নেশা লাগিল রে পর্ব-৫+৬

0
264

#নেশা_লাগিল_রে। পর্ব-৫
লেখক- ইতি চৌধুরী
(কোনো ক্রমে কপি করা যাবে না।)

নিজের ঘরে বসে পড়ার টেবিলে বইয়ে মুখ গুজে বসে আছে বানী। যদিও বইয়ে তার মন নেই। মনে মনে ভীষণ রাগ হচ্ছে তার। মাহাপারাকে সে এত ভালোবাসে অথচ তারই ভাইয়ের সাথে প্রেম করলো তলে তলে আজ একদম বিয়ে অব্দি করে চলে এসেছে কিন্তু তাকে একটাবার বলারও প্রয়োজন মনে করলো না? এই দুঃখেই কিছু ভালো লাগছে না বানীর। বান্ধবীর মতো সম্পর্ক যার সাথে সেই মাহাপারার থেকে এমন বেঈমানি হজম করতে পারছে না সে। পড়ার টেবিলে বসে মনে মনে সাপের মতো ফস ফস করছে বানী ঠিক তখনই তার দরজায় শব্দ হয়। নিজের জায়গায় বসে থেকেই সে বলে,
‘কে? দরজা খোলাই আছে।’
নবে হাত রেখে তা ঘুরিয়ে দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকে মাহাপারা। তার হাতে কোলবালিশ। এই সময় মাহাপারাকে এখানে দেখে ছোটখাটো একটা বিষম খায় বানী। বিস্ময়ে তার মুখ ফসকে বেরিয়ে আসে,
‘তুই এখানে!’
‘তোর সাথে ঘুমাবো।’
চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ায় বানী। আগের চাইতে আরেক ডিগ্রী বেশি অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করে,
‘তুই আমার সাথে ঘুমাবি?’
‘হ্যাঁ, সবসময়ই তো ঘুমাই। এই বাসায় রাতে থাকলে তো আমি তোর সাথেই ঘুমাই তাই না?’
খাটের দিকে এগিয়ে যেতে যেতে মাহাপারা আরও বলে,
‘তুই কি পড়ছিলি? পড়তে থাক সমস্যা নেই৷ আমার জন্য লাইট অফ করতে হবে না। আজ আমি বড্ড ক্লান্ত রে বিছানায় গা এলিয়ে দিলেই দেখবি ঘুমে তলিয়ে গেছি।’
বলতে বলতেই বিছানায় গা এলিয়ে দেয় মাহাপারা। ওহীর ঘর থেকে নিয়ে আসা কোলবালিশটা ঝাপটে ধরে চোখ বুঝে সে। বানী কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে তাকিয়ে থাকে। এসব হচ্ছেটা কি? এটা ঠিক এতকাল মাহাপারা এবাসায় এসে রাতে থাকলে এই ঘরে তার সাথেই থেকেছে। কিন্তু এতকাল থাকা আর আজ থাকার মধ্যে আকাশ-পাতাল পার্থক্য। এতদিন বেড়াতে এসেছে। আজ থেকে তো সে ওহীর বিবাহিত স্ত্রী। মাথায় কিছুই ধরে না বানীর। তবে তার ছোট্ট মনে একটা সন্দেহ বাসা বাঁধে। কোনো না কোনো একটা ঝামেলা আছে এমনটা গন্ধ পায় বানী। তার ভাই নিশ্চয়ই কিছু একটা ঘোল পাকিয়েছে। সন্দেহটা বেশ শক্তপোক্ত ভাবেই বাসা বাঁধে বানীর মনের ভেতর।

সবেই ঘরে এসেছে ওহী। কিন্তু ঘরে ঢুকেই দেখে মাহাপারা নেই। ভেবেছিল এতক্ষণে সম্ভবত ঘুমিয়ে পরেছে অথচ এখন তো দেখছে ঘরেই নেই। একবার নিজের ঘরের বাথরুম ও বারান্দায় দেখে নেয় ওহী। কিন্তু না মাহাপারা সেখানেও নেই। কার ঘরে যেতে পারে দ্রুত চিন্তা করে ওহী। হুট করেই মনে হয় এত রাতে এক বানী ছাড়া অন্য কারো ঘরে যাবে না মাহাপারা। এতরাত পর্যন্ত কেউ জেগে থাকার সম্ভাবনাও কম। এতক্ষণে সবারই ঘুমিয়ে পড়ার কথা। যদিও আজ সবার না ঘুমানোর একটা সম্ভাবনাও আছে এবং সেটা তারই ঘটনো ঘটনার কারণে। তবে আর সবাই জেগে থাক বা ঘুমাক মাহাপারা বানী ছাড়া অন্য কারো ঘরে যাবে না। ওহী ভাবে হয়ত তার আসতে দেরি হচ্ছে দেখে মাহাপারা বানী ঘরেই গিয়েছে। বানীর রুমের সামনে আসলেই দেখতে পায় ভেতরে লাইট জ্বলছে। দরজা সামান্য খোলাই আছে। একবার নক করেই হালকা করে ধাক্কা দেয় ওহী। দরজাটা খানিক খুলতেই সে বানীকে দেখতে পায়। দরজার কাছে এগিয়ে গিয়ে জিজ্ঞেস করে,
‘মাহাপারা তোর ঘরে?’
বানী চোখ দিয়ে ইশারা করলে ওহী আরও খানিকটা এগিয়ে গিয়ে রুমের ভেতরে ঢুকে দেখে মেডাম মহা আয়েশ করে বিছানায় শুয়ে গড়াগড়ি দিয়ে ঘুমাচ্ছে। দেখে মনে হয় মাত্রই শুয়েছে। পুরোপুরি ঘুমে তলিয়ে যায়নি। একটু আগে যে বিষমটা বানী খেয়েছে সেই একই বিষম এখন ওহী খেলো। মনে মনে ওহী বলে, ‘এই মাইয়া আমারে কেস খাইয়ে ছাড়বে, মাবুদ বাঁচাও।’ চট করেই নিজেকে গুছিয়ে নিয়ে ওহী বলে,
‘বাবু তুমি এখানে?’
ওহীর কন্ঠ পেয়েই হুড়মুড় করে চোখ মেলে তাকায় মাহাপারা। সবেই তন্দ্রায় চোখ লেগে এসেছিল তার। শরীরটা একদম হালকা হয়ে গিয়েছিল। এমন সময় ওহীর ডাক পেয়ে ঘুম রেখে বাস্তবে ফিরে এসে একটা ধাক্কার মতো খায় মাহাপারা। টালমাটাল লাগে তার। এগিয়ে এসে ওহী আরও বলে,
‘তুমি আমার সাথে রাগ করে এখানে চলে আসছ জান। ছিঃ, আজ আমাদের প্রথম রাত। তুমি আমার সাথে রাগ করে আলাদা থাকবা? আচ্ছা যাও সরি। আমার কথায় রাগ হইছে তোমার।’
‘কোন কথা?’
মনে মনে নিজেকে গাল দেয় ওহী। মুখে বলে,
‘চলো, ঘরে চলো বলতেছি।’
‘তোমার ঘরে কেন যাবো? আমি এখানে ঘুমাবো।’
‘আহা বললাম তো সরি। ওটা তো এখন থেকে তোমারও ঘর। চলো জান কান ধরে বলতেছি সরি।’
‘কি আবোলতাবোল বলতেছ ওহী ভাইয়া। যাও তো ঘুমাও, অনেক রাত হইছে আমাকে ঘুমাইতে দাও। এই বানী আয় আমরা ঘুমাই।’
বানীর দিকে তাকিয়ে বৃথা হাসার চেষ্টা করে ওহী বলে,
‘বুঝছি তোমার ঘুম ধরছে তাই আবোলতাবোল বলতেছ। ওকে ফাইন তোমার যাইতে হবে না আমিই নিয়ে যাচ্ছি তোমাকে।’
বলেই পাঁজা কোলে তুলে নেয় ওহী মাহাপারাকে। বানীকে উদ্দেশ্য করে কিছু না বলেই বেরিয়ে যায়। পেছনে বানী বেশ কিছুক্ষণ ভাইয়ের যাওয়ার দিকে তাকিয়ে থাকে। তার সন্দেহটা আরও পাকাপোক্ত হয়েছে ভাইয়ের এসব ন্যাকামি দেখে। তার ভাই মোটেও এমন ন্যাকা নয়। সেই মানুষটাই এমন ন্যাকামি করছে দেখেই বানীর সন্দেহটা প্রবল হয়। মানুষ যখন তার স্বভাবের বিরুদ্ধে গিয়ে কাজ করে তখনই তার প্রতি সন্দেহের জন্ম হয়। এই যেমন এই মাত্র ওহীর প্রতি বানীর মনে সন্দেহের জন্ম হয়েছে। মানলো ওরা প্রেম করে বিয়ে করেছে তাই বলে এত শো-অফ মাখা ন্যাকামি করার মানুষ ওর ভাই নয় তা বানী বেশ ভালো করেই জানে। তারউপর মাহাপারার এই ঘরে ঘুমাতে আসাটাও সন্দেহজনক। ওদের বিয়ে হয়ে গেছে তাহলে মাহাপারা কেনো এই ঘরে আসবে ঘুমানোর জন্য। কোথাও না কোথাও, কোনো না কোনো একটা গন্ডগোল তো আছেই। তার ভাই যে একটা পাঁচ মিশালি সবজি খিচুড়ি পাকাচ্ছে তা বেশ আন্দাজ করতে পারছে বানী। মায়ের তুখোড় বুদ্ধির কিছুটা নয় অনেকটাই বানী পেয়েছে। তাই বানীর চোখ ফাঁকি দেওয়াটাও ওত সহজ নয়। এতক্ষণ তো সে দুঃখ করতেই ব্যস্তছিল সেজন্য সন্দেহজনক কিছুই তার চোখে পরেনি। এখন বানীর দুঃখ ভাবটা কেটে গেছে, সেখানে জায়গা বদল করেছে সন্দেহ। কাউকে কিছু বলা যাবে না। সবার আগে সে সিওর হবে আসল কাহিনিটা কি জানবে তারপর দেখা যাবে এই বিষয়ে কত দূর কি করা যায়। আগে তো দেখতে হবে বিয়েটা কতটুকু সত্যি মনে মনে ভাবে বানী।

মাহাপারাকে ঘরে নিয়ে এসে কোল থেকে বিছানার উপর নামিয়ে দিয়ে তার বাহু ধরে ঝাঁকি দেয় ওহী ঘুম কাটানোর জন্য। মাহাপারার চোখমুখের ঘুম সম্পূর্ণ উবে গেলে ভুত দেখার মতো তাকিয়ে থাকে সে ওহীর দিকে। বুঝতে পারে না সে এখানে কীভাবে এলো? মাহাপারা নিজেই জিজ্ঞেস করে,
‘আমি তো বানীর ঘরে ছিলাম। এখানে কীভাবে এলাম?’
‘তুই ঐ ঘরে গিয়েছিলি কেন?’
‘ঘুমাবো বলে, অনেক ক্লান্ত লাগছিল।’
‘বাহ! কি সুন্দর কাজ করেছিস। সব পন্ড করে দিয়েছিস এক্কেবারে। সকালে তৈরি থাকিস নিজের বাসায় যাওয়ার জন্য।’
‘এ্যা!’
‘এ্যা না হ্যাঁ। আরে পাগল এখন আমরা বিবাহিত তুই যদি প্রথম রাতেই আমাকে রেখে বানীর সাথে গিয়ে ঘুমাস তাহলে বাকিরা তো সন্দেহ করবেই। ওদের মাথায় তো আসবেই আসলেই আমরা বিয়ে করেছি কিনা।’
বিছানার উপরেই বসা থেকে হাটুতে ভর দিয়ে বসে মাহাপারা বলে,
‘এই যা ওহী ভাইয়া কাহিনি করে ফেললাম।’
‘ব্যস ষোলো কলা পূর্ণ। বানীর সামনেও তুই আমায় ভাইয়া ঢেকেছিস।’
‘কি!’
‘কি না জি। এবার কেস খাও। তুই বানীর ঘরে কেন গেলি বলতো?’
‘ঘুমাবো বলে।’ মুখটা কাচুমাচু করে বলে মাহাপারা। এগিয়ে এসে মাহাপারার চিবুকে আঙ্গুল রেখে মুখটাকে উপরে তুলে ওহী বলে,
‘তুই এখন থেকে আমার বউ, আমার ঘরে আমার সাথে থাকবি।’
সরে গিয়ে মাহাপারা বলে,
‘তোমার কি মাথাটা খারাপ হয়ে গেছে ওহী ভাইয়া? তোমার সাথে এক বিছানায় থাকবো আমি?’
‘এখন দুই বিছানা পাবো কই আমি? এটা বাংলা সিনেমা না যে তুই খাটে ঘুমাবি আর আমি নিচে। দু’জনেই খাটে ঘুমাবো, বুঝলি?’
‘একসঙ্গে?’
‘হ্যাঁ একসঙ্গে, পাশাপাশি।’
‘অসম্ভব।’
‘কেন অসম্ভব?’
‘তুমি বুঝতেছ না কেন? একসাথে ঘুমাইলে অনেক সমস্যা আছে।’
‘কিসের সমস্যা? বরং একসাথে না ঘুমাইলেই সমস্যা।’
‘একসাথে না ঘুমাইলে আবার কিসের সমস্যা?’
‘এই যেমন ধর যখন তখন যে কেউ ঘরে চলে আসতে পারে তখন যদি দেখে আমরা একজন খাটে আরেকজন নিচে ইন শর্ট আমাদের ঘরের ভেতর বাংলা সিনেমা চলতেছে তখনই কেস খেয়ে যাবো। তাই ঘুমাবো আমরা দু’জন একসাথে, এক বিছানাতেই।’
‘ওহো ওহী ভাইয়া।’
‘দেখ মাহা…’
‘আবার তুমি আমাকে মাহা ডাকছ?’
‘তাহলে তুই আমাকে বারবার ভাইয়া ঢাকতেছিস কেন? আমি তোর কোন জন্মের ভাই রে?’
‘ওমা জন্মের পর থেকেই তো ভাইয়া ডাকতেছি তোমাকে।’
‘সেটা ডাকলে ডাকছিস আগে। কিন্তু এখন আর আমি তোর ভাইয়া নাই, ছাইয়া হয়ে গেছি। দু’দিন পর বাচ্চার বাপ হবো আর তুই আমাকে ভাইয়া ডাকতেছিস।’
‘কি বললা তুমি? কি হবা?’
‘ঐটা কথার কথা। তা যাই বা নাই হই এখন থেকে একদম ভাইয়া ডাকবি না বলে দিলাম।’
‘সময় লাগবে এভাবে দুম করেই কি এতদিনের অভ্যাস ছেড়ে দেয়া যায় নাকি।’
‘ওকে ফাইন আমারও সময় লাগবে মাহা ডাক ছাড়তে। তবে আর যাই করিস বাসার কারো সামনে এমন ভাইয়া ডাকিস না প্লিজ। তুই নিজে তো কেস খাবি খাবিই আমাকেও খাওয়াবি। আম্মু একবার সন্দেহ করলে সব শ্যাষ।’
‘আচ্ছা আচ্ছা আর বলতে হবে না। ডাকব না ভাইয়া। তুমিও মাহা ডাকবা না।’
‘সে দেখা যাবে। এখন চল শুয়ে পরি। বাকি কথা শুয়ে শুয়ে বলবো। বড্ড ক্লান্ত লাগছে রে।’
মাহাপারা একবার বিছানার দিকে তাকিয়ে আরেকবার ওহীর দিকে তাকায়। তারপরেই তার মনে পরতেই মাথায় হাত দিয়ে বলে,
‘এই যা তোমার কোলবালিশটা তো আমি বানীর ঘরে রেখে চলে এসেছি। যাও ওটা নিয়ে আসো।’
‘কোলবালিশ দিয়ে কি হবে?’ শুতে শুতে জিজ্ঞেস করে ওহী।
‘মাঝখানে দিয়ে ঘুমাবো।’
‘এ্যা যত্তসব নাটক। লাইফটাকে বাংলা সিনেমা বানায় ছাড়বি তাই না? চুপচাপ এসে শুয়ে পর বলছি আর নাটক করিস না। বানীকে কনভেন্স করতে হবে ভুলে গেলি অলরেডি একটা ব্লান্ডার করে ফেলেছিস। বানীটা হয়েছে একদম আম্মুর মতো চট করেই ধরে ফেলতে পারে কোথায় কি হচ্ছে। ও নিশ্চয়ই সন্দেহ করেছে আমাদের। এখন কোলবালিশ আনতে গেলে ওর সন্দেহটা বাড়বে, বুঝলি?’
অসহায় ভাব করে বাধ্য হয়েই বিছানায় এসে বসে। মাহাপারা এসে বসতেই চট করে শোয়া থেকে উঠে বসে নিজের গায়ের শার্টটা খুলে ফেলে ওহী। তা দেখে কিছুক্ষণ ভুত দেখার মতো তাকিয়ে থেকে ওহীর উন্মুক্ত বুকের দিকে তাকিয়ে একবার ঢোক গিলে মাহাপারা বলে,
‘শার্ট খুলছ কেন?’
‘শার্ট গায়ে দিয়ে ঘুমাতে পারি না আমি।’
‘ছিঃ!’ বলে নাক ছিটকায় মাহাপারা। তা দেখে ভ্রু কুচকে ওহী বলে,
‘এখানে ছিঃ এর কি হলো?’
‘তুমি আমার পাশে এমন আধা ন্যাংটা হয়ে ঘুমাবা?’
‘আরে ন্যাংটা কই? ট্রাউজার তো পরাই আছি।’
বলেই হেসে ফেলে ওহী মাহাপারার লজ্জা পাওয়া দেখে। হেসে নিয়ে বলে,
‘যা আমার ড্রয়ার থেকে একটা টি-শার্ট এনে দে উঠতে মন চাইছে না।
‘তুুমি নিজে গিয়ে নিয়ে আসো। আমি আনবো কেন?’
‘কারণ তুই আমার বউ। আমার সব এখন থেকে তুই করবি।’
‘এ্যা, আসছে। পারব না আমি।’
‘ওকে ফাইন। না দিলে নাই, আমি এমনিই ঘুমাইলাম। পরে বলিস না ন্যাংটা হয়ে ঘুমাইছি তোর সাথে।’
‘ওহো!’ বিরক্ত হয়েই উঠে যায় মাহাপারা। একটা টি-শার্ট এনে ওহীর দিকে ছুড়ে মারে। টি-শার্ট পরে ওহী শুয়ে পরে বলে,
‘লাইট টা অফ করে দিয়ে শুয়ে পর মাহা, অনেক রাত হয়েছে।’
‘আবার মাহা বলছ?’
‘ভুলে মুখ ফসকে বেরিয়ে গেছে রে।’
মাহাপারা আর কথা বাড়ায় না৷ জানে ওহী ঘাড়ত্যাড়া এর সাথে কথা প্যাঁচিয়ে লাভ নেই। একে পরে দেখে নিবে ভেবে আপাতত ক্ষ্যান্ত দেয়। রুমের লাইট নিভিয়ে দিয়ে এসে ইয়া নাফসি জপতে জপতে ওহীর থেকে দূরত্ব বজায় রেখে শুয়ে পরে মাহাপারা। উপরের সিলিঙের দিকে তাকিয়ে থেকে মাহাপারা জিজ্ঞেস করে,
‘ঘুমায় পরছ?’
‘উঁহু,’
‘তুমি কিন্তু আমার গায়ে হাত পা দিবা না বলে দিলাম।’
‘সজ্ঞানে দিব না সিওর থাক। কিন্তু ঘুমিয়ে পরার পর তো আমার নিজের উপর নিয়ন্ত্রণ থাকবে না। তখন হাত পা দিয়ে দিলে আমার কোনো দোষ নেই।’
‘একদম না বলছি। হাত-পা নিজের জায়গায় রাখবা।’
‘এমনও তো হতে পারে আমি না বরং তুই আমাকে ঘুমের মধ্যে ঝাপটে ধরলি।’
‘কখনো না। আমি অনেক সুন্দর করে ঘুমাই।’
‘আচ্ছা সে দেখা যাবে। এখন ঘুমা সকালে আমার অফিস আছে। বিয়ে করেছি বলে তো চাকরী বাকরী লাটে উঠে যায়নি। আর মনে আছে তো? একদম বাড়ির বউয়ের মতো আচরণ করা যাবে না কিন্তু।’
‘আমার চরিত্র মনে আছে। তুমি চিন্তা করো না, ঘুমাও।’
‘হ্যাঁ সেই নমুনা দেখা হয়ে গেছে আমার। সকালে যেভাবেই হোক বানীকে কনভিন্স করবি আমাদের কথা কাটাকাটি হয়েছিল। আমার কথায় রাগ করে ওর ঘরে গিয়েছিলি তুই। ঠিক আছে?’
‘হু, ঠিক আছে।’
মুখে ঠিক আছে বললেও মনে মনে শঙ্কিত মাহাপারা। সে ঠিকঠাক পারবে তো ম্যানেজ করতে। এসব চিন্তা মাথায় ভর করতেই চোখের ঘুম পালিয়ে যায় তার। বেশ কিছুক্ষণ চোখ বন্ধ করেও উপায় হয় না। চোখে ঘুম নামে না। আচমকাই মাহাপারা অনুভব করে কিছু একটা তার পেটের কাছে হাটাহাটি করছে। চিৎকার দিতে নিয়েও নিজেকে সামলে নেয় সে। টের পায় সেটা ওহীর হাত। শুয়ে থাকায় মাহাপারার পেটের কাছের খানিকটা গেঞ্জির অংশ সরে গেছে। ওহীও অনেকটা তার দিকে চেপে এসে গা ঘেষেছে। কখন যেন তাকে ঝাপটে ধরে ধরে অবস্থা। বিছানা ছেড়ে উঠে যাবে ভাবতে ভাবতেই ওহী সত্যি সত্যি মাহাপারার পেটের দিকে হাা
ত বাড়িয়ে জড়িয়ে ধরে তাকে। বেশ শক্ত ভাবেই জড়িয়ে ধরেছে। কাছাকাছি এসে মাহাপারার কানের কাছটায় মুখ গুঁজে দিয়েছে। সুর সুর লাগছে মাহাপারার। দম বন্ধ হয়ে আসছে। না পারছে নিজেকে ছাড়াতে আর না পারছে সরে যেতে। এভাবে বেচারীর আরও ঘুম আসবে না। ঘুমের মাঝেই ওহী তার একটা পা মাহাপারার পায়ের উপর তুলে দিয়ে আলতো করে পায়ের পাতা ঘষে দেয়। মাহাপারা পা সরিয়ে নেয়ার চেষ্টা করে কিন্তু তা বিফলে যায়। ইতোমধ্যে হাত-পা ঠান্ডা হয়ে এসেছে মাহাপারার। শুকনো গলায় ওহীকে ডাকে সে,
‘এ…এই, ভাই…ভাইয়া, থুক্কু এই শুনো না।’
কিন্তু কিসের কি? ওহী রাজ্যের ঘুমে তলিয়ে আছে। সমুদ্রের চাইতেও গভীর সে ঘুম।
হাজার ডাকলেও উঠবে বলে মনে হয় না। বাধ্য হয়েই চোখ-মুখ খিস্তি মেরে শুয়ে থাকে মাহাপারা। ঘুমিয়ে পরার প্রাণপণ চেষ্টা করে।

চলবে…

#নেশা_লাগিল_রে। পর্ব-৬
লেখক- ইতি চৌধুরী
(কোনো ক্রমে কপি করা যাবে না।)

ঘাপটি মেরে শুয়ে থেকেই কখন ঘুমিয়ে পরেছে মাহাপারা নিজেও জানে না। নড়াচড়া থেমেছে টের পেয়ে এবারে চোখ মেলে তাকায় ওহী। তাকিয়ে দেখে মাহাপারা ঘুমিয়ে পরেছে। সত্যি সত্যি ঘুমিয়েছে কিনা পরীক্ষা করার জন্য চোখের উপর আলতো করে ফু দেয়। ফুয়ের তোড়ে চোখের আশেপাশের কয়েকটা চুল উড়ে গিয়ে জায়গা বদল করে। মাহাপারা নড়ে না, তাকায়ও না। এবারে ওহী সিওর হয় সত্যি সত্যিই ঘুমিয়ে পরেছে। ডান হাতে মাথার ভার দিয়ে পাশ ফিরে মাহাপারার মুখের দিয়ে তাকিয়ে থাকে ওহী। চোয়াল জুড়ে বিস্তৃত হাসি ভাব। কতদিনের সাধ তার মাহাপারাকে নিজের করে পাওয়ার। আজ সত্যি সত্যি তার মাহা তার পাশেই শুয়ে আছে তাও পূর্ণ অধিকার নিয়ে। এখনো বিষয়টা পুরোপুরি বিশ্বাস করে উঠতে পারছে না ওহী নিজেই। এমন একটা ঘটিয়ে ফেলেছে সে তার নিজেরও বিশ্বাস হয় না। খানিক সময় নিয়ে মাহাপারার মুখের দিকে তাকিয়ে থেকে তাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে ওহী। তৎক্ষনাৎই খেয়াল হয় মাহাপারা উঠে যায় কিনা কিন্তু ঘুম ভাঙে না বরং ঘুমের ঘোরেই এগিয়ে এসে মাহাপারা নিজেও ওহীকে জড়িয়ে ধরে। হয়ত কোলবালিশ মনে করে খুব শক্তভাবেই পা ও হাত বাড়িয়ে জড়িয়ে ধরেছে। এবার আর ওহীকে কে পায়। মনের আনন্দে আলতো করে মাহাপারার কপালে একটা ছোট্ট চুমু খায় সে। প্রিয়তমাকে দেয়া তার উষ্ণ ঠোঁটের প্রথম স্পর্শ। তারপর মাহাপারাকে বুকের সাথে জড়িয়ে রেখেই ঘুমিয়ে পরে সেও।

সকালে যখন এলার্মের শব্দে ওহীর ঘুম ভাঙে। তখন টের পায় মাহাপারা বিছানা রেখে তার উপরে চলে এসেছে পুরোপুরি। চোখ মেলে তাকাতেই হাসি পেয়ে যায় তার। যে কিনা বলেছিল তার গায়ে হাত পা তুলে না দিতে সে নিজেই সম্পূর্ণ শরীর নিয়ে তার উপরে উঠে এসেছে। এই মুহূর্তটাকে ক্যাপচার করা প্রয়োজন। কঠিন ঘুম ঘুমিয়েছে মাহাপারা এলার্মের শব্দেও তার ঘুম ভাঙছে না। এই সুযোগটাই কাজে লাগায় ওহী। ডান হাতটা নাড়াতে পারছে না তাই বাম হাত বাড়িয়েই মাথার নিচের বালিশের পাশ ঘেষে থাকা মোবাইলটা হাতে নেয় সে। নিয়েই পটাপট কয়টা ছবি তুলে ফেলে। এবারে বিছানা ছেড়ে উঠতে নিয়ে বেশ ঝামেলা পোহাতে হয় তাকে। সে যতই ধাক্কা দেয় কিন্তু মাহাপারা সরে না। একটু মোচড়ামুচড়ি করে সেই আগের মতোই শুয়ে থাকে। বাধ্য হয়ে শেষমেশ ধাক্কা দিয়ে ঠেলে ফেলে দেয় ওহী মাহাপারাকে। মেয়ের কি ঘুম রে বাবা! জোরে ধাক্কা খেয়েও মাহাপারার ঘুম ভাঙে না। ঘুমের ঘোরেই হাতড়ে ওহীর বালিশটা নিয়ে তা শক্ত করে জড়িয়ে নেয়। পাশে বসে এসব কান্ড দেখে খানি হেসে নেয় ওহী। মনে মনে নিজেকে বলে, ‘একখান পিস নিয়া আসছি আমি আমার জন্য। কপালে অনেক খারাপ আছে রে ওহী। এই মেয়ে তোর রক্ত চুষে খাবে আজীবন, গেট রেডি।’
আর অপেক্ষা করে না ওহী। এই বাসায় সকাল ৭ টায় সকালের নাস্তা খেয়ে যার যার কাজে বেরিয়ে যায় বাড়ির ছেলেরা। রেডি হয়ে ওহী একা খাবার টেবিলে এলে তার দিকে সবাই-ই একবার আড় চোখে তাকায়। তাকে একা দেখে সবারই মনে প্রশ্ন জাগে মাহাপারা কোথায়? কিন্তু কেউই মুখে জিজ্ঞেস করে না কিছু। যেখানে শশুর-শাশুড়ী দু’জনেই সামনে সেখানে ছেলের বউরা প্রশ্ন করার সাহস পায় না। তবু অনেকটা সময় চলে যাওয়ার পর। ওহীর নাস্তা প্রায় শেষের দিকে তখন বাধ্য হয়েই বড় বউ তাইয়েবা জিজ্ঞেস করে,
‘মাহাপারা কোথায় ওহী?’
চায়ের কাপে একটা টান দিয়ে ওহী বলে,
‘ঘরে ভাবী।’
‘ও নাস্তা করবে না?’
‘ও তো ঘুম থেকেই উঠে নাই নাস্তা কি করবে। ও কি এত সকালে ওঠে নাকি। উঠবে মহারাণী নিজের সময় মতো। তখনই খেয়ে নিবে। ওকে নিয়ে চিন্তা করো না।’
এমন কথার পর আর কেউ রা শব্দ করে না। বাকি তিন ছেলের বউয়ের একজনও এই বাসায় আসার পর ফজরের নামাজের পরে আর ঘুমায়নি। আর মাহাপারা এসে প্রথমদিনেই নিয়মের বাইরে গিয়ে কাজ করে ফেলেছে। তিন বউয়ের তিনজনই মনে মনে আচ করতে পারে এই মেয়ে সামনে আরও বিশাল বিশাল কান্ড ঘটাবে। এই বাড়ির এতদিনকার নিয়ম কানুনের চৌদ্দটা বাজিয়ে ছাড়বে। টেবিলে উপস্থিত কেউ আর মাহাপারা বা তার ঘুম বিষয়ে আর কোনো কথা বলে না। প্রতিদিনকার মতো যে যার যার মতো কাজে বেরিয়ে পরে।

মাহাপারার ঘুম ভাঙে সকাল দশটায়। যদিও তার আসলে ঘুম ভেঙেছে ৯ টায়। কিন্তু ওহী বলে দিয়েছে আজ যেন সে সকাল ১০ টার আগে ঘর থেকে না বের হয়। মাহাপারা কখনোই এত লেইট করে ঘুম থেকে উঠে না। প্রতিদিনই তার সকাল হয় ৮ টায়। গতকালকের এত ধকলের পর আজ একঘন্টা বেশি ঘুমিয়েছে সে। তাও তাকে আরও একঘন্টা শুয়ে থাকতে হবে ঘুমের ভান করে। ঘড়ির কাটায় যখন ঠিক সকাল ১০ টা বাজে তখন বিছানা ছেড়ে নামে মাহাপারা। পরনের ট্রাউজার ও টি-শার্ট গায়েই রুম থেকে বেরিয়ে ডাইনিং-এ যায় সে। এই সময়টায় বউয়েরা রান্নার কাজে ব্যস্ত থাকে। ডাইনিং এর সাথে লাগোয়া কিচেন। এগিয়ে এসে কিচেনের সামনে দাঁড়িয়ে মাহাপারা বলে,
‘গুড মর্নিং।’
তিনজনই যার যার হাতের কাজ রেখে মাহাপারার দিকে তাকায়। তন্মধ্যে তাইয়েবা বলে,
‘এতক্ষণে তোর সকাল হলো?’
বিনিময়ে জবাব না দিয়ে কেবল হাসে মাহাপারা। তাইয়েবা আরও বলে,
‘টেবিলে বোস নাস্তা দিচ্ছি।’
‘আজ নাস্তায় কি ভাবী?’
‘ঘি দিয়ে ভাজা পরোটা আর মিক্সড সবজি।’
‘এ মা সকাল সকাল এত ঘি, তেল খাওয়া অসম্ভব। ব্রেড নেই বাসায়?’
‘আছে।’
‘আমাকে ২ পিস ব্রেড দাও আর একটা ডিম পোচ। ওহ হ্যাঁ, সঙ্গে একটা ব্লেক কফি। একদম চিনি দিবা না। আমি গিয়ে চট করে শাওয়ার নিয়ে আসছি।’
বলেই দ্রুত পদক্ষেপে সেখান থেকে সরে যায় মাহাপারা। এর আগেও সে এই বাসায় থেকেছে। কিন্তু কখনো কেউ তাকে নাস্তা বা খাওয়া নিয়ে এমন নাটক করতে দেখেনি। আজই হয়ত প্রথম মাহাপারা খাওয়া নিয়ে এমন ট্যানট্রাম দেখালো। নিজের ঘরে ফিরে এসেই বুকে থুতু ছিটায় মাহাপারা। হরহর করে বলে দিয়ে চলে এসেছে সে। তিন ভাবীর কেউ একজন যদি ধমকে দিতো তাহলে সেখানেই ভ্যা ভ্য করে কেঁদে ফেলতো। ভাগ্যিস কেউ কিছু বলেনি তাকে।

শাওয়ার নিয়ে একেবারে রেডি হয়ে বেরিয়েছে মাহাপারা। পরনে তার জিন্সের সাথে কামিজ ধরনের সিঙ্গেল টপস আর গলায় স্কার্ফ প্যাঁচানো। ভেজা চুল ছেড়ে রেখেছে সে। নাস্তার টেবিলেই তাইয়েবা জিজ্ঞেস করে,
‘কোথাও যাবি তুই?’
‘ইউনিভার্সিটি যাবো ভাবী। ক্লাস আছে।’
‘তুই লেখাপড়া কন্টিনিউ করবি?’
‘ওমা সেকি কথা! কন্টিনিউ করব মানে? লেখাপড়া বন্ধ করে ঘরে বসে থাকার মতো কিছু হয়েছে নাকি?’
মাহাপারার এমন প্রশ্নে খানিক বিব্রত হয় তাইয়েবা। বলে,
‘না, তেমন কিছু হয়নি তবু একবার মাকে জিজ্ঞেস করে নিস বের হওয়ার আগে।’
‘খালামনিকে কি জিজ্ঞেস করবো? তোমার কি মনে হয় সে আমাকে বারন করবে লেখাপড়া করতে? কখনোই না।’
পাশ থেকে খানিক খোঁচার সুরে মরিয়ম বলে,
‘ওহী জানে?’
‘ওহী ভাই থুক্কু তোমাদের দেবর সবই জানে। প্রেম তো আর দু’দিন ধরে করছি না বরং বিয়ে হলো ১ দিনও হয়নি। আমার ইচ্ছা, স্বপ্ন, ভালো লাগা, চাওয়া সম্পর্কে সে সবই জানে।’
কফির মগে শেষ টান দিয়ে পাশে রাখা ব্যাগপ্যাক কাঁধে তুলে নিয়ে হনহনিয়ে বেরিয়ে যায় মাহাপারা তিনজনের চোখের সামনে দিয়ে। এমনকি সালমা বেগমকেও জানায় না। কিছু জিজ্ঞেস করা তো দূরে থাক। মাহাপারা ভালো করেই জানে বড় ভাবী কেন তাকে বারবার করে বলছিলেন খালামনি মানে শাশুড়ীকে বলে নিতে। তাইয়েবা যখন বিয়ে হয়ে এই বাড়ি আসে তখন অনার্স শেষ করে মাস্টার্সে ভর্তি হয়েছিল সবে। বিয়ের পরে পড়া কন্টিনিউ করতে পারবে কি পারবে না এসব বিষয়ে বিয়ের কথা চলার সময় কোনো কথা দুইপক্ষের কেউই বলেননি। তাইয়েবার পরিবার হয়ত ভেবেছিল বর্তমান সময়ে সবাই লেখাপড়াকে বেশ প্রায়োরিটি দেয় হয়ত তার লেখাপড়াও গুরুত্ব পাবে। কিন্তু তাইয়েবার ভুলটা ভাঙে বিয়ে করে এই বাড়িতে পা রাখার পর। বিয়ের সপ্তাহ খানিক বাদে যখন সব অনুষ্ঠান শেষ হয় ক্লাসের জন্য একদিন বিকালে তৈরি হলে সালমা বেগম তাইয়েবাকে নিজের ঘরে ডেকে পাঠিয়ে বলেছিলেন, ‘যা পড়ালেখা করেছ তাই যথেষ্ট। অনেক পড়েছ আর বইখাতা নিয়ে পড়ালেখার প্রয়োজন নেই। আমাদের বাড়ির বউরা বাইরে গিয়ে চাকরী বাকরী করে না। সংসার সামলানোর জন্য এত বেশি লেখাপড়া লাগেও না। তাই যা পড়েছ তাই অনেক আর দরকার নেই।’ সেদিন শাশুড়ীর মুখের উপর কোনো প্রতিবাদ করেনি তাইয়েবা। ভাগ্যিস তার অনার্সটা শেষ হয়ে গিয়েছিল নাহলে মাঝ পথেই সব ছেড়ে দিতে হতো তাকে। শাশুড়ীর কথায় কষ্ট পায়নি তাইয়েবা। সালমা বেগম অনেকটা সেকেলে চিন্তা-ভাবনা পোষণ করা মানুষ তা সবাই জানে। তাই তার আপত্তির কথায় একদমই কষ্ট পায়নি তাইয়েবা। তার কষ্টটা নিজের স্বামী রিসালাতকে নিয়ে। সে ভেবেছিল স্বামীকে বললে সে মাকে বুঝিয়ে বলবে বিষয়টা। চাকরী না করুক তাও অল্প একটু পড়া বাকি, মাত্র দেড়টা বছর তাকে শেষ করতে দেয়া হোক কিন্তু এসব শুনে সেদিন রাতে রিসালাত বলেছিল, ‘আম্মা ঠিকই বলছে তাইয়েবা। কি দরকার তোমার এত লেখাপড়া দিয়ে? সংসার করতে, রান্নাবান্না করতে, বাচ্চা জন্ম দিতে, বাচ্চা পালতে সার্টিফিকেট লাগে না। আমরা কি কাজের লোক রাখার সময় দেখি তাদের অনার্স-মাস্টার্স এর সার্টিফিকেট আছে কিনা? কাজ কতটুকু ভালো তা দেখি। তোমারও সংসার করতে এসব ডিগ্রীর প্রয়োজন নেই। আম্মা ঠিকই বলছে মাথা থেকে এসব লেখাপড়ার ভুত নামায় মন দিয়ে সংসার করো। তুমি বাড়ির বড় বউ এটা মাথায় রাখবা সবসময়, সবার বড় তুমি। তোমাকে দেখে ছোটরা শিখবে। সংসারে মন দাও বুঝলা।’
আজ পর্যন্ত তাইয়েবা শাশুড়ীকে তোয়াজ করে চললেও সেদিনের এই ঘটনা সে জীবনেও ভুলবে না। রিসালাতের দেয়া এই আঘাত কখনো তার মন থেকে মুছবে না। এত বছরের সংসার তার রিসালাতের সাথে তবু মনে হয় কোথায় যেন সম্পর্কের গিটটা মজবুত নয়। ছেড়া সুতা আলগা গিট দিয়ে বাঁধা হয়েছে। মনের মিল ব্যতীতই একটা সম্পর্ক তারা বয়ে বেড়াচ্ছে বছরের পর বছর।
তাইয়েবা মাহাপারার যাওয়ার পথের দিকে তাকিয়ে থাকলে এগিয়ে এসে তার কাঁধে হাত রাখে খাদিজা। বলে,
‘সেদিন তুমি এমন করে বলতে পারলে হয়ত আজ এভাবে আফসোস করা লাগত না ভাবী।’
‘হু’ বলে একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে তাইয়েবা। তার এই একরত্তি দীর্ঘশ্বাসের সাথে মিশে আছে এক জীবন সমান না পাওয়ার বিষাদ।

চলবে…