পথান্তরে প্রিয়দর্শিনী পর্ব-২২+২৩+২৪

0
200

#পথান্তরে প্রিয়দর্শিনী
#মম_সাহা
#পর্ব-২২+২৩+২৪

অবাক জোছনায় ভরা রজনী। ক্যানভাসের মতন যেন রং-তুলিতে এঁকেছে রাত। টানা সপ্তাহখানেক বর্ষণের পর আজ প্রকৃতি ক্লান্ত,পরিশ্রান্ত। পৃথিবীতে ঢেলে দেওয়ার জন্য যেন এ বিশাল আকাশের বুকে কোনো জলবিন্দু অবশিষ্ট নেই। তাই সে বিশাল বর্ষণের পর ছুটি নিয়ে জোৎস্না ভরা রাত্রি উপহার দিয়েছে ধরণীর বুকে।

জায়গাটা ঠিক সিলেটের জাফলং। প্রকৃতির কন্যা বলা হয় যাকে। কী তার যৌবনা! সৌন্দর্যতা! তাকে দেখলে মনে হয় যেন কোনো অষ্টাদশীর হাসি। মনে হয় স্বপ্নের কোণে যত্নে গড়া বিলাসিতার প্রাচুর্য। বড় বড় পাহাড় ভেদ করে যখন অবাক জোৎস্না ছড়ায় চাঁদ, তখন মনেহয় সৃষ্টিকর্তা বড় যত্ন করে গড়িয়াছে এ প্রকৃতি। তবে প্রকৃতির কন্যা আজ বিধ্বস্ত, বন্যায় ভেসে গেছে তার অর্ধেক প্রাচুর্য। কী যে মূমুর্ষ অবস্থা তার! তার কোলে বেঁচে থাকা প্রাণ গুলো আজ বাস ভূমি হারা, হাহাকার মিশে গেছে বিশাল পাহাড়ের কানায় কানায়। তাদের একটু সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিতেই পুরো দেশের জায়গা জায়গা থেকে ছুটে আসছে মানুষ। কেউ খাদ্য, কেউ বস্ত্র,কেউ চিকিৎসার হাত বাড়িয়ে দিচ্ছে। সে বাড়িয়ে দেওয়া হাত গুলোর মাঝে দর্শিনী, দৃষ্টান্ত,তৃণা,মৃত্যুঞ্জয়, বিহঙ্গিনী সহ আরও কত যুবক যুবতীর হাত আছে। যারা এ প্রাণ গুলোকে দিতে চাচ্ছে নিরাপত্তা।

জাফলং জিরো পয়েন্টে বন্যা হওয়াতে দর্শিনীরা ক্যাম্পিং করেছে এখানে। বিগত পাঁচদিন যাবত তারা এখানেই আছে। অক্লান্ত পরিশ্রম দিয়ে গেছে বন্যায় ভুক্তভোগী মানুষের পিছে। পরিস্থিতি কিছুটা এখন হাতের মুঠোয়।

ঘড়ি কাটায় সময় এখন তিনটা পনেরো। দর্শিনী দাঁড়িয়ে আছে তাদের তাবুর বাহিরে। তাবুর পূর্ব দিকে বিশাল ঝর্ণা। অনবরত জল গড়িয়ে পড়ছে সেদিক থেকে। দর্শিনীর দৃষ্টি সেখানেই নিবদ্ধ। মনের মাঝে তার বিশাল দ্বন্দ্ব। সেদিন বাচ্চাটার কথা শোনার পর কেউ বিপরীত প্রতিক্রিয়া দেয় নি বরং তার আদর যত্ন একটু বেড়েছে। তবে মা আর নিপা বৌদি কেমন থম মেরে আছে। এটা অবশ্য জানা কথা যে মা আর বৌদি এমন কিছুই করবে। দর্শিনী তো ভেবে ছিলো এর চেয়ে বেশি কিছুই করবে। কিন্তু না,তেমন কিছুই হয় নি। এর জন্য সে সৃষ্টিকর্তার কাছে কৃতজ্ঞতা স্বীকার করেছে হাজার বার।

“ঘুমান নি কেনো, প্রিয়দর্শিনী? এত রাত অব্দি জেগে আছেন যে?”

রাতের নিস্তব্ধতা ভেদ করে গম্ভীর পুরুষালী কণ্ঠটা ঝংকার তুললো যেন প্রকৃতিতে। সামান্য কেঁপে উঠলো রমনী। ভাবনায় ব্যস্ত থাকা অক্ষি গুলোর কোণায় চিকচিক করা অশ্রুবিন্দু গুলোকে বার কয়েক চোখের পাপড়ি ঝাপটিয়ে নিরুদ্দেশ করে দেওয়ার চেষ্টা চালালো। অতঃপর পিছনে ঘুরে দৃষ্টি দিলো সুঠাম দেহী পুরুষটার দিকে। ছেলেটার বয়স ত্রিশ-বত্রিশ হবে নির্দ্বিধায়। কিন্তু চোখ মুখে এখনো যেন চব্বিশের লাবণ্যতা। মুখমন্ডলে ফুটে আছে ভিনদেশী ভাব। শরীরে রং একটু বেশিই সুন্দর। যেন এই আঁধার রাতেও দীপ্ত দিছে কেমন অবলীলায়।

দর্শিনীকে চুপ থাকতে দেখে মৃত্যঞ্জয় এগিয়ে এলো আরও দু’কদম। কণ্ঠের গাম্ভীর্যতা আরেকটু বাড়িয়ে বললো,
“এত বাতাসের মাঝে এখানে এমন দাঁড়িয়ে আছেন কেনো? আর রাত কত হয়েছে সে খেয়াল আছে? নাকি দেবদাসী হয়ে ঘোরা ছাড়া কোনো খেয়ালই আপনার মাথায় থাকে না?”

মৃত্যুঞ্জয়ের কথায় দর্শিনী ক্ষাণিকটা ভ্রু কুঁচকালো। সন্দিহান কণ্ঠে বললো,
“আমি দেবদাসী হয়ে কখন ঘুরলাম?”

“এখন সেটাও আমাকে বলে দিতে হবে? আপনার চাল-চলন হাবভাবে এখনও দেবদাসীর ছোঁয়া। কেনো? একটু হাসতে পারেন না নাকি? অদ্ভুত!”

“আজকাল দেখছি আপনার মুখেও বেশ কথা ফুটেছে! আগে তো ভাবতাম আপনি তত কথা বলতে জানেন না।”

মৃত্যুঞ্জয় গম্ভীরমুখে কিছু বলতে গিয়েও দর্শিনীর কথায় হেসে উঠেছে। অনবরত গড়িয়ে পড়তে থাকা ঝর্ণার স্বচ্ছ, সুন্দর জলের দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ করে বললো,
“আগে আমার কথা আপনার শোনার প্রয়োজন মনে হতো না, আমি বললেও আপনি হয়তো এখনের মতন মনযোগ দিয়ে শুনতেন না, তাই বলি নি।”

মৃত্যুঞ্জয়ের এমন উত্তরে দর্শিনীর যেন ভাষা কেড়ে নিলো। সে অবাকের সপ্তম পর্যায়ে উঠে বিষ্মিত কণ্ঠে বললো,
“তার মানে আমার মুডের উপর ডিপেন্ড করে আপনার শব্দকণিকারা বাক্য বুনে? বাহ্! ইন্টারেস্টিং।”

“আপনার কাছে ইন্টারেস্টিং হতে পেরে আমার হৃদয়ও পিঞ্জিরা ছলাৎ করে উঠলো। আমি ধন্য যে, মেডাম।”

দর্শিনী খিলখিল করে হেসে উঠলো। হাসির সাথে দোল খেলো যেন শক্ত পাহাড়ের কোণ থেকে শুরু করে সুঠাম দেহী মানবের বক্ষ। এই বিধ্বস্ত জাফলংও যেন রঙিন হলো।

_

“এটা কী চাঁদ দেখানোর সময়,তৃণা?”

ঘুমঘুম বিরক্ত স্বরে প্রশ্ন ছুঁড়লো দৃষ্টান্ত। তৃণা দৃষ্টান্তের বাহু আঁকড়ে ধরে মিষ্টি হেসে বললো,
“হ্যাঁ, এখনই চাঁদ দেখার সময় দৃষ্টান্ত দা। দিনের বেলা তো আর চাঁদ থাকে না, চাঁদ তো রাতের বেলাতেই পাওয়া যায় তাই না? আর তাছাড়া আজ কতগুলো দিন পর চাঁদ উঠেছে,সে খেয়াল আছে তোমার? একটু দেখো না, চোখের কোণা থেকে কেমন করে জোৎস্না গড়িয়ে পড়ে।”

তৃণার আকুতি মাখা কণ্ঠে ঘুম ছুটে দৃষ্টান্তের। তৃণার গালে ঠোঁট ছুঁইয়ে নরম কণ্ঠে বলে,
“আমার হৃদয় আঙিনায় তো রোজ নিয়ম করে তৃণা নামক চন্দ্রিমা জোৎস্না ছড়ায়। সে জোৎস্নার কাছে এ জোৎস্না যে কিছুই না মোর, তৃণশয্যা।”

তৃণা লজ্জা পায়, আরেকটু গুটিয়ে যায় দৃষ্টান্তের বক্ষ মাঝে। চাঁদ তার জোৎস্নার রঙ আরেকটু বাড়িয়ে দেয় কপোত-কপোতীদের মিষ্টি প্রেম দেখে। তৃণা মৃদু হাসে, অন্তরের অন্তঃস্থল থেকে বিশাল ধন্যবাদ দেয় এক নারীকে। সে মানবী অবুঝ হয়েছিলো বলেই হয়তো আজ দৃষ্টান্ত তার।

_

মায়া কলেজ যাওয়ার জন্য তৈরী হচ্ছে। গত সপ্তাহেই সে এখানের একটা বেশ খ্যাতনামা কলেজে ভর্তি হয়েছে। বিপ্রতীপ নিজে গিয়ে ভর্তি করিয়ে দিয়ে এসেছে। বাড়িটা কেমন যেন মৃত্যুপুরীর মতন ঠেকছে মায়ার কাছে। কেমন নিস্তব্ধতা ঘেরা। মোহনা মাঝে মাঝে হুংকার না দিলে বোঝা’ই যায় না বাড়িটাতে মানুষজন যে বাস করে। কেমন অদ্ভুত বাড়ি!

বিপ্রতীপ গলার টাই বাঁধতে ব্যস্ত। সেও একটু পর অফিসের জন্য বের হবে। মায়াও নিজেকে পরিপাটি করে নিচ্ছে কলেজ যাওয়ার জন্য। কিন্তু চুল বাঁধতে গিয়ে বাঁধলো বিপত্তি। গতকাল ভাঙা কাচের গ্লাসের টুকরো উঠাতে গিয়ে তার ডান হাত বিশ্রী ভাবে কেটে গিয়েছে। এখন সে হাতে জোর দিয়ে মাথায় চিড়ুনি চালান করতে পারছে না।

মায়া কতক্ষণ চেষ্টা করে অবশেষে হতাশার শ্বাস ফেললো। নাহ্,তার দ্বারা এ কাজ সম্ভব না। মন খারাপ করে যেই চিড়ুনিটা ড্রেসিং টেবিলের উপর রাখতে যাবে তখনই বিপ্রতীপ মায়ার কাছ থেকে চিড়ুনিটা নিয়ে নেয়। মায়া অবাক হয়ে যায়। মায়াকে আরও এক ধাপ অবাক করে দিয়ে বিপ্রতীপ নিজের হাতের চিড়ুনিটা মায়ার মাথায় চালান করে। খুব ধীরে,যত্নে গুছিয়ে দেয় মায়ার এলোমেলো চুল। মায়ার যেন বাকশক্তি হারিয়ে ফেলার উপক্রম। সে বিষ্ময়ে চোখ বড় করে তাকিয়ে আছে। আজকাল বিপ্রতীপের ব্যবহার তার কাছে অদ্ভুত লাগে। কেমন যেন মাঝে মাঝে ঘোর লেগে যায়। মাঝে মাঝে মনে হয় এ লোকটার মোহে পড়ে যাচ্ছে সে। এ কেমন অনুভূতি! এমন অনুভূতির কারণই বা কী!

মায়া সামলে নেয় নিজেকে। যতটা সম্ভব নিজেকে ধাতস্থ করে ধীর কণ্ঠে শুধায়,
“ছোট দি’র কোনে খোঁজ পেলেন? কোথায় আছে সে?”

“সামান্য একটা পুচকির খোঁজ পাবো না আমি? সে যেখানে আছে, ভালোই আছে।”

মায়ার চুলের দিকে তাকিয়েই বিপ্রতীপের সহজসরল স্বীকারোক্তি। মায়া আবারও অবাক হলো। যে বিপ্রতীপকে সে দেখে এ বাড়িতে পা রেখেছিলো, সে বিপ্রতীপ আর এ বিপ্রতীপের মাঝে আজ বিশাল তফাৎ। এতটা বদল কেনো? মায়াকেও প্রিয়দর্শিনীর মতন বশে আনার চেষ্টা’ই কি এটা? মায়া নিজেকে শীতল রেখে তীক্ষ্ণ স্বরে আবার প্রশ্ন ছুঁড়লো,
“ছোট দি’র খবর জানেন,অথচ তাকে বাসায় আনছেন না। কেমন অদ্ভুত না ব্যাপার টা?”

বিপ্রতীপ হাসে। মায়ার চুলে খুব সুন্দর ভাবে বেনী করে দিয়ে নিঃশব্দে চিড়ুনিটা ড্রেসিং টেবিলের উপর রাখে। ধীর গলায় বলে,
“যে যেভাবে খুশি থাকে,তাকে সেভাবে খুশি থাকতে দেওয়া উচিত।”

“ওহ্ আচ্ছা! তাহলে সইয়ের খুশির সময় এ কথা খানা কোথায় ছিলো?”

“মায়ার মোহে আটকে ছিলো।”

মায়ার তাচ্ছিল্য মাখা প্রশ্নে বিপ্রতীপের আবার নিবিড় জবাব। জবাব দিয়ে অবশ্য এক সেকেন্ডও দাঁড়ায় না বিপ্রতীপ। ধীর পায়ে ঘর থেকে বেরিয়ে যায়। মায়া হা হয়ে তাকিয়ে রইলো। এ কেমন বেড়াজালে আটকাচ্ছে সে? তবে তার সমাপ্তিও কী দর্শিনীর মতন!

_

বিছাকান্দির বড় সড়ক পথে দাঁড়িয়ে আছে কত গুলো যুবক-যুবতী। মোটামুটি সবার হাতেই এপ্রন। দুপুরের কড়া তীর্যক রশ্মি খাড়াখাড়ি ভাবে পড়ছে তাদের উপর। একেকটা মানুষের মুখ গুলো কেমন শুকিয়ে লাল হয়ে আছে গরমে। কে বলবে, গতকয়েকদিন অব্দি এখানে তুমুল বর্ষণ ছিলো! রোদের তেজে যেন বন্যার, বর্ষণের আমাজে থিতিয়ে পড়েছে।

দর্শিনী নিজের শাড়ির আঁচল দিয়ে মুখের বিন্দু বিন্দু ঘাম টুকু মুছে ফেললো। আরও দশ পনেরো মিনিটের মতন হেঁটে গেলেই তারা তাদের গন্তব্যে পৌঁছাবে। জলের তৃষ্ণায় দর্শিনীর মুখটা শুকিয়ে ছোট হয়ে গেছে। বিহঙ্গিনী,তৃণা,দর্শিনী পাশাপাশি হাঁটছে। টুকটাক কথাও বলছে। হঠাৎ কিছু বুঝে উঠার আগেই বিহঙ্গিনী চিৎকার দিয়ে কেঁদে উঠে। কাঁদতে কাঁদতে দৌড়ে চলে যায় রাস্তার অপরপাশে। হন্ন হয়ে কী যেন খুঁজতে শুরু করে দেয়। রাস্তার এপাশের মানুষ গুলো কেবল অবাক চোখে সে দৃশ্য দেখে যায়।

#চলবে

#পথান্তরে_প্রিয়দর্শিনী
#মম_সাহা

পর্বঃ তেইশ

বড় ফ্লাইওভারের কিনারে চিন্তিত মুখ নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে সবাই। সবার মুখের আদলে একটাই প্রশ্ন,”বিহঙ্গিনী এমন অদ্ভুত ভাবে দৌড় দিলো কেনো?” বিহঙ্গিনীকে ঘিরেই দাঁড়িয়ে আছে সবাই। বিহঙ্গিনীর দৃষ্টি স্থির। মুখে থমথমে ভাব বিরাজিত। দর্শিনী তার হাতের জলের বোতলটা এগিয়ে দিলো বিহঙ্গিনীর কাছে। ধীর,নম্র,শীতল কণ্ঠে বললো,
“আগে জলটুকু খা,বিহু। তারপর নাহয় বাকি কথা বলা যাবে?”

বিহঙ্গিনীর চোখের পাতা পিটপিট করে নড়লো। কোনো বাক্যব্যয় না করেই জলের বোতলটা নিয়ে ঢকঢক করে অনেকখানি জল খেয়ে নিলো। সে যেন এতক্ষণ এই জলের অপেক্ষাতেই ছিলো। অতঃপর বোতলের মুখটা লাগাতে লাগাতে ধীর কণ্ঠে বললো,
“দুঃখীত, সবাইকে এত বিচলিত করে তোলার জন্য। হুট করে আমার এমন ছুটে যাওয়া উচিত হয় নি। আ’ম এক্সট্রিমলি সরি।”

বিহঙ্গিনীর কথার বিপরীতে দর্শিনী তার শাড়ির আঁচল দিয়ে ঘামে চুপচুপে হয়ে যাওয়া বিহঙ্গিনীর লাল মুখ খানা মুছে দিলো পরম যত্নে। আদুরে কণ্ঠে বললো,
“ছুটে গিয়েছিলি কেনো,বিহু? কী দেখেছিলি?”

বিহঙ্গিনী ক্ষানিকটা চমকালো। অতঃপর আমতা-আমতা করে বললো,
“আমি ভেবেছিলাম আমার পরিচিত একজনকে দেখেছি, তাই ছুটে গেছিলাম। কিন্তু কেউ তো ছিলো না। আমার চোখের ভ্রান্তি হয়তো সেটা।”

“পরিচিতকে দেখে গগন কাঁপানো চিৎকার দিয়ে কান্নার সাইন্স টা বুঝলাম না, ম্যাডাম?”

দৃষ্টান্তের খোঁচা মারা কথায় হেসে উঠলো সবাই। কেবল বিহঙ্গিনীর মুখে ঘন আঁধার করে মেঘ জমলো। ঠাট্টাটা যে সে ঠিক হজম করতে পারে নি সেটারই বহিঃপ্রকাশ ঘটালো যেন মুখমন্ডলটা। দর্শিনী হয়তো আঁচ করতে পারলো সে মন খারাপ। তাই সবার দিকে তাকিয়ে গমগমে স্বরে বললো,
“হাসাহাসি হয়ে গেলে এবার গন্তব্যে রওনা হওয়া যাক? অনেক কাজ বাকি, তাই না?”

সবাই সায় জানালো দর্শিনীর কথায়। হাঁটা ধরলো গন্তব্যে। দর্শিনী ধীরে বিহঙ্গিনীকে উঠিয়ে খুব যত্নে আগলে ধরলো তার হাত খানা। যেন বিহঙ্গিনীর হঠাৎ চলে আসা মন খারাপের মেঘকে সে মুছে দিবে। বিহঙ্গিনী হাসলো। মেয়েটা এখনো এতটা ভাবে সবাইকে নিয়ে! অথচ মেয়েটারই কপাল পুড়া।

মৃত্যুঞ্জয় আরেকটু মুগ্ধ হয়। প্রতিনিয়ত সে এই নারীর প্রতি মুগ্ধ হচ্ছে। প্রাক্তন স্বামীর বোনকে এতটা নিঃস্বার্থ ভাবে আগলে নিতে ক’জনেই পারবে?

বিহঙ্গিনীর মাথায় কেবল একটা ভাবনাই ঘুরছে। তার চোখ কী তবে ভুল দেখলো? এতটা নিখুঁত ভুল কীভাবে দেখলো? নাকি তার মনের ভ্রান্তি ছিলো? এতবছর পর মানুষটাকে দেখতে পাওয়াটা কেমন যেন ভ্রমের মতন লাগছে। তাকে দ্রুত বাড়ি ফিরতে হবে। রহস্য তো সব ঐ বাড়ি থেকে উৎপাদিত। ঐ বাড়িতে গিয়েই রহস্যের সমাধান পাবে সে নিশ্চয়।

বিহঙ্গিনীকে ভাবনায় বিভোর থাকতে দেখে ভ্রু কুঁচকালো দর্শিনী। বিহঙ্গিনীর বাহুতে সামান্য ধাক্কা দিয়ে জিজ্ঞেস করলো,
“কি ভাবছিস, বিহু? কোনো সমস্যা হয়েছে কি?”

বিহঙ্গিনী ডানে-বামে মাথা নাড়ায়। মুচকি হেসে বলে,
“বৌদি,তুই যে অন্তঃসত্ত্বা সেটা তো দাভাই জানে না। জানাবি না?”

বিহঙ্গিনীর প্রশ্নে দর্শিনীর পা থেমে যায়। সাথে থেমে যায় আরও তিন জোড়া পা। মৃত্যুঞ্জয়ও দর্শিনীর উত্তরের আশায় তাকিয়ে থাকে সে দিকে। দর্শিনী কিছুক্ষণ সময় নেয়। তপ্ত এক শ্বাস ফেলে বলে,
“তোর দাভাই জানলেই বা কী? না জানলেই বা কী? তার তো সংসার হয়েছে। দারুণ রঙের সংসার। দর্শিনীদের কোনো কিছু জানার অধিকার তার নেই।”

“কিন্তু সন্তানটা তো তারও। তুই অস্বীকার করতে পারবি?”

বিহঙ্গিনীর একটা প্রশ্নে থম মেরে গেলো সব। মৃত্যুঞ্জয়ের হৃদয়খানি বোধহয় কিঞ্চিৎ কেঁপে উঠলো। দর্শিনী চুপ রইলো কেবল। তন্মধ্যেই তৃণা তাচ্ছিল্য হেসে বললো,
“অস্বীকার না করার কী আছে? এমন নষ্ট পুরুষদের স্বীকার করার কোনো দরকার নেই। এ সন্তান কেবল দিভাইয়ের। তোমার ভাইয়ের মতন নোংরা মানুষের পরিচয় দিয়ে এ সন্তান বড় হবে না।”

“আমার মনে হয় বিহঙ্গিনী এত কিছু ভেবে বলেন নি। যে মেয়ে নিজের বৌদির প্রতি অবিচার সহ্য করতে না পেরে বাড়ি ছেড়েছে,সে নিশ্চয় ঐ অবিচারকদের পক্ষে কথা বলবে না। তাই না বিহঙ্গিনী?”

মৃত্যুঞ্জয়ের কথায় বিহঙ্গিনী মলিন হেসে মাথা নাড়ালো। অতঃপর দর্শিনীর দিকে তাকিয়ে মলিন কণ্ঠে বললো,
“তুই রাগ করিস নি তো বৌদিভাই?”

“না বিহু,রাগ করবো কেনো? আর তুই তো জানিসই তোর ভাইকে আমি ডিভোর্স পেপার দিয়ে আসছি। কয়েকদিন পর কোর্ট থেকে ডাক আসবে। তারপর চিরদিনের জন্য খাতা কলমেও বিচ্ছেদ হবে আমাদের। তাহলে এ সন্তানের কথা তোর ভাই জানুক বা না জানুক তাতে কিছু আসে যায় না।”

“গর্ভধারণ কালীন ডিভোর্স তো হয় না মনে হয়, দিভাই?”

তৃণার কথায় সবারই মোটামুটি ভ্রু কুঁচকালো। সত্যিই তো,প্রেগন্যান্সি অবস্থায় তো ডিভোর্স হয় না। তাহলে!

সবাই যখন উত্তরের আশায় দর্শিনীর দিকে তাকালো,দর্শিনীর মুখে তখন মলিন হাসি বিরাজমান ছিলো।

“তাহলে কি বাচ্চাটা আসা অব্দি অপেক্ষা করতে হবে তোর,দর্শিনী?”

দৃষ্টান্তের প্রশ্নে ডানে-বামে মাথা নাড়ালো দর্শিনী। হাঁটার গতি স্বাভাবিক রেখেই বললো,
“যেহেতু ডিভোর্স ফাইল আমি করেছি তাই অপেক্ষা করার প্রয়োজন নেই৷ গর্ভাবস্থায় যদি কোনো স্ত্রী নিজ ইচ্ছায় ডিভোর্স দিতে চায় এবং সে-ই যদি ডিভোর্সের জন্য আপিল করে তবে কোনো ঝামেলা ছাড়ায় ডিভোর্স হয়ে যায়। এটা নিয়ে উকিল সাহেবের সাথে আমার খোলামেলা কথা হয়েছে। আর খুব শীগ্রই কোর্ট থেকে আমাদের ডাক এলো বলে। তারপর,চিরতরে মুক্তি।”

কথা শেষে ছোট্ট একটা শ্বাস ফেললো দর্শিনী। সে শ্বাসের সাথে যেন ভেসে গেলো কিছু হৃদয় নিংড়ানো হাহাকার। এই হাহাকার পাওয়া না পাওয়ার হিসেবের উপরে বেইমানী করা মানুষটার জন্য। এই হাহাকার জানে,এককালীন প্রিয় মানুষটার প্রতি অগাধ প্রেমের প্রাণঘাতী কতটা।

দর্শিনীর সাথে সাথে আর চার জন মানুষের দীর্ঘশ্বাস ভেসে এলো।

_

শহরের রাত আর দিনকে তেমন আলাদা করা যায় না। সবসময়ই রাস্তা ঘাটে মানুষের বিশাল স্তূপ থাকবেই। হৈচৈ, চেঁচামেচি এক ধরণের হট্টগোল পরিস্থিতিতে ভরা থাকবে শহর। এই বিশাল হৈচৈ পরিপূর্ণ রাস্তায় হেঁটে যাচ্ছে মায়া। তার পাশাপাশি হাঁটছে হৈমন্ত। শহরের বুকে তখন মুখ ভার করা সন্ধ্যা।

“তুই যে বাজারে যাচ্ছিস,আমাকে একটু বলে বের হলি না কেনো? আমি বারান্দা দিয়ে না দেখলে তো জানতামই না।”

হৈমন্তের কথায় তাদের নিশ্চুপতায় ভাঁটা পড়লো। মায়া একটু হেসে বললো,
“ভেবেছিলাম বাজার এখান থেকে এখানে। যাবো আর টুকটাক কেনাকাটা করে চলে আসবো।”

“তুই কী বিপ্রতীপের প্রতি আসক্ত হচ্ছিস, মায়া?”

হৈমন্তের এহেন প্রশ্নে চমকে যায় মায়া। হাতে থাকা ব্যাগটা সামান্য কেঁপে উঠে। হৈমন্তের নজর তখনও মায়ার উপর নিবদ্ধ। মায়ার খুব গোপনে কেঁপে উঠা টাও চোখ এড়ায় নি তার। হৈমন্ত খানিক বাঁকা হাসলো। হাসিটা তাচ্ছিল্যের নাকি বিষাদের ঠিক টের পাওয়া গেলো না।

মায়া তার শাড়ির আঁচলটা দিয়ে খুব সন্তপর্ণে কপালের ঘাম টুকু মুছে নেওয়ার প্রচেষ্টা চালালো। কোনো মতে কথা কাটানোর চেষ্টা করে বললো,
“তুমিও না, হৈমন্ত ভাই। হুটহাট কি যে বলো। এসব কিছুই না। আমি এত সহজে আমার লক্ষ্যের কথা ভুলি নি।”

“লক্ষ্যের কথা ভুলিস নি মানে এই না যে তুই কারো প্রতি দুর্বল হতে পারবি না। তোর লক্ষ্যে তো এমন কোনো চুক্তি ছিলো না যে তুই কারো প্রতি আসক্ত হতে পারবি না। তা,কোনো কথা লুকোচ্ছিস নাকি মায়া? তাও আবার আমার কাছ থেকে?”

হৈমন্তের প্রশ্নের উত্তর এলো না। কেবল এলো কিছু নিরব দীর্ঘশ্বাস, যা হয়তো হৈমন্তের কথাকে সমর্থন জানালো।

হৈমন্ত হাসলো। রাস্তা বরাবর দৃষ্টি নিবদ্ধ রেখে হাসতে হাসতে বললো,
“বিপ্রতীপকে ভালোবাসা এক ধরণের অন্যায়। মনে রাখিস মায়া,তুই নিজের প্রতিশোধ পূরণের জন্য একটা সংসার ভেঙেছিস। যেটা অন্যায়, আমি তবুও তোর সাথ দিয়েছি ঐ মানুষ গুলোকে শাস্তি দেওয়ার জন্য। কিন্তু তুই যদি তাদের প্রতি দুর্বল হয়ে আরেকটা অন্যায় করিস, তবে তোর ক্ষমা নেই। এই অন্যায়ের শাস্তি কিন্তু আমি তোকে দিবো।”

মায়া চমকালো। পা দুটো তার থেমে গেলো। হৈমন্তের কথা বলার ভঙ্গিমাই ছিল এমন যে থামতেই হতো। মায়ার মনের কোণে ভয় জমা হলো। কণ্ঠ খাদে নামিয়ে বললো,
“তুমি আমায় শাস্তি দিতে পারবে, হৈমন্ত ভাই?”

“অন্যায়কারীর শাস্তি আমি দিবোই। সেটা তুই হলেও। আমার ভালোবাসা আমার দুর্বলতা না, মায়া।”

কথা থামিয়েই হৈমন্ত চলে গেলো। মায়া ড্যাব ড্যাব চোখে চেয়ে রইলো। আজ হৈমন্ত ভাইয়ার কথার ধরণ অন্যরকম। এর কারণ কী? মায়ার অহেতুক আবেগই কী এর কারণ!

হাজার কথা ভাবতে ভাবতে মায়া বাসায় এসে পৌঁছালো। হাতের বাজারের ব্যাগটা দরজার সাথে রেখে ড্রয়িং রুমে পা রাখতেই এক দানবীয় চড় এসে পড়লো তার গালে। সে হতভম্ব চোখে সামনে তাকালো। বিপ্রতীপের রাগী, জ্বলন্ত চোখ জোড়া চোখে পড়লো তার। মায়া বিপ্রতীপের এমন রাগের কারণ বুঝলো না। তাই অবাক কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলো,
“এটার মানে কী?”

“কার সাথে ছিলা তুমি? ঐ ছেলেটা কে? এত রাতে একটা ছেলের সাথে ঘুরে বেড়াতে লজ্জা লাগছে না? বাজারের কাছ দিয়ে না আসলে তো এমন লীলাখেলা দেখতেই পারতাম না।”

বিপ্রতীপের এমন কাজের কারণ এখন বোধগম্য হলো মায়ার। বিপ্রতীপের পিছে দাঁড়িয়েই মোহনা হাসছে। বাকিটা বুঝতে বাকি রইলো না মায়ার। হয়তো বিপ্রতীপের জ্বলন্ত আগুনে ঘি ঢেলেছে সেই মহিলা।

এতক্ষণের ভালো লাগাটা মুহূর্তেই মূর্ছা গেলো যেন। তেঁতে উঠলো মায়া। ভয়ংকর রকমের শব্দ করে পাশে রাখা ফুলের টবটা ভেঙে ফেললো। সে ভাঙা টবের টুকরোটা হাতে নিয়ে নিজের হাতেই দুইটা টান দিলো। বিপ্রতীপ কেবল অবাক ও হতভম্ব চোখে সবটা দেখলো। মায়ার নিজেকে আঘাত করার কারণ খুঁজে পেলো না মোহনাও।

মায়া এবার বিপ্রতীপের কলার টেনে ধরে বললো,
“আপনি যখন ঘরে বউ রেখে বাহিরের মেয়ের পিছে ঘুরছেন,তখন আপনার লজ্জা করে নি? তাহলে আজ আমার কেনো লজ্জা করবে শুনি? মায়ার গালে চড় দেওয়া এত সোজা তাই না? দাঁড়ান, একটু সামান্য মজা দেখিয়ে দেই।”

কথা থামিয়েই মায়া “মরে গেলাম গো,মরে গেলাম গো” করে চিৎকার দিয়ে উঠলো। হাতে থাকা ফোনটা দিয়ে কল লাগালো অনাকাঙ্খিত জায়গায়। কথার ধাঁচে বোঝা গেলো মায়া পুলিশ স্টেশনে কল করেছে।

বিপ্রতীপ আর তার মা কেবল নিরব দর্শকের ভূমিকা পালন করলো। এটা কী মেয়ে না অন্যকিছু!

_

দর্শিনী কেবল বিছানায় মাথা দিয়েছে। তন্মধ্যেই তার ঘরের দরজায় ক্রমাগত কেউ আঘাত করা শুরু করলো। দর্শিনীর সাথে সাথে বিহঙ্গিনী, তৃণাও লাফিয়ে উঠলো। সারাদিন পর তিনজন মাত্র ঘুমাতে এসেছিলো। এর মাঝেই এমন করাঘাতে কেঁপে উঠলো সব।

তৃণা দ্রুত গিয়ে দরজা খুলতেই হুড়মুড় করে প্রবেশ করলো বিপ্রতীপ আর দৃষ্টান্ত। দৃষ্টান্ত প্রবেশ করেই ব্যতিব্যস্ত কণ্ঠে বললো,
“দর্শিনী,তাড়াতাড়ি এখান থেকে যেতে হবে। বাড়ি থেকে কল আসছে। প্রদীপদা আর সুমনদা এর অবস্থা খুব খারাপ। আমাদের যেতে হবে দ্রুত।”

কথা টা বলতে দেরি, দর্শিনীর মাথায় বিনা মেঘে বজ্রপাত হতে দেরি হয় নি। সে কোনো মতে কাঁপা কাঁপা কণ্ঠে বললো,
“কী হয়েছে তাদের?”

দৃষ্টান্ত আর বিপ্রতীপ দর্শিনীর প্রশ্নের উত্তর দিলো না। দর্শিনী খাট থেকে নামতে নিলে অসাবধানতা বশত পা পিছলে যায়। মুখ থুবড়ে পড়ার আগে শক্ত একটা হাত আঁকড়ে ধরে তাকে। দর্শিনী হাতের মালিকের দিকে তাকাতেই দেখে বিপ্রতীপ খুব যত্নে তাকে আগলে ধরেছে আর ভয়ার্ত কণ্ঠে বলছে,
“দেখে চলবেন তো,বাবা। এখনই তো মুখ থুবড়ে পড়তেন। নিজে থেকে সাবধান না হলে আর কে সাবধান করবে বলুন। পাঁচমাস রানিং আপনার। এখন অন্তত নিজের কথাও ভাবেন। যাই হোক,ভয় পেয়েছেন? কিছু হবে না আপনার। আমি আছি তো।”

হাজারো অনিশ্চয়তার মাঝে দর্শিনী যেনো কাউকে পেলো। যে হারাবে না, থেকে যাবে চিরকাল।

এর মাঝেই দৃষ্টান্ত তাড়া দিলো। বাড়ির পরিস্থিতি ভয়াবহ।

#চলবে

#পথান্তরে_প্রিয়দর্শিনী
#মম_সাহা

পর্বঃ চব্বিশ

শুকনো মুখে মধ্যরাতে বাড়ি ফিরেছে বিপ্রতীপ। তার বাবা নিলয় কুমার জেল থেকে মোটা টাকার বিনিময়ে মাত্র ছাড়িয়ে আনলেন। পাড়ার মাঝে তাদের নিয়ে মোটামুটি একটা কলরব উঠে গেছে। এই মধ্যরাতেও কেউ কেউ জানালা দিয়ে উঁকি দিয়ে বিপ্রতীপের ফিরে আসার দৃশ্য উপভোগ করছে। কেউবা রাস্তার মোড়ে দাঁড়িয়ে মিটমিটিয়ে হাসছে। এসব কিছু চোখ এড়ায় নি বিপ্রতীপের। মাথায় তার উত্তপ্ত অনল থিতিয়ে আছে। একমাত্র এই রাগের বশে মায়াকে একটা চড় দিয়েছিলো যার ফলস্বরূপ সন্ধ্যা হতে মধ্যরাত অব্দি জেলের ভিতরে কাটাতে হয়েছে সাথে প্রতিবেশীদের কটুক্তি, হাসি তামাশার পাত্র হতে হয়েছে।

নিলয় কুমার আর বিপ্রতীপ ঘরে ঢুকতেই ছুটে আসে মোহনা। ছেলের গলা জড়িয়ে আহ্লাদে কেঁদে উঠে সাথে দাঁত কিড়মিড় করে হাজার টা অভিশাপ দেয় মায়াকে। বিপ্রতীপ ক্লান্ত পায়ে সোফায় গিয়ে বসতেই বিরক্তিতে শরীর আরেকটু ঝিমিয়ে আসে। মেয়েটা তাকে সামান্য চড়ের জন্য জেলের ঘানি টানিয়ে নিজে আরামে বসে টিভি দেখছে! বিপ্রতীপের ভিতরের শব্দ কণিকা গুলো উগ্র হয়ে উঠে। দল বেঁধে বেরিয়ে আসতে চায়। কিন্তু বিপ্রতীপ নিজেকে শক্ত রাখে। সন্ধ্যাবেলা মেয়েটা যে খেলা দেখিয়েছে, এরপর আর দানবীয় রাগ দেখানোর মানে হয় না। এতে নিজের পায়ে নিজের কুড়াল মারা হবে।

বিপ্রতীপকে পাশে বসতে দেখেই মায়া কুটিল হাসলো। হাতের রিমোটটা ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে টিভির দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ রেখেই বললো,
“তা স্বামী,জেলের ঘানি টেনে কেমন লাগলো শুনি? ইশ,শ্বশুর বাবা যে কেন তার কুলাঙ্গার ছেলেকে এত টাকা দিয়ে ছাড়ালো আমার বোধগম্য হয় না। যার জায়গা যেখানে তাকে তো সেখানেই রাখা উচিত।”

বিপ্রতীপের রাগে শরীরের শিরা উপশিরা কাঁপছে। বর্তমানে এ মেয়েটাকে তার এক মুহূর্ত সহ্য হচ্ছে না। কেবল নিজেকে পাগল পাগল লাগছে তার। কে জানতো, মানুষ এভাবে বদলে যাবে? বিয়ের আগের মায়া আর এখনের মায়ার মাঝে এমন বিস্তর পার্থক্য দেখা দিবে,সেটাও বা কার জানা ছিলো?

বিপ্রতীপের ভাবনা গুলো বিপ্রতীপকে যেন ধিক্কার জানালো। তাচ্ছিল্য হেসে বললো,
“তুই কী কম করেছিলি দর্শিনীর সাথে? তুই কী বদলে যাস নি? বিয়ের আগে বিপ্রতীপ আর পরের বিপ্রতীপকে মেলাতে দর্শিনীরও তো কষ্ট হয়েছিল, তখন তুই বুঝেছিলি?”

হঠাৎ করেই বিপ্রতীপের মস্তিষ্কে দোল খেয়ে যাওয়া কথা গুলো বিপ্রতীপকে ভাবালো। প্রায় অনেক গুলো বছর পর বিপ্রতীপ ভাবতে বসলো। সত্যিই তো,সে দর্শিনীর সাথে যা যা করেছে তা-ই তো সুদে আসলে ফেরত আসছে। এটা তো এখন মানতেই হবে। এটা যে হওয়ারই ছিলো। দর্শিনীরা ছেড়ে দিলেও যে প্রকৃতি ছাড় দেয় না।

বিপ্রতীপ সোফা ছেড়ে উঠতেই মোহনা একটা শরবতের গ্লাস নিয়ে হাজির হলো। ছেলের দিকে এগিয়ে দিয়ে নরম স্বরে বললো,
“এটা খেয়ে নে, বাবা। নিশ্চয় খিদেও লেগেছে? যা হাত মুখ ধুয়ে নে,আমি খাবার দিচ্ছি।”

বিপ্রতীপ ধীর পায়ে উঠে দাঁড়ালো। কণ্ঠ শীতল রেখেই বললো,
“আমি এখন একা থাকতে চাই, মা। আমার কিছু খাওয়ার প্রয়োজন নেই। আমি রুমে যাচ্ছি। কেউ বিরক্ত করবে না আশাকরি।”

শেষ কথাটা অবশ্য মায়ার দিকে তাকিয়েই বলেছে। মায়া মুখ ভেংচি দিয়ে টিভির দিকে তাকালো। বিপ্রতীপ গটগট পায়ে চলে গেলো নিজের রুমে। সর্বস্ব শক্তি দিয়ে দরজাটা আটকিয়ে ফেললো।

বিপ্রতীপ যেতেই মায়াও উঠে দাঁড়ালো। ঠাঁই হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা মোহনার হাত থেকে শরবত টা নিয়ে একটা গা জ্বালানো হাসি দিয়ে ছাদের দিকে যেতে যেতে বললো,
“আপনার ছেলের আর শরবত খেয়ে কাজ নেই। জেলের হাওয়া খেয়েই পেট ভরেছে। আপনিও যাবেন নাকি হাওয়া খেতে? খুব শীগ্রই তবে ব্যবস্থা করবো?”

মোহনা মুখ ঝামটি মেরে চলে গেলো। মায়াও খিল খিল হাসতে হাসতে ছাঁদের দিকে গেলো। এবং তার বেসুরে গলায় গান ধরলো,
“ওরে,জীবন হইলো ইটের ভাঁটা,
ধিকি ধিকি জ্বলে রে,
সুখ যে আছে এ জীবনে,
কোন পাগলে বলে রে?”

বিপ্রতীপ মাত্র জামা বদলাচ্ছিলো,মায়ার এমন গানে তার হাত থেমে যায়। বিরক্তিতে একটা ঢেঁকুর তুলে। শব্দ করে মাথার উপর ঘুরতে থাকা সিলিং ফ্যানটার দিকে তাকায়। আজ অনেক গুলো দিন পর দর্শিনীকে বাজে ভাবে মনে পড়ছে। মেয়েটা বাড়ি ছেড়েছে দু’মাস হবে, এ অব্দি ওর বৌদি ছাড়া কারো সাথে কথা হয় নি। বৌদির সাথেও অনেকদিন আগে কথা হয়েছিলো এরপর আর কোনো যোগাযোগ নেই। বিপ্রতীপ নিজেই অবাক হলো,দর্শিনী খারাপ মেয়ে ছিলো না, বিপ্রতীপ যথেষ্ট ভালোবাসতো দর্শিনীকে। তবে হঠাৎ করে সব বিষিয়ে গিয়েছিল কেনো? বিপ্রতীপ দিগ বেদিক খুঁজে বেড়ায় কারণ কিন্তু কোনো কারণই তার মাথায় আসে না। অতঃপর বরাবরের মতন দর্শিনীর ঘাড়ে দোষ চাপিয়ে শান্তির ঘুমের প্রয়াস চালায়। হয়তো দর্শিনীই শক্ত হাতে সংসার টা ধরে রাখতে পারে নি। দর্শিনী একটু শক্ত হলে হয়তো আজ সবটা সুন্দর হতো। আরও হাজারটা অভিযোগ উঠে দর্শিনীর উপর।

_

শীতের হিমশীতল বাতাস ছুঁয়ে দিয়ে যাচ্ছে জীপে বসা প্রতিটি মানুষের শরীরে। গাড়ি চলছে আপন গতিতে বিশাল রাস্তা পিছে ফেলে। গাড়িতে বসে থাকা মানুষ গুলো চুপচাপ। তাদের ভয় হচ্ছে,বাড়ি গিয়ে না আবার খারাপ কোনো খবর শুনতে হয়। দর্শিনীর দুই ভাইয়ের শরীর ভীষণ অসুস্থ, কী হয়েছে জানা নেই তাদের। নেটওয়ার্ক খারাপ ছিলো বিধায় জানতেও পারে নি। কেবল কাল বিলম্ব না করে তারা ছুট লাগিয়েছে বাড়ির পথে।

জাফলং ছাড়িয়ে উত্তর দিকে দর্শিনীদের গ্রাম। যখন জাফলং এর রাস্তায় গাড়ি উঠলো তখন ঘড়িতে বাজে রাত পৌনে তিনটা। দর্শিনী চুপচাপ তাকিয়ে আছে বিশাল আকাশে। আবহাওয়া শীতল। ঝিরিঝিরি বৃষ্টি পড়ছে শরীরে। দর্শিনী ডুব দিয়েছে অতীতে। জীবনটা তার এত বিষাদময় ছিলো না। বিষাদের গল্পে ভরা জীবন সে কখনো কল্পনাও করে নি। যখন বাবার বাড়িতে ছিলো,মা-বাবা ভাইদের প্রাণ ভোমরা ছিলো। হ্যাঁ, মা অনেক রাগী ছিলো ঠিক কিন্তু দর্শিনীর গায়ে কখনো হাত তুলে নি। মাঝে মাঝে ধমক দিতো কিন্তু বড় বৌদির জন্য সেটাও তত করতে পারতো না। বড় বৌদি বরাবরই অনেক সোহাগ করতো তাকে। দর্শিনী যখন শ্বশুর বাড়িতে উঠে তখনও জীবন এতটা খারাপ ছিলো না। বিপ্রতীপ প্রতিদিন তার জন্য বেলীফুলের মালা আনতো। কখনো বা আলতা,চুড়ি, পাকোড়া, সিঙ্গারা ইত্যাদি অনেক কিছু আনতো রোজ বিকেলে। মাঝে মাঝে সন্ধ্যায় তারা ঘুরতেও যেতো।

মোহনা বাদে কেউ দর্শিনীকে কিছু বললে বিপ্রতীপ প্রতিবাদ করে উঠতো। এইতো গত তিন বছর আগের এক শরৎ এর কথা। বিপ্রতীপদের বাড়িতে মেহমানে ভরা। দর্শিনী তখন নতুন বউ। মাসি শাশুড়ীকে চা করে দিয়েছিলো। চিনি অতিরিক্ত হওয়ায় সে ভদ্র মহিলা কত কথা শুনালো। বাড়ি ভর্তি মানুষের সামনে দর্শিনীর মাথা নত হয়ে যায়। কান্নায় চোখ ভরে উঠে। তন্মধ্যেই বিপ্রতীপ হাজির হয়। অফিস থেকে এসেই দর্শিনীর ক্রন্দনরত মুখ দেখে সে হিংস্র বাঘ হয়ে যায়। চিৎকার চেঁচামেচি করে পুরো বাড়ি মাথায় তুলে। মাসি তো নিজের বোনের ছেলের আচরণে লজ্জায় কুঁকড়ে বাড়ি থেকে চলে যায় সেদিনই। যেতে যেতে অভিশাপ দিয়ে যায় ক’দিন এ সোনার সংসার টিকে সে ও দেখবে। এইতো আজ সে মানুষটার কথা মিলে গেলো। টিকলো না সে সংসার। দর্শিনী হেসে উঠে। সেই বিপ্রতীপ এতটা বদলে গেলো কীভাবে! এটা ভাবতেও যে বুকটা কাঁপে।

দর্শিনীকে হঠাৎ হাসতে দেখে ভ্রু কুঁচকালো তৃণা। অবাক কণ্ঠে বললো,
“প্রিয়দি,হাসছো যে?”

দর্শিনীর ধ্যান ভাঙলো। হাসি থামালো। মৃত্যুঞ্জয় গাড়ি ড্রাইভ করতে করতে পিছে ঘুরে তাকালো। দর্শিনী কিছুটা অস্বস্তিতে পরলো। আমতা-আমতা করে বললো,
“কই না তো।”

কিন্তু তখন দর্শিনীর ঠোঁটের কোণে হাসির রেখা মৃত্যুঞ্জয় ও দৃষ্টান্তও খেয়াল করেছিলো। তৃণা সন্দিহান কণ্ঠে বললো,
“তোমার মুখে স্পষ্ট হাসি দেখলাম। কিছু মনে করে হাসছো তাই না? কোনো মজার ঘটনা কি?”

দর্শিনী বুঝলো,কথা ঘুরানোর উপায় নেই। তাই মলিন হেসে বললো,
“অতীত ভেবে হাসছি। আমার সাংসারিক ঘটনা মনে পড়লো।”

দর্শিনীর কথা বলতে দেরি কিন্তু জীপ গাড়ি ব্রেক কষতে দেরি নেই। মৃত্যুঞ্জয় কাঠ কাঠ হয়ে বসলো। তৃণা তাচ্ছিল্য হেসে বললো,
“বাহ্,ঐ মানুষটার সাথে তোমার হাসির স্মৃতিও আছে?”

“থাকবে না আবার? ছিলো তো প্রেমের বিয়ে, সুখের স্মৃতি না থেকে কোথায় যাবে? মানুষটা তো এক কালে আমায় ভালোবেসেছিল। সেটা অভিনয় ছিলো না। ভালোবাসা-ই ছিলো। সময় গড়িয়েছে, ভালোবাসায় ধূল জমে জমে মরুভূমির গহ্বরে হারিয়ে গেছে। আজ সে পাল্টে গেছে বলে অতীতের তাকে আমি স্বীকার করবো না, ততটা বেইমান আমি না।”

“এত ভালোবেসে কী পেলে, দি?”

“এই যে,হুটহাট হাসির কারণ পেয়েছি। আর কী লাগে জীবনে?”

“তাহলে সংসার টা একটু শক্ত হাতে টিকিয়ে রাখলেই পারতে।”

“শক্ত হাতে জমির হাল ধরা যায়, সংসার না। আর যে সংসারে স্বামীর মন বাহিরে চলে যায় সে সংসার শশ্মানের সমান। সংসারে শ্বশুর,শাশুড়ী, ননদ,দেবর সব এক দিকে আর স্বামী আরেকদিকে। সব মানা যায় কিন্তু স্বামীর অবহেলা সহ্য করার মতন না। মানুষ মরে একদিনে আর আমি মরছি গত কয়েক বছর ধরে। এই মৃত্যুতে শরীর লাশ হয় না, লাশ হয় হৃদয়।”

পুরো রাস্তায় থম মারা নিস্তব্ধতায় যোগ হলো দীর্ঘশ্বাস। মৃত্যুঞ্জয় নিস্তব্ধতা ঠেলে তার হাতের জ্যাকেট টা দর্শিনীর দিকে এগিয়ে দিলো। ভরাট কন্ঠে বললো,
“জ্যাকেট টা পড়ে নিন। ঠান্ডা লাগবে না হয়।”

দর্শিনী হাসে। মৃত্যুঞ্জয়ের জ্যাকেট টা জড়িয়ে নেয় শরীরে। সেও চায় আরেকটা সুন্দর বর্তমান তৈরী করতে। যে বর্তমান ভবিষ্যতে হাসাবে। যে বর্তমানে কোনো, বেইমান বিপ্রতীপ থাকবে না। স্বার্থহীন মৃত্যুঞ্জয় থাকবে। দর্শিনী জানে এটা সম্ভব। কারণ সে মৃত্যুঞ্জয়ের ঝড়ের রাতে দেওয়া আভাস বানী শুনেছিলো। দৃষ্টান্তের আর মৃত্যুঞ্জয়ের সে রাতের কথা জানালার আড়ালে দর্শিনীই শুনে ছিলো। এই বিষাদময় মরুভূমিতে দর্শিনীরও ইচ্ছে হয় মধুময় ভালোবাসা পাওয়ার। কে না চায় ভালোভাবে বাঁচতে?

_

বিধ্বস্ত অবস্থায় খাটে শুয়ে আছে দর্শিনীর বড় ভাই প্রদীপ। আর তার পাশের চেয়ারে ভাঙা হাত নিয়ে বসে আছে সুমন।

দর্শিনী ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে আছে সে দিকে। নিধি মিহি সুরে কেঁদে যাচ্ছে। সাথে নিপাও কাঁদছে।

দর্শিনী বড় ভাইয়ে পায়ের ব্যান্ডেজটার উপর আলতো হাত বুলায়। ঠোঁট ভেঙে আসা কান্না আটকানোর চেষ্টা করে আহত কণ্ঠে বলে,
“কীভাবে হলো এসব, বড়দা?”

“যদি বলি তোর জন্য এসব হয়েছে, প্রিয়।”

দর্শিনী চমকে উঠে। এ কথা টা মা কিংবা ছোট বৌদি বললে বোধহয় দর্শিনী স্বাভাবিক ভাবে নিতো কিন্তু কথা টা বলেছে তার বড় বৌদি। যে কিনা এ অব্দি উঁচু স্বরে একটা ধমক দেয় নি দর্শিনীকে।

দর্শিনী বড় বৌদির রুক্ষ কণ্ঠে হা হয়ে রইলো। বড় বৌদির মাঝে কেমন যেন বিরাট পরিবর্তন দেখলো। তার পরিচিত এক ভয়ঙ্কর নারীর ছায়া যেন দেখলো সে এই কোমলপ্রাণ বড় বৌদির মাঝে। দর্শিনীর মাথা ঘুরে উঠলো। হয়তো বদলাতে চলেছে অনেক কিছু।

#চলবে