তথ্য নিয়ে কাউকে এভাবে বিভ্রান্ত করাটা বোধ হয় আইনের কাজ নয়!

-‘কথাটা হয়তো আপনি ঠিকই বলেছেন।তবে আপনাদের দুর্ভাগ্য যে আমরা কোনো ভুল তথ্য নিয়ে এ বাড়িতে আসিনি।

-‘পুলিশ অফিসারের কথায় মা কে ঠেলে এগিয়ে এলো আবেশ।খুব শান্ত ভাবেই বললো,

-‘প্রথমত আমি কাউ কে গুম করিনি,জোর পূর্বক উঠিয়ে আনিনি।মেহরুবা আমার স্ত্রী।যথেষ্ট প্রমান আছে আমার কাছে।

কথা গুলো শেষ করেই বিয়ের রেজিষ্ট্রি পেপার এগিয়ে দেয় আবেশ।পুলিশ অফিসার উল্টে পাল্টে চেক করে পেপার গুলো।কয়েক মুহুর্ত সময় নিয়ে চলে যায় সেখান থেকে।

-‘আবেশের কর্মকাণ্ডে হতবাক হয়ে যায় বাড়ির সবাই।লজ্জায় ঘৃনায় মাথা নুইয়ে পড়ে মাটিতে।আয়না বেগম তেড়ে আসেন আবেশের দিকে।পরপর কয়েকটা চড় বসিয়ে দেয় আবেশের গালে।হুংকার ছেড়ে বলে উঠেন,

-‘ছিহ!আবেশ।এ বাড়ির ছেলে হয়ে শেষ পর্যন্ত তুই নিষিদ্ধ পল্লীকে শ্বশুর বাড়ি বানিয়ে নিলি।বাহ!আবেশ বাহ!এই তুই আমার ছেলে। এই তোকে জন্ম দিয়েছি আমি!

এ কথা এখন পাড়ার অলিতে গলিতে প্রতিবেশীদের কানে পৌঁছে যাবে।জেনে যাবে।সমাজে মুখ দেখাবো কি করে?একটা বার আমাদের সম্মানের কথা ভাবলি না তুই!ইয়া মাবুদ!এমন দিনটাও দেখার ছিলো আমার!

কথা গুলো বলে বিলাপ করতে থাকেন আয়না বেগম।বাবা ইসহাক সাহেব হতবিহ্বল হয়ে সোফায় বসে আছেন।

সেদিকে আবেশের কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই।এতো কিছুর পরেও সে খুব শান্ত। নিরব।কয়েক সেকেন্ড সময় নিয়ে সে বলে উঠে,

-‘আম্মা সমাজের কথা বলছো!এ সমাজ ই কিন্তুু মেহরুবার মতো মেয়েদের ঐ অন্ধকার কুটরিতে ঠেলে দেয়।আমরা যদি দু বেলা না খেয়েও থাকি এ সমাজ আমাদের খাবার দিয়ে যাবে না।ভুলে খোঁজ ও নিতে আসবে না।আর তুমি কিনা সেই সমাজ নিয়ে পড়ে আছো!

কথা গুলোর মাঝেই আবেশ তার মায়ের কাছে চলে যায়।আয়না বেগম সোফায় হেলান দিয়ে বিরস মুখে বসে আছেন।আবেশ তার পায়ের কাছে গিয়ে বসে নির্লিপ্ত গলায় বলতে থাকে,

-‘বিশ্বাস করো আম্মা মেহরুবা খুব ভালো মেয়ে।সে আমাকে ভালো রেখেছে।সে বুঝে আমাকে।ওর মতো জীবনসঙ্গী আমার কাম্য ছিলো।তোমরা ঝামেলা না করে মেনে নাও প্লীজ!

আয়না বেগমের বুক বিতৃষ্ণায় ভরে উঠে। চোখে মুখে ভর করে আষাঢ়ের কালো মেঘ।দাঁতে দাঁত চেপে কঠোর গলায় বলে উঠেন,

-‘আমার মৃত্যু হতে পারে,আমি নিঃস্ব হয়ে যেতে পারি তবুও মনে রাখিস ঐ মেয়েকে কোনোদিন এ বাড়ির বউ হিসেবে মেনে নিবো না।কখনোই না!

আবেশ থামে।শেহরীন একটু নড়েচড়ে বসে।আবেশের প্রত্যেক টা কথায় খুব মনোযোগ দিয়ে শুনছিলো শেহরীন।শেহরীন খেয়াল করে আবেশের মুখে অনুশোচনার তীব্র ছাপ।কিন্তুু এ অনুশোচনা কিসের?তার জন্য নাকি মেহরুবার জন্য! এটা তার বোধগম্য হচ্ছে না।

-‘শেহরীন এর মনে অশান্তি। আরও অনেক কিছু তার জানার ইচ্ছে হচ্ছে।কিন্তুু মন সায় দিলেও শরীর কোনোভাবেই সায় দিচ্ছে না।অনিচ্ছা থাকা সত্বেও চুপ হয়ে রইলো শেহরীন। আবেশ ও আর কথা বাড়ালো না।

-‘ঘড়িতে ভোর ৪.৪০

ভোরের আলো ফোঁটার সময় এখনো হয় নি।আচমকায় ঘুম ভেঙে যায় মেহরুবার।ঘুমঘুম চোখে বিছানা হাতড়ে আবেশ কে পেলো না সে।বুকটা ধুক করে উঠলো।মনে অশান্তি ছেয়ে গেলো।ধরফরিয়ে উঠে বসে বিছানায়।

-‘কোনো কিছু স্থির হওয়ার আগেই আলুথালু ভারী শরীরটা নিয়ে হাঁটা ধরে শেহরীনের ঘরের দিকে।দরজাটা হালকা করে ভিড়ানো।লাইট জ্বলছে।ঝকঝকে সাদা আলোর প্রতিদানে মেহরুবার চোখে ধরা দিলো পৃথিবীর সবচেয়ে অসহ্য কঠিনতম দৃশ্য।

-‘শেহরীনের আধশোয়া শরীরে ভর করে কোলে মাথা রেখে শুয়ে আছে আবেশ।তার চুলে গুঁজে আছে শেহরীনের হাত।

-‘সেখানে আর এক দন্ডও সময় নেয় না মেহরুবা।দুনিয়া থমথমে হয়ে গেছে।লাগাতার ঘুরছে।হঠাৎ ঘুম ভেঙে যাওয়ায় মাথা টা টনটন করছে।সারা শরীরে বিশ্রী অলসতা।আর দু দিন পরই তার ডেলিভারির ডেইট পড়েছে।শরীর মারাত্মক রকমের ভারী।

-‘টাল সামলাতে পারে না মেহরুবা।কোনো কিছু বুঝে উঠার আগেই থরথরে শরীরটা মাটিতে পড়ে গড়াগড়ি খেতে থাকে।রক্তপাত হয়।বুক ফেটে বেরিয়ে আসে নিষ্ঠুর করুন তম শব্দ,

-‘ইয়া আল্লাহ!

চলবে

#নিয়তি
লেখনীতে -বর্ষা ইসলাম

১০

ছোট্ট একটি মাংসপিন্ড। ছোট্ট দুটি আদুরে হাত। তুলোর মতো নরম ছোট্র একটি শরীর ল্যাপ্টে আছে আবেশের বুক জুড়ে।ফুসফুস করে নিঃশ্বাস চলছে।

আবেশ মাথাটা নিচু করে। দরদমাখা চোখে আরো একবার তাকায় কোলে থাকা ঘুমন্ত ফুটফুটে সাফওয়ানের দিকে। মনে প্রশান্তি। শান্তি লাগছে। ভীষন শান্তি। অথচ ঘন্টা দুয়েক আগেও তার পৃথিবীতে নেমে এসেছিলো নির্মম অন্ধকার।

মেহরুবার চিৎকার শুনে ছুটে যায় শেহরীন ও আবেশ। মেহরুবা ততক্ষণে মাটিতে পড়ে গড়াগড়ি খাচ্ছে। ব্যথায় কুকাচ্ছে।সারা শরীরে কাদারক্তের মাখামাখি।দু হাতে পেট চেপে ধরে চিৎকার করে বলতে থাকে,

-‘আবেশ বাঁচাও আমাকে। আমি বাঁচতে চাই।আমি আমার সন্তানের মুখ টা একবার দেখতে চাই।আবেশ বাঁচাও আমাকে।

কথা গুলো বলই জ্ঞান হারায় মেহরুবা।আবেশের পৃথিবী ঘুরতে থাকে।কোনো মতে নিজেকে সামলে মেহরুবা কে নিয়ে রওনা দেয় মেডিকেলের উদ্দেশ্যে।সাথে নেয় শেহরীন কে।অপারেশন থিয়েটারে এডমিট করার ঘন্টা খানিক পরে জন্ম নেয় সাফওয়ান।মেহরুবা তখনো অচেতন অবস্থায় কেবিনে পড়ে আছে।ডক্টর বলেছে প্রচুর রক্ত ক্ষরনে সে মারাত্মক রকমের দুর্বল।জ্ঞান ফিরতে সময় লাগবে।

ডাক্তার কেবিন থেকে বেড়িয়ে আসেন।কোলে করে নিয়ে আসেন আবেশের নতুন দুনিয়া কে।আবেশের বুকে ঢেলে দিলেন জুনিয়র আবেশ কে।আবেশের চোখে জল আসে।খুশীর জল।অপেক্ষার অবসানের জল।বুকটা ভরে উঠে প্রশান্তি তে।বাবা হওয়ার সাধ বোধ হয় একেই বলে!

সাফওয়ান দেখতে অবিকল আবেশের মতোই হয়েছে। শেহরীন তো দেখে বলেই ফেললো এতো আপনার পুরো মাস্টার কপি হয়েছে!স্বভাব টাও কি আপনার মতোই হবে!

-‘শেহরীনের শেষের কথা টা কেনো জানি তীর্যক শোনালো আবেশের কানে।আবেশ চোখ তুলে তাকিয়ে সাথে সাথেই আবার চোখ নামিয়ে নেয়।শেহরীন বুঝতে পারে।কিন্তুু শেহরীন সেভাবে কিছু বলতে চায় নি।হতে পারে আবেশের দিক থেকে এটা তার খারাপ লাগা।এখানে শেহরীনের কোনো দোষ নেই।

আবেশ ও কোনো কথা বাড়ালো না।ছেলেকে বুকে জড়িয়েই বসে রইলো কিছুক্ষণের জন্য।

এর মাঝে কেটে গেলো কিছুদিন।আজ মেহরুবা বাড়ি ফেরার কথা।টানা ৭ দিন পর বাড়িতে ফিরছে সে।এই ৭ দিনে আবেশ ছাড়া কাউকে পাশে দেখতে পায় নি মেহরুবা।সাফওয়ানের জন্মের পর শেহরীন দু দিন হসপিটালে থেকে গেলেও তারপর আর তার দেখা মিলেনি।শ্বশুর, শ্বাশুড়ি,ফুপু শ্বাশুড়ি, ননদ আইরিন একটা বারের জন্যও তাকে দেখতে যায় নি।এমন কি সাফওয়ান কেও নয়।

-‘শ্বাশুড়ির কড়া নির্দেশ ছিলো শেহরীনের উপর সে যেনো আর কিছুতেই হসপিটালে না যায়।তাই আর তারও যাওয়া হয়নি।তবে এই সাত দিনের যত প্রয়োজনীয় জিনিস তিনবেলা খাবার সব কিছুই গুছিয়ে মেহরুবার কাছে পাঠিয়েছে আবেশের মাধ্যমে।আর এসব কিছুই হয়েছে শ্বাশুড়ির অগোচরে।

-‘এসব করতে কি শেহরীনের ভালো লাগে?মোটেও না।তারও যন্ত্রণা হয়!কষ্ট হয়।তবে কেনো করে!শুধু মাত্র আবেশ তাকে একটু ভালোবাসবে বলে।তার সাথে একটু কথা বলবে বলে!স্বামী যে এক অবিচ্ছেদ্য অংশ।তাকে কি চাইলেই স্থানান্তর করা যায়!সবাই কি তা পারে!!

-‘রান্না ঘরের সমস্ত কাজ সেরে ডাইনিং এ বসে শেহরীন।সারা শরীর ঘামে চুপচুপে ভেজা।শাড়ির আঁচল টা পেঁচিয়ে কোমড়ে গুঁজে রেখেছে।তৃষ্নায় গলাটা খা খা করছে।জগ থেকে পানি ঢেলে ঢকঢক করে দু গ্লাস পানি পান করে নেয়।পানি শরীরে ছড়াতে না ছড়াতেই ঘাম যেনো আরো উপচে পড়া শুরু করলো।চোখের পলকেই ঘেমে নেয়ে একাকার।

-‘শেহরীন কে এভাবে অস্বাভাবিক ভাবে ঘামতে দেখে ছুটে আসেন শ্বাশুড়ি আয়না বেগম।উদ্বেগ ভরা কন্ঠে বলে উঠেন,

-‘কি হয়েছে শেহের?শরীর খারাপ লাগছে কি?

শেহরীন নিজেকে তটস্থ করে।আঁচল দিয়ে মুখের ঘাম মুছে মৃদু হাসে।শান্ত কন্ঠে বলে উঠে,

-‘না মা কিছু হয়নি।বাইরে যা গরম পড়েছে!একটু অসস্তি লাগছে।বিশ্রাম নিলেই ঠিক হয়ে যাবে।

-‘আর বিশ্রাম!সারাদিন তো খেটে মরছিস।ঐ মেহরুবা বাড়ি ফিরলে আর একটা কাজেও তুই হাত দিবি না।সে কোন জমিদারের ঘর থেকে উঠে এসেছে শুনি।সারাদিন পটের বিবির মতো বসে বসে খাবে?

বলে দিলাম শেহের আজকের পর থেকে আর একটা কাজেও হাত দিবি না তুই!

শ্বাশুড়ির এমন কথায় একটুও অবাক হয় না শেহরীন।বরং নির্লিপ্ত ভাবেই বলে,

-‘মা একটু বসবেন আমার কাছে?

হঠাৎ শেহরীনের এমন আবদারে একটু বিস্মিত হন আয়না বেগম।কিন্তুু কোনো কথা না বাড়িয়ে নিজ ভঙ্গিতেই বসে পড়ে শেহরীনের পাশে।শেহরীন মাথা টা এলিয়ে দেয় শ্বাশুড়ির কাঁধে।কিছুক্ষণ সময় নিয়ে আস্তে করে বলতে থাকে,

-‘মা আপনি না বলেছিলেন কখনো নিজের অধিকার ছাড়তে নেই?

-‘হু

-‘তাহলে আমাকে সব কিছু থেকে নিজেকে গুটিয়ে নিতে বলছেন কেনো?

শেহরীনের কথার ভাজ ধরতে পারলেন না শ্বাশুড়ি।উৎসুক দুটি চোখ নিয়ে শুধু চেয়েই রইলেন।শ্বাশুড়ির নিরবতার কারন বুঝতে পারে শেহরীন।কিছুক্ষণ সময় নিয়ে আবারো বলতে থাকে,

-‘আমি হয়তো বর হারা হয়েছি।কিন্তুু ঘর হারা হয়নি।আমার সংসার আছে।আমি নিরলস ভাবে রাত দিন সে সংসার সাজাচ্ছি।আমি যদি এখন এসব থেকে সরে যাই আর তার পরিবর্তে মেহরুবা বু যদি জায়গা করে নেয় তাহলে আমার আর কি থাকলো মা!!আমি তো তখন অকুল পাথারে পড়ে যাবো।এ কুল অকুল কিছুই থাকবে না আমার।

-‘আমি মানুষটা কে দু বেলা দু চোখ ভরে দেখতে পারছি।তার সাথে কথা বলতে পারছি।এটাই বা কম কিসে!কাছে পাওয়াই কি সব!!

মেহরুবা থামে।নিরব হয়।আয়না বেগমের গাল বেয়ে তখন গড়িয়ে পড়ছে অজস্র অনুতাপের নোনাজল।কোনো কথা বলেন না তিনি।শেহরীনের কপাল থেকে এলোমেলো চুলগুলো সরিয়ে মায়ামাখা চুমু একে দেন।অনুতাপে তকতকে মন নিয়ে বলে উঠেন,আমাকে মাফ করে দিস শেহের!

কিন্তুু এ কথা শেহরীনের কান অবদি পৌছালো না।আয়না বেগমের ভারাক্রান্ত মনেই গেঁথে রইলো।

শ্বাশুড়ি -বউয়ের আবেগ আহ্লাদে কেটে যায় বেশ কিছুক্ষণ। কলিংবেল বাজে।ঘড়িতে তখন দুপুর দেড় টা।মাথার উপর সূর্যের ঢেলে পড়া আগুন।কেউ যে অতিষ্ঠ হয়েই বারবার কলিংবেল বাজাচ্ছে বুঝতে পারে শেহরীন। শ্বাশুড়িকে সোফায় বসিয়ে রেখেই তঠিঘড়ি সদর দরজার দিকে এগিয়ে যায় শেহরীন।দরজা খুলে দিতেই দেখা পায় আবেশ,মেহরুবা আর সাফওয়ান এর।

আবেশ গরমে এক প্রকার অসহ্য হয়ে বিরক্ত নিয়ে বলেই ফেললো এতোক্ষণ লাগে দরজা খুলতে!!সারাদিন শুয়ে বসে থেকেও নড়তে চড়তে এতোক্ষণ লাগে!

কিন্তুু শেহরীন কোনো প্রতিক্রিয়া জানালো না।সাফওয়ান কে তার কোল থেকে নিয়ে খুব শান্ত ভাবেই বললো,

-‘আপনি উপরে গিয়ে ফ্রেশ হন।আমি সব গুছিয়েই রেখেছি।মেহরুবা বু আর সাফওয়ান কে আমি নিয়ে যাচ্ছি।

-‘শেহরীনকে ঠেলে ভেতরে ঢুকে আবেশ।ড্রয়িংরুমে আসতেই মায়ের দেখা পায়।মেহরুবা কে দেখা মাত্রই মুখ কালো হয়ে যায় আয়না বেগমের।শরীর তেঁতে উঠে।মায়ের এমন রিয়াকশন চোখ এড়ালো না আবেশের।

-‘তবুও চোখ কান বন্ধ করে দু তলায় যাওয়ার প্রস্তুতি নেয় আবেশ।শেহরীন সাফওয়ান ও মেহরুবা কে নিয়ে ভেতরে ঢুকে। হাসি হাসি মুখে সাফওয়ান কে নিয়ে চলে যায় শ্বাশুড়ির কাছে।

-‘শেহরীন তার কাছে এগুতেই সোফা ছেড়ে উঠে দাড়ান আয়না বেগম।আবেশ তখনো সিড়ি পার হয় নি।রাগে গর্জে উঠেন তিনি।আবেশ ও মেহরুবার উদ্দেশ্যে বলে উঠেন,

-‘কোনো পতিতার পেটে জন্ম নেওয়া শিশুর মুখ আমি এ জীবনে দেখতে চাইনা শেহের।তার আগে যেনো মৃত্যু হয় আমার।

চলবে,,,,,,,