পদ্মফুল পর্ব-৭+৮

0
327

#পদ্মফুল
#জান্নাতুল_ফারিয়া_প্রত্যাশা
।৭।

বাইরে ফকফকা রোদ। আরেকটা সুন্দর সকাল। রুমের ভেতরের বা পাশটায় অনেকটা অংশ জুড়ে রোদ পড়ে আছে। পদ্ম এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে সেই রোদ দেখছে। সে কিছুক্ষণ ঐভাবে তাকিয়ে থাকার পর আস্তে করে বেড থেকে নেমে সেই রোদের মাঝে গিয়ে দাঁড়াল। তাপহীন রোদ। শরীরে আরাম বোধ করছে। কিছুটা সময় দাঁড়িয়ে থেকে সে তার জায়াগায় আবার ফিরে এলো। তখনই কেবিনে নার্স এলো সকালের নাস্তা নিয়ে। নাস্তার প্লেট’টা এগিয়ে দিয়ে নার্স তাকে বললো,

‘স্যার বলেছে নাস্তা করে তাড়াতাড়ি তৈরি হওয়ার জন্য।’

পদ্ম নাস্তা শেষ করে ওয়াশরুমে গিয়ে হাত মুখ ধুয়ে এলো। সে বেরুতেই নার্স তার দিকে একটা প্যাকেট এগিয়ে দিয়ে বললো,

‘এখানে একটা জামা আছে, পরে দেখুন আপনার হয় কিনা?’

পদ্ম বিস্মিত হলো। অবাক কন্ঠে বললো,

‘কে দিয়েছে এই জামা?’

‘আমি কিনেছি। আপনি দু দিন ধরে এই এক জামা’ই পরে আছেন। আজ আমার একজনের বাসায় যাবেন, এই ময়লা পুরাতন জামা পরে কি আর যাওয়া যায় বলুন। তাই এটা কিনে আনলাম। যদিও আপনার মাপ জানি না, তবে আপনার মতোই আমার এক ছোট বোন আছে তাই ওর মাপ অনুযায়ী নিয়ে এসেছি। জানি না হবে কিনা, একবার ট্রাই করে দেখলে খুশি হবো।’

নার্স জামার ব্যাগ’টা পদ্ম’র দিকে এগিয়ে দিয়ে কথাটা বললো। পদ্ম এখনো বিস্ময় নিয়ে তাকিয়ে আছে। সে ভীষণ অবাক হয়। সবকিছু কত অদ্ভুত! যাদের সাথে তার রক্তের সম্পর্ক তারা তাকে নিয়ে এইটুকুও ভাবে না অথচ এই মানুষটা, যার সাথে তার কোনো সম্পর্ক’ই নেই সে তার কথা ভেবে তার জন্য জামা পর্যন্ত কিনে নিয়ে এসেছে। আসলেই, পৃথিবীতে এখন রক্তের চেয়ে আত্মিক সম্পর্কগুলোর মূল্য অনেক বেশি।

পদ্ম ওয়াশরুম থেকে জামা’টা পরে বেরুল। নার্স তাকে দেখে অবাক হলো। কী সুন্দর ফিটিং হয়েছে! আর একটা সামান্য সুতি জামাতেও মেয়েটাকে কী সুন্দর মানিয়েছে! আসলে কথায় আছে না, সুন্দর মানুষকে সবকিছুতেই সুন্দর লাগে। পদ্মও তো তাই, ভীষণ সুন্দর একটা মানুষ।

পদ্ম হেসে বললো,

‘আমাকে কেমন লাগছে, আপু?’

‘খুব সুন্দর।’

‘জামা’টা খুব সুন্দর হয়েছে। আমার খুব পছন্দ হয়েছে। ধন্যবাদ আপু। আমি আপনার ভালোবাসার কাছে চির কৃতজ্ঞ থাকবো। এইখানে আসার পর থেকেই আপনি আমার অনেক যত্ন নিয়েছেন, আমাকে নিজ হাতে খাইয়ে পর্যন্ত দিয়েছেন। আমি আপনাকে কখনো ভুলবো না, আপু। আজীবন কৃতজ্ঞ থাকবো।’

পদ্ম’র কথা শুনে নার্স মনে যেন প্রশান্তি পেল। কাউকে খুশী করার মাঝেও ভীষণ সুখ পাওয়া। যে সুখ’টা আর অন্যকিছুতে পাওয়া যায় না। নার্স প্রসন্ন হেসে বললো,

‘আমারও আপনার কথা মনে থাকবে। আপনি খুব ভালো একটা মেয়ে। আমি দোয়া করবো আপনার জন্য, দেখবেন আপনার সব কষ্ট একদিন দূর হয়ে যাবে।’

পদ্ম’র অক্ষিযুগল যেন ভিজে উঠল। সে আর কিছু বললো না। নার্সটি তখন বললো,

‘আপনার চুল’টা বেঁধে দেই।’

‘আচ্ছা।’

পদ্ম’র চুলে খুব যত্ন করে বিনুনি করতে করতে নার্স বললো,

‘আপনার চুলগুলোও খুব সুন্দর। জানেন, আপনাকে যখন ও.টি তে নেওয়া হয়েছিল তখন তো প্রথমে আমি ভেবেছিলাম আপনি মাথার উপরে ব্যাথা পেয়েছেন; হয়তো সেই জায়গার চুল ফেলে তারপর সে/লাই করতে হবে। পরে দেখলাম না মাথায় না কপালে ব্যথা পেয়েছেন, তখন খুব শান্তি লাগছিল এটা ভেবে যে, অন্তত এই সুন্দর চুলগুলো তো আর ফেলতে হবে না।’

পদ্ম আলতো হাসল। তারপর হঠাৎ আবার মুখটা গম্ভীর করে বললো,

‘আচ্ছা, সেলাই কবে খুলবেন?’

‘স্যার বলেছে কালকে খুলবে।’

‘সেলাই খোলার সময় কি ব্যথা পাওয়া যায়?’

‘না, অতটাও না। হালকা।’

‘ওহ।’
.
.

আদিদ তার সমস্ত কাজ শেষ করে পদ্ম’র কেবিনে এলো। তারপর সে পদ্ম-কে উদ্দেশ্য করে বললো,

‘আপনি কি তৈরি?’

পদ্ম ইতস্তত কন্ঠে বললো,

‘জ্বি।’

‘চলুন তাহলে। উমম, আপনি কি হেঁটে গাড়ি পর্যন্ত যেতে পারবেন নাকি হুইল চেয়ারের ব্যবস্থা করবো?’

‘না না, আমি পারবো।’

‘স্যার, আপনি যান আমি উনাকে ধরে নিয়ে আসছি।’

‘আচ্ছা ঠিক আছে, আসুন।’

বাইরের খোলা আকাশের নিচে আসতেই পদ্ম’র মন’টা যেন ফুরফুরে হয়ে উঠল। এই দুই দিন নিজেকে জেলখানার এক কয়েদী মনে হয়েছে। হসপিটালের ভেতরের পরিবেশ’টা যেন কেমন। অদ্ভুত নিরব চারপাশ, কোনো হৈ চৈ নেই, নেই কোনো কোলাহল। এই নিরবতা যেন গায়ে কাটা দিয়ে উঠে। পদ্ম’র এমন পরিবেশ পছন্দ না। তার তো পছন্দ এই এত এত মানুষ, এই এত এত মানুষের ব্যস্ত পদধ্বনি। তাদের হৈ চৈ, কোলাহল। জীবন তো তার এসব দেখেই অভ্যস্ত। সে প্রাণ ভরে নিশ্বাস নিল। এই তো ফট করে নাসারন্ধ্র দিয়ে গাড়ির একটা বিচ্ছিরি গন্ধ ঢুকে পড়ল। কিন্তু সেটাতেও সে যেন শান্তি খুঁজে পেল।

নার্স পদ্ম-কে গাড়িতে বসিয়ে এক সাইডে গিয়ে দাঁড়াল। আদিদ তখন নার্সকে বললো,

‘কোনো অসুবিধে হলে আমাকে কল দিয়েন। আর আমি সন্ধ্যার মধ্যেই ব্যাক করার চেষ্টা করবো। আরেকটা কাজ করবেন, ড. সাদিক-কে বলবেন একটু আমার পেশেন্টগুলোর দিকে খেয়াল রাখার জন্য।’

‘আচ্ছা স্যার, আমি বলে দিব।’

‘ঠিক আছে।’

আদিদ ড্রাইভিং সিটে বসে গাড়ি স্টার্ট দিল। পদ্ম তার হাত বের তখন নার্স-কে বিদায় জানাতে ব্যস্ত। আদিদ বললো,

‘হাত’টা ভেতরে আনুন, আমি জানলাগুলো তুলে দিব।’

পদ্ম সঙ্গে সঙ্গে হাত ভেতরে নিয়ে এলো। আদিদ তখন জানলাগুলো তুলে দিয়ে এ.সি অন করে দিল।

পদ্ম সিটে হেলান দিয়ে বসে আছে। আদিদ আড় চোখে একবার তার দিকে তাকিয়ে বললো,

‘সিট বেল্ট লাগান’নি কেন?’

পদ্ম নিজের দিকে তাকিয়ে আস্তে করে বললো,

‘লাগাচ্ছি।’

সিট বেল্ট লাগিয়ে সে আবার সিটে হেলান দিয়ে বসলো। কেন যেন খুব অস্বস্তি হচ্ছে তার। ব্যাপার’টা যেন কেমন দেখাচ্ছে, এইভাবে দুদিনের পরিচয়ে একজনের বাড়িতে থাকতে চলে যাচ্ছে সে। যতই তারা ভালো মানুষ হোক না কেন, তাও তো নিজের কাছে কেমন একটা লাগে। এইভাবে কারোর বাসায় আশ্রিতা হয়ে থাকা’টা কি ঠিক। ব্যাপার’টা একদমই ভালো দেখায় না। পদ্ম মনে মনে ঠিক করে নেয়, সে ঐ বাড়িতে এমনি এমনি থাকবে না। তার বিনিময়ে সে ঐ বাড়ির সব কাজ করবে। মামার বাড়িতে থাকতে তো এসবই করেছে সে। তাও তো কোনো দিন মামির মন পায়নি। উল্টো কিছু থেকে কিছু হলেই তাকে মা/র খেতে হয়েছে। এখানে তো সে কাজ করার বিনিময়ে একটু ভালোবাসা পাবে। সেটাই তার জন্য অনেক।

অনেক’টা পথ তারা এলো। রাস্তা’টা ভীষণ সুন্দর। তাদের গাড়ি’টা শো শো করে এগিয়ে যাচ্ছে। তার সাথে পাল্লা দিয়ে পেছনের দিকে ছুটে যাচ্ছে রাস্তার দু পাড়ের গাছগুলো। বাইরে ভীষণ বাতাস। পদ্ম’র খুব ইচ্ছে করছে জানলা’টা খুলে একটু বাইরের হাওয়া খাওয়ার জন্য। কিন্তু সে এই কথাটা কোনোভাবেই আদিদ-কে বলতে পারছে না। সে কেবল বিষন্ন চোখে বাইরের দিকে তাকিয়েই আছে। ইশ, যদি একটু হাওয়া খেতে পারতো!

বলবে বলবে করতে করতেই তারা তাদের গন্তব্যে এসে পৌঁছে গেল। আদিদ পদ্ম’র পাশের দরজা’টা খুলে দিয়ে বললো,

‘নামুন।’

পদ্ম গাড়ি থেকে নেমে কৌতুহল নিয়ে এদিক ওদিক তাকাল। সামনেই সে দেখল একটা বিশাল গেইট। যার বাকি চারপাশ বড়ো দেয়াল দিয়ে বাউন্ডারি করা। তাহলে কি এটাই ডাক্তারবাবুর বাড়ি?
পদ্ম’র মনের অস্বস্তি’টা এক লাফে যেন তখন আকাশ ছুঁলো। মনটা ভীষণ খচখচ করছে তার। তার বার বার কেন যেন মনে হচ্ছে, সে এখানেও ভালো থাকতে পারবে না। সত্যিই কি তাই, নাকি পুরোটাই তার দুশ্চিন্তা?

চলবে…

#পদ্মফুল
#জান্নাতুল_ফারিয়া_প্রত্যাশা
।৮।

পদ্ম’র সামনে এক গাদা খাবার এনে রাখা হলো। সে যেন অস্বস্তিতে মরে যাচ্ছে। এই ছোট্ট একটা জীবনে এত সমাদর আগে কখনো পায়নি সে। তাই এক সঙ্গে এত সব তার হজম করতে একটু কষ্ট হয়ে যাচ্ছে।

পদ্ম কোনো খাবার ধরছে না দেখে রুবি হোসেন তার মাথায় হাত রেখে বললেন,

‘কী হলো মা, কিছু খাচ্ছো না কেন?’

পদ্ম অস্বস্তি ভরা হাসি দিয়ে একটা আপেলের টুকরো প্লেট থেকে হাতে নিল। রুবি হোসেন পুনরায় তখন বললেন,

‘খাওয়ার পর তোমাকে তোমার রুম দেখাবো। আমি নিজের হাতে তোমার রুম গুছিয়েছি।’

পদ্ম কী বলবে বুঝে উঠতে পারে না। একে তো এত বড়ো বাড়ি, তার উপর সবকিছু অচেনা অজানা। সব মিলিয়ে ভীষণ অস্থির লাগছে তার। ডাক্তারবাবু-কে যাই একটু চেনে কিন্তু সেও যে সেই রুমে গিয়েছে আর আসার নাম গন্ধ’ই নেই।

রুবি হোসেনের জোরাজুরিতে অনেক কিছুই পদ্ম’কে খেতে হলো। যদিও তার গলা দিয়ে খাবার নামছিল না। তাও না খেয়ে পারলো না।

খাওয়ার পাঠ চুকিয়ে রুবি হোসেন পদ্ম’কে নিয়ে গেলেন তার রুম দেখাতে। উনি উনার নিজের রুমের পাশের রুমটাতেই পদ্ম’র থাকার ব্যবস্থা করেছেন।

কাঠের কারুকার্য করা দরজাটা খুলে রুবি হোসেন হাসি মুখে বললেন,

‘এটা আজ থেকে তোমার রুম পদ্ম। দেখতো পছন্দ হয় কিনা?’

পদ্ম নির্বাক হয়ে চেয়ে আছে কেবল। এটা তার রুম? সে আজ থেকে এই রুমে থাকবে? সিরিয়াসলি? মামার বাড়িতে ছোট্ট একটা স্টোর রুমেতে থেকে এসেছে সে। এটা তো তার আগের রুমের চেয়ে তিন গুণ বড়ো হবে। এত বড়ো বিছানা তার জন্য? বিছানার পাশে এডজাস্ট টেবিলটাতে ছোট্ট একটা ল্যাম্পশেড। রুমের একপাশে একটা আলমারি। তার বিপরীত পাশে ছোট একটা স্টাডি টেবিল। ঠিক তার পাশের কর্ণারেই একটা বুক শেলফ। বুক শেলফটাতে চোখ যেতেই তার মনটা লাফিয়ে উঠল। কতদিন বই পড়া হয় না। আহা, নিজের চোখকে যেন সে বিশ্বাস করতে পারছে না। সত্যিই এই এত সব তার জন্য করা হয়েছে?

পদ্ম’র বিস্ময় কাটল রুবি হোসেনের কন্ঠে। তিনি তাকে জিগ্যেস করলেন,

‘পছন্দ হয়েছে? নাহলে বলতে পারো, আমি তোমার পছন্দ অনুযায়ী..’

‘খুব পছন্দ হয়েছে। বিশ্বাস করুন, আপনাকে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করার মতো কোনো ভাষা আমার জানা নেই। কিন্তু এত কিছু আমার জন্য? কেন আন্টি? এর বিনিময়ে যে আমার কাছে কিচ্ছু নেই আপনাকে দেয়ার মতো। আমি যে আপনার কাছে আজীবন ঋণী থেকে যাবো।’

রুবি হোসেন হাসলেন। বললেন,

‘চিন্তা করো না, তোমাকে আমি ঋণী করে রাখবো না। এখন আর এসব নিয়ে ভেবো না তো। যাও গিয়ে ফ্রেশ হও। আর শোনো আলমারিতে দেখো, তোমার জন্য কিছু ড্রেস কিনে রেখেছি। ঐগুলো তোমার হয় কিনা পরে দেখো। না হয় চেঞ্জ করে আনতে হবে। ঠিক আছে তাহলে তুমি ফ্রেশ হয়ে রেস্ট নাও। আমি তোমার পাশের রুমেই আছি। কোনো অসুবিধা হলে বলো, কেমন?’

‘আচ্ছা আন্টি।’

রুবি হোসেন দরজাটা চাপিয়ে দিয়ে নিজের রুমে চলে গেলেন। পদ্ম বিছানায় গিয়ে বসলো। চোখ ঘুরিয়ে রুমের সবকিছু আবার একবার দেখল। বিছানা বরাবর একটা ড্রেসিং টেবিলও আছে। পদ্ম ঘুরে সেই আয়নার দিকে তাকাল। আয়নায় ফুটে উঠা নিজের প্রতিবিম্ব’টা দেখে নিজেকে বড্ড অসহায় মনে হলো তার। মানুষ ঠিক কতটা অসহায় হলে এইভাবে অন্য একজনের বাসায় এসে থাকতে পারে। পদ্ম ঠিক বুঝে উঠতে পারছে না কেন, কেন রুবি হোসেন তার জন্য এত কিছু করছেন। এই স্বার্থপর পৃথিবীতে কি এখন আর কেউ নিজ স্বার্থ ছাড়া কিছু করে? করে না তো। তাহলে এই মানুষটা কেন করছে? কেন তাকে এতটা ভালোবাসা দিচ্ছে? সত্যিই কি এর পেছনে কোনো স্বার্থ নেই? পদ্ম’র মন কোনো জবাব দিতে পারে না। সে থম মেরে কিছুক্ষণ বসে থেকে ওয়াশরুমে চলে যায় ফ্রেশ হতে।

__________________

‘মা, মেয়েটাকে তুমি কতদিন এই বাড়িতে রাখবে? একবার না একবার দেখবে ঠিকই তার মামা মামি চলে এসেছে তাকে নেয়ার জন্য।’

‘আসবে না।’

‘তুমি এতটা সিউর কী করে হচ্ছো?’

রুবি হোসেন ছেলের দিকে ব্রু কুঁচকে তাকালেন। বললেন,

‘আমি কথা বলেছি উনাদের সাথে, তাই আমি এতটা সিউর। তোমাকে এসব ব্যাপারে আর ভাবতে হবে না। পদ্ম-কে নিয়ে আমি ভাববো। ওর সমস্ত দায়িত্ব আমার, তুমি নিশ্চিন্তে থাকো।’

আদিদ খানিক বিরক্ত গলায় বললো,

‘মা, বললেই কী আর নিশ্চিন্তে থাকা যায়। এইভাবে একটা অপরিচিত মেয়েকে বাসায় রাখা কতটা রিস্কি তুমি জানো? আজকাল কত কিছু ঘটছে। বাসায় সারাদিন আমি, বাবা কেউই থাকি না। দুই জন কাজের লোক ছাড়া আর কেউই নেই এই বাড়িতে। বলতে গেলে তুমি পুরো একাই থাকো। এর মধ্যে এইভাবে একটা মেয়ে বাসায় থাকলে কি নিশ্চিন্তে থাকা যায়? মাথার ভেতর কত সব চিন্তা আসে তোমার কোনো ধারণা আছে? মা একটা কথা বলি, উনাকে তো চাইলে আমরা ভালো একটা আশ্রমে দিয়ে আসতে পারি। সেখানে উনিও সেইফ থাকতে পারবে আর আমাকেও অযথা এসব নিয়ে আর ভাবতে হবে না, তাই না?’

‘তোমাকে ভাবতে কে বলেছে? বলেছি আমি? বলেনি তো। তাহলে এত ভাবছো কেন? বললাম তো ঐ মেয়ের দায়িত্ব আমার। আর কিসের এত ভয় পাচ্ছো তুমি? তোমার কি মনে হয়, ঐ মেয়ের দ্বারা আমার কোনো বিপদ হতে পারে? শুনো আদিদ, পৃথিবীতে না কিছু মানুষ আছে, যারা খুব কষ্টে থাকার পর হুট করেই একটু সুখ আর ভালোবাসার দেখা পেলে তারা এতটাই আবেগপ্রবণ হয়ে যায় যে, সেই ভালোবাসা আর সুখ প্রদানকারী-কে তারা তখন মাথায় তুলে রাখে। পদ্মও হলো সেসব মানুষদের মতো। ওকে নিয়ে দুশ্চিন্তা করার মতো কিছুই নেই, বুঝলে তো।’

আদিদ আর তর্কে জড়ালো না। সে নিজেও জানে না কেন তার মা পদ্ম-কে এত পছন্দ করে ফেলেছে? আপাতত যা হচ্ছে সেটাকে সেইভাবেই চলতে দেওয়া উচিত বলে তার মনে হলো। তাই আদিদ আর কথা বাড়াল না। মায়ের রুম থেকে বেরুতেই পাশের রুমের দিকে চোখ গেল তার। সে তখন ভাবছে, পদ্ম’র রুমে একবার যাবে নাকি যাবে না। তার মন বলছে একবার যাওয়া উচিত। তারা বাসায় এসেছে অনেকক্ষণ হয়েছে, কিন্ত আসার পর থেকে সে একবারও পদ্ম’র খোঁজ নেয়নি। অন্তত ডক্টর হিসেবে তাকে তার পেশেন্টকে একবার দেখা উচিত।

দরজায় টোকা দিয়ে আদিদ বললো,

‘আসবো?’

‘জ্বি, আসুন।’

আদিদ পদ্ম’র রুমে ঢুকতেই পদ্ম বসা থেকে উঠে দাঁড়াল। আদিদ বললো,

‘দাঁড়াতে হবে না, বসুন।’

পদ্ম বসলো। আদিদ তার রুম’টা ভালো ভাবে দেখে বললো,

‘কোনো অসুবিধা হচ্ছে না তো?’

পদ্ম মাথা নাড়িয়ে বললো,

‘না না, কোনো অসুবিধা হচ্ছে না। আপনারা আমার জন্য অনেক করেছেন, ডাক্তারবাবু। এত কিছুর পরেও কি আমার কোনো অসুবিধা থাকতে পারে, বলুন।’

আদিদ পদ্ম’র সামনে এসে দাঁড়াল। গম্ভীর সুরে বললো,

‘একটা কথা বলি কিছু মনে করবেন না, আপনি দয়া করে আমাকে ডাক্তারবাবু বলা বন্ধ করুন। আমার এই শব্দ’টা পছন্দ না। আপনি চাইলে আমাকে আমার নাম ধরে ডাকতে পারেন আর নয়তো “ডাক্তার সাহেব” বলে ডাকতে পারেন বাট “ডাক্তারবাবু” না।’

পদ্ম খানিকটা বিব্রত বোধ করলো যেন। হঠাৎ ডাক্তারবাবু আবার এমন কথা কেন বলছেন? আগে তো কিছু বলেননি। তাহলে আজ হঠাৎ কী হলো?

পদ্ম’র চোখমুখ দেখে আদিদ বুঝতে পারে তার কথায় সে অবাক হয়েছে ভীষণ। কিন্তু সে বিষয়টাকে তেমন আওতায় আনেনি। সে মৃদু সুরে বললো,

‘এত ভাবতে হবে না। জাস্ট নরমাল একটা কথা বলেছি। আমি ডাক্তারবাবু শুনতে অভ্যস্ত না। তাই কথাটা বলেছি। আশা করি বুঝতে পেরেছেন।’

আদিদ তার কথা শেষ করে পদ্ম’র রুম থেকে বেরিয়ে গেল। পদ্ম এখনও আগের মতোই বিস্মিত হয়ে ভাবছে,

“ডাক্তারবাবুর আজ হলো’টা কী? আমার এখানে থাকাটা কি উনি পছন্দ করছেন না? নাকি অন্যকিছু?”

চলবে…