পথান্তরে প্রিয়দর্শিনী পর্ব-২৮+২৯+৩০

0
231

#পথান্তরে প্রিয়দর্শিনী
#মম_সাহা
#পর্ব-২৮+২৯+৩০

মোহনাকে নিয়ে হসপিটালে ছুটে গিয়েছে বিহু আর নিলয় কুমার। বিপ্রতীপ কেবল মাকে গাড়ি অব্দি তুলে দিয়েছে। মায়ের সাথে যাওয়ার কোনো ইচ্ছে সে প্রকাশ করে নি। তার মনে হয়েছে মায়ের সাথে যাওয়ার চেয়ে এখানে থেকে যাওয়া টা জরুরী বেশি। আধাঘন্টার মাঝে কী থেকে কী হয়ে গেলো কারো মাথায়ই যেন প্রবেশ করলো না। দর্শিনী কাঠের একটা বেঞ্চিতে বসে আছে। মোহনা যখন মাটিতে লুটিয়ে পড়লো তখন সে-ই তার হাতে জলের বোতলটা এগিয়ে দিয়েছে। শান্ত তবে চিন্তিত ভাবে পরোখ করেছিলো। দৃষ্টান্ত জানালো স্ট্রোক করেছে। অতঃপর ধরাধরি করে তাকে নিয়ে যাওয়া হলো৷ তবে এই পুরোটা সময়ই বিপ্রতীপকে বিচলিত হতে দেখা গেলো না। সে নির্জীব হয়ে দর্শিনীর দিকে তাকিয়ে ছিলো। তার চোখ বলেছে সে অনেক কথা বলতে চায় কিন্তু দ্বিধার দেয়ালের কারণে বলা হয়ে উঠে নি।

মোহনার গাড়ি বেরিয়ে যেতেই বিপ্রতীপ দর্শিনীর পায়ের কাছে এসে বসলো। দর্শিনী তখন কেবল তার ঘর্মাক্ত মুখ খানা আঁচল দিয়ে মুছে নিচ্ছিলো। বিপ্রতীপকে পায়ের সামনে বসতে দেখে সামন্য চমকালো সে। তবে প্রকাশ করলো না। মুখে কাঠিন্য ভাব।

মৃত্যুঞ্জয় বাড়িতে কথা বলে এগিয়ে এসে এ দৃশ্য দেখে প্রচন্ড বিরক্ত হলো। বিরক্ত কণ্ঠে বলে উঠলো,
“আজব,পাবলিক প্লেসে এসব কেমন কাজ? আপনারা দেখি দারুণ ড্রামাবাজ।”

বিপ্রতীপের রাগ হলো। কপাল কুঁচকে রাগ সংযত করে বলল,
“একদম স্বামী-স্ত্রীর মাঝে তৃতীয় ব্যাক্তি হয়ে নাক গলাতে আসবেন না। হু আর ইউ ম্যান?”

” স্বামী-স্ত্রী! হাসালে ব্রো। আমি যেই হই না কেনো অন্তত প্রিয়দর্শিনীর চোখের জলের কারণ নই। তাই আপনার চেয়ে উপরের স্থানেই আছি। এখান থেকে উঠুন নাটক কম করে। একটু পর বড় গলায় বলা স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্কটারও ইতি টানা হবে। তখন দেখবো নাটক কই থাকে। আর তাছাড়া সাথে তো আপনার বর্তমান মিসেস দাঁড়িয়ে আছে, তার সামনে এসব করতে লজ্জা করে না?”

মুত্যুঞ্জয়ের তাচ্ছিল্য মাখা কথায় বিপ্রতীপ ফুঁসে উঠে। তেড়ে গিয়ে কিছু বলবে এর আগেই সপাটে চড় পড়ে তার গালে। সে কেবল থতমত খেয়ে যায়। চড় দেওয়া ব্যাক্তিটার দিকে তাকিয়ে দেখে প্রতাপ সাহা অগ্নিমূর্তি ধারণ করে দাঁড়িয়ে আছে। কপালে তার রাগে রগ ফুলে গেছে। ফর্সা ষাটোর্ধ্ব মানুষটার শরীরে রাগের এক আভা বের হচ্ছে। বিপ্রতীপ কিছুটা সময় চুপ রইলো। প্রতাপ সাহা আঙ্গুল উঁচিয়ে বেশ রুক্ষ স্বরে বলল,

“এ চড়টা তোমার গালে আগে পড়লে আমার মেয়ের জীবনটা সুন্দর হতো। পুরুষ মানুষের ব্যর্থতা কী জানো? তার মা,স্ত্রী আর কন্যাকে যত্নে রাখতে না পারে। আর আমার দেখা মতে তুমি পৃথিবীর সবচেয়ে ব্যর্থ পুরুষ। যে না মায়ের ছেলে হতে পারলো না স্ত্রীর ভরসা। তোমার পুরুষত্বে থু ফেলি আমি। আমার মেয়েকে তো সম্মান দিলে না এজীবনে, অন্তত নতুন যাকে এনেছো তার অসম্মান করো না।”

বিপ্রতীপ মাথা নিচু করে ফেললো। তার অনুশোচনা হচ্ছে না কিন্তু চরম ক্ষোভ জন্মাচ্ছে প্রতাপ সাহার উপর। তার পুরুষত্বে আঙ্গুল তুলছে! বিপ্রতীপ হাসলো, গালে হাত বুলিয়ে তীক্ষ্ণ কণ্ঠে বলল,
“আমার পুরুষত্বে আঙ্গুল তুলছেন? পুরুষ বলেই না দুই বউ নিয়ে ঘুরছি সমাজে ঝামেলা বিহীন। আমি পুরুষ বলেই আপনার মেয়ে অন্তঃসত্ত্বা। আমার পুরুষত্ব,, ”

আর কিছু বলতে পারে নি বিপ্রতীপ। এর আগেই দ্বিতীয় চড়টা পড়েছে তার গালে। সেটা মেরেছে দর্শিনী। বিপ্রতীপ এবার অবাক হলো। চরম অবাক। যে মেয়েকে মেরে ফেললেও টু শব্দ করতো না সে মেয়ে কিনা তার গালে চড় দিয়েছে!

ততক্ষণে দর্শিনী রণমুর্তি ধারন করলো। ঘৃণার দৃষ্টিতে বিপ্রতীপের সারা শরীরে চোখ বুলিয়ে তীক্ষ্ণ কণ্ঠে বললো,
“এসব করে নিজেকে পুরুষ দাবী করছো? এটা চরম কাপুরুষতা। পুরুষ, কাপুরুষ পরের ব্যাপার তুমি তো মানুষই হতে পারো নি। এই তোমার জন্য কত অশ্রু বিসর্জন দিয়েছি ভাবলেই ঘৃণা হচ্ছে। এমনকি তুমি আমার সন্তানকেও নিজের পুরুষত্বের ঐশ্বর্য মনে করো? সন্তান জন্ম দেওয়ার ক্ষমতা রাস্তার কুকুরেরও আছে। তবে কী তুমি নিজেকে সে রকমের পুরুষ দাবী করছো?”

বিপ্রতীপ থ বনে বিস্ফোরিত নয়নে তাকিয়ে রইলো। দর্শিনী তাকে রাস্তার কুকুরের সাথে তুলনা করতে পারলো?

পুরোটা ঘটনা চুপ করে হজম করলো মায়া। সে বিপ্রতীপ আর তার মাকে যতটা নোংরা ভেবেছিলো তার চেয়েও দ্বিগুণ নোংরা তারা। যদি আজ মোহনা মারা যায় তবে চরম তৃপ্তি পাবে মায়া। এসব মানুষের বেঁচে থাকা নিষেধ। কিন্তু মায়ার এটা ভেবে খারাপ লাগছে যে প্রতিশোধ আগুনে সে একজন স্ত্রীর থেকে স্বামীকে আর একটা নিষ্পাপ সন্তান থেকে তার বাবাকে আলাদা করেছে। কিন্তু এমন পুরুষের নৈকট্য ঠিক কতটা ভালো! হয়তো অজান্তে দর্শিনীর চরম উপকার করেছে সে।

থম মারা পরিস্থিতিকে শিথিল করতে দর্শিনীদের উকিল আসলো। ভেতরে যাওয়ার সময় হয়েছে বলে তাড়া দিলো। দর্শিনী সবার অগোচরে চোখের কোণে চিলিক দেওয়া অশ্রু কণাকে মুছে ফেললো। এসব অহেতুক আবেগের মূল্য নেই।

দর্শিনীর অশ্রু মোছার দৃশ্য পরোখ করলো মৃত্যুঞ্জয়। তার রাগ হলো। এমন নিচু স্তরের মানুষের জন্য চোখের জল বিসর্জন দেওয়া নেহাতই বোকামি ছাড়া কিছু না। মৃত্যুঞ্জয় রাগ থেকেই কর্কশ কণ্ঠে বলল,
“আসুন দর্শিনী। আমাদের যেতে হবে।”

দর্শিনী খানিক চমকালো গম্ভীর কণ্ঠে। তার উপর অবাক হলো নামটা শুনে। মৃত্যুঞ্জয় কখনো তাকে এভাবে ডাকে নি। অতঃপর মৃত্যুঞ্জয়ের কঠিন দৃষ্টি দেখে ব্যাপারটা আঁচ করে দর্শিনী। বিপ্রতীপও এত অধিকারবোধ থেকে ডাক শুনে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইলো। দর্শিনী বিপ্রতীপের মনের ভাবনাও বুঝলো। হঠাৎ কী মনে করে অদ্ভুত কণ্ঠে বলল,
“দর্শিনী না,প্রিয়দর্শিনী হবে ভিনদেশী সাহেব। চলুন যাওয়া যাক।”

কথা শেষে মুচকি হাসি দিয়ে পা বাড়ালো প্রিয়দর্শিনী। তার পিছে পিছে মুচকি হাসি দিয়ে মৃত্যুঞ্জয়, প্রতাপ সাহা আর দৃষ্টান্তও গেলো। বিপ্রতীপ কেবল অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো। দর্শিনী যেন তাকে চোখে আঙ্গুল দিয়ে নাম ডাকার অধিকারের গল্প শুনিয়ে গেলো। যে গল্পে বিপ্রতীপ এক তাচ্ছিল্যের পাত্র। এক পেয়ে হারানো নিম্ন শ্রেণীর মানুষ।

_

বিকেলের সূর্য অস্তায়মান। গরমের গুমোট ভাব হালকা এখন। অবশেষে চির জীবনের বিচ্ছেদ ঘটলো সম্পর্কের। তার সাথে একটা অদ্ভুত কাজ করলো দর্শিনী। যা সবার ভাবনার বাহিরে ছিলো। বিপ্রতীপের নামে মামলা করলো। স্ত্রী বর্তমান থাকতেও বিপ্রতীপ আরেকটা বিবাহ করেছে। যার জন্য বিপ্রতীপকে আপাতত জেলে নেওয়ার আদেশ দেওয়া হয়েছে। দর্শিনী জানে বিপ্রতীপ টাকার দাপটে হয়তো ছাড়া পেয়ে যাবে কিন্তু এটা ভেবে শান্তি যে বিপ্রতীপ যেই বিয়েকে নিজের পুরুষত্ব ভেবেছে সেই বিয়ে তার কাল হয়ে দাঁড়িয়েছে। দর্শিনী এমন কিছু করতো না যদি না বিপ্রতীপ তখন এমন দম্ভ প্রকাশ করতো। সেই দম্ভ চুর্ণ করার জন্যই এমন বিশাল ব্যবস্থা।

সারাদিনের ধকলে সবাই বেশ ক্লান্ত। দর্শিনীরা যেই গাড়িতে উঠতে যাবে মায়া হাজির হয়। মায়াকে দেখে দর্শিনী থামে। ফিচলে কণ্ঠে বলে,
“কী সই? কেমন দিলাম?”

“তুমি আমাকে ক্ষমা করো সই।”

দর্শিনী ভ্রু কুঁচকালো। অবাক কণ্ঠে বলল,
“ক্ষমা মানে? কেনো?”

“কেনোর কোনো উত্তর নেই। তবে আমি আমরণ ক্ষমা চেয়ে যাবো। তুমি ভীষণ ভালো,সই। আমি তোমার কপাল পুড়ালাম।”

“ভাগ্য লিখেন সৃষ্টিকর্তা। তুমি আমি উপলক্ষ্য মাত্র। তবে হ্যাঁ, আমার সংসার সুখের না হোক তবে নড়বড়ে হলেও আমার ছিলো। সেই সংসারটা ভাঙার জন্য আমি মায়া নামক মেয়েটাকে ক্ষমা করবো না। একজন সন্তানের মা হিসেবে আমার সন্তানকে এতিম বানানো মানুষটাকে আমি ক্ষমা করবো না। দীর্ঘশ্বাসেরও একটা অভিশাপ থাকে। তবে সইয়ের প্রতি আমার অভিযোগ নেই।”

মায়া মাথা নত করলো। “ভালো থেকো” বলে গুটি গুটি পায়ে এগিয়ে গেলো সামনে। অনেক কথা বলবে বলেও আর বলা হলো না।

মায়া যেতেই বিপ্রতীপ হাজির হলো। সাথে কনস্টেবলও আছে। বিপ্রতীপ করুণ স্বরে দু’হাত জোড় করে পাগলের মতন বলতে শুরু করল,
“আমাকে ছেড়ে যেও না প্রিয়দর্শিনী। অন্তত আমাদের সন্তানের কথা ভেবে থেকে যাও। প্লিজ দর্শিনী।”

দর্শিনী কেবল তাচ্ছিল্য হেসে গাড়িতে উঠে বসলো। বিপ্রতীপ গাড়ির কাঁচ ধরে সমানে আকুতি করে যাচ্ছে৷ একেই হয়তো বলে নিয়তি। যে ছেলেটা সকালেও আসার সময় ভেবেছিলো তার পা ধরে তার স্ত্রী করুণ আকুতি করবে, সে ছেলেটাই দিনশেষে স্ত্রীর পা ধরে আকুতি করছে। এ জন্যই বোধহয় বলে, সময় বদলাতে সেকেন্ড লাগে না।

দর্শিনীরা গাড়িতে উঠতেই গাড়ি স্টার্ট দিলো মৃত্যুঞ্জয়। দর্শিনী মাথা এলিয়ে দিলো সিটে। অদ্ভুত হলেও সত্যি যে আজ নিপা তার অনেক যত্ন করেছে। মৃত্যুঞ্জয় ক্লান্ত মেয়েটার মুখ পানে চেয়ে এসির পাওয়ার সামান্য কমিয়ে দিলো। তন্মধ্যেই নিপার ফোনে কল এলো। কল ধরেই সে চমকে গেলো। অবাক কণ্ঠে গাড়িতে থাকা মানুষ গুলোর উদ্দেশ্যে বললো,”আজ তৃণার আশীর্বাদ হয়ে গেছে।”

#চলবে

#পথান্তরে_প্রিয়দর্শিনী
#মম_সাহা

পর্বঃ উনত্রিশ

রাতের আঁধারও জমজমাট খুশির আমেজ কমাতে পারে নি। তৃণাদের বাড়ি ভরা মানুষ। আশেপাশে বাড়ির মহিলা দিয়ে বাড়ি পরিপূর্ণ। পান খাচ্ছে, চা খাচ্ছে আর বিয়ের গল্পে মেতে উঠছে। কেউবা নিজের বিয়ের গল্পও শুনাচ্ছে। কেউ তৃণাকে দেওয়া তার শ্বশুর বাড়ি থেকে আশীর্বাদের গহনা দেখতে চাচ্ছে। ঠাট্টা, টিটকারিতে রমরমা পরিবেশ। বাড়ির উঠোনে বড় একটা লাইট জ্বালানো। সেই লাইটের আলোর নিচে বসেছে মহিলাদের গল্পের হাট। বিমল সাহা একটু পর পর এসে তদারকি করছে সবার কোনো অসুবিধা হচ্ছে কি না। মাঝে মাঝে মহিলা গুলো তার সাথেও ঠাট্টায় মেতে উঠে। গ্রামের রীতি নিয়মও একটু ভিন্ন রকম। অনুষ্ঠান এক বাড়ির হলেও মেতে উঠে সবাই। আবার শোক এক বাড়ির হলেও বিষাদে মিইয়ে যায় সবাই। কিন্তু আবার পুরোনো সংস্কৃতি অনুযায়ী কাউকে হেয় করতে এক মিনিটও ভাবে না।

নিধি, নিধির মা রমলা,নিধির কাকী রান্নাঘর সামলাচ্ছে। চা বানাচ্ছে, পাপড় ভাজছে। সরলাও এসেছে,সে আপাতত উঠোনে। প্রদীপকে একটা রুমে শুয়ে দেওয়া হয়েছে।

বাড়ির সামনে এসে থামে দর্শিনীদের গাড়ি। ঘড়ি কাঁটায় তখন রাত দশটা পনেরো বাজছে। দর্শিনী, নিপা,প্রতাপ সাহা ধীর গতিতে নেমে গেলেন। মৃত্যুঞ্জয় আর দৃষ্টান্ত ঠাঁই বসে আছে। তাদের বাড়ির ভেতর আসতে বললে তারা প্রস্তাব নাকোচ করে। অনেক রাত হয়েছে বলে পাড়ি জমায় নিজেদের গন্তব্যে। দর্শিনীরা ধীর পায়ে প্রবেশ করে বাড়িতে।

দর্শিনীকে দেখে উঠানের জাঁকজমক আড্ডায় ভাঁটা পড়ে। সবার হাসি হাসি মুখ গুলোতে কৌতূহল উপচে পড়ে। এখানে অবস্থিত সবাই ই জানে দর্শিনী শ্বশুর বাড়ি ছেড়ে এসেছে। দর্শিনীকে দেখে উঠানে অবস্থানরত নিধির এক জেঠিমা বলে উঠে,
“আরে দর্শিনী যে! তা ডিভোর্সটা হলো শেষমেশ?”

উপস্থিত সবার চোখ বড় বড় হয়ে গেলো। আজ যে দর্শিনীরা ডিভোর্সের জন্য শহরে গিয়েছে এটা কেউ জানতো না। হয়তো নিধির কাছ থেকে এই ভদ্রমহিলা জেনেছে। আগে সংসারের কোনো কথা নিধি বের করতো না কারো কাছে কিন্তু এখন তার আচরণ বদলেছে। পাড়া প্রতিবেশীর সাথে মানুষের সমালোচনা করে বেড়ায়। এর ওর দোষ ধরতে বেশি পছন্দ করে।

জেঠিমার পাশে বসা কালো, মোটাতাজা এক মহিলা বলে উঠলো,
“আহারে,আজ ডিভোর্স টা হলো? বাচ্চার কথা ভেবেও তো টিকিয়ে রাখতে পারতে সংসার টা। ডিভোর্সই কী সব সমাধান? আজকালকার মেয়েছেলেরাও না ডিভোর্সের মাঝে সুখ খুঁজে নেয়।”

“যখন বেঁচে থাকাটা মুখ্য হয় তখন ডিভোর্সই সব সমাধান হয়ে যায়, মাসি।”

নিপার হাসি হাসি মুখের ঝাঁঝালো উত্তরে দর্শিনী ভরসা পেলো। নিধির ঠাকুমাও ফোঁকলা দাঁতে পান চিবাচ্ছিলেন সেখানে। এতদিন সে মেয়ের বাড়িতে ছিলো। নাতনির বিয়ের কথা শুনে এখানে এসেছে। সত্তরের বেশি বয়স হবে মহিলাটির। সাদা থান শরীরে জড়ানো। ব্লাউজ পড়েন নি। গ্রামের বেশির ভাগ বৃদ্ধাই শরীরে কেবল সাদা থান জড়িয়ে ঘোমটা দিয়ে থাকেন।

মহিলাটি পান চিবুতে চিবুতে দর্শিনীর উদ্দেশ্যে বললো,
“পোয়াতি মাইয়া মানুষ এত রাইতে বাইরে থাকা ভালা না লো ছেড়ি। যা, আমার তিরিনা দিদি ভাইয়ের ঘরে গিয়া বাইরের জামা কাপড় পাল্ডা। বেডা মানুষ গেছে গা জীবন থেইকা, হেইডার শোক পালন করার দরকার নাই। এমন বেডা থাহনের চেয়ে বিধবার মতন থাহাও ভালা। যা তো ছেমড়ি। আমি তিরিনার মারে কইতাছি তোরে হলুদ দুধ দিতে। খাইলে ভাল্লাগবো। যা।”

দর্শিনী মাথা নিচু করে ধীর পায়ে তৃণার ঘরের দিকে অগ্রসর হচ্ছিলো। তন্মধ্যেই বৃদ্ধার কর্কশ কণ্ঠ ভেসে এলো। সে উপস্থিত মহিলাদের উদ্দেশ্য করে বলছে,
“তোমরা মাইয়া মানুষ হইয়া আরেকডা মাইয়াে শোক বুঝো না, কষ্ট, দুক্কু বুঝো না এইডা একটা লজ্জার কতা। এই ছেমড়িডার উপর দিয়া কী যাইতাছে সেইডা যদি বুঝতা তাইলে এমন তামাশা করতে পারতা না।”

দর্শিনী আর দাঁড়ালো না৷ তৃণার ঘরে ধীর পায়ে প্রবেশ করলো। আসলে যুগ বদলানোর সাথে মানসিকতা বদলায় এ ধারণাটা ভুল। নাহয় এ যুগের মানুষ হয়ে মহিলা গুলো তাকে ভৎসনা করতো না আর না ঠাকুমা আগের যুগের হয়েও তার পক্ষে কথা বলতো। সমাজ শিক্ষিত হচ্ছে ঠিক,বিবেক আজও মূর্খই রইলো।

তৃণার ঘরের লাইট বন্ধ। উত্তর দিকের জানালাটা খোলা। সেখানেই শাড়ি পড়া এক নারীর অবয়ব দেখা যাচ্ছে। জানালার এই দিকটাই মানুষ জনের আসা যাওয়া নেই। কেবল গাছাপালা আর খোলামেলা জায়গা।

দর্শিনী ঘরে ঢুকেই দরজাটা হালকা করে চাপিয়ে দিলো। তৃণার সামান্য ধ্যান ভাঙলো। দর্শিনী ততক্ষণে তৃণার পাশাপাশি এসে দাঁড়িয়েছে। চাঁদের আলোয় হালকা উজ্জ্বল দুই নারীর মুখমন্ডল। তৃণা দর্শিনীর দিকে তাকিয়ে হাসি দিলো। ক্ষীণ কণ্ঠে বললো,
“হ্যাপি ইনডিপেনডেন্স ডে, প্রিয়দি।”

এই সময়ে এমন কথায় ভ্রু কুঁচকালো দর্শিনী। অতিব আশ্চর্যিত ভঙ্গিমায় বললো,
“আজ স্বাধীনতা দিবস হতে যাবে কেন? কী বলছিস এসব?”

“আমি তো কেবল তোমাকে স্বাধীনতা দিবসের শুভেচ্ছা জানালাম। কারণ আজ স্বাধীনতা দিবস কেবল তোমার জন্য। ভুল সম্পর্ক থেকে মুক্তি পাওয়াটাও এক প্রকারের স্বাধীনতা। হয়তো কষ্ট পাবে কিন্তু বাঁচার মতন বাঁচবে।”

“সে মানুষটাকে ছাড়া আমাকে বাঁচতে হবে কখনো ভাবি নি রে তৃণা। আর তাকে ছাড়া বাঁচাকে স্বাধীনতা দিবস ভাবতে হবে সেটাও ভাবি নি কখনো। তবুও আজ মনে সংশয় নেই। নিঃসন্দেহে আজ আমি স্বাধীন।”

তৃণা হাসলো। অন্ধকারের মাঝেই তার নাকের সরু নাক ফুলটা চিলিক দিয়ে উঠলো। দর্শিনীকে যেন জানান দিলো তৃণাকে নিয়ে ভাবার কথা। দর্শিনী কতক্ষণ তৃণার সারা মুখে চোখ বুলালো। বিষন্ন কণ্ঠে বললো,
“মেসো মশাই কেনো তোর বিয়েটা এত দ্রুত দিচ্ছে, তৃণা?”

“জানিনা, দি। হয়তো ভালোবাসা জীবনের সব থেকে বড় আফসোস সেটা প্রমাণ করানোর জন্যই এ সিদ্ধান্ত।”

তৃণার কণ্ঠে হতাশার ছাপ স্পষ্ট। দর্শিনী অদ্ভুত কণ্ঠে বললো,
“তুই দৃষ্টান্ত’দাকে ভালোবাসিস তাই না?”

তৃণা উত্তর দিলো না। কেবল মুচকি হাসলো। হয়তো নিরবতা সম্মতির লক্ষণ বলেই দর্শিনী উত্তরটা বুঝে নিলো। তৃণার বাহুতে হাত দিয়ে স্বান্তনার কণ্ঠে বললো,
“তবে মেসো মশাইয়কে কেনো বলছিস না?”

“বাবা এটা জেনেছে বলেই বিয়ের এত তোড়জোড়। বাবা বলেছে দৃষ্টান্তকে, ওর বাবা যদি তোমাদের জমি নিয়ে আর কোনো ঝামেলা না করে তবেই সে তার মেয়েকে দৃষ্টান্তের হাতে তুলে দিবে। দৃষ্টান্তকে এমন শর্ত দিয়েছে যেটা সে কখনো পূরণ করতে পারবে না। ওরা আমার জীবনটাকে খেলনা পেয়েছে। আমার জীবনে সবচেয়ে বড় ভুল দৃষ্টান্তকে আবার ভালোবাসতে বাধ্য করা। ছেলেটাতো আমায় যেচে ভালোবাসতে আসে নি। আমিই আশ্বাস দিয়ে ছিলাম চিরদিন ওর পাশে থাকার। কতটা বেইমান হয়ে গেলাম আমি! ছেলেটাকে আবার না পাওয়ার যন্ত্রণায় পুড়াবো।”

দর্শিনী অবাক হলো তৃণার কথায়। অবাক কণ্ঠে বললো,
“আবার না পাওয়ার যন্ত্রণায় মানে? দৃষ্টান্ত দা আগেও কাউকে ভালোবাসতো!”

তৃণা উত্তর দেওয়ার আগেই তাদের বাড়ির গৃহপরিচারিকা গরম দুধ নিয়ে হাজির হলো। রমলা নাকি পাঠিয়েছে। দর্শিনীর আর জানা হলো না দৃষ্টান্তের ভালোবাসার গল্প। তবে সে এই মেয়েটার জন্য কিছু অবশ্যই করবে।

_

পুরো একটা রাত পর মোহনার জ্ঞান ফিরলো। ডান হাতটা নড়ানোর শক্তি তার নেই। তাছাড়া পুরো শরীরই নড়াচড়া করাতে সক্ষম সে।

মোহনা জ্ঞান ফিরতেই চোখ বুলালো আশেপাশে। কেবিনের এক সাইডে সোফায় বিহঙ্গিনী ঘুমিয়ে আছে। মোহনা ডান দিকে তাকাতেই চক্ষু চড়কগাছ। তার মাথার কাছেই একটা কাঠের টুলে মায়া বসে আছে। মোহনা আবারও পুরো কেবিনে চোখ বুলালো। ছেলে আর স্বামীকে না দেখে তপ্ত এক শ্বাস ফেললো। তার স্বামীর না থাকাটা স্বাভাবিক ভাবে নিতে পারলেও ছেলের ব্যাপারটা সে নিতে পারে নি। তার ছেলে এখানে আসে নি কেনো! তবে কী ঐ মেয়েটার সাথে তার ছেলের সম্পর্ক ঠিক হয়ে গেছে? ছেলে কী তবে বৌ ভক্ত হয়ে যাবে? তারপর তার ছেলে আর ছেলের বৌ মিলে কী তাদের উপর খুব অত্যাচার করবে? বিহুকে অনেক শাস্তি দিবে? তাদের কী বাড়িতে আর জায়গা হবে না?

মোহনার শ্বাস প্রশ্বাসের গতি স্বাভাবিকের চেয়েও অধিকতর হয়ে গেলো। অনাকাঙ্খিত ভয়ে শরীর ঘেমে উঠলো। চোখের সামনে ভেসে উঠলো নোংরা অতীত।

মায়া এতক্ষণ মোহনার দিকেই নিষ্পলক তাকিয়ে ছিলো। কিন্তু আকষ্মিক মোহনার এমন পরিবর্তনে সে হকচকিয়ে গেলো। বুড়িকে তো এত তাড়াতাড়ি মরতে দেওয়া যাবে না। ছটফটিয়ে বাঁচবে এই মহিলা।

মায়া ব্যতিব্যস্ত কণ্ঠে মোহনাকে বললো,
“কী হলো, শাশুড়ি? কোনো সমস্যা হচ্ছে?”

মোহনা অস্ফুটস্বরে বললো,
“আমার বাবু,আমার বাবু কই মায়া?”

মায়া অবাক হলো। বিয়ের এত মাসে এ প্রথম মোহনা তার নাম ধরে ডাকলো। মায়া বিস্মিত চোখে তাকিয়ে রইলো।

মোহনা ধৈর্য হারা হয়ে বললো,
“ডিভোর্সটা হয় নি তাই না?”

মায়া নিজেকে ধাতস্থ করলো। এই মোহনা জীবনেও শুধরোবে না ভেবে হতাশার শ্বাস ফেলে। তারপর কুটিল হেসে বলে,
“আপনার জন্য দুইটা খবর আছে শাশুড়ি মা। একটা সুখবর, আরেকটা দুঃখের খবর। কোনটা শুনবেন আগে?”

মায়ার কুটিল হাসি আর কথার ভঙ্গিমা দেখে মোহনার রক্ত হিমশীতল হয়ে গেলো। কেনো মতে কাঁপা কাঁপা কণ্ঠে বললো,
“সুখবরটাই আগে বলো।”

“ডিভোর্স টা হয়ে গেছে,শাশুড়ি।”

মোহনার যেন মনে হলো মায়া পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর কথাটা উচ্চারণ করলো। তার কানকে সে ধন্য মনে করলো এমন একটা কথা শুনে।

মোহনার মুখে হাসি খেলে যেতে ঘৃণায় রি রি করে উঠলো মায়ার শরীর। তাই সে বাঁকা হেসে বললো,
“দুঃখের খবরটা শুনবেন না, শাশুড়ি?”

“কী সেটা?”

মোহনার তীক্ষ্ণ প্রশ্নে মায়ার হাসি গভীর হলো। কণ্ঠ খাঁদে নামিয়ে হেসে বললো,
“আপনার ছেলে আবারও জেলে গিয়েছে।”

মোহনা অবাকে হতবাক হয়ে যায়। অবাক কণ্ঠে চিৎকার দিয়ে বলে,
“কী!”

মোহনার চিৎকারে ধরফরিয়ে উঠে বিহু। মায়ের কাছে এসে ব্যস্ত ভঙ্গিতে মাকে দেখতে শুরু করে। মায়ের কোনো সমস্যা হলো কিনা। মায়ার মুখের হাসি গভীর থেকে গভীর হলো। তন্মধ্যেই তার ফোন কিঞ্চিৎ ভাইব্রেট করে উঠে জানান দিলো নতুন বার্তা এসেছে। মায়া ম্যাসেজ ওপেন করতেই হৈমন্তের ম্যাসেজ ভেসে উঠলো,
“মায়া,তাড়াতাড়ি বাড়ি ফের। তোর শাশুড়ির ঘর হাতিয়ে কিছু তথ্য পেয়েছি। উনি স্বাভাবিক না মায়া। উনি খুনি।”

মায়া হতভম্ব হয়ে একবার ম্যাসেজ আরেকবার মোহনার দিকে তাকালো। এমন কথার কারণ তার যেন বোধগম্য হলো না।

_

সকাল হতেই দর্শিনী মৃত্যুঞ্জয়দের বাড়িতে হাজির হলো। তৃণা আর দৃষ্টান্তের সম্পর্কটার সঠিক পরিণতির জন্য মৃত্যুঞ্জয়ের সাহায্য দরকার। বাড়ির সদর দরজা খুলে দিলো বাড়ির কেয়ার টেকার। ড্রয়িং রুমে তখন অনেক মানুষজন। দর্শিনী বিব্রতিতে পড়লো। সে তো ভুলেই গেছে মৃত্যুঞ্জয়ের পরিবারের লোক যে এসেছে বাংলাদেশ।

হঠাৎ কাউকে প্রবেশ করতে দেখে রাজকীয় বাড়িটার মানুষ জনের আড্ডায় বিরতি ঘোষণা হলো। সবাই দর্শিনীর দিকে কৌতূহল দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো। তার মাঝেই পঞ্চাশের মতন বয়সী এক সুন্দর, সভ্য, লম্বা চওড়া মহিলা এগিয়ে এলো। চোখে তার চিকন গ্লাসের চশমা। শরীরে জড়ানো শাড়ি। ভরাট কণ্ঠে সে ভদ্রমহিলা প্রশ্ন ছুঁড়লো,
“তুমিই কী প্রিয়দর্শিনী?”

#চলবে

#পথান্তরে_প্রিয়দর্শিনী
#মম_সাহা

বীভৎস বিধ্বস্ততা পর্বঃ ত্রিশ

ধূলো পড়া ঘরে যেন লুকিয়ে আছে মোহনার অমানুষ হওয়ার চিহ্ন। হাজের খানেক রহস্যের জাল বুনানো আছে এই ঘরখানায়। মায়া হৈমন্ত নিস্তব্ধ হয়ে সেই রহস্য, লুকিয়ে রাখা হিংস্রতা দেখে তব্দা খেয়ে আছে। তাদের বলার ভাষা নেই। বাক্যও ফুরিয়েছে। দু’জন কেবল দু’জনের দিকে তাকিয়ে আছে অবাক দৃষ্টিতে। ডায়েরীর মলিন পাতায় ঘেটে যাওয়া লিখাটাতে মোহনার আফসোস ছাড়া পাপকার্যের কথা লিখা।

হৈমন্তের ফোন পেয়েই মায়া ছুটে এসেছিলো বাড়িতে। হৈমন্ত তখন বিপ্রতীপদের বাড়ির ছাদের চিলেকোঠার ঘরে। মায়া ঘরে ঢুকতেই দেখে হৈমন্ত একটা ডায়েরী বার বার নেড়েচেড়ে দেখছে। মায়া তার সামনে দাঁড়াতেই ডায়েরীটা মেলে ধরে হৈমন্ত। মায়া কতক্ষণ পৃষ্ঠা উল্টিয়ে উল্টিয়ে দেখে। ডায়েরীর শক্ত মলাটের উপর লাল রাঙা কালিতে গোটা গোটা অক্ষরে লিখা ‘বীভৎস বিধ্বস্ততা’।

মায়া ডায়েরীটা উলোটপালোট করে দেখলো কতক্ষণ। ডায়েরীটার এমন অদ্ভুত নামকরণ দেখে সামান্য চমকায়ও সে। কিন্তু ডায়েরীটা খুলে পুরোই হতভম্ব হয়ে গেলো মায়া। ডায়েরীটার প্রথম থেকে মাঝামাঝি অংশ ছেঁড়া। লাস্টের কত পৃষ্ঠা নেই। কেবল গুটি কয়েক পৃষ্ঠাই আছে ডায়েরীটার। মায়া মাঝামাঝি একটা পৃষ্ঠায় কিছু লেখা দেখতে পায়। তারিখটা বেশ পুরানো। আরও পঁয়ত্রিশ বছর আগের। এত পুরানো তারিখ দেখে ভ্রু কিঞ্চিৎ কুঁচকে যায় তার। তারিখের থেকে চোখ নামিয়ে আনে পৃষ্ঠার মাঝামাঝি দোয়াত দিয়ে লিখা স্থূল শব্দ যুগলে। দোয়াতের কালি ঘেঁটে গিয়ে কালসিটে হয়ে গেছে। তবুও লিখাটা স্পষ্ট হয়ে জানান দিচ্ছে মোহনার কৃতকর্ম। গোটা গোটা অক্ষরে লিখা,
❝জীবনের দ্বিতীয় খু*ন করেছি আজ। প্রথম খু*নটা করার সময়ই টার্গেট করেছিলাম দ্বিতীয় খু*নটা তাকেই করবো। প্রথম বারের মতন আমার হাত কাঁপে নি আজ, হৃৎপিণ্ডও ছলাৎ করে উঠে নি খু*ন করার সময়। বেশ সাবলীল ভাবে খু*নটা করেছি। সবার ভাষ্যমতে খু*ন হওয়া ব্যাক্তিটা আমার ভাইয়ের বউ। খু*ন করে পিস পিস করে কেটেছি। মাটির ঘর লাল বর্ন ধারণ করেছিল। তারপর ভাসিয়ে দিয়েছি বাড়ির পিছে পুকুরটাতে। কেউ জানবে না সে কোথায়। কি তৃপ্তি!❞

মায়ার হাত থেকে ছিটকে ডায়েরীটা পরে যায়। চোখের সামনে যেন দেখলো সে নিদারুণ বীভৎসতা। এত ভয়ঙ্কর তার শ্বাশুড়ি! এতদিন যাবত তার আচরণের কারণে তাকে নিকৃষ্ট মনে হয়েছিলো কিন্তু আজ,আজ যেন তাকে আখ্যায়িত করার ভাষা মায়ার জানা নেই। শব্দ ভান্ডার খুঁজেও পাওয়া গেলো না মোহনার জন্য উপযুক্ত শব্দ। মানুষ এতটা খারাপ কীভাবে হয়?

হৈমন্ত ডায়েরীটা উঠালো। হৈমন্তের মাঝে কোনো পরিবর্তন নেই কারণ সে হয়তো আগেই পড়ে ফেলেছে। মায়ার শরীর অনবরত কাঁপছে আর ঘামছে। এমন নিষ্ঠুর মেয়ে মানুষ হতে পারে কখনো? হৈমন্ত মায়ার আঁচল টেনে মায়ার মুখের ঘামটুকু মুছে দেয় যত্নে। বাহুতে হাত রেখে ভরসা দেয়। চোখ দিয়ে ইশারা করে পরের পৃষ্ঠা গুলো পড়তে।

মায়া আবার পৃষ্ঠা উল্টায়। মাঝের পৃষ্ঠা গুলো ছেঁড়া। এক,দুই,তিন করে পৃষ্ঠা উল্টাতে উল্টাতে ঠিক ষষ্ঠ নাম্বার পৃষ্ঠার মাঝা মাঝি আরেকটা লেখা চোখে পড়লো মায়ার। মায়া নিজেকে শক্ত করলো এই ভেবে যে, হয়তো আরও বীভৎস কিছু আছে ডায়েরীটার মাঝে। এই লিখাটা লেখা হয়েছে আগের লেখাটার ঠিক দুইমাস পর।
❝এই নিয়ে তৃতীয় খু*নটা করেই ফেললাম। মানুষ জানবে না, আমার ভাই আমার হাতে খু*ন হয়েছে। আহারে বেচারা, খুব কষ্ট দিয়ে মেরেছি তোকে তাই না রে? মানুষ তোর লাশটা দেখলে আফসোসের সাথে বলবে আহারে কৃষ্ণকমল লোকটা কত ভালোই না ছিলো। ফাঁ*সি দিয়ে মরলো কেনো! নিশ্চয় বউটা পরপুরুষের সাথে গিয়েছে বলে এ কাজ করলো লোকটা। আহারে! আহারে! ওরা তোর ঝুল*ন্ত লাশ আর গলার মোটা দাঁগ দেখবে ভিতরের ভয়াবহতা কেউ জানবে না।❞

মায়া আরেকদফা চমকে গেলো। নিজের ভাইকেও এ মহিলা খু*ন করেছে? এ মানুষ নাকি পিচাশ? মায়া ব্যাতিব্যস্ত হয়ে পর পর আরও পৃষ্ঠা উল্টায়। এ মহিলা আর কোনো খু*ন করেছে কিনা জানার জন্য। কিন্তু না,আর কোনো খু*নের কাহিনী নেই। মায়া স্বস্তির শ্বাস ফেললো। এ মহিলাকে রীতিমতো তার ভয় করছে এখন। এ মহিলা যে স্বাভাবিক না বুঝায় যাচ্ছে। মারাত্মক রকমের মানসিক সমস্যার রোগী তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। স্বাভাবিক মানুষ কখনো এমন করতে পারবে না নিশ্চয়।

মায়া ডায়েরীটা বন্ধ করতে নিলেই থামিয়ে দেয় হৈমন্ত। ধীর কণ্ঠে বলে,
“আরও কিছু আছে লিখা। শেষ পৃষ্ঠায় দেখ।”

মায়া অবাক হয়। আরও কিছু লিখা আছে মানে? এ মহিলা কী আরও খু*ন করেছে? কাকে করেছে?

মায়া বিদ্যুতের গতিতে আবার ডায়েরীটা খুলে। শেষ পৃষ্ঠায় চোখ যেতেই চক্ষু চড়কগাছ। ডায়েরীটা পুরোনো। সেখানে লিখা প্রতিটা ঘটনাকাল,সময়ও পুরোনো। কিন্তু এ লিখাটা পুরোনো না। কয়েকদিনের মাঝেই লিখেছে। তারিখটা প্রায় মাস খানেক আগের। কালো বলপেন দিয়ে হয়তো লিখেছে। লিখাটা,
❝আমার মৃত্যু ক্ষুধা অনেক বছর আগেই মিটে গিয়েছিলো। কিন্তু কে জানতো এত বছর পর আবারও তা জেগে উঠবে? আমি আবার রক্ত মাখাবো হাতে! খুব শীগ্রই পড়তে যাচ্ছে আরেকটা লা*শ। সময়ের অপেক্ষা কেবল।❞

মায়া একবার লিখাটা আরেকবার হৈমন্তের দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ করছে। তার চোখ ব্যাপ্ত করছে কত রকমের কথা। হৈমন্ত মায়ার অবস্থা বুঝলো। ধীর গতিতে মায়ার হাতে নিজের হাতে রাখলো। আশ্বাসের স্বরে বললো,

“ভয় পাস না। আমি আছি তো। এই মহিলাকে আর কারো মৃত্যুর কারণ হতে দেওয়া যাবে না। তিন তিনটা খু*ন করেছে সে। নিজের ভাই আর বৌদিকে খু*ন করেছে। কিন্তু আরেকজনটা কে সেটা বের করতে হবে আমাদের। আর তাছাড়া সে পরবর্তী কাকে নিশানা করেছে সেটাও খুঁজে বের করতে হবে আমাদের। আমরা পারবো।”

“শেষ টার্গেট আমি না তো?”

হৈমন্ত কেঁপে উঠলো মায়ার প্রশ্নে। সত্যিই তো,সে তো এটা ভেবে দেখে নি। শেষ টার্গেট তো মায়াও হতে পারে। কারণ ইদানীং মায়া এ মহিলাকে জ্বালাচ্ছে,ক্ষ্যাপাচ্ছে। নিজের ভয়টা নিজের মনেই রাখলো হৈমন্ত। ভরসার স্বরে বললো,
“আরে না,তুই হবি কেনো? আর তুই হলেও বা কী? আমি আছি না তোর সাথে? আমি তোর ঢাল হয়ে দাঁড়াবো। ভাবিস না। আবার দর্শিনী দিদিও হতে পারে। সাবধানে থাকতে হবে।”

হৈমন্ত যতই আশ্বাস দেক,মায়ার মনে খুঁতখুঁত রয়েই গেলো। যতটুকু মনে হয়েছে মোহনা ভয়ঙ্কর মহিলা। শেষ টার্গেট খুব সম্ভবত মায়াই হবে। মায়ার নিজেকে সাবধানে রাখতে হবে। তার বোনের জন্য হলেও তাকে বাঁচতে হবে।

_

দারুণ কারুকাজ সজ্জিত সোফার মাঝে গোল হয়ে বসে আছে মৃত্যুঞ্জয়দের বিশাল পরিবার। মধ্যমণি হলো দর্শিনী। সবার কৌতূহল দৃষ্টি দর্শিনীর মুখের উপর।

দর্শিনীর মনে সামান্য ভয় আর লজ্জা মিলে মিশ্র অনুভূতির সৃষ্টি হচ্ছে। সে যখন প্রবেশ করলো বাড়িতে, যে ভদ্রমহিলা তার নাম জিজ্ঞেস করেছিলো, সে মহিলা তার পাশে বসে আছে হাসি হাসি মুখে। তার আশেপাশে অনেক মানুষ। সাত আট বছরের একটা ফর্সা ধবধবে ছেলেও আছে। এটা যে পুরো বিদেশি দেখেই বুঝা যাচ্ছে।

দর্শিনী কৌতূহলী দৃষ্টি এদিক ওদিক ঘুরিয়ে আমতা-আমতা করে বললো,
“মৃত্যুঞ্জয় কোথায়?”

পাশের মহিলাটি মুচকি হাসলো। দর্শিনীর মাথায় হাত বুলিয়ে বললো,
“ও তো নিজের ঘরে আছে। তুমি ভালো আছো তো,মা?”

দর্শিনী অবাক হলো এই অপরিচিত মহিলার আচরণে। এত সুন্দর ব্যবহার!

দর্শিনী হাসি মুখে উত্তর দিলো,
“হ্যাঁ আন্টি,ভালো আছি। আপনি ভালো আছেন তো?”

“আমি ভালো আছি মা। তোমাকে দেখার বড্ড ইচ্ছে ছিলো,আজ পূরণ হলো। তুমি ভারী মিষ্টি। প্রেগন্যান্সির কারণে বোধহয় আরও বেশি মিষ্টি লাগছে।”

দর্শিনী কিঞ্চিৎ অবাক হলো মহিলার কথায়। কিন্তু অবাক ভাবটা নিজের ভিতরেই রাখলো। তাছাড়া ভদ্রমহিলা দারুণ বাংলা জানেন। বিদেশী কোনো ছাপ নেই শরীরে।

দর্শিনীর ভাবনার মাঝেই তার সামনের সোফায় বসা ফর্সা বাচ্চা ভদ্রমহিলাকে উদ্দেশ্য করে বললো,
“হু ইজ সি, জেম্মা?”

দর্শিনীর পাশে বসা মহিলাটা মুচকি হাসলো। ছেলেটার মাথায় হাত বুলিয়ে মিষ্টি করে বললো,
“সি ইজ এ্যা ফেইরি। তোমার না ফেইরি পছন্দ?”

বাচ্চাটা মাথা ঝাঁকালো। যার অর্থ তার ফেইরি পছন্দ। অতঃপর সে দর্শিনীর দিকে তাকিয়ে মিষ্টি করে বললো,
“আ’ম ধ্রুব। আমি বেঙ্গলিও পারি। জেম্মা শিখিয়েছে। তোমাকে আমার দারুণ লেগেছে ডার্লিং।”

দর্শিনী চোখ বড় বড় তাকিয়ে থাকে ছেলেটার কথায়। কী পাঁকা ছেলে! তবে ভীষণ আদুরে আর মিষ্টিও। বাংলাটা একটু অশুদ্ধ বলে কিন্তু দারুণ লাগে।

ভদ্রমহিলা এবার দর্শিনীকে সবার সাথে পরিচয় করিয়ে দেয়। ভদ্রমহিলা হলো মৃত্যুঞ্জয়ের মা। পিচ্চিটা মৃত্যুঞ্জয়ের কাকাতো ভাই৷ মৃত্যুঞ্জয়ের বাবা কাকারা দুই ভাই আর তাদের এক বোন আছে। সে বাংলাদেশই থাকে। এছাড়া মৃত্যুঞ্জয়দের পরিবারের সবাই বিদেশী। মৃত্যুঞ্জয়ের কাকী সেই দেশেরই মহিলা। সবাই বেশ ভালো ও মিশুক। দর্শিনীর এক নিমিষেই পুরো পরিবারটাকে দারুণ লেগে যায়।

সবার সাথে পরিচয়ে ব্যস্ত থাকা কালীন ড্রয়িং রুমে হাজির হয় লম্বাচওড়া এক ভদ্রলোক। দর্শিনীর দিকে দৃষ্টি দিয়েই চিৎকার দিয়ে বলে,
“এই মেয়েটা! এই মেয়েটা এখানে কী করছে? এ বাড়িতে ওর কী?”

#চলবে