পদ্মফুল পর্ব-১১+১২+১৩

0
286

#পদ্মফুল
#জান্নাতুল_ফারিয়া_প্রত্যাশা
।১১।

আদিদ পদ্ম’র দিকে তাকিয়ে ঠান্ডা গলায় বললো,

‘ও হারিয়ে গিয়েছে।’

পদ্ম’র কুঁচকানো ব্রু যুগল এখন আরো কিছুটা কুঁচকে গেল। সে অবাক কন্ঠে বললো,

‘মানে?’

‘মানে সুজানা-কে আমি হারিয়ে ফেলেছি। ও গত এক বছর যাবত নিখোঁজ। অনেক খুঁজেছি, ইনফ্যাক্ট এখনও খুঁজে যাচ্ছি। কিন্তু…কিন্তু ওকে আমি পাচ্ছি না। পুলিশ কেইসও হয়েছিল। অনেক তদন্ত আর খোঁজা খুঁজির পর তারাও হার মেনে নিয়েছে। আর ওর মা বাবা, উনারা তো এখন পুরো স্তব্ধ হয়ে গিয়েছে। একটা মাত্র মেয়ে উনাদের। মেয়েকে হারিয়ে যেন পুরো পৃথিবী থমকে গিয়েছে উনাদের। আর আমি..সুজানার সবথেকে পছন্দের মানুষ। যেই মানুষটাকে সে একা ফেলে রেখে হারিয়ে গিয়েছে। জানেন তো, খুব করে চাই ও আবার ফিরে আসুক। কিন্তু আমার এই আশাটা আদৌ পূর্ণ হবে কিনা জানি না।’

আদিদ থামল। গলা ধরে এসেছে তার। সে এক টানে পুরো কফি শেষ করলো। তারপর আবার পদ্ম’র দিকে তাকিয়ে বললো,

‘কিছু মনে না করলে, আপনি এখন আসতে পারেন। আমি একটু একা থাকতে চাই।’

পদ্ম কিছু না বলে ধীর পায়ে রুম থেকে বেরিয়ে নিজের রুমে চলে গেল। বিছানায় বসে ভাবতে লাগল, সত্যিই মেয়েটা হারিয়ে গিয়েছে? এত বড়ো মেয়ে এইভাবে উধাও হয়ে গেল কিভাবে? মেয়েটার কি কোনো শত্রু আছে? কোথায় গেল মেয়েটা? ইশ, মেয়েটার জন্য পদ্ম’র কেন যেন খুব মায়া হচ্ছে। এই ভাগ্য নামক জিনিস’টা এত বিচিত্র কেন? একেক জনের সাথে একেক খেলা খেলে। কাউকে একভাবে কষ্ট দেয় তো কাউকে অন্যভাবে। না জানি, মেয়েটা এখন কোথায় আছে, কিভাবে আছে। তবে সেও মনে মনে খুব করে দোয়া করলো, মেয়েটা ফিরে আসুক। ও ফিরে আসলে ডাক্তারবাবু খুশিতে হয়তো আত্মহারা হয়ে যাবে। প্রথম দেখেই হয়তো জাপটে জড়িয়ে ধরে কিছুক্ষণ কাঁদবে। আচ্ছা, ডাক্তার’রা ও কি কাঁদে? ওদের তো মন খুব শক্ত হয়। ওরাও কি আমাদের মতো কাঁদতে পারে? কি জানি..

পদ্ম কফি’টা শেষ করে বিছানায় হেলান দিয়ে বসলো। তখনই তার রুমের দরজায় শব্দ হলো। পদ্ম ঘাড় ঘুরিয়ে দরজার দিকে তাকাতেই দেখল আকবর সাহেব। পদ্ম চমকে উঠে বসলো। নিজের জামা ওড়না টেনে উঠে দাঁড়িয়ে ইতস্তত কন্ঠে বললো,

‘আংকেল আপনি?’

‘হ্যাঁ মা, আমি। তোমার সাথে তো আমার তেমন করে কথাই হলো না তাই ভাবলাম এসে একটু গল্প করি। তা তোমার কোনো অসুবিধা নেই তো?’

পদ্ম না চাইতেও হেসে বললো,

‘না না, অসুবিধা কিসের? আপনি আসুন না, ভেতরে আসুন।’

আকবর সাহেব ভেতরে গিয়ে বসলেন। পদ্ম দাঁড়িয়ে রইল। তিনি তাকে বললেন,

‘বসো।’

পদ্ম গুটিসুটি মেরে বসলো। আকবর সাহেব হেসে বললেন,

‘তোমার পুরো নাম কী, মা?’

‘আফসানা পদ্ম।’

‘বাহ! বেশ সুন্দর নাম। আচ্ছা, একটা কথা বলতো, তুমি পড়াশোনা কতটুকু করেছো?’

‘টেন পাশ’টা কোনোরকমে করেছিলাম। তারপর আর মামা মামি পড়তে দেয়নি।’

‘ওহ, তা এখন তোমার বয়স কত?’

‘একুশ বাইশ হবে হয়তো।’

‘আচ্ছা আচ্ছা।’

লোকটা ঠোঁটের উপর দুই আঙ্গুল রেখে কী যেন ভাবলেন। তারপর বললেন,

‘তোমার নাকি কার সাথে বিয়ে ঠিক হয়েছিল? সেই ছেলেটা কি ভালো ছিল না?’

পদ্ম মাথা নুইয়ে বললো,

‘না, ঐ লোকটা খুব খারাপ।’

আকবর সাহেব বললেন,

‘কেন? বয়স বেশি বলে?’

‘বয়স না, আসলে লোকটার ব্যবহার খারাপ। আমার সাথে বাজে ব্যবহার করেছিল।’

আকবর সাহেব তপ্ত শ্বাস ছেড়ে বললেন,

‘আহারে, এইটুকু একটা মেয়ের সাথে কতকিছু হয়ে গেল। থাক মা, তুমি আর কষ্ট পেয়ো না। আগের কথা সব ভুলে যাও। ভেবে নাও এটা তোমার নতুন জীবন। তাই এখন থেকে সবসময় হাসিখুশি থাকবে, নিজেকে আনন্দে রাখবে কেমন?’

আকবর সাহেব কথা’টা বলার সময় পদ্ম’র মাথায় হাত রাখলেন। পদ্ম হেসে বললো,

‘আচ্ছা।’

তিনি তার হাত’টা নামিয়ে পদ্ম’র বাহুতে রাখলেন। সেখানে হাত ঘষতে ঘষতে বললেন,

‘আচ্ছা মা, কোনো টেনশন নিও না। কোনো অসুবিধা হলে সবার আগে আমাকে বলবে। আমি সবটুকু দিয়ে তোমাকে সাহায্য করবো।’

লোকটার অমন করে গায়ে হাত ঘষা’টা পদ্ম’র ঠিক পছন্দ হলো না। সে হেসে হেসে উনার হাত’টা সরিয়ে বললো,

‘আচ্ছা আংকেল বলবো।’

তিনিও হেসে এদিক ওদিক তাকিয়ে আরো কিছু প্রশ্ন করলেন। এই যেমন এই রুম’টা পছন্দ হয়েছে কিনা, রুমের কিছু বদলানো লাগবে কিনা কিংবা কিছু আনতে হবে কিনা এই ধরনের অবান্তর কিছু প্রশ্ন। পদ্ম’র ভীষণ বিরক্ত লাগলেও সে হেসে হেসে উত্তর দিল। লোকটি এক পর্যায়ে কথা শেষ করে উঠে দাঁড়াল। পদ্মও সম্মানের খাতিরে তার সঙ্গে উঠে দাঁড়াল। লোকটি বললো,

‘আচ্ছা তাহলে অনেক গল্প হয়েছে, এখন তাহলে আমি আমার রুমে যাই?’

এই কথাটা বলার সময়ও তিনি পদ্ম’র গালে আবার হাত রাখলেন। পদ্ম এবার ব্রু কুঁচকে ফেলল। বারবার গায়ে হাত দিয়ে কথা বলা লাগে নাকি, আশ্চর্য! পদ্ম হাত সরিয়ে বিরক্ত কন্ঠে বললো,

‘ঠিক আছে আংকেল, আপনি আসুন।’

আকবর সাহেব বেরিয়ে গেলেন। উনি বেরিয়ে যেতেই পদ্ম গিয়ে দরজা’টা লাগিয়ে দিল। তারপর ধপ করে গিয়ে বিছানায় বসে পড়ল। কেন যেন লোকটার এই ছোঁয়াগুলো সে ভালো ভাবে নিতে পারছে না। এই ছোঁয়াতে কোনো স্নেহ ছিল না, ছিল অন্যকিছু। তার অস্বস্তি হতে লাগল ভীষণ। গাল’টা ঘষে বিছানায় চোখ বুজে শুয়ে পড়ল সে। আর কিছু খারাপ চায় না সে। আর নিতে পারবে না। তার মধ্যে আর সেই ধৈর্য নেই। এবার কিছু খারাপ হলে সে মরে’ই যাবে। এইভাবে আর বেঁচে থাকা তার পক্ষে সম্ভব না।

.

ডাইনিং এ বসে সবাই রাতের খাবার খাচ্ছে। পদ্ম’র আজ খেতে ইচ্ছে করছে না। তাও রুবি হোসেনের জোরাজুরিতে তাকেও বসতে হলো। তার উল্টো পাশে চেয়ারে আদিদ বসা। লোকটা কী সব সেদ্ধ শাক সবজি খাচ্ছে। ঐগুলো তো জীবনেও পদ্ম খেতে পারবে না। আদিদের পাশে তার বাবা বসেছে। উনার জন্য আজ অনেক কিছু রান্না হয়েছে। উনি একের পর এক খাবার নিচ্ছেন আর খাচ্ছেন। মনে হয় খুব ভোজনরসিক মানুষ। পদ্ম এক লোমকা নিচ্ছে তো কিছুক্ষণ জিরুচ্ছে। রুবি হোসেন পদ্ম’র দিকে তাকিয়ে বললেন,

‘কি ব্যাপার পদ্ম, তুমি তো দেখি কিছুই খাচ্ছো না।’

পদ্ম হালকা হাসার চেষ্টা করে বললো,

‘না না, খাচ্ছি তো।’

আদিদ তখন তাকিয়ে বললো,

‘শরীর খারাপ লাগছে আপনার? খেতে মন না চাইলে জোর করে খেতে হবে না। নয়তো তাতে আবার অসুস্থ হয়ে পড়বেন।’

পদ্ম এবার আমতা আমতা করে বললো,

‘আ-আমার আসলে সত্যিই খেতে ইচ্ছে করছে না।’

‘ওমা! কেন মা, কী হয়েছে তোমার? শরীর কি খুব খারাপ তোমার? দেখি তো..’

উনি হাত বাড়িয়ে পদ্ম’র কপাল আর গলা ছুঁয়ে বললো,

‘না, জ্বর টর তো আসেনি। তাহলে কী হয়েছে?’

পদ্ম’র এবার আরো বেশি খারাপ লাগতে লাগল। লোকটা ইচ্ছে করে তার গায়ে হাত দিচ্ছে। একজন পুরুষ মানুষের কোন ছোঁয়া’টা কেমন সেটা একটা মেয়ে খুব সহজেই বুঝতে পারে। এই লোকটার ছোঁয়ার উদ্দেশ্য ভালো নয়। পদ্ম চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়াল। ফিচেল গলায় বললো,

‘আপনারা খান, আমি রুমে যাচ্ছি।’

পদ্ম উপরে চলে গেল। রুবি হোসেন তখন তার যাওয়ার দিকে তাকিয়ে বললো,

‘মেয়েটার আবার কী হলো?’

‘কিছু হয়নি মা। হয়তো শরীর একটু খারাপ লাগছে। রেস্ট নিলে ঠিক হয়ে যাবে। তুমি টেনশন নিও না।’

সবাই খেয়ে দেয়ে যার যার রুমে চলে গেল। আদিদ নিজের রুমে যাওয়ার আগে একবার পদ্ম’র রুমের কাছে গেল। দরজায় নক করতে গিয়েও হাত সরিয়ে নিল সে। মনে মনে ভাবল, মেয়েটা ঘুমিয়ে পড়লে, অযথা তার ঘুম’টা নষ্ট হবে। এই ভেবে সে আর দরজায় নক করলো না, চলে গেল নিজের রুমে।

.

সবাই হয়তো ঘুমিয়ে পড়েছে। কিন্তু পদ্ম তার দু চোখের পাতা এক করতে পারছে না। তার খুব ভয় করছে। ভয়ে সে জড়সড় হয়ে শুয়ে আছে। আদিদের বাবাকে তার পছন্দ হচ্ছে না। উনার ব্যবহার স্বাভাবিক না। উনার এই স্পর্শ স্বাভাবিক না। পদ্ম’র ভালো লাগছে না। সে জোর করে ঘুম আনার চেষ্টা করছে। ঘুমালে হয়তো মাথাটা একটু ঠান্ডা হবে তার। তাই সে যখন চোখ বুজে আপ্রাণ চেষ্টা চালাচ্ছে ঘুমের জন্য ঠিক তখনই তার রুমের দরজায় কে যেন নক করে। এমন নিস্তব্ধ পরিবেশে দরজার এই ঠকঠক শব্দ কিছু সময়ের জন্য পদ্ম-কে ভীষণ ভীত করে তুলে। সে ভয়ে ভয়ে উঠে বসে। ঢোক গিলে জিগ্যেস করে,

‘কে?’

চলবে..

#পদ্মফুল
#জান্নাতুল_ফারিয়া_প্রত্যাশা
।১২।

বাইরে থেকে কারো মোটা গলার শব্দ পাওয়া গেল,

‘খুলো মা, আমি।’

আকবর সাহেবের গলা’টা শুনেই পদ্ম’র ভয়টা যেন তরাৎ করে বেড়ে গেল। উনি এত রাতে কেন এসেছেন? পদ্ম থম মেরে বসে থাকে। বাইরে থেকে তখন আবার শোনা যায়,

‘কী হলো মা, দরজা খুলছো না কেন?’

পদ্ম জবাব দেয় না। তার চোখমুখ ইতিমধ্যেই শুকিয়ে গিয়েছে। সে চাদর খামছে ধরে বসে আছে। দরজায় আরেকবার ঠকঠক শব্দ হলো। পদ্ম চোখ বুজে মরার মতো শুয়ে পড়ল। কিছুটা সময় গেল। এরমধ্যে বাইরে থেকে আর কোনো শব্দ এলো না। সে মিটমিট করে ঘড়ির দিকে তাকাল। রাত এক’টাই ঐ ভদ্র লোক কেন তার রুমে আসতে চাইছিল। কী চাই লোকটা? উনি কি তবে সত্যি সত্যিই খুব খারাপ একটা লোক? পদ্ম’র ভাবনার মাঝেই ছেদ পড়লো দরজায় যখন আবার ঠকঠক করে শব্দ হলো। পদ্ম ভয়ার্ত দৃষ্টিতে দরজার দিকে তাকাল। না, দরজা খুলবে না সে। দুনিয়া উল্টে গেলেও খুলবে না। কিন্তু সে এবার চমকে গেল দরজার বাইরে রুবি হোসেনের গলা শুনে। তিনি পদ্ম-কে বললেন,

‘দরজা খুলো মা। কী হলো?’

পদ্ম এবার আর কিছু না ভেবে দরজা খুলে দিল। রুবি হোসেনকে বাইরে দেখে প্রসন্ন হাসলো সে। বললো,

‘বড়োমা, তুমি এত রাতে..?’

‘তোমার কী হয়েছে, বলতো? জেগে থেকেও দরজা খুলছিলে না কেন, তোমার আংকেলও তো কতক্ষণ ডাকল। আমরা তো দুশ্চিন্তায় পড়ে গিয়েছিলাম।’

পদ্ম শুকনো মুখে হাসল। বললো,

‘না মানে আসলে, ভেবেছিলাম কে না কে এসেছে..তাই..’

‘কে না কে এসেছে মানে কী? এই বাড়িতে আছিই তো আমরা কয়জন মানুষ। আমাদেরকেও কি তুমি বিশ্বাস করতে পারছো না?’

আদিদের বাবা ক্ষুব্ধ কন্ঠে বলে উঠলেন। পদ্ম’র এই মুহুর্তে মনে হচ্ছে লোকটার মুখের উপর বলে দিতে যে, “না পারছি না। সবাই-কে বিশ্বাস করতে পারলেও অন্তত আপনাকে সত্যিই বিশ্বাস করতে পারছি না।”
সেটা বলা তার পক্ষে সম্ভব নয় বলে সে আপাতত চুপ হয়ে রইল।

রুবি হোসেন তখন এগিয়ে এলেন। পদ্ম’র মাথায় হাত রেখে বললেন,

‘আচ্ছা থাক মা, আর মন খারাপ করতে হবে না। বুঝতে পেরেছি তুমি হয়তো এখনও নিজেকে আমাদের সাথে এডজাস্ট করে উঠতে পারছো না। সমস্যা নেই, আস্তে আস্তে ঠিক হয়ে যাবে।’

পদ্ম ঠোঁটের কোণে মৃদু হাসি ফুটিয়ে তুলে বললো,

‘কিন্তু, আপনারা এত রাতে এখানে এসেছেন, কোনো সমস্যা?’

‘আরে আর বলো না। তোমার আংকেল, সে তোমার জন্য চিন্তা করতে করতে শেষ। তুমি ওভাবে না খেয়ে চলে এলে না, সেই নিয়ে ওর দুশ্চিন্তা। হঠাৎ কী হলো তোমার, শরীর খারাপ হলো কিনা এসব টেনশনে সে ঘুমাতেই পারছিল না। আর আমাকেও ঘুমাতে দিচ্ছিল না। তাই বাধ্য হয়ে এত রাতে তোমার রুমে আসতে হলো।’

পদ্ম আকবর সাহেবের দিকে তাকাল। উনি দরদমাখা গলায় বললেন,

‘বাবা’র তার মেয়ের জন্য টেনশন হবে সেটা কি স্বাভাবিক নয়, বলো?’

পদ্ম’র বুকের ভেতরটা হঠাৎ ধক করে উঠল। মেয়ে? উনি কি পদ্ম-কে নিজের মেয়ের চোখে দেখেন? সত্যিই তাই? তাহলে কি পদ্ম’ই উনাকে নিয়ে ভুল ভাবছে? তার এই স্পর্শ, এই চাহনী সবটাই কি স্নেহ আর মায়ার খাতিরে? কোনো খারাপ চিন্তা নেই এর মাঝে? পদ্ম’র মস্তিষ্ক কাজ করা বন্ধ করে দিয়েছে। সে কাকে নিয়ে কী ভাবছে সে নিজেও জানে না। কাকে বিশ্বাস করবে আর কাকে বিশ্বাস করবে না সেটাই সে বুঝতে পারছে না। মানুষ ভীষণ ধূর্ত প্রাণী। তাদের মুখোশের আড়ালের চেহারা’টা সহজে ধরা যায় না। তাই তো তখন এই বিশ্বাস নামক জিনিসটার প্রতিফলন ঘটাতে খুব কষ্ট হয়ে পড়ে। পদ্ম নিশ্বাস নিল জোরে। জিভ দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে বললো,

‘আমি একদম ঠিক আছি। প্লীজ আমাকে নিয়ে এত দুশ্চিন্তা করবেন না। আমার খারাপ লাগছে এটা ভেবে যে আপনারা আমার দুশ্চিন্তায় ঘুমাতে পারছেন না। প্লীজ এমন করবেন না। আমি ঠিক আছি, আপনারা নিশ্চিন্তে থাকুন।’

রুবি হোসেন বললেন,

‘আচ্ছা ঠিক আছে, আর দুশ্চিন্তা করবো না। তুমি এখন ঘুমিয়ে পড়ো আমরাও শুয়ে পড়বো।’

‘আচ্ছা বড়ো মা।’

রুবি হোসেন বেরিয়ে গেলেন। আকবর সাহেবও তার পেছন পেছন দরজার কাছে গিয়ে একবার পেছনে ফিরে মুচকি হেসে বললেন,

‘গুড নাইট, বেবিগার্ল।’

পদ্ম জবাব দিল না। ফ্যালফ্যাল করে কিছুক্ষণ চেয়ে থেকে দরজা আটকে এসে আবার শুয়ে পড়ল। মাথাটা খুব ধরেছে তার। আর এত প্রেসার মাথায় নিতে পারবে না সে। সম্ভব না, মাথা ফেটে যাচ্ছে যে। সে ড্রয়ার থেকে একটা পেইনকিলার বের করে খেয়ে চুপচাপ গিয়ে আবার বিছানায় শুয়ে পড়ল। এখন একটু ঘুম আসলে বাঁচে সে…
.
.

‘তুই আমার শেষ ভরসা ছিলি, দোস্ত। আর শেষ পর্যন্ত এখন তুইও হার মেনে নিলি?’

আদিদের গলার স্বর আটকে আসছে। তার সবটুকু আশাও এবার যেন শেষ হয়ে গেল। ফোনের ওপাশ থেকে কেউ বললো,

‘আমার সবটুকু দিয়ে আমি ট্রাই করেছি, কিন্তু আমি পারিনি। এমন কোনো জায়গা নেই যেখানে আমি ওকে খুঁজিনি। তুই বিশ্বাস কর দোস্ত, সারা দেশে আমার পরিচিত যত ডিটেক্টিভ ছিল, সবার কাছে আমি সাহায্য নিয়েছি কিন্তু তাও লাভের লাভ কিছুই হয়নি। তুই হয়তো জানিস না আমি এই কেইসটা নিয়ে ফরেইনার কিছু ডিটেক্টিভদের সাথেও কথা বলেছি। তারাও অনেক চেষ্টা করেছেন। কিন্তু আ’ম সরি টু সে দ্যাট, উই অল আর ফেইলড। আমার পক্ষে আর কিছু করা সম্ভব না, দোস্ত। ক্ষমা করিস আমায়।’

আদিদ স্তব্ধ হয়ে গেল। তবে কি আর কোনোভাবেই সে সুজানা-কে খুঁজে পাবে না। এত ভাবে খুঁজেছে সে সুজানা-কে, এই এক বছর পাগলের মত হন্য হয়ে ঘুরে বেড়িয়েছে এদিক ওদিক তাও সে পায়নি তাকে। শেষ ভরসা তার এই বন্ধু। কিন্তু সেও এখন হাল ছেড়ে দিয়েছে। সুজানা-কে খুঁজে পাওয়ার শেষ আলোটাও যে নিভে গেল এবার। আদিদ চোখ বুজল। ভাঙ্গা গলায় বললো,

‘ফোন’টা রাখ।’

রাখ বলে সে আর অপর পাশের ব্যক্তির ফোন কাটার অপেক্ষা করলো না নিজেই কল’টা কেটে দিল। তারপর সেই ফোন’টা ছুঁড়ে মারল বিছানার উপর। ফ্লোরে সটান হয়ে শুয়ে পড়ল। তার ছোটোবেলা থেকেই এই অভ্যাস। যখনই তার খুব মন খারাপ হয়, খুব কষ্ট হয় তখনই সে রুমে এসে ফ্লোরে শুয়ে পড়ে। কেন যেন সেই মুহুর্তে ফ্লোরে শুয়ে থাকতে তার ভীষণ ভালো লাগে। মনে হয় মনটা হালকা হয়েছে।

মাথার নিচে দু’হাত রেখে সে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে তার দেয়ালে টানানো সুজানার ছবিগুলোর দিকে। আজ যদি মেয়েটা থাকতো তবে সে তার কলিগ হতো। আর তো কেবল এক বছরই ছিল তার ইন্টার্নি শেষ করার। তারপর সে একজন ডক্টর হিসেবে তার হপিটালে জয়েন করতে পারতো। আর তারপর..তারপর দুজনের কত শত প্ল্যানিং ছিল। সুজানার ইচ্ছে ছিল ডাক্তার হিসেবে জয়েন করার পর পরই তারা বিয়ে করবে। তারপর দুই ডাক্তার দম্পতি মিলে চুটিয়ে সংসার করবে। কিন্তু তার মাঝেই হুট করে কী থেকে কী হয়ে গেল। তবে আদিদের এখনও মনে আছে, সুজানা হারিয়ে যাওয়ার আগে সবসময়ই তাকে কী যেন বলতে চাইতো। কিন্তু কোনোভাবেই সেটা সে বলে উঠতে পারতো না। আর আদিদও কখনো তাকে সেটা বলার জন্য জোর করেনি। আদিদের এখন মনে হচ্ছে, যদি একবার সে সেই কথাটা শুনতে পারতো, তাহলে হয়তো সুজানা-কে তার আজকে হারাতে হতো না। নিশ্চয়ই সুজানা এমন কিছু তাকে বলতে চাইছিল যেটা তার হারিয়ে যাওয়ার জন্য দায়ী..

চলবে..

#পদ্মফুল
#জান্নাতুল_ফারিয়া_প্রত্যাশা
|১৩|

কিছুক্ষণ আগে আদিদ বেরিয়ে গেছে। রুবি হোসেন তাকে খুব করে বলছিলেন, দুপুরের খাবার খেয়ে বেরুনোর জন্য কিন্তু তার তাড়া ছিল ভীষণ, তাই সকালের নাস্তা কোনোরকমে খেয়েই বেরিয়ে পড়লেন হসপিটালের উদ্দেশ্যে।
পদ্ম হাতে কফির মগ’টা নিয়ে নিজের রুমে ফিরে এলো। নিচে তখন ও রুবি হোসেন আর আকবর সাহেব বসে কথা বলছিলেন আর কফি পান করছিলেন। রুবি হোসেন যদিও পদ্ম-কে উনাদের সাথে বসে গল্প করতে বলেছিলেন কিন্তু পদ্ম’র কাছে আকবর সাহেবের ঐরকম ঘুরঘুর করে তাকানো’টা পছন্দ হচ্ছিল না বিধেয় সে রুমে চলে এসেছে। সে বুঝে উঠতে পারে না, লোকটা আসলে কেমন, কিংবা তিনি কী চান। একবার উনার ব্যবহার দেখলে মনে হয় উনার চেয়ে ভালো মানুষ বোধ হয় দুনিয়াতে আর নেই, আর একবার উনার তাকানোর ধরণ আর কথা বলার ভঙ্গিমা দেখলে মনে হয়, উনার চেয়ে কুৎসিত মনের মানুষ বোধ হয় আর একটাও হয় না। কিন্তু আদৌ ঐ মানুষ’টা কেমন, সেটাই সে বুঝে উঠতে পারছে না।

কফির মগ’টা নিয়ে নিচে নামে পদ্ম। গিয়ে দেখে নিচে কেউ নেই। পদ্ম রান্নাঘরে ঢুকে। খালা দুপুরের রান্নার আয়োজন করছে। পদ্ম মগ’টা ধুয়ে এক সাইডে রেখে খালা-কে গিয়ে বললো,

‘খালা, আমি একটু সাহায্য করবো?’

খালা মুখ কালো করে তাকাল, যেন পদ্ম এই প্রশ্ন করে খুব বড়ো অপরাধ করে ফেলেছে। পদ্ম তখন বোকা বোকা হেসে বললো,

‘আরে খালা রেগে যাচ্ছো কেন? ঠিক আছে আমি আর সাহায্য করার কথা বলবো’ই না। তুমি একাই সামলাও সবকিছু। আমি উপরে গেলাম,,’

পদ্ম ফিরে যেতে নিলেই খালা তাকে আবার ডাকল। পদ্ম চমকে পেছন ফিরে তাকাল। সে চমকিয়েছে এইজন্য যে, সে এই বাড়িতে আসার পর থেকেই এই খালার সাথে অনেকবার কথা বলার চেষ্টা করেছে; কিন্তু কোনো এক অজানা কারণে খালা কোনোভাবেই তার সাথে কথা বলতে চায় না। আজ প্রথম তিনি তাকে ডাকলেন। পদ্ম ভীষণ খুশি যেন। সে খালার কাছে গিয়ে বললো,

‘কিছু বলবে খালা?’

খালা তার চোখ মুখ কুঁচকে বললো,

‘তুমি খুব ভালা মাইয়া। আর খুব বেকুব ও। মানুষরে খুব সহজেই বিশ্বাস করে ফেল। এই অতি বিশ্বাসের ফল একদিন তোমারে ঠিকই ভোগ করতে হইব মাইয়া। সাবধানে থাইকো।’

পদ্ম হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে রইল। খালা এইসব কী বললো। পদ্ম খালা’র দিকে বিভোর দৃষ্টিতে তাকালো। বললো,

‘খালা, এসব কী বলছেন আপনি? যদি কিছু বলতে চান তবে সরাসরি বলুন, এইভাবে ঘুরিয়ে পেঁচিয়ে বললে কিভাবে বুঝবো?’

‘ওকে কী বলার কথা বলছো, পদ্ম?’

দরজার দিকে তাকিয়ে দেখল রুবি হোসেন দাঁড়িয়ে আছেন। উনাকে দেখে খালার যেন প্রাণ যায় যায়। উনি কাঁপাকাঁপা গলায় অস্থির হয়ে বলতে লাগলেন,

‘না না খালাম্মা, কিছু না। আসলে ও একটা রান্না শিখতে চায়, তাই ঐডার কথায় আমারে জিগ্যেস করছিলো।’

পদ্ম’র কেন যেন মনে হলো এখন খালার কথার সাথে তাল না মেলালে উনি হয়তো বিপদে পড়ে যাবেন। তাই সেও বলে উঠল,

‘হ্যাঁ, বড়ো মা। আমি খালা-কে একটা রান্নার কথাই জিগ্যেস করছিলাম।’

রুবি হোসেনের কথা’টা হয়তো বিশ্বাস হলো না। তিনি কিছুটা রাগ দেখিয়ে বললেন,

‘পদ্ম তুমি তোমার রুমে যাও।’

পদ্ম কোনো কথা না বলে চুপচাপ নিজের রুমে চলে যায়। পদ্ম চলে যেতেই রুবি হোসেন খালার দিকে এগিয়ে গেলেন। খালা ভয়ে জমে গিয়েছেন। রুবি হোসেন তার কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিসিয়ে বললেন,

‘আমার নুন খেয়ে আমার সাথেই বেইমানি করতে চাইছিস? এত সাহস কিন্তু ভালো না,,,’

খালা বুক ধরফর করছে। তিনি হাত জোড় করে করে কাঁদো কাঁদো গলায় বললেন,

‘বিশ্বাস করেন খালাম্মা, আমি ঐ মাইয়ারে কিচ্ছু বলি নাই। আর জীবনেও কিছু বলমু না। একেবারে আমার পোলার কসম।’

রুবি হোসেন বাঁকা হেসে বললেন,

‘কথা’টা যেন মনে থাকে।’

খালা ভয়ে ভয়ে মাথা নাড়ালেন। তারপর রুবি হোসেন হনহন করে বেরিয়ে পদ্ম’র রুমে গেলেন।

.
.

পদ্ম ওয়াশরুম থেকে বেরিয়ে বিছানায় রুবি হোসেন-কে বসে থাকতে দেখল। সে তাই ধীর পায়ে তার সামনে গিয়ে দাঁড়াল। রুবি হোসেন এতক্ষণ পদ্ম’র জন্য অপেক্ষা করছিলেন। পদ্ম-কে দেখে বললেন,

‘বসো মা।’

পদ্ম উনার পাশে বসলো। উনি তখন পদ্ম’র মাথায় হাত রেখে বললেন,

‘তখন ঐভাবে বলাতে কি খুব খারাপ লেগেছে তোমার?’

‘না না বড়ো মা, আমার একটুও খারাপ লাগেনি। তোমার যেটা পছন্দ নয় সেটা আমি করবো না। তোমার বারণ থাকলে আমি আর খালার সাথে কথা বলবো না, সমস্যা নেই।’

‘কথা কেন বলবে না? কথা বলতেই পারো। আমার তাতে কোনো আপত্তি নেই। তবে বোঝই তো গ্রামের মহিলা খুব কথা লাগায়। তুমি এই বাড়িতে আসার পর তোমাকে নিয়েও অনেক কথা আমাকে বলেছে। আজ নিশ্চয়ই তোমার কাছে আমাদের নিয়ে কিছু বলতে চাইছিল? ওর অভ্যাস’ই এটা। খালি এর কাছে ওর কথা লাগানো। তাই ওর কথায় গুরুত্ব দিও না। নয়তো ও পুরোপুরি তোমার ব্রেইন ওয়াশ করে ফেলবে।। বুঝেছো তো আমার কথা?’

পদ্ম কিছু না বোঝা সত্ত্বেও মাথা নাড়িয়ে বললো,

‘হ্যাঁ, বুঝেছি।’

রুবি হোসেন হেসে বললেন,

‘এই তো আমার বুদ্মিমতী মেয়ে, সহজেই সবকিছু বুঝে ফেলে।’

.

ডাইনিং এ বসে সবাই দুপুরের খাবার খাচ্ছে। পদ্ম’র বরাবর চেয়ার’টাতে আকবর সাহেব বসেছেন। উনি খাচ্ছেন কম পদ্ম’র দিকে তাকাচ্ছেন বেশি। পদ্ম ব্যাপারটা খেয়াল করেছে অনেক আগেই। এক পর্যায়ে সে আর না পেরে আকবর সাহেব-কে জিগ্যেসই করে বসলো,

‘আপনি কি কিছু বলবেল আমায় আংকেল? না, আসলে তখন থেকে ঐভাবে তাকিয়ে আছেন তো তাই জিগ্যেস করলাম। আপনার কিছু বলার হলে বলতে পারেন।’

বিষম খেলেন আকবর সাহেব। পানি খেয়ে গলা ভিজিয়ে বললেন,

‘কক-ক-কই না তো। আমি তো দেখছিলাম তুমি ঠিক ভাবে খাচ্ছো কিনা? এই এক তরকারি দিয়েই তো সব খেয়ে ফেলছো, এটাও একটু ট্রাই করো; বেশ মজা হয়েছে কিন্তু।’

কথা’টা বলে তিনি একবার রুবি হোসেনের দিকে আড়চোখে তাকালেন। রুবি হোসেনের রক্তিমা অক্ষিযুগল দেখে তিনি ঢোক গিলে ফটাফট নিজের খাবার খেতে লাগলেন। পদ্ম আর কথা বাড়াল না। নিজের খাওয়ায় আবার মনোযোগ দিল।

দুপুরের খাবারের পর্ব শেষে সবাই যার যার রুমে গেল। রুবি হোসেন রুমে ঢুকেই দরজাটা ঠাস করে লাগিয়ে দিলেন। আকবর সাহেবের শার্টের কলার ধরে ক্ষিপ্ত কন্ঠে বলতে লাগলেন,

‘কচি মেয়ে দেখলেই লাফালাফি শুরু হয়ে যায়, না? এর আগেও এমন অনেক কমপ্লেইন এসেছে, কিচ্ছু বলেনি জাস্ট সাবধান করে গিয়েছি। এবারও যদি কিছু উল্টা পাল্টা করেছো, তাহলে কিন্তু খুব খারাপ হয়ে যাবে বলে রাখলাম।’

কলার থেকে বউয়ের হাত সরিয়ে আকবর সাহেব আহ্লাদী গলায় বললেন,

‘আরে বউ, তুমি এত সিরিয়াস হচ্ছো কেন? আমি তো শুধু তোমার জেলাসি লেভেল’টা চেক করছিলাম। তুমি কিন্তু একেবারে আগের মতোই রয়ে গেছো, আমার জেলাসি কুইন।’

‘হয়েছে আর ঢং না করে পরের প্ল্যানিং বলো, কবে কী করবে? আমি আর কাউকে বসিয়ে বসিয়ে খাওয়াতে পারবো না, বুঝলে?’

চলবে…