পদ্মফুল পর্ব-৯+১০

0
289

#পদ্মফুল
#জান্নাতুল_ফারিয়া_প্রত্যাশা
।৯।

পদ্ম ক্যালেন্ডারের পাতার দিকে তাকিয়ে অবাক হলো। এক সপ্তাহ হয়ে গিয়েছে? সাত’টা দিন এত তাড়াতাড়ি কী করে চলে গেল? তার তো মনে হচ্ছে এই তো দু’দিন আগে সে এই বাড়িতে এসেছে এর মাঝেই এক সপ্তাহ শেষ। আশ্চর্য!

পদ্ম বারান্দায় যায়। দুপুরের উষ্ণ গরম। এইখান থেকে দাঁড়িয়ে দেয়ালের ওপারের দৃশ্য খুব একটা দেখা যায় না। পদ্ম গেইটের দিকে তাকিয়ে আছে। একটা বৃদ্ধ দারোয়ান গেইটের একপাশে একটা কাঠের টুলে বসে ঝিমাচ্ছে। এই ভর দুপুরে কেউ এইভাবে ঝিমায়? পদ্ম তার দৃষ্টি ফিরিয়ে নেয়। ডানদিকের বাগান’টার দিকে তাকিয়ে দেখে লাল রঙের যে নয়নতারা গাছ’টা নতুন লাগানো হয়েছিল সেটাতে ফুল ধরেছে। টকটকে লাল নয়নতারা। পদ্ম ফুলগুলোকে গভীরভাবে কিছুক্ষণ পর্যবেক্ষণ করে নিজের রুমে ফিরে এলো। কী ভেবে সে ড্রেসিং টেবিলের আয়নার সামনে গিয়ে দাঁড়াল। এক সপ্তাহ আগে এই বাড়িতে আসার পর প্রথম যে প্রতিচ্ছবি’টা এই আয়নায় ফুটে উঠেছিল তা আজকের প্রতিচ্ছবি থেকে ভিন্ন। পদ্ম নিজেকে দেখে খুব অবাক হলো। এই এক সপ্তাহেই কেমন নাদুসনুদুস হয়েছে। গালের মাংস বেড়েছে তার। গায়ের রঙ’টাও যেন খানিক উজ্জ্বল হয়েছে। হবে না, এত ভালোবাসা আর যত্ন পেলে তো সবাই এমন প্রাণবন্ত হয়ে উঠে। বাবা মা মা/রা যাওয়ার জীবনের এই সাত’টা দিন’ই কেবল সে এত বেশি ভালো থাকতে পেরেছে। রুবি হোসেনের এই অগাধ ভালোবাসা তাকে ক্ষণে ক্ষণে মুগ্ধ করেছে। তার সাথে করেছে লজ্জিত। এমন একটা মানুষকে সে প্রথমে বিশ্বাস করতে পারছিল না। অথচ এই মানুষ’টাই তাকে মায়ের মতো করে আগলে রেখেছে। এতটা যত্ন আর এতটা ভালোবাসা আগে কখনো পায়নি সে। হয়তো ধৈর্য ধরেছিল বলেই আজকের এই দিনটি তার জীবনে এসেছে। সে তাই খুব করে চায় বাকি দিনগুলোতেও এইভাবেই ভালো থাকার জন্য..বাকিটা সৃষ্টিকর্তার ইচ্ছা।

‘পদ্ম, আসবো?’

রুবি হোসেনের কন্ঠ শুনে দরজার দিকে তাকায় পদ্ম। ঠোঁট জোড়া প্রসারিত করে হেসে বলে,

‘এসো বড়ো মা।’

রুবি হোসেন রুমের ভেতর গিয়ে বিছানায় বসলেন। পদ্ম-কে ডেকে বললেন,

‘বসো এখানে।’

পদ্ম তার পাশে বসলো। রুবি হোসেন মোলায়েম তখন তাকে কন্ঠে জিগ্যেস করলেন,

‘তোমার এখানে থাকতে কোনো অসুবিধা হচ্ছে না তো?’

পদ্ম সরব গলায় বললো,

‘বড়ো মা, এত এত ভালোবাসার পাওয়ার পরও কি কোনো অসুবিধা হতে পারে? তুমি আমাকে নিজের মেয়ের জায়গা দিয়েছো, এতটা তো আমার প্রাপ্য ছিল না। কিন্তু আমি পেয়েছি, তুমি দিয়েছো আমায়। এই এক সপ্তাহেই দেখো না, তোমার এত এত ভালোবাসা পেয়ে আমি কিভাবে ফুলে গিয়েছি। দুদিন পর দেখবে ফুলতে ফুলতে বেলুন হয়ে গিয়েছি। এখন থেকে একটু কম কম খাওয়াবে, বুঝলে?’

রুবি হোসেন হেসে ফেললেন। বললেন,

‘হুম, খুব পাজি হয়েছো। না বললে তো কিচ্ছু খাও না, আমার বলে ফুলে নাকি বেলুন হয়ে গিয়েছে। ওহ আচ্ছা, যেটা বলতে এসেছিলাম: আদিদের বাবা আসছে। এতদিন সিলেট তিনি ছিল ব্যবসার কাজে। মাত্রই রওনা দিয়েছে। আসলে ওকে আমি তোমার কথা কিছু বলেনি। তবে চিন্তা করো না, প্রথমে হয়তো একটু রিয়েক্ট করবে কিন্তু পরে আমি ঠিক ওকে ম্যানেজ করে নিব।’

পদ্ম’র মুখটা কালো হয়ে গেল। মানে এতসব ঘটনা কিছুই ডাক্তারবাবুর বাবা জানেন না। এখন যদি উনি এসে বড়ো মা’র উপর খুব রাগ দেখান? রাগ দেখাবেন এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু পদ্ম’র খারাপ লাগছে, তার জন্যই তো এখন আবার বড়ো মা’কে এসব সহ্য করতে হবে। পদ্ম মাথা নুইয়ে আস্তে করে বললো,

‘আমি চলে যাই, বড়ো মা?’

‘একদম না। তোমার চলে যাওয়ার কোনো প্রশ্নই আসে না। আরে বোকা মেয়ে, তুমি ভয় পাচ্ছো কেন? আদিদের বাবা কিচ্ছু বলবেন না, আর আমি আছি তো, একদম টেনশন নিও না।’

পদ্ম মাথা তুলে ভয়ে ভয়ে বললো,

‘আংকেল যদি রেগে গিয়ে আপনাকে কিছু বলে?’

রুবি হোসেন হেসে বলেন,

‘তোমার আংকেল রাগ দেখাবে তাও আমার সাথে? আমি উল্টো ওর সাথে রাগ দেখায়। আমি চোখ গরম করে তাকালে তো বেচারা একেবারে ভেজা বেড়াল হয়ে যায়।’

পদ্ম হেসে ফেলল। রুবি হোসেনও তার সাথে তাল মিলিয়ে হাসলেন। তারপর বললেন,

‘গোসল সেরে নিচে এসো। একসাথে খাবো।’

রুবি হোসেন কথা’টা বলে রুম থেকে বেরিয়ে যাচ্ছিলেন পদ্ম তখন তাকে হঠাৎ ডেকে উঠল,

‘বড়ো মা!’

রুবি হোসেন ঘুরে তাকিয়ে বললেন,

‘কিছু বলবে?’

পদ্ম আমতা আমতা করে বললো,

‘না মানে, ডাক্তারবাবু কি আজকে আসবেন? আ-আংকেল না আসবেন, তাই বলছিলাম আর কী।’

‘হ্যাঁ, বলেছে তো আসবে। এখন বাকিটা ওর মর্জি।’

‘ওহহ।’

‘ঠিক আছে, তাহলে তুমি গোসল করে নাও। আমি আমার রুমে যাচ্ছি।’

সেই যে ডাক্তারবাবু তাকে এই বাড়িতে রেখে গিয়েছে তারপর আর তার কোনো দেখা মেলেনি। উনি কি রাত দিন ঐ হসপিটালেই কাটান? কী করে থাকেন ঐখানে? অবশ্য উনার তো অভ্যাস হয়ে গিয়েছে তাই হয়তো সমস্যা হয় না। কিন্তু তাও সপ্তাহে দু থেকে তিন বার অন্তত উনার বাড়িতে আসা উচিত। বাড়ি তো আর বেশি দূর না, এক ঘন্টার পথ। চাইলেই তো আসতে পারেন। পদ্ম তখন পরক্ষণেই আবার মনে হলো, উনি উনার রোগীদের প্রতি যে সিরিয়াস, উনার কাছে হয়তো এই এক ঘন্টায় অনেক কিছু। এই ব্যাপার’টা অবশ্য পদ্ম’রও ভীষণ ভালো লাগে। যদিও তিনি বাড়িতে আসেন না কিন্তু মায়ের সাথে কথা বলার সময় পদ্ম’র খোঁজ ঠিকই নেয়। ভাবতে ভাবতেই তার হঠাৎ করেই হাসি পেয়ে গেল। সে কী ভেবে যেন তখন তার কপালে হাত দেয়। সেইদিন কী করেছিল সে। সামান্য সেলাই খোলার সময় সেকি কান্না। পদ্ম’র বাচ্চাদের মতো কান্না দেখে এক পর্যায়ে ডাক্তারবাবু হেসে ফেলেছিলেন। আর সেদিনই প্রথমবারের মতো ডাক্তারবাবুর উপর চোখ আটাকেছিল তার। এর আগে কখনো কোনো পুরুষ মানুষের হাসি এতটা ভালো লাগেনি যতটা সেদিন ডাক্তারবাবুর হাসি তার ভালো লেগেছিল। যদিও সেই হাসির স্থায়িত্ব কেবল কয়েক সেকেন্ড ছিল কিন্তু ঐ কয়েক সেকেন্ড’ই পদ্ম’র মনে কয়েক যুগের তীব্র যন্ত্রণা ধরিয়ে দিয়েছিল। পদ্ম জানে না এটা কিসের যন্ত্রণা। কিন্তু প্রায়’ই সে এটা টের পায়। অল্প কিছুক্ষণ থেকে আবার ভালো হয়ে যায়। আর কিছু জানুক বা না জানুক এইটুকু সে ঠিকই জানে, এই যন্ত্রণাকে তাকে বাড়তে দেওয়া যাবে না। নয়তো এই ফলে একদিন তার হৃৎপিণ্ড ক্ষতবিক্ষত হয়ে যাবে।
.
.

বাইরে গরম কিছুটা কমেছে। আকাশের পশ্চিম পাশটা এখন একটু বেশিই লালিমা হয়ে আছে। দুপুরে ক্লান্তি ক্ষণের পর প্রকৃতি এখন হয়তো কিছুটা বিশ্রাম নিচ্ছে। এই সময়টা বিশ্রামের সময়। এক গাদা কাজ শেষে খেয়ে দেয়ে সকলে বিছানায় যায় একটু আরামের উদ্দেশ্যে। কেউ কেউ আবার আরাম খুঁজতে খুঁজতে ঘুমিয়েও যায়। ক্লান্তি শরীরে সেই একটু ঘুম পরবর্তীতে মনকে চাঙা করে তোলে। কি জানি আদৌ তুলে কিনা। পদ্ম’র এই সময় ঘুম পায় না, তাই সে জানে না। তবে হসপিটালে থাকা অবস্থায় বিকেলে হয়তো একবার ঘুমিয়েছিল সে, যদিও তার মনে পড়ছে না এতকিছু। তার আবার এত ক্লান্তি আসে না। সে এখন বসে বসে বই পড়ছে। বই পড়ছে বললে ভুল হবে। বইয়ের মাঝে কাউকে একটা দেখছে সে। একটা মেয়েকে। চমৎকার দেখতে মেয়েটা। কিন্তু কে এই মেয়েটা? আর এই বইয়ের মাঝেই বা এই মেয়েটার ছবি কী করে এলো?

চলবে…

#পদ্মফুল
#জান্নাতুল_ফারিয়া_প্রত্যাশা
।১০।

পদ্ম সিঁড়ির কাছে গিয়ে হালকা উঁকি দিল। সোফার রুমে সুঠাম দেহী এক ভদ্রলোক-কে তখন দেখল সে। তাহলে উনি’ই ডাক্তারবাবুর বাবা। ভদ্রলোকের যে বয়স হয়েছে সেটা উনাকে দেখে বোঝার যো নেই। সেই কী কঠিন ভাবভঙ্গি উনার। স্বামী স্ত্রী দুজনেই হয়েছেন সমান তালে সুদর্শন সুদর্শনা। আর উনাদের ছেলে…তাকে নিয়ে পদ্ম আর কিছু ভাবল না। তার তো দুশ্চিন্তা অন্য জায়গায়। ভদ্র লোক বাসায় এসেছে অনেকক্ষণ। আসার পর থেকেই রুবি হোসেন তাকে বুঝিয়ে যাচ্ছেন। কিন্তু উনি আদৌ উনার কথা শুনবেন কিনা কে জানে। এতক্ষণ তো হয়ে গেল, এখনো তো তিনি পদ্ম’র সাথে দেখা করার কথা বলছেন না। পদ্ম উপরে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কেবল টেনশন’ই করছে। নিচের কথোপকথন কিছুই সে শুনতে পারছে না। কিছু শুনলে তো অন্তত এইটুকু বুঝতে পারতো আবহাওয়া গরম না ঠান্ডা।

পদ্ম তার রুমে ফিরে যায়। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখে ছয়’টা বাজে। বাইরে সন্ধ্যা নেমেছে। সূর্য হারিয়ে গিয়েছে বেশিক্ষণ হয়নি। এর মাঝেই গাড়ির হর্ণ শুনতে পেল সে। দৌড়ে বারান্দায় গেল। বড়ো গেইট’টা আবার খুলতে দেখেই কেন যেন খুব খুশি লাগল তার। গেইট খোলার সঙ্গে সঙ্গেই ভেতরে প্রবেশ করলো কালো রঙের একটা গাড়ি। ডাক্তারবাবু চলে এসেছেন। এবার যেন কিছুটা হলেও সাহস পাচ্ছে সে। সে তার রুমে এসে আয়নার সামনে দাঁড়ায়। নিজেকে ভালোভাবে খেয়াল করে মাথার চুলগুলো হাত দিয়ে ঠিক করে নেয়। পরে হঠাৎ তার মনে হলো, এসব কেন করছে সে। ডাক্তারবাবু এসেছে এটা নিয়ে এত খুশি হওয়ার কী আছে। পদ্ম নিজেকে নিজে ধমক দিয়ে উঠে, “নিজের লিমিট ক্রস করিস না পদ্ম, ভুলে যাস না তুই এই বাড়ির আশ্রিতা।”

নিজের মনকে বুঝিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলে সে। মনে মনে বলে, “ঐসব প্রেম ভালোবাসা তোর জন্য না পদ্ম। তোর তো দু বেলা পেট ভরে খেতে পারলেই চলে।”

অনেকটা সময় রুমে বসে কাটানোর পর পদ্ম’র মনে হলো এবার একটু বাইরের খবর’টা নেওয়া উচিত। কী জানি বাইরে কী হচ্ছে। পদ্ম বাইরে যাওয়ার জন্য দরজার কাছে যেতেই সিঁড়ি থেকে কিছু মানুষের গলা শুনতে পেল সে। তার মানে সবাই উপরে উঠছে। পদ্ম এক দৌড়ে বিছানায় গিয়ে বসে পড়ে। কথার শব্দগুলো আস্তে আস্তে আরো কাছে আসতে থাকে। এক সময় তার দরজার সামনে এসেই সবকিছু নিরব হয়ে যায়। তখন রুবি হোসেনের ঠান্ডা গলার স্বর শোনা গেল,

‘পদ্ম, আসবো?’

পদ্ম ছোট্ট ঢোক গিলে বললো,

‘জ-জ্বি বড়ো মা, এসো।’

সবাই একে একে ভেতরে ঢুকল। পদ্ম ভীষণ অস্বস্তিতে পড়ে গেল যেন। সে অপরাধীর মতো এক কোণে গিয়ে দাঁড়াল। অস্বস্তিতে সামনের মানুষগুলোর দিকে তাকাচ্ছে না পর্যন্ত। রুবি হোসেন বললেন,

‘ওই হচ্ছে পদ্ম। ওর কথায় তোমাকে বলেছিলাম। ভারি মিষ্টি না মেয়েটা?’

আলী আকবর হোসেন পদ্ম’র আপাদমস্তক পরখ করে নিয়ে বললেন,

‘হ্যাঁ, ঠিক বলেছো। তা মা, কেমন আছো তুমি?’

পদ্ম চমকে তাকাল। এক রাশ বিস্ময় নিয়ে বললো,

‘জ্বি আংকেল, ভালো। আপনি ভালো আছেন?’

‘হ্যাঁ, আমিও খুব ভালো আছি। তোমার কথা রুবি আমাকে সব বলেছে। শুনে আমার খুব খারাপ লেগেছে জানো তো। এইরকম একটা মেয়েকে কেউ এত কষ্ট দেয়। তবে তুমি চিন্তা করো না, এখন থেকে তোমাকে আর কোনো কষ্ট পেতে হবে না। এই বাড়িতে তুমি আমাদের মেয়ে হয়ে থাকবে।’

পদ্ম বাকরুদ্ধ হয়ে গিয়েছে। উনি এত সহজে সবটা মেনে নিলেন? একটুও রিয়েক্ট করলেন না? এই মানুষগুলোকে পদ্ম যত দেখছে ততই অবাক হচ্ছে। আজ কালকার পৃথিবীতে এত ভালো মানুষ হয়?

পদ্ম বিনয়ের সুরে বললো,

‘আমি আপনাদের কাছে কৃতজ্ঞ থাকবো। আপনারা ভীষণ ভালো মানুষ। আপনাদের মতো মানুষ আছে বলেই হয়তো আমাদের মতো অসহায়েরা এখনও পৃথিবীতে বেঁচে আছে।’

‘এইভাবে বলছো কেন মা? আমাদের মেয়ে হলে আমরা দেখতাম না তাকে? তাহলে তোমাকে দেখতে কেন অসুবিধা হবে। এই বাড়ি’টাকে নিজের মনে করে থাকো। আর কোনো কিছুতে কোনো লজ্জা পেতে হবে না, ঠিক আছে?’

পদ্ম মাথা হেলিয়ে বললো,

‘আচ্ছা।’

‘ঠিক আছে তাহলে, তুমি থাকো আমি একটু রুমে গিয়ে রেস্ট নেই।’

‘আচ্ছা আংকেল।’

রুবি হোসেন আর আকবর সাহেব পদ্ম’র রুম থেকে বেরিয়ে গেলেন। রয়ে গেলে কেবল ডাক্তারবাবু। পদ্ম তার দিকে তাকিয়ে সৌজন্যমূলক হাসি দিল। আদিদ বললো,

‘শরীর ঠিক আছে আপনার, মাথায় আর কোনো ব্যথা নেই তো?’

‘না, এখন একদম ঠিক আছি।’

‘আচ্ছা। আর এই বাড়িতে থাকতে কোনো অসুবিধা বা কোনো সমস্যা হচ্ছে না তো?’

‘একদমই না।’

‘হুম, মা বলেছে, আপনি আসার পর থেকে নাকি মায়ের সময় খুব ভালো যাচ্ছে। আপনি নাকি মায়ের খুব খেয়াল রাখেন, শুনে ভালো লাগল।’

পদ্ম মাথা নিচু করে আলতো হাসল। আদিদ আবার বললো,

‘উম, তাহলে আমিও এবার যাই আমার রুমে। ফ্রেশ হতে হবে।’

পদ্ম চোখের পল্লব তুলে তাকাতেই আদিদের পিঠ দেখতে পেল। সে ইতিমধ্যেই রুম থেকে বেরিয়ে গিয়েছে। পদ্ম ভারি নিশ্বাস ফেলে বিছানায় বসে। মন যে তার কেন এমন করছে কে জানে। পদ্ম মনে মনে তাচ্ছিল্যের হাসি দিয়ে বলে, “আমার এই মনের অসুখ কে সারাবে, ডাক্তারবাবু?”

পদ্ম রান্নাঘরে। খুব যত্ন করে দু কাপ কফি বানাল সে। তারপর কাপ দুটো স্ট্রে’তে নিয়ে উপরে গেল, আদিদের রুমে। দরজায় টোকা দিয়ে বলেলো,

‘আসবো?’

‘হুম।’

অনুমতি পেয়ে পদ্ম ভেতরে যায়। অদ্ভুত ভাবেই সামনের মানুষটিকে দেখা মাত্রই অক্ষিজোড়া তার থেমে যায়। কিছুক্ষণ সেই দৃষ্টি আটকে থাকে সেখানেই। মস্তিষ্কে নিউরনগুলো জেগে উঠতেই বুকের ভেতরে ঢিপ ঢিপ করে উঠে। সঙ্গে সঙ্গে সেই দৃষ্টি সংকোচন করে নেয় সে। মস্তিষ্ক নতুন কোনো কিছু হঠাৎ করে দেখতে অভ্যস্ত নয়। ডাক্তারবাবুর এই নতুন সাজ মস্তিষ্কে তাই সেট হতে কিছুক্ষণ সময় লাগবে। সবসময় ফর্মাল গেট আপে দেখা মানুষটাকে আজকে হঠাৎ একটা টাউজার আর টি শার্টে মোড়ানো দেখে অন্যরকম লাগছে। লাগাটাই অবশ্য স্বাভাবিক।

পদ্ম কফি নিয়ে ডাক্তারবাবুর কাছে এগিয়ে যায়। গিয়ে বলে,

‘কফি, ডাক্তার বা…ড-ডাক্তার সাহেব।’

আদিদ ঠোঁটের কোণে কিঞ্চিত হাসির রেশ ফুটিয়ে বললো,

‘থ্যাংক ইউ, এটার খুব প্রয়োজন ছিল।’

পদ্ম প্রতিত্তুরে তাকে ধন্যবাদ জানাল। কফির কাপে চুমুক দিয়ে আদিদ বললো,

‘বাহ! দারুণ হয়েছে তো।’

‘সত্যি!’

পদ্ম’র কন্ঠে খানিক উত্তেজনা। আদিদ আরেকবার চুমুক দিয়ে বললো,

‘হ্যাঁ। আপনি খাচ্ছেন না কেন?’

পদ্মও তখন কফির কাপে চুমুক দিল। আদিদ তার দিকে তাকিয়ে বললো,

‘এখানে বসে খান।’

পদ্ম বসলো। কফির কাপে চুমুক দিতে দিতে এবার সে আদিদের পুরো রুম’টা চোখ বুলালো। যেহেতু সে এই রুমে প্রথম এসেছে তাই এখানের সবকিছুই তার কাছে নতুন লাগছে। তবে হঠাৎ করেই একটা জিনিসের দিকে তার চোখ আটকে গেল। কফি খাওয়া রেখে সে দাঁড়িয়ে পড়ল। বিছানার ডান দিকের দেয়ালে কিছু দেখেছে সে। কারো ছবি। একটা মেয়ের ছবি। পদ্ম কাছে গিয়ে খুব মনোযোগ দিয়ে দেখছে ছবিগুলো। মস্তিষ্কে জোর দিতেই তার মনে পড়ল এটা তত সেই মেয়েটা যার ছবি সে বিকেলে ঐ বইটা থেকে পেয়েছিল। এই মেয়েটার ছবি ডাক্তারবাবুর রুমের দেয়ালে কী করছে? মেয়েটা ডাক্তারবাবুর কী হয়? খুব কাছের কেউ? পদ্ম পেছন ফিরে আদিদের দিকে তাকাল। আদিদ কফি খাচ্ছে আর ল্যাপটপে কি কী যেন করছে। পদ্ম তখন নিজের মনকে স্থির করে আদিদ-কে ডেকে উঠলো,

‘ডাক্তার সাহেব, এই মেয়েটা কে?’

আদিদ তাকাল তার দিকে। তারপর আবার তাকাল দেয়ালের ছবিগুলোর দিকে। কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে চোখ সরিয়ে আবার ল্যাপটপের স্ক্রিনে দৃষ্টিপাত করলো। পদ্ম উৎসুক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে আদিদের জবাবের অপেক্ষা করছে। আদিদ মৃদু সুরে বললো,

‘ও সুজানা, আমার গার্লফ্রেন্ড।’

পদ্ম অবাক হলো না। ঘুরে দেয়ালের সেই ছবিগুলোর দিকে আবার তাকাল। মেয়েটা সুন্দর। অনেক বেশিই সুন্দর। ডাক্তারবাবুর সাথে তাকে খুব মানিয়েছে। নিশ্চয়ই উনি মেয়েটাকে খুব ভালোবাসেন নয়তো এত যত্ন করে দেয়াল জুরে উনার ছবি লাগাতেন না। পদ্ম হেসে হেসে বললো,

‘আপু’টা খুব সুন্দর। একদিন উনার সাথে আমাকে পরিচয় করিয়ে দিয়েন।’

আদিদ বিক্ষিপ্ত কন্ঠে বললো,

‘যদি কোনোদিন খুঁজে পাই, তবে অবশ্যই করাবো।’

আদিদের কথার মানে পদ্ম বুঝতে পারলো না। সে ব্রু কুঁচকে বললো,

‘খুঁজে পাবেন মানে?’

চলবে…