#নেশা_লাগিল_রে। পর্ব-৭
লেখক- ইতি চৌধুরী
(কোনো ক্রমে কপি করা যাবে না।)
মাহাপারা কলেজে গেছে এই খবর সালমা বেগম পেয়েছেন দুপুরের খাবার খেতে বসে। যেই প্লেটের ভাত মেখে প্রথম লোকমাটা মুখে তুলেছেন পাশ থেকে বড় বউ তাইয়েবা বলে ওঠে,
‘মাহাপারাটা কখন কলেজ থেকে আসবে কে জানে।’
এক মুহূর্তের জন্য হাত টললেও লোকমাটা মুখে পুরে নেন তিনি। মুখের ভাত চিবিয়ে নিয়ে বলেন,
‘আসার সময় যখন হবে তখন ঠিকই চলে আসবে।’
শাশুড়ির কথা শুনে খাবার টেবিলে উপস্থিত কেউ আর রা শব্দ করে না। তবে তাইয়েবা মনে মনে একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে। অতীতে তার সাথে হওয়া অন্যায়টা বুকের ভেতর হাহাকার সৃষ্টি করেছে নতুন করে। ভুলে যাওয়া কষ্ট আবার তাতিয়ে উঠেছে নয়া উদ্যমে। এসব কষ্ট কেউ চাইকেও ভুলতে পারে না। তবু নিজেকে সামলে নেয় তাইয়েবা। কোনো কিছুর জন্য তো আর জীবন থেমে থাকে না। তার ভাগ্য সে মেনে নিয়েছে আরও অনেক বছর আগেই। পরাজয় স্বীকার করে নিয়ে এতবছর পর বিদ্রোহ করার কোনো যু্ক্তি খুঁজে পায় না। তাই বিদ্রোহ করার কথা সে ভাবছেও না।
খাওয়া দাওয়ার পর ভাত ঘুম দিবে বলে সবেই বিছানায় গা এলিয়ে দিয়েছেন সালমা বেগম। তন্দ্রায় চোখ ঠিকঠাক বন্ধও হয়নি ওমনি তার ঘরের দরজায় টোকা দিয়ে নব ঘুরিয়ে দার ঠেলে ভেতরে প্রবেশ করে তাইয়েবা। বড় বউকে দেখে পুরোপুরি চোখ মেলে তাকান তিনি। শাশুড়ির দৃষ্টি দেখেই তাইয়েবা বুঝে যায় সে জানতে চায় হঠাৎ এই অসময়ে এঘরে আগমনের কারণ কি। তাই শাশুড়ি মুখ খুলে প্রশ্ন করার আগেই তাইয়েবা জবাব স্বরূপ বলে,
‘বড় জেঠিমা এসেছেন।’
বড় জায়ের কথা শুনেই শোয়া রেখে হুড়মুড়িয়ে উঠে বসেন সালমা বেগম। গায়ের উপর আয়েশ করে টেনে রাখা নকশি কাঁথাটা ছো মেরে ফেলে দিয়ে বিছানারা ছেড়ে উঠে পড়েন তিনি। উঠে গায়ের শাড়ি-কাপড় টেনেটুনে ঠিকঠাক করে নিয়ে মাথায় আঁচল টেনে দ্রুত সামনের দিকে কদম ফেলে নিজর ঘর থেকে বেরিয়ে যান। তার পেছন পেছন ব্যস্ত ভঙ্গিতে তাইয়েবাও ছুটে।
ড্রইং রুমে প্রবেশ করতেই সালমা বেগম দেখতে পান আলিশান সোফায় আয়েশ করে বসেছেন তার বড় জা ডলি খাতুন। নিয়াজ গনিদের পাঁচ ভাইয়ের মধ্যে সবার বড় রহমত গনির স্ত্রী ডলি খাতুন। এই পরিবারের সবার বড় সে। সবাই তাকে যথেষ্ট সমিহ করেন সেই সঙ্গে তোয়াজ করে চলেন। স্বভাবের দিক দিয়ে যথেষ্ট ঠোঁট কাটা মহিলা। সে কথা বললে সামনে যে থাকবে তারই বুক কাঁপবে উনার কর্কশ কন্ঠ শুনে। মায়াদয়া নেই বললেই চলে। তার নিজের তিন ছেলে। তিন ছেলে বউয়েরা সর্বক্ষণই তার আতংকে সটান হয়ে থাকে। তুলনা করতে গেলে ডলি খাতুনের তুলনায় সালমা বেগম যথেষ্ট ভালো। তার বউরা তাকে ভয়ডর করলেও অনেক ক্ষেত্রেই দিল খুলে কথা বলতে পারে। এটা কম নয় তাদের জন্য। ডলি খাতুনের পুত্রবধূরা তা কল্পনাও করতে পারেন না। এই পরিবারের অতীত ইতিহাসটাই অন্যরকম, অন্যান্য পরিবার, বংশ থেকে অনেকটাই আলাদা। শাশুড়ির মুখের উপর কখনোই ছেলের বউয়েরা টু শব্দ করেনি। এই ধারাবাহিকতাই ধরে রাখার চেষ্টায় আছেন ডলি নিজেও। সালমা বেগমও অবশ্য কম যায় না। আজ অব্দি সে সংসার, স্বামী, ছেলেপুলেদের নিজের হাতের মুঠোয় করে রেখেছেন।
এগিয়ে এসে সালাম জানিয়ে পাশে বসে আলতো আলিঙ্গন করেন সালমা বেগম বড় জায়ের সাথে। তৎক্ষনাৎই বড় বউকে চোখে ইশারা করতেই তাইয়েবা মরিয়মকে সঙ্গে নিয়ে বেরিয়ে যায় সেখান থেকে। রান্না ঘরে ঢুকেই নিজে চায়ের হাড়ি হাতে নেয় আর মরিয়মকে বলে,
‘জলদি মাহাপারাকে ফোন করে বাসায় আসতে বল।’
‘কিন্তু ও তো কলেজে ক্লাস করছে।’
‘ফোন দিয়ে বল আজ ওর ক্লাস চুলায় যাক। জেঠিমা যদি শুনে প্রথমদিনই ঢ্যাং ঢ্যাংগায়ে কলেজে চলে গেছে তাহলে বুঝতে পারছিস আম্মাকে কত কথা শুনতে হবে?’
‘শুনুক। কেউ তো আছে।’
‘মানে?’ অবাক হয় তাইয়েবা।
‘মানে সহজ ভাবী। যার ভয়ে আমরা সটান হয়ে থাকি ২৪ ঘন্টা তাকেও ভয় দেখানোর, শাসন করার কেউ আছে।’
‘বাজে বকিস না তো। জলদি ফোন কর মাহাপারাকে।’
অনিচ্ছা স্বত্তেও মরিয়ম ফোন আনতে নিজের ঘরের দিকে পা বাড়ালে তাইয়েবা জিজ্ঞেস করে,
‘কোথায় যাচ্ছিস?’
‘ফোনটা ঘরে, নিয়ে আসি।’
‘ওহ আচ্ছা, জলদি কর।’
জোরে একটা শ্বাস ছেড়ে ফোন আনার উদ্দেশ্যে বেড়িয়ে যায় মরিয়ম।
সামান্য কুশলাদি বিনিময়ের সময় সালমা বেগম বলেন,
‘হঠাৎ কোনো খবর না দিয়ে…’
তাকে আর কথা শেষ করতে দেন না মহিলা। ছো মেরে সালমা বেগমের মুখের কথা কেড়ে নিয়ে বলেন,
‘কেন? তোমাদের বাসায়য় আসার আগে বুঝি এপয়েন্টমেন্ট নিয়ে আসতে হবে? তোমাদের ভাত ঘুমে বিরক্ত করে ফেললাম বুঝি।’
‘আরে না ভাবী তেমন কিছুু না।’
কিঞ্চিৎ মুখ বাকান মহিলা তারপরেই সরাসরি মূল প্রসঙ্গে চলে যান তিনি তার হঠাৎ আগমনের। বলেন,
‘তোমার নাকের নিচ দিয়ে এমন একটা ঘটনা কীভাবে ঘটে গেল নিয়াজের বউ? বলি চোখ নাক কি সব বন্ধ করে রাখো নাকি আজকাল? এইজন্যই আমি সবসময় বলি ছেলেমেয়ের ঠিকঠাক শাসন করবে। একদম আদর, দরদ দেখাবে না। শাসন না করলে ছেলেপুলে নষ্ট হয়ে যায় প্রমাণ পেলে তো হাতে নাতে। দেখলে তো এখন কি কান্ডটা ঘটিয়ে বসেছে।’
সালমা বেগম আমতা আমতা করেন কি বলবেন বুঝে উঠতে পারেনো না। ডলি খাতুন নিজেই বলে চললেন,
‘আম্মার থেকে কি শিখলা বলো তো নিয়াজের বউ। হায় হায় আমাদের বংশের ছেলে এভাবে একলা একলা কাজি অফিসে গিয়ে বিয়ে করে এত বড় সাহস! তুমি ছেলেরে শাসন করো নাই বলেই তার কলিজা এত বড় হয়ে গেছে। আবার সেই ছেলে, ছেলের বউ তুমি ঘরে তুলছ। আম্মা বাঁইচা থাকলে ঝাটা দিয়ে পিটায় বাইর করে দিত। তুমি বইলাই ঘরে তুলছ আদর দেখায়। এই আদর না কাল তোমার ঘরে বিপদ ডাকে। দেইখো এরপর তোমার মেয়ে না একি কাজ করে বসে। বড়দের দেখেই ছোটরা শিখে বুঝলা। সময় থাকতে মেয়েরে টাইট দিও বুঝলা। আমার কথা শক্ত শুনাইলেও মন্দ বলি না আমি।’
সালমা বেগম কেবল মাথা ঝাকিয়ে সম্মতি জানিয়ে সব মেনে নেয়। তখনই ট্রেতে করে পানি ও শরবত নিয়ে ড্রইং রুমে আসে খাদিজা। এক গ্লাস শরবত জেঠির দিকে বাড়িয়ে দিলে তা হাতে নিতে নিতে একবার খাদিজাকে আপাদমস্তক চোখ বুলিয়ে নেন ডলি খাতুন। ট্রে নিয়ে আসতে আসতে তার মাথার ঘোমটা টা পরে গিয়েছে। তা দেখে শরবতের গ্লাসে একটা চুমুক দিয়ে ডলি খাতুন বলেন,
‘শরম হায়া কি সব বেঁচে ফেলছ নাকি আদব কায়দা সব পানিতে গুলায় খেয়ে ফেলছ।’
আচমকা জেঠি শাশুড়ির কথায় তাজ্জব বনে যায় খাদিজা। তার ঠিক কোথায় ভুল হয়েছে বুঝে উঠতে পারে না। মনে মনে ভাবে আগে কি পানি দেয়া উচিত ছিল? কিন্তু শরবত আগে দেয়ায় কি কেউ এভাবে রিয়্যাক্ট করবে? ভেবে পায়না বেচারি। অবাক নয়নেই শাশুড়ির মুখের দিকে তাকালে তিনি চোখের ইশারায় বুঝিয়ে দেয় তার ঘোমটা পরে গেছে। সঙ্গে সঙ্গেই তড়িৎ গতিতে মাথার কাপড় টেনে নেয় খাদিজা। রান্না ঘরে বাকি দুই জা’কে কাজে হাত বাড়িয়ে দিবে বলে যেই পা বাড়ায় ওমনি পেছন থেকে ডলি খাতুন বাধা দিয়ে বলেন,
‘দাঁড়াও বউ।’
পেছন ঘুরে জেঠি শাশুড়ির মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে খাদিজা তার আদেশ শুনবে বলে। মনে মনে প্রস্তুতি নিয়ে নেয় ঘোমটা বিষয়ক কোনো লেকচার শুনার জন্য। হয়ত এখন সে তাকে আদব কায়দা শিক্ষা দিবেন। এটা নতুন কিছু নয় অবশ্য। এর আগেও বহুবার এই মহিলার কাছে নানান বিষয়ে ধোয়া খেয়েছে সে সহ অন্যান্য বউরা। ডলি খাতুন যেমন নিজের ছেলের বউদের ছেড়ে দেয় না ওমনি অন্য দেবরের ছেলের বউদেরও ছাড় দেন না।
ডলি খাতুন বলেন,
‘তা তোমাদের নতুন বউ কই তাকে তো দেখছি না।’
এই কথায় সালমা বেগম ও খাদিজা একে অপরের মুখ চাওয়া চাই করে একবার। ডলি খাতুন বলেই চললেন,
‘বড় তিন বউকেই তো দেখলাম, নবাবের বেটি কি আয়েশ করে ভাত ঘুম দিতে ব্যস্ত নাকি। কই ডাকো তারে। তার শাশুড়ি উঠে বসে আছে। গনি বাড়ির বড় বউ আসছে আর সে বিছানায় গড়াগড়ি খায়। কেন সারারাত স্বামীর তলে থেকে হয় নাই তার যে এখন বিছানা ছাড়তে মন চাচ্ছে না।’
এমন কথা শুনে কান গরম হয়ে যায় খাদিজার। আড়াল থেকে মরিয়মও শুনছে সব। তাইয়েবা এদিকটায় আসতে পারছে না। নাস্তা তৈরি করতে ব্যস্ত সে। মরিয়ম একটু একটু শুনে গিয়ে তাকে বলছে। এই কথা শুনে হুড়মুড় করে রান্না ঘরের দিকে পা বাড়ায় মরিয়ম তাইয়েবাকে কথাটা বলবে বলে। খাদিজা বেচারী পরেছে মাইনকা চিপায়। আমতা আমতা করে সে, জবাবে কি বলবে খুঁজে পায় না। একবার অসহায়ভাবে শাশুড়ির মুখের দিকে তাকায়। সঙ্গে তার মুখের হাবভাবও দেখে নেয়। তাদের তিনজনকে নাহয় পরের ঘর থেকে এনেছে কিন্তু মাহাপারা তো তার নিজের বোনজি। তাছাড়া মাহাপারা যে তার কলিজার টুকরা এটা সবার জানা, নয়ত উনার মতো মহিলা কোনোদিন এই বিয়ে মেনে নিতেন না। তাই খাদিজা চেষ্টা করে শাশুড়ির প্রতিক্রিয়া বুঝার। মাহাপারাকে নিয়ে এমন কথা বলায় শাশুড়ির কি মনোভাব হয় সেটাই বুঝতে চেষ্টা করে আর কি। সালমা বেগম নিজেও কিঞ্চিৎ বিচলিত। খাদিজাকে চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে বাজখাঁই কন্ঠে মহিলা বলেন,
‘কথা কানে যায় না? দাঁড়ায় আছো কেন? ডাইকা আনো নবাবের বেটিরে, দেখি সে কোন নবাবের কন্যা।’
আরেক দফা শাশুড়ির মুখের দিকে তাকায় খাদিজা। সে ইশারা করে দেয় যা সত্য তাই বলে দিতে। রাখডাক না করে খাদিজা বলে,
‘মাহাপারা তো বাসায় নেই জেঠিমা।’
‘বাসায় নাই মানে? ঘরের বউ ঘরে নাই তো কই গেছে?’
খাদিজা কিছু বলার আগে সে নিজেই আরও বলেন,
‘ওহ! বিয়া কইরা আসতে না আসতেই জামাইর হাত ধরে ঢ্যাং ঢ্যাং করে রাস্তায় নাইমা গেছে। ছিঃ ছিঃ এইসব কি শুনতেছি আমি নিয়াজের বউ।’
বলেই সালমা বেগমের মুখের দিকে তাকান ভদ্রমহিলা।
চোখ-মুখ শক্ত করে রেখেছেন সালমা বেগম তবু মুখে রা করেন না। খাদিজাই বলে,
‘না জেঠিমা, মাহাপারা ওহীর সাথে যায় নাই।’
‘জামাইর সাথে যায় নাই তো কই গেছে?’
এক মুহূর্ত থেমে খাদিজা বলে,
‘কলেজে গেছে।’
‘কি বললা?’ মহিলার ভাব দেখে মনে হয় সে ভীষণ অবাক হওয়ার মতো কিছু শুনে ফেলেছেন। কলেজ কি জিনিস সে জানেনই না। কলেজ খায় না মাথায় দেয় তা তার অজানা।
একবার ঢোক গিলে নিয়ে খাদিজা আবার বলে,
‘কলেজে গেছে।’
সালমা বেগমের মুখের দিকে তাকিয়ে তিনি বলেন,
‘তোমার সংসার তো দেখি এক্কেবারে রসাতলে চলে গেছে নিয়াজের বউ। সংসার তো তোমার হাতে নাই। সব তোমার হাত ছাড়া হয়ে গেছে আয়হায় এসব কি দেখতেছি আমি। এইজন্যই ছেলের বউরা মুরব্বিদের সামনে মাথা কাপড় দেয় না (বলতে বলতে একবার খাদিজার দিকে তাকানও তিনি) বিয়ে হয়ে বাড়িতে পা রাখছে ২৪ ঘন্টাও হয় নাই সেই বউ ঢ্যাং ঢ্যাংগায় কলেজও চলে গেছে। ছিঃ ছিঃ সংসারটা তো এক্কেবারে গোল্লায় চলে গেছে তোমার।’
সালমা বেগমের চোয়াল শক্ত হয়। মনে মনে নিজের উপরেই বিরক্ত হোন তিনি। মাহাপারার উপর তার শক্ত হওয়া উচিত ছিল। ছাড় দিয়ে হয়ত ভুলে করে ফেলেছেন। নিয়ম সবার জন্য সমান হওয়া উচিত। কেবলমাত্র আদরের বলে মাহাপারাকে হালকায় নেয়া একদম অনুচিত হয়েছে তার। চোখ-মুখ শক্ত করে সালমা বেগম খাদিজার দিকে তাকিয়ে বলেন,
‘মাহাপারাকে ফোন লাগাও।’
মাথা ঝাঁকিয়ে খাদিজা জিজ্ঞেস করে,
‘কি বলবো?’
‘এক্ষুণি বাসায় আসতে বলবে। এক্ষুণি মানে এক্ষুণি।
আজ হয়ত মাহাপারার কপালে বিশাল আকারের শনি আছে। এই শনির হাত থেকে তাকে কেউ বাঁচাতে পারবে না, কেউ না।
চলবে…
#নেশা_লাগিল_রে। পর্ব-৮
লেখক- ইতি চৌধুরী
(কোনো ক্রমে কপি করা যাবে না।)
খাদিজা কেবলই পা বাড়িয়েছে নিজের ঘরে গিয়ে ফোন আনবে, মাহাপারাকে কল করবে বলে। তখনই আড়াল থেকে মরিয়ম এগিয়ে এসে তার পাশে দাঁড়ায়। আমতা আমতা করে বলে,
‘মাহাপারাকে আমি ফোন দিয়েছিলাম। কিন্তু…’
‘কিন্তু কি?’ জিজ্ঞেস করেন সালমা বেগম।
শাশুড়ির থমথমে চেহারা দেখে মরিয়ম বলে,
‘ফোন তোলেনি। হয়ত ক্লাসে আছে।’
‘বাহ নিয়াজের বউ তোমার তো দেখছি…’
ডলি খাতুন তার কথা শেষ করতে পারেন না। তৎক্ষনাৎই বাসার কলিংবেলটা বেজে ওঠায় থেমে যান তিনি। সালমা বেগম বউদের দিকে চোখ দিয়ে ইশারা করতেই খাদিজা জোর কদমে এগিয়ে যায় দরজা খুলতে। বাসার দরজা খুলে দিতেই হনহনিয়ে ভেরতে প্রবেশ করে মাহাপারা। খাদিজাকে সালাম জানিয়ে সে সরাসরি ঢুকে যায় ড্রইং রুমের দিকে। খাদিজা বেচারি আটকানোর সুযোগটাও পায় না৷ স্কার্ফটা মাহাপারা গলায় পেঁচিয়ে রেখেছে৷ খাদিজা বলতে চেয়েছিল সুন্দর করে মাথায় ঘোমটা টেনে নিতে৷ কিন্তু বেচারী কিছু বলারই সুযোগ পায় না। তার আগেই মাহাপারা হনহনিয়ে ভেতরে চলে গিয়ে সামলা বেগম ও তার পাশে বসে থাকা ডলি খাতুনের মুখোমুখি এসে দাঁড়িয়ে দু’জনের উদ্দেশ্যে লম্বা করে সালাম দেয়।
ডলি খাতুন মাহাপারাকে দেখে তার চোখ কোটর থেকে বেড়িয়ে আসার জোগায়। চোখ বুলিয়ে ডলি খাতুন নতুন বউকে একবার আপাদমস্তক দেখে নেন। মাহাপারার পরণে জিন্সের সাথে লম্বা কুর্তি কামিজের মতো অনেকটা দেখতে, গলায় প্যাঁচানো স্কার্ফ, পেছনে ঝুলছে ব্যাগপ্যাক। একটা সেন্টার ফ্রুট বা ফ্রেশ হবে মুখে অনবরত চাবিয়ে যাচ্ছে মাহাপারা। চোখ-মুখ আপনাতেই কেমন যেন হয়ে গেল ডলি খাতুনের। ভ্রু কুঁচকে বাড়ি মাথায় তুলে তিনি বললেন,
‘নাউজুবিল্লাহ, আস্তাগফিরুল্লাহ এই মেয়ের তো দেখছি শরম হায়া বলতে কিচ্ছু নেই। কেমন খোলামেলা পোশাক পরে বাইরে থেকে আসছে। আর না আছে আদব কায়দা। বড়দের সামনে কেমন উদাম মাথায় দাঁড়িয়ে আছে। এসব আমি কি দেখতেছি নিয়াজের বউ। তুমি এসব দেখেও চুপ করে রইছ কেন?’
মাহাপারা একবার পেছনের দিকে তাকায়। সে মনে করে হয়ত তার পেছনে কেউ দাঁড়িয়ে আছে আর তাকে এই কথাগুলো বলা হচ্ছে। কিন্তু মাহাপারার পেছনে কেউ নেই। তার থেকে বড়জোর দু’কদম পাশে দাঁড়িয়ে আছে খাদিজা। মরিয়ম আগেই চম্পট মেরেছে। সে জানে এখানে থাকলে জেঠি শাশুড়ি তাকেও ছেড়ে কথা বলবেন না। উনি যে কথাগুলো খাদিজাকে বলেননি তা বুঝতে অসুবিধা হয়নি মাহাপারা। কারণ খাদিজার পরণে শাড়ি কাপড়। এবং সে মাথায় ঘোমটা টেনে রেখেছে। এমনকি তার খালা অর্থাৎ শাশুড়িও মাথায় ঘোমটা টেনে রেখেছেন। এই ঘরে উপস্থিত একমাত্র তার মাথায়ই কাপড় মানে ঘোমটা নেই। তাই মাহাপারার আর বুঝতে অসুবিধা হলো না কথাগুলো একান্তই তার উদ্দেশ্যে বলা হয়েছে। আর সময় বিলম্ব না করে মাহাপারা বলে ওঠে,
‘আপনার মনে হয় চোখে সমস্যা আন্টি। এত লম্বা একটা জামাকে আপনার খোলামেলা মনে হচ্ছে। চোখের একটা ভালো ডাক্তার দেখিয়ে নিয়েন কেমন? চাইলে আমি একজনের ঠিকানা দিতে পারি। আব্বু আম্মু তাকেই দেখায়। অনেক ভালো ডাক্তার। খালমনিও তো দেখায়। আপনিও দেখিয়ে নিয়েন। আমি এপয়েন্টমেন্ট নিয়ে দিবনি।’
মাহাপারার কথা শুনে ভদ্রমহিলার চান্দি গরম হয়ে গেল যেন সঙ্গে সঙ্গে। এই মেয়ে বলছে কি? তার চোখে সমস্যা? কত বড় সাহস মেয়ের? অবাক হওয়া ভঙ্গি ও কন্ঠে সালমা বেগমের মুখের দিকে তাকিয়ে ডলি খাতুন বলেন,
‘এসব কি শুনছি নিয়াজের বউ?’
‘কোন সব আন্টি?’ কথা কেড়ে নিয়ে জবাব দেয় মাহাপারা।
‘এই মেয়ে এই, আন্টি কাকে বলছ তুমি?’
আন্টি ডাকটা একদম সহ্য হয় না ডলি খাতুনের। মাহাপারা তাকে আন্টি ডাকায় আগের চাইতে আরও বেশি ক্ষেপে যান তিনি। শান্ত ভঙ্গিতেই মাহাপারা বলে,
‘আপনাকে বলেছি।’
‘তুমি জানো আমি কে?’
‘হ্যাঁ জানি তো। ওহী ভা… থুক্কু ওহীর বড় জেঠি। আপনাকে কে না চিনে বলেন। যে জল্লাদের জল্লাদ আপনি।’
সম্পূর্ণ কথা জোরে বললেও “যে জল্লাদের জল্লাদ” কথাটা বিড়বিড় করেই বলে যার ফলে কেউ শুনতে পায়নি। আবার একদমই কেউ শুনতে পায়নি তেমনটাও নয়। পাশ থেকে খাদিজা শুনে ফেলে মনে মনে বিষম খায় কিন্তু নিজেকে সামলেও নেয় সে। ওহীকে নাম ধরে ডাকায় যেন আরও ক্ষেপে গেলেন মহিলা। বললেন,
‘কেমন বেয়াদপ মেয়ে। স্বামীকে নাম ধরে ডাকছে। বাবা-মা দেখছি আদব কায়দা কিছু শিখায়নি।’
এতক্ষণ শান্ত থাকলেও এবারে খানিকটা চটে যায় মাহাপারা। তাকে যে যাই বলুক তাতে তার কোনো আপত্তি নেই। কিন্তু বাবা-মা তুলে কথা বললে সেই মানুষটাকে সে ছেড়ে কথা বলে না কখনোই। সে যেই হোক না কেন। এই কথা সালমা বেগমও খুব ভালো করে জানেন। তৎক্ষনাৎই মাহাপারা তেলে বেগুনে জ্বলে ওঠে বলে,
‘দেখুন আন্টি একদম বা…’
কিন্তু মাহাপারাকে কথা শেষ করতে দেন না সালমা বেগম। তিনি মাঝখানে ঢুকে বলেন,
‘আহা, কি হচ্ছে মাহাপারা? উনি তোমার জেঠিমা হোন। এগিয়ে এসে সালাম করো।’
খালার মুখের দিকে তাকিয়ে জোরে একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে মাহাপারা বলে,
‘শুনুন জেঠিমা আমার বাবা-মা যথেষ্ট আদব কায়দা শিখিয়েছে আমাকে। প্রমান লাগলে আপনার পাশে বসে থাকা মানুষটাকে জিজ্ঞেস করে দেখতে পারেন। আমার মায়ের চাইতে তার কাছেই বেশি মানুষ হয়েছি আমি। তাই আমার আদন কায়দা শিক্ষার সত্তর শতাংশ দায়ভার উনারই।’
জেঠিমাকে এতটুকু বলে খালার মুখের দিকে তাকিয়ে মাহাপারা আরও ভালো,
‘বাইরে থেকে এসেছি এখন কাছে গিয়ে হাত দিয়ে ছুঁয়ে সালাম করতে পারব না।’
হাত উঁচু করে ধরে আরও বলে,
‘আমার হাতে ভাইরাস আছে। ফ্রেশ হয়ে আসছি।’
বলেই টাবটান পদক্ষেপে নিজে ঘরের দিকে চলে যায় মাহাপারা। তার কান্ড দেখে ডলি খাতুন হা করে রইলেন। এতটুকু মেয়ের এত বড় সাহস তাকে কদমবুসি না করেই কিনা ঘরে চলে গেল। তার এত বড় অপমান! দেবরের বউকে কিছু বলতে নিবে কিন্তু তার আগেই সালমা বেগম বলেন,
‘আপনি কিছু মনে করবেন না ভাবী ছোট মানুষ তো তাই কি বলতে কি বলে ফেলেছে ঠিক নেই। আমি বুঝিয়ে দিব। নতুন তো আমাদের বংশের আদব কায়দা সম্পর্কে কিছু জানে না। আমি সব শিখিয়ে পড়িয়ে নিব। আপনার ওহীর বউ তো। ওহীর মুখের দিকে তাকিয়ে বাচ্চা মনে করে মাফ করে দিন।’
এটা সত্যি ওহীকে সবাই অনেক আদর করে, ভালোবাসে। এমনকি এই পাষাণ মহিলাটাও ওহীকে অসম্ভব আদর-স্নেহ করেন, ভালোবাসেন। নিজেকে শান্ত করার চেষ্টা করে তিনি বলেন,
‘এত হালকায় নিও না নিয়াজের বউ। ২৪ ঘন্টা হয়নি এই মেয়ে বউ হয়ে এসেছে অথচ একের পর এক নিয়ম ভেঙে অন্যায় করেই চলেছে। সময় থাকতে লাগাম টানো বলে দিচ্ছি নাহলে কিন্তু পরে দেয়ালে কপাল ঠোকা ছাড়া কোনো পথ খোলা থাকবে না এই আমি বলে রাখলাম।’
সম্মতি প্রকাশ স্বরূপ জায়ের হাত শক্ত করে চেপে ধরেন সালমা বেগম। সঙ্গে সঙ্গেই খাদিজার মুখের দিকে তাকিয়ে বলেন,
‘তুমি এখানে দাঁড়িয়ে আছো কেন? গিয়ে দেখো ওদের দু’জনের কতদূর কি হলো? একজন মানুষ এসেছে সেই কখন অথচ এখনো খালি মুখে বসে আছেন। ওরা কি হাতে মেহেদী পরেছে নাকি?’
তড়িঘড়ি করে রান্নাঘরের দিকে প্রস্থান করে খাদিজা। এদিকে আসতেই তিনজন প্রথমে কিছুক্ষণ একে অপরের মুখ চাওয়া চায়ি করে শব্দহীন হাসিতে মেতে ওঠে। হাসি সামলে নিয়ে নিচু কন্ঠে মরিয়ম বলে,
‘একদম উচিত কাজ হয়েছে। জল্লাদ একটা মহিলা। ডের শিক্ষা হয়েছে আজ তার। আর জীবনেও লাগতে যাবে না মাহাপারার সাথে দেখেনিও তোমরা।’
অবাক কন্ঠে পাশ থেকে আস্তে আস্তে তাইয়েবা নাস্তার প্লেট সাজাতে সাজাতে বলে,
‘বাপরে বাপ৷ মাহাপারাটা কম যায় না। বুকের কি পাঠা মেয়ের ভাবা যায়। আমি হলে ভয়ে মরেই যেতাম।’
‘তোমরা দুইজন তো ওখানে ছিলে না ভাবী। আমি দেখেছি জেঠিমার মুখটা দেখার মতো হয়েছিল। উফ! যদি একটা ছবি তুলে রাখতে পারতাম, বিশ্বাস করো সেই ছবি বাঁধাই করে দেয়ালে টাঙিয়ে রাখতাম আমি, সত্যি বলছি। এতদিনে এই জল্লাদ মহিলাকে টক্কর দেওয়ার মতো কেউ একজন এসেছে এই বংশে। আমি বলছি তোমরা দেখে নিও, সবে তো শুরু এরপর দিনে দিনে আরও কত কি হবে নে।’
‘এভাবে বলিস না ছোট।’ পাশ থেকে বাধা দেয়ার চেষ্টা করে তাইয়েবা।
‘আরে রাখো তো ভাবী। তুমি কেবল মজা দেখো। আমরা তো কিছু করব না, কিছু বলবোও না। যা করার মাহাপারাই করবে সব কয়টাকে টাইট করে দিবে দেখে নিও। আমরা দর্শকের মতো বসে বসে খেলা ইনজয় করব জাস্ট।’
পাশে দাঁড়িয়ে মাথা ঝাকিয়ে সম্মতি জানায় মরিয়ম। তারপর খাদিজার কথার সাথে যোগ দিয়ে মরিয়ম আরও বলে,
‘ঐ খাটাশ মহিলাটার সাথে মাহাপারার মুখোমুখি সংঘর্ষ হলে যা হবে না। ভাবতেই আমার থ্রিল ফিল হচ্ছে।’
‘ঐ খাটাশ মহিলার কথা বলছ?’ জিজ্ঞেস করে খাদিজা।
‘হু।’
‘কি শুরু করলি তোরা দুইটায়।’ আবার বাধা প্রয়োগের চেষ্টা করে তাইয়েবা।
আর কেউ কিছু বলার আগেই ঐদিক থেকে সালমা বেগম হাঁক পারেন।
‘কই? এত সময় লাগছে কেন?’
তাগাদা দিয়ে তাইয়েবা বলে,
‘জলদি যা। এখনো এখানে দাঁড়িয়ে আছি দুইটায়। এরপর আমাদের চোদ্দগুষ্টি উদ্ধার করে দিবে নে।’
দু’জনকে ঠেলে পাঠিয়ে দিয়ে নিজে আরেকটা ট্রে নিয়ে এগিয়ে যায় তাইয়েবা।
চলবে..