পুষ্পের নিদ্র পর্ব-১০

0
278

#পুষ্পের_নিদ্র
#আনআমতা_হাসান
পর্ব : ১০

রাতের আকাশে জ্যোৎস্না ছড়াচ্ছে গোলাকৃতি শুভ্র চাঁদ। তার পাশেই আকাশ জুরে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে অল্প সংখ্যাক তারা। শহরের রাতে নিস্তব্ধতা ছেয়ে গেলেও কখনো অন্ধকারে আচ্ছনো হয় না। এখানে সূর্যের আলো নিবার আগেই রঙ বেরঙের বাতি জলে উঠে। সূর্যের আলোর বিকল্প এই লাইট। বিকল্প শব্দটা মনে আসতেই হাতে থাকা সিগারেটের দিকে তাকায় পল্লব। রিমঝিমের নেশা থেকে মুক্তি পেতে সে রিমঝিমের নেশার বিকল্প হিসেবেই এই সিগারেট এর নেশায় ডুব দিয়েছিল। আদৌও কি সে এই নেশা থেকে মুক্তি পেয়েছে? না পায়নি। পেলে হয়তো আজও রিমঝিমের জন্য ,,,,,,,,,,,,

কারো পায়ের শব্দ কানে আসতেই পিছনে ঘুরে তাকায় পল্লব। পিছনে তাকিয়ে দেখে তার পিছনে রিমঝিম। ফর্সা গায়ে কলাপাতা রঙের সেলোয়ার-কামিজ পরে তার ঠিক পিছনেই দাঁড়িয়ে আছে। রিমঝিমকে দেখে সাথে সাথেই আবার পিছনে ঘুরে যায় পল্লব। চোখ দুটো বন্ধ করে হাতের সিগারেটটায় একটা টান দেয় সে। রিমঝিম শান্ত কন্ঠে বলল
– সোহান আমাকে পছন্দ করেছে। পুষ্পের বিয়ের পরই তারা আমার বিয়ের ডেট ফিক্সড করবে।

রিমঝিমের কথা শুনতেই পল্লবের বুক দুপ করে উঠে। কিন্তু নিজের মনের অবস্থা রিমঝিমকে বুঝতে দেয় না। রিমঝিমের দিকে ঘুরে দাঁড়িয়ে মুখে নকল হাসির রেখা ফুটিয়ে বলল
– কংগ্রচুলেশন মিস রিম ,,,,,,,

পুরো কথাটা শেষ হওয়ার আগেই রিমঝিম ঠাস করে পল্লবের গালে একটা চড় মারে। পল্লব কখনো কল্পনাতেও ভাবতে পারেনি রিমঝিম তাকে চড় মারবে। গালে হাত দিয়ে অবাক চোখে রিমঝিমের দিকে তাকায় সে। রাগে কটমট করতে করতে রিমঝিম বলল
– ষোল বছর। মাএ ষোল বছরের নাবালিকা একটা মেয়ে ছিলাম। নিজের মায়ের কাহিনি জানার পরও ভরসা করে আপনাকে ভালোবেসে ছিলাম। তার কি প্রতিদান দিয়েছেন আপনি? হ্যাঁ আমি শিকার করছি। আমি শিকার আমি অন্যায় করেছি। ভুল করেছি। তার জন্য আপনার কাছে বারবার ক্ষমাও চেয়েছি। অনেক কষ্টও পেয়েছি। কিন্তু আপনি তারপরও আমাকে ক্ষমা করেননি। এতো বড়ই কি ছিল আমার ভূলটা। হয়তো ছিল তাই আপনি আমাকে এখনো ক্ষমা করতে পারেননি। আর বিয়েটা গপনে হয়েছে। কোন রেজিষ্ট্রেশন হয়নি। সামাজিক ভাবে হয়তো এটা কোন বিয়ে না। কিন্তু ইসলামের সরাইয়াত মোতাবেক আমরা স্বামী-সএী। স্বামী কথা নাকি মানতে হয়। তার কথা অমান্য করা পাপ। তাই আমিও আপনার কথা মানব। আর আপনাকে জ্বালাবো না। সোহানকে বিয়ে করে রোবট হয়ে জীবন কাটাবো। আর কখনো আপনার সামনে আসবো না। ভালো থাকবেন আর পারলে আমার মহা অন্যয়ের জন্য আমাকে ক্ষমা করেন।

কথাগুলো বলে আর এক সেকেন্ডও সেখানে দাঁড়ায় না রিমঝিম কান্না করতে করতে নিচে চলে যায়।

🌺

রাত ১০ঃ৪৫ নিজের রুমে সোফাতে বসে ল্যাপটপে কাজ করছে পল্লব। বলা ভালো নিজেকে ব্যস্ত রাখতে চেস্টা করছে। যাতে করে রিমঝিমের কথাগুলো মাথায় না ঘুরে। রুমের দরজা অর্ধেক খোলা। সেই আধখোলা দরজাটা আরো একটু খুলে দরজায় দাঁড়িয়ে পুষ্প নম্র কন্ঠে বলল
– ভাইয়া তুমি কি বিজি তোমার সাথে একটু কথা ছিল।

পল্লব ল্যাপটপ থেকে চোখ তুলে পুষ্পের দিকে তাকিয়ে হাসি মুখে বলল
– আমার বনুর জন্য আমি আলটাইম ফ্রি।

পুষ্প হাসি মুখে রুমে ডুকে দরজাটা বেজিয়ে দিয়ে গিয়ে ভাইয়ের পাশে সোফাতে বসে। পল্লব ল্যাপটপটা টেবিলে রাখতে রাখতে জিজ্ঞেস করল
– তা কি তোর ইম্পটেন্ট কথা শুনি যার জন্য এতো রাতে না ঘুমিয়ে জেগে আছিস?

পুষ্প কোন ভণিতা না করে পল্লবের দিয়ে তাকিয়ে বলল
– ভাইয়া রিমঝিমকে ক্ষমা করা দেওয়া না।

পল্লব ভ্রু কুচকে জিজ্ঞেস করল
– মানে?

– ভাইয়া আমি তোর আর রিমঝিমের ব্যাপারে সব জানি।

কথাটা শুনে পল্লব অবাক হয়ে গেল। সে কখনো ভাবিনি যে রিমঝিম তার পারমিশন ছাড়া তাদের বিয়ের কথা কাউকে বলবে। এটা নিয়ে রিমঝিমের উপর তার দৃঢ় বিশ্বাস ছিল। কিন্তু রিমঝিম আবারো তার ধারণা ভুল প্রমাণ করলো। পল্লব রেগে বলল
– এই মেয়ে এখন আমাকে মানানোর জন্য তোকে পাঠিয়েছে।

– না ভাইয়া ও বলেনি। প্রথমদিন দরজায় রিমঝিম আর তোমার একে ওপরের দিকে তাকিয়ে থাকা দেখেই বিষয়টা আমার অন্যরকম লেগেছে। তারপর সেদিন রাতে তুমি যে নিজের রুম থেকে রিমঝিমকে বের করে দিয়েছিলে তাও আমি দেখি। খাবার টেবিলেও যে তুমি রিমঝিমের রান্না খেতে চাওনা তাও আমার চোখে পরেছে। আর আজকে সন্ধ্যায় রিমঝিমকে খুজতে খুজতে আমি তোর রুমের সামনে এসে তোদের সব কথা শুনি। ভাইয়া রিমঝিম তোকে নিজের থেকেও বেশি ভালোবাসে।

পল্লব তাচ্ছিল্যের সুরে বলল
– ও আমাকে নিজের থেকেও বেশি ভালোবাসে। তাহলে কেন আমার কথা বিলিভ না করে ওই রুহির কথা বিলিভ করলো?

– ও রুহির কথা বিলিভ করেনি। রুহির কাছে প্রুভ ছিল?

– এডিট করা কিছু পিক আর ফেইক ম্যারেজ সার্টিফিকেট। এই প্রুভ গুলোই ওর কাছে সব হয়ে গেল। আর আমি যে বার বার বলেছিলাম, ‘এগুলো মিথ্যা আমাকে কিছুদিনের সময় দেও। আমি প্রমাণ করে দিব যে এগুলো মিথ্যা।’ শুনেছিল ও। শুনেনি। ভরা কেম্পাসে আমার গালে চড় মেরে বলেছিল সে আমাকে ঘৃণা করে। আমার মুখ দেখতে চায় না। সেদিন কোথায় ছিল ওর ভালোবাসা?

– ওর বাবা মার এমন কাহিনির পর ওর পক্ষে তোমার কথা বিশ্বাস করা এতো সহজ ছিল না। তাই ও ,,,,,

– আমি জানি, তাই ওকে আমাকে অন্ধের মতো বিশ্বাস করতে বলিনি। আমি শুধু ওর থেকে সময় চেয়েছিলাম।

– দেখ ভাই তখন পিক ইডিট সম্পর্কে ওর কোন ধারণা ছিল না। তার উপর কোনো মেয়ে যে নিজের চরিত্রের উপর নিজেই এমন কলংক ছড়াতে পারে তা সম্পর্কেও কোন ধারণা ছিল না। বয়সটা ছিল অল্প। চেয়েও তোমাকে বিশ্বাস করতে পারেনি তখন। কিন্তু পরে যখন নিজের ভুল বুঝতে পেরেছে তখন তোমাকে হারিয়ে ফেলেছে। মনে প্রানে ও সব সময় সবখানে তোমাকে খুজেছে। ভার্সিটি কত হ্যান্ডসাম, বিলিয়ান্ড, বড়লোকের ছেলে ওকে প্রপোজ করেছে। ওর জন্য সুইসাইড এটেম্প পর্যন্ত করেছে। কিন্তু ও কাউকে পাত্তা দেয়নি। আমি নিজে ওকে কতো বুঝিয়েছি। কিন্তু তার একটাই কথা সে ইহকাল আর পরকালে শুধুমাএ তার স্বামীর বউ হয়েই বাচতে চায়। একবার কি ক্ষমা করা যায় না? প্লিজ ভাইয়া প্লিজ। আমার রিকোয়েস্ট রাখার জন্য না হয় ওকে একটা সুযোগ দেও।

কিছুক্ষণ চুপ থেকে পল্লব আবার ল্যাপটপটা কোলের উপর নিয়ে বলল
– অনেক রাত হয়েছে ঘুমাতে যা।

পুষ্প অবাক হয়ে তার ভাইয়ের দিকে তাকায়। তার এতো কথা প্রতিউত্তরে এমন কথা সে মোটেও আশা করেনি। এখন পল্লবের সব মনোযোগ ল্যাপটপে। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বসা থেকে উঠে দরজার দিকে যেতে নিলেই পল্লব ল্যাপটপের দিকে তাকিয়েই বলল
– আর তোর বান্ধবীকে বলে দিস বউ সাজার জন্য তৈরি থাকতে।

পুষ্প তড়িৎগতিতে পিছন ফিরে ভায়ের দিকে তাকায়। পল্লব হাসি মুখে তার দিকে তাকিয়ে আছে। পুষ্প দৌড়ে গিয়ে পল্লবকে জড়িয়ে ধরে বলল
– থ্যাংক ইউ। থ্যাংক ইউ। থ্যাংক ইউ সো মাচ ভাইয়া।

🌺

ঠাসসসসস।

থাপ্পড়রের শব্দে কেপে উঠে রিমঝিম। কান্নারত চোখ তুলে সামনের দিকে তাকায় সে। গালে হাত দিয়ে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে পল্লব। তার সামনে রাগে চোখ মুখ শক্ত করে দাঁড়িয়ে আছে সাহানা। রিমঝিম বুঝতে পারলো সাহানাই পল্লবের গালে চড় মেরেছে। সকালের ব্রেকফাস্ট শেষ করার পর পল্লব সবাইকে ড্রয়িংরুমে ডাকে কিছু ইম্পটেন কথা বলবে বলে। সবাই ড্রয়িংরুমে আসলে পল্লব এসে সবার সামনে দাঁড়িয়ে বলল
– সোহানকে আমি না করে দিয়েছি। রিমঝিমের বিয়ে সোহানের সাথে হবে না।

পল্লবের কথা শুনে পুষ্প আর রিমঝিম ছাড়া বাকি সবাই অবাক হয়ে গেল। রেনু কৌতুহলি হয়ে জিজ্ঞেস করল
– কেন বাবা ছেলেটা কি খারাপ?

পল্লব উত্তর দিল
– না আন্টি ছেলেটা ভাল।

সাহানা মনে মনে ভাবে তাহিলে কি তার ছেলের রিমঝিমকে পছন্দ করে। তার জন্যই সোহানকে না করে দিয়েছে৷ মনে মনে খুব খুশি হলেও তা প্রকাশ বা করে। পল্লবকে জিজ্ঞেস করল
– তাহলে কেন না করেছিস?

পল্লব শান্ত কন্ঠে উত্তর দিল
– কারন রিমঝিম আমার বিবাহিত স্ত্রী।

আবারও পুষ্প আর রিমঝিম ছাড়া বাকি সবাই অবাক হয়ে যায়। সাহানা অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল
– তুই রিমঝিমকে বিয়ে করেছিস! কবে? কখন? আমাদের বলিসনি কেন? আর এভাবে লুকিয়ে বিয়ে করলি কেন? রিমঝিমের মতো মেয়েকে আমরা কি মেনে নিতাম না?

পল্লব নম্র কন্ঠে বলল
– আমি রিমঝিমকে এখন বিয়ে করিনি। আট বছর আগে করেছি।

রিমঝিম আর পুষ্পকে ছাড়া সবাইকে তৃতীয়বার অবাক করে। আতাউর অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল
– আট বছর আগে মানে যখন তুই রাজশাহী ছিলি? তখন তুই রিমঝিমকে বিয়ে করেছিস?

– হুম্ম।

বলেই পল্লব সবার সামনে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে তার আর রিমঝিমের প্রথম দেখা থেকে শুরু করে তার বিদেশে চলে যাওয়া পর্যন্ত সব কাহিনি বলে। সবটা শোনার পরই রাগে সাহানা গিয়ে ঠাস করে পল্লবের গালে চড় মারে। রাগে কটমট করে বলল
– বাচ্চা একটা মেয়ের সাথে তুই কিভাবে একম একটা কাজ করতে পারলি। এই শিক্ষা দিয়েছি আমি তোকে। আজ মনে হচ্ছে তোর মা হিসেবে আমি ব্যর্থ।

পল্লব মাথা তুলে আসহায় কন্ঠে বলল
– মা আমি ,,,,,

পল্লবকে আর বলতে না দিয়ে সাহানা বলল
– চুপ একটা কথাও বলবিনা তুই।

রেনু একটা দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলে বলল
– আমি সারাজীবন নিজের মেয়েকে নিয়ে গর্ব করেছি। সেই মেয়ে এমন একটা কাজ কিভাবে করলো।

সাহানা রেনুকে উদ্দেশ্য করে বলল
– রিমঝিমের কোন দোষ নেই। ওতো বাচ্চা মেয়ে ছিল।

রেনু রিমঝিমের উপর রাগ দেখিয়ে সাহানাকে বলল
– ভাবতে পারো যদি পল্লবের যায়গাতে কোন খারাপ ছেলে হতো। তাহলে কি হতো। ছেলে তোমার সোনার টুকরো। ছেলেটাকে শুধু শুধু বকছো কেন? ওতো আর জোড় করে কিছু করেনি। রিমঝিমের ইচ্ছাতেই আর দোষেই সব হয়েছে।

রিমঝিমের পক্ষ নিয়ে সাহানা বলল
– ওই রিমঝিমের মতো ভালো মেয়ের মাথায় এসব ডুকিয়েছে।

পুষ্প সাহানাকে বলল
– থাকনা মা। যা হয়েছে তা নিয়ে কথা না বলে তুমি ভাইয়া আর রিমঝিমের বিয়ের ডেটা ফিক্সড করো।

পুষ্পের কথার সুর টেনে আতাউরও বলল
– হ্যাঁ যা হবার হয়ে গেছে এখন বউমাকে বাসায় উঠানোর ব্যাবস্থা করো।

সাহানা রিমঝিমের দিকে তাকিয়ে বলল
– রিমঝিম মা এদিকে এসো।

রিমঝিম আস্তে করে উঠে সাহানার সামিনে গিয়ে মাথা নিচু করে দাঁড়ায়। সাহানা রিমঝিমের দুই গালে হাত দিয়ে হাতের বুড়ো আঙুল দিয়ে চোখের পানি মুছে কপালে একটা চুমু একে দেয়। তারপর রেনুর দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল
– রেনু তুমি রাজি থাকলে আমি একমেয়ের বিদায়ের দিনই অরেক মেয়েকে ঘরে তুলতে চাই। আমি আমার মেয়ের বিয়ের দিনই আমার ছেলের বউকে বাড়িতে উঠাতে চাই।

রুবিনা খুশি হয়ে বলল
– তুমি যেদিন চাও সেদিনই তোমার বউমাকে ঘরে তোল।

সাহানা নিজের হাতের সোনার চুরি জোড়া খুলে রিমঝিমের হাতে পরিয়ে দেয়। রিমঝিমের চোখ দিয়ে আবার নোনা জল পরতে থাকে। তবে এবারেরটা কষ্টের না সুখের নোনা জল।

🌺

চলবে………..