নীল সীমানার শেষপ্রান্তে পর্ব-০৭

0
4209

#নীল_সীমানার_শেষপ্রান্তে
#Writer_Mahfuza_Akter
||পর্ব_০৭||
;
;
;

জায়েদ চোখ মুখ শক্ত করে বললো,
—“কার সাথে কথা বলছিলে তুমি? ”

অদ্রি তোতলিয়ে গিয়ে বললো,
—“আমি, আমি আসলে, না মানে,,, ”

জায়েদ অদ্রির সামনে গিয়ে দাড়িয়ে বললো,
—“তোমার এসব আসলে মানে বলা অফ করো। এতো কিছু হয়ে গেছে আর তুমি আমায় কিছু জানাওনি? জয়ের এতো সাহস হয় কী করে ঐ নোংরা মেয়েটার জন্য ও একটা নিষ্পাপ মেয়ের জীবন নিয়ে খেলছে? আজ তো আমি ওকে,,,”

জায়েদ শার্টের হাতা ফোল্ড করতে করতে বাইরে যেতে নিবে, এমন সময় অদ্রি ওকে আটকে দিয়ে বললো,
—“পাগলামি করো না, জায়েদ। আমার কথাটা আগে শোনো। হুট করে মাথা গরম করলে কোনো সমাধান হবে না। উল্টো জয় মুনের ওপর আরো বেশি বিগড়ে যাবে। আমাদের যা করার মাথা ঠান্ডা রেখে করতে হবে।”

জায়েদ বিছানায় বসে বললো,
—“কী করে মাথা ঠান্ডা রাখবো, বলতে পারো? জয় যে এতোটাই বেয়াড়া আমি ভাবতেই পারি নি। মুনকে আজ আমি নিজের বোনের জায়গায় বসালাম, তার সাথে যদি আমার নিজের ভাই ই এতো বড় অন্যায় করে; তাহলে কীভাবে আমি সহ্য করবো? নিজের বোনের সাথে কেউ এমন কিছু টলারেট করতে পারবে কখনো?”

অদ্রি জায়েদের পাশে বসে ওর কাধে হাত রেখে বললো,
—“চিন্তা করো না, আমি আহিলকে সব জানিয়েছি। ওই কিছু করতে পারবে বলে আমার মনে হয়।”

জায়েদ অবাক হয়ে বললো,
—” আহিল!! ওহ শিট! ওর কথা তো আমার মাথায়ই আসেনি। ”

অদ্রি মনখারাপ করে বললো,
—“দেখলে তো? আমার মাথায় যেটা আসে, সেটা তোমার মাথায় কোনোদিনও আসবেনা। আমি তোমার থেকে বেশি কাজের!! ”

জায়েদ অদ্রির গাল টেনে বললো,
—“ওরে আমার কাজের বউটা রে!! আমি তো জানতামই না!!”

—“তা তো জানেবেই না। আচ্ছা, বাদ দাও। শোনো, তুমি যে সবকিছু জানো এটা যেন কেউ বুঝতে না পারে। আপাতত চুপচাপ থাকাটাই ভালো হবে।”

—“হুমমম ”
————

সকাল বেলা বিছানায় আরাম করে ঘুমাচ্ছে জয়। মুন ঘরে নেই, হয়তো বাইরে জুনায়েদের সাথে খেলছে, নয়তো টিভি দেখছে। এদিকে মুনের ফোনের ননস্টপ রিং হওয়ার শব্দে জয়ের অসম্ভব বিরক্ত লাগছে। ঘুমের ঘোরে বিরক্তি নিয়ে নাক-মুখ কুঁচকে বললো,
—“এই মেয়েটার কি কোনো বুদ্ধি সুদ্ধি নেই নাকি? ফোনটা নিজের সাথে নিয়ে ঘুরতে পারেনা। এখনো বাচ্চাদের সাথে বাচ্চামো করবে! ফজরের নামাজটা পড়ে একটু ঘুমিয়েছিলাম। এখন সেটাও ধ্বংস হয়ে গেল।”

বলে উঠে বসলো। বেডসাইড টেবিলে থাকা ফোনটা এখনো বাজছে, এ নিয়ে তিনবার হলো। জয় ফোনটা হাতে নিয়ে মুনকে ডাকতে লাগলো,
—“মুন, এই মুন, তোমার কল এসেছে!! ”

কিন্তু মুনের কোনো খবর নেই। ফোনের স্ক্রিনে দেখলো ‘Anita’ নামটা জ্বলজ্বল করছে। অবশেষে হাজারো জড়তা নিয়ে জয়ই ফোনটা রিসিভ করলো। ফোন কানে দিয়ে কিছু বলতে যাবে, তার আগেই ওপাশ থেকে অনিতা বলে উঠলো,
—“ওই বজ্জাত মাইয়া, কতবার ফোন দিসি তোকে? বলি মোবাইল কি চান্দে পাঠাইয়া তুই মঙ্গল গ্রহে বেড়াতে গেছিস নাকি? শালার দরকারের জন্যই তো ফোন দিচ্ছি, এটুকু কমনসেন্স কি তোর ঘিলু তে নাই? তুই কেমনে টপার হস বলতো? তোরে এখন সামনে পাইলে আমি যে কী করতাম, ইউ জাস্ট কান্ট ইমেজিন!!”

জয় ঠিক কী করবে বুঝে উঠতে পারছে না। এমন কথা এজীবনে কখনো শুনেছে কিনা মনে আসছে না। তাও কিছু তো বলতে হবে। কিন্তু কী দিয়ে কী শুরু করবে বেচারা?

অনিতা আবার বলে উঠলো,
—“আপনার গলায় কি ব্যাঙ ঢুকসে? নাকি কথা গুলোকে হিমালয়ে ফেলে আসছেন?”

জয়ের গা গুলিয়ে আসলো এমন কথা শুনে। ইয়াক!! ব্যাঙ!!! নিজের গলা পরিষ্কার করে বললো,
—“কে আপনি? সেই তখন থেকে কিসব আজেবাজে কথা বলছেন? ”

অনিতা পুরুষালি কন্ঠ শুনে ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেল। সে বুঝে গেছে যে, এটা মুনের বর। তাই তোতলাতে তোতলাতে বললো,
—“ইয়ে মানে, জিজু, আমি অনিতা। মুনের ফ্রেন্ড। আমি ভেবেছিলাম, হয়তো মুন ফোন ধরেছে। আপনি রিসিভ করছেন এটা বুঝতে পারিনি। ”

—“সেটা তো না হয় বুঝলাম। কিন্তু তোমার বান্ধবী তো ঘরে নেই। কোথায় গেছে কে জানে? ”

—“জিজু, তাহলে ও আসলে আমায় কল করতে বলিয়েন। অনেক ইম্পর্ট্যান্ট কথা আছে। ”

—“আচ্ছা, ঠিক আছে। ”

বলেই ফোন কেটে দেয়। ফোনটা হাতে নিয়েই জয় ভাবতে থাকে,
—“আচ্ছা, আমার কি একবার এই ফোনটা চেক করা উচিত। দেখি ও কি কি ইউজ করে? ”

জয় ফোন অন করতেই দেখে পিনলক করা, তাই পাসওয়ার্ড চাইছে। জয় নিজের ফোনও এমন লক করে রাখে। তাই অভ্যাস বশত নিজের ফোনের মতো এ ফোনেও নিজের নাম টাইপ করতে শুরু করে দেয়। ‘JoyMahmud’ টাইপ করার সাথে সাথে ফোনটার লক খুলে গেল। দুই সেকেন্ডের মধ্যে জয়ের কপাল কুঁচকে এলো এটা মনে করে যে, এটা তো তার ফোন না। তার মানে মুন জয়ের নাম দিয়ে নিজের ফোনের পাসওয়ার্ড সেট করেছে!! কিন্তু কেন? তার থেকেও অবাক হওয়ার বিষয় হলো, ফোনের হোমস্ক্রিনে জয়ের অনেক গুলো ছবি ওয়াল পেপার হিসেবে সেট করা। জয় স্ক্রল করে নিজের ছবি গুলো দেখছে আর ভাবছে,
—“তার মানে মুন আমায়,,,,,,,”
————

অনেক্ক্ষণ পর,,,

আমি রুমে এসে দেখি বিছানায় জানালার পাশে বসে বাইরের দিকে তাকিয়ে আছে। আমি সোফায় গিয়ে বসে পরলাম। জুনায়েদের সাথে ছুটোছুটি করে অনেক ক্লান্ত লাগছে। সত্যিই এ বাড়ির প্রতি টা মানুষ খুবই ভালো, অনেক ভাগ্য করে এমন শশুরবাড়ি পাওয়া যায়। কিন্তু আমার ভাগ্য যে এতো ভালো না তা আমি ভালো ভাবেই জানি।

—“তোমার এক ফ্রেন্ড ফোন দিয়েছিল। কী দরকারি কথা আছে বললো। তোমায় কলব্যাক করতে বলেছে।”
জয়ের কথা শুনে আমি উঠে গিয়ে টেবিল থেকে মোবাইলটা নিয়ে দেখলাম অনিতা ফোন দিয়েছে। আমি ওকে কল দিতেই ও যা বললো তা শুনে আমার মাথায় আকাশ ভেঙে পড়লো। আমি ধপ করে বেডে বসে পড়লাম। জয় আমার দিকে তাকিয়ে আমার এমন অবস্থা দেখে জিজ্ঞেস করল,
—“কী হয়েছে? এনি প্রবলেম? ”

আমি আনমনে বললাম,
—“কালকে অনার্স ফাইনাল এক্সেমের ফাইনাল প্রেজেন্টেশন। আমি কোনো স্লাইড-কন্টেন্ট কিছুই বানাইনি। কালকে প্রেজেন্টেশন না দিতে পারলে আমার চার বছরের সব পরিশ্রম বৃথা।”

—“এখন কী করবে তাহলে? ”

আমি কাঁদো কাঁদো ফেস করে ওয়াশরুমে যেতে যেতে বললাম,
—“কী করবো আবার? ফ্রেশ হয়ে কাজে লেগে যাবো।”

জয় অবাক হয়ে ভাবতে লাগলো,
—“এই মাত্র না ওকে দেখলাম কেমন ডিপ্রেসড। আবার এখন বলছে কাজে লেগে পড়বে। সত্যিই তুমি অসাধারণ! হয়তো অসাধারণের চেয়েও বেশি! কিন্তু তোমাকে আমি ভালোবাসতে পারবো না, তুমি আমায় বাসলেও না। তোমার বাবার অপারেশনের দিন ভেবেছিলাম তোমার সাথে খারাপ আচরণ করাটাই ভালো হবে, কিন্তু না, তুমি তো আমায় হেল্প করছো। তাই তোমার সাথে মিসবিহেইভ করাটা লজিক্যাল লাগেনি আমার কাছে। আর এখন তুমি আমায় ভালোবাসো এটা জানার পরেও তোমার সাথে মোটেও খারাপ ব্যবহার করবো না। কারণ আমি জানি, তুমি কখনো তোমার ফিলিংস প্রকাশ করবে না। কাউকে ভালোবাসাটা তো অন্যায় না! আমার এখন শুধু একটাই প্রার্থনা, আল্লাহ্ যেন আমায় সঠিক পথটাই দেখায়।”

নিজের অবস্থা ভাবতেই জয়ের মুখে একটা তিক্ততার হাসি ফুটে উঠলো। সত্যিই তার জীবনটা বড়োই অদ্ভুত। সবার জীবনেই অনেক আঁকাবাঁকা মোড় থাকে, আর তার জীবনের ক্র্যাক্স গুলো সে নিজেই তৈরি করেছে। এমন কমপ্লেক্স একটা জীবনের অধিকারী না হলে কী খুব সমস্যা হয়ে যেত তার?
———-

আহিল কানে ফোন গুঁজে বললো,
—“হ্যালো, মিসেস তনিমা বলছেন?”

একজন পুরুষ ফোনের অপর পাশ থেকে বলে উঠলো,
—“না, তনিমা একটা কাজে বাইরে গেছে। কেন তনিমাকে কী দরকার? আর আপনি কে?”

—“ওনি আমায় একটা কাজ দিয়েছিলেন। সেটার জন্য ওনাকে ফোন দিয়েছি।”

—“আপনি আমাকে বলতে পারেন। আমি তনিমার হাসবেন্ড নিবিড় বলছি।”

—“না, আপনি বলবেন কী করে? মেয়েদের পোশাক-আশাকের ব্যাপারে আপনি বুঝবেন না।”

নিবিড় বিরক্ত হয়ে বললো,
—“ও আপনি টেইলারিং শপ থেকে ফোন দিয়েছেন। সেটা আগে বলবেন না। আমি আরো ভেবেছি কী না কী কাজ। যত্তসব!
বলেই ফোন কেটে দিলো নিবিড়।

এদিকে আহিল নিজের ফোন থেকে সিম কার্ডটা বের করে ভেঙে ফেললো, আর তৃপ্তির হাসি দিয়ে বললো,
—“আমি যা সন্দেহ করেছিলাম সেটাই ঠিক। তনিমা বিবাহিতা। তনিমার নামের আগে মিসেস শব্দটা আমি শুধু শুধু ব্যবহার করিনি,ওটা তো একটা ট্রেপ ছিল যেটাতে এই তনিমার হাসবেন্ড, নাম কী বললো যেন, নিবিড়? হ্যাঁ এই নিবিড় সুন্দর ভাবে ফেঁসে গেছে। কিন্তু ও এসব কেন করছে? সেটাই আমাকে বের করতে হবে।”

আহিল অন্য একজনকে কল দিয়ে বললো,
—“শোনো, তোমাকে একটা নাম্বার পাঠাচ্ছি। ঐ নাম্বারটার একজেক্ট লোকেশনটা ট্রেস করে আমায় মেইল করবে, পুরো ঠিকানাটা আমার চাই।”

—“ওকে, স্যার। আমি সব ডেটা আপনাকে পাঠিয়ে দিব। ”

আহিল ফোন কেটে দিলে স্ক্রিনে একজনের ছবি ভেসে ওঠে। আহিল ছবিটার দিকে তাকাতেই তার ওপর একফোঁটা অশ্রু আহিলের চোখ থেকে গড়িয়ে পড়লো।
—“অনেক দিন ধরে তোকে দেখি না। কবে যে এই দায়িত্ব থেকে বের হয়ে তোকে নিজের করে নিব, জানি না। ভালোবাসি তোকে, অনেক ভালোবাসি। #নীল_সীমানার_শেষপ্রান্তে গেলেও এ আহিল আহরার শুধু তোরই থাকবে আর তোকেই ভালোবাসবে।”

-চলবে…………