নীল সীমানার শেষপ্রান্তে পর্ব-০৮

0
4132

#নীল_সীমানার_শেষপ্রান্তে
#Writer_Mahfuza_Akter
||পর্ব_০৮||
;
;
;

সকাল ছয়টায় ল্যাপটপ বন্ধ করে ওঠে দাড়ালাম। কাল দুপুরের পর থেকে শুরু করেছি এই প্রেজেন্টেশন এর স্লাইড বানানো। এই এখন শেষ হলো সবকিছু ; কাল সারারাত একমিনিটের জন্যও ঘুমাইনি। আমার কাছে রাতজাগা টা কোনো ব্যাপার না, এরকম কত রাত বইয়ে মুখ গুঁজে নির্ঘুম কাটিয়েছি হিসেব নেই। কিন্তু এতোক্ষণ ল্যাপটপ নিয়ে কাজ করায় মাথাটা কেমন কেমন যেন করছে।

—“এমন করছো কেন? আর তোমায় এমন দেখাচ্ছে কেন? নিষেধ করেছিলাম সারারাত জাগতে!”

আমি চোখ পিটপিট করে বেডের দিকে তাকিয়ে দেখলাম জয় শুয়ে আমার দিকে ঘুরে তাকিয়ে আছে। আমি অবাক হয়ে বললাম,
—“আপনি জেগে আছেন? একটু আগে না দেখলাম ঘুমিয়ে আছেন?”

জয় শুয়ে শুয়েই বললো,
—“না ম্যাডাম, আমি উঠে নামাজ পড়ে একটু আগে শুয়েছি। এখনো ঘুমাইনি। তুমি আমায় একটু আগে দেখোনি, অনেকক্ষণ আগেই দেখেছো। তারপর কাজে মগ্ন হয়ে গেছিলে তাই খেয়াল করোনি।”

—“ওহ আচ্ছা! ”

আমি এসাইনমেন্ট শিট, সার্ভে রিপোর্ট আর ল্যাপটপটা আমার ব্যাগে ঢোকাতে লাগলাম। এসব আমি পরীক্ষার পরপরই তৈরি করে রেখেছিলাম। তাই অনেক সুবিধা হয়েছে আজ।
______________

জয় নিজের কেবিনে বসে একটা ফাইল দেখছে। তার চোখ দুটো ফাইলের উপর আছে ঠিকই, কিন্তু মনযোগ টা সেখানে নেই।

যতোই মানুষ নিজের আবেগকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে চায়, মন ঠিক ততোটাই বেহায়া হয়ে যায়। মস্তিষ্ক দ্বারা নিষিদ্ধ ভাবনাগুলো বারবার অন্তরাল থেকে অন্তরের অন্তস্তলে ঘোরাঘুরি করে। ভাবতে ভাবতে সময় দৌড়ে চলে যায় দূরপাল্লার বাসের মতো। কিন্তু ভাবনা, সেটাতে বড্ড জেদি! নিজের অস্তিত্ব জুড়ে সেটা বিরাজ করতে চায়।

—“একজন মানুষ কতোটা ধৈর্যবান, জেদি ও পরিশ্রমী হলে সারারাত জাগতে পারে, আবার সকাল সকাল নিজের গন্তুব্যে ছুটে যেতে পারে। ও এতোটা প্যাশনেট, আমি ওকে দেখে ভাবতেও পারিনি। এমন মানুষ হয় আদৌও! পৃথিবীটা বড্ড বৈচিত্র্যময় ; তাই এখানে এমন বিচিত্র বৈশিষ্ট্যের অধিকারী মানুষ থাকাটা অস্বাভাবিক কিছু নয়।”
জয় বসে বসে এসব ভেবে ফোঁস করে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললো।

—“তুই কী নিয়ে এতো চিন্তা করছিস বলতো?”

পেছন থেকে কানের কাছাকাছি এসে কেউ এমন কথা জিজ্ঞেস করতেই জয় লাফিয়ে উঠলো আর হাত থেকে ফাইলটা উড়ে গিয়ে টেবিলে পড়লো। জয় পিছনে ঘুরে তাকাতেই দেখলো, জায়েদ ওর দিকে সন্দেহের দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। বুকে হাত দিয়ে একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে বললো,
—“এমন করে কেউ হঠাৎ কানের কাছে এসে এভাবে কথা বলে? আমার ইমম্যাচিউর ডেথ চাও নাকি তুমি?”

জায়েদ ভ্রু কুঁচকে বললো,
—“তোর মতো বেয়াড়া ছেলের ১০০ বছর বয়সেও ম্যাচিউরিটি আসবে না। কী ভাবছিলি এতো মনযোগ দিয়ে, সেটা বল।”

জয় আমতা আমতা করে বললো,
—“আ,,আ,আমি আবার ক,,কী ভাবতে যাবো? আমি তো এই ফাইলটা দেখছিলাম।”

জায়েদ জয়ের চেয়ারের অপজিটের একটা চেয়ার টেনে বসতে বসতে বললো,
—“তাই নাকি? ফাইল কেউ উল্টো করে ধরে পড়ে, জানতাম না তো!! ”

জয় হকচকিয়ে গিয়ে বললো,
—“উল্টো করে ধরে কেন পড়তে যাবো আমি? আমাকে দেখে কি তোমার পাগল মনে হয়? ”

—“মনে তো হয় না, কারণ আমি শিয়র তুই একটা আস্ত পাগল।”

জয় রেগে গিয়ে বললো,
—“ভাইয়া, বেশি বেশি হয়ে যাচ্ছে কিন্তু!! ”

জায়েদ ডোন্ট কেয়ার মুড নিয়ে বললো,
—“কোনো কিছু বেশি বেশি হচ্ছে না। আমি তোর কেবিনে ঢোকার পর দেখলাম, তুই ফাইল হাতে নিয়ে এমন ভাবে তাকিয়ে আছিস যে বোঝাই যাচ্ছে, তোর মনযোগ ফাইলের মধ্যে নেই। তোর পেছনে গিয়ে দাড়িয়ে দেখলাম, তুই ফাইল উল্টো করে ধরে আছিস। নাও হোয়াট শ্যুড আই স্যায় অ্যাবাউট ইউ, ড্যুড??”

জয় আনমনে বললো,
—“আচ্ছা ভাইয়া, তুমি যদি কাউকে ভালোবাসো আর তোমাকে যদি আরেকজন ভালোবাসে, তাহলে তোমার কাকে চুজ করা উচিত?”

—“তাকেই চুজ করা উচিত, যে প্রকৃত অর্থে আমায় ভালোবাসে। তুই যাকে ভালোবাসিস, তাকে আগে বোঝ যে, সে তোকে কতটা ভালোবাসে। দ্যান ডিসিশন নিবি।”

জয় বাস্তবে ফিরে এসে বললো,
—“আমি আমার কথা বলিনি। আচ্ছা বাদ দাও। তুমি কেন এসেছো আমার কেবিনে আগে সেটা বলো।”

জায়েদ হতাশার সুরে বললো,
—“আমরা রিসেন্টলি যেই প্রজেক্টের জন্য কাজ করছি, ওটা অন্য একটা কোম্পানির হাতে চলে যাচ্ছে। ”

—“হোয়াটটটট! অন্য কোম্পানির হাতে কীভাবে যাবে? এটা তো কথা ছিল না! আমরা কত টাকা ইনভেস্ট করেছি এই প্রজেক্টের জন্য! ডু ইউ হেভ এনি আইডিয়া, ভাইয়া?”

—“সেটাই তো আমার টেনশান। অনেক গুলো টাকা লোন ও করেছি আমরা, এখন এই কাজটা যদি হাতছাড়া হয়ে যায়, তাহলে আমাদের দেউলিয়া হতে হবে!! ”

—“কিন্তু কোন কোম্পানি আমাদের থেকে এতো ভালো পারফরম্যান্স করছে যে, আমরা এতো বড় রিস্কের মধ্যে পড়ে গেলাম? ”

—“নাম জানি না। তবে যেটুকু জেনেছি, কোম্পানিটা নতুন আর অনেক দক্ষ। আমরা এতোগুলো টাকা ইনভেস্ট করে প্রজেক্ট দাঁড় করিয়েছি, আর তারা আমাদের ৭৫% টাকা দিয়ে প্রজেক্টের বাজেট করেছে। ওদের দক্ষতা দেখেই মুলত ওরা কাজ পাবে, আর তার সম্ভাবনাও অনেক বেশি। ”

জয় মাথায় হাত দিয়ে বললো,
—“ও মাই গড!!! তাহলে আমাদের কিছু করতে হবে। তুমি কোনো কিছু ভেবেছো?”

জায়েদ ডানে-বামে মাথা নাড়িয়ে বললো,
—“না, তবে আরো একমাস আছে মাত্র। এর মধ্যে কী করতে পারবো কিছু বুঝতে পারছি না। ”

জয় স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললো,
—“এখন আমাদের করণীয় একটাই। আর সেইটা হলো পুরো কোম্পানির কাজ আমাদের হাতে নিতে হবে। দিনের বেশিরভাগ সময়ই কোম্পানিতে দিতে হবে। আমি মুনকে দেখেছি কীভাবে প্যাশনেটলি কাজ করতে হয়। আমাদেরকেও সেভাবেই এগুতে হবে। ”
_____________

ভার্সিটির মাঠে একটা গাছের নিচে বসে আছি আমি, অনিতা, রুহি, অর্নব, রাদিফ আর হিম। আমরা ছয়জন হলাম আমাদের ব্যাচের টপ সিক্সে থাকা স্টুডেন্টস। আমি আর হিম সবসময় ফার্স্ট আর সেকেন্ড পজিশনে থাকি, এটা বলতে গেলে ফিক্সড। অন্যদিকে বাকিদের পজিশন সবসময় চেঞ্জ হলেও সিক্সের বাহিরে কেউ যায় না।

আমি বরাবরের মতোই চুপচাপ বসে আছি, কেন জানিনা আজ মনটা অনেক ভারী লাগছে। জয় কি কোনোদিন তনিমার আসল রূপটা দেখতে পাবে না? যদি দেখতেও পায়, সেদিন অনেক দেরী না হয়ে যায়! আমার এই থিংকিং মোড দেখে রুহি হালকা ধাক্কা দিয়ে বললো,
—“কি রে জানু, কী এতো ভাবছিস তুই? সবকিছু কমপ্লিট হয়নি নাকি?”

রুহির কথার ভেতর বাম হাত ঢুকিয়ে দিয়ে রাদিফ বললো,
—“তোর এতো চুলকানি ক্যান রে, ছ্যারি? ও যা ইচ্ছে হয় তাই ভাবুক, তুই সবার চিন্তন স্বাধীনতায় খালি হস্তক্ষেপ করস কেন বলতো?”

রুহি চোখ দিয়ে অগ্নিবর্ষণ করতে করতে বললো,
—“তোর মতো ছ্যাচ্ছড়রে উত্তর দিতে আমার কোনো ইচ্ছা নেই। সারাক্ষণ খালি পকর পকর করতেই থাকে। ফাউল পোলা একটা!!”

রাদিফ তেড়ে গিয়ে বলে,
—“কী বললি তুই? আমি ফাউল?”

ওদের কথা শুনে অর্ণব রাদিফকে সান্ত্বনা দিতে দিতে বললো,
—“আরে বাদ দে ইয়ার! সব কথা এতো ধরা লাগে না। তুই শুধু শুধু রাগারাগি করতেছিস!”

অনিতা অর্ণবের কথায় ফোড়ন কেটে বললো,
—“এ্যাহহহহ আইসে! নিজে কী সাধের লাউটা আহা! নেংটি ইঁদুরের পেখম গজালে যা হয় আর কী!”

অর্ণব অনিতার কথায় মুখ বাকিয়ে বললো,
—“তোর মতো হুল্লা বিলাই না যে নাকের নিচ দিয়ে মিউমিউ করুম।”

রাদিফ অর্ণবকে শাবাশি দিতে দিতে বললো,
—“একদম মনের কথাটা বলসে, এই রুহির এমন একটা বদ অভ্যাস আছে। সত্যি কথা বলতে ও আস্ত একটা বদের হাড্ডি। আমার তো মনে হয় আল্লাহ্য় ওরে বদ অভ্যাসের গুণসম্পন্ন একটা আইডিয়াল মডেল হিসেবে তৈরী করসে।”

রুহি মাটি থেকে শুকনো পাতা তুলে রাদিফের দিকে ছুড়ে মেরে বললো,
—“তোকে শয়তানের আইডল হিসেবে বানিয়েছে। শয়তান তোকে দেখে সবকিছু শিখে নেয়। বলদা কুমির একটা।”

আমি ওদের ঝগড়া দেখে মুখ টিপে হাসছি। এগুলো দেখতে দেখতে আমি অভ্যস্ত। আমরা সেই কলেজ লাইফ থেকে একসাথে আছি, তাই খুনসুটি একটু বেশিই। হিম ওদের কথা শুনে কিটকিটিয়ে হাসছে, হাসির চোটে কথা বলতে পারছে না বেচারা। আমিই তাই বলে উঠলাম,
—“স্টপ ইট গাইস। আর কতো ফ্রী বিনোদন দিবি সবাইকে বলতো?”

অর্ণব ঠোঁট ফুলিয়ে বললো,
—“বইন, আমার আর ভাল্লাগে না, কবে যে একটা ভালো চাকরি পামু। তোর তো একটা হিল্লে হয়ে গেছে, আমাদের কথা তো একটু ভাব, বইন।”

অনিতা বললো,
—“তোর মতো চান্দুর বাপকে কোনো বান্দরেও বিয়ে করবে না। মুন শোন, তোর বরের সাথে না আমার কথা হয়েছে। তোকে অনেক ভালোবাসে, তাই না? ”

-চলবে…….