পদ্মফুল পর্ব-১৪+১৫+১৬

0
281

#পদ্মফুল
#জান্নাতুল_ফারিয়া_প্রত্যাশা
|১৪|

গোধূলি লগ্ন, সূর্যের রক্তিম আলোয় পশ্চিমাকাশ’টা ঝলসে আছে। সেই ঝলসানো আলোর কিছু এসে পড়ছে পদ্ম’র মুখশ্রীতে। তার তৈলাক্ত গালগুলো সেই আলোয় চিকচিক করছে। নাকের ডগায় লেগে থাকা ঘামগুলোও চিকচিক করে জানান দিচ্ছে তাদের অস্তিত্বের কথা। তার ভেজা চোখের পল্লবগুলো কাঁপছে। বুকের ভেতর’টা ঢিপঢিপ করছে তার। তাকিয়ে আছে এক দৃষ্টিতে সামনের লোহার গেইট’টার দিকে। সুযোগ বুঝে এখান দিয়ে পালাবে সে। এই বাড়িতে থাকা আর সম্ভব না। ঐ লোক’টা খুব খারাপ। এই বাড়িতে থাকলে ঐ লোক’টা তাকে শেষ করে ফেলবে। আর সে এসব কাউকে মুখ ফুটে বলতেও পারবে না। ডাক্তারবাবু আর বড়ো মা এই খারাপ মানুষটাকে ভীষণ ভালোবাসে, তাই তাদেরকে সে কখনোই বিশ্বাস করাতে পারবে না। তাই সেই চেষ্টা সে করবেও না। এই বাড়ি থেকে পালিয়ে যাওয়াই একমাত্র সমাধান।

পদ্ম তার হাত মুষ্টিবদ্ধ করে জোরে নিঃশ্বাস ফেলে। তারপর ছাদের সিঁড়ির কাছে গিয়ে দাঁড়ায়। তার তখন হঠাৎ চোখ যায় সিঁড়ির কর্ণারের একটা দরজা দেওয়া রুমের দিকে। তালাবদ্ধ রুম। তবে কেন যেন এখানটাই দাঁড়ালে একটা উটকো গন্ধ তার নাসারন্ধ্রে এসে ঠেকে। তার খুব বিচ্ছিরি লাগে এই গন্ধটা। হয়তো এই রুম’টা অনেকদিন ধরে পরিস্কার করা হয় না, তাই এই গন্ধ।

পদ্ম নিচে নেমে তার রুমে যায়। আলমারি খুলে একটা ব্যাগ বের করে। তারপর সেই ব্যাগে কিছু কাপড় ঢুকায়। তার মন’টা খচখচ করছে। কাজটা ঠিক হবে তো? ডাক্তারবাবু আর বড়ো মা খুব কষ্ট পাবেন। বিশেষ করে বড়ো মা, এই মানুষটা তো তাকে নিজের মেয়ের মতো ভালোবাসে। এইভাবে উনাকে না বলে পালিয়ে যাওয়াটা কি ঠিক হবে?

পদ্ম ব্যাগ’টা সাইডে রেখে নিচে নেমে যায়। সে নিচে গিয়ে এদিক ওদিক কাউকে খুঁজতে লাগল। কাঙ্খিত ব্যক্তিকে না পেয়ে পদ্ম দরজা খুলে বাইরে বের হলো। ডানদিকে একটা রুম আছে। পদ্ম সেই দরজায় নক করলো। কিছুক্ষণ পর দরজা খুলে খালা উঁকি দিয়ে বজ্র গলায় জিগ্যেস করলেন,

‘কী চায়?’

‘খালা, আমার আপনার সাথে কিছু কথা আছে..’

খালা চোখ মুখ কুঁচকে বললো,

‘না না, আপনার লগে আমার কোনো কথা নাই। আপনি যান তো, আজাইরা কথা বইলেন না।’

খালা পদ্ম’র মুখের উপর দরজা’টা লাগিয়ে দিল। পদ্ম বিষন্ন চোখে দরজার দিকে তাকিয়ে আছে। তার মন বলছে, খালা এমন কিছু জানে যেটা জানা তার খুব জরুরী। কিন্তু বড়ো মা তখন ওভাবে কেন রিয়েক্ট করলো? ব্যাপারটা কি সত্যিই খুব স্বাভাবিক?
পদ্ম আবার নিজের রুমের দিকে পা বাড়ায়।

সন্ধ্যা হয়ে গিয়েছে। পদ্ম’র চোখ কিছুটা লেগে গিয়েছিল। সে শোয়া থেকে উঠে বসলো। বারান্দার দিকে তাকিয়ে দেখল, চারদিক অন্ধকার। পদ্ম উঠে ফ্রেশ হতে গেল। ওয়াশ রুম থেকে বেরিয়ে সিঁড়ির কাছে গিয়ে দাঁড়াল। নিচ থেকে কিছু মানুষের গলার আওয়াজ শোনা যাচ্ছে। পদ্ম’র কাছে বড্ড পরিচিত মনে হচ্ছ সেই স্বর। পদ্ম দুই সিঁড়ি নামল। সোফার রুমে বসে থাকা মানুষগুলোকে দেখে তার আত্মা যেন কেঁপে উঠল। মামা-মামী, উনারা এখানে কী করছেন? পদ্ম ভয়ে ভয়ে নিচে নেমে গেল। পদ্ম-কে দেখা মাত্রই তার মামী ছুটে এসে তাকে জড়িয়ে ধরলেন। ন্যাকামি করে কেঁদে বললেন,

‘ওমা রে কেমন আছিস তুই? তোর কথা মনে হইলে কষ্টে আমার বুকটা তো ফাইটা যায় মা।’

পদ্ম তার মামিকে নিজের কাছ থেকে ছাড়াল। তারপর বললো,

‘শুনে ভালো লাগল যে, আমার কথা তোমার অন্তত মনে পড়ে।’

‘ওমা পদ্ম! তোর সবকিছু মনে পইড়া গেছে? ও গো দেখছ, আমাদের পদ্ম’র সব মনে পইড়া গেছে।’

পদ্ম তখন টনক নড়লো। তার মনে পড়ল, সে তো সব ভুলে যাওয়ার নাটক করছিল। ধুর, নাটক’টা চালিয়ে গেলেই তো ভালো হতো…

পদ্ম দম ফেলে বললো,

‘হ্যাঁ, মনে পড়েছে আমার। তোমাদের কি আর এত সহজে ভুলতে পারবো, বলো?’

পদ্ম তাচ্ছিল্যের হাসি দিয়ে আবার বললো,

‘তা এখানে কেন এসেছো তোমরা? আমাকে নিয়ে যাওয়ার জন্য? আমি কিন্তু এখান থেকে এক পা ও নড়বো না।’

‘না না, আমরা তোকে নিতে আসি নাই তো; তোর কথা আমাদের খুব মনে পড়েছিল তাই তোকে দেখতে আসছি মা।’

পদ্ম হাসল, যেন ভীষণ মজার কথা শুনেছে সে। সে আর কিছু না বলে সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠে গেল। ওর চলে যাওয়া দেখে মামী চোখ মুখ কুঁচকে কিছু বললো, যেটা কেউ শুনলো না।

পদ্ম’র মামা মামী বেরিয়ে গেলেন। রাত তখন আট’টা কী নয়’টা। মামা মামী বেরিয়ে যেতেই পদ্ম যেন প্রাণ ফিরে পেল। এতক্ষণ ভীষণ আতংকে ছিল সে। না জানি আবার কোন উদ্দেশ্যে এসেছেন উনারা। আর সত্যি বলতে, তার মাথায় এখনও একটা কথা বার বার ঘুরে, মামী এত সহজে কী করে মেনে নিল সবটা? আর বড়ো মা’ই এত সহজে কিভাবে তাদের মানিয়ে নিল, কিভাবে?

রাত দশ’টা,

পদ্ম বই পড়ছিল। তখন রুবি হোসেন তার রুমে এলেন,

‘পদ্ম!’

‘জ্বি, বড়ো মা।’

‘তোমাকে কিছু কথা বলার ছিল।’

‘বলুন।’

‘বলছি, আগে এখানে বসো।’

পদ্ম রুবি হোসেনের পাশে বসলো। রুবি হোসেন তখন পদ্ম’র হাতে একটা ছবি দিল। পদ্ম অবাক হলো। ছবি’টা উল্টে দেখল। একটা ছেলের ছবি। পদ্ম আবার অবাক হলো। বললো,

‘এটা কে বড়ো মা?’

‘আরাফাত খান।’

পদ্ম আবার ছবি’টার দিকে তাকাল। বললো,

‘আরাফাত খান? কে উনি?’

রুবি হোসেন মুচকি হাসলেন। বললেন,

‘আগে বলতো, ছেলেটাকে পছন্দ হয়েছে?’

পদ্ম এবার চকিত হলো। বড়ো বড়ো চোখ করে বললো,

‘পছন্দ হবে মানে?’

রুবি হোসেন পদ্ম’র মাথায় হাত রেখে বললেন,

‘আমাকে বিশ্বাস করো, মা?’

পদ্ম মাথা নাড়াল। রুবি হোসেন আবার বললেন,

‘আমি জানি তুমি আমাকে খুব বিশ্বাস করো। আর আমিও আমার এই মেয়েটাকে ভীষণ ভালোবাসি। (একটু থেমে) আমার মেয়ে তো বড়ো হয়েছে, তাই না? ওর বিয়ে নিয়ে তো আমাকেই ভাবতে হবে। আমি জানি মা, তোমার মামি যা করেছিল তার জন্য তুমি ঠিক বিয়ের জন্য প্রস্তুত না, কিন্তু আমি শুধু একবার অনুরোধ করবো , তুমি ছেলেটার সাথে কথা বলে দেখো। আমি তোমার উপর কিছু চাপিয়ে দিব না মা। তোমার ভালোর কথা ভেবেই আমরা এই সিদ্ধান্ত’টা নিয়েছি। তুমি এখন ভেবে দেখো, কী করবে।’

পদ্ম রুবি হোসেনের কথার পিঠে কিছু বললো না। তিনি তাই আবার বললেন,

‘তুমি সময় নাও মা। সময় নিয়ে ভাবো। ছেলে কিন্তু খুব ভালো। একটা প্রাইভেট কোম্পানিতে জব করে। মা, বাবা আর ছোট্ট একটা বোন আছে। এখন সবটা তোমার হাতে। তুমি যা চাও তাই হবে।’

রুবি হোসেন রুম থেকে বেরিয়ে গেলেন। পদ্ম ছবিটার দিকে আবার তাকাল। ছবির মানুষটা বেশ সুদর্শন। পদ্ম ছবিটা পাশে রাখল। মনকে প্রশ্ন করলো, এখন তার ঠিক কী করা উচিত।

জীবনের এত এত বৈচিত্র্য সে আর সহ্য করতে পারছে না। তার জীবন কেন এত অগোছালো? কেন অন্য সবার মতো স্বাভাবিক না? কেন এত কষ্ট পেতে হয় তাকে? কেন কাউকে বিশ্বাস করতে পারে না? চোখ বুজলেই মনে হয়, আশে পাশের সবাই তাকে ধোঁকা দিচ্ছ, তাকে নিয়ে খেলছে। কাউকে যে সে বিশ্বাস করতে পারছে না। বড়ো মা, উনাকে কি সত্যিই বিশ্বাস করা যায়? উনিও যদি তাকে ঠকায়?

পদ্ম ছবিটা আবার হাতে নিল। মনে মনে বললো,

‘যদি চেহারার মতো মানুষের মনটাও সুন্দর হতো!’

চলবে…

#পদ্মফুল
#জান্নাতুল_ফারিয়া_প্রত্যাশা
|১৫|

রাতের খাওয়া দাওয়া শেষ করে পদ্ম বারান্দায় গিয়ে দাঁড়াল। কুচকুচে কালো আকাশ। তার একপাশে আবছা রূপালি আলো। পদ্ম সেদিকে তাকিয়ে আছে। বাইরে ঠান্ডা বাতাস, পদ্ম’র শরীরে এসে ঠেকছে। পদ্ম চোখ বন্ধ করে জোরে শ্বাস টানল। একটা মিষ্টি ঘ্রাণ পেল সে। গেইটের কাছে একটা বেলী ফুলের গাছ আছে। সুবাস’টা সেখান থেকেই আসছে। পদ্ম’র ভীষণ আরাম লাগছে। সে চোখ বুজে সেই আরাম অনুভব করছে। হঠাৎ সে তার কাঁধে ঠান্ডা কিছু একটার স্পর্শ অনুভব করলো। চট করে চোখ মেলে তাকাল সে। কিছু একটা আঁচ করতে পেরে পেছন ফিরে তাকাল। পেছনের মানুষ’টাকে দেখে বরাবরের মতোই সে রাগে আর বিদ্বেষে ফেটে পড়ল। কিন্তু সেই মানুষ’টা দাঁত কেলিয়ে বিচ্ছিরি ভাবে হাসলো। বললো,

‘একা একা বারান্দায় কী করছো মা?’

পদ্ম’র গাঁ যেন জ্বলে উঠলো। সে দাঁতে দাঁত চেপে বললো,

‘আপনার মুখে “মা” ডাক’টা শুনলে আমার গাঁ জ্বলে উঠে। দয়া করে আমাকে আর মা বলে ডাকবেন না।’

আকবর সাহেব অসহায়ের মতো মুখ করে বললেন,

‘কেন মা, কী হয়েছে?’

‘উফ, বন্ধ করুন আপনার এই নাটক। আপনার এই অভিনয় আপনি অন্য কাউকে গিয়ে দেখান। আপনার উদ্দেশ্য আমার খুব ভালো করেই জানা আছে। দয়া করে আপনি এখান থেকে চলে যান, নয়তো আমি কিন্তু বড়ো মা ডাকবো।’

‘আহা মা, এত হাইপার হচ্ছো কেন? আমি তো তোমার সাথে একটু গল্প করতে এসেছি। তা মা, আরাফাত-কে কি তোমার পছন্দ হয়েছে?’

পদ্ম’র ভীষণ রাগ হচ্ছে। সে কাঠকাঠ গলায় বললো,

‘আপনাকে এত কিছু জানতে হবে না। আপনি দয়া করে এখান থেকে যান।’

আকবর সাহেব হাসলেন। বললেন,

‘সুন্দরীদের রাগ দেখতেও ভালো লাগে।’

বলেই তিনি হেসে হেসে রুম থেকে বেরিয়ে গেলেন। পদ্ম’র ইচ্ছে করছে লোকটাকে খু*ন করে ফেলতে। একটা মানুষ এত খারাপ কী করে হয়?

বিছানায় বসে নিচের দিকে তাকিয়ে আছে পদ্ম। তার এখন ভীষণ ভাবে ডাক্তারবাবুর কথা মনে পড়ছে। এই মানুষটাকে সত্যিকার অর্থেই বিশ্বাস করা যায়। আচ্ছা, তার কাছে কি একবার সাহায্য চাইবে সে? ব্যাপারটা কি ঠিক দেখায়? মানুষটা তো এমনিতেই তাকে এত সাহায্য করেছে, দয়া করে তার বাড়িতে আশ্রয় দিয়েছে এখন আবার তাকে কিছু বলে বিরক্ত করা’টা কি ঠিক হবে? আর তার উপর উনার নিজের ও তো মন মেজাজ ভালো নেই। প্রিয় মানুষের জন্য প্রতিনিয়ত কত কষ্ট পাচ্ছন। না জানি কোথায় আছে মেয়ে’টা? আদৌ বেঁচে আছে তো? না না, বেঁচে অবশ্যই আছে। আর ডাক্তারবাবুও ঠিক উনার প্রিয় মানুষকে খুঁজে বের করতে পারবে।

.
.

রোদ ঝলমলে সকাল। বারান্দা টপকিয়ে রোদের আবছা আলো এসে পড়ছে পদ্ম’র রুমের ফ্লোরে। কিছু আলো তীর্যক ভাবে এসে পড়ছে পদ্ম’র টেবিলে। সেখানে রাখা ছোট্ট পাতাবাহার গাছ’টা সেই আলোয় ঝলমল করছে।

দরজার ঠকঠক আওয়াজে পদ্ম’র ঘুম ভেঙ্গে গেল। চোখ ডলে উঠে বসলো সে। ঘুম ঘুম চোখে দেয়াল ঘড়ির দিকে তাকাল। বোঝার চেষ্টা করলো ঠিক কয়টা বাজে। নয়’টা ত্রিশ। পদ্ম জোরে হাই তুললো। তারপর গিয়ে দরজাটা হালকা খুলে বাইরে উঁকি দিয়ে দেখার চেষ্টা করলো কে এসেছে। কেউ নেই? আশ্চর্য! তাহলে দরজায় নক করলো কে? সে তো স্পষ্ট শুনেছে দরজায় কারোর ঠকঠক শব্দ। তবে কি ভুল শুনলো সে? হতে পারে। পদ্ম দরজা’টা চাপিয়ে দিয়ে ওয়াশরুমে ঢুকে পড়লো, ফ্রেশ হতে।

পদ্ম ফ্রেশ হয়ে এসে নিচে নামল। নিচে গিয়ে দেখল কেউ নেই। পদ্ম অবাক হলো। কী ব্যাপার! কেউ কি এখনো ঘুম থেকে উঠেনি? কিন্তু, এতক্ষণে তো উঠে পড়ার কথা! পদ্ম রান্নাঘরে গেল। খালা কাজ করছেন। সে তখন খালা-কে জিগ্যেস করলো,

‘খালা, কেউ কি এখনো ঘুম থেকে উঠেনি?’

খালা তার দিকে না তাকিয়েই জবাব দিলো,

‘খালাম্মা আর সাহেব একটু বাইরে গেছেন, কী যেন কাজ আছে উনাদের। আপনার খাবার ডাইনিং এ আমি দিয়া রাখছি, গিয়া খান।’

পদ্ম কিছুক্ষণ খালার দিকে তাকিয়ে থেকে ডাইনিং রুমে চলে এলো। চেয়ার টেনে বসলো সে। তার কেন যেন কিছু ভালো লাগছে না। মনটা অস্থির অস্থির লাগছে। বারবার মনে হচ্ছে, কিছু যেন হতে চলছে। খুব খারাপ কিছু। পদ্ম খেতে পারে না। উঠে গিয়ে সোফায় বসে। টি.ভি টা ছেড়ে দিয়ে হা করে তাকিয়ে থাকে সেই দিকে। খবর চলছে। হঠাৎ হেড লাইনে একটা লেখা উঠলো, “প্রথম শ্রেণীতে পড়ুয়া একটা মেয়েকে গণধর্ষণ করা হয়েছে।” পদ্ম সঙ্গে সঙ্গে টি.ভি টা অফ করে দিল। তার হঠাৎ দম আটকে আসছে। দু হাত নাড়িয়ে নিজেকে বাতাস করছে সে। পদ্ম জানে, আজকাল এই ধর্ষণ জিনিসটা খুব স্বাভাবিক হয়ে উঠেছে। এখন তো ঘরে ঘরে ধর্ষীতা। মানুষ হয়তো আর ধর্ষণের খবর শুনলে আঁতকে উঠে না, হয়তো তার মতো করে কারোর আর দম বন্ধ হয়ে আসে না। ঐ যে মানুষ এখন জিনিসটাকে খুব সাধারণ চোখে দেখে। কেউ পাত্তা দেয় তো কেউ মজা নেয়। কিন্তু তার বুক এখনও কাঁপে, দম বন্ধ হয়ে আসে। মনে হয় যেন তার সাথেই ঘটেছে এত সবকিছু। পদ্ম কিছুটা সময় চোখ বুজে থাকল। তারপর সে সোজা হয়ে বসলো। মনে মনে তখন ভাবলো,

“ইশ, এই স্বাধীন বাংলাদেশে যদি মেয়েরা একটু সুরক্ষিত থাকতে পারতো…!’

_________________________________

বাড়ির ল্যান্ড লাইন’টা তখন থেকে বাজছে। পদ্ম এতক্ষণে টের পেল সেটা। পদ্ম ছুটে গিয়ে তখন ফোন’টা রিসিভ করলো,

‘হ্যালো!’

‘ডাক্তারবাবু?’

‘জ্বি।’

‘আমি পদ্ম।’

‘হু, বুঝতে পেরেছি। আচ্ছা, মা বাবা কোথায়? উনাদের নাম্বারে তখন থেকে কল দিচ্ছি কিন্তু ধরছেন না, বাসায় নেই?’

‘না, উনারা কাজে বেরিয়েছেন।’

‘ওহ আচ্ছা। আপনি বাসায় একা তাহলে, কোনো সমস্যা নেই তো?’

‘না না, কোনো সমস্যা নেই।’

‘আচ্ছা তাহলে রাখছি।’

‘ডাক্তারবাবু..’

‘কিছু বলবেন?’

পদ্ম চুপ হয়ে যায়। বলতে তো অনেক কিছুই চায়, কিন্তু কী করে বলবে? আদিদ আবার জিগ্যেস করলো,

‘কী হলো, কথা বলছেন না কেন?’

পদ্ম জিভ দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে বললো,

‘আপনি আবার কখন আসবেন?’

‘সিউর বলতে পারছি না। কেন, কোনো সমস্যা? শরীর ঠিক আছে আপনার?’

‘হ্যাঁ, সব ঠিক আছে। কিন্তু…’

‘কিন্তু কী? আপনার কি কোনো প্রকার অসুবিধা হচ্ছে, হলে বলতে পারেন?’

পদ্ম ভাবছে বলবে কী বলবে না। সে খানিকটা সময় নিয়ে বললো,

‘আসলে আপনার বাবা…’

‘আমার বাবা…কী?’

পদ্ম ইতস্তত কন্ঠে বললো,

‘আপনার বাবা আ-আমার সাথে…’

‘কার সাথে কথা বলছো, পদ্ম?’

পেছন থেকে কারোর গলার স্বর শুনে চমকে উঠল পদ্ম। পেছন ফিরে তাকিয়ে দেখল রুবি হোসেন আর আকবর সাহেব। পদ্ম কাঁপা কাঁপা গলায় বললো,

‘ড..ড-ডাক্তারবাবু।’

আকবর সাহেব তখন ব্রু কুঁচকে বললেন,

‘তা, তুমি এত ওর সাথে কী কথা বলছো?’

চলবে…

#পদ্মফুল
#জান্নাতুল_ফারিয়া_প্রত্যাশা
|১৬|

পদ্ম আমতা আমতা করে বললো,

‘ক-কিছু না।’

রুবি হোসেন কপাল কুঁচকে এসে ফোনটা পদ্ম’র কাছ থেকে নিয়ে নিলেন। তারপর পদ্ম-কে বললেন,

‘তুমি উপরে যাও। আমি আদিদের সাথে কথা বলছি।’

পদ্ম মুখ কালো করে উপরে উঠে গেল।

‘কেমন আছো, আদিদ?’

‘ভালো আছি, মা। তোমরা কোথায় ছিলে? তখন থেকে তোমাদের নাম্বারে কল করছি, ধরছিলে না কেন?’

‘আসলে একটু ব্যাংকে গিয়েছিলাম, কাজ ছিল।
তোমার কী খবর, আবার কবে আসছো?’

‘সিউর নেই মা। দেখি, সময় পেলে চলে আসবো। আচ্ছা, বাবা আর কোথায়?’

‘এই তো আছে আমার সামনেই।’

‘আচ্ছা। আর ঐদিকে সব ঠিক আছে তো? পদ্ম-কে নিয়ে কোনো সমস্যা হচ্ছে না তো?’

‘উমম, না তেমন কোনো সমস্যা নেই। তবে আমি আর তোমার বাবা মিলে একটা সিদ্ধান্ত নিয়েছি ওর ব্যাপারে।’

আদিদ অবাক হয়ে বললো,

‘কী সিদ্ধান্ত?’

‘বলবো, তুমি বাসায় আসলে তোমাকে সব বলবো।’

‘আচ্ছা, ঠিক আছে তাহলে। রাখছি, মা।’

‘আচ্ছা বাবা, তাড়াতাড়ি আবার বাসায় এসো। তোমাকে আমরা খুব মিস করছি।’

‘আচ্ছা। চিন্তা করো না, খুব তাড়াতাড়িই চলে আসবো ।’

কথা শেষ করে রুবি হোসেন বাঁকা চোখে আকবর সাহেবের দিকে তাকালেন। রাগি গলায় বললেন,

‘ঐ মেয়ে আদিদ-কে কী বলতে চাইছিল?’

আকবর সাহেব ঢোক গিললেন। শুকনো মুখে বললেন,

‘তা আমি কী করে বলবো।’

রুবি হোসেন তখন চোয়াল শক্ত করে বললেন,

‘শুনো, তোমাকে লাস্ট বারের মতো সাবধান করছি। ঐ মেয়ের কাছ থেকে দূরে থাকো। নয়তো তোমার জন্য আমাকেও ফাঁসতে হবে।’

আকবর সাহেবকে শাসিয়ে রুবি হোসেন নিজের রুমে চলে গেলেন। আকবর সাহেব ভীত প্রকৃতির মানুষ হওয়ায় বউ-কে আর কিছু বলতে পারলেন না। বউয়ের মুখের উপর কথা বলার সাহস তার কোনো কালেই ছিল না। হয়তো কখনো হয়েও উঠবে না।

.

পুরোটা সকাল পদ্ম তার রুমে কাটাল। কেমন যেন এক অবসাদ তাকে ধীরে ধীরে গ্রাস করছে। সে বুঝতে পারছে তার শরীর, মন কিছুই ঠিক নেই। সবকিছু এলোমেলো, অগোছালো লাগছে। তার সাথে কিছু ঠিক হচ্ছে না। তার ভীষণ অসহায় লাগছে। এইভাবে এই বাড়িতে থাকতে পারবে না সে, আজই সে পালিয়ে যাবে।

তখনই দরজায় ঠকঠক শব্দ হয়। পদ্ম জিগ্যেস করে,

‘কে?’

‘পদ্ম আমি, বড়োমা। দরজাটা খুলো।’

পদ্ম উঠে গিয়ে দরজাটা খুলে দিল। রুবি হোসেন প্রসন্ন হেসে ভেতরে ঢুকলেন। পদ্ম-কে বললেন,

‘কী হয়েছে পদ্ম, মন খারাপ?’

পদ্ম মাথা নাড়িয়ে “না” করলো। রুবি হোসেন আলতো হেসে বললেন,

‘জানি, মন খারাপ। আচ্ছা, তোমার মন’টা ভালো করে দিব?’

পদ্ম অবাক কন্ঠে বললো,

‘কীভাবে?’

রুবি হোসেন মুচকি হাসলেন। বললেন,

‘আরাফাতের সাথে কথা বলবে?’

পদ্ম যেন বিস্মিত হলো। সে চেনে না জানে না একটা ছেলের সাথে কেন কথা বলতে যাবে? পদ্ম ইতস্তত কন্ঠে বললো,

‘না না বড়ো মা। আমি উনার সাথে কেন কথা বলতে যাবো? উনাকে তো আমি চিনি না। এমন অচেনা অজানা একজন মানুষের সাথে আমি কীভাবে কথা বলবো?’

‘কথা বললেই না অচেনা মানুষ চেনা মানুষ হওয়ার সুযোগ পাবে। একবার ওর সাথে কথা বলেই দেখো না। তখন বুঝতে পারবে, ছেলেটা কেমন। জানো তো, মানুষের ব্যবহারই বংশের পরিচয়। শুধু একবার কথা বলে দেখো, তারপর তুমি যা খুশি তা সিদ্ধান্ত নিও।’

পদ্ম অস্বস্তিতে পড়ে গেল। এইভাবে হুট করেই একজন অপরিচিত মানুষের সাথে কথা বলা যায় নাকি? আর সে কী কথাই বা বলবে? খালি খালি তাকে লজ্জায় পড়তে হবে।

পদ্ম-কে চুপ থাকতে দেখে রুবি হোসেন বললেন,

‘কী হলো? এইভাবে থম মেরে দাঁড়িয়ে আছো কেন? শুনো, জীবন এইভাবে চলে না। জীবনে সবসময় এগিয়ে যেতে হয়। আর সেই এগিয়ে যাওয়ার জন্য প্রয়োজন একটা প্রোপার গাইড লাইন। আর সেই গাইড লাইন’টা কেবল দিতে পারে, একজন আদর্শ জীবনসঙ্গী। শুনো মা, তোমাকে আমি আজীবন আমার বাসায় রাখতে পারবো, আমার তাতে কোনো সমস্যা নেই। কিন্তু, আমি জানি একসময় তুমি নিজে থেকেই আর এখানে থাকতে চাইবে না। কারণ তখন তোমার নিজেকে নিজের কাছে বোঝা মনে হবে, মনে হবে তুমি আমাদের জন্য একটা বাড়তি চাপ। তখন তুমি নিজেই আর এই বাড়িতে থাকতে চাইবে না। কিন্তু এছাড়া আর যাবে কোথায়? মামা, মামীর কাছেও আর ফিরে যাওয়ার কোনো পথ নেই। রাস্তায় রাস্তায় ঘোরা কি সম্ভব? না, সম্ভব না। বাধ্য হয়ে তোমাকে এখানে থাকতেই হবে। আর তাই শুধুমাত্র তোমার কথা ভেবেই আমি এই সিদ্ধান্ত’টা নিয়েছি। ইনফেক্ট, আদিদও এটাই চায়। আমি একটু আগেই এই ব্যাপারে আদিদের সাথে কথা বলেছি। আর সে খুব খুশিও হয়েছে। ছেলের সমস্ত ইনফরমেশন আমি ওকে পাঠিয়ে দিয়েছি যেন সে ও ঐদিক থেকে একটু খোঁজ খবর নিতে পারে। তোমাকে তো আর যার তার হাতে তুলে দেওয়া যায় না, সবকিছু দেখে শুনে তারপর আমরা এগুবো। তাই বলছিলাম, ছেলের সাথে তুমি আগে কথা বলো। নয়তো, তুমি বুঝবে না ছেলে কেমন। কথা বললে তোমার নিজের কাছেই সবটা ক্লিয়ার হয়ে যাবে।’

পদ্ম’র মস্তিষ্ক এবার ভরে গেল একগাদা চিন্তায়। নিউরনগুলো সব জেগে উঠেছে। প্রচুর ভাবতে হবে তাকে। কঠিন কঠিন সিদ্ধান্ত নিতে হবে। আর ডাক্তারবাবু ও যেখানে মত দিয়েছে, সেখানে তার একবার হলেও ব্যাপার’টা নিয়ে ভাবা উচিত। সত্যিই তো এইভাবে তো চলা যায় না। আর মেয়েদের জীবনে তার একমাত্র আশ্রয়’ই হলো শ্বশুরবাড়ি। যদি সেই বাড়ির মানুষগুলো ভালো হয় তবে তো সেই মেয়েকে আর পেছন ফিরে তাকাতেই হয় না। তার জীবন ধন্য। তবে কি তারও জীবনকে একবার সুযোগ দেয়া উচিত? এইবার যদি সত্যি সত্যিই ভালো কিছু হয়? যদি সত্যি সত্যিই তার জীবন ঐ একজন মানুষের জন্য বদলে যায়, তবে খারাপ কী তাতে? এমন ছন্নছাড়া জীবনের চেয়ে, একটা পরিপূর্ণ জীবন চাওয়া’টা কি উত্তম নয়?

পদ্ম রাজি হয়। রুবি হোসেন খুশি খুশি গলায় বললেন,

‘কই, তোমার মোবাইল’টা দাও তো; আমি আরাফাতের নাম্বারে কল লাগাচ্ছি।’

পদ্ম ফোনটা এগিয়ে দিলে, রুবি হোসেন উনার কাঙ্খিত নাম্বারে কল দিলেন। দু’বার বাজতেই কল’টা কেটে গেল। রুবি হোসেন বিরক্ত হয়ে বললেন,

‘কেটে দিল কেন?’

সঙ্গে সঙ্গেই আবার ফোন’টা বেজে উঠল। রুবি হোসেন তখন হেসে বললেন,

‘এই যে কল ব্যাক করেছে।’

কল’টা তিনি রিসিভ করলেন। ওপাশের মানুষ’টা হয়তো উনাকে সালাম দিয়েছে তাই তিনি সালামের জবাব দিয়ে কথা শুরু করলেন,

‘আমি রুবি হোসেন বলছি। ভালো আছো বাবা?’

‘….’

‘আমিও আলহামদুলিল্লাহ খুব ভালো আছি। তোমার বাসার সবাই ভালো আছেন তো?’

‘….’

‘যাক, শুনে ভালো লাগল। আচ্ছা তো যেই জন্যে কল দিয়েছিলাম, আসলে তুমি চাচ্ছিলে না পদ্ম’র সাথে আগে থেকেই একটু কথা বলে নিতে, আর পদ্ম ও এখন রাজি হয়েছে তোমার সাথে কথা বলতে। ও এখন আমার সামনেই আছে, নাও তুমি ওর সাথে কথা বলো।’

রুবি হোসেন পদ্ম’র দিকে ফোন’টা এগিয়ে দিলেন। পদ্ম’র ভীষণ অস্বস্তি হচ্ছে। সে কাঁপাকাঁপা হাতে ফোনটা নিল। রুবি হোসেন তখন হেসে বললেন,

‘তুমি কথা বলো, আমি আমার রুমে যাচ্ছি।’

পদ্ম ভয়ে ভয়ে ফোনটা কানে লাগাল। তখন ওপাশ থেকে সে কারোর বলিষ্ঠ কন্ঠস্বরের সালামের ধ্বনি শুনতে পেল। সে চোখ বুজে তখন জোরে নিশ্বাস নিল। আস্তে করে সালামের জবাব দিয়ে বললো,

‘কেমন আছেন?’

চলবে…