পথান্তরে প্রিয়দর্শিনী পর্ব-১৩+১৪+১৫

0
210

#পথান্তরে প্রিয়দর্শিনী
#মম_সাহা
#পর্ব-১৩+১৪+১৫

ঝিরিঝিরি বৃষ্টির জন্য দর্শিনীর শরীর প্রায় খানিকটা ভিজে গেছে। সে প্রাণপণে দৌঁড়িয়ে তাদের মাঠে হাজির হয়। তার পিছে পিছে তৃণা,নিধি,নিপা সবাই হাজির হয়েছে। মাঠের মাঝামাঝি তখন দাঁড়িয়ে আছে অনেকে। ভীষণ হট্টগোল সেথায়। দর্শিনী এগিয়ে গেলো, এগিয়ে যেতেই তার পিলে চমকে উঠলো। বাবার মাথার এককোণা দিয়ে গড়িয়ে পড়ছে রক্ত। তাকে ধরে দাঁড়িয়ে আছে দৃষ্টান্ত দা। সেথায় চলছে নিরলস বাক-বিতর্ক। দর্শিনী সহ সকল মহিলা আৎকে উঠলো। দর্শিনী ছুটে বাবার পাশে গিয়ে দাঁড়ালো,বাবার মাথায় ছাই রাঙা শাড়ির আঁচলটা চেঁপে ধরলো। উৎকণ্ঠিত গলায় বললো,
“কী হয়েছে বাবা? ব্যাথা পেলে কীভাবে?”

প্রতাপ সাহা এত ব্যাথা পাওয়া স্বত্বেও মিষ্টি হাসলেন। শীতল কণ্ঠে বললেন,
“কিছু হয় নি, মা। শান্ত হও।”

বাবা-মেয়ের কথার মাঝে কেউ একজন হুংকার দিয়ে উঠলো,
“প্রতাপ,তবে তুমি কী এ জমিন ছাড়বে না? এটাই কী তোমার শেষ সিদ্ধান্ত?”

প্রতাপ সাহা মেয়ের থেকে দৃষ্টি ফিরিয়ে লোকটার দিকে তাকালেন। অদ্ভুত এক দাম্ভিক হাসি দিয়ে বললেন,
“আমি একবার যা বলি তা কখনোই বদলাই না। আমার ‘না’ কথাটি আর হ্যাঁ হবে না।”

প্রতাপের উত্তরে হরমোহন সেন কুটিল হাসলেন। রহস্যময় কণ্ঠে বললেন,
“ভেবে বলছো তো?”
“একদম।”

প্রতাপের দ্বিধাহীন উত্তরে হরমোহনের হাসি প্রশস্ত হলো। সে এবার দর্শিনীর দিকে অযাচিত দৃষ্টি নিবদ্ধ করলো। কাজের ছেলেটা থেকে হুঁকা নিয়ে সেটাই কয়েকটা টান দিয়ে ধুঁয়া ছাড়লো। অতঃপর পাঞ্জাবির হাতা ঠিক করতে করতে দর্শিনীর উদ্দেশ্যে বললো,
“দেখেছেন তো মা, আপনার বাবা বড্ড অবুঝ সাজছে। সে বুঝেও বুজছে না। আমাকে রাগালে তার পরিণতি কিন্তু খারাপ হতে পারে।”

দর্শিনী এতক্ষণ চুপ থাকলেও এখন আর চুপ থাকতে পারলো না। কণ্ঠে তার উত্তপ্ত তেজ নিয়ে বললো,
“ছোট বেলা থেকেই তো দেখে এসেছি এ জমি আমার বাবার। হুট করে আপনি চাইলেই তো আমার বাবার সাধের জমি আপনাকে দিয়ে দিবে না, তাই না? এ ছাড়াও শুনেছি এ জমিতে নাকি আপনি তামাক চাষ করবেন। যেখানে তামাক ক্ষতিকর জিনিস। আমার বাবা তার জমিকে সন্তানের মতন মানে। সেই সন্তানের এমন নিকোষ কালো ব্যবহার তো সে হতে দিবে না। আর না আমরা মেনে নিবো এই অবমাননা। এতক্ষণ আপনি দৃষ্টান্ত দা’র বাবা দেখে সম্মান করেছি। কিন্তু আপনি আপনার সম্মান রক্ষা করতে অক্ষম, জেঠামশাই। দুঃখের সাথে বলছি যে, এ জমির আশা আপনি ছেড়ে দেন।”

দর্শিনীর কথার ধরণে হরমোহনের বিশ্রী, প্রশস্ত হাসিখানা দমে এলো। মুখে ভর করলো অদ্ভুত হিংস্রতা। কণ্ঠস্বরে কাঠিন্যতা এনে সে হুমকির স্বরে বললো,
“আমিও দেখি,তোমরা কীভাবে আটকাও। মূল্য না বড় মাপের দিতে হয় দেখো।”

“হুমকি দিচ্ছেন? আপনার হুমকিতে কিছু যায় আসে না। আপনার ছেলে হয়েই আমি ওদের পক্ষে আছি। আমিও দেখি, আপনি কী করতে পারেন। আসলে আপনার ছেলে হিসেবে নিজেকে পরিচয় করাতেও আমার ঘৃণা লাগে। এই আপনার জন্য আমি দেশ ছেড়েছিলাম। আপনি একটা জঘন্য লোক।”

দৃষ্টান্তের কথায় কোনো রকমের প্রতিবাদ করলো না লোকটা। বরং বেশ সরল কণ্ঠে বললো,
“বাড়িতে এসো তুমি। অন্যের ঝামেলায় নিজেকে জড়িও না। তুমি আমাকে বাবা হিসেবে না মানলেও আমি তোমাকে ছেলে মানি। গ্রামে এসে অন্য জায়গায় থাকছো, সেটা দৃষ্টিকটু লাগে।”

দৃষ্টান্ত ঘৃণ্য দৃষ্টিতে বাবার দিকে তাকালো। হরমোহন তার দলবল নিয়ে মাঠ ছাড়লো। ততক্ষণে সন্ধ্যা নেমেছে পরিবেশে। সাথে ধীরে ধীরে বাড়ছে বৃষ্টির প্রকোপ।

হরমোহন চলে যেতেই দৃষ্টান্ত মাথা নিচু করে প্রতাপ সাহার দিকে তাকিয়ে লজ্জিত কণ্ঠে বললো,
“আমাকে ক্ষমা করবেন, কাকা। বাবা ধীরে ধীরে পিচাশে রূপান্তরিত হচ্ছে। আপনারা চাইলে মানহানীর মামলা করতে পারেন।”

দৃষ্টান্তের কথায় প্রতাপ সাহা হাসলেন। ছেলেটার বাহুতে ছোট একটা চড় দিয়ে বললেন,
“ছোট্ট একটা ব্যাপারে মানহানীর মামলা করার দরকার নেই। আর তাছাড়া তোমারও লজ্জিত হওয়ার কিছু নেই। আমরা তোমাকে আমাদের ছেলে হিসেবেই দেখি। এবার চলো আমাদের বাড়ি। আমার কপালটা তো ব্যান্ডেজ করাতে হবে।”

বরাবরের মতন প্রতাপ সাহার আচরণে মুগ্ধ হলো দৃষ্টান্ত। মাথা ঝাকিয়ে সাঁই দিলো বাড়ি যাওয়ার প্রস্তাবে। দর্শিনী, তৃণা আর দৃষ্টান্ত প্রতাপ সাহাকে আগলে ধরলো। তার পিছে পিছে আসলো তার দুই ছেলে আর ছেলের বউ।

_

নিস্তব্ধ ড্রয়িং রুমের মানুষ গুলোর মাঝে বিধ্বস্ত অবস্থা। মায়া বিহঙ্গিনীর চিঠিটা খুলে পড়া শুরু করলো,

“অপ্রিয় পরিবার,
তোমরা যখন আমার বিষাক্ত শব্দগুচ্ছ দিয়ে সাজানো পত্র খানা পাবে,তখন আমি তোমাদের কাছ থেকে অনেক দূর চলে গেছি। একদম ধরা ছোঁয়ার বাহিরে। চিঠির শুরুতে নিজের পরিবারকে অপ্রিয় বলতে আমার হাত কেঁপেছিলো কিন্তু হৃদয় কাঁপানি একবারও। তোমাদের আচরণ ধীরে ধীরে আমাকে অতিষ্ঠ করে তুলছিলো, তাই চলে যাচ্ছি বহুদূর। আর ফিরে দেখবো না তোমাদের। নেই কোনো পিছুটান আমার। বৌদির সাথে তোমরা যা করেছো, তা-ই যথেষ্ট ছিলো আমার ঘৃণা কুড়াতে।

বিপ্রতীপ দাদা,বরাবরই তোমাকে আমি আমার আদর্শ মানতাম। কিন্তু মানুষের আসল রূপ যে খোলসের আড়ালে থেকে যায়, তোমাকে না দেখলে জানতামই না। বৌদিকে যখন তুমি এ বাড়িতে নিয়ে এসেছিলে সেদিন থেকে আমি পৃথিবীর সেরা একজন বন্ধু পেয়েছিলাম যা কালের গহব্বরে হারিয়ে গেছে তোমাদেরই কারণে। তুমুল স্বপ্ন চোখে নিয়ে যে মেয়েটা তোমাদের বাড়িতে পা দিয়েছিলো, রঙহীন জীবন নিয়ে সে মেয়েটা তোমাদের বাড়ি ছেড়েছে। দুজনই মেডিকেলের একই ইয়ারের স্টুডেন্ট ছিলাম। আমি ঘরের মেয়ে বলে আমাকে পড়াশোনা করিয়ে ডাক্তার বানানোর পর্যায়ে এনে দিয়েছো আর ও পরের মেয়ে বলে পায়ে চেপে হ’ত্যা করেছো ওর স্বপ্ন। মেয়েটা অভিযোগ করে নি। সকাল বিকেল খেটে গিয়েছে অক্লান্ত,কেবল তোমাদের ভালোবাসা পাওয়ার জন্য। কিন্তু অভাগিনীর কী আর সে কপাল আছে? তুমি যেদিন নতুন বউ নিয়ে ঘরে ঢুকলে,সেদিন প্রথম মেয়েটা অভিযোগের ঝুলি খুলে বসেছিলো। ঢেলে দিয়েছিলো তার সকল ব্যাথা। আমি সহ্য করতে পারছিলাম না মেয়েটার এমন বিধ্বস্ত অবস্থা। এরপর আর তার চোখে চোখ মেলাতে পারি নি। প্রিয় বান্ধবীর করুণ দশা দেখে গেছি দূর হতে। সে তো পরের মেয়ে, তোমরা হলে ঘরের লোক। কিইবা আর করতে পারি?

আর মা,তোমাকে সত্যিই আমার কিছু বলার নেই। আমার চোখে সবচেয়ে ঘৃণ্য মানুষ তুমি। একমাত্র তোমার কারণে আমাদের হাসি খুশি পরিবার মূর্ছা গেছে। শুধু তোমার অহেতুক দম্ভের কারণে ঝলসে গেছে কত গুলো মানুষের সুখ। খুব নতুন বউয়ের প্রয়োজন ছিলো তোমার তাই না? এসেছে তো নতুন বউ। আমি প্রার্থনা করি তোমার প্রতিটা সময় তুমি গুমরে গুমরে শেষ হও।

প্রিয় বাবা,ক্ষমা করো আমায়। এই সবকিছুর মাঝে তোমার কোনো দোষ ছিলো না। আদৌও কী তুমি একেবারেই নির্দোষ, বাবা? অন্যায় যে করে আর অন্যায় যে সহ্য করে তারা সমান দোষী। তাই তুমি আমিও দোষী। তাও তো আমি প্রতিবাদ করেছিলাম। কিন্তু তুমি চুপ থাকতে সদা। মেয়েটাকে তো এত ভালোবাসতে,একটু পাশে দাঁড়াতে পারলে না? তোমার একটা বুলি হয়তো বদলে দিতে পারতো সবটা। তবুও আমি যেতে যেতে তোমায় দোষী করলাম বলে মন খারাপ করো না। তোমার সবচেয়ে বড় দোষ তুমি অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে জানো নি।

অতঃপর মায়া,তোমাকে দেখলাম আর কতদিনই বা হলো। তুমি এভাবে না আসলেই হয়তো পারতে। যাই হোক,তুমি না এলে আমার গুণধর ভাই হয়তো অন্য কাউকে আনতো। তাই সম্পূর্ণ দোষ তোমাকে দেওয়া যায় না। কেবল এতটুকু বলবো,আমার বাবাটাকে দেখে রেখো। আর কার কী করবে সেটা তোমার ব্যাপার।

তোমার সংসার তুমি সামলে রেখো।

ইতি
বিহঙ্গিনী”

প্রতিটি সদস্য মাথা নিচু করে সবটা নিরবে শুনলো। মোহনা আফসোস করতে করতে বললো,
“আমার মেয়েটাকে ঐ মুখপুরীই খেয়েছে। নিশ্চয় ও ই কুমন্ত্রণা দিয়ে গিয়েছিলো। নাহয় আমার সাধাসিধা মেয়ে এমন করে?”

মায়া চিঠিটা ভাজ করছিলো। শাশুড়ির কথা শুনে ভ্রু কুঁচকে যায় তার। তীক্ষ্ণ কণ্ঠে বলে,
“মানুষটা তো এখন আর আপনাদের সাথে থাকে না। তবুও আপনারা ভালো হলেন না। তাকেই এসবের মাঝে টানতে হবে কেনো! একটু তো মানুষ হোন।”

মোহনা ফুঁসে উঠলো। আর তো সয় না এ মেয়ের পটরপটর কথা। মোহনা উঠে দাঁড়িয়ে দাঁত কিড়মিড় করে যখন মায়ার গালে চড় দিতে যাবে তখনই তার হাত ধরে ফেলে নিলয় কুমার, মানে তার স্বামী। মায়া হঠাৎ আক্রমণে চোখ মুখ খিঁচে বন্ধ করে ফেলে। মোহনা স্বামীর এমন আচরণে হা হয়ে যায়। অবাক কণ্ঠে দাঁত কিড়মিড় করে বলে,
“হাত ছাড়ো আমার। তোমার সাহস কী করে হয় আমার হাত ধরার? হাত ছাড়ো,,”

মহিলা আর কিছু উচ্চারণ করতে পারে না। তার আগেই সপাটে চড় পড়ে তার গালে। বিপ্রতীপ, মায়া এমনকি মোহনাও স্তব্ধ, বিস্ফোরিত নয়নে তাকিয়ে রইলো।

নিলয় কুমার হাত মুঠ করে তাচ্ছিল্য হেসে বললো,
“এই চড়টা কিছুদিন আগে মারলে আমার প্রিয়দর্শিনী থেকে যেতো শেষ অব্দি।”

নিলয় কুমারের এমন বদলে সবাই অবাক, বিষ্মিত। মায়া কেবল হাসলো। এইতো,বদল শুরু।

_

বাহিরে তুমুল বর্ষণ। কদম কেয়া হয়তো ভিজে সিক্ত বর্ষণের ছোঁয়ায়। দর্শিনীদের বাড়িতে বিরাট রান্নাবান্নার আয়োজন। খিচুড়ি চড়েছে চুলোয়। আবহাওয়া নির্ভর খাবার তৈরী হচ্ছে আজ। বসার রুমটাতে প্রতাপ সাহা, তার দুই ছেলে,স্ত্রী,নিপা,নিপার বাবা-মা,বোন,মৃত্যুঞ্জয়, দৃষ্টান্ত, তৃণা বসে আলাপ আলোচনা করছে। বিকেলের ঘটনাই আলোচনার মূল বিষয়।

রান্নাঘরে নিধি আর দর্শিনী রান্নার বন্দোবস্ত করছে। রাত হয়েছে সাথে বিদ্যুৎ নেই। হারিকেনের আলোয় সারছে সব কাজ। বৃষ্টি পড়লেই গ্রামাঞ্চলে বিদ্যুৎ থাকবে না। এটাই যেন নির্ধারিত।

ধৃষ্ট আর নিপার বোনের ছেলে আরেক জায়গায় বসে খেলছে। যে যার আলোচনায় যেন তুমুল ব্যস্ত।

রান্না-বান্না শেষ হতে দর্শিনী বসার ঘরে সবাইকে খাবার বেড়ে দিচ্ছে। আলোচনার এক পর্যায়ে দর্শিনীর মা বলে উঠলো,
“কী লাভ অত ঝামেলা করে? জমিটা দিয়ে দেও ওদেরকে। পরে যদি কোনো ক্ষতি করে?”

শাশুড়ির কথায় সায় জানালো নিধি। সেও শ্বশুরকে উদ্দেশ্য করে বললো,
“হ্যাঁ বাবা,শান্তিতে সবটা মিটমাট করে নেন না। পরে যদি কিছু করে?”

দর্শিনী রান্নাঘর থেকে মাংসের বাটিটা নিয়ে মাত্র ঘরে এসেছে। বড় বৌদির কথাতে সে প্রতিবাদ করে বলে উঠলো,
“না বৌদি,কেনো দিবে বাবা জমি? এটা আমাদের জমি। বাবার কত শখের জমি। এত সহজে তো দেওয়া হবে না।”

দর্শিনীর মা দর্শিনীকে ধমক দিয়ে উঠলো,
“চূপ কর। এত কথা তোকে কেউ জিজ্ঞেস করেছে নাকি? চিনিস না হরমোহন দাদাকে। উনি অনেক ভয়ঙ্কর।”

“দর্শিনী তো কোনো ভুল বলে নি। এ জমি আমি দিবো না, সরলা।”

প্রতাপ সাহার গম্ভীর কণ্ঠ ভেসে এলো। এরপর পিনপতন নীরবতায় ছেয়ে গেলো রুম। মৃত্যুঞ্জয় নিরবতা ঠেলে বলে উঠলো,
“আপনারা কিছু ভাববেন না৷ দৃষ্টান্ত আর আমি আপনাদের সাথে আছি। কে কী করবে আমরা দেখবো।”

মৃত্যুঞ্জয়ের কথায় আশ্বাস পেলো সবাই। দর্শিনী মাংসের বাটিটা নিয়ে আবার রান্নাঘরের দিকে অগ্রসর হলো। কিয়ৎক্ষণ পরে উঠোনে কারো পরে যাওয়ার শব্দ হলো। আৎকে উঠলো সবাই। তন্মধ্যে দৃষ্টান্ত খাবার রেখে ছুট লাগালো উঠোনের দিকে। তার ভয়ে হাত পা কাঁপছে। মেয়েটা এ অবস্থায় পড়ে গেলো নাতো! চারমাসের বেশি চলছে। এমন অবস্থায় এই বিপদ তো সর্বনাশ ডেকে আনবে।

#চলবে

#পথান্তরে_প্রিয়দর্শিনী
#মম_সাহা

পর্বঃ চৌদ্দ

টিনের চালে বৃষ্টির শব্দ যেন ছন্দ তুলছে। রাতের আকাশে মেঘ জমলে রাত ততটা নিকোষ, কালো লাগে না। বরং অন্যান্য দিনের তুলনায় রাতটা স্বচ্ছ হয়। ঘরের মানুষ বেশিরভাগই উঠোনে দাঁড়িয়ে আছে। নিধি তার ছেলেকে উঠোন থেকে তুলে লাগিয়ে দিলো এক চড়। কানটা মলে দিয়ে বললো,
“পাঁ’জি শয়’তান ছেলে। বৃষ্টি দেখলেই ওর ভিজতে হবে সবসময়। নিশ্চয় এখন লুকিয়ে ভিজার জন্য এসেছিলো অন্ধকারের মাঝে তাই পড়েছে। বে’য়া’দব ছেলে হয়েছে একটা।”

দৃষ্টান্ত একটা স্বস্তির শ্বাস ফেললো। দর্শিনী রান্নাঘর থেকে ছুটে উঠোনে নামতে নিলেই ধমকে উঠে দৃষ্টান্ত,
“এই,এই তুই উঠোনে নামছিস কেনো? দেখছিস না উঠোন কত পিচ্ছিল হয়ে আছে? পড়ে যাবি তো নাকি? সাবধান হবি কবে? অদ্ভুত!”

দৃষ্টান্তের ধমকে দর্শিনীর পা আবার আগের জায়গায় স্থির হলো। দৃষ্টান্ত কেনো সবাধান করেছে, তা আর বুঝতে বাকি রইলো না তার। নিধিও স্বাভাবিক কণ্ঠে বললো,
“হ্যাঁ প্রিয়,তুই আর ভিজিস না অন্তত। দেখ এখানে সবাই কত ভিজে গেছে। যা তাড়াতাড়ি সবার জন্য গামছা আর জামা-কাপড় বের কর। এই ছেলেটার জন্য সবার কী নাজেহাল অবস্থা। দৃষ্টান্ত দাদা প্রথমে ছুটে এসেছে এই আঁধারে। আমরা তো ভেবেছিলাম তুই কোনো অঘটন ঘটিয়েছিস। যাক ঈশ্বর বাঁচিয়েছে।”

দর্শিনী মাথা নাড়িয়ে ঘরে চলে গেলো। সবার জন্য জামা-কাপড় বের করা শুরু করলো। একে একে সবাই ঘরে প্রবেশ করলো।

মৃত্যুঞ্জয় এতক্ষণ সবটা নিরবে পর্যবেক্ষণ করলো। ভ্রু কুঁচকে এলো তার আপনা-আপনি। দৃষ্টান্তের শাসন নামক ব্যাপারটা তার ঠিক সহ্য হচ্ছে না। দৃষ্টান্ত একটু বেশিই ভাবছে আজকাল দর্শিনীকে নিয়ে!

একে একে যখন সবাই ঘরে ঢুকতে ব্যস্ত মৃত্যুঞ্জয় তখন ধীর কণ্ঠে দৃষ্টান্তের পিছু ডেকে উঠলো,
“দৃষ্টান্ত,শোন।”

দৃষ্টান্ত ঘরে ঢুকতে গিয়েও থেমে গেলো। তখনও অঝোরে বৃষ্টি পড়ছে পৃথিবীর বুকে। ভিজিয়ে দিচ্ছে উত্তপ্ত পরিবেশকে। দৃষ্টান্ত পিছু ফিরলো, ভ্রু কুঁচকে বললো,
“হ্যাঁ বল?”

মৃত্যুঞ্জয় মুখের কাঠিন্য ভাবটা সরিয়ে সামান্য হাসলো। একটু খোঁচা দিয়ে বললো,
“আজকাল দেখি প্রিয়দর্শিনীর ভালোই খেয়াল রাখছিস! শাসনও করছিস! বাহ্। কী ব্যাপার, বন্ধু?”

দৃষ্টান্ত মৃত্যুঞ্জয়ের কথা শুনে কতক্ষণ থম মেরে রইলো। পরক্ষণেই উচ্চ শব্দে হেসে উঠলো। যেন সে মজার কিছু শুনে ফেলেছে। সেই হাসি ঠোঁটের কোণে বজায় রেখেই ফিচলে কণ্ঠে বললো,
“আজকাল দেখি আমার শাসন দেখে কারো হৃদয় পুড়ে,প্রতিহিংসারা জ্বলে উঠে উদ্যমে হৃদয় আঙিনায়। বাহ্। কী ব্যাপার, বন্ধু?”

মৃত্যুঞ্জয় যেন এটার জন্য প্রস্তুত ছিলো না। খানিকটা থতমত খেয়ে যায় সে। নিজের বিব্রত পরিস্থিতি আড়াল করতেই বলে উঠলো,
“কী বলছিস এসব!”
“তুমি যা বুজেছো, ভাই।”

দৃষ্টান্তের দুষ্টুমি মাখা কণ্ঠে হেসে ফেলে মৃত্যুঞ্জয়ও। যাক,তার বন্ধু যেহেতু তার মনের পরিস্থিতি বুঝে গেছে তবে আর ভয় নেই। আর দ্বিধা নেই। প্রকৃতির সাথে শীতল হলো মানবের বক্ষ পিঞ্জিরা। যাক,এবার অন্তত মানবী তার।

দৃষ্টান্ত কতক্ষণ পর হাসি থামলো। কিছু একটা ভেবে অদ্ভুত কণ্ঠে বললো,
“মেয়েটাকে আগলে রাখবি তো সবসময়?”
“আমার উপর তোর ভরসা নেই?”
“তোর উপর ভরসা আছে। কিন্তু দর্শিনীর ভাগ্যের উপর আমার ভরসা নেই।”

দৃষ্টান্তের কণ্ঠে,কথায় কিছু একটা ছিলো যা নাড়িয়ে দিলো মৃত্যুঞ্জয়কে। সে ভেবে ভেবে অবাক হলো,দৃষ্টান্ত এতটা গভীর কথা কেনো বললো?

ততক্ষণে ভিতর থেকে তাদের ডাক এলো। দু’জন নিজেদের ভাবনা বাদ দিয়ে ছুটে গেলো ঘরের দিকে। তারা হয়তো দক্ষিণ দিকের জানালার দিকে তাকালে দেখতে পেতো কেউ একজন তাদের কথা শুনেছে অতি গোপনে,নিরবে।

_

নিপা ধৃষ্টের মাথাটা ভালো করে মুছে দিচ্ছে। সবার সাথে তেমন ভাব ভালোবাসা না থাকলেও ধৃষ্টকে নিপা অনেক বেশিই আদর করে। কারণ একটাই, বিয়ের এত গুলো বছর পরও তার কোল খালি। একটু “মা” ডাক শোনার হাহাকার তার হৃদয়ে জ্বলছে অনবরত। তাই সে ধৃষ্টকে নিজের সন্তানের মতনই আদর করে।

তন্মধ্যেই সকলের খাবার শেষ হলো। এখন কেবল নিধি আর দর্শিনী বাকি আছে। নিধি রান্নাঘর থেকে নিজেদের খাবারটা এনে সাজিয়ে রাখলো। নিজের ছেলের পানে তাকিয়ে ধমকের স্বরে বলল,
“ওকে এত সোহাগ করার দরকার নেই, নিপা। আদরে আদরে বাঁ’দর তৈরী হচ্ছে।”

মায়ের ধমকে ধৃষ্ট নিপার গলা জড়িয়ে ধরলো। নিপা আহ্লাদী স্বরে বললো,
“আহা দিদি,বাচ্চা মানুষ একটু তো দুষ্টুমি করবেই। তার জন্য তুমি ওকে এত বকবে না তো। আমার ভালো লাগে না।”

“এই তুই ই আহ্লাদ দিয়ে ওকে এমন বানাচ্ছিস। একদম আহ্লাদ দিবি না। একটু তো শাসন করিস।”

“যার কোল খালি তার শিশুদের প্রতি আহ্লাদ ছাড়া আর কিছু আসবে না দিদি। তুমি তো “মা” ডাক শুনতে পেরেছো কিন্তু আমি পাই নি। আমি জানি কতটা তৃষ্ণা আমার হৃদয়ে। কতটা হাহাকার। তোমরা অনেক ভালো তাই হয়তো দর্শিনীর মতন আমার দশা হয় নি। নাহয় আমার ভাগ্যও তো সেই একই পথে। সে আমি যতই দর্শিনীকে কথা শুনাই।”

পুরো ঘরময় পিনপতন নীরবতা। নিপার মতন শক্ত মেয়ের চোখে অশ্রুকণা টলমল করছে। প্রতাপ সাহা নিজের আরামকেদারা থেকে উঠে আসলেন, পুত্রবধূর মাথায় আদুরে হাত বুলিয়ে বললেন,
“মা,আফসোস রেখো না জীবনের প্রতি। সে তোমাকে যা দিয়েছে তাতেই সন্তুষ্ট থেকো। আর রইলো সন্তানের কথা, অনেক দম্পতি সন্তান জন্ম না দিয়েও সন্তান পায়। তোমরা দত্তক নিতো পারো। আমাদের কোনো আপত্তি নেই। তোমাদের খুশিতেও আমরা খুশি। এতে একটা অনাথ বাচ্চা বাবা-মা পাবে আর তোমরা সন্তান।”

“হ্যাঁ ছোট বউ,তোমরা চাইলেই সন্তান দত্তক নিতে পারো। অনাথ আশ্রমে কত অসহায় শিশুরা আছে। তাদের মাঝে একজনের ছাদ হও তোমরা।”

শ্বশুর শাশুড়ির এমন নিবিড় কথায় নিপার ঠোঁট তিরতির করে কেঁপে উঠে। দু’ফোটা অশ্রুকণা গড়িয়ে পড়ে নিরবে। এতক্ষণ সবটা দর্শিনী চুপ করে শুনছিলো। ইশ,তাদের বাবা-মায়ের মতন যদি তার শ্বশুর বাড়ি হতো তাহলে বোধহয় তার সংসারটা এভাবে ধূলিসাৎ হতো না।

নিপার স্বামী সুমন নিপাকে ধমকিয়ে উঠলো,
“এই, এমন কান্না করছো কেনো? তোমাকে কী আমরা কোনো কিছুর অভাবে রেখেছি? তোমার বাবা-মায়ের সামনে কান্না করছো,তাদের কেমন লাগছে বুঝতে পারছো না? আর ধৃষ্ট আছে না? ও আমাদের সন্তানই তো।”

দেবরের কথাকে প্রশ্রয় দিয়ে নিধিও বললো,
“হ্যাঁ রে নিপা,ধৃষ্ট কী তোদের সন্তান না? এমন করে বলছিস কেনো? কান্না বন্ধ কর। সবার খারাপ লাগছে।”

দর্শিনী ছোট্ট শ্বাস ফেললো। ছোট বৌদির কাছে ধীর পায়ে এগিয়ে গেলো। হাঁটু গেড়ে বসলো ছোট বৌদির পায়ের কাছে। ছোট বৌদির চোখ দুটো খুব আদরের সাথে মুছে দিয়ে নিবিড় কণ্ঠে বললো,
“ছোট বৌদি,তুমি কেঁদো না। ঈশ্বর যখন সব শখ পূরণ করেছে, তখন তোমার এ শখও অপূর্ণ থাকবে না। দেখেছো,তোমার শ্বশুর বাড়ির মানুষ তোমার চোখের জল ঝড়তে দিচ্ছে না। তোমার কত ভাগ্য! এমন ভাগ্যের উপর না পাওয়ার কলঙ্ক আর লেপন করো না। তোমাকেও “মা” ডাকার মতন কেউ নিশ্চয় আসবে।”

নিপা থামলো। বিষণ্ণ কণ্ঠে বললো,
“এত বছরেও যার কোলো কেউ এলো না, তার কোলে কী আর কেউ আসবে?”

দর্শিনী মুচকি হাসলো,আশ্বাসের স্বরে বললো,
“এই যে আমি কথা দিলাম, তুমিও একদিন কাউকে কোলে পিঠে করে মানুষ করবে। দেখে নিও।”

নিপা চুপ হলো। সাথে চুপ হলো নিরব পরিবেশ। টিপ টিপ বৃষ্টির ফোঁটা গুলো কেবল ছন্দ তুলে যাচ্ছে। দর্শিনীও ভেতরে খুব গভীর ভাবনা ভাবছে। আজকাল তার মন কু ডাকছে। তার সন্তানের তো বাবা নেই, যদি জন্ম দিতে গিয়ে সেও চলে যায় বহুদূর! তবে,বাচ্চা টা এখন আর অনাথ হবে না। এই তো, সে তার বাচ্চার জন্য নতুন বাবা-মা খুঁজে এনেছে।

#চলবে

#পথান্তরে_প্রিয়দর্শিনী
#মম_সাহা

পর্বঃ পনেরো

নতুন একটি দিনের আবির্ভাব ঘটলো। সময়টা ঠিক সুন্দর, স্বচ্ছ সকালের পরের ভাগ। মায়া নিশ্চুপ ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে আছে ছাঁদের গ্রিল ধরে। আজ তার ভেতর চাঞ্চল্যতা নেই। কেমন নিষ্প্রাণ তার দৃষ্টি। চোখেরা আজ ভাষাহীন। তন্মধ্যেই পাশের ছাদে লম্বাটে ছেলেটা হাজির হয়। কোঁকড়ানো চুল গুলো এলোমেলো, ঢিলেঢালা শার্ট জড়ানো শরীরে। মুখে একটা কৌতুক হাসি বিদ্যমান। সেই হাসিটা বজায় রেখেই সে তাদের ছাঁদের কার্নিশ ঘেষে দাঁড়ালো। একদম মায়ার সম্মুখে।

মায়ার ধ্যান ভাঙলো না, নির্জীব দৃষ্টি উচ্ছ্বাসে পরিপূর্ণ হলো না। পেট ফেটে বেরিয়ে এলো না মজার কোনো বাক্য।

মায়ার আচরণে ভ্রু কুঁচকায় ছেলেটা। অদ্ভুত কণ্ঠে বিষ্ময় প্রকাশ করে বলে,
“কিরে,তোর ধ্যান কোথায় আজ? হা করে আকাশে তাকিয়ে রইলি যে? কোনো জরুরি কিছু দেখাচ্ছে নাকি আকাশে? সেটা না দেখলে কী তোর মাথায় আকাশ ভেঙে পড়বে?”

মায়ার ধ্যান ভাঙলো। বিবর্ণ এক হাসি দিয়ে বললো,
“কি বলো এসব হৈমন্ত ভাই? তোমার কাছে সবসময় উদ্ভট কথাবার্তা। তা,কখন এলে ছাদে? টেরই পেলাম না যে?”

“এমন হা করে আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকলে তো টের পাবিও না। আকাশ না যেন মাছের মাথা। চোখ দিয়ে গিলে খাচ্ছে। তারা গুনছিলি নাকি দিনের আকাশে?”

মায়া রিনরিনে কণ্ঠে হেসে উঠলো। চোখ ঘুরিয়ে বললো,
“তুমিও না হৈমন্ত ভাই। আকাশের সাথে মাছের মাথার তুলনা করছো! একমাত্র তোমার দ্বারাই এমন কথা বলা সম্ভব।”

“হ্যাঁ, যত দোষ হৈমন্ত ঘোষ। তা মাছের মাথা প্রেমী মায়াবতী,আজ যে আপনার এসএসসির রেজাল্ট বেরিয়েছে সে খবর আছে?”

মায়ার হাসিখুশি চেহারাটা এক নিমিষেই আঁধারে ঢেকে গেলো। ফ্যাকাশে হলো গোলগাল ছোট্ট মুখটা। মনে হচ্ছে এখনই অশ্রু বৃষ্টি নামবে চোখ আকাশের বুক থেকে। তার চোখের সামনে ভেসে উঠলো ঝুলন্ত লা’শ, এলোমেলো ঘর,র’ক্তা’ক্ত চিঠি আর বিশ্বাসঘাতকতার স্বীকার হওয়া এক কিশোরীর করুণ আর্তনাদ।

মায়া নিজের কান চেপে ধরলো, উদভ্রান্তের মতো বলে উঠলো,
“দিভাই,দিভাই। আমার দিভাইটা কই গেলো? হৈমন্ত ভাই আমার দিভাই টা।”

মায়ার পরিবর্তনে বিচলিত হলো হৈমন্ত। কোনোরকমে নিজের হাত এগিয়ে নিয়ে মায়ার মাথায় রাখলো। কণ্ঠে শীতলতা রেখে নিবিড় ভাবে বললো,
“শান্ত হ,মায়া। শক্ত হ। কথা কিন্তু এটা ছিলো না। ভুলে যাচ্ছিস নিজেকে দেওয়া কথা? মায়া,চুপ কর একদম। যদি এখন না থামিস তবে তোকে আমি এখান থেকে নিয়ে যেতে বাধ্য হবো। তুই কী সেটা চাচ্ছিস?”

মায়ার চোখের সামনে বীভৎস ভাবে অতীত ফুটে উঠেছে। তবুও সে নিজেকে শান্ত করলো। মাত্র ষোলো বছরের মেয়েটা কীভাবে এমন শক্ত হলো সে অতীত বার বার তার চোখে ভেসে উঠলো। সেদিন তার বয়স কতই বা ছিলো? এগারোর এপার-ওপার। কিন্তু যেই ভয়ং’কর চিত্র সে দেখেছিলো তা আজও তাকে তাড়া করে বেড়ায়। দুই বেনী করা মায়া স্কুল ড্রেস পড়া, মাত্রই স্কুল থেকে এসেছিলো। বোনের ঘরের সামনে গিয়ে অনবরত দরজা খুলতে বলছিলো কিন্তু অপরপাশ থেকে কোনো উত্তর এলো না। বিচলিত হয়ে অবশেষে বাড়ির বড়রা দরজা ভাঙলো। ফ্যানের সাথে ঝুলে থাকতে দেখলো তাদের বাড়ির এক রাজকন্যাকে। এরপর থেকেই মায়া শক্ত হয়ে গেলো। বদলে গেলো তার সবটা।

হৈমন্ত মায়াকে সামান্য ধাক্কা দিলো, অতঃপর ধ্যান ভাঙলো মায়ার। কতক্ষণ চুপ থেকে নিজেকে সময় দিলো। ধীরে ধীরে তার মুখভঙ্গি বদলানো শুরু করলো। মুখমন্ডলে তখন মন খারাপের ঘন মেঘ সরে গিয়ে জায়গা নিলো রহস্য। সেই রহস্য মাখা দৃষ্টি নিয়ে মায়া হৈমন্তের দিকে তাকালো। বিভীষিকাময় হাসি দিয়ে বললো,
“ভাগ্যিস তুমি সেই অতীত মনে করিয়ে দিয়েছো, হৈমন্ত ভাই। নাহয় আমি তো ভুলতেই বসে ছিলাম। জানো আজকে আমার শ্বশুর বাড়ির সবার আঁধারিয়া মুখ আর করুণ আর্তনাদ দেখে আমারও মন খারাপ হয়ে গিয়েছিল। একটা সময়ের জন্য আমি তাদের প্রতি দুর্বল হয়ে গিয়েছিলাম। কিন্তু না,এই দুর্বলতা ভুল জায়গায় সৃষ্টি হয়েছে তাই না বলো? আর যাই হোক,এমন মানুষের জন্য কী আদৌও দুর্বলতা মানায়? এখনও আমার অনেক কিছু জানা বাকি। এখানে যার জন্য এসেছি তার রহস্য উন্মোচন করা বাকি। এত তাড়াতাড়ি দুর্বল হলে হবে নাকি!”

হৈমন্ত হাসলো। মায়ার বয়স আবেগের। সে আবেগে পরে যেতে পারে সেটা হৈমন্তের জানা আছে। তাই তো সে সবটা সামলে নেওয়ার জন্য এতদূর অব্দি মায়ার সাথে এসেছে। মায়ার ভবিষ্যৎ অন্তত ওর বড় বোনের মতন হতে দিবে না হৈমন্ত।

মায়া কতক্ষণ চুপ থাকে। তারপর ধীর কণ্ঠে জিজ্ঞেস করে,
“আমার রেজাল্ট কী,হৈমন্ত ভাই?”

হৈমন্ত ভ্রু কুঁচকায়। তীক্ষ্ণ কণ্ঠে বলে,
“এতক্ষণে রেজাল্টের কথা মনে পড়লো? আর রেজাল্ট কীইবা হবে বল? পড়াশোনা তো করতিস না ঠিকমতন। এখন রেজাল্ট কী হবে তা তুই ই আন্দাজ কর।”

মায়ার মুখটা শুকিয়ে ছোট্ট হয়ে গেলো। তবে কী তার রেজাল্ট অনেক খারাপ হয়েছে!

মায়ার মুখের পরিবর্তন দেখে হেসে উঠে হৈমন্ত। মায়ার মাথায় টোকা দিয়ে বলে,
“পাশ করে গেছিস। এখন আর আমসির মতন মুখ খানা করতে হবে না। যা পড়াশোনা করেছিস তাতে যে পাশ করেছিস সেটাই শুকরিয়া জানা। এ প্লাস আসে নি তবে ভালো রেজাল্ট হয়েছে। প্রতিশোধের নেশায় বুদ না হলে হয়তো আরও ভালো হতো।”

মায়া “ইয়াহু” বলে লাফিয়ে উঠলো। ধপ করে শব্দ হলে বাড়ির ছাদে। পরক্ষণেই মোহনার কণ্ঠস্বর ভেসে এলো। মায়া দ্রুত মুখ চেপে ধরলো নিজের। হৈমন্ত চোখ রাঙিয়ে বিরক্তির স্বরে বললো,
“তুই আর মানুষ হবি না। যা নিচে যা। নাহয় তোর ডা’ই’নী শাশুড়ি ঝা’ড়ু মারবে তোকে। যা।”

মায়া “আসছি” বলে ছুট লাগালো। ছাঁদের দরজার কাছাকাছি আসতেই হৈমন্ত আবার ডেকে উঠলো,
“মায়া!”

মায়ার পা থামলো। পিছে ঘুরে প্রশ্নাত্মক দৃষ্টিতে বললো,
“কী?”

“শুভ জন্মদিন,মায়াবতী। ষোড়শীর কন্যা সপ্তদশে পা রাখলো অবশেষে। যে বিরাট দায়িত্ব মাথায় নিয়েছিস তা পূরণ করতে যেন পারিস, আশীর্বাদ রইলো। আর হ্যাঁ, ঐ বিপ্রতীপের প্রতি দুর্বল হতে দিস না ছোট্ট মনটাকে। কষ্ট ছাড়া কিছুই পাবি না।”

হৈমন্তের কথা শেষ হতেই গটগট পায়ে বেরিয়ে গেলো নিজেদের ছাঁদ থেকে। মায়া কেবল চেয়ে রইলো নির্বাক। অতঃপর ছোট্ট একটা হাসি দিয়ে বললো,
“মায়ারা কেবল হৈমন্তদের। বিপ্রতীপরা বড়জোর মোহ হতে পারে এর বেশি কিছু না।”

_

গ্রামের এক বিয়েতে দর্শিনীদের বাড়িসুদ্ধ সবাই হাজির হয়েছে। দর্শিনীর বাবা গ্রামের স্কুলের শিক্ষক ছিলেন বিধায় তাকে গ্রামের মানুষ একটু বেশিই সম্মানের চোখে দেখে। সেই সুবাধে তাকে গ্রামের সব অনুষ্ঠানেই থাকতে হয় সবার মনরক্ষা করার জন্য।

দাস পাড়ায় এক বিয়েতে এসেছে সবাই। দর্শিনী,তার বাবা-মা,দুই ভাই,বড় বৌদি, বৌদির পরিবার, ছোট বৌদি, ছোট বৌদির পরিবার,তৃণা। নিধি এবং নিপার বাবা-মা মূলত প্রতাপ সাহাকে দেখতে এসেছিলো। তাই বিয়ের নিমন্ত্রণে তারাও এসেছে।

রাত বাজে আট টা। হিন্দু বিয়ে সাধারণত রাতেই হয়। হয়তো গোধূলি লগ্নতে নয়তো মধ্যরাতের দিকে। এই বিয়েটা মধ্য রাতেই হবে। বিয়ে বাড়ি তুমুল জমজমাট। দর্শিনী প্রথমে আসতে চায় নি, এই ভীড়ের মাঝে তার কেমন জানি অস্বস্তি হচ্ছিলো। তবুও দর্শিনী সবার জোড়াজুড়িতে এক প্রকার আসতে বাধ্য হলো। গ্রামের লোক কেমন দৃষ্টিতে যেন তাকাচ্ছে তার দিকে। সে জানতো এমন কিছুই হবে তাই সে আসতে চায় নি। এসেই যখন পড়েছে আর এত কিছু ভেবে লাভ নেই।

দর্শিনী হঠাৎ অনুভব করলো তার পিছে কেউ দাঁড়িয়ে আছে। পাশের মানুষটার শরীরের সুগন্ধিটারর সাথে সে পরিচিত। দর্শিনী পাশ ফিরে তাকালো। এক পলক দেখেই সে চোখ নামিয়ে নিলো। ভিনদেশী পুরুষের এ কী সর্বনাশা রূপ! দর্শিনীর মতন নারীর চোখ আটকে গিয়েছিলো সে রূপে? ভাবা যায়!

দৃষ্টান্ত হাসি মুখে দর্শিনীর পাশে এসে দাঁড়ালো। মিষ্টি কণ্ঠে বললো,
“কী ব্যাপার, প্রিয়দর্শিনী? আমাকে দেখেও দেখলেন না যে?”

দর্শিনী নিজেকে একটু ধাতস্থ করলো। বুকের মাঝে ঢিপঢিপ শব্দটা ক্রমশ বাড়ছে। এমনটা কেনো হচ্ছে? আগে তো কখনো এমন হয়নি। তাহলে আজ কেনো?

দর্শিনী নিজেকে ধাতস্থ করেই নিবিড় কণ্ঠে বললো,
“কে বলেছে দেখি নি? ভাবলাম আপনি এমনিই দাঁড়িয়েছেন তাই কিছু বলি নি। তা আপনাকেও নিমন্ত্রণ করেছে?”

“হ্যাঁ, আমি আর দৃষ্টান্তও নিমন্ত্রিত। তা আপনাকে বকুল ফুলের মতন লাগছে আজ। শুভ্র শাড়িতেও কাউকে এত সুন্দর লাগে জানতাম না।”

দর্শিনী চুপ করে থাকে। এই পুরুষের সাথে আর চোখ মিলিয়ে কথা বলা তার পক্ষে সম্ভব না। সে এতদিন এই ভিনদেশী মানবকে এতটা গভীর ভাবে খেয়াল করে নি কিন্তু আজ খেয়াল করতেই ঝংকার দিয়ে উঠলো হৃদয় কোণ। ছেলেটার মাঝে বিদেশি একটা ভাব আছে। শরীরের রঙ,গঠন,সুদীর্ঘ দেহ, রাজকীয় চালচলন যেন বলে দিচ্ছে সে ভিনদেশী। সব মিলিয়ে সুদর্শন পুরুষ বলা যায়।

হঠাৎ ই দর্শিনীদের সামনে হাজির হয় হরমোহন সেন। কেমন কুৎসিত হেসে প্রতাপ সাহা’র উদ্দেশ্যে বললেন,
“নমস্কার প্রতাপ। পুরো পরিবার নিয়ে অনুষ্ঠানে এসেছো দেখে ভালো লাগলো। তা প্রতাপ,জমির ব্যাপারটা ভেবে দেখেছো তো?”

সবার হাসি হাসি মুখটা নিমিষেই কালো হয়ে গেলো। দৃষ্টান্তও তন্মধ্যে সেখানে প্রবেশ করলো। নিজের বাবাকে তার দ্বিতীয় স্ত্রীর সাথে দেখে ঘৃণায় চোখমুখ কুঁচকে ফেললো।

প্রতাপ সাহা উত্তর দেওয়ার আগেই প্রিয়দর্শিনী তার নিবিড় কণ্ঠে ঝংকার তুলে বললো,
“জেঠামশাই,আপনাকে তো কাল-ই বলা হয়েছে এ ব্যাপারে। আর নতুন করে পুরোনো কাসুন্দি ঘাটছেন কেনো? ও জমি আমরা দেবো না।”

“এই মেয়ে, এই, তুমি বড়দের কথার মাঝে কেন কথা বলছো? অলক্ষী মেয়েছেলে। নিজের সংসার খেয়ে বাপের ঘরে এসে উঠেছে, এখন বাপের কপালও পুড়াবে নিশ্চিত।”

হরমোহনের স্ত্রী রমলার কথায় দর্শিনীর মুখটা অপমানে ছোট হয়ে গেলো। প্রতাপ সাহা মেয়ের অবস্থা বুঝে সেই মহিলার দিকে তাকিয়ে বললেন,
“প্রণাম নিবেন বউঠান। তা আজকাল আমি বাদে দেখছি সবাই আমার মেয়েকে নিয়ে এত ভাবছে! ব্যাপার কী? আপনার কোনো অধিকার নেই আমার মেয়েকে এসব বলার।”

“রমলা কোনো ভুল বলে নি, প্রতাপ। তোমার মেয়ে অতিরিক্ত বেড়েছে। এর মাশুল না আবার দিতে হয় দেখো। এই যে বাড়ির বউরা, তোমাদেরও না আবার মাশুল দিতে হয় দেখো।”

হরমোহনের কথার বিপরীতে দর্শিনীর বড় ভাই প্রদীপ কথা বললো। এমন এক কথায় দু কথায় বিরাট ঝামেলা সৃষ্টি হলো। তর্কাতর্কি গাড়ো হতেই গ্রামের লোক তাদের আলাদা করে দিলো। প্রতাপ সাহা বিচক্ষণ মানুষ,অন্যের অনুষ্ঠানে তার জন্য ঝামেলা হোক সে চায় না। তাই সে নিজেও চুপ হয়ে গেলো।

তর্কাতর্কির পর বিয়ে বাড়ি কিছুটা শান্ত হয়ে গেলো। প্রতাপ সাহাদের ডাক পড়লো খাবার খাওয়ার জন্য। সবাই সেদিকেই অগ্রসর হলো। মৃত্যুঞ্জয় ভাবলো,এবার তাকে কিছু করতে হবে।

_

খাবারের কাছে আসতেই দর্শিনীর মাথা ঘুরে উঠলো। খাবারে ঘ্রাণে পেট মোচড় দিয়ে গড় গড় করে বমি করে দিলো এক কোণায়। সবাই দর্শিনীর হঠাৎ অসুস্থতায় হতবাক। কী হলো মেয়েটার?

সবাই ব্যতিব্যস্ত হয়ে উঠলো। দর্শিনী সবাইকে শান্ত হতে বললো। মনে মনে কিছুটা ভয়ও পেলো,সবাই না আবার বুঝে যায়।

সবাই যেখানে দর্শিনীকে নিয়ে ব্যস্ত, মৃত্যুঞ্জয় সেখান নিশ্চুপ। সে দূর হতে দর্শিনীকে তীক্ষ্ণ ভাবে পর্যবেক্ষণ করলো। সে কয়েকদিন যাবতই দর্শিনীকে খেয়াল করছে। কিছু তো একটা খটকা লাগছে তার। তার মস্তিষ্ক কিছু জানান দিচ্ছে কিন্তু মন মানতে চাইছে না।

সবাইকে ব্যতিব্যস্ত হতে দেখে দর্শিনী বললো,
“বাবা,আমি বাড়ি চলে যাই। তোমরা থাকো। আমি বাড়ি গিয়ে বিশ্রাম নিলেই ঠিক হয়ে যাবো।”

মেয়ের কথায় ঘোর প্রতিবাদ জানালো প্রতাপ সাহা,
“কী বলো মা? তুমি একা একা চলে যাবে? না। গেলে আমরা সবাই যাবো।”

“না না, বাবা। তোমরা তো খাও নি এখনো। তোমরা খেয়ে দেয়ে আস্তে-ধীরে আসো। আমি পারবো।”

দর্শিনীর কথা শেষ হতেই নিধি বলে উঠলো,
“আমি যাচ্ছি তোর সাথে। চল।”

নিধির কথা শুনে ধৃষ্ট হাউমাউ করে কেঁদে উঠলো। সে বিয়ে না দেখে কিছুতেই যাবে না। কতক্ষণ বাক-বিতর্কের পর ঠিক হলো তৃণা আর দর্শিনী যাবে। মেয়েটাকে একা ছাড়ার চেয়ে তৃণা সাথে গেলে সবাই হাফ ছেড়ে বাঁচবে।

অবশেষে দর্শিনীর বড় ভাই তাদের রাস্তা অব্দি দিয়ে গেলো। দুই রমনী পথ ধরলো বাড়ির দিকে। দর্শিনীর নিজেকে একটু বেশিই ক্লান্ত লাগছে। হয়তো প্রেগন্যান্সির লক্ষণ গুলো দেখা দিচ্ছে।

দর্শিনীরা বেরিয়ে যেতেই হরমোহন তার সাথের চাকরটাকে কিছু ইশারা করে পৈচাশিক হাসলেন। খুব বাজে কিছু হবে।
_

রাত বারোটা। ধৃষ্ট ঘুমিয়ে গেছে বাবার কোলে। সবাই হাফ ছেড়ে বাঁচলো। এবার বাড়ি ফিরতে পারবে। ছেলেটার জন্য এতক্ষণ কেউ জায়গা থেকে নড়তে পারে নি। মৃত্যুঞ্জয়ও বেশ আকর্ষণ নিয়ে বিয়ে দেখছে। তার বরাবরই বাঙালি বিয়ে দারুণ লাগে।

হঠাৎ কোথা থেকে গ্রামের এক ছেলে ছুটে আসলো। হাঁপাতে হাঁপাতে প্রতাপ সাহার সামনে দাঁড়ালো। কোনোরকমে উচ্চারণ করলো,
“কাকা,কাকা,আপনাদের বাড়িতে দাউদাউ করে আগুন জ্বলছে। সব পুইড়া ছারখার।”

প্রতাপ সাহা যেন কিছুক্ষণের জন্য তব্দা খেয়ে গেলেন। পরক্ষণেই চেয়ার থেকে উঠে ছুট লাগালের বাড়ির দিকে। তার পিছু পিছু সব ছুটতে শুরু করলো। শত্রুকে পাশে দেখেও কীভাবে সে নিজের চোখের মনিকে একা ছাড়লো? মেয়েটা বোধহয় আর নেই।

হরমোহন এক পৈচাশিক হাসি হাসলেন। বড় মাশুল দেওয়া শুরু এখন থেকে।

#চলবে