পদ্মফুল পর্ব-৩+৪

0
363

#পদ্মফুল
#জান্নাতুল_ফারিয়া_প্রত্যাশা
।৩।

‘কোথাও একটা ঠিক চলে যাবো। কিন্তু এইখানে থাকবো না। মামি এসে কালই আমায় এখান থেকে নিয়ে যাবে। তারপর ঐ খারাপ লোকটার সাথে আমায় বিয়ে দিয়ে দিবে। কাল মামি আসার আগেই আমি এখান থেকে চলে যাবো।’

‘কাল তো এমনিতেও আপনাকে রিলিজ দেওয়া হচ্ছে না। চিন্তা করবেন না আপনার মামিও আপনাকে কাল নিয়ে যেতে পারবেন না। নিশ্চিন্তে থাকুন। অযথা দুশ্চিন্তা করলে আরো অসুস্থ হয়ে পড়বেন। রেস্ট নিন, আর কোনো অসুবিধা হলে নার্সকে বলবেন।’

পদ্ম আস্তে করে বললো,

‘আচ্ছা।’

আদিদ তার কেবিনে চলে গেল। নার্স পদ্ম-কে রাতের খাবারে একটা স্যুপ খাইয়ে ঔষধ দিল। তারপর ওর স্যালাইন’টা চেক করে বললো,

‘এবার আপনি একটু ঘুমানোর চেষ্টা করুন। আমি এখানেই আছি, ভয় পাবেন না।’

পদ্ম আলতো হাসল। এই মানুষগুলো তাকে চেনে না, হোক না পেশার খাতিরে কিন্তু কী নিখুঁত ভাবে তার সেবা যত্ন করছে। তাদের মনে অঢেল মায়া। নয়তো এমন অচেনা অজানা মানুষকে কখনোই তারা এতটা গভীর ভাবে সেবা যত্ন করতে পারতো না। এই একটু মায়া যদি তার মামা মামিরও থাকতো। তাহলে সেও আর পাঁচটা মানুষের মতো একটু প্রাণ ভরে নিশ্বাস নিতে পারতো।

পদ্ম কথাগুলো ভাবতে ভাবতে চোখ বুজল। বাবা মা’র কথা ভীষণ মনে পড়ছে তার। তার মনে আছে ছোট্ট বেলায় গ্রামে খেলতে গিয়ে একবার গাছ থেকে পড়ে গিয়ে মাথায় খুব ব্যথা পেয়েছিল সে। সেই নিয়ে তার মা বাবা সেকি হুলস্থুল বাধিয়েছিল! মেয়ের জন্য জীবন যেত তাদের। আজকে তাদের সেই মেয়ে কতটা অসহায় হয়ে হসপিটালের বিছানায় একা পড়ে আছে। তাকে দেখার মতো কেউ নেই। একটু পাশে বসে মাথায় হাত বুলিয়ে দেওয়ার মতোও কেউ নেই। কী হতো মা বাবা বেঁচে থাকলে?

এই এক প্রশ্ন যে সে কতবার সৃষ্টিকর্তাকে করেছে তার কোনো ইয়ত্তা নেই। কষ্টে যখন তার দম বন্ধ হয়ে আসে তখন আবার তার হঠাৎ মনে পড়ে, সে শুনেছিল সৃষ্টিকর্তা যাকে বেশি ভালোবাসেন তাকে তিনি তাড়াতাড়ি উনার কাছে ডেকে নেন। হয়তো তার মা বাবাকেও সৃষ্টিকর্তা খুব ভালোবাসতেন তাই হয়তো তিনি উনাদের এত তাড়াতাড়ি উনার কাছে নিয়ে গেছেন। এই কথাটা ভাবলে একটু হলেও শান্তি পায় সে। তার কষ্ট কিছুটা হলেও লাঘব পায় তখন।

পদ্ম ঘুমিয়ে পড়ে। নার্স লাইট অফ করে সোফায় গিয়ে বসে। তারও খুব ক্লান্ত লাগছে। তাই হেলান দিয়ে বসে থাকতে থাকতেই সেও ঘুমিয়ে পড়ে।

.

জানলার ফাঁক গলিয়ে রোদের কিছু অংশ পদ্ম’র চোখে মুখে এসে পড়ছে। পদ্ম’র ঘুমটা তখন হালকা হয়ে যায়। আস্তে আস্তে চোখ মেলে তাকায় সে। চোখের সামনে দৃশ্যপট পরিষ্কার হতেই দেখল তার পুরো রুম রোদের আলোয় ঝলমল করছে। পাশে তাকিয়ে দেখল নার্স যেন কী একটা ফাইল দেখছে। পদ্ম আস্তে আস্তে বসার চেষ্টা করলো। কিন্তু বসার শক্তি পেল না সে। নার্স সেটা দেখে তাকে সাহায্য করলো, উঠে বসতে। পদ্ম আস্তে করে বললো,

‘আমি একটু ওয়াশরুমে যাবো।’

নার্স পদ্ম’র হাত থেকে ক্যানোলা’টা খুলে তাকে ধরে ওয়াশরুমের কাছে নিয়ে গেল। পদ্ম’র শরীর যেন ভার হয়ে আছে। হাঁটতে চলতেও যেন তার খুব কষ্ট হচ্ছে। সে কোনোরকমে ফ্রেশ হয়ে ওয়াশরুম থেকে ফের হলো। নার্স তাকে আবার বেডে নিয়ে শুইয়ে দিল। তারপর বললো,

‘আপনি রেস্ট নিন। আমি স্যারকে ডেকে আনছি।’

পদ্ম মাথা নাড়িয়ে সম্মতি জানাল।

কিছুক্ষণ পর আদিদ কেবিনে এসে পদ্ম’র পালস্ চেক করলো। তারপর জিগ্যেস করলো,

‘এখন কিছুটা সুস্থ লাগছে?’

‘হ্যাঁ, তবে শরীরটা একটু দুর্বল লাগছে।’

‘ঠিকমতো খাওয়া দাওয়া করলে এই দুর্বলতা কেটে যাবে। আর এই স্যালাইন’টা শেষ হলে আরেকটা স্যালাইন দিব সেটা নিলেই দেখবেন অনেকটা বেটার ফিল করছেন।’

‘স্যালাইন শেষ করতে আর কতক্ষণ লাগবে।’

‘এই দেড় থেকে দু ঘন্টা।’

পদ্ম ঘড়ির দিকে তাকাল। আট’টা বাজে। দশটার আগে সে এখান থেকে বেরিয়ে পড়বে। মামি আসার আগে যেকোনো মূল্যে তাকে এখান থেকে চলে যেতেই হবে। নয়তো মামি এসে তাকে এখান থেকে নিয়ে যাবে আর ঐ লোকটার সাথে বিয়ে দিয়ে দিবে। কথাটা ভাবতেই পদ্ম’র বুকে মোচড় দিয়ে উঠে। পদ্ম নরম সুরে বলে,

‘স্যালাইন’টা শেষ হলে আমি এখান থেকে চলে যাবো। আর বিল কত এসেছে? আমার কাছে তো ক্যাশ টাকা নেই তবে এই ছোট্ট সোনার দুলগুলো আছে বাকি যা ছিল সব মামি নিয়ে গিয়েছে এইগুলো খুব কষ্ট রেখে দিয়েছি, মায়ের শেষ স্মৃতি হিসেবে। আচ্ছা একটা দুল দিয়ে হবে? নাহলে দুটো’ই..’

‘পাগল হয়েছেন আপনি? আপনাকে এসব নিয়ে ভাবতে হবে না। আমাদের এখানে বিনামূল্যে চিকিৎসা করানো হয়। তাই এইসব না ভেবে রেস্ট নিন। আমি আপনার স্যালাইনের ব্যবস্থা করছি।’

আদিদ বেরিয়ে গেল। নার্স তাকে হালকা খাবার খাইয়ে ঔষধ খাইয়ে দিল।

ঘড়ির কাটা দশ’টা ছুঁলো। পদ্ম’র মন জুড়ে ছুটে চলছে তখন অস্থিরতার স্রোত। সে বারবার দরজার দিকে তাকাচ্ছে। তার মনে হচ্ছে এই বুঝি মামি চলে এলো। আরেকবার তাকাচ্ছে স্যালাইনের দিকে। এটা এখনো শেষ হচ্ছে না কেন? সময়ের সাথে সাথে পদ্ম’র অস্থিরতা বেড়েই চলছে। এক পর্যায়ে সে আর না পেরে নার্সকে বলে উঠে,

‘আমার ক্যানোলা’টা খুলে দিন না প্লীজ।’

নার্স অবাক হয়ে বললো,

‘কেন? কী হয়েছে?’

‘আমি এখান থেকে চলে যাবো। আমার মামি এক্ষুণি চলে আসবি। তাড়াতাড়ি আমার ক্যানোলা’টা খুলে দিন প্লীজ। মামি আসার আগে আমাকে এখান থেকে চলে যেতে হবে। প্লীজ খুলে দিন।’

পদ্ম অনেক বেশি অস্থির হয়ে পড়ে। নার্স তার কোনো কথা শুনছে না দেখে সে নিজেই ক্যানোলা ধরে টেনে টুনে সব খুলতে থাকে। নার্স যখন অনেক চেষ্টা করেও তাকে থামাতে পারে না তখন সে দ্রুত গিয়ে ড. আদিদ-কে ডেকে নিয়ে আসে। সে এসে দেখে পদ্ম স্যালাইন ট্যালাইন সব ছিঁড়ে ফেলেছে। সে তখন তাড়াহুড়ো করে বেঠ থেকে নামছিল। আদিদ দ্রুত তার কাছে যায়। শরীর দুর্বল থাকায় বেড থেকে অস্থির হয়ে নামতে গেলেই পদ্ম’র মাথা ঘুরে উঠে। সে তখন ব্যালেন্স হারিয়ে পড়ে যেতে নিলেই আদিদ তাকে ধরে বেডে বসিয়ে দেয়। তারপর সে ধমক দিয়ে বলে উঠে,

‘পাগলামী করছেন কেন? এক্ষুণি তো পড়ে গিয়ে আরো বিপদ বাধাতেন। আমার অনুমতি ছাড়া এখান থেকে আপনাকে কেউ নিয়ে যেতে পারবে না। তাই এসব পাগলামী বন্ধ করুন। আপনি ছাড়াও আমার আরো অনেক পেশেন্ট আছে, আপনার জন্য আমি অযথা এত প্যারা নিতে পারবো না। আপনার মামি আসলে আমি কথা বলবো উনার সাথে, আপনাকে এই নিয়ে আর ভাবতে হবে না। চুপচাপ এখানে বসে থাকুন। আর আপনি উনার দিকে খেয়াল রাখবেন। (নার্সের দিকে তাকিয়ে)’

কথাটা বলেই আদিদ কেবিন থেকে বেরিয়ে গেল। আদিদ যে ভীষণ রেগে গিয়েছে সেটা পদ্ম তার কথা শুনেই বুঝতে পারছে। কিন্তু সেই বা কী করবে। তার বুকের ভেতরটা ভয়ে কেমন করছে সেটা কেবল সেই জানে। এই অনুভূতি তো সে কাউকে বোঝাতে পারছে না।

পদ্ম শক্ত হয়ে বিছানায় বসে ভয়ার্ত দৃষ্টিতে রুমের দরজার দিকে তাকিয়ে থাকে। তার মন বলছে তার মামি মনে হয় চলে এসেছে। এই বুঝি তাকে ধরে নিয়ে যাবে। আর তারপর..

সত্যি সত্যিই মহিলাটা চলে এসেছে। মামিকে দেখা মাত্রই পদ্ম’র মনের ভয়টা হাজার গুণ বেড়ে যায়। সে ঘন ঘন নিশ্বাস ফেলতে থাকে। তার মামি তখন তার কাছে এসে দাঁত কেলিয়ে হেসে বলে,

‘তোকে নিতে এসেছি মা। দেখ সাথে সুলাইমানও এসেছে।’

চলবে…

#পদ্মফুল
#জান্নাতুল_ফারিয়া_প্রত্যাশা
।৪।

সুলাইমানের কথা শুনে পদ্ম আরো বেশি ভয়ে কুকরে উঠে। সে বেডের এক কোণে গিয়ে জড়সড় হয়ে বসে। তার মামি হেসে বেডের এক পাশে বসে বলে,

‘কী সুলাইমান, ভেতরে আসো।’

মোটাকাটা এক মধ্য বয়স্ক লোক তখন কেবিনের ভেতর ঢুকল। মুখে একগাদা কালো কালো দাড়ি। চোখ মুখ যেন কেমন অদ্ভুত লোকটার। লোকটা এসেই পদ্ম’র খুব কাছে গেল, তার হাতে স্পর্শ করে বললো,

‘তুমি ঠিক আছো, পদ্ম?’

পদ্ম এক ঝটকায় তার হাত সরিয়ে নিল। তারপর কাঁপাকাঁপা গলায় বললো,

‘ক-কে আপনি?’

‘ওমা! তুমি আমাকে চিনতে পারছো না? আমি সুলাইমান, তোমার হবু বর।’

পদ্ম আরো কিছুটা দূরে সরে গিয়ে বললো,

‘আমি কোনো সুলাইমান-কে চিনি না। কাউকে চিনি না আমি। আপনারা চলে যান এখান থেকে।’

‘যাবো তো অবশ্যই। তবে তোমাকে সাথে নিয়ে যাবো।’

সুলাইমান লোকটা তার পান খাওয়া দাঁত বের করে বিকট ভঙ্গিতে হাসল। পদ্ম’র গা যেন শিউরে উঠল সেই হাসি দেখে। মামি তখন বললো,

‘হুম, তা তো নিয়া যাবোই। তার আগে ঐ ডাক্তারের সাথে কথা বলতে হইব। চলো সুলাইমান, আমরা বরং ঐ ডাক্তারের কেবিনে গিইয়া ওর সাথে কথা বইলা আসি।’

‘আচ্ছা, চলুন। তুমি এখানে একটু অপেক্ষা করো, আমরা এক্ষুণি আসছি।(পদ্ম’র দিকে তাকিয়ে)’

ওরা কেবিন থেকে বেরিয়ে যেতেই পদ্ম ছটফট করতে লাগল। যদি ডাক্তারবাবু-কে তারা মানিয়ে নেয়? ডাক্তারবাবু যদি তাদের কথায় রাজি হয়ে যায়? তাহলে তার কী হবে? কী করবে সে? পালিয়ে যাবে? হ্যাঁ, পালাতে হবে। এক্ষুণি পালাতে হবে।

পদ্ম আস্তে আস্তে উঠে দাঁড়াল। বুক ধরফর করছে তার। নার্স কেবিনে আসার আগেই তাকে বেরিয়ে যেতে হবে। পদ্ম ধীর পায়ে দরজার সামনে গেল। তারপর এদিক সেদিক দেখে দরজার বাইরে পা রাখতেই সেখানে তার নার্স চলে এলো। সে পদ্ম’র হাত ধরে বললো,

‘কোথায় যাচ্ছেন?’

পদ্ম তখন কেঁদে ফেলল। কাঁদতে কাঁদতে বললো,

‘প্লীজ, আমাকে যেতে দিন। আমি আপনার কাছে অনুরোধ করছি। প্লীজ।’

পদ্ম’র চোখ দিয়ে অঝোরে জল পড়ছে। নার্সের মায়া হলো খুব। কিন্তু সে নিজেকে শক্ত করে বললো,

‘আপনার কথা শুনলে যে আমার চাকরি থাকবে না। আদিদ স্যার আমাকে সাসপেন্ড করে দিবে। ক্ষমা করবেন আমায়। চলুন, ভেতরে চলুন।’

পদ্ম থমকে যায়। কী করবে সে? তার জন্য কারো চাকরি যাক সেটা সে কখনোই চায় না। কিন্তু, এছাড়া আর বাঁচার উপায় কী?

নার্স পদ্ম-কে ধরে এনে বেডে বসালো। পদ্ম এখনো কাঁদছে। নার্স কিছুক্ষণ চেয়ে থাকল তার দিকে। তারপর তার পাশে বসে কোমল গলায় বললো,

‘স্যার যখন বলেছে আপনাকে আজকে এখান থেকে কেউ নিয়ে যেতে পারবে না, তার মানে সত্যিই সেটা কেউ পারবে না। স্যারের উপর ভরসা রাখুন। আপনার মামি-কে উনি ঠিক ম্যানেজ করে নিবেন।’

পদ্ম ভেজা অক্ষিপল্লব মেলে তাকাল নার্সের দিকে। ধরা গলায় বললো,

‘আজকে না নিয়ে যেতে পারলে, কাল আবার আসবে। কালকে না পারলে, পরশু আসবে। কিন্তু আমাকে নিয়ে যাবেই। এখানে থাকলে আমি মামির হাত থেকে কোনোভাবেই রেহাই পাবো না। তাই আমি পালিয়ে যেতে চাই। মামির হাতের নাগাল থেকে অনেক অনেক দূরে চলে যেতে চাই।’

‘কিন্তু, আপনি এখন অনেক দূর্বল। এই অবস্থায় একা চলাচল করতে পারবেন না। আপনাকে এখন রেস্টে থাকতে হবে। এই অবস্থায় কোনোভাবেই আপনাকে আমরা ছাড়তে পারবো না।’

পদ্ম নার্সের দিকে অসহায় দৃষ্টিতে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকে। তারপর সে চুপচাপ বেডে শুয়ে পড়ে। আর পারছে না। এই একটা শরীর আর কত ধকল সহ্য করবে। এই মন আর কত আঘাত সহ্য করবে। সে তো রোবট নয়, একটা র/ক্তে মাংসে গড়া মানুষ। একটা মানুষ ঠিক কতটা কষ্ট, কতটা যন্ত্রণা সহ্য করতে পারে? তার যে বড্ড মরে যেতে ইচ্ছে করছে। ইচ্ছে করছে মা বাবার কাছে চলে যেতে। এইভাবে বেঁচে থাকার চেয়ে মরে যাওয়া’টা কি ভালো সিদ্ধান্ত নয়?

.

‘বললাম তো আজ কোনোভাবেই উনাকে ডিসচার্জ করা যাবে না। উনি এখনও পুরোপুরি সুস্থ নন। উনাকে আরো দুদিন হসপিটারে থাকতে হবে। তারপর উনার শারীরিক কান্ডিশন দেখে আমরা পরবর্তী সিদ্ধান্ত নিব।’

‘আহ, ডাক্তার! আপনাকে কী করে বোঝায়? আমার বিয়েটা যে আটকে আছে। আর কতদিন আমি অপেক্ষা করবো? আপনি একদম নিশ্চিন্তে থাকুন ডাক্তার। ওকে বাড়িতে খুব যত্নে রাখা হবে। কোনো চিন্তা করবেন না, ও খুব তাড়াতাড়ি সুস্থ হয়ে যাবে।’

আদিদ কপালে চওড়া ভাজ ফেলে লোকটার দিকে তাকাল। এই লোকটার সাথে মেয়েটার বিয়ে হবে? লোকটা-কে আদিদের মোটেও ভালো মানুষ মনে হলো না। আর তাছাড়া এই লোকটা বয়সে মেয়েটা থেকে অনেক বড়ো হবে। মেয়েটার সাথে তার মামা মামি সত্যিই খুব অন্যায় করছে।

আদিদ চাপা নিশ্বাস ছেড়ে বললো,

‘উনার সুস্থতার চেয়ে আপনার কাছে বিয়েটা ইম্পোরটেন্ট? আর তাছাড়া আপনাকে দেখে তো মনে হচ্ছে আপনি বিবাহিত। এই বয়সে ঐটুকু একটা মেয়েকে বিয়ে কেন করতে চাইছেন? বিয়েতে মেয়েটার মত আছে তো? নাকি জোর করছেন? জানেন তো আজ কাল এসব ব্যাপার নিয়ে প্রশাসন খুব সতর্ক? তাই যা করবেন ভেবে চিন্তে করবেন, নয়তো জেলে ঢুকতে দু মিনিট সময়ও লাগবে না।’

‘এই ডাক্তার, আপনারে এত কথা কইতে কেউ কইছে? খালি আজাইরা কথা। আমাদের মাইয়া বিয়েতে রাজি। এটা নিয়া আপনার ভাবতে হইত না। আপনার যা কাজ আপনি তাই করেন। পদ্মরে আজকেই আমাদের সাথে যাইতে দেন। ও আমাদের কাছে থাকতে ভালো থাকব, বুঝছেন?’

মামির কথায় চোখ মুখ শক্ত হয়ে এলো আদিদের। সে দারাজ গলায় বললো,

‘ভদ্রতার বিন্দু মাত্র ছিটে ফোটাও দেখছি আপনার মাঝে নেই। আমি কি বলেছি আপনি বুঝতে পারেননি? পদ্ম-কে আজ ডিসচার্জ করা হচ্ছে না। অযথা ঝামেলা করবেন না, নয়তো আমি অন্য স্টেপ নিতে বাধ্য হবো।’

সুলাইমান তখন টেবিলে চাপড় মেরে উঠে দাঁড়াল। উঁচু স্বরে বলতে লাগল,

‘মগের মুল্লুক নাকি? আমাদের মেয়েকে আমরা নিতে পারবো না, এটা আবার কেমন কথা? একদম বাড়াবাড়ি করবেন না ডাক্তার। চুপচাপ যা বলছি তাই করেন।’

আদিদ তার চেয়ারটায় হেলান দিয়ে বসলো। তাচ্ছিল্যের সুরে বললো,

‘না করলে কী করবেন?’

সুলাইমান রাগে চোয়াল শক্ত করে এসে আদিদের শার্টের কলার চেপে ধরলো। আদিদ চোখ বুজে নিশ্বাস ছেড়ে ঠান্ডা গলায় বললো,

‘কলার ছাড়ুন।’

‘ছাড়ব না।’

আদিদ আর নিজেকে কন্ট্রোল করতে না পেরে লোকটার নাক বরাবর এক ঘুষি মারল। সঙ্গে সঙ্গে সে ছিটকে দূরে সরে গেল। আর তার সাথে সাথেই নাক দিয়ে বের হতে লাগল অনর্গল রক্ত। সুলাইমান নাকে হাত দিয়ে রক্ত দেখে কিছুটা ঘাবড়ে গেল। সে জানে শক্তিতে সে আদিদের সাথে পেরে উঠবে না। তার বয়স হয়েছে, আর আদিদ এখন চাঙ্গা যুবক। তার শরীরে এখন বয়ে চলছে টাটকা র/ক্ত। তাই সে দমে গেল। আদিদ তার কাছে এসে দাঁড়িয়ে কাঁধে হাত রেখে বললো,

‘দুঃখিত, হাত তুলতে চাইনি। আপনি বাধ্য করেছেন। বসুন এখানে আমি ড্রেসিং করে দিচ্ছি।’

লোকটিকে বসিয়ে আদিদ তার নাকের র/ক্ত মুছে ড্রেসিং করিয়ে দিল। তারপর নরম গলায় বললো,

‘দেখুন, আমি কোনো ঝামেলা চাই না। আমাদের হসপিটালের একটা নিয়ম আছে। সেই নিয়মের বাইরে আমরা যেতে পারবো না। একজন অসুস্থ রোগী-কে আমি কোনোভাবেই রিলিজ দিতে পারবো না, এটা নিয়মের খেলাপ। আপনারা আরো দুদিন পর আসুন। আশা করছি ততদিনে উনি পুরোপুরি সুস্থ হয়ে উঠবেন।’

‘কিন্তু..’

মামি কিছু বলতে নিলে সুলাইমান তাকে ইশারা দিয়ে থামিয়ে দেয়। তারপর সে হালকা হাসার চেষ্টা করে বলে,

‘আচ্ছা ডাক্তার, আপনি যা বলবেন তাই হবে। আমরা দু দিন পর এসেই ওকে নিয়ে যাবো। আজ তাহলে আমরা যাই। আর আমিও আমার খারাপ ব্যবহারের জন্য খুব দুঃখিত।’

‘ঠিক আছে, সমস্যা নেই। আপনারা আসতে পারেন।’

মামি কেবিন থেকে বেরিয়েই ষুলাইমান-কে বললো,

‘এটা কী করলে সুলাইমান? তোমাকে আনলামই যাতে ডাক্তাররে বুঝাইয়া পদ্মরে বাসায় নিয়া যাইতে পারো। আর তুমি এখানে আইসা পল্টি মারলা। এটা কেমন হলো।’

সুলাইমান দাঁত বের করে হাসল। বললো,

‘আরে মামি ধৈর্য ধরুন। আপনার ভাগ্নী খুব চালাক। আমিও কিন্তু কম চালাক না। আপনি নিশ্চিন্তে থাকুন, ওর আর আমার বিয়ে কেউ আটকাতে পারবে না। কেউ না।’

কথাটা বলে সুলাইমান জোরে জোরে হেসে উঠল। তার সাথে মামি ও তাল মেলালো।

_______________________

মামির চলে যাওয়ার খবর শুনে কিছুটা স্বস্তি পেল পদ্ম। তবে দুশ্চিন্তা তার এখনও যায়নি। মামি তো আবার আসবে। তাকে তো একবার না একবার যেতে হবেই। পদ্ম সিদ্ধান্ত নিল। আদিদের সাথে কথা বলবে সে। এই হসপিটালে এক মুহুর্তেও সে শান্তিতে থাকতে পারছে না। তার উপর আবার ঐ সুলাইমান, ওকে দেখলেই কেন যেন পদ্ম’র গায়ে কাটা দেয়। কেমন অদ্ভুত করে তাকায় লোকটা।

পদ্ম নার্স-কে বলে,

‘একটু ডাক্তারবাবু-কে ডেকে দিন না।’

‘কোনো অসুবিধা? আমাকে বলুন..’

‘না, আসলে উনার সাথে আমার একটু কথা ছিল।’

‘ওহ আচ্ছা। আপনি অপেক্ষা করুন, আমি উনাকে ডেকে আনছি..’

চলবে…