নেশা লাগিল রে পর্ব-১+২

0
647

#নেশা_লাগিল_রে। পর্ব-১
লেখক- ইতি চৌধুরী
(কোনো ক্রমে কপি করা যাবে না।)

ইউনিভার্সিটির গেইট দিয়ে বের হতেই রাস্তার ধার ঘেষে নিজের বাইকের উপর ওহীকে বসে থেকে অপেক্ষা করতে দেখতে পায় মাহাপারা। ওহীকে দেখতে পেয়েই হাত উঁচিয়ে, হাত নাড়ে সে। মাথা ঝাঁকিয়ে সায় জানায় ওহীও। এগিয়ে এসে মাহাপারা ওহীর পাশে দাঁড়িয়ে তার মুখোমুখি হয়ে ভ্রু নাচিয়ে জিজ্ঞেস করে,
‘হঠাৎ জরুরী তলব কি মনে করে?’
‘উঠে বোস৷’
‘কই যাবো আমরা?’
‘উঠ তো আগে, গেলেই দেখতে পাবি কই যাচ্ছি। চিন্তা করিস না, তোকে কিডন্যাপ করছি না।’ বলে সামান্য হাসির রেখা ওহীর গাল জুড়ে বিস্তৃত হয়।
‘সেই সাহস তোমার নাই তা আমি ভালো করেই জানি। আমাকে কিডন্যাপ করলে সবার আগে তোমাকে খালামনির হাতেই উত্তম মাধ্যম খাইতে হবে।’ বলেই সশব্দে মৃদু শরীর ধুলিয়ে হেসে ওঠে মাহাপারা। তা দেখে ওহী বলে,
‘এখন কি এখানে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়েই হাসবি নাকি উঠে বসবি। আমি অফিস কামাই দিয়ে আসছি। জলদি উঠে বোস প্লিজ।’
মাহাপারা আর কথা বাড়ায় না। বাইকের পেছনে উঠে বসতেই ওহী এক টানে ডার্কের বিল্ডিংয়ের সামনে এসে দাঁড়ায়।

দু’জনে মুখোমুখি বসেছে। খাবার অর্ডার করা হয়ে গেছে, আসার অপেক্ষায় আছে। নিজের চিবুকে হাত দিয়ে বসে থেকে ভালো মতো ওহীকে পর্যবেক্ষণ করতে ব্যস্ত হয় মাহাপারা। নিজে নিজেই বুঝার চেষ্টা করে ওহীর ভেতর এই মুহূর্তে ঠিক কি চলছে কিন্তু কিছুই আন্দাজ করতে পারছে না সে। একটা নার্ভাসনেস ওহীর চেহারা আদলে ভেসে উঠছে যদিও এর কারণ কি হতে পারে তা ধরতে পারছে। হঠাৎ এই জরুরী তলবই বা কেন সেটাই বুঝে কুলে উঠতে পারছে না। বেশ কিছুক্ষণ চুপ করে থাকার পর স্বাভাবিক হয়ে বসে মাহাপারা নিজেই জিজ্ঞেস করে,
‘তুমি নিশ্চয়ই আমাকে ভালো টালো বাসো এইধরনের কিছু বলতে ডাকো নাই।’
মাহাপারার কথা শুনে কিঞ্চিৎ ভ্যাবাচ্যাকা খায় ওহী। সঙ্গে সঙ্গেই নিজেকে সামলে নিয়ে বলে,
‘মাথা কি নষ্ট হইছে তোর?’
‘তাহলে তুমি এত নার্ভাস কেন ওহী ভাইয়া? তিন গ্লাস পানি খাইয়া ফেলছ এর মধ্যে। খাবার যা অর্ডার করছ মনে তো হয়না কিছু খেতে পারবা তুমি। পানি খেয়েই তো পেটের ভেতর সমুদ্র বানায় ফেলছ। সমস্যা কী? এত নার্ভাস কেন তুমি?’
সঙ্গে সঙ্গেই আরও এক গ্লাস পানি পান করে ওহী। বসা থেকে উঠে দাঁড়ায় সে।
‘আমি একটু ওয়াশরুম থেকে আসছি রে।’
বলেই প্রস্থান করে সেখান থেকে। তার পেছনে মাহাপারা নিজে নিজেই বলে, ‘যাও যাও, যা পানি খাইছ, তিনদিনে ফিরে আসতে পারবা কিনা আল্লাহ মালুম।’
ওয়াশরুমে ঢুকেই চোখে-মুখে পানির ঝাপটা দিয়ে নিজেকে ধাতস্থ করার চেষ্টা করে ওহী। যদিও সে মোটেও মাহাপারাকে ভালোবাসি টাইপের কথা বলতে ডাকেনি কিন্তু যা বলতে ডেকেছে সেটা তার মতে আরও ভয়ংকর কথা। তাই নিজেকে একটু গুছিয়ে নেয়ার চেষ্টা করছে যাতে করে মাহাপারাকে ভালো মতো বিষয়টা বুঝিয়ে বলতে পারে। দেখা গেল নার্ভাসনেসের কারণে সে ভুলভাল বলে ফেলল আর মাহাপারা তার আসল কথাটা না বুঝে, তার কথার উল্টা ধরে তাকে ভুল বুঝে ফেলল। তাই কথাটা বলার আগ মুহূর্তে নিজেকে আরেকটু গুছিয়ে নেয়ার চেষ্টা চলছে আর কি।
চোখে-মুখে পানি দিয়ে প্রায় দশ/পনেরো মিনিট পরে ফিরে আসে ওহী। টেবিলে ফিরে এসে দেখতে পায় মাহাপারা গোগ্রাসে পাস্তা গিলে যাচ্ছে। খাওয়ার গতি দেখে মনে হচ্ছে এখনই খাওয়া শেষ করে দৌড়ে কমলাপুর গিয়ে ট্রেন ধরবে তাই এমন গোগ্রাসে গিলে যাচ্ছে কোনো দিক-বেদিক না দেখে। ফিরে এসে চেয়ারে বসতে বসতে ওহী বলল,
‘তোর কি ট্রেন ছুটে যাচ্ছে নাকি রে মাহা?’
চেহারা আদলে কপট রাগ ফুটিয়ে তুলে মুখে জবাব না দিয়ে কেবল মাথা ঝাঁকিয়ে না করে মাহপারা।
‘তাহলে মানুষের মতো খা, এভাবে নাকে মুখে গিলছিস কেনো?’
খাওয়া থামিয়ে দিয়ে পাস্তার বোল থেকে মুখ তুলে ওহীর মুখের দিকে তাকিয়ে দু’মিনিট সময় নিয়ে মুখের সবটুকু খাবার গিলে কোল্ড ড্রিংকস খেয়ে নিয়ে বলে,
‘অনেক খুদা লাগছিল ভাইয়া।’
‘তাই বলে এভাবে খাবি? সকালে নাস্তা করে বের হসনি?’
‘সকালে নাস্তা করব তারপর বের হবো এত সময় কই আমার? আমি তো পারি না রাতের কাপড় পরেই ক্লাসে চলে যাই।’
‘হু, বুঝছি। খা এখন। পেট ভরে খেয়ে নে। প্রয়োজনে আরও অর্ডার করে দিচ্ছি।’
‘উঁহু, আমার খাওয়া হয়ে গেছে এখন তুমি বলো কাহিনি কী?’
কাহিনি টা একদম সিম্পল, তোর হেল্প লাগবে আমার।’
‘তা কী হেল্প?’
‘আমি বিয়ে করতে চাই তোকে মাহা।’
কথাটা হঠাৎ বজ্রপাতের মতো অনুভূতি দেয় মাহাপারাকে। এক মুহূর্তের জন্য থম ধরে সঙ্গে সঙ্গেই নিজেকে সামনে নিয়ে তোতলায় সে।
‘কি! বি বিয়ে! বিয়ে, হেল্প মানে?’ ওহীর মুখে বিয়ে বিষয়ক কিছু শুনতে হবে এমনটা আশা করা তো দূরের কথা ভাবেওনি মাহাপারা।
‘বিস্তারিত বলছি শুন।’
খুব মনোযোগী ছাত্রীর মতো মনোনিবেশ করে মাহাপারা ওহীর দিকে।
‘আম্মুর বিষয়গুলো আমি আর নিতে পারছি না।’
‘খালামনি আবার কি করলো আর এর সাথে তোমার আমাকে বিয়ে করতে চাওয়ার সম্পর্ক কোথায়?’
‘আরে মাহা থামবি তুই?’
আবার রাগ দেখিয়ে মাহাপারা বলে,
‘তুমি এই নিয়ে তিনবার আমাকে মাহা ডাকছ?’
‘আচ্ছা, মাহা ডাকব না। তুই আমার কথা শুন।’
‘বলো শুনছি।’
‘তুই তো জানিস আমাদের সংসারের সব কর্তৃত্ব আম্মুর হাতে। ভাবীরা কখনোই নিজেদের ইচ্ছা মতো বা চাওয়াকে কেন্দ্র করে কখনো কিছু করতে পারে না। আম্মু সেই স্বাধীনতা ভাবীদের কখনো দেয়নি। আর আমার ভাইয়েরা আরেক ডিগ্রী উপরে, তারাও আম্মু যা বলে তাই সই। আম্মু কি ভাববে বা কষ্ট পাবে চিন্তা করে বউয়ের চাওয়া, পাওয়ার দিকে প্রয়োজনের বাইরে মন দেয় না বললেই চলে। যদিও ভাবীরা কখনোই তাদের না খুশি প্রকাশ করেননি কিন্তু এতদিন ধরে এসব দেখতে দেখতে আর নিতে পারছি না আমি। অলরেডি বাসায় আমার বিয়ের একটা গুঞ্জন উঠেছে তা আমার কান অব্দি এসে পৌঁছেছে। আমি অফিস জয়েন করলাম মাত্র পাঁচ মাস হলো। আম্মুকে বলেও ছিলাম অন্তত একটা বছর যাক তারপর বিয়ে করব। কিন্তু না, কে শুনে কার কথা? তার যা মন চাইবে সে তো তাই করবে। আমি বলছি না আমার আম্মু মানুষ ভালো নয়। যথেষ্ট ভালো মনের একজন মানুষ সে নাহলে কি ভাবীরা এতদিন তার সাথে থাকতে পারতো? পারতো না। কিন্তু তার এই নিজের হাতের মুঠে সব কিছু রাখার বিষয়টা আমার একদম পছন্দ নয় শুরু থেকেই। এখন আমাকে বিয়ে দিলে তো সেই একই অবস্থা হবে তাই না? আমি চাই না ভাবীদের মতো আরেকটা মেয়ে এসে শাশুড়ীর হাতের পুতুল হয়ে যাক। আম্মুকে বদলাতে হবে। ছাড় ও ছেড়ে দিয়েই সংসার। এটা আমার মাকে বুঝতে হবে। সে হাতের মুঠোয় ধরে রাখলে হবে না। তাকে ছাড় দিতে হবে, অনেক কিছু ছেড়েও দিতে হবে। এই বিষয়টাই আমি আম্মুকে উপলব্ধি করাতে চাই কেবল।’
‘সেটা না হয় বুঝলাম কিন্তু তুমি আমাকে যে কথা বললে তার সাথে এর সম্পর্ক টা কোথায় সেটাই তো বুঝলাম না ভাইয়া।’
‘বলেছি তুই ধরতে পারিসনি।’
‘কী?’
‘আমি চাইনা আমার ভাবীদের মতো আরেকটা মেয়ে এসে আমার মায়ের কর্তৃত্বের হাতে বাঁধা পরুক।’
‘তাহলে?’
‘তাহলে সোজা কথা বিয়ে তো আমাকে করতেই হবে। কিন্তু মেয়েটা যদি বাইরের না হয়ে আমার মায়েরই খুব আদরের হয় তাহলে সে তার সাথে ঐ রকম ট্রিট করতে পারবে না যেটা সে সচরাচর ভাবীদের সাথে করে। যেমন দেখ আম্মু তুই বলতে অজ্ঞান। তোকে সে বাণীর চাইতে কোনো অংশে কম ভালোবাসে না। এটাই তোর প্লাস পয়েন্ট হয়ে দাঁড়াবে। তাই তুই আমার বউ হয়ে গেলে, তুই আর আমি মিলে আম্মুকে জাস্ট এতটুকুই বুঝাব সে ভাবীদের সাথে যেটা করছে সেটা অন্যায়, অবিচার। তাকে বদলাতে হবে। তার বদল হওয়াটা এখন সময়ের দাবী। আর এই দাবী পূরণ হতেই হবে বাই হুক অর বাই কুক। সেজন্য আমি তোকে বিয়ে করতে চাই, আমার বউ করতে চাই।’
‘আচ্ছা এতক্ষণে বুঝলাম আসল কাহিনি। কিন্তু আমি ভাবছি অন্য বিষয়।’
‘কোন বিষয়?’
‘খালমনি রাজি হবে আমাকে তার পুত্রবধূ করতে? দেখো তুমি তার সব চাইতে আদরের ছেলে তাই সোজা হিসাব তোমার বউ, বিয়ে নিয়ে নিশ্চয়ই তার অনেক স্বাদ,
আহ্লাদ আছে। সে কি রাজি হবে?’
‘এটাও ধরতে পারিসনি তুই।’
‘আবার কি মিস করলাম?’
‘আমি তোকে বিয়ে করব বলছি। মানে সরাসরি তোকেই বিয়ে করব যদি তুই রাজি থাকিস তো। বাসায় বলার হলে তো এখানে এসে তোকে বলতাম না।’
‘আচ্ছা, আচ্ছা।’
‘দেখ এখানে আরেকটা বিষয় হতে পারে। এই সমস্যাটা সমাধান হয়ে যাওয়ার পর তুই যদি মনে করিস আমরা একসাথে থাকব না তাহলে উই ক্যান চুজ আওয়ার ওউন ওয়ে। যার যার রাস্তায় সে সে। আর যদি মনে হয় একসাথে থাকবি তাহলে সেটাও অসম্ভব কিছু নয়। এখন তুই দেখ তুই কোনটা চাস।’
বিজ্ঞের মতো মুখো ভঙ্গি করে কিছুক্ষণ চিন্তা-ভাবনা করে মাহাপারা বলে,
‘আমার মনে হয় কি আমরা যেহেতু খালামনিকে বিষয়টা রিয়েলাইজ করানোর জন্য বিয়ে করছি সেক্ষেত্রে তো আমরা বিয়ে না করে বিয়ের নাটকও করতে পারি।’
‘না, পারি না।’
‘কেন পারি না?’
‘পারি না কারণ, যখন আমি তোকে বাসায় নিয়ে গিয়ে বলল আমরা বিয়ে করেছি সবার আগে আমার মা মানে তোর খালামনিই বিয়ের কাগজপত্র দেখতে চাইবে।’
‘বলবা কাগজ তোলা হয়নি।’
‘ওকে ফাইন বললাম৷ কিন্তু কয়দিন? দুইদিন, চারদিন, এক সপ্তাহ, এরপর? এভাবে ফাঁকি দেয়া যাবে না। আর বিয়ের মতো বিষয় নিয়ে আমি ফাঁকি দিতে চাইছি না। পরে তো সেপারেট হওয়ার অপশন আছেই আমাদের হাতে তাহলে কেন মিথ্যা বিয়ের নাটক করতে যাব? ধরা পরে গেলেই তো সমস্যা। তাছাড়া বিয়ে নিয়ে আমি কোনো মিথ্যা বলতে চাই না।মিথ্যা মিথ্যাই, বিয়ে কখনো মিথ্যা হতে পারে না। বিয়ে পৃথিবীর অন্যতম সুন্দর সত্য। তাই আমি নিজের প্রয়োজনে নাটক করে বিয়ে নামটাকে, এর পবিত্রতাকে কূলশিত করতে চাই না।’
‘আর যদি খালমনি জেনে ফেলে তুমি তাকে রিয়েলাইজ করানোর জন্য আমাকে বিয়ে করেছ, তখন কী হবে?’
‘কীভাবে জানবে? এই কথা পৃথিবীতে তুই, আমি ছাড়া আর কেউ জানবে না। আমি তো বলবো না। বাকি থাকলি তুই।’
‘ওহ! সেটাই তো। আমরা দুইজন না বললে তো জানার কোনো উপায় নেই।’
‘এক্সাক্টলি মাই পয়েন্ট। এখন তুই বল, তুই রাজি কিনা।’
আবারও একটু চিন্তা-ভাবনা করে মাহাপারা। তারপর বলে,
‘তুমি তো শুধু এইটুকুর জন্যই বিয়েটা করতে চাইছ তাই না?’
‘হ্যাঁ।’
‘তাহলে কাজ হয়ে গেলে আমরা যার যার রাস্তায় সে সে।’
‘তুই এটা চাইছিস?’
‘আমার মনে হয় এটাই ভালো হবে আমাদের জন্য।’
‘ওকে ফাইন, তাহলে এভাবেই হবে। আমার শুধু তোর হেল্প লাগবে বিনিময়ে তুই যা চাস, যেভাবে চাস, সেটা সেভাবেই হবে।’
‘তোমার এত বড়ো একটা কাজ করে দিবো বিনিময়ে আমি কি পাবো?’
‘কি চাই তোর? যা চাইবি তাই পাবি। তুই চাইলে আইফোনের লেটেস্ট মডেলটা কিনে দিতে পারি। ফরেন ট্যুর দিতে চাইলে দিতে পারিস। আনলিমিটেড শপিং, ঘোরাফেরা, ইনি থিং ইউ ছ্যা।’
‘এসব চাই না আমার।’
‘তাহলে তুই বল তোর কি চাই।’
‘যা চাই দিবা তো?’
‘কথা দিচ্ছে। এন্ড ইউ নো আমার কথা কখনো এদিক সেদিক হয় না।’
‘দুইটা জিনিস চাই।’
‘তুই শুধু নাম বল।’
‘প্রথমতো প্লিজ তুমি আমাকে একদম মাহা বলে ডাকতে পারবা না। আর দ্বিতীয় শর্ত তোমাকে পূরন করতেই হবে। যেহেতু তোমার খালা, খালুর আমি একমাত্র মেয়ে। তাদের কলিজার টুকরা, নয়নের মনি, চোখের তারা তাই তারা আমার একদিনের জন্যও চোখের আড়াল হতে দেন না। কিন্তু আমার ইচ্ছা গ্রাজুয়েশনের পর আমি বাইরে যাব বাকি লেখাপড়ার জন্য কিন্তু আব্বু, আম্মু কখনোই আমাকে সেই অনুমতি দিবে না। যেহেতু বিয়ের পর আমার গার্ডিয়ান হয়ে যাবে তুমি, এজ এ হাসবেন্ড। তাই তোমায় আমাকে বাইরে গিয়ে ফার্দার পড়ার পারমিশন দিতে হবে। এমনকি আমি সেখানে সেটেল্ড করতে চাইলে সেই পারমিশনও দিতে হবে তোমায়। পরিবার থেকে কেউ বাঁধা দিতে চাইলে সেসব বিষয় তুমি সামলে নিবা, কথা দাও। সবার বিরুদ্ধে গিয়ে হলেও আমাকে যেতে দিতে হবে। রাজি আছো কিনা বলো? এই শর্ত মেনে নিলে তুমি যা করতে বলবা আমি তাই করব তোমার জন্য।’ বলেই সামনে হাত মেলে ধরে মাহাপারা। সময় বিলম্ব না করে হাত বাড়িয়ে মাহাপারার হাত ধরে ওহী বলে,
‘দেখ মাহা…’
ওহীকে কথা শেষ করতে না দিয়েই চেঁচিয়ে ওঠে মাহাপারা। তাকে থামিয়ে দিয়ে ওহী বলে,
‘তোকে মাহা ডাকাটা আমার ছোটবেলার অভ্যাস। বললেই তো আর সঙ্গে সঙ্গে ডাক পাল্টে ফেলতে পারব না। তবে তোর দ্বিতীয় শর্ত পূরণ হবে এই কথা দিতে পারি।’
‘সত্যি বলছ? পরে আবার নিজের কথা থেকে পিছ পা হবা না তো?’
আগের চাইতে আরও বেশি সিরিয়াসনেস চোখে-মুখে ফুটিয়ে তুলে ওহী বলে,
‘আজ পর্যন্ত দেখেছিস আমি কথা দিয়ে কথা রাখিনি।’
‘না, তা করোনি।’
‘তাহলে? তোর চাওয়া পূরণ হবে৷ আর তা পূরণ করা আমার দায়িত্ব ও কর্তব্য। কথা দিলাম আমি তোকে, তোর স্বপ্ন পূরণ করব।’
‘সেটা ঠিক আছে কিন্তু আরেকটা সমস্যা আছে তো।’
‘আবার কি সমস্যা?’
‘আমি সবে থার্ড ইয়ারে আছি। আমার এখনো পাঁচটা সেমিস্টার বাকি। বিয়ের পর আমার লেখাপড়া কে চালাবে?’
‘বিয়ে হয়ে গেলে অবশ্যই আমি চালাবো। তুই হয়তো ভুলে গেছিস আমি একজন সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার। একটি মাল্টি-ন্যাশনাল কোম্পানিতে কর্মরত আছি। এবং আল্লাহর রহমতে যথেষ্ট হ্যান্ডসাম সেলারি পাই। সো বউকে একটা প্রাইভেট ইউনিভার্সিটিতে পড়ানোর মতো এবিলিটি আমার আছে আলহামদুলিল্লাহ। আর কিছু?’
‘না, আর কিছু না। তবে আরেকটা প্রশ্ন।’
‘করে ফেল।’
‘আমি রাজি হলে এরপর আমাদের পদক্ষেপ কী হবে?’
‘সব প্ল্যান করাই আছে। আমি দুইটা কল করব তারপর এখানের বিল মিটিয়ে সোজা শপিংমল যাব। মল থেকে তোর জন্য শাড়ি, গহনা কিনে যাব পার্লার। সেখানে তুই বউ সাজবি। তারপর সেখান থেকে কাজি অফিস। বিয়ে করে ডাইরেক্ট বাসায় গিয়ে উঠবো দু’জনে।’
‘বাব্বাহ! তুমি তো সাংঘাতিক মানুষ। কিন্তু শাড়ি, গহনা, সাজটা বেশি হয়ে যাবে না?’
‘একদম না, সবাই তো জানবে আমাদের আগে থেকে প্রেম ছিল। বিয়েটা আমরা পরিকল্পনা করেই করেছি। সেক্ষেত্রে তোর শাড়ি, গহনা পরে বউ সাজাটা জরুরী।’
এতক্ষণে ক্লিয়ার হয় মাহাপার। সব ক্রিস্টাল ক্লিয়ার বুঝে নিয়ে ওহীর প্রশংসা না করে থাকতে পারে না সে। তারিফের সুরে বলে,
‘বাহ! তুমি তো দেখছি তুখোড় প্ল্যানার। সব একদম পরিকল্পনা করেই এসেছ। মনে মনে ওহী আওড়ায়, ‘কেবল তো শুরু, এখানেই শেষ নয় রে মাহা। আমি বহুদূর পরিকল্পনা করে এসেছি, তুই শুধু আমায় সঙ্গ দিস কেবল।’
মুখে বলে,
‘এখন তুই বল, তুই রাজি কিনা।’
মাহাপারার রাজি না হওয়ার আর কোনো প্রশ্নই আসে না৷ বাইরে পড়তে যাওয়ার জন্য যেকোনো শর্তে রাজি সে এক পায়ে। মুখে আর কিছু না বলে হাসি বিনিময় করতেই ওহী বলে,
‘চল তাহলে আমাদের বিয়ের শপিং দিয়ে শুরু করি।’
হাসি বিনিময় করে দু’জনেই উঠে দাঁড়ায়। ওহী বিল পে করে তারা বের হওয়ার প্রস্তুতি নিতেই মাহাপারা বলে,
‘আমার আরও একটা প্রশ্ন ছিল।’
‘কী?’
‘বিয়ের পর কি আমি তোমাকে ওহী ভাইয়া বলেই ডাকব?’
মাহাপারার এমন প্রশ্নে কেমন কেমন করে তাকায় ওহী তার দিকে। ভ্রুদ্বয় কুঁচকে নিয়ে জিজ্ঞেস করে,
‘কখনো কাউকে দেখেছি বা শুনেছিস নিজের হাসবেন্ডকে ভাইয়া ডাকতে? ভাবীদের দেখেছিস?’
‘তা দেখিনি। তবে তুমি তো আমার ভাই লাগো তাই জিজ্ঞেস করলাম আর কি…’
‘উই আর কাজিন মাহা। আর আমাদের ইসলাম ধর্ম মতে কাজিনদের মধ্যে বিয়ে হওয়া জায়েজ আছে।’
আর রা করে না মাহাপারা। বেচারি নিজের করা প্রশ্নে নিজেই বলদ বনে গেছে। আর কথা না বলে বেকায়দায় পরে শরম পাওয়ার ভঙ্গিতে হাসতে চেষ্টা করে। তা দেখে তাকে স্বাভাবিক করার জন্য ওহী হাত বাড়িয়ে মাহাপারার হাত আলতো করে ধরে সামনে আগায় তারায়।

চলবে…

#নেশা_লাগিল_রে। পর্ব-২
লেখক- ইতি চৌধুরী
(কোনো ক্রমে কপি করা যাবে না।)

সলিমুল্লাহ রোডের ডি ব্লকের উঁচু প্রাচীরে ঘেরা এই একতলা বাড়িটা ওহীর দাদা ওসমান গোনীর বানানো। তার জীবন এখানেই কেটেছে। ওহীর বাবা নিয়াজ গোনী ছিলেন তার ছোট পুত্র। সম্পত্তি ভাগের সময় ছোট ছেলেকে তিনি বাড়িটাই দিয়েছিলেন কেবল। বাবার করে যাওয়া বাড়ির একটা ইট পাথরও তার জায়গা থেকে নড়েনি। এই বিশ্বাস থেকেই ওসমান গোনী ছোট ছেলেকে বাড়িটা দিয়েছিলেন। বড়ো ছেলেদের দিলে তারা বাবার মৃত্যুর পরপরই যে আসর বসিয়ে বাড়িটা ভেঙে সেখানে উঁচু দালান তুলতো তা নিয়ে ওসমান গোনীর মনে কোনো সন্দেহ ছিল না। যাই হোক, বাড়িটা আজও সেভাবেই দাঁড়িয়ে আছে। যদিও এখন অনেক পুরোনো হয়ে গেছে। নিয়াজ গোনী চিন্তা না করলেও তারা ছেলেদের মধ্যে বাড়ি ভাঙা নিয়ে গুঞ্জন ঠিকই উঠেছে। যদিও তারা সখ করে এই চিন্তা করছেন না। বাড়িটা বেশ পুরোনো হয়ে গেছে মূলত সেজন্যই চিন্তা ভাবনা করা। তাদের বিশাল পরিবার এই বাড়িটাতেই থাকে। কারণ ঢাকার শহরের তিন বেড রুম ওয়ালা বাসাগুলোতে তাদের মতো বিশাল পরিবারের পোষাবে না। এই একতলা বাড়িটা পাঁচ কাঠা জমির মধ্যে করা। বেডরুমই আছে সাতটা। আরও তিনটা গেস্ট রুম আছে। যেমন বড়ো ডাইনিং রুম তার চেয়ে বড়ো ড্রইং রুম। পরবর্তীতে কাজ করিয়ে ভেতরের দিকে নিজেদের জন্য ছোটো আরেকটা এক্সট্রা ড্রইং রুম বানানো হয়েছে অবশ্য। সবসময় তো বিশাল সাইজের রুমটায় বসা হয় না। কিন্তু ডাইনিং স্পেসটা বিশালই রাখা হয়েছে, সেখানে চৌদ্দ চেয়ারের একটা দানব সাইজের ডাইনিং টেবিল রাখা আছে যে। সংসারিক কাজ সব বউয়েরাই করে। কাজের লোকের কাজ ওহীর মা সালমা বেগমের পছন্দ হয় না। বুয়াদের ছুমন্তরের মতো কাজ করা তিনি দুই চোখে দেখতে পারেন না। তাই সংসারের যাবতীয় কাজ সব তিন ছেলের বউয়েরাই করে। চৌদ্দ সদস্যের সংসারের এত এত কাজ করেও বউদের মুখে টু শব্দ নেই। সালমা বেগমের সোনায় বাঁধাই করা কপাল বলা যায়। তিন ছেলের বউয়ের একজনও তার কথার উপরে কথা বলে না। তিনি যা বলেন তাই সই। তার কথার বাইরে এই সংসারে এক পদ তরকারীও রান্না হয় না। মূলত সংসারটাকে তিনি চাবির গুচ্ছার মতো নিজের আঁচলের সাথে বেঁধে রেখেছেন শক্ত গাঁট দিয়ে। এক দিকে তার ছেলেরা যেমন মা বলতে অজ্ঞান তেমনি তিনিও বউদের কড়া খবরদারীর উপরেই রেখেছেন। উনি বেঁচে থাকতে থাকতে বউদের শক্ত করে দিয়ে যেতে চান। যেন তার পরে তারা সংসারটা শক্ত করে ধরে রাখতে পারে। তার মতে সংসার টিকিয়ে রাখা অনেক কঠিন কাজ। যুদ্ধের চাইতে কোনো অংশে কম কঠিন নয়। আর এই কঠিন কাজটা ঠিকঠাক করতে হলে সংসারে নিজের অবস্থানটাকে শক্ত করতে হবে, মজবুত করতে হবে। এই শিক্ষা তিনি ছেলের বউদের দিয়ে যেতে চান। যেন তারা নিজেদের অবস্থানটা শক্ত করে ধরে রাখতে পারে সংসারে।

সন্ধ্যা পেরিয়ে ইতোমধ্যে রাত তবে অনেক বেশি নয়। সবে রাতের প্রথম প্রহর। ঘড়ির কাটায় এখনো রাত আটটা বাজেনি। হয়তো সোয়া সাত কি বেশি হলে সাড়ে সাতটা বাজে। এই সময়টা, ওহীর বড়ো ভাই রিসালাতের জমজ দুই ছেলে আলিফ ও মীমের পড়ার সময়। তারা সবে ক্লাস টুতে পড়ে।
এই বাড়ির বড়ো বউ আলিফ ও মীমের মা তাইয়েবা, তারপর মেজো বউ মরিয়ম এবং সেজো বউ খাদিজা। প্রতিদিন নিয়ম করে আলিফ ও মীম এই সময়টায় খাদিজার কাছে পড়তে বসে। সন্ধ্যায় ওদের দুইজনকে পড়ানো ব্যতীত খাদিজার আর কোনো কাজ নেই। আলিফ ও মীমকে খাদিজার কাছে পড়তে দিয়ে তাদের মা তাইয়েবা অর্থাৎ বড়ো বউ এই সময় ব্যস্ত থাকে শাশুড়ীর খেদমতে। বেশি কিছু নয় শাশুড়িকে একটু সঙ্গ দেয়া। মাগরীবের নামাজের পর নিয়াজ গোনী বাসায় ফিরেন না। এলাকার তার পরিচিতজন ও বন্ধুদের সাথে আড্ডা দিয়ে একেবারে এশার নামাজ পড়েই ফিরেন তিনি। সালমা বেগমের একমাত্র মেয়ে বানী ব্যস্ত তার নিজের পড়ালেখা নিয়ে। বাকি থাকলো মেজো বউ মরিয়ম। এই সময়টা সে ব্যস্ত থাকে তার এগারো মাসের মেয়েকে খাওয়াতে। ওহীর বোন বানীর পরে এই পরিবারের দ্বিতীয় কন্যা সন্তান দোয়া। পরিবারের সকলের চোখের মনি সে। মস্তো বড়ো পরিবারের সকলের আদর পেয়ে এখনই মাথায় উঠে গেছে সে। মন চাইলে খাবে, না মন চাইলে নেই। সারাদিনের সাংসারিক ব্যস্ততার জন্য দিনের বেলা বেশি একটা খেয়াল না দিতে পারলেও এই সময়টা ধরে বেঁধে হলেও ঠিকঠাক খাওয়ায় মরিয়ম মেয়েকে। এই বয়সটা বাড়ন্ত। এখন না খেলে শরীর সঠিক পুষ্টি পাবে না। এই সময়ে স্বাস্থ্য ঘেটে গেলে সেই স্বাস্থ্য সহজে উঠতে চায় না। তাই বাচ্চা এই সময় যেন সম্পূর্ণ পুষ্টিটা পায় সে দিকে মায়ের বিশেষ নরজ রাখা উচিত। দুপুরের ঘাটতিটা মরিয়ম সন্ধ্যা ও রাতের খাবারে পূরণ করে দেয়ার চেষ্টা করে। তাই মেয়েকে খাওয়ার জন্য ডাইনিং রুমে তাকে নিয়ে হেঁটে হেঁটে গল্প করে খাওয়ানোর চেষ্টায় মশগুল সে। বিচ্ছু মেয়ে একবার খাবার মুখে পুরে পাক্কা দশ/পনেরো মিনিট নিয়ে বসে থেকে তারপর গিলে। তবু অধৈর্য্য হয়না মরিয়ম। মেয়ে সময় নেয় নিক। সে ধৈর্যের সাথে চেষ্টা চালিয়ে যায়। ডাইনিং রুমটার পাশেই মস্ত বড়ো বসার রুমটা। তার অন্য পাশেই বাড়িতে ডুকার গেইট। কলিং বেলটার তার টেনে এনে তা লাগালোও হয়েছে এখানেই। যাতে সবাই ভেতরের দিকে যার যার ঘরে থাকলেও শব্দ পায়। একদম ভেতরের দিকে না পাওয়া গেলেও সামনের তিনটা বেড রুমে স্পষ্ট শব্দ পাওয়া যায়। এখানে থাকায় এই সময় কলিংবেল বাজার শব্দটা সবার আগে মরিয়মই শুনতে পেল। খাদিজা বাচ্চাদের পড়াতে ব্যস্ত তাই সে আপাতত উঠে আসবে না। বাকি রইলো তাইয়েবা, সে আপাতত শাশুড়ীর ঘরে আছে তাই তারও উঠে আসার কোনো সম্ভাবনা নেই বললেই চলে। আর তিন তিনজন পুত্রবধূ থাকতে সালমা বেগমের নিজের উঠে আসার তো প্রশ্নই উঠে না। বানীও পড়ায় ব্যস্ত, তাই বুঝায় যায় সেও আসবে না। কেউ যে আপাতত উঠে আসবে না তা মরিয়মের ভালো করেই জানা। তাই সে আর কারো আসার অপেক্ষা না করে এক কোলে মেয়েকে নিয়ে আরেক হাতে খাবারের বাটিসহই এগিয়ে যায় দরজা খুলতে৷ দরজার লকটা নিচের দিকে হওয়ায় মেয়েকে কোলে নিয়ে তা খুলতে তেমন একটা বেগ পেতে হয় না তাকে। দরজা খুলতে বেগ পেতে না হলেও দরজা খুলে যা দেখতে পেল সে, তা দেখার জন্য এই মুহূর্তে কোনোভাবেই প্রস্তুত ছিল না মরিয়ম।সকালে অফিসের উদ্দেশ্যে ফর্মাল গেটাপে বের হওয়া ওহী এখন দাঁড়িয়ে আছে একটা লাইট ব্রাউন রঙের আড়ং কটনের পাঞ্জাবি গায়ে। ডান হাতে তার একটা গোলাপ ফুলের গলার মালা। তার পাশেই পরনে লাইট ব্রাউনের মধ্যে গোল্ডেন সুতার কাজ করা কাতান শাড়ি ও মাথায় একটা লাল দুপাট্টা তুলে দেয়া। গলায় জড়োয়া, কানে ঝুমকো, মাথায় টায়রা ও হাত ভর্তি চুরি। ওহীর পাশে বউ সাজে সেজে দাঁড়িয়ে থাকা মেয়েটা আর কেউ নয় বরং মাহাপারা। মুখ ভর্তি এত এত মেকাপ থাকার পরেও তাকে চিনতে বিন্দুমাত্র কষ্ট হয়নি মরিয়মের। ছোট দেবরের সাথে এভাবে বউ সাজে মাহাপারাকে দেখে ভীষণ রকম চমকেছে সে। চমকে যাওয়ারই কথা। বলা নেই, কওয়া নেই দেবর বউ নিয়ে বাড়ি ফিরলে ভাবীতো চমকাবেই। ওরা যে বিয়ে করে এসেছে তা বুঝতে অসুবিধা হয় না মরিয়মের। সদ্য ফোড়ানো নাকে ডায়মন্ডের কানফুলটা ঝলঝল করছে, সেটাও মরিয়মের দৃষ্টি এড়ায়নি। দু’জনকে এভাবে এই পরিস্থিতিতে দেখার সঙ্গে সঙ্গেই মরিয়মের হাত থেকে দোয়ার খাবারের বাটিটা পরে গিয়ে সম্পূর্ণ খাবার এই মুহূর্তে মাটিতে লুটোপুটি খাচ্ছে। কি বলা উচিত বা কি বলবে ভেবে পায় না মরিয়ম। কথা সব তার গলার কাছে দলা পাকিয়ে গেছে। এক মুহূর্তের জন্য ওদের দেখে টলে উঠলেও পরমুহূর্তেই নিজেকে সামলে নেয়।
‘ম মা, আম্মাআআ…’ গলা ছেড়ে চেঁচিয়ে ওঠে মরিয়ম। তার একটা ডাক ভেতর বাড়ি পর্যন্ত কাঁপিয়ে ফেলতে সক্ষম হয়। যদিও গলা উঁচু করে চিৎকার চেঁচামেচি করার অনুমতি এই বাড়ির বউদের নেই। কিন্তু আজ যা ঘটেছে তা নিজের চোখে দেখার পর আর চিৎকার না করে থাকতে পারে না সে। মরিয়মের এক চিৎকারে নিজ অবস্থান থেকে সবাই ছুটে এসেছে বাড়ির দরজায়।

বাড়ির মস্ত বড়ো বসার ঘরটায় এই মুহূর্তে পিনপতন নীরবতা বিরাজ করছে। কারো মুখে রা শব্দ নেই। যেখানে শাশুড়ি নিজে উপস্থিত সেখানে বউয়েরা আর কি বলবে। অল্প কিছু সময়ের মধ্যেই বাড়ির অন্য পুরুষেরা সবাই এসে উঠবে, সবার আসার সময়ও হয়ে গেছে প্রায়। মাহাপারা ওহীর পাশেই বসেছে তার একটা হাত শক্ত করে ধরে রেখে। সালমা বেগমের দৃশ্য দু’জনের হাতের দিকেই আটকে আছে আপাতত। জীবনের এতগুলো বছর পেরিয়ে এসে তার বুঝতে অসুবিধা হচ্ছে না এখানে আসলে ঠিক কি ঘটেছে। প্রয়োজন না হলেও গম্ভীর ও থমথনে কন্ঠে সালমা বেগম জিজ্ঞেস করেন,
‘এসব কী ওহী?’
‘আমি মাহাকে বিয়ে করেছি আম্মু।’ কোনো ভনিতা ছাড়াই স্পষ্ট বাক্যে কথাটা বলে ওহী। এমনকি সামান্যতম কাঁপেও না তার কন্ঠ এমন একটা কথা মাকে বলতে গিয়ে। মাহাপারা ওহীর ধরে রাখা হাতটা শক্ত করে চেপে ধরে ঠিক ভয়ে নয় তাকে ব্যথা দেয়ার চেষ্টায়। সে শর্ত দিয়েছিল তাকে মাহা ডাকা যাবে না। কিন্তু এই হতচ্ছাড়া ছেলেটা বিয়ে হয়েছে চব্বিশ ঘন্টা তো দূরের কথা ছয় ঘন্টাও হয়নি অথচ কি সুন্দর প্রথম শর্তটা তার চোখের সামনেই কটমট করে ভেঙে ফেলছে। কিন্তু ওহীর হাত শক্ত করে ধরে বিশেষ লাভ হয় না। ওহী নিজেই তার হাত শক্ত করে ধরে রেখেছে তাই তার ব্যথা পাওয়ার কোনো সম্ভাবনা নেই। যদিও ওহী বিপরীতে তাকে কোনো প্রকার ব্যথা দিচ্ছে না।
কেউ কোনো কথা বলছে না দেখে ওহী নিজেই বলল,
‘আমরা কি এখানেই বসে থাকব আম্মু? একটু ফ্রেশ হওয়া দরকার ছিল আমাদের। আমরা রুমে যাই।’
ছেলের কথায় সন্তপর্ণে একটা শ্বাস ছাড়েন সালমা বেগম। মুখে বলেন,
‘তোমার বাবা আসুক, এতক্ষণ যেহেতু থাকতে পেরেছ আরেকটু না হয় অপেক্ষা করো।’
মা রাগ হয়েছে কিনা তা বুঝা না গেলেও সে ক্ষেপেছে তা ঠিক বুঝা যাচ্ছে তার কথার ধরনের। ক্ষেপে গেলেই সে এত ফর্মাল হয়ে কথা বলেন। ওহী পাশ ফিরে মাহাপারার দিকে তাকাতেই সে উঠে খালার পাশে গিয়ে বসে পরে। তার একটা হাত শক্ত করে জড়িয়ে ধরে। এতে একটুও টলেন না সালমা বেগম। হাত ছাড়িয়ে নেয়ারও চেষ্টা করেন না। যারা এমন একটা কান্ড ঘটিয়ে এসেছে তাদের মধ্যে কোনো বিকার না থাকলেও অন্য দিকে বাড়ির বাকি তিন বউয়ের গলা শুকিয়ে ইতোমধ্যে কাঠ হয়ে গেছে। তাদের শাশুড়ি সচরাচর এমন ঠান্ডা মারেন না। একটা বড়ো ধরনের তুফান যে যেকোনো সময় তাদের বাড়ির ড্রইং রুমে আঘাত হানবে তা বুঝতে তিন বউয়ের একজনেরও অসুবিধা হচ্ছে না। এখন কেবল অপেক্ষা বাড়ির অন্য পুরুষদের বিশেষ করে বাড়ির কর্তার। তারা এলেই আসল ঘটনা ঘটবে বলে আন্দাজ করছে বাকিরা।
অন্য দিকে জড়োসরো হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা বানীকে উদ্দেশ্য করে সালমা বেগম বলেন,
‘খালামনিকে ফোন করে বলো তোমার খালুকে নিয়ে চলে আসতে।’
বিরতি না দিয়ে বড়ো বউয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে আরও বলেন,
‘মেহমান আসছে বউ, রান্না চাপাও।’
তাইয়েবা একমুহূর্তও অপেক্ষা করে না। সে রান্নাঘরের দিকে প্রস্থান করলে তার পেছন পেছন খাদিজাও চলে যায়। দোয়াকে কোলে নিয়ে মরিয়মও সেদিকে পা বাড়ালে পেছন থেকে ওহী বলে,
‘দোয়াকে ওর নতুন চাচীর কাছে দিয়ে যাও ভাবী।’
মরিয়ম একবার শাশুড়ির মুখের দিকে তাকায়। তার চোখেমুখে কোনো বিকার না দেখে ভয়ে ভয়েই মাহাপারার কোলে দিয়ে দেয় দোয়াকে। তারপর আর সেখানে এক মুহূর্তও অপেক্ষা করে না।
এখন ড্রইং রুমে কেবল সালমা বেগম, ওহী ও মাহাপারা অবস্থান করছে। কিন্তু কারো মুখে কোনো কথা নেই। মনে মনে যেকোনো পরিস্থিতির জন্য প্রস্তুত হয়েই এসেছে ওহী। নিজের মাকে তার ভালো করেই চেনা আছে। তুফান যে একটা ঘটাবে তা মনে মনে নিশ্চিত সে। তবে যেকোনো পরিস্থিতির জন্য সে প্রস্তুত আছে। এই ঘটনায় মাহাপারার ভুমিকাও সে ক্লিয়ার করে দিয়েছে বাসায় ঢুকার আগেই। যাই ঘটুক না কেন তাকে শান্ত থাকতে বলে দিয়েছে ওহী, সব সে সামলে নিবে। যেকোনো ভাবেই মাহাপারাকে এই বাড়িতেই থাকতে হবে।

চলবে…