পদ্মফুল পর্ব-৫+৬

0
353

#পদ্মফুল
#জান্নাতুল_ফারিয়া_প্রত্যাশা
।৫।

‘ডাক্তারবাবু, প্লীজ। আমি জানি আপনি আপনার পেশেন্টের ব্যাপারে খুব সিরিয়াস। কিন্তু আমার কথাটাও একবার চিন্তা করুন। আমি পারবো না এখানে থাকতে। দুদিন তো দূরে থাক, আর এক মুহুর্তও আমি এখানে শান্তিতে থাকতে পারবো না। ঐ সুলাইমান খুব খারাপ লোক। লোকটা আমাকে এত সহজে ছাড়বে না। ও কিছু না কিছু একটা করবে, আমার মন বলছে ডাক্তারবাবু। প্লীজ, আমায় আপনি আজই যেতে দিন। আমি এখন অনেকটা সুস্থ, আমি পারবো যেতে।’

পদ্ম’র আকুতি ভরা কন্ঠও আদিদের মধ্যে কোনোরূপ ভাবান্তর আনতে পারলো না। সে সামনের চেয়ারটায় বেশ আরাম করে কিছুক্ষণ বসে রইল। পদ্ম চেয়ে রইল লোকটার মুখের দিকে। আদিদ অনেকক্ষণ সময় পর হালকা করে গলা ঝাড়লো। তারপর গম্ভীর গলায় বললো,

‘আপনার কি ধারণা আছে, এই বাইরের জগত একটা মেয়ের জন্য ঠিক কতটা ভয়ানক? ধারণা নেই। আপনাকে আটকে রাখার ক্ষমতা বা ইচ্ছে কোনোটাই আমার নেই। কিন্তু মানবতার খাতিরেও আপনার জন্য আমাকে ভাবতে হচ্ছে। আপনি বাইরে সেইফ নন। বাইরে একা পা রাখলেই হাজারটা বিপদের মুখে পড়তে হবে আপনাকে। যতই বলুক সমাজ দিন দিন সভ্য হচ্ছে, কিন্তু এখনও এই সমাজে এমন অনেক অসভ্য লোক আছে যাদের হাত থেকে আপনি বা আপনার মতো অসহায় মেয়েরা কখনোই রেহাই পাবে না। আপনি বাইরে একা গেলেই সেই অসভ্য লোকগুলো তাদের অসভ্য দৃষ্টি দিয়ে আপনাকে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরবে। বাঁচতে দিবে না আপনাকে তারা। আর যদি বলেন সাহায্য করার কথা, তবে আমি আপনার হয়ে পুলিশের সাথে কথা বলবো। এছাড়া আমার পক্ষে আর কিছু করার সম্ভব না। আপনার অভিভাবক উপস্থিত থাকা অবস্থায় তাদের অনুমতি না নিয়ে আমি আপনাকে অন্য কোথাও পাঠাতে পারবো না। সেই অধিকার আমার নেই। আর আপনাকে এখন এইভাবে ছেড়ে দিলেও পরে আমাকে এর জন্য জবাবদিহিতা করতে হবে। তাই আমি দুঃখিত, আমার পক্ষে আপনার কথা রাখা সম্ভব না।’

আদিদ চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়াল। তারপর সে পদ্ম’র কিছুটা কাছে এসে দাঁড়িয়ে বললো,

‘আল্লাহ-কে বিশ্বাস করেন?’

পদ্ম মাথা নাড়িয়ে “হ্যাঁ” বলে।

আদিদ বলে,

‘আমিও খুব বিশ্বাস করি। আমি বিশ্বাস করি উনি যা করেন ভেবে চিন্তে করেন। তাই আপাতত এইটুকুই বলবো, আল্লাহ্‌র উপয ভরসা রাখুন।’

কথাটা বলে আদিদ সেই কেবিন থেকে বেরিয়ে গেল। পদ্ম দীর্ঘশ্বাস ফেলল। হ্যাঁ সত্যিই, আল্লাহর উপর বিশ্বাস রাখা ছাড়া তার আর এখন কিছুই করার নেই। পদ্ম বেডে হেলান দিয়ে বসে উপরের দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে।

.

আদিদ মাত্রই একটা অপারেশন শেষে ও.টি থেকে বেরিয়েছে। সে হাত থেকে গ্লাবসগুলো খুলতে খুলতে নিজের কেবিনে ঢুকতেই চমকে গিয়ে বললো,

‘মা, তুমি এখানে?’

তার সামনে থাকা পঞ্চাশোর্ধ মহিলাটি ঠোঁট জোড়া প্রসারিত করে হাসলেন। তার চোখগুলোও যেন তখন হেসে উঠল। বয়স বাড়লেও সৌন্দর্যের এইটুকুও কমতি নেই তার মাঝে। হাসলে এখনও যেকোনো ছেলে মুগ্ধ হয়ে তার দিকে তাকাতে বাধ্য। মুখের চামড়া এখনো যেন যুবতীদের মতো চকচক করছে।

রুবি হোসেন হেসে জবাব দিলেন,

‘তোমাকে সারপ্রাইজ দেওয়ার জন্য এলাম।’

আদিদ উদ্বিগ্ন কন্ঠে বললো,

‘তাই বলে একবার আমাকে বলে আসবে না?’

‘বলে আসলে কি আর সারপ্রাইজ হতো?’

আদিদ হাসল। বললো,

‘আচ্ছা বাবা, বুঝেছি। তা হঠাৎ এখানে চলে এলে যে, বাবার সাথে ঝগড়া হয়েছে নাকি?’

‘আরে না। তুমি দুদিন ধরে বাসায় যাচ্ছো না। আমার বুঝি তোমার জন্য দুশ্চিন্তা হয় না? তাই আর থাকতে না পেরে চলে এলাম।’

‘আসলে মা, এইদিকে খুব চাপ। আর অনেকেই ছুটিতে গিয়েছে তো তাই ডক্টর কম থাকায় একটু প্রেশারে পড়ে গিয়েছি আর কী। আমার জন্য তোমাকে কষ্ট করে এখানে আসতে হলো। আমি যেতাম আজকে। কিন্তু…আচ্ছা বাদ দাও সেসব। কী খাবে বলো? চা, কফি নাকি ভারি কোনো খাবার?’

রুবি হোসেন তার হাতের ঘড়িটার দিকে তাকিয়ে বললেন,

‘পাঁচটা বাজে, নিশ্চয়ই এখনো তুমি দুপুরের খাবার খাওনি?’

আদিদ ইতস্তত কন্ঠে বললো,

‘না মানে আসলে মা, ও.টি তে ছিলাম তাই..’

‘আচ্ছা থাক, আর বাহানা দিতে হবে না। আমি বাসা থেকে খাবার রান্না করে নিয়ে এসেছি। তুমি ফ্রেশ হয়ে এসো, আমি খাবার দিচ্ছি।’

আদিদ প্রসন্ন হাসল। পৃথিবীর সব মা’ই কি এমন? এত ভালো? তার হঠাৎ তখন পদ্ম’র কথা মনে পড়ল। মেয়েটা নিশ্চয়ই প্রতি মুহুর্তে মায়ের এই ভালোবাসাটাকে মিস করে? সৃষ্টিকর্তার কত অদ্ভুত মহিমা! কাউকে দুহাত ভর্তি ভালোবাসা দিচ্ছেন তো কাউকে আবার কাউকে সেই ভালোবাসার’ই কাঙ্গাল বানিয়ে রেখেছেন।

আদিদ ভীষণ মজা করে খাবার খেল। মায়ের হাতের রান্না তার বরাবরই প্রিয়। সে তার খাবারের মাঝ থেকে কিছু খাবার রেখে দিল। রুবি হোসেন সেটা খেয়াল করে বললেন,

‘এই খাবারগুলো আবার আলাদা করে রাখছো কেন? সব তো তোমার জন্যই।’

‘মা, আসলে হয়েছে কী আমার একজন পেশেন্ট আছে, তাকে যত্ন বা তিন বেলা খাবার দেওয়ার মতো তার পরিবারের কেউ নেই। মামা মামির কাছে বড়ো হয়েছে, অনাদর আর অবহেলায়। মেয়েটা খুব অসুস্থ। বলতে পারো মানসিক, শারীরিক দুই ভাবেই। ভাবছি মেয়েটাকে খাবারগুলো দিব। তোমার হাতের রান্না খেলে শরীর মন দুইটাই সুস্থ হয়ে যাবে, দেখো।’

রুবি বেগম ব্রু কুঁচকালেন সঙ্গে সঙ্গে। চিকন ফ্রেমের চশমাটা চোখ থেকে খুলে বললেন,

‘আমাকে দেখা করাবে মেয়েটার সাথে?’

আদিদ বললো,

‘আচ্ছা করাবো।’

‘চল, তাহলে এখনই যাই।’

আদিদ খাবারগুলো প্যাক করে তার মা’কে নিয়ে পদ্ম’র কেবিনের দিকে গেল। পদ্ম চোখ বুজে শুয়ে আছে। আদিদ কেবিনের ভেতর প্রবেশ করে নার্সকে জিগ্যেস করলো,

‘উনি কি ঘুমাচ্ছেন?’

‘না স্যার, এক্ষুণি তো আমার সাথে কথা বললো।’

‘ওহ আচ্ছা। আপনি এই খাবারগুলো একটা প্লেটে বেড়ে আনুন।’

নার্সকে খাবারের প্যাকেট’টা দিয়ে আদিদ পদ্ম’র কাছে গেল। রুবি হোসেনও তার পেছনে গিয়ে দাঁড়ালেন। তিনি অবাক হয়ে মেয়েটার মুখের দিকে তাকিয়ে আছেন। কী নিখুঁত মেয়েটার চোখ মুখ। মায়া যেন উপচে পড়ছে তার।

আদিদ তখন পদ্ম-কে ডাকল। পদ্ম চোখ খুলে আদিদ-কে দেখে আস্তে করে উঠে বসলো। তার পাশের মহিলাটিকে চিনতে না পেরে সে গোল গোল চোখে তাকিয়ে রইল তার দিকে। আদিদ তখন হালকা হেসে বললো,

‘উনি আমার মা।’

“মা” কথাটা শুনেই পদ্ম অস্থির হয়ে সঙ্গে সঙ্গে সালাম দিল। রুমি হোসেন তখন সালামের জবাব দিয়ে বললেন,

‘ভালো আছো মা?’

‘জ্বি। আপনি ভালো আছেন?’

‘হ্যাঁ মা। আমিও আলহামদুলিল্লাহ খুব ভালো আছি। আদিদ আমাকে তোমার কথা বলেছে। তোমার নাকি পরিবারে তেমন কেউ নেই। আর তোমার মামা মামিও তোমাকে খুব একটা পছন্দ করেন না, তাই তো?’

পদ্ম কিছু বলে না। সে মাথা নিচু করে বসে থাকে। নার্স তখন সেখানে খাবারের প্লেট নিয়ে উপস্থিত হলে তিনি নার্সের হাত থেকে খাবারের প্লেট’টা নিয়ে বললেন,

‘আমি তোমাকে খাইয়ে দেই?’

পদ্ম অবাক হয়ে উনার দিকে তাকাল। এই মানুষটা তাকে খাইয়ে দিতে চাইছে? চেনে না জানে না একটা মেয়েকে কেবল মায়ার তাড়নায় নিজ হাতে খাইয়ে দিতে চাইছে? পদ্ম তখন মনে মনে ভাবল, ডাক্তারবাবু এইজন্যই এত ভালো। গাছ ভালো হলে তো ফল ভালো হবেই। পদ্ম’র জবাব না পেয়ে রুবি হোসেন বললেন,

‘খাবে না তুমি আমার হাতে?’

পদ্ম মাথা কাত করে বললো,

‘খাবো।’

রুমি হোসেন খুব খুশি হলেন। তিনি ভাত মাখিয়ে পদ্ম’র মুখে লোকমা তুলে দিলেন। পদ্ম অবিশ্বাস্য চোখে তার দিকে তাকিয়ে আছে। এই মানুষটা কত ভালো। কত সুন্দর করে একটা মানুষকে আপন করে নিতে পারে। এতটা যত্ন আর ভালোবাসা নিয়ে কেউ তাকে কখনো খাইয়ে দেইনি। সেই লাস্ট মায়ের হাতে খেয়েছিল। আর তারপর থেকে অধিকাংশ দিনই না খেয়ে পার করে দিত সে। মামা মামির এত এত অপমান সহ্য করে দিন শেষে তার গলা দিয়ে খাবার নামতো না। আজ আবার অনেকদিন পর সে পেট ভরে খেয়েছে। পদ্ম আবেগে আপ্লুত হয়ে বললো,

‘খাবারগুলো খুব মজা হয়েছে।’

আদিদ বলে,

‘আমার মায়ের হাতের রান্না, মজা না হয়ে উপায় আছে।’
.
.

রুবি হোসেন হাত ধুয়ে এসে আদিদকে বললেন,

‘তোর কোনো কাজ থাকলে করতে পারিস। আমি এখন ওর সাথে বসে একটু গল্প করি। কি, গল্প করবে তো আমার সাথে?’

পদ্ম খুশি হয়ে উপর নিচ মাথা নাড়িয়ে সম্মতি জানাল। আদিদ বললো,

‘আচ্ছা, তোমরা গল্প করো আমি মিটিং রুমে আছি।’

রুবি হোসেন পদ্ম’র কাছ থেকে তার জীবনের সব কথা শুনলেন। এইভাবে তো আর একটা মানুষ বাঁচতে পারে না। কিন্তু এই মেয়েটাকে বাঁচাতে হবে। তাই তিনি সিদ্ধান্ত নিলেন পদ্ম-কে তার কাছে রেখে দিবেন। এমন একটা মেয়ে, দেখলেই তো মায়া হয়। এমনিতেও তার একজন সঙ্গীর খুব প্রয়োজন ছিল। আর পদ্ম-কে দেখার পর তার মনে হচ্ছে ওর চেয়ে ভালো সঙ্গী আর কোথাও পাবেন না তিনি। তাই এই সুযোগ তিনি আর হাতছাড়া করবেন না…

চলবে…

#পদ্মফুল
#জান্নাতুল_ফারিয়া_প্রত্যাশা
।৬।

‘মা, তুমি এসব কী বলছো? তুমি চেনো না জানো না একটা মেয়ে-কে শুধুমাত্র মায়ার খাতিরে আমাদের বাড়িতে রাখতে চাইছো, এটা কি আদৌ ঠিক হবে মা?’

রুবি হোসেন শান্ত কন্ঠে বললেন,

‘কেন ঠিক হবে না? তুমি তো মেয়েটার ব্যাপারে সবকিছুই জানো, তারপরও কী করে তুমি এই মেয়েটাকে তার মামা মামির হাতে তুলে দিতে চাইছো, আদিদ? তুমি কি চাও মেয়েটা ম/রে যাক? ঐ মেয়েটার চোখ মুখ দেখলে কি তোমার একটুও মায়া হয় না?’

‘মা, তুমি বুঝতে পারছো না। তুমি সবটা যতটা সহজ ভাবে নিচ্ছো, সবকিছু কিন্তু আদৌ এতটা সহজ নয়। উনার মামা মামি ভালো মানুষ না আর তার উপর উনার আবার একজনের সাথে বিয়েও ঠিক হয়ে আছে। কি যেন নাম..ওহ সুলাইমান। ঐ লোকটাকে আমার মোটেও পছন্দ হয়নি। উনারা জীবনেও পদ্ম-কে আমাদের বাড়িতে থাকতে দিবে না মা। অযথা আমাদের ঝামেলায় ফেলতে চাইবে। দরকার আছে বলো এসব আজাইরা ঝামেলা পোহানোর? উনাকে সাহায্য করতে হলে, আইনানুগ ভাবে করো। কিন্তু এই বাড়িতে নিয়ে যাওয়ার ব্যাপার’টা আমার কেন যেন পছন্দ হচ্ছে না মা।’

রুবি হোসেন তপ্ত শ্বাস ফেললন। বললেন,

‘ওর মামা, মামি আর সুলাইমান-কে যদি আমি রাজি করাতে পারি, তাহলে তো আর কোনো সমস্যা থাকবে না আশা করছি।’

‘কিন্তু উনারা রাজি হবেন না। কোনোভাবেই না।’

‘তুমি উনাদের কল দিয়ে এখানে আসতে বলো। উনাদের সাথে আমি কথা বলবো। তুমি এক্ষুণি উনাদের একবার হসপিটালে আসতে বলো।’

‘কিন্তু মা…’

‘আমি আর কোনো কিন্তু শুনতে চাই না আদিদ। যা বলেছি তাই করো।’

আদিদ রাজি না থাকা সত্ত্বেও মায়ের কথা তাকে মানতেই হলো। ব্যাপার’টা তার কাছে ভীষণ অস্বাভাবিক লাগছে। কিছু সময়ের পরিচয়ের একটা মেয়েকে মা হঠাৎ বাড়িতে রাখার জন্য এত কেন উতলা হয়ে উঠলেন? এটা কী শুধুই মায়া নাকি অন্যকিছু? আদিদের মনটা যেন হঠাৎইম অস্থির হয়ে উঠল। সে গভীর ভাবে মায়ের দিকে তাকাল। অতঃপর নরম সুরে বললো,

‘মা, তুমি কিন্তু সবকিছু জানো। তাই আমি তোমার কাছে শুধু এইটুকুই অনুরোধ করবো, এমন কোনো সিদ্ধান্ত নিও না যেটাতে তোমার ছেলে কষ্ট পাবে। আশা করছি তুমি বুঝতে পারছো আমি কি বলতে চাইছি।’

আদিদের কথায় যেন তার মা ভীষণ মজা পেলে। তিনি হেসে উঠলেন। বললেন,

‘তোমার মায়ের উপর কি তোমার এইটুকুও ভরসা নেই। আমি জানি তুমি কী ভাবছো। নিশ্চিন্তে থাকো তেমন কিছুই হবে না।’

আদিদ তখন আলতো হেসে বললো,

‘আমি নিজের থেকেও তোমাকে বেশি বিশ্বাস করি মা। আমি জানি তুমি সেই বিশ্বাস কখনো ভাঙ্গবে না। ঠিক আছে তবে, তুমি যা চাও তাই হবে। আমি পদ্ম’র মামা মামিকে কল দিয়ে এখানে আসতে বলছি।’

.
.

মাগরিবের আযান হয়েছে কিছুক্ষণ হলো। বাইরে এখনো আবছা আলোর রেশ রয়ে গেছে। রুবি হোসেন জায়নামাজ’টা ভাজ করে আদিদ-কে ডাকলেন। আদিদ মায়ের কাছে এলো। রুবি হোসেন তখন শুধালেন,

‘উনারা এসেছেন?’

‘হ্যাঁ মা, তুমি বসো আমি উনাদের ভেতরে ডেকে আনছি।’

পদ্ম’র মামা মামি রুমের ভেতর ঢুকেই রুবি হোসেনের আপাদমস্তক পরখ করতে লাগলেন। তাকে দেখেই তাদের মনে হলো ভীষণ বড়োলোক। পদ্ম’র মামির চোখ তো বারবার উনার গলার মোটা চেইন আর কানের বড়ো ঝুমকোগুলোর দিকে যাচ্ছে। তার সাথে হাতের মোটা বালাগুলো দেখে তো তিনি চোখই সরাতে পারছেন না। তিনি মনে মনে ভীষণ আফসোস করলেন। হা হুতাশ করে বললেন “ইশ! এই জিনিসগুলো যদি তার হতো।”

রুবি হোসেন প্রসন্ন হেসে বললেন,

‘আপনারা দাঁড়িয়ে আছেন কেন, বসুন।’

‘নেন বসলাম। এবার বলেন তো আমাদের এত তোড়জোড় করে কেন ডাকাইলেন? আইচ্ছা, আমাদের মাইয়ার আবার কিছু হয় নাই তো? এই ডাক্তার পদ্ম ঠিক আছে তো?’

মামির এই আলগা পিরিত দেখে আদিদ বিরক্ত কন্ঠে বললো,

‘চিন্তা করবেন না, উনি একদম ঠিক আছেন। আসলে আমার মা আপনাদের সাথে কিছু কথা বলতে চাই, তাই আপনাদের এইভাবে ডাকা হয়েছে।’

সুলাইমান তার দাড়িতে হাত বুলাতে বুলাতে ব্রু কুঁচকে বললো,

‘আপনার মায়ের আবার আমাদের সাথে কী কথা?’

‘বলছি। আপনারা একটু ধৈর্য ধরে বসুন, আমি সব বলছি। আদিদ, বাবা তুমি একটু বাইরে যাও। আমি উনাদের সাথে একটু একা কথা বলতে চাই।’

মায়ের কথায় আদিদ ভীষণ অবাক হলেও সে কিছু না বলে সেই রুম থেকে বেরিয়ে তার কেবিনে চলে গেল। মায়ের আচরণ’টা এবার তার অনেকটাই অদ্ভুত লাগছে। মা তার সামনে কেন কথা বলতে চাইলো না? কেন? আদিদ চেয়ারে হেলান দিয়ে বসে বসে অনেক কিছু ভাবছে। তার মাথায় নানান দুশ্চিন্তা আসছে। কথাগুলো ভাবতে ভাবতেই হঠাৎ তার মনে হলো সে তার মা-কে সন্দেহ করছে। সে চট করে উঠে বসলো। না না, এটা একদম ঠিক হচ্ছে না। তার মা আজ পর্যন্ত কখনোই কোনো ভুল কোনো সিদ্ধান্ত নেয়নি। আজও নিশ্চয়ই তিনি ভুল কিছু করবেন না। আদিদের চোখে তার মা ভীষণ বিচক্ষণ একজন মানুষ। মা যা করে ভেবেচিন্তেই করে। অযথা তার মা-কে এইভাবে সন্দেহ করা একদম ঠিক হচ্ছে না।

আদিদ তার ওষ্ঠযুগল গোল গোল করে ফুঁস করে নিশ্বাস ছাড়ল। তারপর এসি’টা কুল মুডে দিয়ে সে একটা ফাইল নিয়ে বসলো। এসব কিছু থেকে বেরিয়ে আসতে এখন এই ফাইলটাই একমাত্র তাকে সাহায্য করতে পারে..

প্রায় ঘন্টা খানেক পর রুবি হোসেন আদিদের কেবিনে ঢুকলেন। আদিদ খুব মনোযোগ দিয়ে লেপটপে কিছু করছে। রুবি হোসেন হেসে বললেন,

‘কাজ শেষ হয়েছে আমার ছেলের?’

আদিদ চমকে তাকাল।

‘মা, তোমার কথা বলা শেষ? কী বললেন উনারা? রাজি হয়নি নিশ্চয়ই? আমি জানতাম এমন কিছুই হবে। আচ্ছা, উনারা আবার তোমার সাথে কোনপ্রকার অভদ্র আচরণ করেনি তো? আমি তো..’

‘বাবা থামো, আমাকে এবার একটু কিছু বলতে দাও।’

‘আচ্ছা সরি, বলো।’

রুবি হোসেন খুশ মেজাজে বললেন,

‘উনারা রাজি।’

‘রাজি?’

আদিদ যেন আকাশ থেকে পড়লো। সে অবিশ্বাস্য কন্ঠে বললো,

‘এত সহজে সবাই রাজি হয়ে গেল? ঐ লোকটাও? সিরিয়াসলি মা?’

‘হ্যাঁ, উনারা সত্যি সত্যিই রাজি হয়েছেন। কারো কোনো আপত্তি নেই। ইনফেক্ট ঐ সুলাইমান না যেন কী, সে ও রাজি।’

আদিদের মাথায় ঢুকছে না কিছু। ঐ লোকগুলো এত সহজে কী করে রাজি হয়ে গেল? মা এমন কী বলছে উনাদের যে উনারা বিনা বাক্যে রাজি হয়ে গেল? আশ্চর্য! এটা তো ভীষণ আশ্চর্যের ব্যাপার।

‘তোমাকে আর এসব নিয়ে ভাবতে হবে না। সব সমস্যার সমাধান হয়ে গিয়েছে। এখন আমি নির্দ্বিধায় পদ্ম-কে আমাদের বাড়িতে রাখতে পারবো। আমি বরং পদ্ম’র কেবিনে যাই, ওকেও তো সবকিছু বলতে হবে।’

রুবি হোসেন পদ্ম’র কেবিনের দিকে গেলেন। আর আদিদ এখনো ভাবছে, কিভাবে সম্ভব হলো এসব। ব্যাপার’টা যে এত সহজে সলভ্ হয়ে যাবে সেটা সে চিন্তাও করতে পারেনি। পদ্ম’র মামা মামির মতো মানুষ পদ্ম-কে এত সহজে ছেড়ে দিল? আর ঐ সুলাইমান যার কিনা বিয়ের জন্য তর সইছিল না সেও এত সহজে রাজি হয়ে গেল। হাউ স্ট্রেঞ্জ!
.

পদ্ম কেবিনে একা। সে এক দৃষ্টিতে জানলার বাইরে তাকিয়ে আছে। অন্ধকারে তেমন কিছু দেখা যাচ্ছে না। তাও যেন সেই অন্ধকার দেখেই সে মনে অন্যরকম শান্তি অনুভব করছে। তার মনে হচ্ছে এই তো তার জীবন। কুচকুচে কালো, ঠিক এই অন্ধকারের মতো। যেখানে আলোর কোনো ছিটে ফোটাও নেই। আর যাই একটু আলো আসতে চাইছে তাও এই কুচকুচে অন্ধকারটা গোগ্রাসে গিলে খাচ্ছে। পদ্ম হাসে। কেন হাসে সে জানে না। হাসলে তার গালগুলো রসগোল্লার মতো হয়ে যায়। ছোটবেলায় তার বাবা এই গাল টেনে খুব আদর করতো তাকে। পদ্ম হাসি থামিয়ে আবার বাইরের দিকে তাকায়। তখন সে পেছন থেকে কারোর গলা শুনতে পায়। পেছনে ফিরে রুবি হোসেন-কে দেখে হঠাৎই খুব আনন্দ লাগে তার। রুবি হোসেন তার কাছে এগিয়ে এলেন। তার পাশে গিয়ে বসলেন। বললেন,

‘একটা অনুরোধ করবো, রাখবে মা?’

পদ্ম বিস্মিত চোখে তাকায়। এত ভালোবেসে কেউ অনুরোধ করলে কি সেই অনুরোধ ফেলা যায়। পদ্মও তখন মিষ্টি হেসে বললো,

‘বলুন, কী অনুরোধ?’

রুবি হোসেন একটু সময় নিয়ে বললেন,

‘আমি চাই তুমি আমার সাথে আমার বাড়িতে থাকো। তুমি তো বলেছো, তুমি তোমার মামা মামির কাছে যেতে যাও না। তাছাড়া আর কোথায় যাবে তুমি? তাই আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছি তুমি আমার সাথে থাকবে, আমার মেয়ে হয়ে।’

পদ্ম কী বলবে বুঝতে পারছে না। আর এই মানুষটা কী বলছে সেটাও তার বোধগম্য হচ্ছে না। পদ্ম উনার বাড়িতে কী করে গিয়ে থাকবে? এটা কিভাবে সম্ভব? পদ্ম বিস্ময় নিয়ে বললো,

‘এটা কিভাবে সম্ভব আন্টি। আমি আপনার সাথে আপনার বাড়িতে থাকবো? না না এটা কেমন দেখায়। আর তাছাড়া আমার মামা মামি..’

‘তোমার মামা মামির সাথে আমার কথা হয়েছে। সুলাইমানের সাথেও কথা হয়েছে। ওদের কারোরই কোনো আপত্তি নেই। মা, তুমি আমার মেয়ে হয়ে আমার বাড়িতে থাকবে। তুমি জানো আমাকে বাসায় সবসময় একা থাকতে হয়। আদিদ থাকে সারাক্ষণ ওর হসপিটাল নিয়ে আর আদিদের বাবা থাকে তার ব্যবসা বাণিজ্য নিয়ে। আমি বাসায় একা একা কী করবো বলো। সারাদিন শুয়ে বসে আমার সময় কাটে। গল্প করার মতোও কাউকে পায় না। তোমারও তো মা কেউ নেই। তুমি কি চাও না একটু ভালো থাকতে? নাকি চাও মামা মামির কাছে ফিরে গিয়ে ঐ সুলাইমানকে বিয়ে করতে? কী চাও তুমি, বলো?’

পদ্ম চুপ হয়ে থাকে। রুবি হোসেন মোলায়েম গলায় বললেন,

‘আমি একজন মা। মা হিসেবে তুমি আমার উপর এইটুকু ভরসা তো করতেই পারো। আমি তোমায় জোর করবো না। তবে মা হিসেবে কেবল এই অনুরোধ’টাই করবো, আমার কথাটা ফেলো না প্লীজ।’

রুবি হোসেন পদ্ম’র গালে হাত রেখে ভেজা চোখে তাকিয়ে রইলেন। পদ্ম’র মনে হলো এই চোখগুলো মিথ্যে না। মানুষটাকে বিশ্বাস করা যায়। হয়তো আল্লাহই তার কষ্টের কথা ভেবে এসব করছেন। হয়তো তিনি এই মানুষটার মাধ্যমেই তার বেঁচে থাকার মাধ্যম উন্মোচন করে দিয়েছেন। যদি সৃষ্টিকর্তা সত্যিই এমন কিছু চায়, তবে সেও তাতে রাজি। অনেক তো কষ্ট ভোগ করেছে, এবার না হয় একটু মানুষের ভালোবাসা পাবে। তার জন্য তো এই একটু ভালোবাসায় বিশাল।

পদ্ম’র তাই চাপা নিশ্বাস ফেলে বললো,

‘ঠিক আছে আন্টি, আমি রাজি।’

রুবি হোসেন ভীষণ খুশি হয়ে তাকে জড়িয়ে ধরলেন। একজন মা-কে জড়িয়ে ধরতে পেরে পদ্ম’র সমস্ত কষ্ট যেন তখন নিমিষেই দূর হয়ে গেল।

চলবে…