পথান্তরে প্রিয়দর্শিনী পর্ব-১৯+২০+২১

0
198

#পথান্তরে প্রিয়দর্শিনী
#মম_সাহা
#পর্ব-১৯+২০+২১

রাতের হিমশীতল বাতাসে কেঁপে কেঁপে উঠছে সকলের শরীর। দর্শিনী অপলক তাকিয়ে আছে থানার সামনের রাস্তায় থম মেরে দাঁড়িয়ে থাকা মেয়েটার দিকে। এ কী সে স্বপ্ন দেখছে? বিহঙ্গীনি এখানে, এসময়ে? অতীতের রাগ,অভিমান মানলো না দর্শিনীর ছোট্ট হৃদয়। এতদিনের প্রিয় বান্ধবীকে দেখে ভুলে গেলো সে তার অতীতের কুৎসিত গল্প। ছুটে গেলো বিহঙ্গিনীর সামনে। আবেশে জড়িয়ে ধরলো সেই নারী দেহকে। নিশ্চুপ আলিঙ্গন যেন বলে গেলো কত অব্যক্ত কথা। কত দীর্ঘশ্বাসের গল্প।

দর্শিনী বিহঙ্গীনির চুলে মোলায়েম, কোমল,আদুরে হাত বুলিয়ে বিগলিত বদনে বলে উঠলো,
“কবে এলি বিহু এখানে? আমার কাছে যাস নি কেনো?”

বিহঙ্গীনিও ততক্ষণে দর্শিনীকে জাপ্টে ধরেছে। কতদিনের তৃষ্ণাত্ব আত্মা আজ শান্তি মিললো। অবশেষে এতদিন পর সে তার প্রাণপ্রিয় সইয়ের দেখা পেলো।মেয়েটাকে ছাড়া জীবনটা কেমন বিষাক্ত হয়ে গিয়েছিলো! আজ শান্তি মিলছে। ঠান্ডা হয়েছে হৃদয় কোণ। আনন্দরা বাঁধন হারা হলো। মিশে গেলো শরীরের প্রতিটি শিরায় উপশিরায়।

বিহঙ্গিনীকে চুপ থাকতে দেখে দর্শিনী আলিঙ্গন ছাড়লো। তার দুই হাতের মধ্যিখানে বিহঙ্গীনির মুখটা আদুরে ভাবে ধরে মিষ্টি কণ্ঠে আবারও শুধালো,
“কবে এলি, পাখি? এত রাতে এখানেই বা কেনো?”

বিহঙ্গীনি এবার মুখ খুললো। সাজিয়ে রাখা বর্ণ গুচ্ছকে দর্শিনীর সামনে তুলে ধরে বললো,
“এসেছি সপ্তাহ খানেক হয়। আমাদের কলেজ থেকে ক্যাম্পিং এর জন্য এই গ্রামে এসেছে ছাত্র ছাত্রীরা। প্রথমে ভেবেছিলাম তোর সাথে কথা বলবো, দেখা করবো কিন্তু সেটা আর হয়ে উঠে নি?”

“কেনো? তোর ভাই না করে দিয়েছে বুঝি?”

দর্শিনীর ভ্রু কুঁচকানো প্রশ্ন শুনে বিষন্ন হাসলো বিহঙ্গিনী। অতঃপর উত্তর দিলো,
“ঐ বাসার কেউ জানেনা বোধহয় আমি এখানে এসেছি। আসলে আমি ঐ বাড়ি ছেড়ে একবারের মতন চলে এসেছি।”

বিহঙ্গীনির কথায় হা হয়ে গেলো দর্শিনী। যে মেয়ে কি-না বাবা-মা, ভাই ছাড়া ঘর থেকে বের হতে লজ্জা পেতো সে কিনা সপ্তাহ খানেক আগে বাড়ি ছেড়ে চলে এসেছে? মেয়েটার এত পরিবর্তন কী করে ঘটলো? তবে কী বিপ্রতীপের নতুন বউ টা ভালো না? কিন্তু কথা বলে তো তেমন মনে হয় নি। এসব ভাবনার মাঝেই বিহঙ্গীনি দর্শিনীর গলা জড়িয়ে ধরলো। আহ্লাদী স্বরে বললো,
“তুই এখানে কী করছিস, বৌদি? কোনো সমস্যা?”

দর্শিরী প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার আগে বিহঙ্গীনি ভ্রু কুঁচকে ফেললো। দর্শিনীর থেকে গুনে গুনে দু পা পিছিয়ে গিয়ে দর্শিনীকে পা হতে মাথা অব্দি খেয়াল করলো। তার মিষ্টি চোখ জোড়াতে এখন বিষ্ময়। মেয়েটাকে আজ এমন লাগছে কেনো? বিশাল পরিবর্তন দেখা যাচ্ছে। সাধারণত এ পরিবর্তন গুলো তো প্রেগন্যান্সির সময় দেখা দেয়। তবে কী দর্শিনী…. ! বিহঙ্গীনি আর কিছু ভাবলো ন। এসব পড়েও ভাবা যাবে। আপাতত এ মুহূর্তেটা উপভোগ করার জন্য।

বিহঙ্গীনি একে একে সবার সাথে কুশলাদি বিনিময় করলো। অতঃপর তাদের থানায় আসার কারণ জানতে পারলো এবং সবাই একসাথে থানায় প্রবেশ করে।

রায়পুর থানার বড় অফিসার আরাম কেদারায় বসে শরীর দুলাচ্ছে আর পা চিবুচ্ছে। হাতের সামনে একটা ফোন ধরা হয়তো ভিডিও দেখছে। হুড়মুড় করে কত গুলো মানুষকে প্রবেশ করতে দেখে তিনি অবাক হন। ভ্রু জোড়া কুঁচকে যায় আপনা-আপনি। সচারাচর গ্রামের মানুষ রাতের বেলা পুলিশ স্টেশন আসে না। অথচ ওরা দলবল নিয়ে চলে এসেছে? এখানের অনেক মানুষের মুখ চেনা আবার অনেকে অপরিচিত তার। অফিসার উঠে দাঁড়ালো। মুখে থাকা পান টাকে কিছুক্ষণ চিবিয়ে ফেলে দিলো সাথের জানলা দিয়ে। অতঃপর তাদের দিকে তাকিয়ে দু হাত জোর করে বললো,
“পেন্নাম নিবেন মাস্টার, বিমল, ডাক্তার বাবুরা। তা এত রাতে এখানে?”

একে একে সবাই প্রবেশ করলো। প্রতাপ সাহা ও বিমল সাহা মানে নিধির বাবাও হাত জোর করে ভদ্রতার সহিতে বললো,
“প্রণাম নিবেন আপনিও। আসলে আমরা একটা সমস্যায় পড়ে আপনার কাছে এসেছি। আশাকরি আপনি আমাদের সাহায্য করবেন।”

“তা তো বুজেছিই যে আপনারা সাহায্য চাওয়ার জন্যই এসেছে। এমনি এমনি পুলিশের খোঁজ নিতে তো আর কেউ পুলিশ স্টেশন আসে না। বলুন তবে কী বলবেন।”

প্রতাপ সাহা তার পাঞ্জাবির পকেটটা থেকে রুমাল বের করে কপালের বিন্দু বিন্দু ঘাম টুকু মুছে ফেললো। আশ্চর্যজনক ভাবে তার শরীর কাঁপছে। নিজের স্বাধের বাড়ি পুড়ে যাওয়ার কথা যেন সে বলতে পারছে না। তার কণ্ঠনালী কাঁপছে।

প্রতাপের অবস্থা সবাই-ই ধরতে পারলো। বাবার এমন অবস্থা দেখে প্রদীপ এগিয়ে এলো সাথে দর্শিনীও। বাবাকে ধরে পাশের চেয়ারটায় বসালো। দর্শিনী নিজের শাড়ির আঁচলটা দিয়ে বাবার মুখ মুছিয়ে দিলো। প্রদীপ বাবার জন্য এক গ্লাস জল আনালো। মুহূর্তেই বাবার ভরসার কাঁধ হয়ে গেলো সন্তান গুলো। জীবন আমাদেরকে সব ফিরিয়ে দেয়। একসময় যে বাবা-মা থাকে সন্তানের ছায়াতল,সময়ের বিবর্তনে সে বাবা-মায়ের ছায়াতল হয়ে উঠে সন্তান। যে বাবা-মায়ের ভরসার হাত ধরে গুটি গুটি পায়ে চলতে শিখে সন্তান একটা সময় পর সে বাবা-মায়ের বৃদ্ধ বয়সের লাঠি হয়ে যায় তার সন্তান। প্রকৃতির কী দারুণ মেলবন্ধন!

প্রতাপ সাহা নিজেকে ধাতস্থ করতেই প্রদীপ মুখ খুলে। হরমোহনের সকল কৃতকর্ম গুছিয়ে উপস্থাপন করে অফিসারের সামনে। প্রদীপের কথা থামতেই অফিসার কতক্ষণ তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকায় সবার দিকে। অতঃপর কিছুটা সময় মৌন থেকে বলে উঠে,
“আপনারা হরমোহন বাবুর বিপক্ষে মা’ম’লা করতে এসেছেন! অসম্ভব সাহস দেখিয়েছেন বলা যায়। কিন্তু সেই সাহসকে আমি ভর্ৎসনা জানাই। আজ মাথার উপর ছাঁদ পুড়েছে কাল আপনারও পুড়ে যেতে পারেন। আমি সুন্দর একটা উপদেশ দেই, ঝামেলায় না জড়িয়ে মিটমাট করে ফেলুন। এতে আপনাদেরই লাভ।”

অফিসারের কথায় তেতে উঠে সবাই। সুমন তো রেগে চিৎকার দিয়ে বলে উঠে,
“আপনার কাছে কী আমরা উপদেশ চাইতে এসেছি? আপনার চেয়ে বিবেক বুদ্ধি বোধহয় আমাদেরই বেশি উন্নত। আপনার কাছে আমরা মা’ম’লা করতে এসেছি আর আপনি সেটা করতে আমাদের সাহায্য করবেন। দ্রুত কেইস ফাইল করুন। আপনার উপদেশ পকেটে রেখে দালালি বন্ধ করুন।”

সুমনের কথায় ক্ষ্যাপে গেলো পুলিশ অফিসারও। এতক্ষণের বাঁকা হাসিটা তার মুখে আর নেই। বরং তার অগ্নিশর্মা রূপ। সুমনের দিকে আঙ্গুল তাক করে বললেন,
“পুলিশ স্টেশনে বয়ে এসে পুলিশকে হ্যারেস করার অপরাধে আমি আপনাকে জেলে নিতে পারি জানেন সেটা?”

এবার দর্শিনীর তীক্ষ্ণ কণ্ঠ শোনা গেলো,
“ক্ষমতার অপব্যবহার করতে তো সবাই ই জানে। আপনার ক্ষমতা আছে তাই আপনি সেটা করতেই পারেন। তবে মনে রাখবেন সাধারণ জনগনেরও শক্তি অতটাও কম না।”

পুলিশ অফিসার ক্রুর হাসলেন। আরাম করে নিজের চেয়ারটায় বসে পা নাড়াতে নাড়াতে বললেন,
“আচ্ছা? সাধারণ মানুষের এত শক্তি! তবে আমি আগে আপনাদের ক্ষমতা দেখবো তারপর কেইস ফাইল করবো।”

দর্শিনীরা একে অপরের মুখ চাওয়া চাওয়ি করলো। এটা স্পষ্ট বুঝায় যাচ্ছে হরমোহনের পক্ষের লোক উনি। আইনি কোনো সাহায্য যে সহজে পাওয়া যাবে না সেটাও তাদের বোধগম্য হয়ে গেলো কয়েক মিনিটে। হতাশার শ্বাস ফেললো দর্শিনী। এ জগতে টাকার কাছে বিকিয়ে যায় সব। ক্ষমতা,প্রেম এমনকি ভালোবাসাও টাকার কাছে হার মানে। তবে কী তারা বিচার পাবে না?

তন্মধ্যেই মৃত্যুঞ্জয় কাকে যেন ফোন লাগায়। দরজার কাছে গিয়ে কার সাথে যেন কথা বলে অতঃপর সে ফোন অফিসারের দিকে এগিয়ে দিয়ে বাঁকা হেসে বলে,
“ধরেন অফিসার,সাধারণ মানুষের ক্ষমতা দেখুন এবার।”

অফিসার ভ্রু কুঁচকে ফোনটা নিয়ে নেয়। বিপরীত পাশ থেকে কিছু একটা বলতেই সে তড়িৎ গতিতে লাফিয়ে উঠে। মিইয়ে যাওয়া কণ্ঠে কথা বলেই ফোনটা এগিয়ে দেয় মৃত্যুঞ্জয়ের কাছে। মৃত্যুঞ্জয় আরও কিছু কথা বলে ফোনটা রেখে দেয়। পকেটে দু হাত গুজে হাসি হাসি মুখে বলে,
“কী অফিসার? আরও কিছু দেখবেন?”

অফিসার তার সামনে থাকা জলটা তাড়াতাড়ি এক নিমিষেই শেষ করে স্বস্তির শ্বাস ফেলে। এর একটা বাক্য ব্যয় না করেই কেইস ফাইল করেন। তার মুখে যেন রা নেই। মৃত্যুঞ্জয়ের দিকে সবাই কৃতজ্ঞতার দৃষ্টিতে তাকায়। অসময়ে দূরের মানুষ গুলোই যেন বেশি আপন হয়ে যায়।

_

রাত প্রায় দেড়টা কিংবা দুটো বাজে। দর্শিনী তার রুমের পিছিনের দরজা খুলে দাঁড়িয়ে আছে। তারা ন’টার দিকেই বাড়ি ফিরেছে। বিহঙ্গিনী অবশ্য আসে নি অনেক জোড়াজুড়ি স্বত্বেও। বলেছে কাল দেখা করবে। মৃত্যুঞ্জয় জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে ফোন দিয়ে ছিলো যার ফলস্বরূপ দর্শিনীদের কাজ সহজ হয়ে গেছে। দর্শিনী তপ্ত শ্বাস ফেলে। হঠাৎ উঠোনে কারো প্রতিচ্ছবি দেখতে পেয়ে সে অবাক হয়। পরক্ষণেই মনে হয় এটাই মোক্ষম সময় তার অজানা প্রশ্নের উত্তর টা জানার।

যেমন ভাবনা তেমন কাজ। দর্শিনী ধীর পায়ে উঠোনে গিয়ে দাঁড়ায়। আকাশে আজও ভরা জোৎস্না। রাত হলেও সব কিছু পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে। দর্শিনী মানুষটার দিকে তাকিয়ে আহত কণ্ঠে বলে উঠে,
“বিপ্রতীপকে কল দেওয়ার কারণ জানতে পারি?”

#চলবে

#পথান্তরে_প্রিয়দর্শিনী
#মম_সাহা

পর্বঃ বিশ

জোৎস্না ভরা রজনী। বকুলের ঘ্রাণে আচ্ছাদিত পরিবেশ। দূর হতে ভেসে আসছে শেয়ালের ডাক। ঝিঁঝি পোকা সর্বোচ্চ চেষ্টা দিয়ে রাতের আঁধারকে হালকা করার চেষ্টা করছে। এ এক মধুময় রজনী। কিন্তু সবার জন্য সবকিছু মধুময় আদৌও হয়? যে মানুষের পুরো জীবন জুড়ে আঁধারে পরিপূর্ণ তার কাছে জোৎস্না রাত নেহাৎই বিলাসিতা ছাড়া কিছুই না। তার কাছে রাত মানেই কেবল বিষন্নতার হাহাকার,বিষাদের ছড়াছড়ি। এই জগৎ সংসারের সবটুকু রঙ তার কাছে ভীষণ ফিকে,অস্বচ্ছ। কোনো কিছুতেই তার কিছু যায় আসে না।

উঠোনের এক কোণায় বেতের মোড়া পেতে বসেছে দুই রমনী। তাদের মাঝে এক আকাশ নিশ্চুপতা। তারা হয়তো নিজেদের সময় দিচ্ছে। গুছিয়ে নিচ্ছে তাদের এলোমেলো বাক্য গুলো, সাথে কিছু অনুভূতি।

নিরবতা ঠেলে দর্শিনীই মুখ খুললো। দৃষ্টি নিবদ্ধ করলো মুক্ত আকাশে। কণ্ঠ তার কাঁপছে। তবুও সে কথা বলে উঠলো,
“আমি কী তোমাদের বোঝা হয়ে গিয়ে ছিলাম, বড় বৌদি? আমি আসার পর তুমি বিপ্রতীপকে কেন কল করেছিলে? ঘাড়ের বোঝা নামানোর জন্য?”

নিধির কণ্ঠস্বর কাঁপছে। তবুও নিজেকে ধাতস্থ করলো সে। নিচু হয়ে গেলো তার মাথা। কথা বলবে বলবে করেও কণ্ঠনালীতে এক অদৃশ্য বাঁধা অনুভব করলো। মস্তিষ্ক হয়তো ধিক্কার জানাচ্ছে তার ছোট কাজের জন্য। কিন্তু আদৌও সে এত ছোট কাজ করেছে? সে তো কেবল ননদের ভালোর জন্য একটা পদক্ষেপ নিতে চেয়েছিলো।

বড় বৌদিকে চুপ থাকতে দেখে দর্শিনীও নিষ্প্রাণ কণ্ঠে বলে উঠলো,
“যদি মায়া আমাকে কল না দিতো তবে জানতামই না আমার বড় বৌদি আমার অগোচরে আমার স্বামীর কাছে নতজানু হয়েছে। কেনো করেছো এসব বৌদি? স্বামী ছাড়া কী বেঁচে থাকা যায় না?”

এবার নিধি কথা বললো। ভেঙে ফেললো দ্বিধার দেয়াল। তার তো নিজেকে ছোট ভাবার কোনো কারণ নেই। কারো ভালো করতে গেলে মাঝে মাঝে একটু নতজানু হওয়া তো অন্যায় না। সে দর্শিনীর দিকে এবার দৃষ্টি নিবদ্ধ করলো। কেমন যেন একটা গম্ভীর কণ্ঠে বললো,
“স্বামী ছাড়া তুই হয়তো বেঁচে থাকবি কিন্তু আদৌও সুখে থাকতে পারবি, প্রিয়? তোর প্রথম দিনের বিধ্বস্ত রূপ দেখে আমার সহ্য হচ্ছিলো না। তাই সবার অগোচরে বিপ্রতীপকে কল করেছিলাম যেন সে তোর সুখ কেড়ে না নেয়। একটাবার তোকে যেন আগলে নেয়।”

“তা সে মিনসে তোমার কথা রাখলো বৌভাই? অপাত্রে কেনো কিছু দান করা উচিৎ না আর ভুল মানুষের কাছে ভুল আর্জি পেশ করাও উচিৎ না। তুমি কী ভেবেছো,বিপ্রতীপ তোমার কথা শুনে আমাকে নিতে আসতো? কখনোই না। আর তার সাথে থেকে গেলেই আমি ভালো থাকতাম? যদি সত্যিই এমনটা হতো তাহলে আমার চেয়ে খুশি আর কেউ হতো না। হাজারো কটুক্তি সহ্য করে নাহয় আরও কতগুলো যুগ তার সাথে কাটিয়ে দিতাম। কিন্তু না,যেই সুখের লোভে সেখানে থাকতাম সেই সুখই আমাকে কখনো ধরা দিতো না। বেঁচে তো এতদিনও ছিলাম বৌদিভাই কিন্তু মরার মতন বেঁচে থাকাকে কী সুখে থাকা বলে?”

নিধি চুপ করে থাকে। দর্শিনীর প্রত্যেকটা কথায় যুক্তি আছে। কিন্তু নিধিরও যে কিছু করার ছিলো না। তখন দর্শিনীর অবস্থা তার কাছে সহ্য হচ্ছিলো না। তাই তো সে কল করেছিলো ঐ মানুষকে। কিন্তু সে ছেলে আগাগোড়া পুরোটাই অ-মা-নু-ষ।

নিধি দর্শিনীর মুখটা দু’হাতে তুলে ধরে। ব্যাথিত কণ্ঠে বলে,
“তাহলে একবার সুখের সন্ধানে যা না প্রিয়। খুঁজে নে নিজের সুখটা। চোখ মেলে দেখ না, কে তোর সুখের দায়িত্ব নিতে চায়। আরেকটা বার বিশ্বাসের পাহাড় গড়ে তোল না মন মন্দিরে।”

“সে আর সম্ভব না যে বৌদিভাই। ভালোবাসা কী বার বার হয়? সে মানুষ নতুনে মত্ত হতে পেরেছে তাই বলে আমিও পারবো তেমনটা না। আমার কাছে রঙিন বসন্ত একবারই ধরা দিয়েছিলো। বার বার বসন্ত জীবনে আসে না গো বৌদিভাই। তবে তার আর আমার মাঝে পার্থক্য কি রইলো?”

নিধি কিছু বললো না। ছোট্ট শ্বাস ফেলা ছাড়া তার আর কিছু বলারও রইলো না। মাঝে মাঝে কারো বিষন্নতা দেখলে নিজেকে ক্লান্ত লাগে। মনে হয় ইশ, তার জন্য যদি কিছু করতে পারতাম! কিন্তু আফসোস,বাস্তবে তার জন্য কিছু করে উঠে হয় না আর। অতঃপর পৃথিবীতে নিজেকে ব্যর্থ ছাড়া আর কিছু ভাবা সম্ভব হয় না। নিধি এখন নিজেকে সেই ব্যর্থতার খাতাতেই দেখছে।

রাত আরেকটু গভীর হলো। দুই রমনীর মাঝে হাজার কথা থেকেও কিছু বলার মতন খুঁজে পেলো না। অতঃপর নিধি “তাড়াতাড়ি শুয়ে পড়িস” বলে চলে গেলো। দর্শিনী রয়ে গেলো একা। এমন করেই সবাই যার যার মতন চলে যায় জীবন থেকে। একটা সময় পর মানুষকে একা-ই বেঁচে থাকতে হয়।

দর্শিনী মুচকি হাসলো। নিজের গালে নিজে হাত ছুঁয়েই আনমনে বলে উঠলো,
“একা বাঁচতে শিখো, প্রিয়।”

নিজের করা কাজের কথা ভেবে নিজেই আবার হেসে উঠলো। দিনে দিনে কী সে পাগল হয়ে যাচ্ছে? তার তো পাগল হওয়ার কথা ছিলো না৷ তবে? জীবন কেনো তাকে এমন মোড়ে এনে দাঁড় করালো? ছয় সাত মাস আগেও জীবন টা অন্যরকম ছিলো। রাতটা তার এত বিদঘুটে ছিলো না। কিন্তু এক লহমায় যেন সব শেষ। একদম সবটা মিলিয়ে গেলো হাওয়ায়। আচ্ছা, এখন কী বিপ্রতীপ মায়াকে তার বুকের বা’পাশে নিয়ে ঘুমায়? এখনো কী চুমু না খেলে বিপ্রতীপের সকাল মিষ্টি হয় না? অফিস থেকে এসে ঘাম গুলো কার আঁচলে মুছে সে? মায়ার? না,না। সব ভাবনা গুলো এত যন্ত্রণাদায়ক কেনো? তার সংসারে আজ অন্য কারো বসবাস কেনো? নিয়তি তার বেলা এত নিষ্ঠুরতম কেনো? বিপ্রতীপের খাটের ডানপাশ আর বুকের বা’পাশ তো দর্শিনীর নামে ছিলো। তবে আজ কেনো সেথায় অন্য কারো রাজত্ব? কেনো দিশ শেষে মানুষ বদলে যায়? শুরু আর শেষে মানুষের অনুভূতির এত পার্থক্য কেনো হয়?

এসব প্রশ্নের উত্তর জানা নেই দর্শিনীর। সে কেবল জানে,সে জীবন যুদ্ধে একজন পরাজিত সৈনিক। যে প্রতিনিয়ত মরে যাওয়ার প্রার্থনা নিয়ে বেঁচে আছে। অনেকদিন পর বিপ্রতীপের ভাবনা স্মৃতির পাতায় আঁকিবুঁকি করছে। মানুষটা কেমন আছে? বেশ সুখে আছে বোধহয়। বিপ্রতীপদের সুখের জন্য প্রিয়দর্শিনীরা নাহয় খারাপ থাকবে। তবুও বেইমানরা ভালো থাকুক।

_

শহুরে জীবন মানেই যান্ত্রিক জীবন। কর্ম ব্যস্ততা থেকে তাদের মুক্তি নেই। রোবটের মতন অনুভূতি বিসর্জন দিয়ে চলতে হয় তাদের জীবনধারার স্রোতে গা ভাসিয়ে। দিনের আলো ফুটতে না ফুটতেই বাহিরে বের হয় আর রাতে আলো ঝিমিয়ে এলে বাড়ি ফিরে। এ যেন মুসাফির। নিরন্তর হেঁটে চলাই যেন তার কাজ!

মায়া রান্নাঘর থেকে টিফিনবক্স হাতে নিয়ে ড্রয়িং রুমে এসে উপস্থিত হয়েছে। খাবার টেবিলে তখন টুংটাং শব্দ তুলে খেয়ে যাচ্ছে নিলয় কুমার, বিপ্রতীপ আর মোহনা। কারো সাথে মনে হয় কারো কোনো সম্পর্ক নেই। কেমন বিচ্ছন্নতা ঘেরা সম্পর্ক।

মায়া বিপ্রতীপের দিকে টিফিনবক্সটা এগিয়ে দিলো। ছোট্ট কণ্ঠে বললো,
“আপনার খাবার।”

বিপ্রতীপ বা’হাতে বক্সটা নিয়ে পাশেই রাখলো। অতঃপর আবার খাওয়ায় মনযোগ দিলো। মোহনা আটার রুটিটার এক অংশ ছিঁড়ে দুধে ভিজাতে ভিজাতে মায়ার দিকে তাকিয়ে তীক্ষ্ণ কণ্ঠে বললো,
“বিয়ে হলো এক মাসের বেশি হয়ে গেছে। আশাকরি খুব দ্রুতই কোনো সুসংবাদ আমাদের দিবে। তাই না?”

“অবশ্যই, সুসংবাদ তো আছেই। বলতে ভুলে গেছিলাম।”

মায়ার কথায় উপস্থিত তিনজনের খাবার থেমে গেলো। বিপ্রতীপ ভ্রু কুঁচকে তাকালো মায়ার পানে। মায়া ঠিক কোন সুসংবাদের কথা বুঝালো!

মোহনার মুখটা খুশিতে চকচক করে উঠলো। অবশেষে সে বংশধরের মুখ দেখে যেতে পারবে। মোহনা গদোগদো হেসে বললো,
“সুসংবাদ আছে অথচ তুমি আমাদের বলো নি?”

“আসলে বলার সুযোগ পাই নি। কিছুদিন আগে আমার রেজাল্ট দিলো না? আমি ভালো একটা কলেজে চান্স পেয়েছি। দারুণ না সংবাদ টা?”

মায়ার কথায় মোহনার মুখের হাসি উবে গেলো। মুখটা থমথমে করে শব্দ করে উঠে গেলো সেখান থেকে। নিলয় কুমারও প্লেটে রুটিটা রেখে উঠে গেলো। আজকাল তার যে কোনো কিছুতেই মন বসে না। সংসার ছেড়ে সন্ন্যাসী হতে মন চায়।

মায়া মিটমিটিয়ে হাসে। মোহনাকে জব্দ করতে তার এত যে ভালো লাগে সেটা বলার বাহিরে। বিপ্রতীপ আগের ন্যায় খেতে খেতে বললো,
“তোমার সাথে বিয়ের পর এখনো আমি এক বিছানায় ঘুমাই নি। সুসংবাদ তো আসবে দূরের কথা। তাই না মায়া?”

মায়া হকচকিয়ে গেলো। বিপ্রতীপের ঠোঁটের কোণায় এখনো বিদ্রুপের হাসি বিদ্যমান। মায়া নিজের হাত কাচলাতে লাগলো। সে যেন ভাবতেই পারে নি বিপ্রতীপ তার চাল বুঝে যাবে।

_

সকাল হতেই নিধিদের বাড়িতে রান্নার ধুম। দৃষ্টান্ত আর মৃত্যুঞ্জয়ও বসে আছে তাদের উঠানে। তৃণা আর দর্শিনীকে ক্যাম্পিং এর জন্য নিতে এসেছিলো কিন্তু সবাই সকালের নাস্তার জন্য জোড়াজুড়ি শুরু করায় বাধ্য হয়ে থেকে যেতে হলো তাদের।

দর্শিনী মাত্র চুলাতে দুধ বসিয়ে ছিলো ধৃষ্টের জন্য। হঠাৎ করেই দুধের গন্ধ নাকে যেতেই তার পেট মোচড় দিয়ে উঠলো। হুড়মুড় করে ছুটে উঠোনের এক কোণায় বমিতে ভাসিয়ে দিলো। রীতিমতো ততক্ষণে সবাই তাকে ঘিরে দাঁড়িয়ে পড়েছে। সবাই যেন বিষ্মিত। দুধের ঘ্রাণে বমি করার মতন যুক্তি তাদের বোধগম্য হলো না। একবারেই যে বোধগম্য হলো না তেমনটা না। কিন্তু তারা নিজেদের ভাবনাকে প্রশ্রয় দিতে চাইলো না।

দর্শিনী ততক্ষণে বমি করে ক্লান্ত প্রায়। তৃণা ছুটে জল এনে দর্শিনীর মুখ চোখ ধুয়ে দিলো। দর্শিনী ক্লান্ত শরীরে ভার ছেড়ে দিলো তৃণার উপর। ততক্ষণে বাড়ির সবার বিষ্ময় দৃষ্টি তার চোখে পড়লো। না,এবার বোধহয় আর সব লুকানো সম্ভব নয়। অতঃপর নিজের গলার ঘামটা কাপড়ের আঁচল দিয়ে মুছে বাবার দিকে তাকিয়ে সে অবশ কন্ঠে বললো,
“বাবা,আমার ঘরে নতুন অতিথি আসতে চলেছে।”

#চলবে….

#পথান্তরে_প্রিয়দর্শিনী
#মম_সাহা

পর্বঃ একুশ

আষাঢ়ের ঝিমিয়ে আসা সকাল জানান দিচ্ছে প্রকৃতি আঁধার করে ঝড় আসছে। চারদিক কাঁপিয়ে দিয়েছে বায়ু প্রবাহ। বড় বড় গাছপালা গুলোও বাতাসের তান্ডবে টিকতে না পেরে উত্তর দিকে হেলে যাচ্ছে। টিনের চালে শব্দ করে পাঁকা আম গুলো বাতাসে ঝড়ে পড়ছে। ফসলি খোলা জমিটাতে ছোট ছোট বাচ্চারা লাফাচ্ছে। তাদের শিশু মনে তুমুল বৃষ্টিতে ভেজার আকাঙ্খা জেগে উঠেছে। তাদের হাসি সেই আকাঙ্খার বহিঃপ্রকাশ। গোয়াল ঘর থেকে শব্দ করে গরু গুলো ডাকছে। খামার থেকে সাদা মুরগী গুলোর বিশৃঙ্খলা যুক্ত চিৎকার ভেসে আসছে। তারা হয়তো ঘনিয়ে আসা প্রকৃতির ভয়ঙ্কর তান্ডবের কথা ভেবে ভয় পাচ্ছে। গাছের শুকনো পাতা জমিনে লুটাচ্ছে। এ যেন প্রকৃতি অশান্ত রূপের বহিঃপ্রকাশ। গ্রামের বাড়ির চারদিক থেকে চিৎকার চেঁচামেচি ভেসে আসছে। কেউ জোড়ে জোড়ে “আল্লাহু আকবর” বলছে। কেউবা আজান দিচ্ছে। কারো কারো বাড়ির মন্দির থেকে তুমুল শঙ্খধ্বনির শব্দ ভেসে আসছে সাথে উলুধ্বনি ও ঘন্টার শব্দ। প্রকৃতির অশান্ত রূপ দেখে গ্রামবাসীরা ভয়ার্ত। বার বার টেলিভিশন থেকে ভেসে আসছে বিপদ সংকেত। এলাকাতেও মাইকিং করে চার নাম্বার বিপদ সংকেতের আভাস দেওয়া হয়েছে। কিন্তু এসব কিছুই দর্শিনীদের উঠোনো দাঁড়িয়ে থাকা মানুষ গুলোর কর্ণকুহরে পৌঁছাচ্ছে না। কারণ প্রকৃতিতে ঝড় আসার আগেই তাদের হৃদয়ে চলছে অনাকাঙ্খিত তান্ডব। বর্তমানের সবার উৎসুক, বিষ্মিত দৃষ্টি দর্শিনীর উপর নিবদ্ধ। দর্শিনী মাথা নিচু করে মোড়ায় বসে আছে। তার পাশে তার বাবা বসা। এছাড়া সবাই দাঁড়ানো। দর্শিনীর একটা কথা’ই যথেষ্ট ছিলো সবার ভাষা কেড়ে নিতে।

অনেকক্ষণ পর প্রতাপ সাহা কুড়িয়ে পেলেন শব্দ। গুছিয়ে নিলেন বাক্য। নিস্তব্ধতাকে কাঁপিয়ে দিয়ে গম্ভীর কণ্ঠে বললেন,
“এ কথা তুমি আগে কেনো বলোনি, মা? আমাদের কী জানার অধিকার ছিলো না এটা আগে?”

দর্শিনী নিজের দু’হাতের আঁজলে মুখ লুকিয়ে আছে। ক্ষণে ক্ষণে কেঁপে উঠছে তার শরীর। এক বিরহী, করুণ ক্রন্দনরত সুর জানান দিচ্ছে দর্শিনী কাঁদছে। কাঁদতে কাঁদতে রীতিমতো তার হেঁচকি উঠে গেছে। কেউ থামাচ্ছে না, কেউ বারণ করছে না। সবার নিরবতা দেখে দর্শিনীর কান্নার দাপট আরও বেড়েছে। বার বার তার মনে হচ্ছে,আজকেই এ বাড়িতে তার শেষ দিন। হয়তো মাথা গোঁজার যে ঠাঁই সে পেয়েছিলো তার গর্ভে ভূমিষ্ট হওয়া শিশুটার জন্য সে আশ্রয়স্থল সে হারাবে।

এই নিরবতা সবার কাছেই বিষাক্ত ঠেকছে। কারও মুখে কোনো রা নেই। উপস্থিত কেউ কেউ কথা বলতে চাচ্ছে কিন্তু কোথাও এক অদৃশ্য বাঁধার জন্য তারা তাদের অব্যক্ত অনুভূতি গুলো প্রকাশ করতে পারছে না। কি শ্বাসরুদ্ধকর অবস্থা!

অবশেষে ভেসে এলো এক মহিলা কণ্ঠ। কণ্ঠের অধিকারিণী হলো এ বাড়ির কর্তী, নিধির মা- রমলা। তরতাজা, স্বাস্থ্যবান মহিলা। কপালে মোটা করে সিঁদুর দিয়ে ফোঁটা দেওয়া। লাল পেড়ে সাদা শাড়ি পড়া। চকচকে লাল রাঙা ব্লাউজ তার শরীরে। চুল গুলো এই মোটা খোপা করা। বয়সের কারণে দু একটা সাদা চুল অবশ্য দেখা যাচ্ছে। পান খেয়ে লাল হয়ে থাকা টকটকে ঠোঁট। চোখ-নাক কেমন ভাসা ভাসা। সৃষ্টিকর্তা যেন পরম মমতায় সৃষ্টি করেছেন এ নারীকে। এ বয়সেই সে পুরুষ জাতীর নজর কাড়তে ব্যস্ত তাহলে যৌবন কালে সে কেমন ছিলো তা নির্দ্বিধায় ধারণা করা যায়। ভারী শরীর নিয়ে মহিলা রান্নাঘরের দাওয়া থেকে উঠোনে পা রাখলেন। একমাত্র উপস্থিত এ মহিলার মুখেই কোনো বিষ্ময়,উৎসুকভাব ছিলো না।

মহিলা এগিয়ে দর্শিনীর সামনা-সামনি এসে দাঁড়ালেন। তারপর আশেপাশে সবার দিকে তাকিয়ে তার কনিষ্ঠা আঙ্গুলের চুন টুকু মোটা জারুল গাছের বাকলে মুছে ফেললেন। পানটা দু একটা চাবান দিয়ে দর্শিনীর দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ করলেন। গম্ভীর কিন্তু শান্ত কণ্ঠে বললেন,
“কত মাস চলছে? চার সাড়ে চার তো হবেই মনে হচ্ছে।”

ভদ্রমহিলার কথার ধরণে সবাই তো অবাক হয়েছে সাথে দর্শিনীও কম অবাক হয় নি। সত্যিই তার সাড়ে চারমাস চলছে। কিন্তু উনি জানলেন কীভাবে?

সবার দৃষ্টির মানে বুঝে গেলেন বুদ্ধিমতী রমলা। খুব শীতলতা বজায় রেখেই বললেন,
“কী দর্শিনী, এমন প্রশ্নে অবাক হলে নাকি?”

দর্শিনী মাথা নাড়ালো, যার অর্থ সে অবাক হয়েছে। পরক্ষণেই দর্শিনী ক্ষীণ স্বরে বললো,
“আপনি কীভাবে সঠিক আন্দাজ করলেন মাসিমা?”

“আমি কীভাবে সঠিক আন্দাজ করেছি সেটা ভাবনার বিষয় না দর্শিনী। এমনকি এটা অবাক হওয়ারও বিষয় না। অবাক হওয়ার বিষয় এখানে বাকি মেয়ে মানুষ গুলা কীভাবে এতদিন তোমাকে দেখেও সেটা বুঝতে পারে নি। ব্যাটাছেলেদের কথা না-হয় বাদই দিলাম কিন্তু মেয়ে মানুষ এমন চোখের মাথা খায় কীভাবে তা ভাববার বিষয়। স্বভাবতই তুমি চিকন, ছিমছাম গড়নের মেয়ে। তাই তোমার পেট তত ফুলে নি কিন্তু শাড়ির উপর দিয়ে পেট ভালো বোঝা যায়। আর সাথে তোমার শরীরে গঠনও বদলিয়েছে। আগের মতন শুকনো লাগে না বরং গাল মুখ ভরা ভরা লাগে। স্বাভাবিক ভাবে গর্ভাবস্থায় এমন পরিবর্তন আসে। তাছাড়া আমরা আগের কার মেয়ে মানুষ, এই হাতে কত পোয়াতির চিকিৎসা করেছি। স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ছিলাম কিনা। কিন্তু তোমার পাশের তৃণা তারপর তোমার আরও দুই ডাক্তারও কীভাবে বুঝলো না! কী পাশ করে এরা ডাক্তার হয়েছে? আর তোমার মা, মানে বেয়াইন মেয়ের পরিবর্তন ধরতে পারলো না কেনো? অদ্ভুত!”

রমলার কাঠ কাঠ জবাবে নিরুত্তর দর্শিনীর মা। এবার নিপা মুখ খুললো। সন্দিহান কণ্ঠে বললো,
“আমার তো আগেই সন্দেহ হয়েছিল কিন্তু বলি নি। আমি কিছু বললে তো দোষ হয়ে যায়। তা মা, আপনি কিছু বুঝেন নি?”

সরলা এক ধ্যানে মেয়ের দিকে তাকিয়ে রইলো। কারো কোনো উত্তর দিলো না। কেবল মেয়ের দিকে তাকিয়ে যান্ত্রিক কন্ঠে বললেন,
“জামাই জানে না, তাই না দর্শিনী?”

দর্শিনীর হৃদপিণ্ড ছলাৎ করে উঠলো। সে মনে মনে হাজার বার চেয়েছিলো বিপ্রতীপের কথা যেন এখানে না উঠে। কিন্তু তার মা বরাবরই যেন তার বিপরীতে যেতে পছন্দ করেন। সেটাই আরেকবার প্রমাণ হলো।

“জামাইয়ের কথা এখানে কোনো তুলছো, সরলা? তুমি যা ভাবছো তা মাথা থেকে বের করে দেও। ও ছেলে এটা জানুক আর না জানুক আমার মেয়ে সেই নরকে পা দিবে না।”

প্রতাপের ভারিক্কি কথাতেও হেলদোল হলো না সরলার। বরং কণ্ঠের কাঠিন্যতা আরেকটু বাড়িয়ে বললো,
“তুই জামাইকে এটা জানাস নি তাই না? জানালে আমি নিশ্চিত যে এমন অঘটন ঘটতো না। তুই ইচ্ছে করে বিয়েটা ভেঙেছিস তাই না?”

দর্শিনী মাথা নিচু করে রাখলো। সব জিনিসের বিপরীত দিক বের করা যেন মা আর নিপা বৌদির বিশ্রী স্বভাব।

মৃত্যুঞ্জয় এতক্ষণ কেবল সবটা দেখেই গেলো। কিছু ক্ষণের জন্য তার মনে হয়েছিলো তার হাত-পা অবশ হয়ে গিয়েছিলো। অনেকটা সময় নিয়ে নিজেকে সে সামলালো। সে দর্শিনীকে ভালোবাসে, দর্শিনীর ভালো খারাপ সবটা নিয়েই সে তাকে ভালোবাসবেই। তাহলে সামান্য কারণে এমন দমে যাওয়ার তো কোনো কারণ নেই। দৃষ্টান্ত মৃত্যুঞ্জয়ের কাঁধে হাত রেখে আশ্বাস দিলো।

দর্শিনীর মা তার দিকে এগিয়ে আসতে নিলেই দর্শিনীর সামনে ঢাল হয়ে দাঁড়ায় মৃত্যুঞ্জয়। দর্শিনী রীতিমতো বিষ্মিত। হচ্ছেটা কী তার সাথে! দর্শিনীর ভাবনার মাঝেই মৃত্যুঞ্জয়ের দাঁত কিড়মিড় করা কথা ভেসে এলো,
“একদম প্রিয়দর্শিনীর শরীরে হাত দিবেন না কাকিমা। ও ছোট্ট নেই। অন্তত ওর ভিতরের প্রাণটার কথা ভেবেও এ ভুল করতে যাবেন না, কেমন? মা হয়ে আশ্রয়স্থল হোন, সেটা না পারলে হাত গুটিয়ে রাখুন কিন্তু তবুও ক্ষতির কারণ হবেন না।”

উপস্থিত সবাই বিষ্মিত। সরলা আগের জায়গায় দাঁড়িয়ে আছে। পা তার আর চলছে না। কেবল একজনের চোখ হাসছে। সে চিন্তামুক্ত একটা শ্বাস ফেললো এটা ভেবে যে তার মেয়ের আরেকটা আশ্রয়স্থল তবে তৈরী হয়ে গিয়েছে। এবার বোধহয় অংকটা মিলবে।

দর্শিনীর বুক কাঁপলো। ঝড়ের বাতাস ছুঁয়ে দিলো তার শরীর। মনের মাঝে ভর করলো শীতলতা। হঠাৎ করেই তার ভালো লাগা শুরু করলো। এমনটা তো কখনো হয়নি। তবে কী বিপ্রতীপের করা কর্মকান্ড দর্শিনীর হৃদয় থেকে মুছে দেওয়ার জন্য নতুনের আবির্ভাব!

ভাবনার মাঝেই প্রকৃতি গর্জন করে উঠলো। বাহির থেকে মাইকিং এর শব্দ ভেসে এলো। মাইকিং করা লোকটা ভয়ার্ত কণ্ঠে সাবধান করছে, পাশের এলাকার বাঁধ ভেঙে গিয়েছে। বন্যা হওয়ার সম্ভাবনা। সবাই যেন সাবধানে থাকে।

#চলবে