নীল সীমানার শেষপ্রান্তে পর্ব-০১

0
7232

#নীল_সীমানার_শেষপ্রান্তে
#Writer_Mahfuza_Akter
#Part_01
#সূচনা_পর্ব

—“আমি শুধু আমার স্বার্থের জন্য তোমাকে বিয়ে করতে চাচ্ছি। নয়তো তোমার মতো একটা মেয়েকে এই জয় মাহমুদ বিয়ে করবে! হাও ফানি! আমার প্রয়োজনের তাগিদেই এমন একটা শর্ত দাড় করালাম, শুধু মাত্র তোমায় ব্যবহার করার জন্য। নাথিং এলস!!”

জয় স্যারের মুখে একথা শোনার পর আমার মাথায় যেন আকাশ ভেঙে পড়লো। মানুষ কিভাবে অন্য একজন মানুষের অসহায়ত্বের সুযোগ নিতে পারে তা মিস্টার জয় মাহমুদকে না দেখলে হয়তো অজানাই রয়ে যেতো। কিন্তু স্যারের মধ্যে না আছে কোনো করুনা, আর না আছে কোনো অনুতাপ। তার চোখের মধ্যে শুধু নিজের ব্যক্তিগত স্বার্থ দেখতে পাচ্ছি, যার বলি হচ্ছি আমি। মানুষ এতোটা স্বার্থান্ধ ও সুযোগসন্ধানী কী করে হয়!!

দুই গাল বেয়ে গড়িয়ে পড়া নোনাজল গুলো হাতের উল্টো পিঠ দিয়ে মুছে ওনার দিকে তাকিয়ে বললাম,
–“স্যার, আমায় সবকিছু কি একটু ক্লিয়ার করে বলবেন?”

গলাটা কেমন যেন কাঠ কাঠ হয়ে উঠছে। খুবই শান্ত ও ভদ্র ভাবে বললাম। কারণ আমার মতো অসহায় ও অভাগী মেয়ের মুখে রাগী ভাব বা তেজ কোনোটাই শোভা পায় না।

আমার কথায় উনি মুখ তুলে আমার দিকে তাকালেন, যেন কোনো স্নিগ্ধ সকালে সদ্য প্রস্ফুটিত শুভ্র বর্ণের গোলাপ । কিন্তু তা যে শুধু মাত্র একটা ভ্রম, এই সুন্দর শুভ্রতার অন্তরালের কুৎসিত কদর্যতা শুধু মাত্র আমি দেখতে পাচ্ছি। হয়তো আমার এমন শান্তভাবে কথা বলাটা আশা করেননি, তাই ওনার দৃষ্টিতে আমায় অষ্টম আশ্চর্যের মতো মনে হচ্ছে । কিন্তু ওনার অবাকতার ভাষা, চোখের ভাষা বা মনের ভাষা কোনোটা বোঝার বিন্দু মাত্র আগ্রহ আমার মধ্যে অনুভব করতে পারছি না। এখন আমার মাথায় শুধু একটাই চিন্তা, যে করেই হোক আমার বাবাকে বাচাতেই হবে।

জয় স্যার চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়িয়ে উল্টো দিকে ঘুরে জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে থমথমে গলায় বললেন,
–“চেয়ারে বসো। অনেক্ষন ধরে দাঁড়িয়ে আছো।”

আমি ভাবলেশহীন ভাবে বললাম,
–“আমি বসবো না, বসতে আসিনি এখানে। ”

আমার কথায় উনি এমনভাবে আমার দিকে তাকালেন যেন চোখ দিয়ে আমায় এখনি গিলে খাবেন। ওনার ভয়ংকর চাহনী আমার হাত পা কাপিয়ে তুলছে। আমি কাঁপা কাঁপা হাতে চেয়ার টেনে বসলাম।

স্যার দুই হাত পকেটে গুজে বলতে লাগলেন,
–“তোমাকে এতো এক্সপ্লেইন করে বলার কোনো ইচ্ছা আমার নেই। কিন্তু বাধ্য হয়ে বলছি। কারণ আমি জানি তুমি আমার কথা মানতে বাধ্য, এছাড়া তোমার আর কোনো উপায়ও নেই । যেহেতু তোমার বাবার অপারেশনের জন্য যে পরিমান টাকার প্রয়োজন তা শুধু আমিই তোমায় দিবো, তাও একটা মাত্র শর্তে : আমায় বিয়ে করতে হবে। ”

ওনার কথার ধরনই আমায় চোখে আঙুল দিয়ে জানান দিয়ে দিচ্ছে যে, এই বিরাটকায় পৃথিবীতে আমার চেয়ে তুচ্ছ ও মূল্যহীন হয়তো একটা পিপড়াও না। বরং একটা আণুবীক্ষণিক প্রানীও আমায় দেখে হাসবে এবং তারচেয়েও বেশি অবহেলা প্রাপ্তির যোগ্য কেউ আছে এটা ভেবে অহংবোধ করবে। ভাবনাকে নিজের আপন গতিতে ছুটতে দিয়ে কথা গুলোকেও তার সাথে তাল মেলানোর অবকাশ দেওয়ার জন্যে বলে উঠলাম,
–“কিন্তু এর কারণ? ”

–“আমি একজনকে ভালবাসি। কিন্তু আমার ফ্যামিলি তাকে কখনো মেনে নিবে না। তাই আমি তোমায় বিয়ে করে আমার ফ্রেন্ডস এন্ড ফ্যামিলির কাছে মিসেস জয় মাহমুদ নামে পরিচিতি দিব। আর তার কিছু মাস পরেই তনিমা, মানে যাকে আমি ভালোবাসি তাকে বিয়ে করবো। কিন্তু সেটা শুধু তুমি জানবে। তোমার আমার বিয়েটা হবে একবছরের কন্ট্র্যাক্টে। একবছর পর আমরা ডিভোর্স নিয়ে নিব। তারপর বাকিটা তোমার না জানলেও চলবে।”

উনি এমনভাবে কথাগুলো বলছিলেন যেন এটা তেমন কিছুই না, জাস্ট একটা খেলার মতো। যেখানে একটা গুটি হিসেবে আমায় শামিল করতে চাইছেন। প্রয়োজনে ব্যবহার করলেন, প্রয়োজন শেষে ফেলে দিলেন। ভাবতেই বুকের ভেতরটা দুমড়ে মুচড়ে যাচ্ছে। আমার ভাগ্যে কি একটুও সুখ লেখা নেই। সব মেয়েই তো চায়, তার পারিবারিক জীবনে সুখী না হলেও বৈবাহিক জীবনে একটু সুখী হতে। কিন্তু আমার কপালে যে তাও লেখা নেই তা আমি আমার আসন্ন অন্ধকার ভবিষ্যৎ দেখে ঠিকই অনুমান করতে পারছি। কিন্তু এছাড়া তো আমার আর কোনো উপায়ও নেই, বাবার অপারেশনের জন্য এতোগুলো টাকা আমি কোত্থেকে জোগাড় করবো?
এসব ভাবতে ভাবতে কখন যে হাত দিয়ে মুখ চেপে হু হু করে কাদছিলাম জানি না।

হঠাৎ জয় স্যার হুংকার দিয়ে উঠলেন,
–“হোয়াট রাবিশ! আমি তোমার এসব মেলোড্রামা দেখার জন্য বসে নেই। জাস্ট আনসার মাই কোয়শ্চন ডিরেক্টলি এন্ড স্টপ ইয়র ডিজগাস্টিং ক্রায়িং, ড্যামম।”

আমি কেঁপে ওঠে বললাম,
–“হুম, আমি রাজী। আমার বাবা মায়ের জন্য আমি সব করতে পারি। আপনি শুধু আমার বাবার চিকিৎসার ব্যবস্থা করে দিন।”

–“ওকে, পাঁচ মিনিট ওয়েট করো।”
বলে ওনি আমায় ওনার কেবিনে বসিয়ে কোথায় গেলেন জানিনা।

এর মধ্যে আমার পরিচয়টা দিয়ে দেওয়া যাক। আমি ফাহমিদা আহমেদ মুন। বাবা মায়ের একমাত্র সন্তান। বিবিএ কমপ্লিট করেছি, কিন্তু এখনো রেজাল্ট দেয়নি। বাবা একটা প্রাইভেট কোম্পানিতে চাকরি করতো কিন্তু হার্টের সমস্যার কারণে এখন আর উপার্জন ক্ষম নেই। তাই এক বছর ধরে এই কোম্পানিতে চাকরি করছি আমি, আমার পড়ার খরচ ও পরিবারের খরচের তাগিদে। ভেবেছিলাম পড়াশোনা শেষ করে একটা ভালো চাকরি নিব, তখন আর কোনো সমস্যা হবে না। কিন্তু তার আগেই বাবা হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়ায় ডক্টর বলেন, বাবার ২৪ ঘন্টার মধ্যে অপারেশন করতে হবে। নয়তো তাকে বাচানো যাব না। কিন্তু অপারেশন করতে যে পরিমান টাকার প্রয়োজন তা আমি এতো কম সময়ের মধ্যে কোনোদিন জোগাড় করতে পারবো না। তাই ছুটে এসেছিলাম বড় স্যার, জাহিদ মাহমুদ এর কাছে। কিন্তু তিনি নাকি একসপ্তাহের জন্য কানাডা গেছেন। এরপর তার ছোট ছেলের কাছে আসতেই যা বললেন তা তো দেখলেনই।

দুই-তিন মিনিট পর আবার ফিরে এসে আমার সামনে তিন পৃষ্ঠার একটা দলিল এগিয়ে দিলেন। তারপর আরাম করে নিজের চেয়ারে আমার দিকে মুখ করে বসলেন। মুখের গাম্ভীর্যের ভাব বজায় রেখে বললেন,
–“এটা তোমার – আমার বিয়ের কন্ট্র্যাক্ট পেপার। পড়ে নিতে পারো। দ্যান সাইন করে দাও। সিগনেচার দেওয়ার সাথে সাথে তোমার বাবার অপারেশন স্টার্ট হয়ে যাবে। আর বিয়েটা বাবা দেশে ফিরলেই হবে। ”

আমি পেপারটার দিকে পাথরের মতো তাকিয়ে বললাম,
–“পড়ার দরকার নেই। আপনি আমার বাবার চিকিৎসার ব্যবস্থা করে দিন।”
বলে টেবিলের ওপর থেকে কলমটা নিয়ে তিনটা পৃষ্ঠাতেই সাইন করে দিলাম আর পা বাড়ালাম নারকীয় যন্ত্রণার অন্ধকার জীবনের দিকে। আদৌ কি নরক নাকি অন্য কিছু? জানি না আমি। শুধু মাত্র নিজেকে ভাগ্যের কাছে সঁপে দিলাম। কী হবে তার পরিণতি?

-চলবে…..