পথান্তরে প্রিয়দর্শিনী পর্ব-২৫+২৬+২৭

0
211

#পথান্তরে প্রিয়দর্শিনী
#মম_সাহা
#পর্ব-২৫+২৬+২৭

শান্ত, নিবিড় সকাল। নিধির বলা কথাটার পর সকাল যেন আরও নির্জীব রূপ ধারণ করলো। দর্শিনী থম মেরে বড় বৌদির ভারী, ভরাট,গোলগাল মুখটার দিকেই তাকিয়ে আছে। মুখটা কী বড্ড অচেনা হয়ে গেলো কয়েকদিনে! আর আচরণটা তো একদমই চেনা যাচ্ছে না।

নিধি মাথা নত করে দাঁড়িয়ে আছে। কথাটা যে ভুলবশত তার মুখ দিয়ে বের হয়ে গেছে সেটারই বহিঃপ্রকাশ ঘটাচ্ছে তার মুখমন্ডল। দর্শিনী কতক্ষণ চুপ থেকে ছোট্ট শ্বাস ফেলে বললো,
“আমার জন্য কীভাবে হলো এমন? যদি একটু বিশ্লেষণ করতে তবে খুশি হতাম।”

“আহা মা,তোমার বৌদি ভুলবশত বলে ফেলেছে। মন মেজাজ খারাপ তো তাই। তুমি বরং হাত মুখ ধুয়ে এসো। এতটা পথ জার্নি করাটা তোমার শরীরের পক্ষেও তো ক্ষতিকারক। যাও মা,আগে ফ্রেশ হও।”

প্রতাপ সাহার কথায় স্পষ্ট কথা ঘুরানোর আভাস। হয়তো তার বড় ছেলের বউয়ের এমন কথা সেও প্রত্যাশা করে নি।

“না বাবা,বড়দি তো কোনো ভুল বলে নি। এটা তো ঠিকই,দর্শিনীর জেদের কারণে আজ এত কিছু ঘটাচ্ছে ঐ হরমোহন। দর্শিনী যদি জেদ না করতো তবে আপনিও একটা সময় পর মিইয়ে গিয়ে জমিটার ঝামেলা শেষ করে দিতেন। আজ আমাদের বাড়ি ছাড়া হতে হতো না, আর না আমাদের স্বামীদের এত নির্মম দশা দেখতে হতো নিজ চোখে।”

নিপার চোখে মুখে উপচে পড়া অসহায় রাগ। কণ্ঠনালীতেও রাগের আভাস। দর্শিনী খানিকটা সময় চুপ রইলো। বুঝতে আর বাকি রইলো না এটা হরমোহনের কাজ। হরমোহনের নামটা মাথায় খেলে যেতেই শরীর শক্ত হয়ে এলো। লোকটা কতটা নির্দয় ভাবতেই ঘিন ঘিন করে উঠলো তার শরীর। আগের চেয়ে দ্বিগুণ হলো রাগের পাল্লা। না,এবার আর ছাড় দেওয়া যাবে না ঐ মানুষটাকে। যেমন ভাবনা, তেমন কাজ। কাঠের চেয়ারটা থেকে সে উঠে দাঁড়ালো। গম্ভীর কণ্ঠে বাবার দিকে তাকিয়ে বললো,
“আমি পুলিশ স্টেশন যাবো, বাবা। তুমি কী যাবে? এখনই এর একটা ব্যবস্থা না নিলে বড় কিছু হয়ে যাবে।”

প্রতাপ সাহা যেন জানতো তার মেয়ে এমন কিছুই করবে। তাই তার মুখে বিচলিত ভাব দেখা গেলো না। মুখ তার বরাবরের মতনই শীতল। অথচ উপস্থিত সবাই দর্শিনীর আচরণে খানিকটা ভড়কে গিয়েছে।

“কোথাও যেতে হবে না আপনার। দরকার হলে আমি আর দৃষ্টান্ত যাবো কাকার সাথে। এতটা পথ জার্নি করে এসেছেন,এবার বিশ্রাম নেন।”

মৃত্যুঞ্জয়ের বাক্যখানায় প্রবল অধিকারবোধ স্পষ্ট। কিন্তু তার অধিকারবোধ মাখানো বাক্য কতখানি দর্শিনীকে ছুঁতে পেরেছে তা দর্শিনীর চোখ মুখ দেখে বুঝা মুশকিল।

নিপা বিরক্ত হলো। বিরক্ত মাখানো কণ্ঠ নিয়েই বললো,
“দর্শিনী,তোমার আচরণ দেখে আমি অবাক হচ্ছি। আমাদের এত ক্ষতি দেখেও তোমার মন শান্ত হচ্ছে না? আর কী ক্ষতি চাইছো তুমি আমাদের? তোমার ভাই দুইটার নাজেহাল অবস্থা। মাথার উপর ছাঁদ নেই। একটু দয়া করো আমাদের উপর। আর কাঁদা ছোড়াছুড়ি করো না। ক্ষতি আমাদেরই হবে। গেলে তো আমাদেরই যাবে,তোমার তো কিছুই হবে না। নিজের সংসার তো খেয়েছো,এখন এ সংসারটাও কী ধ্বংস করতে এলে?”

নিপার তীক্ষ্ণ কথায় টনক নড়লো দর্শিনীর। বিষ্মিত,বিস্ফোরিত চোখে তাকিয়ে রইলো অপর নারীর দিকে। মানুষটা তাকে এভাবে বলতে পারলো?

নিপার কথার বিপরীতে জোড়ে ধমকি দিলো সুমন। প্রদীপ খানিক চোখ রাঙিয়ে উঠলো। অতঃপর আদুরে স্বরে বোনকে বললো,
“তোর যাওয়ার প্রয়োজন নেই, বনু। সুমন যাবে বাবার সাথে। আর দৃষ্টান্ত, মৃত্যুঞ্জয় ওরা তো আছেই। আমি তো এখন হাঁটতে পারছি না, নাহয় আমিও যেতাম। তুই গিয়ে ফ্রেশ হয়ে খাবার খা। যা।”

“আজ আমার জন্য তোমাদের এ অবস্থা তাই না,বড়দা ছোটদা?”

দর্শিনীর কথায় প্রবল অভিমান। এই যেন চোখ থেকে বৃষ্টি নামবে ভাব। নিধি মাথা নত রেখেই স্বামীর দিকে তাকিয়ে দর্শিনীকে উদ্দেশ্য করে বললো,
“আমার কথাকে ধরে এত কষ্ট পাওয়ার কোনো কারণ নেই। যদি আপন ভাবতো তাহলে এভাবে একটা কথাকে ধরে বসে থাকতো না। আসলে পরকে কী কখনো আপন করা যায়! সেটাই আজ ও প্রমাণ করে দিলো। ছোট থেকে মায়ের স্নেহে বড় করেছি অথচ আজ আমার একটা কথা ওর কাছে বড় হয়ে গেছে।”

নিধির কথার ধরণে তাজ্জব বনে গেলো সবাই। দর্শিনী ডুকরে কেঁদে উঠলো। সব মানা যায়, কিন্তু আপন মানুষের কথার আঘাত হজম করা যে অনেক কষ্টকর। প্রদীপ ঘর কাঁপিয়ে ধমক দিয়ে উঠলো নিজের সহধর্মিণীকে। অসুস্থ শরীরেই চেঁচিয়ে বললো,
“কোন সাহসে তুমি আমার বোনের সাথে এমন আচরণ করছো? তোমার বাপের বাড়িতে আছি বলে কী সাপের পাঁচ পা দেখেছো? একদম এ ভুল করো না নিধি। আমরা কাপুরুষ না যে বউয়ের কথা হজম করে বোনকে কাঁদতে দেখবো। অভদ্র মেয়ে।”

প্রদীপের ধমকে রান্নাঘর থেকে নিধির মা রমলা, দর্শিনীর মা সরলা, নিধির কাকীমা ছুটে আসলো। নিধির বাবা কলপাড়ে ছিলো,সেও ছুটে আসলো। রমলা ব্যতিব্যস্ত হয়ে মেয়ে জামাইকে বললো,
“কী হয়েছে,বাবা? এত চিৎকার চেঁচামেচি করছো কেনো? তোমার শরীর তো আরও অসুস্থ হয়ে যাবে। শান্ত হও,বাবা।”

প্রদীপ ততক্ষণে রণমুর্তি ধারন করেছে। নিজের স্ত্রীর আচরণ গড়গড় করে শাশুড়ির সামনে ঢেলে দিয়েছে। নিধি তখন ঘরের এক কোণায় দাঁড়িয়ে কাঁদছে। রমলা সবটা কথা শুনে ছোট স্বরে নিধিকে ধমক লাগিয়ে দেয়। বিষ্মিত কণ্ঠে বলে,
“তোরে আমি এসব শিখিয়েছি রে নিধু? কীভাবে অন্তঃসত্ত্বা, অভাগী মেয়েটাকে তুই এসব বললি? কীভাবে পারলি রে? মেয়েটার সংসার হারিয়ে একটু আশ্রয়ের খোঁজে তোদের দরজায় এসেছে আর তোরা কিনা এসব বলছিস? ছিঃ। নিপার তো বরাবরের স্বভাব দর্শিনীকে ছোট করা তাই বলে তুই ও? আজ আমার লজ্জা হচ্ছে। মানুষ তো কুকুর বিড়ালের প্রতিও এত আক্রোশ প্রকাশ করে না, আর ও তো জলজ্যান্ত মেয়ে। কীভাবে ওরে এত কথা শুনালি?”

মায়ের তাচ্ছিল্যে নিধিও মুখে আঁচল চেপে কেঁদে দেয়। বিবাহিত নারীদের বড় অলংকার তার স্বামী। সেই অলংকার আজ বিধ্বস্ত প্রায়,কীভাবে সেটা সহ্য করবে সে একটা নারী হয়ে? কিন্তু আজ তার মনের অবস্থা বোঝার মতন কেউ নেই। কী ভাগ্য!

নিধির কাকী এক হাতে নিধির বাহু জড়িয়ে নিধির মায়ের দিকে তাকিয়ে ছোট কণ্ঠে বললো,
“আহা দিদি,বকবেন না তো ওরে। ছোট মানুষ ও। দর্শিনী অভাগী হলে ও কী অনেক সুখে আছে? শ্বশুর বাড়ি ছাই হলো,স্বামী বিছানায়, গ্রামবাসীর কটু কথা সব তো দুই বউকেই সহ্য করতে হয়। ওরাও তো মানুষ। তাই মুখ ফসকে বলে ফেলেছে। তা ছাড়া বিবাহিত ননদ,ননসকে বাড়িতে রাখলে এমন সমস্যা হবেই সংসারে।”

নিধির কাকীর শেষের কথায় কিছু একটা ছিলো যা ঘৃণা ধরালো দর্শিনীর শরীরে। দর্শিনী বাবা-ভাইদের দিকে তাকালো। তাদের সোনার সংসারে আজ ফাটল দেখা দিচ্ছে তার জন্য। এটা যে তার কাছে কত লজ্জাজনক তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না।

কিন্তু এই নিরবতার মাঝে কথা বলে উঠলো সরলা। মুখে তার কাঠিন্য ভাব। মেয়ের দিকে শক্ত চোখে তাকিয়ে অতঃপর নিধির কাকীকে উদ্দেশ্য করে বললো,
“কী করবো বলেন বেয়াইন? মেয়েকে কী আর আমরা ফেলে দিতে পারি? সংসারে এমন ঝামেলা হবে বলেই প্রথম থেকেই মেয়েটার সাথে জন্তুর মতন আচরণ করেছি যেন ও চলে যায়। কোথায় যাবে সেটা ওর ব্যাপার কিন্তু এ বাড়িতে যেন না থাকে। কিন্তু মেয়ে আমার কূল কিনারা খাওয়া। ওর যে আমরা ছাড়া যাওয়ার জায়গা নেই সেটা আমার মাথাতেই ছিলো না। এখন সন্তানকে কী আর আমরা ফেলতে পারবো বলেন? সেদিন মৃত্যুঞ্জয় পরের ছেলে হয়ে যখন আমার মেয়েকে আমার হাত থেকে বাঁচাতে আসলো তখন আমার গালে পড়া জুতার বারিটার কথা বোঝানোর মতন না। যে মায়ের বটবৃক্ষ হওয়ার কথা ছিলো,সে মা হয়েছিলো বাবলা কাটা। মেয়েটা বাড়িতে এসেছে দু’মাস হলো। কিন্তু এ দু’মাসে ও ঠিক কয়টা মাছের টুকরো খেয়েছে আমি হিসেব করে বলতে পারবো। কারণ ও কেবল তরকারির ঝোল দিয়ে ভাত খেয়ে নিতো। আমি দেখেও দেখতাম না। সবার আগে ভাত খেতো বলে ওর ভাইরা,বাবাও দেখতো না। বড়বৌ হয়তো টের পেয়ে মাঝে মাঝে ওকে বকতো, ছোট বউ কিছু বলতো না। গরম লাগলেও মেয়েটা পাখা ছেড়ে বসতো না কারেন্ট বিল বেশি এলে যদি বৌদিরা বা আমি খোটা দেই সেই ভয়ে। এমনকি নিজের সন্তানের কথাও আমাদের কাছে লুকিয়ে গেছে ভয়ে। এবার ভাবেন আমরা কেমন মানুষ! উপরে উপরে সবই সুন্দর দেখতে। অবশ্য এখনও আমি চাই না ও আমাদের সাথে থাকুক কিন্তু একটা গতি না করে তো আমরাও ওকে ছাড়তে পারছি না। মানুষ তো কুকুর বিড়ালের প্রতিও মায়া দেখায় যেখানে ও আমাদের জলজ্যান্ত মেয়ে।”

এমন সময় দর্শিনীর মায়ের এমন কথা যেন হজম করতে কষ্ট হচ্ছে সবার। দর্শিনীর বাবা মেয়ের দিকে তাজ্জব বনে তাকিয়ে রইলো। তার মেয়েটা এত বড় হয়ে গেলো যে বাবার চোখে ধূলো দেওয়া শিখে গেছে? সেও তো তাহলে ব্যর্থ বাবা। যে বাবা মেয়ের সঠিক যত্ন নিতে পারে নি। সেও তো মেয়ের প্রতি উদাসীন হয়েছে তাই তো মেয়ের খোঁজ রাখে নি। কই,বিয়ের আগে তো এমন ছিলো না সবটা। মেয়েকে সে পাশে বসিয়ে খাওয়াতো। মেয়ে আগে খেয়ে নিলে জোড় করে দু এক লোকমা ভাত খাওয়াতো। কিন্তু কই,এ দুইমাসে প্রথম দিন ছাড়া আর একদিনও তো সে একাজটি করে নি। বিবাহিত মেয়ে সংসার ভেঙে এসেছে বলেই কী এতটা উদাসীনতা ছিলো বাবার! লজ্জায় প্রতাপের মাথা নুইয়ে গেলো। রমলা দর্শিনীর মাথায় হাত বুলিয়ে দিলো৷ মৃত্যুঞ্জয় কেবল দাঁড়িয়ে দেখলো এক হতভাগা মেয়েকে। এ দেশেই সে দেখলো একটা মেয়ের এমন পরিণতি। তাদের দেশে আর যাই হোক এত অবহেলা দেখে নি সে।

রমলা নিধিকে আরও কয়েকটা কথা শুনিয়ে বেরিয়ে গেলো। বিমল সাহা মানে নিধির বাবাও তার পিছে পিছে গেলো। তৃণা ছুট লাগালো বাবার পিছে। সবাই তখন গবেষণা করতে ব্যস্ত। কীভাবে হরমোহনকে শাস্তি দেওয়া যায়। সরলা নিজের ছেলের হাত পা বুলিয়ে দিচ্ছে। নিধিকে ধরে তার কাকী ও নিপা দাঁড়িয়ে আছে।

তৃণার ছুট লাগানো দেখে ভ্রু কুঁচকালো দর্শিনী। সেও ধীর পায়ে রমলাদের ঘরের সামনে এসে দাঁড়ালো। জানালা দিয়ে রমলার ঘরে উঁকি দিতেই সে হতভম্ব হয়ে গেলো। রমলার গালে হাত। তৃণারও দু গাল ফুলে আছে। বিমল সাহা রমলার দিকে আঙ্গুল তাক করে বলছে,
“পরের মেয়ের প্রতি এত দরদ তোমার? একদম লাথি মেরে ঘর থেকে বের করে দেবো বজ্জাত মহিলা।”

এবার তৃণাে চুলের মুঠি চেপে ধরে বললো,
“বেশি বড় হয়েছিস তুই না? উড়তে শিখেছিস? আমার মুখে মুখে তর্ক? তোরও পাখনা কাটার ব্যবস্থা আমি করেছি। তোর বিয়ে ঠিক করেছি আমি। নিজেকে প্রস্তুত কর। দুধ কলা দিয়ে কালসাপ পুষবো না আমি।”

দর্শিনীর অবাকে পালা যেন শেষই হচ্ছে না। বিমল মেসো মশাইয়ের এ কী ব্যাবহার? আর তৃণার বিয়ে!

_

ড্রয়িং রুমে বিহঙ্গিনী বসে আছে। তাকে ঘিরে দাঁড়িয়ে আছে সবাই। এতদিন পর মেয়েকে দেখে জড়িয়ে ধরলেন নিলয় কুমার। বিহঙ্গিনীও বাবার পিঠ আঁকড়ে ধরলেন। মোহনা নিজের মেয়ের দিকে টলমলে দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন। যতই হোক সে তো মা। মায়া রান্নাঘর থেকে লেবুর শরবত এনে বিহঙ্গিনীর দিকে এগিয়ে দিয়ে হাসি হাসি মুখে বললেন,
“এই নেও ননদিনী। শরবত টা খেয়ে নেও।”

বিহঙ্গিনী ধীর হাতে শরবতটা নিলো। মায়ার দিকে তাকিয়ে কুটিল হেসে বললো,
“বাব্বা,এখনো যাও নি এ বাড়ি ছেড়ে? আমি তো ভাবলাম এ বাড়িতে তোমার মেয়াদ বেশি দিন না। তা আমাকে ফিরতে দেখে নিশ্চয় অখুশি হয়েছো তাই না?”

বিহঙ্গিনীর কথার ধরণে বিপ্রতীপ সহ সবাই ভ্রু কুঁচকালো। মায়া হাসি হাসি মুখেই বললো,
“ওমা,অখুশি হবো কেনো? এমনেতেও তোমাকে ছাড়া তত মজা লাগছিলো না। বাড়িটা ফাঁকা ফাঁকা লাগছিলো।”

“ওহ্ তাই নাকি? তা আমি চলে যাওয়ার সময় আটকালে না কেনো? ছাঁদ থেকে তো দারুণ ভাবে আমার চলে যাওয়ার দৃশ্য দেখে চোখ জুড়াচ্ছিলে।”

বিহঙ্গিনীর কথা যেন বিস্ফোরণ ঘটালো। মোহনা অবাক কণ্ঠে বললো,
“কী! এ মেয়ে দেখেছিলো তুই যাওয়ার সময়?”

#চলবে

#পথান্তরে_প্রিয়দর্শিনী
#মম_সাহা

পর্বঃ ছাব্বিশ

সময় কেটে যায় ঝড়ের গতিতে। আষাঢ়, শ্রাবণ পেরিয়ে প্রকৃতিতে এখন ভাদ্রের আগমন। দর্শিনীর তখন সাত মাস চলছে। বদলেছে অনেক কিছু। তারা নিজেদের বাড়িতে উঠেছে। নিধির সাথে সম্পর্কটা তুই থেকে তুমিতে গিয়েছে। মায়ের আক্রোশ কমেছে। হরমোহন বদলায় নি। নানান ভাবে ক্ষতি করার চেষ্টা চালাচ্ছে। দর্শিনীর বড় ভাই প্রদীপ এখনো হাঁটা চলা করতে পারছে না। সুমন অবশ্য শক্ত হাতে সংসার চালাচ্ছে। কিন্তু বদলায় নি সমাজ,প্রতিবেশী। প্রতিনিয়ত খারাপ কথা বলে ছোট করে দর্শিনীকে। লজ্জায় মূর্ছা যায় মেয়েটা। কখনো কখনো বা সিংহের ন্যায় গর্জন করে উঠে। খারাপ কথা গুলোর বিনিময়ে একরাশ ঘৃণা ছুঁড়ে মারে। আজ কোর্টে হেয়ারিং। পাকাপোক্ত ভাবে আজ কোর্টে শেষ হবে দর্শিনীর বৈবাহিক সম্পর্ক। এরপর আর কোনো পিছুটান থাকবে না তার। চারটা মাস পর সে মানুষটার মুখোমুখি দাঁড়াবে আজ। হয়তো এরপর আর কখনো মানুষটাকে দেখার ভাগ্য তার হবে না। যে মানুষটাকে একটা সময় না পেলে দমবন্ধকর অনুভূতি হতো আজ সেই মানুষটার সাথে বিচ্ছেদ ঘোষনা করা হবে। প্রকৃতির এই নিষ্ঠুর,নির্মম নিয়ম গুলো নিয়ে বেঁচে থাকাটা বড্ড মুশকিল।

ভাগ্যের নির্মমতা ভেবে ছোট্ট শ্বাস ফেললো দর্শিনী। শাড়ির আঁচলটা ঠিক করতেই বাহির থেকে প্রতাপ সাহার কণ্ঠ ভেসে এলো,
“মা,হলো?”

দর্শিনী ‘আসছি’ বলেই হাত ব্যাগটা উঠিয়ে নেয়। ধীর পায়ে বের হয় ঘর থেকে। আগের তুলনায় শরীর ভার হয়েছে। শরীরের রঙ এত শুভ্র হয়েছে যেন মনে হয় একটু শক্ত করে ধরলেই গলগল করে রক্ত বের হবে। গর্ভকালীন সময়টা পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ সময় একটি নারীর জন্য। অথচ দর্শিনী সেই সময়টাতেই লড়ে যাচ্ছে জীবনের ভয়ঙ্কর লড়াই গুলো। হয়তো তার অপ্রাপ্তির বিরাট খাতায় একমাত্র প্রাপ্তি হবে তার সন্তানটা।

প্রতাপ সাহা উঠানের মধ্যখানে দাঁড়িয়ে আছে। বাবা আর মেয়ে মিলে শহরের পথে পাড়ি জমাবে। যেতে অনেকটা সময় লাগবে তবে দুপুর হতে হতে পৌঁছে যাবে নিশ্চয়। প্রদীপ সুস্থ থাকলে হয়তো তাদের সাথে যেতো কিন্তু হাঁটা চলা করতে পারে না বিধায় যেতে পারছে না। আর বিশাল ব্যবসা রেখে সুমনও যেতে পারছে না, এর জন্য সে অবশ্য অনুশোচনা স্বীকার করেছে। অন্যান্য সময় হলে তৃণা যেতো কিন্তু এখন পরিস্থিতি অন্যরকম। তৃণার বিয়ের কথা চলছে। মৃত্যুঞ্জয়দের বাড়িতে তার মা-বাবা, দাদু,কাকা কাকী সব এসেছে বিদেশ থেকে। প্রায় প্রতিবছরই নাকি তারা আসেন। এ জন্য মৃত্যুঞ্জয় যাবে না,দৃষ্টান্তও তাদের সময় দিচ্ছে তাই সেও যাবে না।

দর্শিনী তপ্ত শ্বাস ফেললো। আজকের দিনে তার অনেক গুলো ভরসার হাত প্রয়োজন ছিলো অথচ বাবা বাদে সাথে কেউ নেই। পৃথিবীতে কঠিন পরিস্থিতি গুলো মানুষকে একাই পাড় করতে হয়। আজ দর্শিনীর কঠিন পরিস্থিতি, তাই সে একাই পাড় করবে। কিন্তু বাবা নামক বটবৃক্ষটা শক্ত হয়ে ছায়া দিয়ে যাচ্ছে অনবরত। এ মানুষটার ব্যস্ততা নেই,অজুহাত নেই। নিঃস্বার্থ ভাবে পাশে আছে কেবল সে।

দর্শিনী বাড়ির উঠানে এসে দাঁড়াতেই মা,বৌদিরা এসে দাঁড়ালো। কাকা কাকীরাও এসেছে। কাকা কাকীরা অবশ্য তাদের বাড়িতে দুধের মাছি। অসময়ে পাশে না পেলেও সুসময়ে দু’পা নিয়ে হাজির থাকে। যখন বাড়ি পুড়ে যাওয়ার মাথা গোঁজার ঠাঁই ছিলো না প্রতাপ সাহার পরিবারের তখন ভাইদের ভালোবাসাটা আমসির মতন শুঁকিয়ে ছিলো। যে-ই বাড়ি হয়ে গেলো সে ভালোবাসা ফুলে ফেপে কলাগাছ হয়ে গেছে।

দর্শিনীর ছোট কাকী দর্শিনীর হাতে একটা ছোট স্টিলের টিফিন বক্স ধরিয়ে দেয়। আদুরে ও মোলায়েম কণ্ঠে বলে,
“এটা পথে যেতে যেতে খেয়ে নিও দর্শিনী। অনেকটা পথ তো,না খেয়ে থাকা উচিৎ না। তোমার বোন একা থাকবে না, নাহয় আমিও যেতাম তোমার সাথে। অবশ্য আমি জানি,তুমি পারবে। মনে রেখো,আমরা নারী আমরাই পাড়ি।”

দর্শিনী হেসে মাথা নাড়িয়ে টিফিনবক্স টা হাতে নেয়। যে কাজটা মায়ের করার কথা ছিলো সেটা ছোট কাকী করছে। ছোট কাকীকে বরাবরই সে পছন্দ করে। কাকী থাকে শহরে। একটা স্কুলের শিক্ষিকা। ছোট কাকা মারা গেছে তাদের বিয়ের তিন বছর পরই। এরপর থেকেই কাকী তার এক বছরের মেয়েটাকে সমাজের থেকে আগলে রেখে লড়ে যাচ্ছে। এ সমাজে ডিভোর্সী,বিধবা,আর বিবাহ উপযুক্ত মেয়ে বিয়ে না হলে দাম থাকে না। কাকী খুব শক্ত মহিলা, তাই তো বৈধব্যের এত বছর পরও বেশ সুন্দর ও সাবলীল ভাবে টিকে আছে। দর্শিনীর বাবা বাদে কেউ এ মানুষটার অসহায় সময়ে পাশে দাঁড়ায় নি। এ মানুষটাকে কেউ সাথ দেয় নি। অথচ এ নারী লড়ে গেছে কোনো কিছু পড়োয়া না করে। তবে দর্শিনী পারবে না কোনো?

হঠাৎ দর্শিনীদের বাড়ির সামনে এসে বড় একটা গাড়ি থামলো। সবাই সেখানেই দৃষ্টি নিবদ্ধ করলো। মৃত্যুঞ্জয়ের গাড়ি দেখে খানিকটা অবাক হলো সবাই। গতকাল তার পুরো পরিবার এসেছে বাংলাদেশ, আজ তার তো এখানে আসার কথা না। গাড়ি থামতেই দৃষ্টান্ত আর মৃত্যুঞ্জয় গাড়ি থেকে নেমে আসলো। দুজনেরই ফর্মাল গেটআপ। মৃত্যুঞ্জয় কালো টিশার্টের উপর সাদা কোর্ট সাথে সাদা প্যান্ট পড়েছে। দৃষ্টান্ত হালকা আকাশী রঙের শার্ট আর কালো প্যান্ট পড়ে এসেছে। প্রতাপ সাহা কণ্ঠ সামান্য উঁচু করে বিষ্ময় নিয়ে বললেন,
“আরে বাবারা, তোমরা এখানে? আমি তো ভাবলাম আসবে না।”

“কেনো ভাবলেন, কাকা? প্রিয়দর্শিনীর এমন দিনে আমরা তাকে একা ছাড়বো ভাবলেন কীভাবে? প্রিয়দর্শিনীকে অনুভব করতে হবে তার পুরো পৃথিবী একা না, স্বল্প হলেও কিছু মানুষ তার সাথে আছে।”

মৃত্যুঞ্জয়ের কথায় প্রতাপ সাহা সন্তুষ্টির হাসি দিলেন। দৃষ্টান্ত কতক্ষণ ভ্রু কুঁচকে আশেপাশে তাকিয়ে অদ্ভুত কণ্ঠে বললো,
“প্রিয়’র সাথে কোনো মেয়েলোক যাবে না? পথে ওর কতরকমের প্রয়োজন হতে পারে।”

দৃষ্টান্তদের দেখে দর্শিনীর হাসি হাসি মুখ খানা মুহূর্তেই চুপসে গেলো কথা শুনে। নিধি তখন তাদের রান্নাঘরের সামনে দাঁড়িয়ে আছে। মুখটা ভার করে সে বললো,
“আমিই যেতাম ভাই কিন্তু এ জায়গাটাও তো সামলাতে হবে। ধৃষ্ট স্কুল থেকে ফিরে আমাকে না পেলে হৈচৈ শুরু করবে। তোমাদের দাদা বিছানায়। তারও তো সব আমার দেখাশোনা করা লাগবে। তাই পারছি না।”

দৃষ্টান্ত হাসলো। ছোট একটা অবহেলার শ্বাস ফেলে মনে মনে তাচ্ছিল্য করে বললো,’তিন নাম্বার হাত,অজুহাত’।

দর্শিনী কথা ঘুরানোর জন্য একটা ফিকে হাসি দিয়ে বললো,
“আরে সমস্যা নেই বৌদি। আমার তেমন কিছুর প্রয়োজন হবে না। চলো সবাই। দেরি হচ্ছে যে।”

“দর্শিনী,খেয়াল করে দেখে আসবে তোমার মিনসে কেমন সুখে আছে। পারলে বাচ্চাটার কথাও ভালো করে মনে করিয়ে দিবে।”

মেঝো কাকীর এমন কথায় ভ্রু কুঁচকালো দর্শিনী। এ মানুষ গুলো যে এমন সেটা তার ঢের জানা। কিন্তু দর্শিনীকে অবাক করে দিয়ে তার বড় জেঠু বলে উঠলো,
“ঐ ছেলের ঘাড় ধরে বাচ্চার দায়িত্ব নেওয়াবে। যতটুকু দেয় সেটাই লাভ। আর এই বাচ্চা তাদের বংশের। সে সূত্রে কিছু হাতাতে পারলে তোমারই লাভ।”

দর্শিনী তাজ্জব বনে জেঠুর দিকে তাকিয়ে রইলো৷ ঘিনে তার শরীর রি রি করে উঠলো। কণ্ঠ হলো,কঠোর। চোখ মুখ শক্ত করে সে বললো,
“এ বাচ্চা কেবল আমার। ও আমার সন্তান হিসেবে আসছে কোনো খেলার গুটি না। আর তাছাড়া তোমাদের ওত ভাবতে হবে না ওকে নিয়ে। আমার সন্তানকে আমি তো আর তোমাদের ঘাড়ে চাপিয়ে দিচ্ছি না। তাই অত চিন্তার প্রয়োজন নেই।”

দর্শিনীর কথাটা সপাটে যেন চড় লাগালো কাকা-জেঠুর-জেঠিমার গালে। তারাও কম যায় না। মেঝো কাকী মুখ ভেঙচিয়ে বলেই উঠলো,
“এত চেটাং চেটাং কথা কম বলো মেয়ে। মুখে চোখে তোমার কোনো শোক তাপ নেই। ঘর ভাঙতে চলছে এমন মেয়ে কীভাবে এত বড় বড় কথা বলে আমার বোধগম্য হয় না। একে তো প্রেমের বিয়ে তাও টিকিয়ে রাখতে পারলে না।”

“তোমারও তো কাকী প্রেমের বিয়ে। কাকা বিদেশ বছরের পর বছর না থাকলে তোমার বিয়েটাও টিকতো না। স্বামী তার স্ত্রীর জ্বালায় দেশে আসতে চায় না, এর চেয়ে লজ্জা আছে?”

দর্শিনীর কথায় ফোঁস ফোঁস করে উঠলো কাকী। দু চারটা কথা শুনিয়ে হন হন করে বেরিয়ে গেলো। আজ হঠাৎ করেই যেন দর্শিনী প্রতিবাদী হয়ে উঠলো। সে হয়তো বুঝতে পেরেছে, টিকে থাকতে হলে প্রতিবাদের বিকল্প নেই।

দর্শিনী তপ্ত শ্বাস ফেলে গাড়ির দিকে এগিয়ে যাওয়ার সময় ব্যতিব্যস্ত পায়ে হাজির হয় নিপা। গাড়ির কাছে গিয়ে বেশ অকপটে বলে,
“আমি যাবো তোমার সাথে, প্রিয়। চলো।”

সবাই যেন বিষ্মিত হয়ে গেলো। নিধি বললে নাহয় মানা যেতো কিন্তু নিপার কথা যেন হজম হলো না কারো। এ জন্য হয়তো বলে মানুষের ভালো খারাপ দুইটা দিকই আছে। কেবল ভালোটাতেও মত্ত হয়ে কারো পূজারী হওয়া উচিৎ না আবার কেবল খারাপটাকে দেখেও কাউকে বিচার করা উচিৎ না।

সময় চলে যাচ্ছিলো বিধায় কেউ আর কথা বাড়ালো না। যে যার মতন গাড়িতে গিয়ে উঠলো। দর্শিনীদের গাড়ি বাড়ির সামনে থেকে পাড় হতেই একজন মনে মনে বললো,
“ওর এ যাওয়াই যে শেষ যাওয়া হয় ভগবান।”

_

বিপ্রতীপের মনে চাপা উত্তেজনা। হাত পাও সামান্য কাঁপছে। তাদের পুরো পরিবার গাড়ি নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে কোটের দিকে। এই দু’মাস মায়ার পরীক্ষা ছিলো বিধায় সংসারে ঝামেলা একটু কম হয়েছে। তবে সেদিন যখন সবাই জানলো মায়া বিহঙ্গিনীকে যেতে দেখেছে এরপর থেকে মায়ার প্রতি তাদের আরেকটা রাগের সৃষ্টি হয়েছে। বিহঙ্গিনীরও পড়াশোনার চাপ একটু বেশি ছিলো বিধায় নিজের উদ্দেশ্য অনুযায়ী কাজ শেষ করতে পারে নি। তবে খুব শীগ্রই সে রহস্যের জাল খুলবে।

বিপ্রতীপের মনে সেই বিয়ের দিনের মতন উত্তেজনা। সেদিন তার মন রোমাঞ্চিত হয়েছিলো ভালোবাসার মানুষটাকে একবারে নিজের করে পাওয়ার আশায়। কিন্তু আজ, আজ সে মানুষটাকে একবার দেখার আশায় এত রোমাঞ্চনা।

আচ্ছা,দর্শিনীকে এখন দেখতে কেমন লাগে? নিশ্চয় বিষাদ কাতর মেয়েটা বিরহে একবারে শুকিয়ে কঙ্কাল হয়ে গিয়েছে! আচ্ছা, আজ যদি দর্শিনী তার কাছে অনুরোধ করে আরেকটাবার থেকে যেতে সে কী করবে? মেয়েটা নিশ্চয় প্রচুর কাঁদবে আজ। কে বলেছিলো সেধে ডিভোর্স পেপার দিতে? এবার বুঝুক মজা।

এমন হাজার জল্পনা-কল্পনা করে বিপ্রতীপ এগিয়ে যাচ্ছে কোটের দিকে। সাথে মা-বাবা,বিহু,মায়াও আছে। দর্শিনীরাও এগিয়ে আসছে তাদের কাছে। কি হবে দুজন চির পরিচিত প্রিয় থেকে অপ্রিয় হওয়া মানুষরা মুখোমুখি হলে! নিশ্চয় নতুন কিছু অপেক্ষা করছে ওদের জীবনে।

#চলবে

#পথান্তরে_প্রিয়দর্শিনী
#মম_সাহা

পর্বঃ সাতাশ

উত্তপ্ত রোদে মানুষ তপ্ত শ্বাস ফেলে কূল পাচ্ছে না। ভাদ্র মাসের আদ্র গরমে প্রকৃতিও বোধহয় দিক ভ্রষ্ট। দর্শিনীদের গাড়ি মাত্র কোর্টের সামনে এসে দাঁড়িয়েছে। চারপাশে ভীড়। ব্যস্ত পথচারীদের পদচারণে গরম যেন প্রতি মিনিটে মিনিটে দ্বিগুণ বৃদ্ধি পাচ্ছে। দর্শিনীর ফর্সা গোলগাল মুখ খানা লাল টকটকে হয়ে আছে। ঘামের জন্য কপালে লেপ্টে আছে চুল। কোমড় অব্দি লম্বা বেনীটা শোভা পাচ্ছে ঘাড়ের ডানদিকে। শরীরে ডুমুরফুল রাঙা শাড়ি। কপালে টিপ। সাথে মোটাসোটা শরীর। খুব আদুরে লাগছে তাকে। মনে হয় যেন একটু আদর করে তার গাল গুলো টেনে দিলে খারাপ হতো না।

মৃত্যুঞ্জয় গাড়ির ভেতর থেকে জলের বোতলটা নিয়ে এগিয়ে দিলো দর্শিনীর দিকে সাথে পকেট থেকে বের করা শুভ্র রাঙা রুমালটাও। দর্শিনী ভ্র কুঁচকে তাকাতেই চোখ দিয়ে ইশারা করে ক্ষীণ স্বরে বললো,
“রুমালটা দিয়ে মুখটা মুছুন। আর জলটুকু খান তো। ঘেমে-নেয়ে কী বিশ্রী অবস্থা হয়েছে মুখটার। নিন ধরুন।”

দর্শিনী আশপাশ তাকালো। মনের মাঝে তার কেমন এক উত্তেজনা। মাঝে মাঝে শরীরটাও মৃদু কেঁপে উঠছে সেই উত্তেজনায়। এতদিন পর মানুষটাকে দেখে তার বুকের তোলপাড় ভয়াবহ রূপ ধারণ করবে না তো আবার? ধৈর্য ধরে টিকে থাকতে পারবে তো সে? নাকি বিক্ষিপ্ত অনুভূতি গুলো ছিটকে বেরিয়ে আসবে? পারবে তো সে নিজেকে সামলাতে? বরাবরই ভালোবাসার কাছে মানুষ বেহায়া হয়ে যায়। শেষ মুহূর্তে এসে সেও কী বেহায়ামি করবে?

হঠাৎ দর্শিনী অনুভব করলো তার মুখে আদুরে ছোঁয়া দিয়ে কেউ ঘাম টুকু মুছে দিচ্ছে। প্রথমে ভাবলো হয়তো বাবা, কিন্তু পরক্ষণেই মানুষটার দিকে তাকিয়ে দর্শিনী হতভম্ব। ছোট বৌদি এত আদর যত্ন করে তার মুখ মুছিয়ে দিচ্ছে! দর্শিনী যেন কিছু বলতে গিয়েও বলতে পারলো না। এই মানুষটিকে যে তার বড্ড অচেনা মনে হচ্ছে।

নিপা ঘাম মুছতে মুছতেই জলের বোতলের মুখটা খুলে দর্শিনীর দিকে এগিয়ে দিলো। শীতল কণ্ঠে বললো,
“জলটা খাও,প্রিয়।”

দর্শিনী কাঁপা হাতে জলটা নিলো৷ ধীর গতিতে পান করলো। তন্মধ্যেই বহুল পরিচিত কালো চকচকে গাড়িটা তাদের সামনে এসে দাঁড়ালো। চির পরিচিত গাড়িটা দেখে আকষ্মিক নাকে মুখে জল উঠে গেলো তার। অনবরত সে কাশতে লাগলো। মৃত্যুঞ্জয়, প্রতাপ,দৃষ্টান্ত, নিপা হঠাৎ ই ভ্যাবাচেকা খেয়ে গেলো। সবাই উৎকণ্ঠা নিয়ে তার মাথায় পিঠে হাত বুলিয়ে ঠান্ডা করার চেষ্টায় নিমজ্জিত হলো।

এর মাঝেই ছুটে আসলো বিহু। উৎকণ্ঠা নিয়ে ব্যাতিব্যস্ত হয়ে প্রশ্ন করল,
“কী হয়েছে বৌদি? ইশ মুখটা কেমন লাল হয়ে গেছে তোর। রোদের মাঝে এখানে ওরে দাঁড় না করিয়ে ভেতরে নিয়ে গিয়েও তো বসাতে পারেন।”

বিহুর পিছে পিছে গাড়ি থেকে নেমে বিপ্রতীপ,মোহনা,মায়া,নিলয় কুমার হা হয়ে তাকিয়ে আছে। তাদের নিজেদের চোখকে তারা বিশ্বাস করাতে পারছে না। এ কাকে দেখছে তারা? দর্শিনীর এ কি রূপ! সবার যেন হতভম্ব অবস্থা। পারছে না তারা এটা ভ্রম বলে উড়িয়ে দিতে আর না পারছে সত্য বলে মেনে নিতে। মোহনা হা হয়ে দর্শিনীর মুখ থেকে পা অব্দি চোখ বুলালো। ফুলে উঠা পেটটার দিকে গিয়ে দৃষ্টি আটকালো। চোখের পাতা পড়লো না, মনি নড়লো না।

মোহনার বিষ্ময় আকাশ ছুঁয়েছে। ছেলে আর স্বামীর দিকে তাকিয়ে দেখে তাদেরও এক দশা। মোহনা বিপ্রতীপের কনুইয়ে কিঞ্চিৎ ধাক্কা দিলো। বিপ্রতীপের ধ্যান কাটলো। হতভম্ব ভাব এখনো বিদ্যমান। তার শরীর বেয়ে ঘামের সরু রেখা গড়িয়ে পড়ছে। সে মায়ের দিকে তাকালো। দৃষ্টিতে তার রাজ্যের কৌতূহল। মোহনা ছেলের দৃষ্টির মানে হয়তো বুঝলেন। প্রায় ফিসফিসিয়ে বললেন,
“কিছু কী বোধগম্য হলো, বাবু?”

বিপ্রতীপ ডানে বামে মাথা নাড়িয়ে অদ্ভুত কণ্ঠে বললো,
“মা,আমাদের সন্তান! দর্শিনীর গর্ভে আমার অংশ তাই না?”

মোহনা হকচকালেন। কী উত্তর দিবে ভেবে না পেয়ে সামান্য চোখ রাঙালেন। বিপ্রতীপ পাত্তা দিলো না সে দৃষ্টি। ছুটে গেলো তার সামনে থাকা অসম্ভব সুন্দর নারীটির কাছে। হাত পা তার কাঁপছে। উত্তেজনায় শরীর মিইয়ে আসছে। কণ্ঠনালীতে মিছিল চালাচ্ছে অগণিত শব্দ কণিকা। কত কথা ভীড় জমিয়েছে ওষ্ঠ মাঝে।

দর্শিনীর তখন কাশি ফুরিয়েছে। জোরে জোরে শ্বাস নিচ্ছে। সব মিলিয়ে যেন তার নাজেহাল অবস্থা হয়ে গেছে। শ্বাস নিতেও তার কষ্ট হচ্ছে। মৃত্যুঞ্জয় মাথায় হাত বুলিয়ে দিলো। চোখে মুখে লোকটার রাজ্যের অস্থিরতা। চিন্তিত কণ্ঠে শুধালো,
“ঠিক আছেন প্রিয়দর্শিনী? একটু সাবধানে খাবেন তো জল। দেখি হাতটা,পালস টা দেখতে হবে। এত অস্বাভাবিক ভাবে ঘামছেনও বা কেনো? আপনার কী অসুস্থতা অনুভব হচ্ছে? কথা বলুন প্রিয়দর্শিনী? আপনার কমফোর্ট জোন দরকার এখন। চলেন ভিতরে যাই।”

দর্শিনী মাথা নাড়ালো। যার অর্থ সে ভিতরে যেতে চায়। মৃত্যুঞ্জয়ের এতক্ষণের শাসন করা দৃশ্য দু চোখ ভরে দেখলো বিহঙ্গিনী। গত দু’মাস যাবত মানুষটাকে দেখে নি কিন্তু অনুভব করেছে রোজ। তার এমন অনুভবের কারণ তার জানা নেই। আবার হয়তো আছে। ফর্সা, সুঠাম দেহী মানুষটাকে কী মারাত্মকভাবে ভালো লেগেছে তার। কিন্তু সেটাকে প্রশ্রয় দেওয়া নিত্যান্তই বোকামী ছাড়া কিছুই না। আফসোসের এক দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো বুক থেকে। চাপা কষ্টে মিইয়ে গেলো দর্শিনীর ভাবনা। কেবল ফ্যাল ফ্যাল করে সে তাকিয়ে রইলো।

“আমার বাচ্চা, আমার আমার বাচ্চা তাই না প্রিয়দর্শিনী? আমার ছোট্ট সোনামণি আসছে? তুমি আমাকে জানালে না? ও আমার তাই না প্রিয়দর্শিনী?”

বিপ্রতীপের চোখ মুখ উজ্জ্বল করা কথা শুনে দর্শিনী কাশি চলো গেলো। জোরে জোরে শ্বাস নেওয়া কমে গেলো। এতক্ষণ যে উত্তেজনাটা তার ভেতর কাজ করছিলো সেটা মিইয়ে গেলো। কেবল ঠোঁট জুড়ে বিচরণ করলো কুটিল হাসি। না তার এখন আর বুক আছড়ে এ মানুষটার জন্য কান্না আসছে না তবে মানুষটাকে দেখার যে গোপন তৃষ্ণা, সেটা মিটিয়ে নিয়েছে সে।

বিপ্রতীপ আরেক কদম এগিয়ে আসলো, দর্শিনীর পেটের দিকে আঙ্গুল তাকে করে বললো,
“ও আমার তাই না প্রিয়দর্শিনী?”

“দর্শিনী। কেবল দর্শিনী হবে। আর ও আপনার না, কেবল এবং কেবল মাত্র আমার। চলো বাবা ভিতরে যাই।”

প্রথম কথাটা শক্ত কণ্ঠে বললেও শেষের কথাটা নিজের বাবাকে উদ্দেশ্য করে বললো দর্শিনী। মৃত্যুঞ্জয় ততক্ষণে বুঝে গেছে এ ছেলেটা কে। হাত তার মুঠ হয়ে এলো। তেড়ে কিছু বলতে যাওয়ার আগেই নিপার গলা ভেসে এলো,
“আরে বিপ্রতীপ বাবু যে,তা কী খবর? নতুন বউ নিয়ে কেমন চলছে দিনকাল? নতুন বউ মনে হচ্ছে তত যত্ন করে না৷ এমন শুকিয়ে মরা কাঠ হয়েছেন যে!”

বিপ্রতীপ ভ্রু কুঁচকালো। সামান্য হলেও সে নিপাকে চেনে। এ মহিলা তো ননদের পক্ষ ধরে কথা বলার মানুষ না।

নিপা তাচ্ছিল্য হাসলো। মুখ বাঁকিয়ে বললো,
“আমাকে অত কী দেখছেন? নতুন করে আবার বিয়ে টিয়ে করার মতলব আছে নাকি? না ভাই আমার স্বামী আছে। বহু বিবাহ করার স্বাধ আমার নেই।”

নিপার টিটকারি মারা কথা যে সপাটে বিপ্রতীপের গালে চড় লাগিয়েছে তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। নিলয় কুমারও এবার সাহস করে এগিয়ে এলেন। বিনীত কণ্ঠে দর্শিনীর গোলগাল মুখ খানার দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে বলল,
“কেমন আছো, মা? অনেকদিন পর তোমাকে দেখলাম। ভীষণ মিষ্টি লাগছে। এই চার মাসেই তোমার সৌন্দর্য দশগুণ বৃদ্ধি পেয়েছে মনে হচ্ছে। এটাকেই হয়তো বাবার বাড়ির যত্ন বলে। তা দাদা, আপনি ভালো আছেন?”

প্রতাপ সাহাও বিনীত স্বরে উত্তর দিলেন,
“এইতো ভালো আছি ভীষণ। আমার মা আমার সাথে থাকে,রাতটা নিশ্চিন্তে ঘুমাতে পারি। গত কত গুলো বছর তো চিন্তায় ঘুমাতে পারতাম না। এ বুঝি মেয়েটাকে আর দেখা হবে না ভেবে ভয়ে থাকতাম। এখন আর সে ভয়ও নেই। এর চেয়ে ভালো আর কী আছে?”

নিলয় কুমারের মাথা নত হলো। প্রতাপ সাহা কী বুঝাতে চেয়েছে তার বুঝতে বাকি নেই কারো। ক্ষেপে উঠলো মোহনা, ক্ষিপ্ত বাঘিনীর ন্যায় হিংস্র কণ্ঠে বলল,
“কেনো, কেনো আপনার মেয়ে বুঝি আমাদের কাছে নিরাপদ ছিলো না?”

“তোমার আচরণেই তোমার উত্তর লুকিয়ে, মোহনা। এবার মানুষ হও।”

স্ত্রীর প্রতি তীব্র ঘৃণা প্রকাশ করে বলে উঠলো নিলয় কুমার। মোহনা কিছু বলতে গিয়েও থেমে গেলো। মনে হলো এখানে কিছু বলা মানেই পরিস্থিতি অন্য দিকে মোড় নেওয়া। ছেলেটাও না আবার বেঁকে বসে।

মোহনা ধীর পায়ে পিছে নেমে গেলো। মায়া তখনো ঠাঁই দাঁড়ানো গাড়ির দরজা ধরে। মোহনা মায়ার কাছে গিয়ে ফিসফিসিয়ে বলল,
“এখানে সঙ সেজে না দাঁড়িয়ে স্বামীকে আগলাও। হাত ছাড়া না হয়ে যায়।”

“হাতের মুঠোয় নিলামই কখন যে হাত ছাড়া হবে? আপনার ছেলে গোঁ ভাগাড়ে গিয়ে মরুক। তাতে আমার কী!”

মায়ার গা ছাড়া এমন উত্তরে মোহনার রাগটা শির শির করে বাড়লো। খুব বিশ্রী এক গালি দিয়ে বলে উঠলো,
“তো বিয়ে করেছিস কেনো রে? শরীরে জ্বালা মিটানোর জন্য? পতিতা হলেই তো পারতিস।”

মায়ার সারা শরীর যেন ঘিন ঘিন করে উঠলো। মায়ের বয়সী মানুষের এমন কথা তার সহ্য হলো না। মহিলাটা বড় বলে বেঁচে গেলো নাহয় ঠাটিয়ে এক চড় দিতো সে। নিজের ঘৃণাটা নিজের ভিতর চাপা রাখলো না মায়া। বরং এক দলা থু থু মোহনার পায়ের সামনে ফেলে ধিক্কার দিয়ে বলল,
“মনে করুন আপনাকে চড়ের পরিবর্তে এই থু থু টা ফেললাম। আপনার মতন তো আর নিচে নামতে পারি নি নাহয় সেই শুভ কাজটাই করতাম।”

মায়ার কথায় কিছু একটা ছিলো যাতে থম মেরে গেলো মোহনা। হাঁটুর বয়সী মেয়ে তাকে চড় মারার ইচ্ছে পোষণ করেছে এর চেয়ে বড় অপমান যেন আর কিছুই হতে পারে না। হঠাৎ করেই তার মাথা ঘুরে উঠলো। তড়তড় করে ঘাম ছুটলো শরীর থেকে। বুকে কে যেন চেপে ধরলো মনে হয়। লুটিয়ে পড়লো সে মাটিতে। সবাই কেবল ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে তাকিয়ে রইলো। মায়া নিজেও হা হয়ে গেলো। পরক্ষণেই মনে হলো সে বিশ্রী একটা কাজ করে ফেলেছে।

#চলবে