পথান্তরে প্রিয়দর্শিনী পর্ব-১৬+১৭+১৮

0
198

#পথান্তরে প্রিয়দর্শিনী
#মম_সাহা
#পর্ব-১৬+১৭+১৮

রাতের আঁধারকে আরও বিভীষিকাময় আঁধারে রূপান্তরিত করেছে দর্শিনীদের আগুনে পুড়ে যাওয়া বাড়ির কালো ধোঁয়া। পুরো গ্রামে মানুষ হাতে হারিকেন,মশাল,চার্জার লাইট,ফোনের ফ্লাশলাইট ইত্যাদি নিয়ে ভীড় জমিয়েছে দর্শিনীদের বাড়ির সামনে। এখনো দাউ দাউ করে আগুন জ্বলছে। বিকট শব্দে ঘর গুলো ভেঙে পড়ছে। কিছুক্ষণের ব্যবধানে বাড়িটা ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে। প্রতাপ সাহা সাথে তার পুরো পরিবার ছুটে এসেছে মিনিট কয়েকের মাঝে। চোখের সামনে কষ্টে গড়ে তোলা বিরাট বাড়িটাকে জ্বলতে দেখে চিৎকার করে উঠে দর্শিনীর মা-সরলা। নিধি, নিপা সহ সবাই হাউমাউ করে কেঁদে উঠে। পরিবেশ যেন মুহূর্তেই ভয়াবহ রূপ ধারণ করলো। প্রদীপ আর সুমন জ্বলন্ত ঘরটার দিকে জল ভর্তি বালতি, গামলা নিয়ে ছুট লাগালো। ইতিমধ্যে অবশ্য গ্রামের মানুষ জল মারা শুরু করে দিয়েছিলো। বাড়ির এমন বিধ্বস্ত অবস্থা দেখে কিয়দংশ সময়ের জন্য যেন সবাই ভুলে গেলো এ বাড়িতে দুটো মেয়ে এসেছিলো বিশ্রামের জন্য। তাদের কী অবস্থা, কী খবর এটা জানার যেন কারো আগ্রহ রইলো না। সবাই কেবল বিশাল বাড়িটাকে বাঁচানোর আপ্রাণ চেষ্টায় মগ্ন হয়ে রইলো। মেয়ের মায়া যেন এত বছরের বাড়ির চেয়েও বেশি হতে পারেনি এই মধ্যবিত্ত পরিবারের কাছে। তার উপর মেয়ে হলো স্বামীর সংসার ছাড়া। তার কতটুকুই বা মূল্য? এ বাড়ির থেকে তো আর বেশি হবে না, তাই না?

প্রতাপ সাহা মাথায় হাত দিয়ে যখন বিমূঢ় হয়ে চেয়ে রইলেন বাড়িটার দিকে তখনই মৃত্যুঞ্জয় আর দৃষ্টান্ত ছুটে এলো। হাত-পা তাদের অসম্ভব কাঁপছে। এত বিপদের মাঝে একমাত্র এই রক্তের সম্পর্ক ছাড়া ছেলে গুলো ঘরের ভেতর থাকা নারীদের কথা ভাবলো। উৎকণ্ঠা নিয়ে জিজ্ঞেস করলো,
“তৃণা আর প্রিয়দর্শিনী কোথায়,কাকা?”

চমকে উঠে প্রতাপ সাহা। সাথে সাথে চুপ হয়ে যায় পরিবেশ। এতদম গম্ভীর হয় প্রকৃতি। অবশেষে সবার মনে পরে মেয়ে গুলোর কথা। সত্যিই তো,মেয়ে গুলো কোথায় গেলো?

পুড়ে যাওয়া বাড়িটায় জল ছোড়াছুড়ির কারণে বাড়ির সামনের কিছু মাটি কাঁদায় পরিপূর্ণ হলো। প্রতাপ সাহা কাঁদার কথা চিন্তা করলেন না,ধ্যান দিলেন না সেদিকে। কেমন পাথরের মতন বসে গেলেন সেখানটায়। কাঠ কাঠ জবাবে বললেন,
“মেয়ে গুলো কী আর বেঁচে আছে? এই বিশাল বাড়িটারই এ অবস্থা। ছোট ছোট মেয়ে গুলোর তাহলে কতটা বীভৎস অবস্থা হয়েছে! অথচ আমি মেয়ে গুলোর কথা না ভেবে এতক্ষণ বাড়ির মায়ায় আচ্ছন্ন ছিলাম। কী পা’ষ’ন্ড মানুষ আমি! তাই না?”

এবার হৈচৈ, হা হুতাশে ভরে গেলো পরিবেশ। মানুষদের আহাজারিতে পরিপূর্ণ চরপাশ। আগুন ততক্ষণে ঝিমিয়ে গেছে। কেবল ছাইয়ের স্তূপে লাল রাঙা আভা হয়ে তার উপস্থিতি জানান দিচ্ছে। সকলের তখন বিধ্বস্ত অবস্থা। মৃত্যুঞ্জয় ছুটে গিয়েছে ঘরটার সামনে। কিন্তু ঘরের ভিতরে প্রবেশ করার কোনো সুযোগ নেই। খুবই ভয়াবহ ভাবে পুড়েছে সে ঘর। সে স্থির হয়ে চেয়ে থাকে সে ঘরের ভিতরে। প্রিয়দর্শিনীকে পাবে পাবে করেও কি সে হারিয়ে ফেললো? প্রনয়ের ফুল এভাবেই ফোঁটার আগে তবে মূর্ছা গেলো!

দর্শিনীর মা রীতিমতো জ্ঞান হারিয়েছে। যতই হোক বাড়ি আর মেয়ের শোক একসাথে সামাল দেওয়ার সক্ষমতা তার হয়ে উঠে নি।

প্রতাপ সাহা যেন মূর্তি হয়ে গেলো। নিপা নিজের কপাল চাপড়াতে চাপড়াতে আহাজারি করে উঠে বললো,
“মাথার উপরের আশ্রয়টা শেষ হয়ে গেলো? এত স্বাধের সংসার আমাদের,কী হাল হলো। দর্শিনী তৃণা কোথায় গেলো? কোথায় ওরা? মেয়ে গুলোর সাথে তখন কেনো এলাম না। মেয়ে গুলো কোথায় গেলো! এ জন্য আমি বার বার বলেছি দর্শিনীকে ঐ ন’র’পি’চা’শের সাথে ঝগড়া না করতে। আমার কথা শুনলে তো! আমি তো সবসময় খারাপই চায়। দেখলো তো এখন পরিণতি? আমি জানতাম,ঐ জা’নো’য়া’র লোক এমন কিছুই করবে। দেখো না গো তোমরা,আমার দর্শিনী কই। তৃণাটা কোথায়।”

নিপার আহাজারিতে পরিবেশ আরও ভয়ঙ্কর নিস্তব্ধতা ধারণ করলো। নিধি পুড়ে যাওয়া বাড়িটার দিকে টলমলে দৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে নিপাকে ধমক দিয়ে উঠলো। কড়া গলায় শাসনের স্বরে বললো,
“একদম হায় হায় করবি না, ছোট। দর্শিনী আর তৃণার কিচ্ছু হবে না। তুই চুপ কর। মায়ের মাথায় জল দে। কিছু হয় নি আমার তৃণার আর দর্শিনীর।”

নিপা চুপ হলো না বরং আরও ফ্যাচফ্যাচ করে কাঁদতে লাগলো।

বিপ্রতীপের শরীরে রক্ত আরও হীম হয়ে গেলো। সে আর দাঁড়ালো না। পুড়ে যাওয়া ঘরটার ভিতর ছুটে গেলো। বাড়িটা খুব অচল অবস্থায় টিকে আছে। একটু জোরে বাতাস হলেই মাথার উপর বড় দোচালা টিনটা ভেঙে পড়বে।

বিপ্রতীপকে ছুটে যেতে দেখে দৃষ্টান্তও পিছে পিছে গেলো। সত্যি বলতে দৃষ্টান্তের পা নড়ছে না। নিজের প্রিয় মানুষের পুড়ে যাওয়া দেহখানা দেখার সহ্য শক্তি যে তার নেই। চিত্ত তার অশান্ত। এ জীবনে কী তার আর প্রিয়তমার সাথে ঘর করা হবে না? মিষ্টি সংসার করা স্বপ্নটা কী তার অপূর্ণই রয়ে যাবে! আর দর্শিনীর বাচ্চাটা? সেই বাচ্চাটা পৃথিবী না দেখতেই এমন বিভৎসতার স্বীকার হয়ে পৃথিবী ছাড়বে! সৃষ্টিকর্তা এটা কঠোর কেনো হলেন! এত এত মানুষের জিইয়ে রাখা স্বপ্ন গুলো আমরণ নির্বাসনে না পাঠালে কী খুব বড় ক্ষতি হয়ে যেতো?

প্রদীপ নিজের বাবাকে ধরে দাঁড়িয়ে আছেন। সুমনের চোখেও টলমল করছে জল। নিপা কাঁদছে,নিধি কাঁদছে। সরলা তখনও মাটিতে টান টান হয়ে মলিন ভাবে পড়ে আছে।

মৃত্যুঞ্জয় আর দৃষ্টান্ত যেমন হন্তদন্ত হয়ে ঘরে ছুটে গেলো, তেমন হন্তদন্ত হয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে এলো। দরদরিয়ে ঘামচে তাদের শরীর। শরীরের শিরদাঁড়া বেয়ে গড়িয়ে পড়ছে সে ঘাম। তাদের শরীরের শিরায় উপশিরায় তখন ছড়িয়ে পড়েছে আতঙ্ক। ভয়ার্ত তাদের মুখমন্ডল। মৃত্যুঞ্জয়ের ডান হাতের কব্জির দিকটা কালশিটে হয়ে আছে। বোধহয় আগুনের আঁচ লেগেছে সেথায়। কিন্তু ওরা ঘরের ভিতর কি এমন দেখেছে যে আতঙ্কিত হয়ে আছে ওদের মুখমন্ডল? পুড়ে যাওয়া নারী দেহ গুলো কী এতটাই বিভৎস ছিলো?

মৃত্যুঞ্জয়কে দেখে মূর্তির ন্যায় দাঁড়িয়ে থাকা প্রতাপ কথা বলে উঠলো। যান্ত্রিক মানবের মতন গুটি গুটি শব্দ উচ্চারণ করে বললো,
“মেয়ে গুলো আর নেই,তাই না?”

দৃষ্টান্ত আর মৃত্যুঞ্জয় নিজেদের দিকে মুখ চাওয়া চাওয়ি করলো। অতঃপর ফ্যাকাসে মুখ চোখ কুঁচকে বললো,
“ওরা তো ঘরে নেই। ঘরের কোথাও ওদের পাই নি। ওদের কোনো চিহ্নই নেই ঘরে।”

ওদের কথায় যেন নিরব বি’স্ফো’র’ণ ঘটলো। তিন চার ঘন্টা আগে মেয়ে দুটো বাড়িতে এসেছিলো অথচ ওরা বলছে মেয়ে দুটো ঘরে নেই! তবে,কোথায় গেলো ওরা? নাকি ওরা বাড়িতেই আসতে পারে নি? আরও বিভৎস কিছু কী তবে হয়েছে ওদের সাথে?

ভয়ে উপস্থিত সকলের কলিজা শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেলো। অনাকাঙ্খিত ভয়ে গুটিয়ে গেলো হৃদপিণ্ড। জলজ্যান্ত মেয়ে গুলো গেলো কোথায়?

_

বিহঙ্গিনী যাওয়ার পর নির্জীব হওয়া বাড়িটা আর জেগে উঠলো না। কিন্তু মোহনার হিংস্রতা দ্বিগুণ বাড়লো যেন। একটু আগের ঘটনা, সন্ধ্যা বেলা মায়া লুচি বেলছিল আর মোহনা ভাজছিলো সেটা ডুবন্ত তেলে। বিকেলের নাস্তা তৈরী করছিলো বউ – শাশুড়ি। মায়া তার হাতের শেষ লুচিটা কড়াইয়ের মাঝে ছাড়তে নিলেই মোহনা ইচ্ছাকৃত অনেকখানি গরম তেল মায়ার হাতে লাগিয়ে দেয় চামচ নাড়ার বাহানায়। ছিটকে উঠে মায়া, ভীষণ যন্ত্রণায় চিৎকার দিয়ে উঠে। মোহনা কিছু জানেনা ভাব ধরে রইলো।

মায়ার চিৎকারে বিপ্রতীপ ও তার শ্বশুর হাজির হয় তৎক্ষনাৎ। ছেলেকে দেখে মোহনা দ্রুত ফ্রিজের কাছে ছুটে গিয়ে বরফ এনে মায়ার হাতে লাগিয়ে দেয়। ভাব এমন যে, সে মায়ার ব্যাথায় ভীষণ ব্যাথিত হয়েছে।

মায়া কিছুটা শান্ত হতেই বিপ্রতীপ আর ওর বাবা রান্নাঘর থেকে প্রস্থান নেয়। মায়া তখনও তার হাতে নিবিড় ভাবে ফু দিয়ে যাচ্ছে। ইশ,গোলগাল হাতটা কেমন লাল হয়ে আছে!

মায়ার এমন বিধ্বস্ত রূপ দেখে প্রশান্তির হাসি হাসে। তার যেন ভীষণ তৃপ্তি লাগছে এ কাজটা করে।

মায়া তার হাতের দিকে তাকিয়েই বাঁকা হেসে বললো,
“আমি প্রিয়দর্শিনী বা সদ্য আবেগে পা দেওয়া কোনো ননীর কন্যা না। কী ভেবেছেন? এমন করলেই আমি চলে যাবো? কখনোই না। আগে আমি আপনার আরেক গুণধর ছেলের সন্ধান জানবো তারপর আপনাদের সমাপ্তি টেনে বিদায় নেবো।”

#চলবে,,,,,

#পথান্তরে_প্রিয়দর্শিনী
#মম_সাহা

পর্বঃ সতেরো

একটা নতুন, পানসে,ফিকে ভোরের আগমন। চারদিকে কেমন নিষ্প্রাণতা,বিধ্বস্ততা। একটি পরিবার তাদের অসহায়ত্ব নিয়ে বসে আছে নিজেদের পুড়ে যাওয়া প্রিয় বাড়িটার কাছে। আকাশে বাতাসে ভেসে বেড়াচ্ছে ধনীদের দানবীয়তার নিদারুণ চিত্র। কিন্তু কেউ প্রতিবাদ করছে না,ফিরে তাকাচ্ছে না সেই দিকে। যেন ধনীরা এমন ভাবেই তাদের ক্ষমতা দিয়ে পিষে যাবে চিরকাল। এটাই যেন অনিবার্য, রীতিনীতি।

পুরো একটা রাত হন্যে হয়ে খোঁজ চললো দুই রমনীর কিন্তু কোথাও তারা নেই। এ যেন বিরাট বি’স্ফো’র’ণ ঘটলো। এক রাতের মাঝে মেয়ে গুলো কোথায় গেলো সেটা যেন কারো বোধগম্য হচ্ছে না। এমনকি হরপ্রসাদের বাড়ি অব্দি গিয়ে মৃত্যুঞ্জয় এবং দৃষ্টান্ত হম্বিতম্বি করে এসেছে। তবে এতে বিশেষ লাভ কিছু হয় নি।

প্রতাপ সাহা তার মলিন মুখ নিয়ে সেই কাঁদা মাটিতেই ঠাঁই বসে আছেন। সরলা সারা রাত কেবল আহাজারি করে গেছেন। বাড়ির প্রতিটি মানুষ বর্তমানে ক্লান্ত,পরিশ্রান্ত। একটা নির্ঘুম রাত কী ভীষণ যন্ত্রণায় তারা কাটিয়েছে সেটা যেন বলে বোঝানো সম্ভব না।

মৃত্যুঞ্জয় আর দৃষ্টান্ত মোটামুটি গ্রামের অধিকাংশ জায়গা খোঁজ করে প্রতাপদের কাছে হাজির হলো। দু’জনই অসম্ভব হাঁপাচ্ছে। শ্বাস দ্রুত উঠানামা করছে। সাথে হৃদপিণ্ড অস্বাভাবিক ভাবে লাফাচ্ছে।

দৃষ্টান্ত আর মৃত্যুঞ্জয়কে দেখে প্রতাপ সাহার মুখে হাসি ফুটলো। আশার আলো দেখলো যেন। পাহাড়ের ন্যায় অটল থাকা প্রতাপ সাহা বাচ্চাদের ন্যায় শুধালেন,
“পেলে বাবা,আমার মেয়ে দুটোকে?”

দৃষ্টান্ত আর মৃত্যুঞ্জয় ডানে-বামে মাথা নাড়ালো। যার অর্থ তাদের ব্যর্থতা প্রকাশ করেছে। নিধির বাবা-মা তৃণার শোকে যেন পাথর হয়ে গেলেন। তারা কোনোরকমের কথা বলছেন না। কেবল ফ্যালফ্যাল দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে ভালো কিছুর আশায়।

গ্রামবাসীদের মধ্যে অনেকেই থেকে গেছে প্রতাপ সাহাদের সাথে। যতই হোক,তারা প্রতিবেশী। একজনের বিপদে চলে যাওয়া টা যেন মানানসই মনে হচ্ছে না। আবার হতে পারে হয়তো তারা দর্শিনী আর তৃণার সম্বন্ধে আরও কোনো চাঞ্চল্যকর খবরের আশায় দাঁড়িয়ে আছে। মানুষের মন বোঝা আজকাল বড্ড কঠিন হয়ে যে দাঁড়িয়েছে।

সবার বিষন্নতার পাহাড় সরিয়ে একরাশ বিষ্ময় এনে দিয়ে রিনরিনে এক নারী কণ্ঠ বলে উঠলো,
“বাবা,তোমরা এখানে কেনো বসে আছো? এ কী অবস্থা তোমাদের?”

সবার বিষ্ময় যেন চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছে গেলো। কতক্ষণ তাজ্জব বনে তাকিয়ে রইলো তারা মেয়ে দুটোর দিকে। মেয়ে গুলোর মুখ খানা কেমন কোমল,মলিন হয়ে আছে। প্রতাপ সাহা তড়িৎ গতিতে উঠে দাঁড়ালেন। তার সাথে সাথে যেন উপস্থিত সবার ঝিমিয়ে থাকা শক্তিটা জেগে উঠলো। নিধি এসে নিজের বোনটাকে জড়িয়ে ধরলো। প্রদীপ এসে দর্শিনীর বাহু আগলে ধরলো। সবার মনে চাপা কৌতূহল, বিষ্ময় যেন উপচে পড়ছে।

দর্শিনী তার বাবাকে কিছু বলতে যাবে তার আগেই নিজের মায়ের দিকে চোখ যায়। মায়ের সুন্দর, সুশ্রী মুখটুকু কেমন কোমল হয়ে আছে! দর্শিনী অবাক চোখে মায়ের দিকে তাকিয়ে বললো,
“মা,তোমার কী হয়েছে? এমন দেখাচ্ছে কেনো? তোমরা কী মাত্র ফিরলে? বাড়ি না গিয়ে রাম্তায় কী করছো?”

দর্শিনীর মা নিষ্পলক মেয়ের দিকে তাকিয়ে রইলেন। অতঃপর কাঠ কাঠ কণ্ঠে বললেন,
“কোথায় ছিলি তুই সারারাত?”

এবার তৃণা এগিয়ে এলো। উচ্ছ্বসিত কণ্ঠে বললো,
“জানো আন্টি,কালকে রাতে কী হয়েছে?”

সবার বিষ্ময় আকাশচুম্বী। মেয়ে গুলো কোথায় ছিলো সারারাত? তাছাড়া ওদের এত হাসি হাসি মুখই বা কেনো?

মৃত্যুঞ্জয় এবার তাদের পাশে এসে দাঁড়ালো। এতক্ষণে যেন তার দেহ স্থির হয়েছে। ছোট্ট একটা শ্বাস ফেলে বললো,
“কোথায় ছিলেন দু’জন সারারাত?”

“ভাইয়া, আমরা তো আমাদের ক্যাম্পে ছিলাম কাল রাতে।”

তৃণার উত্তরে হা হয়ে রইলো সবাই। তাদের যেন বলার কোনো ভাষা নেই। যে মানুষ গুলোকে তারা হন্যে হয়ে খুঁজেছে তারা কিনা ক্যাম্পে ছিলো! কারো মুখ থেকে আর কোনো শব্দ যেনো বের হলো না।

এবার মূর্তির ন্যায় প্রতাপ সাহা উঠে দাঁড়ালো। নিজের মেয়ের সামনে গিয়ে কতক্ষণ প্রাণ ভরে দেখলো মেয়েটাকে। মেয়েটাকে কাল রাতে দেখতে না পেয়ে কলিজাটা কেমন হাহাকার করে উঠেছিল। মনে হয়েছিল এ বিশাল সংসারে কেউ নেই তার। যার মাঝে নিজের মায়ের প্রতিচ্ছবি দেখতো সে মেয়েটাকেও সে রক্ষা করতে পারলো না। এক মুহূর্তের জন্য মনে হয়েছিল বেঁচে থাকাটাই বৃথা হয়ে গেছে। বাবা মানে যেখানে বটবৃক্ষ সেখানে বাবা-ই মেয়ের বিপদের ঢাল হতে পারে নি। এর চেয়ে বেশি অসহায়ত্ব আর কিছুতে নেই। কিন্তু এখন আত্মার শান্তি মিলছে মেয়েকে অক্ষত দেখে। প্রতাপ সাহা আর সময় ব্যয় না করে দর্শিনীকে জড়িয়ে ধরলেন। হিমালয়ের মতন শক্ত,অটল বাবা বাচ্চাদের মতন কেঁদে দিলেন। মেয়েকে যেন বুকের সবটুকু উষ্ণতা ঢেলে দিলেন। মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে অনবরত বললেন,
“মা,তুমি ঠিক আছো? তোমাকে ঈশ্বর ঠিক রেখেছে। এর চেয়ে খুশির খবর আমার কাছে নেই।”

দর্শিনী থমকালো। বুজ হওয়ার পর থেকে বাবাকে সে কখনো কান্না করতে দেখে নি। তবে আজ বাবা কাঁদছে কেনো?

দর্শিনী ব্যতিব্যস্ত হয়ে বাবার চোখের অশ্রু গুলো যত্নে মুছে দিলো। আদুরে কণ্ঠে বললো,
“বাবা, কাঁদছো কেনো? আমাদের জন্য চিন্তা করছিলে বুঝি? আমার ফোনে চার্জ ছিলো না আর তৃণার ফোনটা জলে পড়ে নষ্ট হয়ে গিয়েছিল। তাই তো তোমাদের জানাতে পারি নি আমরা যে ক্যাম্পে।”

“এত রাতে ক্যাম্পে গিয়েছিলেন কেনো? সেটা তো পরিষ্কার করুন।”

মৃত্যুঞ্জয়ের প্রশ্নে দর্শিনী তার দিকে ঘুরে তাকালো। শীতল কণ্ঠে বললো,
“কাল বাড়ি ফেরার পথে ক্যাম্প থেকে আমার ফোনে কল আসে। কোনো জরুরী রোগী নাকি এসেছে সেখানে। তাড়াতাড়ি যেতে হবে। আমি আর তৃণা আর কিছু না ভেবেই সেখানে ছুট লাগাই। সেখানে গিয়ে দেখি পাশের গ্রামেরই এক বউয়ের পেইন উঠেছে। বাচ্চা প্রসবের সময় হয়েছে। তৃণা তখন দিক বেদিক ভুলে দৃষ্টান্তদাকে কল লাগায় কিন্তু ফোন বন্ধ ছিলো। আপনার নাম্বার জানা সেই ওর। অতঃপর আমরাই লেগে গেলাম কাজে। সারারাতের চেষ্টার পর ভোর রাতের দিকে তার একটি ছেলে সন্তান জন্ম নেয়। আর শান্তির কথা এটা যে,তারা দু’জনেই সুস্থ আছে।”

দর্শিনীর সাথে সাথে সবাই একটা স্বস্তির শ্বাস ফেললো। তন্মধ্যেই সরলা ছুটে এসে চড় লাগালো মেয়ের গালে। একটা চড় দিয়ে ক্ষান্ত হয় নি সে। পর পর আরেকটা চড়ও দিলো। অতঃপর চুলের গোছা ধরে টান দিয়ে রণচণ্ডী রূপে বললো,
“তুই ম’র’লি কেনো মুখপুরী! তুই ম’র’লে আমরা শান্তি পেতাম। কাল সারাটা রাত আমাদের তো বেঁচে থেকেও মে’রে ফেলেছিলি। আর এখন এসে কাহিনী শুনাছ?”

দর্শিনী মায়ের এমন আক্রোশ যেন মেনে নিতো পারলো না। বিষ্ময়ে হা হয়ে রইলো মুখটা। বিষ্মিত কণ্ঠে বললো,
“মা,আমি করেছি টা কী?”

“দেখ তোর বাবার স্বপ্নে গড়া বাড়িটার দিকে তাকিয়ে। দেখবি তুই কী করেছিস তার প্রমাণ। একদম শেষ করে দিয়েছিস তুই আমাদের। ম’রে গেলি না কেন তুই?”

দর্শিনী মায়ের দিক থেকে চোখ ফিরিয়ে বাড়ির দরজাটার দিকে তাকালো। ধীর পায়ে এগিয়ে গিয়ে দরজাটা খুলতেই একটা পুঁড়ে যাওয়া বাড়ি চোখে পড়লো তার। যে বাড়িটাতে সে শৈশব,কৈশোর কাটিয়েছে, সে বাড়ির এমন দশা দেখে সে স্তব্ধ। তৃণাও হা হয়ে তাকিয়ে রইলো। চোখ যে বিশ্বাসই করতে পারছে না সে দৃশ্য।

দর্শিনী কাঁপা কাঁপা কণ্ঠে প্রশ্ন ছুঁড়লো,
“কীভাবে এমন হলো?”

অতঃপর গড়গড় করে সবটা বললো তার বড় ভাই। সারাটা রাতের বিধ্বস্ততার বর্ণনা দিলো সে। কী ভয়ানক কালরাত্রি ছিলো!

দর্শিনী সবটা শুনে পাথর হয়ে গেলো। অতঃপর গুটি গুটি পায়ে মায়ের কাছে এগিয়ে গিয়ে তাচ্ছিল্য হেসে নরম কণ্ঠে শুধালো,
“মা,তোমার আমার প্রতি অভিযোগ টা ঠিক কী? চড় মারার কারণটা কী? বাড়ি পুড়েছে বলে? নাকি সেই বাড়ির ভিতর আমি ছিলাম না বলে? পুড়ে যাওয়া সন্তানের দেহ দেখার এত ইচ্ছে তোমার মা? আফসোস নেই,হয়তো খুব শীগ্রই দেখবে। যতই হোক,মায়ের অভিশাপ নিয়ে কী আর বেশিদিন বেঁচে থাকা যায়?”

মেয়ের কথায় সরলা থমকে গেলো। মেয়ে কী ভুল কিছু বলেছে!

#চলবে__

#পথান্তরে_প্রিয়দর্শিনী
#মম_সাহা

পর্বঃ আঠারো

দু’তলা বিশিষ্ট বিশাল প্রাচীর ঘেরা বাড়িটা কেমন নিস্তব্ধ, নিশ্চুপ। গা হিম করা নিস্তব্ধতা এই বাড়িটাতে। মানুষ গুলো কেমন যান্ত্রিক ভাবে জীবনযাপন করছে। কারো সাথে কারো কথা নেই। আগে মোহনার চওড়া গলা শোনা যেতো আবাসিক এলাকাটার মোড় থেকে। সকাল বিকাল দর্শিনীর উপর চোটপাট করার জন্য হলেও তার কণ্ঠ উচ্চস্তরে পৌঁছাতো। কিন্তু আজকাল তো সেটাও নেই।

মায়া চা বানাচ্ছে রান্নাঘরে। নিস্তব্ধ বাড়িটায় খুটখাট শব্দটাই কেবল শোনা যাচ্ছে। তাছাড়া কোনো জনমানসের চিহ্ন যেন নেই। ড্রয়িং রুমে টিভি চলছে। মোহনা বোধহয় টিভি দেখছে। টিভির শব্দটাও খানিক শোনা যাচ্ছে। মায়া খুব মনযোগ দিয়ে চা বানালো। অতঃপর চারটা কাপে চা ঢেলে ট্রেয়ের উপর নিয়ে ড্রয়িং রুমের দিকে অগ্রসর হলো।

মোহনা খুব মনযোগ দিয়ে টিভি দেখছে। মায়া মোহনার কাছে গিয়ে হাসিমুখে ট্রে এগিয়ে দিয়ে বললো,
“শাশুড়ী, চা নেন।”

মোহনা টিভির দিকেই দৃষ্টি নিবদ্ধ করে রাখলেন। মুখে কেমন যেন একটা কাঠিন্যতার আভা। শক্ত মুখে চায়ের কাপটা হাতে নিয়ে টিভির দিকে তাকিয়ে থেকেই চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে বললো,
“আমি তো আজকাল ভয়ে থাকি,কখন তুমি আমার কী ক্ষতি করে দেও। এখন তো ভেবেছিলাম এই চায়ের কাপটা হাতে না দিয়ে বুঝি ঢেলে দিবে আমার শরীরে।”

মায়া হাসলো। মিষ্টি কণ্ঠে বললো,
“সবাইকে আপনার মতন কেনো ভাবতে যান, শাশুড়ি? সবাই কী আর মোহনা হয়?”

“হয়েছে,যাও যাও। ওদেরকেও চা দিয়ে আসো।”

মায়া মুচকি হেসে ট্রে টা নিয়ে ঘুরতে নিলেই ছোট্ট টেবিলটার কোণায় ধাক্কা খেয়ে উপুড় হয়ে ফ্লোরে পড়ে যায়। তার হাতের গরম চায়ের তিনটা কাপই মোহনার শরীলে পড়ে। চিৎকার করে উঠে মোহনা। তার শরীরে যেন কেউ আগুন লাগিয়ে দিয়েছে। চিৎকারে ভারী হয়ে যায় নিস্তব্ধ বাড়িটা। বিপ্রতীপ নিজের ঘর থেকে বেরিয়ে এলো, মায়ার শ্বশুরও বিশ্রাম নিচ্ছিলো কিন্তু মোহনার চিৎকারে সেও জেগে উঠেছে। ছুটে বেরিয়ে এলো সে। মোহনা ততক্ষণে লাফাচ্ছে আর চিৎকার করছে। ঘটি হাতার ব্লাউজ পড়ার কারণে পুরো ফর্সা হাতটা লাল হয়ে গেছে সেটা দেখা যাচ্ছে। সাথে গলা আর গালও লাল হয়ে গেছে।

বিপ্রতীপ শীগ্রই ড্রয়িং রুমে এসে হতবাক। মায়া কোমড়ে হাত দিয়ে কুঁকড়ে যাচ্ছে বারবার। মোহনা তারই পাশে দাঁড়িয়ে লাফাচ্ছে। বিপ্রতীপ কাকে রেখে কাকে ধরবে সেটা যেন বুঝতেই পারছে না। অতঃপর নিজের বাবাকে বের হয়ে আসতে দেখে পথ খুঁজে পেলো। সে গেলো মায়াকে সাহায্য করতে আর তার বাবা মোহনার সামনে গিয়ে দাঁড়ালো।

বিপ্রতীপ মায়াকে টেনে উঠালো। ডান হাতে তার বাহু আঁকড়ে ধরে বিচলিত কণ্ঠে বললো,
“কী হয়েছে, মায়া? কীভাবে পড়লে? কোথায় লেগেছে বলো?”

মায়া বিপ্রতীপের টি-শার্ট টা শক্ত করে আঁকড়ে ধরলো। ভাব এমন যে সে দাঁড়িয়ে থাকতে পারছে না। ততক্ষণে মোহনার চিৎকার যেন মিইয়ে গেলো। তার আদরের ছেলেটা তাকে না ধরে কিনা তার বউকে ধরেছে? বিচলিত হয়েছে? কই এত বছরে এমন দিন তো কখনো আসে নি! দর্শিনী থাকা কালীন যা-ই হতো নির্দ্বিধায় দোষ তাকে দিয়ে মোহনা শান্তিতে থাকতো কারণ বিপ্রতীপ ছিলো মাভক্ত। আর একমাসের ব্যবধানে সে ছেলে কিনা এমন ভাবে বদলে গেলো!

বিপ্রতীপ মায়াকে বসিয়ে রেখে মায়ের কাছে ছুটলো। আহ্লাদী স্বরে বললো,
“কী হয়েছে মা তোমার? চা পড়েছে? জ্বলে যাচ্ছে না? দাঁড়াও আমি বরফ নিয়ে আসছি।”

মোহনা কোনোরকমে চোখের জল লুকালো। তার যেন বিষ্ময়ই কাটছে না। তার ছেলের এমন বদল সে কিছুতেই মানতে পারছে না। এ ছেলের জন্যই সে কত কিছু করেছে এ জীবনে। কত পাপ! অথচ সবটা ভুলে বসেছে সেই ছেলে?

বিপ্রতীপ মাকে চুপ থাকতে দেখে আবার বিচলিত কণ্ঠে শুধালো,
“কী হয়েছে বলবে তো মা? আচ্ছা তুমি বসো। আমি বরফ আনছি।”

“থাক বাবা,জ্বালা কমে গেছে। তুই বরং বউকে নিয়ে ঘরে যা।”

মোহনার বলা বাক্যে আক্রোশ ছিলো না, তীক্ষ্ণতা ছিলো না তবে ছিলো একরাশ নিস্তব্ধতা, বিষন্নতা। এতদিনের গড়া বিশ্বাসের প্রাচীর ভেঙে যাওয়ার হাহাকার।

বিপ্রতীপের বাবাও নিজের স্ত্রীর কথাকে প্রশ্রয় দিয়ে বললেন,
“হ্যাঁ, তুই বৌমাকে নিয়ে রুমে যা। আমি আছি তোর মায়ের সাথে।”

বিপ্রতীপ মাথা নাড়িয়ে মায়াকে ধরে উঠালো। মোহনা ভেবেছিলো তার অভিমানের ভাষা হয়তো বিপ্রতীপ বুঝবে কিন্তু না,বিপ্রতীপ বুঝে নি। সে দিব্যি বউকে নিয়ে ঘরের দিকে হাঁটা ধরলো।

মায়া কোনোরকম হেঁটে যেতে যেতে পিছে ফিরে আবার মোহনার দিকে তাকালো। মায়ার দৃষ্টি মনে হলো যেন হাসছে। তার দৃষ্টি যেন ক্রুর হাসি হেসে বলছে,
“দেখলেন তো শাশুড়ি,সবাই মোহনা হয় না। মোহনা আর মায়ার মাঝে বিশাল তফাত। মোহনারা হাত পুড়াতে জানলে, মায়ারা পুরো শরীর পোড়ানের ক্ষমতা রাখে। শরীরের সাথে সাথে যে হৃদয়ও পুড়িয়েছি সেটা বোধগম্য হলো তো? এইতো আপনার মূর্ছা যাওয়া শুরু। এবার কেবল দেখুন কী হয়।”

মোহনা স্তব্ধ দৃষ্টিতে চেয়ে রইলো। তার তবে রাজত্ব হারানোর সময় হলো?

_

ঘর হারা মানুষ গুলোর ঠাঁই হয়েছে নিধিদের বাড়ি। পাশের গ্রামে নিধিদের বাড়ি বলে সেখানেই সবাই উঠলো। যেহেতু তাদের আর থাকার জায়গা নেই সেহেতু সেখানেই উঠতে হয়েছে। নিধির বাবা-মা আপ্রাণ চেষ্টা করছে কুটুমদের আত্মীয়তা সুন্দর ভাবে করতে। যতই হোক মেয়ের শ্বশুর বাড়ি। সামান্য ভুল ত্রুটিও যেন না হয়।

বিকেল হতেই তৃণা,দর্শিনী,প্রতাপ,মৃত্যুঞ্জয়, দৃষ্টান্ত,নিধির বাবা,প্রদীপ সবাই রওনা হলো পুলিশ স্টেশন। এটার একটা বিহীত যে করতেই হবে। হরপ্রসাদ এত বড় অন্যায় করে তো পাড় পাবে না। অবশ্যই এর যথাযথ শাস্তি হবে।

প্রকৃতি সবে সন্ধ্যার সাজে সেজেছে। মৃত্যুঞ্জয়ের জীপে করে তারা এগিয়ে যাচ্ছে পুলিশ স্টেশন। সবার মাঝে নিরিবিলি ভাব। কারো মুখে রা নেই। অবশ্য কথা বলার অবস্থাতে কেউ নেইও। প্রতাপ সাহা কেমন পাথর রূপ ধারণ করেছে। নিধির বাবাও চুপচাপ। তার চুপচাপ থাকার কারণ হলো দৃষ্টান্ত। কেন জানি তার এ ছেলেটাকে পছন্দ না। পছন্দ না হওয়ার কারণটাও অবশ্য ফ্যালনা না। যে ছেলের বাবার জন্য তার বড় মেয়ের শ্বশুরবাড়িটা এমন দাউ দাউ করে জ্বললো সে ছেলের আদিখ্যেতা যেন তার সহ্য হচ্ছে না।

অবশেষে জীপ এসে থামলো থানার কাছে। সব গুলো মানুষ চুপচাপ নেমে গেলো। সবার মনে প্রতিহিংসার আগুন জ্বলছে দারুণ ভাবে। কিছু একটা না করে তারা বাড়ি ফিরবে না প্রতিজ্ঞা করেছে বোধহয়।

থানার আশেপাশে বিরাট বিরাট বাল্ব জ্বলছে যা আলোকিত করছে চারপাশটা ভীষণ ভাবে। ধীরে ধীরে গুটি গুটি পায়ে সবাই এগিয়ে যাচ্ছে থানার ভিতরে। হঠাৎ তৃণা অনুভব করলো তার হাতটা যেন কেউ শক্ত করে ধরলো। আরেকটা হাতের মুঠোয় বন্দি হলো তার ছোট্ট হাতটা। তৃণা অবাক হলো। ঘাড় ঘুরিয়ে পাশে তাকাতেই দেখলো দৃষ্টান্ত। তৃৃণা স্বস্তির শ্বাস ফেললো। প্রায় ফিসফিসিয়ে বললো,
“হাত ছাড়ো, লাট সাহেব। বাবা সাথে আছে। দেখে ফেললে সর্বনাশ। এমনেতেই সবার মন মানসিকতা খারাপ।”

তৃণার কথার পরিপ্রেক্ষিতে হাতের চাপ যেন বাড়লো বয় কমলো না। দৃষ্টান্তের দাঁত কিড়মিড় করে রুক্ষ স্বরে উত্তর এলো,
“তুমি আমাকে তোমার বাপ দেখাচ্ছো? চ’ড়িয়ে সোজা বানায় দিবো অ’স’ভ্য ডাক্তারনি। জানো কাল একটুর জন্য আমি ম’রি নি। কতটা ভয় পেয়েছি জানো? পাকামি না করলে কি তোমার পেটের ভাত হজম হয় না?”

“আমরা কী জানতাম এতকিছু হবে? আর তোমাকে তো কল দিয়েছিলাম কিন্তু তোমার ফোন বন্ধ ছিলো। সবসময় নিজের দোষ অন্যের ঘাড়ে না দিলে পেটের ভাত কী তোমারও হজম হয় না?”

তৃণার শক্ত কণ্ঠে ভ্রু কুঁচকে তাকায় দৃষ্টান্ত। কোমড়ের পিছে তার বলিষ্ঠ হাতটা দিয়ে জোরে চিমটি কাটে। হাতের মাঝে থাকা হাতটা মুচড়ে দিয়ে রাগী কন্ঠে বলে,
“বেশি মুখে মুখে তর্ক শিখেছো না? দাঁড়াও, তোমার ব্যবস্থা আমি নিচ্ছি। ঝামেলাটা আগে মিটুক। বেশি কথা বেড়েছে না?”

তৃণা মুখ ভেংচি দিয়ে নিজের হাতটা ছাড়িয়ে নিয়ে বাবার পাশে ছুটে গেলো। দৃষ্টান্ত ধরতে গিয়েও পারলো না। তার মন এখন শান্ত। কাল যা গিয়েছে তার উপর দিয়ে একমাত্র সে-ই জানে। মায়ের পর পৃথিবীতে একমাত্র এই নারীটার প্রতিই সে দুর্বল,আসক্ত। এ মানুষটাকে ছাড়া সে বোধহয় উ’ন্মা’দ হয়ে যাবে।

দর্শিনী থানায় পা রাখতে নিবে এমন সময় একজন মানুষকে দেখে সে থমকে যায়। থেমে যায় তার পা। এত গুলো দিন পর তার সামনে তার প্রিয় একজন মানুষ!

#চলবে