পুষ্পের নিদ্র পর্ব-০১

0
637

#পুষ্পের_নিদ্র
#আনআমতা_হাসান
পর্ব : ১

রাত ১১:৪৫ বাজে নিজের রুমে বিছানাতে ১৫ মিনিট ধরে শুয়ে আছে পুষ্প। বার বার বালিসের পাশ থেকে ফোন হাতে নিয়ে পাসওয়ার্ড দিয়ে লক খুলছে টাইম দেখছে, কল লিস্ট চেক করছে আবার ফোনের সাইডের ছোট বাটনটা হালকা চেপে ফোনটা লক করে বালিশের পাশে রেখে দিচ্ছে। তার বুকটা ধুকপুক করছে। ১১:৩০ থেকে ১২টার মধ্যে যে কোন সময়ই তার ফোনটা বেজে উঠতে পারে। প্রতিদিনই এই সময় এই ফোন আসে যা রিসিভ না করা বা কেটে দেওয়ার মতো দুঃসাহস তার নেই। সপ্নেও হবেনা।

রাত ১১:৫৮ মিনিটে ফোন বেজে উঠলো। সাথে পুষ্পের বুকটাও ধুপ করে উঠলো। তাড়াতাড়ি হাত বারিয়ে ফোনটা হাতে নিল সে। স্কিনে একটা শ্যামবর্নের ছেলের গম্ভীর মুখ দেখে বুকের ধুকপুকানিটা আরও বেরে গেল। নিজেকে সামলে ফোনটা রিসিভ করে বলল
– আসসালামু আলাইকুম নিদ্র ভাইয়া।

ফোনের ওপাশ থেকে গম্ভীর পুরুষালী কন্ঠে নিদ্র বলল
– ওয়ালাইকুম আসসালাম। ঘুমিয়ে গিয়েছিলে?

– না ভাইয়া।

– কেন ঘুমাও নি? আমার ফোনের অপেক্ষায় ছিলে? আমার ফোন দোরতে দেরি হলে আমি বকা দিব সেই ভয়ে ঘুমাওনি?

পুষ্প চুপ করে আছে। কিছু সময় নীরবতা কাটার পর নিদ্র আবার বলল
– আচ্ছা তুমি আমাকে এতো ভয়পাও কেন? আমি কি তোমাকে কোনদিন মেরেছি? মারা তোও দূরের কথা, তোমার হাত নরম না শক্ত তাও আমি কোনদিন টাচ করে দেখিনি। হ্যাঁ, এটা বলতে পারবে তুমি দোষ করলে আমি তোমাকে দমক দিয়ে কথা বলি, ভয় দেখাই। তুমি এটা করলে আমি ওইটা করবো, ছোট খাট কিছু শাস্তি দেই। এর বেশি কিছু কি কখনো করেছি?

একটু থেমে একটা দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলে নিদ্র বলল
– শুধু একটা কাজ করেছি তোমার ১৮তম জন্মদিনের দিন তোমাকে ভয় দেখিয়ে বিয়ে করেছি। কি করতাম আমি তাছাড়া বলতো? তোমাকে যে আমি অনেক ভালোবাসি পুষ্প। আর এই ভালোবাসার মানুষটাকে হারানোর ভয় যে আমাকে প্রতিমুহূর্তে কুরে কুরে খাচ্ছিল।

তাচ্ছিল্য হাসি দিয়ে নিদ্র আবার বলল
– কিন্তু তাতে লাভ হলো কি বল। না তুমি ভালোবেসে আমার কাছে আসলে। না ফ্যামিলিগত ভাবে আমাদের বিয়ে হলো। বিয়ের পর থেকে এই সাত বছরে কয়েকশবার তোমার মাকে আমার মা আমাদের বিয়ের কথা বলেছে। প্রথম প্রথম বলত তুমি ছোট। এখন বলে তুমি আমাকে ভয় পাও। আমি অনেক রাগী, মারামারি করি। কেউ না জানলেও তুমি জানো ৭ বছর আগে সজীবকে আমি কেন মেরেছিলাম আর কিছুদিন আগে রাকিবের মতো একটা বখাটে ছেলেকে মেরেছি বলে আমি গুন্ডা হয়ে গেলাম তোমাদের কাছে? হাহ। নিজেকে সবসময় সান্তনা দিয়ে এসেছি যে কোনদিন কোন না কোন ভাবে আমি তোমাকে পাব। কিন্তু আজকে যখন জানতে পারলাম তপুর সাথে তোমার বিয়ে ঠিক হয়েছে তখন আর কোন আশাই যে দেখছিনা। কিভাবে নিজের ভালোবাদার মানুষ, নিজের অর্ধাঙ্গিনীর বিয়ে দেখব বলতো? এর থেকে যে মরাও আমার জন্য সহজ।

পুষ্প ভীত ক্ষীণ কন্ঠে বলল
– কি আবল-তাবল কথা বলছেন?

পুষ্পের ক্ষীণ কন্ঠে বলা কথাটা নিদ্র শুনতে পেল কিনা তা পুষ্প বুঝতে পারে না। নিদ্র কষ্টের হাসি হেসে বলল
– ভালোবাসি পুষ্প। খুব ভালোবাসি তোমায়।

তারপর কোন কিছু পরার শব্দ হলো আর সাথে সাথেই ফোনটা কেটে গেল।

পুষ্প উদ্বিগ্ন হয়ে কিছুটা জোড়ে বলল
– কি হয়েছে ঠিক আছেন তোও আপনি? হ্যালো নিদ্র ভাইয়া। হ্যালো।

ওপাশ থেকে কোন সারাশব্দ পাচ্ছেনা দেখে ফোনটা কান থেকে চোখের সামনে এনে দেখলো ফোনটা কেটে গেছে। সাথে সাথে কল ব্যাক করলো পুষ্প। কিন্তু ফোন বন্ধ পেল। ৬-৭ বার ফোন দিলো। কিন্তু কোন লাভ হলো না। ফোন বন্ধ। ভয়ে পুষ্পের হাত-পা ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে। এখন কি করবে ও? নিদ্র ঠিক আছে কি না সে খবর কোথা থেকে নেবে। কান্না করা শুরু করে দিল। নিদ্রকে ও যেমন সব থেকে বেশি ভয় পায়, ঠিক তেমনি সব থেকে বেশি ভালোও বাসে। আর ভালোবাসবেনাই বা কেন? নিদ্র ওকে ভয় দেখিয়ে বিয়ে করলেও কোনদিন স্বামীর অধিকার খাটানি। ওকে প্রমিজ করেছে ওর পারমিশন ছাড়া ওদের বিয়ের কথা কাউকে বলবে না। বকাবকি যা করে তা যে ওর ভালোর জন্যই করে তাও ও খুব ভালো করেই জানে। কিন্তু ও যে ভীত মেয়ে। তাই সাহস করে ঐ ভালোবাসাপূর্ণ রাগী মানুষটাকে কিছু বলতে পারে না। কি করবে তা ভাবতে ভাবতেই হঠাৎ পুষ্পের মনে পরলো নিদ্রের মায়ের কথা। নিদ্র নিজেই একদিন তার ফোনের নিজের বাবা-মাসহ তাদের বাসার সিকিউরিটি আর ড্রাইভারের নাম্বার সেভ করে দিয়েছিল। যদি কখন কোন দরকার পরে তাই। পুষ্প আর দেরি না করে তারাতাড়ি নিদ্রর মাকে ফোন করলো।

🌺

রাত 1.07 বাজে। নিজেদের রুমেই ঘুমাচ্ছে মধ্যে বয়স্ক দম্পতি। হঠাৎ বেড সাইড টেবিলের উপরে রাখা ফোনটা বেজে উঠতেই তারা সজাগ হয়ে যায়। জাহানারা চোখ খুলে ফোনের দিকে তাকিয়ে বলল
– এতো রাতে আবার কে ফোন করলো।

আতিকুর চোখ বন্ধ করেই বলল
– দরে দেখ।

জাহানারা ফোনটা হাতে নিয়ে দেখে আননোউন নাম্বার থেকে ফোন করেছে। আতিকুরের দিকে তাকিয়ে বলল
– আননোউন নাম্বার।

আতিকুর স্বাভাবিক ভাবেই বলল
– দেখ তাও দরে যদি কেউ কোন দরকারে ফোন করে।

জাহানারা ফোন রিসিভ করে বলল
– আসসালামু আলাইকুম কে ব,,,,,,

জাহানারাকে কথাটা শেষ করতে না দিয়েই পুষ্প কাদতে কাদতে বলল
– আন্টি আমি পুষ্প।

অবাক হয়ে সোয়া থেকে বসে জাহানারা জিজ্ঞেস করল
– পুষ্প! কি হয়েছ মা তোমার? তুমি কাদছো কেন? বাসার সবাই ঠিক আছে তো?

জাহানারার কথাটা শুনে আতিকুরও চোখ খুলে উঠে বসে। পুষ্প কাদতে কাদতেই বলল
– আন্টি প্লিজ তাড়াতাড়ি নিদ্র ভাইয়ার রুমে যাও।

জাহানারা অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল
– নিদ্র! কি হয়েছে নিদ্রের?

পুষ্প কান্না করতে করতেই উত্তর দিল
– উনি আমার সাথে কথা বলছিন হঠাৎ কিছু পরার শব্দ হয়। আর তারপরই ফোনটা কেটে যায়। সাথে সাথে আমি ফোন করি। কিন্তু ফোন বন্ধ বল? সাত-আট বার কল দিয়েছি। বন্ধ বলছে। আন্টি প্লিজ। তাড়াতাড়ি তুমি নিদ্র ভাইয়ার রুমে যাও।

জাহানারা চিন্তিত কন্ঠে বলল
– আচ্ছা আমি দেখছি।

আতিকুর জাহানারাকে জিজ্ঞেস করল
– কি হয়েছে?

জাহানারা বিছানা থেকে নামতে নামতে আতিকুরকে বলল
– চল তাড়াতাড়ি নিদ্রর ঘরে।

বলেই জাহানারা নিদ্রর রুমে দিকে যাওয়া শুরু করে। আতিকুরও কি হয়েছে দেখার জন্য জাহানারার পিছনে পিছনে যায়। জাহানারা নিদ্রর রুমের সামনে গিয়ে নিদ্রকে ডাক দিয়ে দরজায় হালকা ধাক্কা দিতেই দরজা খুলে যায়। জাহানারা রুমে ডুকে দেখে নিদ্র ফ্লোরে পরে আছে আর পাশেই তার ফোনটা ভেঙে পরে আছে। জাহানারা নিদ্র বলে চিৎকার দিয়ে হাত থেকে ফোন ফেলে দিয়ে দৌড়ে গিয়ে নিদ্রর গায়ে হাত দিতেই বুঝল গায়ে ভীষণ জর। নিদ্রের মাথাটা তুলে নিজের কোল নিতেই দেখলো কপালের একপাশে কেটে সেখান থেকে রক্ত পরছে। জাহানারা কাদতে কাদতে ছেলেকে ডাকতে লাগলো
– নিদ্র এই নিদ্র। বাবা চোখ খোল। নিদ্র বাবা আমার চোখ খোল।

আতিকুরও দৌড়ে গিয়ে ছেলেকে দরে বুঝতে পারলো নিদ্র জরে সেন্সলেস হয়ে গেছে। মাথা বাধার জন্য আশেপাশে কিছু খুজতে গেলে টেবিলের কোনে লাগা রক্ত দেখে বুঝতে পারে সেন্সলেস হয়ে পরে যাওয়ার সময় হয়ত টেবিলের কোণ লেগে মাথাটা কেটে গিয়েছে। তারাতাড়ি করে বিছানার উপরে থাকা নিদ্রর টি-শার্ট দিয়ে ছেলের কপাল বেদে দিয়ে জাহানারাকে বলল
– চল তাড়াতাড়ি ওকে হসপিটালের নিয়ে যেতে হবে।

নিদ্রর বাবা মা নিদ্রকে উঠানোর চেস্টা করলো হসপিটাল নিয়ে যাওয়ার জন্য। কিন্তু ৫ ফুট ১১ ইঞ্চি লম্বা। সুঠাম দেহের ৩০ বছর বয়সের ছেলেকে তাদের মতো ৫০-৬০ বছরের বুড়ো-বুড়ির পক্ষে তোলা সম্ভব না। তাই নিদ্রর বাবা তাদের বাড়ির কাজের লোক কে ডেকে নিয়ে আসে। কিন্তু দুইজন মিলেও তোলতে না পারায় বাড়ির কাজের লোককে দিয়ে ড্রাইভারকে ডেকে আনায়। তিনজন মিলে নিদ্রকে গাড়িতে তুলে হসপিটালে নিয়ে যায।

এইদিকে পুষ্প ,,,,,,,

নিদ্রর মার সাথে কথা বলে ফোন কেটে দিয়ে ফোন হাতে নিয়ে কাদতে থাকে আর নিদ্রের মার ফোনের অপেক্ষা করতে থাকে। অনেকক্ষন পরও ফোন না আসলে ও আবার নিদ্রের মার ফোনে ফোন করে। কিন্তু ফোন বার বার বেজে কেটে যাচ্ছে। কেউ রিসিভ করছে না। এইভাবে ২০-২৫ বার নিদ্রের মার ফোনে ফোন করে। কিন্তু কেউ ফোন রিসিভ করে না। তাই ও সিদ্ধান্ত নেয় যে ও নিদ্রদের বাসায় যাবে। রুম থেকে বের হয়ে দরজার সামনে আসতেই ওর খেয়াল হলো এতরাতে এতদূরে ও যাবে কি করে। নিজেদের গাড়ি থাকলেও ও নিজে ড্রাইভ করতে পারে না। আর রাতে ড্রাইভার ও থাকেনা। একমাত্র আব্বুই পারবে এখন ওকে এতো দূরে নিয়ে যেতে। তাই ও গিয়ে ওর আব্বু আম্মুর রুমের দরজা ধাক্কাতে লাগলো আর তাদের ডাকতে লাগলো
– আব্বু আম্মু দরজা খুল। আব্বু। আম্মু।

মেয়ের কন্ঠ শুনে আতাউর আর সাহানা দুজনেই ঘুম থেকে উঠে যায়। আতাউর গিয়ে দরজা খুলে দেখে তার ফুলের মতো সুন্দর, হাসিখুশি, শান্ত মেয়েটা কেদে কেটে চোখমুখ ফুলিয়ে ফেলেছে। ফর্সা মুখ টকটকে লাল বর্ণ ধারণ করেছে। চুলগুলোও পাগলের মতো এলোমেলো হয়ে আছে। মেয়ের এমন বিধস্ত অবস্থা দেখে আতাউর অস্থির হয়ে জিজ্ঞেস করল
– কি হয়েছে মা? তুই কাদছিস কেন?

পুষ্প তাড়া দিয়ে বলল
– আব্বু গাড়ির চাবি নিয়ে তাড়াতাড়ী চল।

আতাউর অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল
– এতো রাতে গাড়ি নিয়ে কোথায় যাবো? আর তুই কান্না করছিস কেন মা?

পুষ্প আবারো কাদতে শুরু করল। মেয়ের কান্না দেখে সাহানা ব্যাস্ত হয়ে পুষ্পর কাছে গিয়ে তার দুই গালে দুই হাত দিয়ে জিজ্ঞেস করল
– কি হয়েছে মা? এভাবে কাদচ্ছিস কেন? আমাকে বল?

পুষ্প কাদতে কাদতেই বলল
– নিদ্র ভাইয়ার কিছু হয়েছে মা। উনি আমার সাথে ফোন করে কথা বলছিল। একটা শব্দ হয় তারপর ফোন কেটে যায়। আমি অনেকবার ফোন করেছি। কিন্তু ফোন বন্ধ বলে। পরে আন্টিকে ফোন করে সব বলি। আন্টি দেখছি বলে ফোন কেটে দেয়। আর ফোন দেয় না। আমি আন্টির ফোনে ২০-২৫ বার ফোন করেছি কিন্তু এখন আর কেউ রিসিভ করছে না। শুধু রিং হয়ে কেটে যাচ্ছে।

আতাউর মেয়েকে সান্ত্বনা দিয়ে বলল
– আমি নিদ্রর বাবাকে ফোন করে দেখছি তুই শান্ত হয় মা।

পুষ্পের বাবা নিদ্রর বাবাকে ২ বার ফোন করে। কিন্তু কেউ রিসিভ করছে না রিং হয়ে কেটে যাচ্ছে। আতাউর এবার চিন্তিত হয়ে যায়। বড় কোন বিপদ হলো নাতো তার ভাইয়ের পরিবারের? নিদ্রের দাদা আর পুষ্পের দাদা দুই ভাই। সেই হিসেবেই নিদ্রের আর পুষ্পের বাবা ভাই হয়।

আতাউর নিদ্রদের বাড়ির টেলিফোনে ফোন করে। বাসার কাজের লোক ফোন দরে জানায় নিদ্রের অনেক জর। জরে সেন্সলেস হয়ে পরে গিয়ে মাথা ফেটে গেছে। তাই তাকে নিয়ে তার মা-বাবা হসপিটালে গিয়েছে। কিন্তু কোন হসপিটালে নিয়ে গিয়েছে তা সে জানে না।

এই কথা শোনার পর পুষ্পের মাথাটা ভারি ভারি লাগতে থাকে। চোখ দুটো খুলে রাখাতে না পেরে চোখ বন্ধ করেই তার মার কোলে ডোলে পরে।

🌺

চলবে………..